বাংলা সাহিত্যে ‘যাবনী ’ শব্দ : ইন্দ্রনীল সান্যাল

বাংলা ভাষায় আরবি ফার্সি শব্দ


“অতএব করি ভাষা যাবনী মিশাল” , লিখেছিলেন আজ থেকে প্রায় ২৭০ বছর আগে কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র। যাবনী, অর্থাৎ যবনদের ভাষা বা আরবি ফার্সি ভাষা কেন তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্যে মিশিয়েছিলেন সেকথা ব্যাখ্যা করতে গিয়েই ভারতচন্দ্র এমনটি বলেছেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সুকুমার সেনের মতো বিদগ্ধ ভাষাতাত্বিকদের মতে বাংলা ভাষায় কমবেশি আড়াই হাজারের মতো আরবি ফার্সি শব্দ আছে। বাংলায় দীর্ঘ ৫০০ বছরের মুসলমান শাসনকালে এই শব্দগুলি ধীরে ধীরে বাংলার শব্দভাণ্ডারে প্রবেশ করে। কালক্রমে এরা চেয়ার টেবিলের মতো একপ্রকার বাংলা শব্দই হয়ে গেছে। আরবি ছিল কোরানের অর্থাৎ ইসলাম ধর্মপ্রচারের ভাষা এবং ফার্সি ছিল সেইসময়ে সরকারী ভাষা। ফলে পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার সভ্যতা সংস্কৃতির প্রভাব বাংলায় পড়েছিল। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে আমাদের জমিজমা ও আইন আদালত সংক্রান্ত অধিকাংশ শব্দই আরবি ফার্সি। পরে কিছু ইংরেজি শব্দ এসেছে। সর্বভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমান শাসনের কেন্দ্র দিল্লিতে ছিল বলে হিন্দি ভাষায় আরবি ফার্সি শব্দের ব্যবহার অনেক বেশি। তবে শুধু মুখের ভাষাতেই নয়, বাংলা কাব্যেও বেশ কিছু স্বল্পপ্রচলিত আরবি ফার্সি শব্দের বারংবার ব্যবহার করেছেন মধ্যযুগের বিখ্যাত কবিরা যেমন মুকুন্দরাম, কৃষ্ণদাস কবিরাজ বা ভারতচন্দ্র। ইংরেজ আমলে ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা সাহিত্যের যে নবজাগরণ ঘটে মধুসূদন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে, সেখানে আরবি ফার্সি শব্দের ব্যবহার বিশেষ দেখা যায়না। বিংশ শতাব্দীর কুড়ির দশকে বাংলা সাহিত্যের আকাশে নজরুল ইসলামের উদয় হয় রীতিমতো সাড়া জাগিয়ে। এক অনবদ্য ভঙ্গিতে নজরুল তাঁর কবিতায় বহু আরবি ফার্সি শব্দ ব্যবহার করেছেন ; এতে তাঁর কবিতার শক্তি ও মাধুর্য বেড়েছে বই কমেনি। নজরুলের এই ভাষা অবশ্য সবাই মেনে নেননি। রক্ত অর্থে খুন ব্যবহার নিয়ে ১৯২৭ সাল নাগাদ রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মধ্যে বিতর্ক প্রায় মনোমালিন্যের রূপ নিয়েছিল। বাংলা সাহিত্যে ‘যাবনী ’ শব্দ নিয়ে আলোচনার আগে আমরা এই দুই মহান কবির মধ্যে ঠিক কিরকম বিতর্ক হয়েছিল তা খানিকটা দেখে নেব।


‘বঙ্গসাহিত্যে খুনের মামলা’


প্রেসিডেন্সি কলেজে রবীন্দ্র-পরিষদের অভ্যর্থনার উত্তরে রবীন্দ্রনাথ অতি আধুনিক বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে একটি বক্তৃতা প্রদান করেন। পরে এটি ৪ঠা পৌষ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের সাপ্তাহিক ‘বাংলার কথা’য় ছাপাও হয়। এই ভাষণে রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষায় অনাবশ্যক ভাবে আরবি ও ফার্সি শব্দ ব্যবহারের বিরোধিতা করেন, বিশেষ করে নজরুলের কবিতায় রক্তের বদলে খুন ব্যবহার কবিগুরু মেনে নিতে পারেন নি। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ পরে অধ্যাপক আবুল ফজল, এম এ আজম ও আলতাফ চৌধুরীকে লেখা তিনটি চিঠিতে একই রকম মত ব্যক্ত করেছেন। এর মধ্যে একটি চিঠি প্রবাসী, বৈশাখ ১৩৪১ সংখ্যায় ‘মক্তব-মাদ্রাসার বাংলা’ নামে প্রকাশিত হয়।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বাংলা ভাষায় সহজেই হাজার হাজার পারসী আরবী শব্দ চলে গেছে। তার মধ্যে আড়াআড়ি বা কৃত্রিম জেদের কোনো লক্ষণ নেই। কিন্তু যে-সব পারসী আরবী শব্দ সাধারণ্যে অপ্রচলিত অথবা হয়তো কোনো-এক শ্রেণীর মধ্যেই বদ্ধ, তাকে বাংলা ভাষার মধ্যে প্রক্ষেপ করাকে জবরদস্তি বলতেই হবে। হত্যা অর্থে খুন ব্যবহার করলে সেটা বেখাপ হয় না, বাংলায় সর্বজনের ভাষায় সেটা বেমালুম চলে গেছে। কিন্তু রক্ত অর্থে খুন চলে নি, তা নিয়ে তর্ক করা নিষ্ফল।“
কবিগুরু আরও লিখেছেন,“আজকাল সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিকে আশ্রয় করে ভাষা ও সাহিত্যকে বিকৃত করবার যে চেষ্টা চলছে তার মতো বর্বরতা আর হতে পারে না। এ যেন ভাইয়ের উপর রাগ করে পারিবারিক বাস্তুঘরে আগুন লাগানো। সমাজের ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে নিষ্ঠুর বিরুদ্ধতা অন্যান্য দেশের ইতিহাসে দেখেছি কিন্তু আজ পর্যন্ত নিজের দেশ-ভাষাকে পীড়িত করবার উদ্যোগ কোনো সভ্য দেশে দেখা যায় নি। এমনতর নির্মম অন্ধতা বাংলা প্রদেশেই এত বড়ো স্পর্ধার সঙ্গে আজ দেখা দিয়েছে বলে আমি লজ্জা বোধ করি। বাংলা দেশের মুসলমানকে যদি বাঙালি বলে গণ্য না করতুম তবে সাহিত্যিক এই অদ্ভুত কদাচার সম্বন্ধে তাঁদের কঠিন নিন্দা ঘোষণা করে সান্ত্বনা পেতে পারতুম। কিন্তু জগতের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশ-প্রসূত এই মূঢ়তার গ্লানি নিজে স্বীকার না ক’রে উপায় কি ?”
এংলো-ইন্ডিয়ানদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে রবীন্দ্রনাথ বলেন , “আমাদের গণশ্রেণীর মধ্যে য়ুরেশীয়েরাও গণ্য। তাঁদের মধ্যে বাংলা লেখায় যদি কেউ প্রবৃত্ত হন এবং বাবা মা শব্দের বদলে পাপা মামা ব্যবহার করতে চান এবং তর্ক করেন ঘরে আমরা ঐ কথাই ব্যবহার করে থাকি তবে সে তর্ককে কি যুক্তিসংগত বলব? অথচ তাঁদেরকেও অর্থাৎ বাঙালি য়ুরেশীয়কে আমরা দূরে রাখা অন্যায় বোধ করি। খুশি হব তাঁরা বাংলা ব্যবহার করলে কিন্তু সেটা যদি য়ুরেশীয় বাংলা হয়ে ওঠে তা হলে ধিক্কার দেব নিজের ভাগ্যকে। আমাদের ঝগড়া আজ যদি ভাষার মধ্যে প্রবেশ করে সাহিত্যে উচ্ছৃঙ্খলতার কারণ হয়ে ওঠে তবে এর অভিসম্পাত আমাদের সভ্যতার মূলে আঘাত করবে।“
তবে রবীন্দ্রনাথ যে বাংলায় আরবি ফার্সি শব্দ ব্যবহারের বিরোধী ছিলেন তা নয়। তিনি লিখেছেন, “বস্তুত বাংলা ভাষা যে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই আপন তার স্বাভাবিক প্রমাণ ভাষার মধ্যে প্রচুর রয়েছে। যত বড়ো নিষ্ঠাবান হিন্দুই হোক-না কেন ঘোরতর রাগারাগির দিনেও প্রতিদিনের ব্যবহারে রাশি রাশি তৎসম ও তদ্ভব মুসলমানী শব্দ ব্যবহার করতে তাদের কোনো সংকোচ বোধ হয় না।এমন-কি সে সকল শব্দের জায়গায় যদি সংস্কৃত প্রতিশব্দ চালানো যায় তাহলে পণ্ডিতী করা হচ্ছে বলে লোকে হাসবে। বাজারে এসে সহস্র টাকার নোট ভাঙানোর চেয়ে হাজার টাকার নোট ভাঙানো সহজ। সমনজারি শব্দের অর্ধেক অংশ ইংরেজি, অর্ধেক পারসী, এর জায়গায় ‘আহ্বান প্রচার’ সাধু সাহিত্যেও ব্যবহার করার মতো সাহস কোনো বিদ্যাভূষণেরও হবে না।“
শব্দ প্রয়োগে মুসলমানি জীবন প্রতিফলিত হওয়ার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের আপত্তি ছিলনা, আবুল ফজলকে লেখা চিঠিতে তিনি বলেছিলেন, ‘শক্তিমান মুসলমান লেখকরা বাংলা সাহিত্যে মুসলমান জীবন-যাত্রার বর্ণনা যথেষ্ট পরিমানে করেননি, এ অভাব সম্প্রদায় নির্বিশেষে সমস্ত সাহিত্যের অভাব। এই জীবন যাত্রার যথোচিত পরিচয় আমাদের জন্য অত্যাবশ্যক। এই পরিচয় দেবার উপলক্ষ্যে মুসলমান সমাজের নিত্য ব্যবহার্য শব্দ যদি ভাষায় স্বতই প্রবেশ লাভ করে তবে সাহিত্যের ক্ষতি হবে না, বরং বল বৃদ্ধি হবে, বাংলা ভাষার অভিব্যক্তির ইতিহাসে তার প্রমাণ আছে।’ কিন্তু জোর করে ভাষার শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের ঘোর আপত্তি ছিল। তার মতে ‘শিশুপাঠ্য বাংলা কেতাবে গায়ের জোরে আরবীফারসীআনা করাটাকেই আচারনিষ্ঠ মুসলমান যদি সাধুতা বলে জ্ঞান করেন তবে ইংরেজি স্কুলপাঠ্যের ভাষাকেও মাঝে মাঝে পারসী বা আরবী ছিটিয়ে শোধন না করেন কেন?’
নজরুল জানতেন যে এই আপত্তি শুধু বিশ্বকবির নয় , আরো অনেকের , যদিও মোহিতলাল মজুমদার ও অজিত চক্রবর্তীর মতো কবি নজরুলের এই স্টাইলটির প্রশংসা করেছেন। নজরুল এক জায়গায় মজা করে লিখেছেন ” আমপাড়া পড়া , হামবড়া মোরা , চলেছি সবার ভাত মেরে / হিন্দুরা ভাবে পার্শী শব্দে কবিতা লেখে ও পাত-নেড়ে।” কিন্তু বিশ্বকবির এই সমালোচনায় নজরুল যথেষ্ট ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। জবাবে তিনি ‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধ’ ( আত্মশক্তি, ডিসেম্বর ৩০, ১৯২৭ ) প্রবন্ধটি রচনা করে রবীন্দ্রনাথকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘এই আরবী ফারসী শব্দ প্রয়োগ কেবল আমিই করিনি। আমার বহু আগে ভারতচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ প্রভৃতি করে গেছেন।….. খুন আমি ব্যবহার করি আমার কবিতায়, মুসলমানী বা বলশেভিকী রং দেওয়ার জন্য নয়।’ নজরুলের আরো একটি যুক্তি ছিল, তিনি মনে করতেন “বিশ্ব কাব্যলক্ষীর একটি মুসলমানী ঢং আছে। ও সাজে তার শ্রীর হানি হয়েছে বলেও আমার জানা নেই। ……আজকের কাব্যলক্ষ্মীর অর্ধেক অলংকারই তো মুসলমানী ঢঙের। বাইরের এ ফর্মের প্রয়োজন ও সৌকুমার্য সকল শিল্পীই স্বীকার করবেন। পণ্ডিত মালবীয়া স্বীকার না করতে পারেন, রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ করবেন।“ নজরুল লিখেছেন “কবিগুরু কেন, আজকালকার অনেক সাহিত্যিকই ভুলে যান যে বাংলার কাব্যলক্ষ্মীর ভক্ত অর্ধেক মুসলমান।“ নজরুল মনে করেছেন , রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রচিত ‘উদিবে যে রবি আমাদেরই খুনে রাঙিয়া পুনর্বার’ গানটিই হয়তো তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নজরুল বলেছেন, এখানে খুনের বদলে রক্ত ব্যবহার করলে কবিতার শক্তি অর্ধেক কমে যেতো। নজরুলের কবিতার জন্য কথাটি সর্বৈব সত্য। খুন এবং খুনের মতো কিছু শব্দ নজরুলের কবিতাকে আলাদা বৈশিষ্ট্য দান করেছে।
নজরুলের লেখার জবাবে প্রমথ চৌধুরী ( বীরবল ) আত্মশক্তিতে ‘বঙ্গসাহিত্যে খুনের মামলা’ নামে একটি প্রবদ্ধ লেখেন । অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ এ লেখায় প্রমথ চৌধুরী বলেন, “আরবি ফার্সি শব্দ যদি ত্যাগ করতে হয় তাহলে আমাদের সর্বাগ্রে ‘কলম’ ছাড়তে হয়। কারণ ও-শব্দটি কেবল আরবি নয়, এমন অনির্বচনীয় আরবি যে ও-শব্দ হা কণ্ঠমূল থেকে হা করে উদগিরণ করতে হয়। ও ‘ক’ কিন্তু হিন্দু জবানে বেরয় না এক কাশি ছাড়া।“ প্রমথ চৌধুরীও রক্ত অর্থে খুন প্রয়োগের পক্ষে রায় না দিলেও বলেছেন, “যদি খুন বাদ দিতে হয় তাহলে reason-এর খাতিরে rhyme-কে তালাক দিতে হয়। আর কে না জানে reason-এর খাতিরে rhyme-এর সাত খুন মাপ।“
এই বিতর্কের প্রায় আড়াই দশক বাদে এরকম আরেকটি বিতর্ক তৈরী হয়েছিল সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও মুহম্মদ শহীদুল্লাহের মধ্যে। কুমিল্লার সাহিত্য সভায় প্রদত্ত ভাষণে সুনীতিকুমারের অভিযোগের জবাব শহীদুল্লাহ দিয়েছিলেন ‘সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা‘ নামে একটি প্রবন্ধ লিখে যা পরে মৈত্রেয়ী দেবী সম্পাদিত ‘পূর্ব বাঙলার প্রবন্ধ সংগ্রহ ‘ নামে সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়। আমরা অবশ্য এসব বিতর্কে না গিয়ে দেখে নেব যে মধ্যযুগের বাংলায় হিন্দু মুসলমান কবিরা কতটা আরবি ফার্সি শব্দভাণ্ডার ব্যবহার করেছেন।


মধ্যযুগের হিন্দু কবিদের রচনায় আরবি-ফার্সি শব্দ


বাংলায় ইসলাম ধৰ্ম প্রসারের সাথে সাথে বাংলা ভাষায় আরবি-ফার্সি শব্দ ঢুকতে শুরু করে। ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত বইতে জানিয়েছেন যে বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে আটটি আরবি এবং ফার্সি শব্দ পাওয়া গেছে। লেখক তাঁর পুস্তকে এই তালিকা দিয়েছেন : কামাণ, খরমুজা, বাকী, মজুর, মজুরিয়া, গুলাল, লেম্বু ও আফার । তবে কামাণ শব্দটি খুব আশ্চর্যের, কারণ ভারতবর্ষে প্রথম কামাণ ব্যবহৃত হয় ১৫২৬ সনে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে। তবে লেখক জানিয়েছেন যে কামাণ শব্দটি ধনুক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে আর আফার শব্দটির অর্থ প্রচুর। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের ভাষা বিচারে মনে করা হয় যে এটি খ্রিষ্টীয় ১৩৫০-১৪০০ সনের মধ্যে লিখিত। অর্থাৎ এই সময়ে বাংলায় তুর্কি-পাঠান শাসন প্রায় ১৫০ বছর ধরে চলছে। ১৯০৯ সালে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ মহাশয় বাঁকুড়ার এক গ্রাম থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের এযাবৎ কাল পর্যন্ত পাওয়া একমাত্র পুঁথিটি আবিষ্কার করেন। কাব্যগ্রন্থটির রচনাকাল নিয়ে সন্দেহ না থাকলেও পুঁথিটি কবে লিখিত তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে দ্বিমত আছে। কারও কারও মত অনুযায়ী যদি পুঁথিটি ১৭ দশ শতকে লিপিকৃত হয়ে থাকে তাহলে বিদেশী শব্দগুলি প্রক্ষিপ্ত হতে পারে। যেহেতু পুঁথিটি বারবার নকল হয়েছে এমন কোন প্রমাণ নেই , তাই আরবি-ফার্সি শব্দগুলি লিপিকার দ্বারা প্রক্ষিপ্ত বলে মনে হয়না। ফার্সির প্রভাব সমাজে এতো বেশি ছিল যে বড়ু চণ্ডীদাসের মত ব্রাহ্মণের লেখনীও আরবি-ফার্সির প্রভাব এড়াতে পারেনি।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কথা বাদ দিলে মধ্যযুগের যে কবির লেখায় প্রথম নিশ্চিত ভাবে আরবি ও ফার্সি শব্দ পাওয়া যায় তিনি হলেন ১৫শ শতকের শেষ দিকের কবি মনসাবিজয় রচয়িতা বিপ্রদাস পিপলাই। তিনি লিখছেন:
কাজী মজলিস করি
কিতাব কোরান ধরি … ইত্যাদি।
বিপ্রদাসই প্রথম ফার্সি বাংলা যুগ্মশব্দ (খতগুলা) ব্যবহার করেন।
এবার দেখা যাক মধ্যযুগের দুজন বিখ্যাত কবির রচনা। কৃষ্ণদাস কবিরাজ ছিলেন ভক্ত বৈষ্ণব, বয়সে তিনি শ্রী চৈতন্যের চেয়ে কিছুটা ছোট। ১৫৩৩ সনে শ্রী চৈতন্যের মৃত্যুর কিছু পরে কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্যের সবচেয়ে প্রামাণ্য জীবনীগ্রন্থ চৈতন্য-চরিতামৃত রচনা করেন। সেখানে কবিরাজ মহাশয় লিখছেন যে ধর্মপ্রচারে বাধা পড়ায় চৈতন্য ক্রূদ্ধ হয়ে দলবল নিয়ে কাজীর বাড়ি ঘেরাও করলে কাজী তাঁকে শান্ত করার জন্য চৈতন্যের মাতামহের সাথে সম্পর্কের প্রসঙ্গ এনে বলেন :
গ্রাম সম্বন্ধে চক্রবর্তী হয় মোর চাচা ৷
দেহ সম্বন্ধ হৈতে হয় প্রায় সম্বন্ধ সাঁচা II
নীলাম্বর চক্রবর্তী হয় তোমার নানা I
সে সম্বন্ধে হও তুমি আমার ভাগিনা II

লক্ষ্য করার বিষয় এই যে মুসলমান কাজীর সঠিক চরিত্রচিত্রণ করতে গিয়ে কবিরাজ মহাশয় তাঁর মুখে চাচা ও নানা শব্দদুটি বসিয়েছেন। এগুলি আদতে হিন্দি শব্দ হলেও বাস্তবে ছিল বাঙালি মুসলমানের কথ্য ভাষার শব্দকোষের অন্তর্গত ; বাঙালি হিন্দুদের বচনে এসব শব্দ ছিল অনুপস্থিত। তাসত্ত্বেও চৈতন্য চরিতামৃতের মতো ঈশ্বরপ্রতিম মহাপুরুষের জীবনীগ্রন্থেও তথাকথিত মুসলমানি শব্দগুলিকে স্থান দিতে কবিরাজ মহাশয় দ্বিধা করেননি।
মধ্যযুগের আরেকজন অতিবিখ্যাত কবি হলেন চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের রচয়িতা কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। মুকুন্দরামের এই চণ্ডীমঙ্গল রচিত হয় ১৬শ শতাব্দীতে। (সম্ভবতঃ ১৬শ শতাব্দীর শেষের দিকেই , কারণ মোগল শব্দটি পাওয়া যাচ্ছে আর ১৫৭৬ সালের আগে বাংলা মোগলদের সংস্পর্শে আসেনি। ) অধ্যাপক সুকুমার সেন মুকুন্দরামকে মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি বলেছেন। চণ্ডীমঙ্গলে কালকেতুর গুজরাট নগরীতে মুসলমান প্রজাদের বর্ণনা দিতে গিয়ে চক্রবর্তী মহাশয় কী লিখেছেন দেখা যাক :
আইসে চড়িয়া তাজি / সৈয়দ মোগল কাজী/খয়রাতে বীর দেয় বাড়ী I
পুরের পশ্চিম পটী / বোলয় হাসন হাঢী/ এক সমুদয় গৃহবাড়ী।।
ফজর সময় উঠি / বিছায়্যা লোহিত পাটী/ পাচ বেরি করয়ে নামাজ ৷
ছিলি মিলি মালা ধরে/ জপে পীর পেগাম্বরে/ পীরের মোকামে দেই সাঁজ।।
দশ বিশ রেরাদরে/ বসিয়া বিচার করে/ অনুদিন কিতাব ও কোরাণ।।
সাঁজে ডালা দেই হাটে/ পীরের শিরণী বাঁটে/ সাঁজে বাজে দগড় নিশান।।
বড়ই দানেশবন্দ/ কাহাকে না করে ছন্দ/ প্রাণ গেলে রোজা নাহি ছাড়ি ।
ধরয়ে কাম্বুজ বেশ / মাথে নাহি রাখে কেশ/ বুক আচ্ছাদিয়া রাখে দাড়ি।।
বসিল অনেক মিয়া/ আপন তরফ লৈয়া/ কেহ নিকা কেহ করে বিয়া।
মোল্লা পড়ায়্যা নিকা / দান পায় সিকা সিকা/ দোয়া করে কলমা পড়িয়া।।
করে ধরি খর ছুরি/ কুকড়া জবাই করি/ দশ গণ্ডা দান পায় কড়ি।
বকরি জবাই যথা/ মোল্লারে দেই মাথা/ দান পায় কড়ি ছয় ঘুড়ি।।
যত শিশু মুসলমান/ তুলিল মক্তব খান/ মখদুম পড়ায় পঠনা।
রচিয়া ত্রিপদী ছন্দ / পাচালি করিল বন্ধ/ গুজরাট পুরের বর্ণনা ।।
দেখা যাচ্ছে যে এর প্রায় এক তৃতীয়াংশই আরবি ও ফার্সি শব্দ ! !
মধ্যযুগের শেষ বিখ্যাত কবি রায় গুণাকর ভারতচন্দ্র তাঁর অন্নদামঙ্গল-এ (১৮শ শতাব্দী) বাদশা ও মানসিংহের কথোপকথন প্রসঙ্গে লিখেছেন:
পাতশা কহেন শুন মানসিংহ রায়।/গজব করিলা তুমি আজব কথায়।।
লস্করে দু’তিন লাখ আদমী তোমার ।/ হাতী ঘোড়া উট গাধা খচর যে আর।।
এ সকলে ঝড় বৃষ্টি হৈতে বাঁচাইয়া।/ বামন খোরাক দিল অন্নদা পূজিয়া।।
সয়তান দির দাগা ভূতের পূজায়।/ আলো চাউল বেড়ে কলা ভুলাইয়া খায়।।
আমারে মালুম খুব হিন্দুর ধরম।/ কহি যদি ইিন্দুপতি পইিবে সরম।।
শয়তানে বাজি দিল না পেয়ে কোরাণ।/ ঝুটমুট পড়ি মরে আগম পুরাণ।।
গোঁসাই মর্দ্দের মুখে হাত বুলাইয়া।/ আপনার নুর দিলা দাড়ী গোঁপ দিয়া।।
হেন দাড়ী বামন মুড়ায় কি বিচারে।/ কি বুঝিয়া দাড়ী গোঁপ সাঁই দিল তারে।।
আর দেখ পাঠা পাঠী না করি জবাই।/ উভচোটে কাটে বলে খাইল গোঁসাই।।
হালাল না করি করে নাহক হালাক।/ যত কাম করে হিন্দু সকলি নাপাক।।
ভাতের কি কব পান পানির আয়েব।/ কাজী নাহি মানে পেগাম্বরের নায়েব।।
বন্দেগী করিবে বন্দা জমিনে ঝুকিয়া।/ করিম দিয়াছে মাথা করম করিয়া ।।
মিছা ফান্দে পড়ে হিন্দু তাহা না বুঝিয়া।/ যারে তারে সেবা দেয় ভূমে মাথা দিয়া ।।
যতেক বামন মিছা পুথি বানাইয়া।/ কাফের করিল লোকে কোফর পড়িয়া।।
দেবী বলে দেয় মিছে ঘড়ায় সিন্দুর।/ হায় হায় আখের কি হইবে হিন্দুর।।
বাঙালিরে কত ভাল পশ্চিমার ঘরে।/ পান পানি খানা পিনা আয়েব না করে।।
দাড়ী রাখে বাঁদী রাখে আর জবে খায়।/ কান ফোঁড়ে টিকি রাখে এই মাত্র দায়।।’
ভারতচন্দ্র সংস্কৃত ও ফার্সি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন ; তিনি কেন আরবি ও ফার্সি মিশ্রিত ভাষা লিখেছেন তার ব্যাখ্যাও দিয়ে গেছেন:
মানসিংহ পাতশায় হইল যে বাণী। /উচিত সে আরবী পারসী হিন্দুস্তানী।।
পড়িয়াছি সেই মত বর্ণিবারে পারি। / কিন্তু সে সকল লোকে বুঝিবারে ভারি।।
না রবে প্রসাদগুণ না হবে রসাল।/ অতএব করি ভাষা যাবনী মিশাল।।
এমনকি সাধক রামপ্রসাদ-ও বাদ যান নি। একটি শ্যামাসংগীতে তিনি গেয়েছেন:
জানিলাম বিষয় বড় শ্যামা মায়েরই দরবারে রে।
সদা ফুকারি ফরেদি বাদি নাহয় সঞ্চার রে।
আরজবেগি যার শিরে দরবারের ভাষা কিরে মাগো।
ও মা দেওয়ান দেওয়ানা নিজে আস্থা কি কথার রে।
লাখ উকিল করেছি খাড়া সাধ্য কি ইহার বাড়া মা গো।।
দেখা যাচ্ছে যে মধ্যযুগের হিন্দু কবিরা অবলীলাক্রমে যাবনী বা আরবি-ফার্সি – তুর্কি শব্দের সুপ্রয়োগ করেছেন। মধ্যযুগের গোড়ার দিকে বাংলা সাহিত্যের ভাষা সংস্কৃতানুসারী থাকলেও ষোড়শ শতক থেকেই মূলতঃ মুঘলদের প্রভাবে আরবি, ফার্সি, ও হিন্দি শব্দ বাংলায় স্থায়ী জায়গা করে নিতে থাকে, ঠিক যেরকম নরমান (Norman) শাসনকালে বহু ফরাসী (French) শব্দ ইংরেজি ভাষায় প্রবেশ করে। মনে রাখতে হবে যে মধ্যযুগে ফার্সি ভাষা ধর্মের সাথে যুক্ত ছিলনা, ছিল শাসনব্যবস্থার সাথে; ফলে হিন্দু বিদ্বানরা বা রাজকার্যে নিযুক্ত হিন্দুরাও ফার্সি শিখতেন। হিন্দু ব্রাহ্মণরাও মধ্যযুগে ফার্সি শিখতেন। ১৬শ শতকে চৈতন্য জীবনীকার জয়ানন্দ তাঁর চৈতন্যমঙ্গলে লিখেছেন ” ব্রাহ্মণে রাখিবে দাড়ি পারস্য পঢ়িবে”। রাজা রামমোহন ফার্সি ভাষায় ধর্মপুস্তক লিখেছেন , মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ফার্সি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন, আবার কথিত আছে যে আচার্য যদুনাথ সরকারের মত ফার্সি অনেক মৌলবীও জানতেন না।


মধ্যযুগে মুসলমান রচিত বাংলা সাহিত্যের ভাষা


পাল রাজাদের সময়ে বাংলা ভাষা শাসকের আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলেও সেন যুগে তা বন্ধ হয়ে যায়। পাল যুগে সন্ধ্যাকর নন্দী বা সেনযুগে জয়দেব, ধোয়ী , উমাপতি, শরণ, শ্রীধর বা হলায়ুধ মিশ্রের মতো সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত সাহিত্যিকেরা উৎকৃষ্ট মানের সাহিত্য রচনা করলেও সংস্কৃত না জানা বাংলার সাধারণ মানুষ সে রস পানে বঞ্চিত ছিলেন। সেন যুগে চর্যাগান রচয়িতা সিদ্ধাচার্যগণও পুঁথিপত্র নিয়ে দেশত্যাগী হয়েছিলেন। বাংলা ভাষার এই চরম সংকটের দিনে বাংলার মুসলমান সুলতানরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চাকে উৎসাহ প্রদান ও সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে শুধু যে বাঙালির সাহিত্যরস পিপাসা মিটিয়েছিলেন তাই নয় , আধুনিক ভারতীয় আর্য ভাষাগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ও সবথেকে উৎকৃষ্ট ও সমৃদ্ধ সাহিত্যের অধিকারী বাংলা ভাষাকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করে স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। গৌড়ের সুলতানদের হাতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নবজন্ম লাভ করেছিল। আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন মন্তব্য করেছেন, ‘মুসলমান সম্রাটগণ বর্তমান বঙ্গ- সাহিত্যের এইরূপ জন্মদাতা বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। … বঙ্গ সাহিত্য মুসলমানদেরই সৃষ্ট, বঙ্গভাষা বাঙ্গালী মুসলমানের মাতৃভাষা।’
কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেকেই মনে করতে পারেন যে মধ্যযুগে মুসলমান কবি সাহিত্যিকরা বোধহয় আরবি-ফার্সি মিশ্রিত বাংলা লিখতেন। কিন্তু বাস্তব হলো এই যে প্রায় সমস্ত বিখ্যাত মুসলমান কবি, শাহ মুহাম্মদ সগীর, জৈনুদ্দিন থেকে শুরু করে দৌলত কাজী, সৈয়দ আলাওল, সৈয়দ সুলতান, আব্দুল হাকিম সকলেই সাধু রীতিতে বিশুদ্ধ সংস্কৃতানুসারী বাংলায় কাব্য রচনা করেছেন।
সুলতান শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহের আমলের (১৪৭৪-৮১ খ্রিস্টাব্দ) শক্তিশালী কবি জৈনুদ্দীন মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের অনুসরণে রসূল বিজয় কাব্য রচনা করেন। এই কাব্যে মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বর্ণনার প্রভাব বেশ স্পষ্ট তবে এতে এর কাব্যগুণের হানি হয়নি:
সারি সারি শ্বেতচ্ছত্রধ্বজ সুশোভন।/ নির্ভয় চলন্ত যুদ্ধে যথাএ সৈন্যগণ।।
সৈন্যপদধূলী উঠি ছাইল গগন। / দিক অন্ধকার হইল না দেখি তপন।।
রসূলের সঙ্গে বীর্য্যবন্ত অশ্ববার। / বিক্রমে কেশরী তুল্য তেত্রিশ হাজার।।
সারি সারি মত্তকরী গলে মুক্তা ধার।/ মারুত সাদৃশ সব বিজুলি সঞ্চার।।
হস্তীগলে বাজে ঘন্টি শুনিতে সুস্বর।/ চলন্ত পর্বত যেন মূর্তি ভয়ঙ্কর।।
বিবিধ সাজন অশ্ব দেখিতে সুন্দর।/ গরুড়ের গতি সব অতি মনোহর।।
মহা মহা মল্ল সব সিংহনাদ করে।/ এথ দেখি এরাকের পৃথিম্বি বিদরে।।
সহস্র সহস্র বীর নাচে গদা ধরি।/ যুদ্ধ মাঝে চলে হেন যেন মত্তকরী।।
পদাতিক পদধূলি ঢাকিল আকাশ।/ দিনে অন্ধকার নাহি রবির প্রকাশ।।
গজে গজে যুদ্ধ হইল দন্তে পেশাপেশি।/ অশ্বে অশ্বে যুদ্ধ হইল দুই মিশামিশি।।
ধানুকি ধানুকি যুদ্ধ অস্ত্র বরিষণ।/ বরিষার মেঘে যেন বরিষে সঘন।।
অস্ত্রজালে ভরি গেল গগন মণ্ডল।/ বীরের গর্জনে ভূমি করে টলমল।।
দৌলত উজির বাহরাম খানের লাইলী-মজনু রচিত আনুমানিক ১৫৩৫-৫৩ খ্রিস্টাব্দে। কবি লায়লীর বিরহযন্ত্রণার বিবরণ দিয়েছেন এইভাবে:
লায়লী কমলমুখী সখীগণ সঙ্গে।
শিবিরেতে গমন করিলা মনোরঙ্গে।।
বিচ্ছেদ হইল যদি প্রাণনাথ সনে।
দরশন উপায় চিন্তএ মনে মনে।।
সখীগণ সঙ্গ তেজি গমন মন্থরে।
কণ্টক ফুটিলা ছলে রহিলা অন্তরে।।
প্রাণনাথ সনে ধনি করিলা দর্শন।
মৃতবৎ কায়া যেন লভিল জীবন।।
শাহ বারিদ খান তাঁর বিদ্যাসুন্দর কাব্যে রাজকুমারী বিদ্যার রূপ-গুণের বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে:
অয় রাজসূত মোর শুন নিবেদন।/ উজানী নগরপতি পুত্রী সংকথন।।
অবলা রতনা বিধুমুখী বিদ্যা নাম।/ অভ্যাসিয়া সর্বশাস্ত্র বিদগ্ধ উপাম।।
শাস্ত্রেত পরাগ অতি জানে সর্বকলা।/ সুচরিতা রূপযুতা কুমারী অবলা।।
সত্য কৈলা রাজকন্যা বিদগ্ধ সতী।/শাস্ত্রবাদে জিনে যেই সেই তার পতি ।।
মধ্যযুগের অন্তিম পর্বে মুঘল সাম্রাজ্যের সীমানার বাইরে বাংলার সীমান্তবর্তী স্বাধীন ও অর্ধস্বাধীন রাজাদের রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য চর্চা হয়। উত্তরবঙ্গের কোচ রাজবংশের কামতা-কামরূপের রাজসভা, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গের ত্রিপুরা ও আরাকানের (রোসাঙ্গ) রাজসভা এবং পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলের মল্লভূম-ধলভূমের রাজসভায় বাংলা ভাষায় বিবিধ কাব্যধারার সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে আরাকানী ধারা এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে । ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে গৌড়ের করদ রাজ্যে পরিণত হওয়ার পর থেকে প্রায় দুশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আরাকানের বৌদ্ধ রাজারা (যাঁরা জাতিতে ছিলেন মগ) বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতিদ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। এই সময়কালে আরাকান রাজসভার বাঙালি ও মগ মুসলমান অমাত্য ও সভাসদদের উৎসাহে বাংলা ভাষার প্রথম মানবীয় প্রণয়কাব্য রচিত হয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাই আরাকান রাজসভার নাম সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। আরাকান রাজসভায় যাঁরা প্রথম কাব্যচর্চা শুরু করেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন চট্টগ্রামের কবি দৌলত কাজী (১৬০০-১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি আরাকানের রাজসভার কাজির পদেও নিযুক্ত ছিলেন। তাঁর রচিত প্রধান কাব্যগ্রন্থ হল সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী । এর মূল কাহিনী আওধী ভাষায় উত্তর ভারতে প্রচলিত ছিল আর বিষয়বস্তু হলো মানব মানবীর প্রেমোপাখ্যান। দৌলত কাজীর সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী থেকে কিছুটা এখানে উদ্ধৃত করছি। লক্ষ্য করে দেখুন , আরবি, ফার্সি বা তথাকথিত মুসলমানি বাংলা, যেমন জলের বদলে পানি , তার নামমাত্রও নেই:
রাখিতে পারনা ভার্যা রতি রস ছলে।
পৃথিবী পালিবা কোন বীর্য বুদ্ধি বলে।।
……..
মহতের ভার্যা প্রাণ সম দুই অন্তর।
প্রেম ভাবে গৌরী অঙ্গ প্রতক্ষ্য শংকর।।
ভার্যা হেতু পঞ্চভাই প্রবেশিল বনে।
জগৎ মাধুরী ভার্যা পুরুষ কারণে।।
ভার্যা বিনে পাটেত না শোভে নরপতি।
স্ত্রী বিনে পুরুষের কোথাতে বসতি।।
মৎস্য যেন জিয়ে সুখে সুশীতল জলে।
সুপুরুষ পুলকিত সুকামিনী কোলে।।

দৌলত কাজী তাঁর কাব্যের তৃতীয় পর্বে ‘রোসাঙ্গের রাজার প্রশস্তি’ শীর্ষক রাজার বন্দনা রচনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে রাজা থিরি থু ধম্মার ( শ্রী সুধর্মার ) উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে কবি দৌলত কাজী লিখেছেনঃ
কর্ণফুলী নদী পূর্বে আছে এক পুরী।/রোসাঙ্গ নগরী নাম স্বর্গ-অবতরী ॥
তাহাতে মগধ বংশ ক্রমে বুদ্ধাচার।/ নাম শ্রীসুধর্মা রাজা ধর্ম অবতার ॥
প্রতাপে প্রভাত ভানু বিখ্যাত ভুবন।/ পুত্রের সমান করে প্রজার পালন ॥
দেবগুরু পুজএ ধর্মেত তার মন।/ সে পদ দর্শনে হএ পাপের মোচন ॥
পূণ্য ফলে দেখে যদি রাজার বদন।/ নীরকিহ স্বর্গ পাএ সাফল্য জীবন ॥

রাজার প্রশস্তির পাশাপাশি লস্কর উজীর আশরাফ খানের প্রশস্তিও গেয়েছেন এইভাবে:
শ্রী আশরফ খান / ধর্মশীল গুণবান/মুসলমান সবার প্রদীপ।
সে রসুল-পরসাদে / গুরুজন আশীর্বাদে/রাজসখা হউক চিরঞ্জীব ॥

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি সৈয়দ আলাওল। ১৬০৭ খ্রীষ্টাব্দে বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার ফতেহাবাদ পরগনায় আলাওলের জন্ম হয়। কিন্তু তাঁর কর্মজীবন, সাহিত্যিক জীবনের সাধনা সবই আবর্তিত হয় আরাকান রাজসভাকে কেন্দ্র করে। আলাওল তাঁর বিখ্যাত পদ্মাবতী কাব্যের আত্মকথা পর্বে লিখেছেন :
মুল্লুক ফতেয়াবাদ গৌড়েতে প্রধান।
তথাতে জালালপুর অতিপূণ্য স্থান ॥
পদ্মাবতী কাব্যটি প্রেমমূলক ঐতিহাসিক কাব্য হলেও এতে প্রেমের স্বরূপই প্রধান্য পেয়েছে, ইতিহাস নয়। কবি পদ্মাবতীর রূপ বর্ণনা শুরু করেছেন এইভাবে :
পদ্মাবতী রূপ কি কহিব মহারাজ।/ তুলনা দিবারে নাহি ত্রিভুবন মাঝ।।
আপাদ লম্বিত কেশ কস্তুরী সৌরভ।/ মহা অন্ধকারময় দৃষ্টি পরাভব ।।
অলি পিক ভুজঙ্গ চামর জলধর।/ শ্যামতা সৌষ্ঠব কেহ নহে সমসর ।।
ত্রিগুণ সঞ্চারে বেণী ভুবনমোহন।/ এক গুণে ডংসিতে পারয় ত্রিভুবন ।।
বিরাজিত কুসুম গুঁথিত মুক্তাহার।/ সজল জলদ মধ্যে তারকা সঞ্চার ।।
আবার পদ্মাবতীর রূপ বর্ণনার আরেক জায়গায় কবি লিখছেন :
প্রভারুণ বর্ণ-আখি সুচারু নির্মল।/ লাজে ভেল জলান্তরে পদ্ম নীলোৎপল ॥
কাননে কুরঙ্গ জলে সফরী লুকিত।/ খঞ্জন গঞ্জন নেত্র অঞ্জন রঞ্জিত ॥
আঁখিত পুত্তলি শোভে রক্ত স্বেতান্তর।/ তুলিতে কমল রসে নিচল ভ্রমর ॥
কিঞ্চিত লুকিত মাত্র উথলে তরঙ্গ।/ অপাঙ্গে ইঙ্গিতে হএ মুনিমন ভঙ্গ ॥
কোথায় যাবনী শব্দ ? আলাওলকে তো গুপ্তযুগের সংস্কৃতজ্ঞ কবি বলেই ভুল করা সম্ভব!
আসলে পৃথিবীর কোনো দেশেই কোনো অনারবীয় মুসলমান জনগোষ্ঠী নিজের মাতৃভাষা বিসর্জন দিয়ে আরবিকে মুখের বা সাহিত্যের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেননি। তাই সপ্তদশ শতকের কবি মুক্তালিব লিখেছেন :
আরবীতে সকলে না বুঝে ভালো মন্দ।
তে কারণে দেশী ভাষে রচিলুঁ প্রবন্ধ।।
মুসলমানি শাস্ত্রকথা বাঙ্গালা করিলুঁ।
বহু পাপ হৈল মোর নিশ্চয় জানিলুঁ ।।
বাংলায় ইসলাম ধর্মের শিক্ষা আরবি ভাষাতেই শুরু হয়েছিল এবং এর অন্যথা কেউ চিন্তাও করতে পারতো না। ষোড়শ শতকের শেষ দিকে অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে যা হয়েছিল, সৈয়দ সুলতানের রচনাতেই তার পরিচয় বিধৃত: নবীবংশ প্রসঙ্গে কবি বলেছেন-
কতদেশে কতভাষে কোরানের কথা ৷/ দ্বীন মোহাম্মদী বুঝি দেয়স্থ ব্যবস্থা ৷ ৷
কর্মদোষে বঙ্গেত বাঙ্গালী উৎপন্ন ৷/ না বুঝে বাঙ্গালী সবে আরবী বচন ৷ ৷
আপন দ্বীনের বোল এক না বুঝিল ৷/ পশুর চরিত্র হই সে সব রহিল ৷ ৷
সদায় পড়য় রামকৃষ্ণের কথা ৷/ শুনিয়া আমার মনে লাগে অতি ব্যথা ৷ ৷
ফারসী ভাষে কোরানের বাখান শুনিল ৷ / যত খোরাশানী সবে ঈমান আনিল ৷ ৷
জাওয়া (জাভা) সব জাওয়া ভাবে আরবী বচন ৷/ কিতাবের কথা যত কৈল উদ্ধারণ ৷ ৷
রুমী সবে রুম ভাষে কোরানের কথা ৷/ লোক সবে লিখি লই করেন্ত ব্যবস্থা ৷ ৷
তুর্কীস্থানে তুর্কীভাষে লোক আপনার ৷/ কোরানের কথা সব লিক্ষি লইল্যা সার ৷ ৷
সামী সবে সামী ভাষে কোরানের মর্ম ৷/ শুনিয়া করিতে আছে মুসলমানী কর্ম ৷ ৷
পাঠান সকলে পোস্ত ভাষে আপনার ৷/ কোরানের কথা শুনি বুঝিল আচার ৷ ৷
এত ভাবি নবীবংশ পাচালি রচিলু ৷/ বোঝে হেন মত করি যা কিছু কহিলু ৷ ৷
আবার কবি আব্দুল হাকিমের (১৬২০-৯০ খ্রিস্টাব্দ) রচনায় বাংলা ভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা ধরা পড়েছে:
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশে ন যায়।।


দোভাষী পুঁথি ও পুঁথি সাহিত্য


তবে অষ্টাদশ শতকে আরবি-ফার্সি মিশ্রিত দোভাষী রীতিতে বাংলা লেখার একটি ধারা গড়ে ওঠে মূলতঃ পশ্চিমবাংলার হুগলী থেকে উড়িষ্যার বালেশ্বর অঞ্চলে ও কিছুটা উত্তরবঙ্গে। এই ধারার প্রধান লেখকদের মধ্যে আছেন ফকির গরীবুল্লাহ, হায়াৎ মামুদ, সৈয়দ হামজা, জামালউদ্দীন, বুরহানুদ্দীন, শান্তিপুরের মোজাম্মেল হক প্রমুখ। অনেক হিন্দুও দোভাষী রীতিতে কাব্য রচনা করেছেন। এদের মধ্যে বিখ্যাত ‘এমাম হোসেনের কেচ্ছা’ র লেখক রাধারমণ গোপ। এমনকি ভারতচন্দ্রের রচনায়ও এর প্রভাব দেখা যায়। পরবর্তীকালে বটতলার ছাপাখানাগুলি থেকে মুদ্রিত হয়ে এরা বটতলার পুঁথি নামে পরিচিত হয়। তাই একে অনেকে পুঁথি সাহিত্যও বলে থাকেন।
১৬শ শতকে মুগল আমলে দিল্লির সঙ্গে বাংলার প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগসূত্র স্থাপিত হলে এ দেশে অবাঙালি মুসলমানদের যাতায়াত বৃদ্ধি পায়। এই উর্দুভাষী মুসলিম পরিবারগুলি মুর্শিদাবাদ, হুগলি, ঢাকা প্রভৃতি প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্রে বসবাস করতে থাকেন । ফলে ওই সময় বাংলা ভাষায় উর্দু-হিন্দির ব্যাপক প্রভাব পড়ে।
১৮শ শতকে বাংলার এরকম ভাষা-পরিস্থিতি লক্ষ্য করে হ্যালহেড তাঁর বাংলা ব্যাকরণে বলেন যে, বাংলা ক্রিয়ার সঙ্গে সর্বোচ্চ সংখ্যক আরবি-ফারসি বিশেষ্য মিশ্রিত করে যাঁরা কথা বলেন, তাঁরাই সুচারুরূপে বাংলা জানেন বলে গণ্য করা হয়। এ শতকের দলিল-দস্তাবেজে এরকম ভাষারই প্রাধান্য। ১৭৭৮ সনে প্রকাশিত হ্যালহেড সাহেবের বাংলা ব্যাকরণ থেকে তৎকালীন বাংলার একটি উদাহরণ দিচ্ছি :
“শ্রীরাম। গরিব নেওয়াজ শেলামত। আমার জমিদারি পরগণে কাকজোল তাহার দুই গ্রাম দরিয়া শীকিস্তি হইয়াছে সেই দুই গ্রাম পয়স্তী হইয়াছে চাকালে একবেরপুরের শ্রী হরেকৃষ্ট রায়চৌধুরী আজ জবরদস্তী দখল করিয়া ভোগ করিতেছে। আমি মাল গুজারির শরবরাহতে মারা পড়িতেছি উমেদওয়ার জে শরকার হইতে আমিও এক চোপদার শরোজমিনেতে পহুছিয়া তোরফেনকে তলব দিয়া আদালত করিয়া হক দেলাইয়া দেন। ইতি সন ১১৮৫ তারিখ ১১ শ্রাবণ । ফিদবি জগধাদিপ রায়।“
সুকুমার সেন একে হিন্দু-মুসলমানের ‘কাজের ভাষা’ বা ‘ব্যবহারিক বাংলা’ বলে অভিহিত করেছেন। ভারতচন্দ্র একেই ‘যাবনী মিশাল’ ভাষা বলেছেন। আরবি-ফারসি-হিন্দুস্থানি মিশ্রিত এরকম ভাষাই সবাই বুঝত বলে তিনি দাবি করেছেন। দফ্তরের ভাষা হিসেবে ছিল ফার্সি। ইউরোপীয় বণিক কোম্পানির লোকেরাও এ ভাষা শিখত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে ক্ষমতা দখলের পর প্রায় আশি বছর অর্থাৎ ১৮৩৫ সন পর্যন্ত ফার্সি ভাষাতেই রাজকার্য চালিয়েছে।
১৭৪০ থেকে ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অজস্র দোভাষী পুঁথি রচিত হয়েছে ও পরবর্তী কালে বটতলা থেকে মুদ্রিত হয়েছে। রেভারেন্ড জেমস লং “এ ডেসক্রিপ্টিভ ক্যাটালগ অব বেঙ্গলি ওয়ার্কস্” (১৮৫৫) গ্রন্থে ৪১টি দোভাষী পুঁথির তালিকা দিয়েছেন। মুহম্মদ মনসুরুদ্দিন, আহমদ শরীফ, আলী আহমদ বা আনিসুজ্জামানের মত পণ্ডিতরা ২০০ থেকে ৫৫০ পুঁথির কথা বলেছেন। কেউবা এই সংখ্যা চার হাজার পর্যন্ত ঠেলে নিয়ে গেছেন। এথেকে পুনরাবৃত্তি বাদ দিয়ে শতাধিক কবির প্রায় ৪০০ কাব্যের নাম পাওয়া যায়।
দোভাষী ধারার প্রধান কবি ছিলেন ফকির গরীবুল্লাহ। ১৮শ শতকের গোড়ার দিকে হুগলি জেলার ভুরশুট পরগনায় তাঁর জন্ম হয়। উল্লেখ্য যে, ভারতচন্দ্র ও গরীবুল্লাহ একই অঞ্চলের (ভুরশুট পরগনার) অধিবাসী ছিলেন। তাঁদের আবির্ভাবকালও প্রায় সমসাময়িক। ফকির গরীবুল্লাহর ইউসুফ-জোলেখা থেকে নীচের কটি লাইন উদ্ধৃত করা হলো :
পূর্ণিমার চন্দ্র যেন মুখের ছুরাত।
ত্রিভূবন জিনে দেখি রূপের মুরাত।
ময়ূরের পর জিনে কেনা মাথা পরে।
রাহু যেন গ্রাসিল আসিয়া চাঁদেরে।
ত্রিভঙ্গ নয়ন যেন খঞ্জরের আঁখি।
ভুবন ভুলাতে নারে সেই রূপ দেখি।
দুইখানি ঠোঁট যেন কমলের ফুল।
তাহার বদন যেন চাঁদ সমতুল।
বত্রিশ দন্ত দেখি যেন মুক্তার হার।
বিদ্যায় পণ্ডিত যেন সরস্বতী পার।
এই ধারার দ্বিতীয় বিখ্যাত কবি সৈয়দ হামজা (আনু: ১৭৩০-১৮০৭ খ্রিস্টাব্দ) হুগলি জেলার ভুরসুট পরগনার উদনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ফকির গরীবুল্লাহর অনুসারী হিসেবে পুঁথিসাহিত্যের ধারায় তাঁর আবির্ভাব। তাঁর পুঁথিগুলির নাম মধুমালতী, আমির হামজা, হাতেম তাঈ এবং জৈগুনের পুঁথি। মধুমালতী ছাড়া অন্য কাব্যগুলি সরাসরি-ফার্সি মিশ্রিত দোভাষীতে রচিত। হাতেম তাঈ কাব্য তাঁর শেষ জীবনের রচনা। তাতে তিনি কৈফিয়ত দিয়েছেন এ ভাষায়:
কেচ্ছা মধুমালতীর জঙ্গনামা আমিরের
জৈগুন পুঁথি লিখেছিনু আগে।
আল্লাতালা ভাল করে যাহার খায়েশ পরে
হাতেম লিখিমু শেষভাগে।
‘আমীর হামজা কাব্য রচনার উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে সৈয়দ হামজা লিখেছেনঃ
লোগের খায়েশ দেখি ভাবি মনে মনে।
আখেরি শায়েরি পুঁথি হইবে কেমনে॥
না পারিনু এড়াইতে লোকের নেহেরা।
এ খাতেরে কবিতার খাহেশ হৈল মেরা॥
পীর শাহা গরীবুল্লা কবিতার গুরু।
আলমে উজালা যার কবিতার শুরু॥
আমার শায়েরি নয় কেতাব সমান।
কেবল বুঝিবে লোগ কেচ্ছার বয়ান॥
১৭৯৭ সালে রচিত সৈয়দ হামজার অপর কাব্য ‘জৈগুনের পুঁথি। এ কাব্যে বিবি জৈগুনের ঘোষিত একটি সিদ্ধান্ত নিম্নরূপঃ
জৈগুন নামে বাদশাজাদী এরেম সহরে।
কারার করেছে বিবি বাপের হুজুরে॥
মহিমে যে কেহ মোরে পাছাড়িবে জোরে।
সাদী বেহা কবুল করিব আমি তারে॥
আমার মহিমে যদি হারে পাহালওয়ান।
করিবে খেদমতগারি হইয়া গোলাম॥
সৈয়দ হামজার পুঁথির ভাষা ফকির গরিবুল্লাহের চেয়ে অনেক বেশি দোভাষী। শুধু আরবি ফার্সি বিশেষ্যই নয়, সৈয়দ হামজা আরবি ফার্সি ক্রিয়াপদ এমনকি বাগ্ধারাও প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করেছেন।
দোভাষী রীতিতে সাহিত্য রচনার প্রেরণা ঠিক কী ছিল তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। অনেকে মনে করেন যে এই আরবি ফার্সি মিশ্রিত বাংলাই ছিল বাঙালি মুসলমানের মুখের ভাষা। ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছেন যে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার মুসলমানের ভাগ্য বিপর্যয় না ঘটলে পুঁথি সাহিত্যের ভাষাই হয়তো হতো বাংলার হিন্দু মুসলমানের ভাষা। আবার সৈয়দ আলী আহসান বা আনিসুজ্জামানের মতো পণ্ডিতেরা একথা মানতে চাননি। তাঁদের মতে অবাঙালি সৈন্য, ছোট ভ্রাম্যমান ব্যবসায়ী প্রমুখের মনোরঞ্জনের জন্যই দোভাষী সাহিত্যের জন্ম। কাব্যের বিষয়বস্তু দেখলেই সেটা বোঝা যায়। যাইহোক, ১৯ শতকের গোড়ার দিকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের ও শ্রীরামপুরের মিশনারিদের হাতে সংস্কৃত তৎসম শব্দ বহুল আধুনিক বাংলা সাহিত্যের জন্ম হলে দোভাষী ধারাটি ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়।

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে যাবনী শব্দ


ঊনবিংশ শতকে বাংলা সাহিত্যের যে নবজাগরণ ঘটে, বাঙালি মুসলমান কবি সাহিত্যিকরা তাতে সেভাবে অংশ নিতে পারেননি। ইংরেজের কাছে রাজনৈতিক পরাজয়ের গ্লানি মুসলমান সমাজ তখনও মুছে ফেলতে পারেনি। এর থেকে তৈরী হলো ওয়াহাবী বা ফরায়জী আন্দোলনের মতো কতগুলি পশ্চাৎমুখী আন্দোলন। এমনকি বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কি তা নিয়েও তৈরী হলো দ্বিধা দ্বন্দ্ব। মাইকেল মধুসূদনের বন্ধু ফরিদপুরের নবাব আব্দুল লতিফ বাংলায় মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের প্রচেষ্টার জন্য বিখ্যাত। কিন্তু তিনিও মনে করতেন যে বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা উর্দু, তবে চাষাভুষারা বাংলায় কথা বলে। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে দুজন বিখ্যাত মুসলমান সাহিত্যিক, অশ্রুমালা রচয়িতা কায়কোবাদ এবং বিষাদসিন্ধু রচয়িতা মীর মোশাররফ হোসেন কিন্তু আরবি ফার্সি বর্জিত বাংলায় লিখেছেন। মীর মোশাররফ হোসেন এমনকি রোজার বদলে উপবাস এবং নামাজের বদলে প্রার্থনা লিখেছেন , সম্ভবত সেটাই ছিল সেই সময়কার দস্তুর। এর কিছু পরেই রংপুরের কবি শেখ ফজলুল করিম (১৮৮২-১৯৩৬) লিখেছেন ‘ কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে তাহা বহুদূর …….’, যা আজ বাংলা প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছে। নজরুল পরবর্তী প্রখ্যাত বাঙালি কবিরা যেমন জীবনানন্দ দাস, সুধীন দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, জসিমুদ্দিন বা প্রেমেন্দ্র মিত্র কেউই আরবি ফার্সি শব্দের ব্যবহার তেমন করেননি। সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রম এঁদের থেকে বয়সে কিছুটা ছোট তথাকথিত ‘ইসলামী ধারার কবি’ ফররুখ আহমদ।
আরেকজনের কথা না বললে এ কাহিনী সম্পূর্ণ হবেনা। তিনি কবি গোলাম মোস্তফা , ইসলামী রেনেসাঁর কবি হিসেবে পরিচিত। যশোর জেলার ঝিনাইদহে ১৮৯৭ সালে জন্ম, উচ্চশিক্ষা কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজে, বিভিন্ন সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন,পরে বালিগঞ্জ গভমেন্ট হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হয়েছিলেন। রবীন্দ্র-ভক্ত ও রবীন্দ্র-স্নেহধন্য হয়েও রাজনীতিতে মুসলিম লীগের সমর্থক ছিলেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করে নিন্দিত হয়েছিলেন। এহেন কবির রচিত ‘কিশোর’ কবিতাটি দেখে নেওয়া যাক:
আমরা নূতন, আমরা কুঁড়ি, নিখিল বন-নন্দনে,
ওষ্ঠে রাঙা হাসির রেখা, জীবন জাগে স্পন্দনে।
লক্ষ আশা অন্তরে
ঘুমিয়ে আছে মন্তরে
ঘুমিয়ে আছে বুকের ভাষা পাঁপড়ি-পাতার বন্ধনে।
সাগর-জলে পাল তুলে দে’ কেউ বা হবো নিরুদ্দেশ,
কলম্বাসের মতই বা কেউ পৌঁছে যাবো নূতন দেশ।
জানবে সাড়া বিশ্বময়
এই বাঙালি নিঃস্ব নয়,
জ্ঞান-গরিমা শক্তি সাহস আজও এদের হয়নি শেষ।
কেউ বা হবো সেনানায়ক গড়বো নূতন সৈন্যদল,
সত্য-ন্যায়ের অস্ত্র ধরি, নাই বা থাকুক অন্য বল।
দেশমাতাকে পূজবো গো,
ব্যথীর ব্যথা বুঝবো গো,
ধন্য হবে দেশের মাটি, ধন্য হবে অন্নজল।
ভবিষ্যতের লক্ষ আশা মোদের মাঝে সন্তরে,
ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।
আকাশ-আলোর আমরা সুত,
নূতন বাণীর অগ্রদূত,
কতই কি যে করবো মোরা-নাইকো তার অন্ত-রে।…
অবিভক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার পক্ষে জোরদার সওয়াল করেছেন এমন কবির কবিতায় আরবি ফার্সি নেই, দেশমাতাকে বন্দনার কথা আছে সর্বোপরি এই কবিতার একটি লাইন (ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে) তো বাংলা প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছে !
ভারতচন্দ্র, নজরুল ও মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সঠিক প্রমাণিত হলেন :যাবনী শব্দ ব্যবহারের সাথে সাম্প্রদায়িকতার কোনো সম্পর্ক নেই, এটি নিতান্তই একটি স্টাইল। ভুল প্রমাণিত হলেন রবীন্দ্রনাথ ও সুনীতিকুমার।

_______________________________________________________________________________________


তথ্যসূত্র:
দীনেশ চন্দ্র সেন: বঙ্গ ভাষা ও সাহিত্য , ১ম খন্ড, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, ১৮৯৬
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়: দ্য অরিজিন এন্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস, কলকাতা, ১৯২৬
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ : বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০১৪
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ :সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা, পূর্ব বাঙলার প্রবন্ধ সংগ্রহ, মৈত্রেয়ী দেবী সম্পাদিত, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিষদ, কলকাতা, ১৯৬০
সুকুমার সেন :মধ্যযুগের বাংলা ও বাঙালী, বিশ্বভারতী, কলকাতা, ১৩৫২ বঙ্গাব্দ
সুকুমার সেন: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, ১ম খণ্ড, মডার্ন বুক এজেন্সী, কলকাতা, ১৯৪০
সুকুমার সেন: ইসলামি বাংলা সাহিত্য, আনন্দ, কলকাতা, ২০১৬
অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় : বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত, মডার্ন বুক এজেন্সী, কলকাতা, ১৩৬৭ বঙ্গাব্দ
আহমদ শরীফ: মধ্যযুগের কাব্য সংগ্রহ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৩৬৯ বঙ্গাব্দ
আহমদ শরীফ: সৈয়দ সুলতান- তাঁর গ্রন্থাবলী ও তাঁর যুগ, আহমদ শরীফ রচনাবলী, ২য় খন্ড, আহমদ কবির সম্পাদিত, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৬
মুহম্মদ আব্দুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান: বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত: আধুনিক যুগ, আহমদ পাবলিশিং হাউস, ঢাকা, ২০১০
আনিসুজ্জামান: মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য, চারুলিপি, ঢাকা, ২০১২
অরুণ কুমার বিশ্বাস: দ্য মুসলিম কমিউনিটি রেসপন্স টু দ্য সাইন্টিফিক আওয়েকনিং ইন দ্য নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ হিস্ট্রি অফ সাইন্স, ৪৮.২ (২০১৩), পৃ ২১৯-২৩৮
কাজী দীন মুহম্মদ: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, ২য় খন্ড, স্টূডেন্ট ওযেজ , ঢাকা , ১৯৬৮
মুহাম্মদ আবু তালিব: বাংলা কাব্যে ইসলামী রেনেসাঁ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, ১৯৮৪
মুহাম্মদ আবু তালিব:আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ভাষা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, ১৯৮৭
সুলতান আহমেদ ভূইয়াঁ: প্রাচীন মুসলিম বাংলা সাহিত্য, সোসাইটি ফর পাকিস্তান স্টাডিজ , ঢাকা, ১৯৭০
গোলাম মুরশিদ : হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, অবসর প্রকাশনা, ঢাকা, ২০১৬
মাহবুবুল আলম: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি, ঢাকা, ২০১৬
মাহবুবুল আলম: বাংলা সাহিত্যের নানান দিক, খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি, ঢাকা, ১৯৮৭
সৈয়দ আলী আশরাফ: মুসলিম ট্রাডিশন্স ইন বেঙ্গলি লিটারেচার, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, ১৯৮৩
আমীনুর রহমান: বাংলা সাহিত্য (বাংলাপিডিয়া থেকে)
ওয়াকিল আহমদ: পুথি সাহিত্য (বাংলাপিডিয়া থেকে)
রফিকুল ইসলাম ও সলিমুল্লাহ খান: সঠিক বাংলা বেঠিক বাংলা, ঢাকার ডিবিসি চ্যানেলের রাজকাহন অনুষ্ঠানে প্রচারিত, ২১ ফেব্রূয়ারি, ২০১৭

{লেখক – Director, NE Zone, National Council of Science Museums (Ministry of Culture, Govt. of India), Sector V, Block GN, Salt Lake, Kolkata 700091]

Facebook Comments

Leave a Reply