কুঁজ : দেবার্ঘ্য গোস্বামী

আগল চুরমার মুষল স্রোতে – পাইন গাছের নীচে নেতান ঢেকিয়ার গায়ে হঠাত খুব বিষম লাগে। খানিক হাবুডুবু খায়। পাতা-ডাঁটি আপোষে ভেসে যেতে চায় জমাট ভাঙ্গা হাঁফে। শিকড়ে টান লাগে। গায়ের ভিতরে ফোঁটা ফোঁটা জমে পাথর হওয়া টনটনানি, হলুদ হয়ে গলে গড়ায় খাদের নীচের অন্ধকারে। আঃ! গলার গত্তে ভয়ের আর কোন গুঁড়া নাই। মাথার রগে রাগের বেলুনের দাপানি নাই। খিদা নাই। বিরক্তি নাই। যেটুকু ব্যথা, বিষ, হাঁকপাঁক না থাকলে শরীর আছে বলেও টের পাওয়া যায় না, সে সবও ফোঁটা ফোঁটা গড়িয়ে চলে খাদের নীচের অন্ধকারে। ভুটিয়া বস্তি রোড ডাইনে রেখে, পূবে উঠে যাওয়া চোরা বাটোর পাইন জঙ্গলের আড়ালে মুততে মুততে খুব স্বস্তি পাচ্ছিল হাছান হক। ………শুধু কোমরের কাছের একটা সুরসুরানি …… নাকি ঝিম ধরা একটা ধারাল ব্যথা……….এ খুব পুরান ব্যথা। এর বয়স তার থেকে বছর ১০ /১২ কম হবে বা।
ওঃ ! এটা কুপ্রো ডারা না! কুপ্রো……
মোতা শুরুর সময় ভর পেট উগরানি নিয়ে খেয়াল করা হয়নি। মুতের তোড় সরু হয়ে আসলে প্রথমে নাকে আসে তিতো পাতির গন্ধ। চোখ তুলে উপরে তাকালে জঙ্গলের ভিতর, পাহার ফোঁড় বেমক্কা পাথর খান চোখে আসে। তার নাকের ডগায় সিঁদুর মাখা। আতপ চাল।
কুপ্রো ডারা।
পাথরের নীচে কুপ্রো থাকেন। কুপ্রো ঘরে ফিরতে চান। কুপ্রো ঘরে ফিরতে পারেন না। তাই রাস্তা দিয়ে যেই যায় তার ঘাড়ে চাপেন কুপ্রো। কুঁজো হয়ে যায় সে। কোমর আর কিছুতেই সোজা হয় না। নিজের পায়ের পাতায় সিলাই হয়ে যায় নিজের চোখ। কোমরের কাছে একটা সুরসুরানি……না! কুপ্রো টুপ্রো হয় না। কুপ্রো বলে কিছু নাই…… এত তার পুরান ব্যথা……

দুই কান লেপে দেওয়া ঝিঁঝিঁর ডাক থেবড়ে দেয় বেশ কয়েক জোড়া পায়ের দাপাদাপি। যে অন্ধকারে গড়াতে গড়াতে পাইনের শিকড়ে খাবি খাচ্ছে মুত – তার কিছু নীচে লেটকে থাকা ভুটিয়া বস্তি রোডে এক দলা ঠাঁটানি জমা হচ্ছে। চমকে সোজা হতে চায় হাছান হক। মুতের সরু ধারা চটকে খানিক জুতায় পড়ে। কোমর সোজা করে পিছে ফিরতে চায়।
কোমর কি আটকাল নাকি! টান ধরল কি?
সোজা হবে?
এই রাত বিরাতে চেওয়াং এর পুড়কি তে এ রাস্তায় আসা এক্কেবারে ঠিক হয় নাই। লোভ।পুলিশ ব্যারাকের ক্যান্টিনে স্কোয়াশের তরকারির একটা লালচা হলুদ রং আছে। ভাতের সাদায় সে রং খেই হারায় ফেলে। যতই মাখ সাদার গায়ে আঁচড় টুক লাগবে না। কিন্তু যদি বাল কাপড়ে পড়ে ত এক হপ্তা রং উঠবে না। সাথে বয়লারের ঝোল আর ডল্লের আচার। পর পর পাঁচ দিন হওয়ার পর, আজ বিকালে চেওয়াং ব্যারাকের সাত ফুট বাই আট ফুট খুপরিতে নিজের খাটের ঠ্যাং এ গাম বুটের গদাম লাথ মেরে মহাকাল বাবার নামে শপথ করে বলে, যে মরে গেলেও আজকে রাতে শালার বাড়িতে গিয়ে গাই কো মাসু দিয়ে রাই কো শাগ খাবেই খাবে।
ব্যারাকের এই খুপরির যে দেওয়ালে চেওয়াং এর খাট তার উল্টা দেওয়ালে হাছানের। গত একবছর হল দার্জিলিং এ। দেড় মাস হল সদরে। এই দেড় মাসের স্ট্রাইক আর গন্ডগোলে দুই কানের উপর দিয়ে গোল হয়ে কাইলা দাগ পড়ে গেছে। হেলমেটের। রাতে বালিশে ঘষা লাগলে ছাল উঠে যায় সে দাগ ধরে। একটা বাঁশের লাঠি আর এই হেলমেটে নেপালি মব সামলান! লাঠি চার্জের অর্ডার পেলে নিজের বিচি শুকায় যায়! আর গুলি চলল কি একটা লাশ পড়ল মানে সে রাতে দুইটা থানা জ্বলবে। দোয়া কর নিজের টা না জ্বলে। থান ইট, কাঁচের বোতল , খুকরি, কেরোসিন বোম, সিঙ্গল শাটার বাদ দেও শালাদের গায়ের জোরেই পারা যায় না। দুই আঙ্গুলের চাপে গলার নালি উপড়ায় এনে দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলার গল্প শোনা যায় ক্যাম্পে। ছিয়াশিতে মরা অনেক পুলিশের গায়ে নাকি কোন বুলেট ইনজুরি বা স্ট্যাব উন্ড ছিল না। ছেড়া ফাটা গলা মুখে গলগল রক্ত বের করে নাকি মরে গেছে। এমন গল্পে, শরীরের কোণে পুরান কম্বলের মতন পড়ে থাকা আঠাল ভয় – রোদ পেয়ে ঠাঁটিয়ে তোলে লাখ লাখ রোঁয়া। ট্রান্সফারের দু মাসের মাথায় এ এস আই ব্যানার্জি সাহেবের কাছে শোনার পর থেকে সন্ধ্যার পর একা একা বাইরে বার হতে সাহস হয় না। এমন সময় রাত বিরাতে … শালার ব্যাটাগুলা আবার মুখ চিনা রাখে। গত বুধবারের লাঠি চার্জে তাদের মারে এই গাঁওয়ের কাউন্সিলারের ব্যাটার মুখ মাথা ফাটচে। চেওয়াং রাস্তায় ফেলায় পিটাচ্ছিল। সে ব্যাটা চেওয়াং এর শালার মেয়েকে মাল খায়ে টিপে টুপে দিছিল কবে। বুধবার চেওয়াং হাতে পায়ে শুয়োরের বাচ্চার মুখ ফাটায় দিসে। খুব ঘন ঘন হাত নড়ে হাছানেরও। নিশ্বাস ভারী হয়। তল পেট থেকে উঠে আসা উগরানি হাত লাঠি হয়ে হর হর করে ভেঙ্গে পড়ে সে চ্যাংড়ার গাঁড়ে। সে হারামি চেওয়াং কে মুখেই চেনে। তার মুখও কি মনে রেখে দিসে? কি এমন আছে মনে রাখার মতন? চোখ বন্ধ করে নিজের মুখ মনে করতে গেলে নাক- কান- চোখ-ঠোঁটের মন্ড মত ভোঁতা আবছা কিছু তৈরি হয়। কোন একটা তে মন দিতে চাইলে বাকি গুল টুপটুপে চোখের পায়ের তলায় জমা হয়। চোখ খুলে আয়না মুখস্তের চেষ্টা করলে বুঝতে পারেঃ আলাদা করে মনে রাখার মতন কিছু নাই। কত বছর আগে এক কাদা রঙের সন্ধ্যায়, তার মুখ আর সবার মুখ থেকে আলাদা হয়ে উঠচিল। একবারই। ডুবডুব নাক। ব্যথা ব্যথা নেশায় টাল খাওয়া ঠোঁট। ভ্যাবলান চোখ। মনোযোগ দিয়ে আয়না দেখে খুব নিশ্চিত ভাবে বুঝতে পারচিল অমন মুখ আর কারো হয় না। সে সময় তার ফিনফিনা বালে পাক ধরে নাই। নাক আর ঠোঁটের মাঝ – হাতের তালুর মতন মোলায়েম। সেই কাদা রঙের সন্ধ্যায়, নুরুল চাচার বাড়িতে ঘুরতে আসা এক ভিনদেশি জিন তামাক খেতে হাছানকে জাপটে ধরে তার নীচের ঠোঁট কেন গিলে ফেলতে গেছিল হাছান জানে না। কিন্তু সেই এক দিন তার মুখ সব্বার থেকে একদম আলাদা হয়ে উঠচিল। লাঠি মারার সময় , কারো চোখ মুখ থেঁতলে দেবার সময়, থেঁতলানি বেয়ে নামা রক্তের ভিতর লাঠি গুঁজে মাংস খোঁজার সময় ও কি তার মুখ আর সব্বার থেকে আলাদা হয়ে যায়? সেই মুখ মনে রাখা যায়? তার মুখ কি মনে রাখচে সেই শুয়োরের বাচ্চারা?
ইডেন হসপিটালের সামনে, পুলিশ ব্যারাকের সাত ফুট বাই আট ফুট খুপরিতে কোন জানালা নাই। দিন রাত এল ই ডির ফ্যাটকা সাদা আলো – মেঝে, বিছানা, আলমারি ছেতরে দিয়ে – দেওয়ালের আঠাশটা ফুটায় ঝিম খায়। ডিউটি শেষের দুমড়ান ঠ্যাং মাথা বিছানায় লেপে দিলে, সেই পেরেক উপড়ান ফুটা জুড়ে জুড়ে ছবি হয়ে যায় হাছান। চেওয়াং এর খাটের দিকের দেওয়ালে মায়ের কাঠ কাঠ হাঁটু – হাঁটু জুড়ে তার খ্যান খ্যান– ছুক ছুক পোয়াটাক খিদার গায়ে মেঝের মাটি মাখায় দিয়ে মাক জড়ায় ঘুমায় পড়া হাছান। পূবের দেওয়ালের ফুটা জুড়ে জুড়ে ঝাঁকুনি দেয় ঘুম ঘুম মাটির মেঝে থেকে মায়ের বাপের খাটিয়ায় চলে যাওয়া। দক্ষিণের ছাতা পড়া দেওয়াল জুড়ে পাক ঘরের পিছনের ড্রেন উপচান গু মুত ভাত গোবর আর কদমের গন্ধ । উপরে ছাদে জোরদার কাঁটাতার তৈরি হয়। এই দিকে তামাকের ক্ষেত। ওই দিকে পাটের। মাঝে টঙে বসে বসে ঝিমায় বি এস এফ কাকা। লজেন্স ছোড়ে উপর থেকে। “বন্দুক দেখনা হে? পহলে দৌড় প্রাকটিস করো। হাত লুস রহেগা। ছাতি সিধা।“ তারপর একখান ৬ মিনিট ১৩ সেকেন্ডের দৌড়। খুব জোড়ে। ১৬০০ মিটারের রাস্তা হুশ হাশ করে পিছলে পিছনে চলে যেতে থাকে ব্যারাকের এই সাত ফুট বাই আট ফুট খুপরিতে।একটা ঠিক ঠাক দৌড় দিতে পারলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ১৬০০ মিটার শেষের মোটা রশিতে আঙ্গুল ছুঁয়ে গেলেই মাথার পিছনের দেওয়ালের ফুটা জুড়ে জুড়ে কালচা সবুজ তামাক ক্ষেত তৈরি হয়। ভোর রাতে তামাক ক্ষেতে মোতার পড়ে প্যান্টের ভিতর থেকে চটি বই বের হয়। কুপির হালকা আলোয় হলুদ পাতায় জলে ভেজা সাদা শাড়ির ভেতর উপচান মাইয়ের চুচি। সব নরম নিশপিশ করে উঠছে। সরাও……ওইটুকু ঢাকা সরাও। সে গলে গিয়ে বুঁদ বুঁদ মিশে যাচ্ছে তামাক ক্ষেতের শিকড়ে কাদায়। হাতের ধাক্কায় কুপি নিভলে কাঁটা তারের পাশে কালো কালো এক দল থ্যাবড়া হাত পা মাথার জমায়েত দেখা যায়। উঁচু একটা মইয়ের ছায়া উঠতে উঠতে আকাশের অন্ধকারে মিলায় যায়। পুরা তামাক ক্ষেতের ইঞ্চি ইঞ্চি অনেকগুলা দাঁতাল কুত্তা হয়ে ভীষণ চিৎকারে আউলায় দেয় অন্ধকার। সব নরম নিশপিশ করে ওঠে। পা বেয়ে উঠতে উঠতে, পেট থেকে নামতে নামতে সব নিশপিশ কোমরে জড়ো হয়। ঝিলিক দিয়ে টান লাগে কোমরে।সে বহু বছর আগের কথা। সেই বছর থেকেই তার হঠাৎ হঠাৎ ঝুঁকে যাওয়া শুরু হয়। চাকরির মেডিকাল টেস্টে ৫০ হাজার গচ্ছা যায় ……… রাত বিরাতে ঘুম ফাল ফাল করে কোমর শক্ত হয়ে আসে……
মুততে গিয়ে কোমর আটকে যায়……
কোমর কি সোজা হবে?
নীচে কত জোড়া জমা হচ্ছে পা? তাদের হাতে কি ওয়ান শাটার? খুকরি? নাকি দুটা আঙ্গুল আর দাঁত?
উপরে চোরা বাট ধরে কতদূর এগল চেওয়াং? উপরে ওঠা যাবে? ও কি? উপরে কুপ্রোর পাথর ক্রস করে আরেকটা জটলা। কিছু মুখ চেনা চেনা। লাঠি চার্জের সময়, আগে থেকে চেনা না থাকলে কোন মুখই মনে গাঁথে না। হাঁটুর চাকি, হাতের কুনুই, পাছার মাংস, মেরুদন্ডের গাঁট, চুলে ঢাকা খুলি এমন টুকরা বাকরা ছবি – ভয় মজান হাত সুখ – নোনতা নোনতা জিভ- হাঁফ ধরা রাগ মন্ড হয়ে একটা টায়ার্ড ছবি পড়ে থাকে। কিন্তু এখন গাঢ় অন্ধকারে, হালকা মোছা মোছা চোখ মুখ দেখলেই মনে হচ্ছে এই কি ছিল? এরই পিঠে কি লাঠির নীল দাগ এখন দগদগাচ্ছে? মনে রাখচে? তাকে চিনবে পুলিশ বলে? তাকে দেখলে বোঝা যায় সে রাজবংশী? সে কি খুব ফর্সা? চেওয়াং যেমন বলে , তাকে কি সত্যিই তেমন নেপালি বলে ভুল হতেই পারে? এক বছরে তার নেপালির ফ্লুয়েন্সি নেপালিদের মতন হয়ে গেছে না? এরা নেপালি পুলিশ মারে না?

নীচের জটলা ঘন হলে জলপাই রঙ হয়।
কোমরের নীচ শক্ত হয়ে এসচে। সোজা হওয়া যাবে না। কাঁধের উপর চাপ লাগে। ঘাড়ের দুই দিকে নুলার মতন সরু দুইটা দাবনা আঠার মতন চেপে থাকে। চামড়া চামড়ার ঘষায় এই ঠান্ডাতেও গল গল করে ঘাম বের হয় ঘাড় থেকে। দুই হাতের নীচে পাঁজরার কাছে কুপ্রোর ভাঙ্গা গোড়ালি।
“মোলায় ঘর পুকায় দেও তিমি”
কানের কাছে হিস হিস করে তাকে ঘরে পৌঁছে দিতে বলে কুপ্রো ।
ছিয়াশিতে সি আর পি এফের গাড়ি থেকে পালাতে গেলে তাকে আর ফেরায় নি সি আর পি এফ। লাঠি দিয়ে গোড়ালি ভেঙ্গে, পকেটে থাকা নেল কাটারের ভোতা ছুরি দিয়ে ঘষে ঘষে ঘষে দুই গোড়ালির উপরের নালি কেটে দেয়। সময় লাগে অনেক যদিও। প্রায় আধা ঘন্টা। তারপর রাস্তায় ফেলে রেখে বলে “ যা বাড়ি যা’”। রাত দুপুরে কোমর ঘেষ্টে ঘেষ্টে খানিক হামাগুড়ি দেয়। ঘর, ঘরের বন্ধ জানলা, মানুষের গলার আওয়াজ ইত্যাদি দেখতে শুনতে পেলে চির চির করে চিঁখ পারে “ ভাই মোলায় ঘর পুকায় দিনু হুঞ্ছ?” ভাই আমায় ঘর পৌঁছে দেবে? তারপর এই ডারায় এসে মরে।
চেওয়াং এর এই গল্পে তার বিশ্বাস নাই। এত তার পুরান ব্যথা……… কুপ্রো বলে কিছু হয় না। কুপ্রো বলে কিছু নাই। তবু কানের কাছে হিশহিশানি বাড়তে থাকে। সোজা হতে হবে। নীচে যেতে হবে। নীচে আর্মির টহলদারি দল মুততে দাঁড়িয়েছে। সে পুলিশ। উপরে খুকরি হাতে মানুষ। তার লাঠির বাড়িতে তাদের মাথায় রক্ত বয়ে গেছে। তাদের দুই আঙ্গুল আর দাঁত খুব ধারাল। সে পুলিশ। আর্মি ঠিক সময়ে বাঁচাবে তাকে।
গাম বুটের ঘষ্টানির আওয়াজ এই উপর থেকে পাওয়া যাচ্ছে। এ মজলিশি আওয়াজ। সিরিয়াস দাপাদাপি কিম্বা কঠিন অঙ্কে গাঁথা প্যারেড না। নিতান্ত পায়চারি। গাম বুটের অগোছালো ধুপ ধাপ।
“হাছান হক স্যার ………কনস্টেবল ডাব্লিউ বি পি………… উপর লোকাল অ্যান্টিসোসাল হে স্যার………… আপন নিহত্তা …………হাম রাজবংশী স্যার………..ইহা কুপ্রো …মানে……… ”
পেটের থেকে ভুরভুর উঠে গলার ভিতর ভাঙ্গে শব্দ। বুকের ভিতর হালকা যে শিরশিরানি বোধ হয় ………………তার কারণ হাঁফ ছাড়া স্বস্তি হতে পারে। তিলতিল জমে ওঠা টেনশন হঠাৎ করে উত্তর পেয়ে গেলে শরীর আতঙ্ক আর স্বস্তির ফারাক করতে পায় না। নীচে কালোর ভিতর জলপাই রং জমে। তার কোমর বেঁকে থাকে। তার এবার নীচে নামতে হবে। নীচে জওয়ান ভাই। নীচে গেলে বেঁচে যাবে। ধুপধাপ গাম বুটের আওয়াজ। রাত জাগা ঘুম লাগা চোখে খুব অসহায় টহল দিচ্ছে বেচারারা। তার মোতা শেষ হয় না। সরু হয়ে আসছে ধারা। নাকে কাঁচা তামাকের গন্ধ ভুরভুরাচ্ছে। ভোর রাতে তামাক ক্ষেতে মুততে এসে প্রচুর কুত্তার ডাক। ধুপ ধাপ খালি পা গাম বুট। অন্ধকার আউলে দেওয়া কি ভীষণ আওয়াজে তড়াক টান লাগে কোমরে। ও কি! ঝুলে আছে! কাঁটা তারের সার সার খোঁচার ভিতর লেটকে থাকা ঠ্যাং। হাত মাথা কোমর উলটান বাদুড় ঝুল। ভোর রাতে থেকে ঝোলে। সকাল হয় – ঝোলে। দুপুর হয় – ঝোলে। কোমর থেকে গড়ায় আসা লাল লাল আঠা নাকের ফুটা চোখের সাদায় সেঁদে যায়। তাতে আটকা পড়ে দুই চার মাছি। আস পাশে ঘুম ভাঙ্গা কোমল চোখ মুখে খুব অসহায় টহল দেয় এ কে ফর্টিসেভেন। দূর দূরে তিন চার জটলা। কিছু জটলা ফোঁপাচ্ছে। কিছু গুজগুজ…………কাপড় আটকে গেছিল কাঁটাতারে। তা চিল্লাবি? বোগদা নাকি? না না চিল্লায় নাই। কেউ দেখে ফেলচে বেড়া ক্রস করার টাইমে। গুলি খায়েই মরচে? না ঝুলে থাকতে থাকতে মরল? খবর ছিল?
বিকালে সেই ঝুলে থাকা জিনিস নামানর পরেও বছরের পর বছর, রাত বিরাতে বাদুড়ের মতন কি যেন ঝোলে তারে। লাল লাল আঠায় কাদা হয় মাথার তলার মাটি।
“নুরুল চাচার ভাগ্নি। জাহানার বেটি। জহুরা। দেখিস নাই, এক মাস হইল আচ্চিল। বাংলাদ্যশত বাড়ি। চুরি করিয়া বর্ডার পাড় কইরবার গেচিল।”
“মারি ফ্যালাল!”
“হ। নিয়ম!“
“মাও, বাইরে দাঁড়াইবু? হামি মুতিম।“
“দাঁড়াইবার নাইগবে ক্যান?”
“কাঁটা তারত জহুরা ঝুলি থাকে। হামি দেখচি।“
“ধুর পাগলা। জহুরা আর নাই।কাক ডরাইস হাছান?“
আধা মুতে দৌড়ে ঘরে ফিরতে গিয়ে চোখ চলেই যায় কাঁটা তারে। ফোঁটা ফোঁটা মুত প্যান্টে পড়ে। জোর করে নীচে নামাতে হয় চোখ। পায়ের পাতায় সিলাই হয়ে যাওয়া চোখ মাটিতে দোলে। কাঁধের উপর চাপ – ঘাড়ের পাশে দাবনা ঝুলে থাকে। এই দাবনা খানিক নরম। কাঁধের উপর কোমর থেকে উলটে ঝুলে থাকে কেউ। বাদুড়ের মতন।
“ঘরত নিয়া যা হামাক” ফিসফিস ফিসফিস।
টনটন করা কোমর খুব কোঁত দিয়েও সোজা করা যাচ্ছে না। পালাতে হবে। নীচে গেলেই বাঁচবে। তার……তাদের সিকিউরিটির জন্যই ত ওনারা…… হামাক বাঁচান স্যার………হামি নেপালি না………হামি রাজবংশী………হামি পুলিশ………না আই কার্ড ত ঘরত ছাড়ি আইচ্চি……হামি আপনারে দলের নোক……হামি সিকিউরিটি পার্সন……হামাক বাঁচান …… না হামাক নেপালির মতন দ্যাখবার নাইগলেও………বিশ্বাস করেন……
“কাক ডরাইস হাছান?”
ঘাড়ের উপর এই চাপ ………পাথরে ডেবে যাবে পা………না না।এ সব মনের ভুল। মনের জোর আনো! এত কিসের ভয়! সোজা হও। নীচে নাম। জহুরা বলে কিছু হয় না। জহুরা বলে কেউ নাই। এত অনেক পুরান……
মুতের সরু ধারা পুরাপুরি শেষ হবার আগেই দানা দানা নুড়ির মতন আটকে যায় বাঁড়ায়। টনটন জমে শরীরে। খুব কাঁপুনি দেয় পা। পায়ের কি নিজের মন থাকে? নীচের দিকে এক স্টেপও নড়াতে পারা যায় না। শুধু থরথর কাঁপে আর উপরের বাটোয় হাঁসফাঁসায়। উপরে যাইতে চাও পা! কুপ্রোর ঘরে যাওয়া লাগে। কুপ্রো কে পৌঁছে দেওয়া লাগে। ঘাড় থেকে নামান লাগে। উপরের মানসি হেরু কুপ্রোর বাড়ি চেনে। তাকে দেখতে নেপালি নেপালি লাগছে। উপরের লোকেরা বাড়ি পৌঁছে দেবে। নীচে আর্মি। তাদের বন্দুক। পকেটে ভোতা নেলকাটার। সে কি উপরে যাবে? সে উপরে যাক। হামাক তোমরা দলে নেন। হামি বুঝি। হামিও দেখচি। হামিও ডরাই। হামাক বাঁচান। হামাক দেখেন। চোখ দেখেন। নাক দেখেন।হামি আপনার ঘরের মানুষ। হামি আপনাদের ভাই। পা সরে না৷
চেওয়াং কতদূর? মোবাইল কই? পকেটের খাদে হাতরে বাতরে মোবাইল ঠান্ডায় আঙ্গুল ঠেকে। আঠা আঠায় মাখামাখি হয় আঙ্গুল – ধাতু। পকেট থেকে টানলে ডান হাতের পাতায় তিরতির কাঁপে আঠাল ভোতা কাটারি। ভোতা কাটারিতে লাল জমে আছে মাংস ছাল।
কাটারি থেকে ফোঁটা ফোঁটা আওয়াজ ঝরে ” কাক ডরাইস হাছান!”
পিঠের উপর চাপ বাড়ে। এবার খানিক ভারী হয় ওজন। কাঁধের উপর চেপে থাকা বাঁড়া থেকে টপ টপ রক্ত ঝরে। খুব চেনা চেনা এই শরীর ।নিজের ভিতর আর বাইরে গড়ান এই রক্তে ফারাক বোঝা যায় না।
বাঁড়ার চামড়া ছিঁড়ে ফাটায় দেওয়া চটকানির টানে গলার তল থেকে উগরায় আসা শীৎকার জিভের গিঁটে বাঁধ খায়। আঠা আঠা জমা হয় ঠাপ, শক্ত হয়ে আসা গায়ে। আসছে। এখনি আসবে। কে নিবে? কে নিবে! একটা মানুষ লাগে, একটা মুখ লাগে একটা ছবি লাগে। দাঁতে দাঁত চাপা খারিজের সব চেষ্টা চুর মার হয়ে, উগরানর মুষল স্রোতে, চোখে প্রতিবার ধরা দেয় এক উলটান মুখ। তার আলগা খোলা ঠোঁটে ভনভনায় দুই চার মাছি। কোমর থেকে উলটে যাওয়া ফ্রকের উপর নীল প্যান্টি ভোরের শিশিরে চুপসা। কোমর থেকে গড়ায় আসা লালে, চোখের সাদা শাপলার মতন হাবুডুবু ভাসে।
আর কেউ। অন্য কেউ। তুই না………..
জিভের গিঁটে বাঁধ পড়ে যায় চিৎকার।
পানু বইয়ের নায়িকা, ক্লাসের বান্ধবী, দিদি, মা, বাবা, দাদা, সব আয়োজন মিলায় গিয়ে ঠিক উগরান মুহূর্তে উলটান সেই মুখে বয়ে যায় হাছান। বমি গিলে ফেলার ঢোঁকে কুঁকড়ে ওঠে বাঁড়া।
হাত মোছে।
জল খায়।
উনান গরমে ঘষির ড্যালার মতন ভুসভুস ধোয়া জমায় শরীরে।
পাক ঘর থেকে ভোতা কাটারি নিয়ে তামাক ক্ষেতে যায়। ঘষে ঘষে ন্যাতান বাঁড়া চিড়ে মাংস বার করে। আঙ্গুলে রক্ত নিয়ে জিভের ডগায় ঠেকায়। এমন এক মাস দুই মাস, এক বছর দুই বছর অত হিসাব নাই……
এই অন্ধকারেও টের পাওয়া যায়, পকেটের গর্ত থেকে উঠে আসা কাটারির ডগায় গুটি পাকায় ঝুলে আছে কুপ্রোদের পায়ের নালির চামড়া।
জহুরাদের উলটান মাথার নীচে থক থক লাল ফোঁটা ফেলে কাটারির ধার।
হাতে লাগা চ্যাট চ্যাটা লাল কুপ্রোর পাথরে ঘষতে ঘষতে ছাল বাকলা উঠে আসে হাতের।
হাতের বাইরে লেগে থাকা লাল আর ছালের তলা থেকে উঠে আসা দানা দানা লাল এমন বিটকাল মিশ খায় , যে কখন আলাদা ছিল বলে বোধ হয় না।
“কান্ধা ঝুকেগা নেহি। সিনা সামনে কি তরফ। পিছে নেহি মুরনা হে।“
“কেয়া হুয়া বেটা ইতনা দুবলা কিউ হো? যানে কে আগে দুধ পিকে যানা।“
“মাতাজী কে শরীর ভালো? ভুখার বাড়লে হেলথ ক্যাম্প পে নিয়ে আসো।“
“ইয়ে দেশ হামারে হে। হামেহি ধ্যান রখনা হোগা। হাম ঘর ছোড়কে এত দূরে তোমাদের হিফাজত করছি। তোমাদেরও ডিউটি হে। কোই ভি রাত কো ফেন্স কে করিব দিখে ত ক্যায়া করোগে? জোরসে চিখোগে? নেহি। ফির তো উনহে ভি পতা চল যায়েগা। কুত্তে কি তরা ভোক সক্তে হো? গুড।“
মায়ের শরীর এখন ভালো। দৌড় টা আরো প্র্যাকটিস দরকার। অতটা জোরে এখনও দৌড়ান যাচ্ছে না।
“১৬০০ মিটার ৬ মিনিট ৩০ সেকেন্ড মে দৌড়না পড়তা হে ফিজিকাল টেস্ট মে। উসকে লিয়ে নিজের বডি তৈরি করতে হবে। হামারি মাসেলস কা খুদ কা মেমোরি রেহেতাহে।“
“খুব জোরে দৌড়াইতে পাড়লে ঠিক হয়ে যাবে সব? অন্ধকারে আর দেখা যাবে না? হঠাৎ হঠাৎ আর ঝুঁকে যাব না? ঘুমের ভিতর আর অমন হবে না? ”
বি এস এফ আউটরিচ প্রোগ্রামের ফিজিকাল ট্রেনার খোলা মাঠের শেষে চোখ ভাসায় দিয়ে অন্যমনস্ক কান চুলকায়। এত আস্তে বিড় বিড়ায় যে নিজেও শুনতে পারে নাঃ
“হবে। কখন কখন হবে।“
কোমরে খুব টান। ঘাড়ের উপর চাপ……. কোমর পর্যন্ত ডেবে যায় পাথরে। উপরে না নীচের ফালতু প্যাচালে আর কাজ নাই। এই খানেই দুই শরীরের ভারে মাটির নীচে বীজের মতন ঢুকে যাবে হাছান। কুপ্রো ডারার এই একেকটা পাইন গাছের তাহলে এভাবেই একেকটা হাছানের বীজে জন্ম। জঙ্গলের ভিতর আরো আরেকটা হাছান গাছ হয়ে আরো কোন হাছানের মুত শিকড়ে জড়াবে সে। একটা হাছান হয়ে আরেকটা হাছানের পিঠে………..
পকেটের ভিতর মোবাইল বাজে। চেওয়াং? ফোনের আওয়াজে উপরের দল, নীচের দল আঁটসাঁট বাঁধে। চোখ হানায়। ঠিক করতে হবে কোথায় যাবে।
” কাক ডরাইস হাছান?”
এ সব মনের ভুল। মনের জোর আনো। সোজা হও।
নীচ থেকে আওয়াজ আসে “কোন হে বে উপর? কেয়া কর রাহাহে?”
ত্রিশ সেকেন্ডের নীরবতার পর, চার পাঁচেক এ কে ফর্টি সেভেন তাক হয় মাথার উপর পাইন জঙ্গলে। কাউকে মারার জন্য না নিশ্চই। সাবধানতা।
ততক্ষণে পাইন কুয়াশার নাড়িভুঁড়ির ভিতর গলতে গলতে হলুদ জলে গড়িয়ে গেছে আস্ত মানুষ। মুত হয়ে গলে যেতে যেতে যে কটা শব্দ বুদবুদ মতন ফাটে পাইন শিকড়ে, তাদের সাজালে খানিক এমন দাঁড়ায়ঃ
“হামি কুপ্রো। তোর মাথাত মুতি শুয়োরের বাচ্চা। বাঁইচবার চাইলে ভাগ মেরো ডারা সে।“
আরও খানিক নীচে নামতে নামতে পাথরে আগল খেয়ে- ফার্নে গা ঘষে – কুয়াশায় চুপসা হয়ে- সেই শব্দ মুছে মুছে শুধু আওয়াজ পড়ে থাকে।
শেষমেষ এক দাঁতাল কুত্তার নাভি উগরান একটানা আওয়াজ – জঙ্গলি সাইরেনের একঘেয়ে তরাস নিয়ে পৌঁছায় পাহাড়ের তলার রাস্তায়।
উপরে চোরা বাটোর বাঁকে- আউলান অন্ধকারে- চার পায়ে মাটি খামচে ধরে হামাগুড়ি দিতে দেখা যায় কাকে?

হাছান বলে কিছু হয় না। হাছান বলে কেউ নাই।

Facebook Comments

Posted in: July 2021, STORY

Tagged as: ,

Leave a Reply