আফজল গুরু-র ফাঁসি – একটি আইনি আলোচনা : অতীন্দ্রিয় চক্রবর্তী
[অতীন্দ্রিয় পেশায় আইন- ও কলমজীবি। কলকাতায় বাড়ি ও বর্তমানে কাজের জায়গা। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে পীপলস ইউনিয়ন অফ সিভিল লিবার্টি-র একটি দলের সাথে হাফতাখানেক কাশ্মীর উপত্যকার আজাদি-স্পর্ধিত বিভিন্ন অস্থির অঞ্চলে কাজের সূত্রে গিয়ে, সেখানের নানান বন্ধুবান্ধবদের সাথে থেকে, কথা বলে, জেনে-দেখে-শুনে-বুঝে-চলে-ফিরে অনুপ্রেরণা আহরণ ও সেই থেকে আজাদির আন্দোলনের বিভিন্ন দিক নিয়ে পড়াশুনা করার চেষ্টা করেছেন। সে’সকল উৎস থেকে তিনি আইনি পর্যালোচনা করেছেন আফজল গুরুর ফাঁসির আদেশের। ‘অপরজন’-এর পাতায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সেই আইনি পর্যালোচনা। এই সংখ্যায় তৃতীয় কিস্তি।]
পুলিশি তদন্ত
অতঃপর ইনভেস্টিগেশনযজ্ঞ রে রে রোলে আরম্ভণ। সবার আগে চোখ রাখা যাক এই আলোচ্য জাজমেণ্ট, যার পোশাকি নাম স্টেট অফ দিল্লি বনাম নভজ্যোৎ সান্ধু – সাইটেশান – (২০০৫) ১১ এস-সি-সি ৬০০, তার ৬৪৭ নং পৃষ্ঠা, অনুচ্ছেদ নং ৪ (vii)-এর দিকে। অকুস্থলে ময়নাতদন্ত করে কী কী এভিডেন্স প্রাপ্ত হয়েছিলো, তার ইঙ্গিত প্রাপ্ত হয় সেইখানে। –
একটা দুধসাদা অ্যাম্ব্যাসাডর গাড়ি যার লাইসেন্স নম্বর – DL 3 CJ 1527 – এবং যার মাথায় সাঁটানো হয়েছে ‘ভি-আই-পি’ চিহ্নিতকারি লালবাতি। গাড়ি-র উইণ্ডস্ক্রীন-এ লাগানো ছিলো কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রকের স্টিকার – যা, সুপ্রীম কোর্টভাষ্যে, পরে জাল ধরা পড়েছিলো। গাড়িটার পিছনদিকে নাকি ভারতবিদ্বেষী ও ভারতরাষ্ট্রের হানিসাধক কিছু বয়ান আঁচড় কেটে লেখা ছিলো।
Xansa Websity নামক কোন এন্টিটি-র তরফ থেকে ইশ্যু হওয়া ছয়টি আইডেণ্টিটি কার্ড – তার মধ্যে পাঁচটা কার্ড-এ যে নামগুলো লেখা আছে সেগুলো, ইনভেস্টিগেশন মারফৎ জানা গিয়েছে – ওই – সেই পাঁচ ‘মৃত টেররিস্ট’-এর নকলনাম সমন্বিত জালকার্ড। উক্ত Xansa Websity – ঠিকানা ৩৭, বাংলো রোড, নয়াদিল্লি, মোবাইল ফোন নং – ৯৮১১৪৮৯৪২৯। কার্ডে ছদ্মকার্ডধারিদের ছাত্র হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁদের ঠিকানা নির্দিষ্ট করা হয়েছে – ১২০-এ, আদর্শ নগর, নয়াদিল্লি। অকুস্থলে উদ্ধার ছয় নম্বর কার্ড-টি – পুলিশি ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট – যা মহামান্য আদালত সর্বৈব স্তরে মান্য ধার্য্য করেছে এই মামলায় – তা অনুসারে – ‘আশিক হোশেন’ নামধারী কারুর উদ্দেশ্যে ‘সাইবারটেক কম্পিউটার হার্ডওয়্যার সলিউশনস’ নামক কোন সংস্থা দিয়েছে। কিন্তু এই ছয় নম্বর কার্ড পাওয়া গ্যাছে সেই পাঁচ ‘মৃত-টেররিস্ট;-এর একজন – মহম্মদ-এর মরদেহে অথবা দেহসমীপে।
আরো পাওয়া যায় কাগজে লেখা পাঁচটা ভারতীয় মোবাইল ফোন নম্বর – যে নম্বরগুলি ‘মৃত টেররিস্ট’-দের দেহ ও দেহসমীপ থেকে উদ্ধৃত মোবাইল ফোন/ (কোর্টভাষ্যে – ‘ইন্সট্রুমেন্টস’) সাথে মিলে গিয়েছে। যেমন মিলে গিয়েছে সেই পাঁচটার মধ্যে তিনটে নম্বরের সাথে ম্যাচিং সিমকার্ড। আরো তিনটে সিম কার্ড পাওয়া গ্যালো সেই ‘মৃত টেররিস্ট’- মোহম্মদ-এর-ই দেহসংযুক্ত পার্স থেকে। তাঁর মরদেহ পড়েছিল ভারতীয় পার্লামেণ্ট-এর গেট নং – ১ -এর সামনে। অপরদিকে, সেই সাদা কাগজে সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর দুটো ফোন নম্বর লেখা ছিলো।
এছাড়াও সেই গাড়ি থেকেই নাকি উদ্ধার হলো একটা পার্লামেণ্ট হাউস চত্ত্বরের দুই-ব্লকে বিস্তীর্ণ দালানবাড়িগুলোর হস্তলিখিত ‘টোপোগ্রাফিকাল ডিটেইল’ – এমন নিদারুণ হামলা শ্রেফ হাতে লেখা টোপোশিট-কে ব্লু-প্রিণ্ট বানিয়ে করার বিশ্বাসযোগ্যতা তখন দশদিশবিদারী জিংগোবাদের ঢক্কনিনাদের গুঁতো খেয়ে ‘উইলফুল সাস্পেনশান অফ ডিসবিলিফ’এর অতলে তলিয়েছে।
স্পষ্টতঃ-ই, অকুস্থল থেকে এমন কিছু পাওয়া যায় নি যার থেকে আফজল গুরু বা ঐ চার অভিযুক্তের কারুর-ই কোনো নাম বা যোগসাজশ উঠে আসতে পারে। ইতিমধ্যে, টেলিভিশন স্ক্রীন-এ গাড়িটির লাইসেন্স-প্লেট দেখে এগিয়ে এলেন জনৈক প্রসিকিউশান উইটনেস নং ২০ – যিনি স্বীয় বয়ান জ্ঞাপন করলেন পি-ডব্লিউ-০১ শ্রীমেহতার সমক্ষে। তিনি পার্লামেণ্ট হামলার ঠিক দুই দিন আগে, অর্থাৎ, ১১ই ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে সেই সাদা আম্ব্যাসাডর-গাড়িটি বিক্রি করেছেন সেই আশিক হুসেন-এর নামে। ‘মৃত টেররিস্ট’ মহম্মদকেই আশিক হুসেন নামে, ওই নামেই স্বীয় আইডেন্টিটি কার্ড দেখিয়ে , পি ডব্লিউ নং ২০-র কাছ থেকে গাড়িটা কিনেছিলো – এমনই ঠাউর হল উক্ত পি ডব্লিউ নং ২০-র বয়ান থেকে।
এইবারে শুরু হল ইলেক্ট্রনিক এভিডেন্স নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটির পালা – যে পালাটির মর্মার্থ সম্যক অনুধাবন ও উপলব্ধি করতে-ই এই লেখার শুরুতে এভিডেন্স অ্যাক্ট নিয়ে সেই সুদীর্ঘ ও বিরক্তিকর প্যাঁচালটি পারা হয়েছিলো।
ফোন নম্বর ও রেকর্ড থেকে উঠে আসে আফজল-সওকৎ -গিলানি-আফসান-দের নাম
স্পেশাল সেলের শ্রী মোহন চাঁদ শর্মা – যিনি ট্র্যায়াল কোর্টে প্রসিকিউশান উইটনেস নং ৬৬ হিসেবে এই মামলায় চিহ্নিত থাকছেন – তাঁর তত্ত্বাবধানে শুরু হলো, গাড়িতে প্রাপ্ত সেই কার্ড-গুলিতে লেখা সেল-ফোন নম্বর – ৯৮১১৪৮৯৪২৯ – এর সূত্র তথা কল রেকর্ডস দেখে বুঝে ফেললেন যে সেই নম্বরের সেলফোন-র সাথে পার্লামেণ্ট হাউসের গেট নম্বর ১-এর কাছে পরে থাকা ‘মৃত টেররিস্ট’ মহম্মদের লাশ-এর আশপাশ থেকে অথবা তাঁর পকেট-পরিধেয়-সংযুক্ত কোন অঞ্চল থেকে ‘রিকভার’ করা মোবাইল ফোন – যেটির নম্বর ৯৮১০৬৯৩৪৫৬। কিন্তু সেই কার্ডে লেখা নম্বর কার? এই নিয়ে অনুসন্ধান করে শ্রীশর্মা বয়ান দিলেন যে ইনভেস্টিগেশন-মারফৎ তিনি অবগত হয়েছেন যে ওই নম্বর-সমন্বিত সেলফোনটি ব্যবহার করেন আফজল গুরু। সেই সূত্রে অভিযুক্তদের নাম উঠে আসতে থাকে সেই ১৭-দিন ব্যাপি পুলিশি ইনভেস্টিগেশন-এ। এই যে অকুস্থলে প্রাপ্ত একটি কার্ড-এ লেখা একটি নম্বর যে সেলফোনের সেই ফোনের মালিক তথা ব্যবহারকারি আফজল, এবং সেই ফোন ব্যবহার করে তিনি অকুস্থলে মৃত পাঁচজন মানুষদের মধ্যে একজনের সাথে সেই ‘মৃত টেররিস্ট’ মোহম্মদেরর ফোনে হামলার ঘটনার পুরববর্তী এক ঘণ্টায় তিনবার মিনিট পাঁচেক কথা বলেছিলেন – এটাই আফজল গুরুর বিরুদ্ধে জোরালোতম সবুৎ তথা লিঙ্ক। এর উপর ভিত্তি করেই তাঁর ফাঁসি হয়।
ঘটনাস্থল থেকে প্রাপ্ত – আরেকটি সেই কাগজে-লেখা সেলফোন নম্বর-গুলোর মধ্যে থেকে একটা – ৯৮১১৫৭৩৫০৬ – এর সূত্র ধরে – উঠে আসে সওকৎ-এর নাম। চতুর্থ বিবাদী নভজ্যোৎ তথা আফসানের থেকে ‘রিকভার’ করা হয় সেই সেলফোন। আবার সেই সেলফোনটি-র ‘কল হিস্ট্রি’ থেকে উঠে আসে আরেকটা নম্বর – ৯৮১০০৮১২২৮ – যেটার ব্যবহার হতো এস-এ-আর গিলানি-র নামে। দেখা যায় যে আফজল ও সওকৎ-এর নম্বরে কানেকশান-দুটো চালু হয় ঘটনার এক সপ্তাহ আগে। এও দেখা যায় যে – এস-এ-আর-এর ফোন নম্বর থেকে তাঁর রেসিডেনশিয়াল অ্যাড্রেস – ৫৩৫, ডক্টর মুখার্জী নগর, দিল্লি- এই ঠিকানা-ও চটজলদি মালুম করে নেয় তদন্তরত পুলিশ। ঘটনার দিন বিকেল পাঁচটার মধ্যে এফ-আই-আর নথীকৃত হয়ে যাওয়ার ফলে, সেই দিনই এই সমস্ত নম্বরগুলি ট্যাপ করার ব্যবস্থা করা হলো। প্রসিকিউশান নং ৬৬, স্বীয় দায়ভার ও ক্ষমতাবলে অচিরেই ঘটনাস্থলে প্রাপ্ত সেল-ফোন নম্বর-গুলো অনুসারে ট্যাপিং-প্রক্রিয়ায় শুভারম্ভণ ঘটান।
পুলিশ-কর্তৃক ফোনে আড়ি পাতা
পরের দিন, অর্থাৎ, ১৪-ই ডিসেম্বর ২০০১ তারিখে, দুপুর ১২:৫২-এ এস-এ-আর গিলানি-র নম্বরে একটি ফোন আসে। কথোপকথন ইন্টার্সেপ্ট করেন প্রসিকিউশান উইটনেস নং ৭০, সাব ইন্সপেক্ট্রর শ্রী হরেন্দর সিং, যাঁর বদান্যতায় রেকর্ড করা হয় সেই কথোপকথন, আর সেই রেকর্ডে ধরা কাশ্মীরি ভাষায় কথোপকথোন শুনে তার হিন্দি অনুলিখন করে দ্যান – উক্ত ট্র্যান্সক্রিপ্ট প্রসিকিউশানের তরফ থেকে উপরোক্ত পি ডব্লিউ ৬৬ স্বীয় প্রদত্ত এগসিবিট নং ৬৬/০৪ হিসেবে ট্রায়াল কোর্ট নথিবদ্ধ করেছিলো সেই মামলায়। আবার অপর একটি নম্বর ৯৮১১৫৭৩৫০৭ – এ-ও এক-ই ভাবে আড়ি পেতে টেপ করর্ডিং করে নেওয়া হল – রাত ০৮.১২-এ একটি ভয়কম্পিত কথোপকথন শোনা গ্যালো – আদালতি বয়ানে, ‘প্যানিক’-ত্রস্ত এক নারীকণ্ঠ সম্বোধিত হচ্ছে সওকৎ-এর নাম।
উপরোক্ত এস-আই শ্রীহরেন্দর তথা পি ডব্লিয় নং ৭০ অথবা শ্রী এম সি শর্মা তথা পি ডব্লিউ নং ৬৬-জ্ঞাপ্ত সেই পুলিশি বয়ান, যা অপ্রশ্নে সাদৃত করেছে মাননীয় আদালতবর্গ – তা অনুসারে সেই রেকর্ডেড কণ্ঠস্বরের ফরেনসিক অ্যানালিসিস করা হলো। কী উপায়ে তা করা হলো সে বিষয়ে মহামান্য আদালতত্রয় নির্বাক, পুলিশি দস্তাবেজ অনুপস্থিত। তবে সেই ফরেনসিক অ্যানালিসিসের মাধ্যমে-ই নাকি বোঝা গ্যালো যে সেই কথোপকথন ঘটেছিলো সেদিনের নবদম্পতি সওকৎ ও আফসান-এর মধ্যে। তবে, আপাত-সাদালোচ্য ‘উইলফুল সাস্পেনশান অফ ডিসবিলিফ’-এর আরো অনেক ঘাট পেরোনো তখনো বাকি ছিলো এই মর্মগ্রাসি মামলা ও প্রকরণের।
অভিযুক্তদের ধরপাকড় আরম্ভ
১৫-ই ডিসেম্বর সকাল দশটায় দিল্লির মুখার্জী নগরস্থ স্বীয় রেসিডেন্স-থেকে গ্রেফতার হলেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি প্রফেসার এস-এ-আর গিলানি। আদালত-আদৃত সেই পুলিশি বয়ান অনুসারে এঁর মাধ্যমে-ই পৌঁছে যাওয়া গ্যালো। তবে, ইণ্ডিয়ান এভিডেন্স আক্ট, ১৮৭২-এর ধারা ২৫-এর সুপ্রভাবে সরাসরি পুলিশের সামনে করা তথাকথিত ‘কনফেশন’-এর মাধ্যমে কনফেসর-এর দোষ সাব্যস্ত করা নিষিদ্ধ, কিন্তু, সেই একই আইনের ধারা ২৭ অনুসারে, সেই ধরণের কোনো কনফেশান-এর ভিত্তিতে প্রাপ্ত এভিডেন্স সে’হ্যানো অপরাধের সংঘটন প্রমাণোদ্দেশ্যে সাচ্ছন্দে ব্যবহার্য। সেই কনফেশনের ভিত্তিতেই নাকি পৌঁছে যাওয়া গ্যালো সেই মুখার্জী নগরেই – সওকৎ – নভজ্যোত-এর বাসায় – যেখান থেকে গ্রেফতার করা হলো আফসান-কে, ‘উদ্ধার’ অর্থাৎ ‘রিকভার’ করা হলো আরো কয়েকটি মোবাইল নম্বর। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, আফসান তথা নভজ্যোত-কে গ্রেপ্তার করা হলো সকাল ১০.৪৫ – এ – অর্থাৎ, এস-এ-আর গ্রেফতার হওয়ার ৪৫ মিনিটের মাথায়। অথচ সেই ‘হোলিআর-দ্যান-দাও’ পুলিশি বয়ান, যা শেষমেশ যথার্থ হিসেবেই নিদান দিলো মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট – সেই সময়কাল থেকে পৌনে চার বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই – অনুসারে এস-এ-আর-কে জেরা করে, তাঁর থেকে স্বীকারোক্তি আদা করে, সওকৎ-আফসান-দের বাসা কিনা, যার-ও লোকেশন কি না ঘটনাচক্রে সেই দিল্লি শহরের মুখার্জি নগরে, এস-এ-আর-এর বাড়ির কাছেই – তার ঠিকানা আদা করে মাত্র ৪৫ মিনিটের মাথাতে-ই সেই ঠিকানায় পৌঁছে গিয়ে নভজ্যোৎ সান্ধু-কে-ও অ্যারেস্ট করতে সক্ষম হল দিল্লি পুলিশ, তা কী বাস্তবে সম্ভব হতো যদি কেবলমাত্র এস-এ-আর গিলানি-র বিয়ানের ভিত্তিতেই সেই বাসা খুঁজে পাওয়ার ঘটনাটার সত্যতা যাচাই করা যেতো? যাচাই করার সমস্ত ব্রিজপথ আজ জ্বালিয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছে ভারতরাষ্ট্র মারফৎ।
বিভিন্ন যে সকল অস্বস্তিকর প্রশ্নসমূহ উঠে আসতে থাকে
এছাড়াও, আরো কিছু প্রসিউডিওরাল প্রশ্নের খাপগুলো খোলাই থেকে যায়। যেমন, এই যে অনায়াসে, যা কোর্ট রেকর্ডস-এ সযত্নে ধরা আছে, পুলিশের জনৈক এস-আই পি ডব্লিউ নং ৬৬ শ্রীশর্মা, তিনে টেলিগ্রাফ অ্যাক্ট, ১৮৮৫-র প্রয়োগবলে ইনফর্মেশন ব্যুরো (আই-বি) – র জয়েণ্ট ডায়রেক্টর-এর অনুমতি আদায় করে বিভিন্ন নাগরিকের, সন্দেহবসে, আড়ি পাততে পারে – সেই পারা-না-পারা-র পিছনে নাগরিক অধিকার বনাম রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তথা একপ্রকার বলপ্রয়োগ – বা বলা যেতে পারে ‘রাইট টু প্রাইভেসি’, যা ‘রাইট টু লাইফ’-এর অংশ, অর্থাৎ, ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১ দ্বারা সুরক্ষিত – এক মৌলিক অধিকার, তার উপর আই-বি, ওরফে গুপ্তচরসংস্থা, ওরফে ‘ডীপ-স্টেট’ এতদূর থাবা কি আদৌ মারার ক্ষমতা ধারণ করে – এ বিষয়ে কোন আলোচনার কোর্ট-রেকর্ডস-এ ধরা নেই, পুলিশের জমা করা বয়ান সে বিষয়ে নির্বাক, যেমন নির্বাক সেই দিল্লিস্থঃ মহামাননীয় আদালতত্রয়ীর জাজমেণ্টগুলি। এমনকি পুলিশের একজন এস-আই-কে এইভাবে নাগরিকদের উপর আড়ি পাতার অধিকারদানের ন্যায্যতা নিয়েও সকল আলোচনা সকল ‘অফিশিয়াল রেকর্ডস’-এ, অনুপস্থিত। আই-বি-র তরফ থেকে এই অনুমতিদান যাচাই করার জন্য উক্ত তদনীন্তন জয়েণ্ট ডায়রেক্টর অথবা কোনো এজেণ্ট অথবা রেপ্রেসেন্টেটিভ কোর্টে কোন অফিশিয়াল বয়ান দ্যান নি যা অদ্যবধি পাব্লিক রেকর্ড হিসেবে কোথাও নথিবদ্ধ রয়েছে। ক্যানো উক্ত জয়েণ্ট ডায়রেক্টর-কে প্রসিকিউশান উইটনেস বানানো হলো না – সে বিষয়েও কোথাও কোন আলোচনা পাব্লিক ডক্যুমেণ্ট হিসেবে কোর্ট-রেকর্ডস-এ ঠাঁই পায় নি।
একে একে অভিযুক্ত চারজনের-ই ১৫-ই ডিসেম্বর ২০০১-এ ঘণ্টা দেড়েক ব্যবধানে গ্রেফতার হয়ে যাওয়া
এই যে দিল্লির মুখার্জি-নগর থেকে ১৫ই ডিসেম্বর সকাল ১০-টার সময়ে এস-এ-আর গিলানি এবং ১০:৪৫-এর সময়ে অ্যারেস্টেড হলেন, তার এক ঘণ্টার মধ্যেই একটা ট্রাক-এর নম্বর-এর সূত্র ধরে শ্রীনগর পুলিশ গ্রেফতার করলো আফজল এবং সওকৎ দুই ’তুতো-ভাই-কে। সে ট্রাক-এর নম্বর কী ভাবে শ্রীনগর পুলিশের কাছে এলো? পুলিসি বয়ান অনুসারে, পুলিশ আফসান গুরু-কে জেরা করে বের করে নিয়েছিলো সেই নম্বর। সব মিলিয়ে যেটা হলো তা এই যে – ২০০১ সালের ১৩-ই ডিসেম্বর সকাল ১১-৩০ নাগাদ পার্লামেণ্ট হামলার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সেই হামলায় অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেপ্তার হলেন আফজল, সওকৎ, আসমান ও এস-এ-আর। এই গ্রেফতারি-র ‘রেকর্ড’ উ মাসের মধ্যে ট্রায়াল সম্পন্ন করে ট্রায়াল কোর্ট আফজল, সওকৎ ও এস-এ-আর-এর ফাঁসি এবং আফসান ওরফে নভজ্যোৎ-এর পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড-র হুকুম রুজু করলো। আবার, আফজাল যেদিন ফর্মালি অ্যারেস্টেড হলেন সেইদিন-ই পুলিশের স্পেশাল সেল-এর ইনস্পেক্টর শ্রী গিল – যিনি ট্রায়াল কোর্টে প্রসিকিউশান উইটনেস নং ৭৬ হিসেবে সাক্ষ্যপ্রদান করেন। শ্রীগিল ডিউটি নেওয়ার দিনেই অর্থাৎ ১৬ই ডিসেম্বর ২০০১-এ, দোষীদের সাক্ষ্য অনুসারে বিভিন্ন স্থানে রেইড করে ‘রিকভার’ করলো বিস্ফোরক কেমিক্যাল, ডেটনেটর-যন্ত্রপাতি ইত্যাদি সহ দুটি মোটরসাইকেল – যার কাগজপত্র দেখে দিল্লি পুলিশ বুঝতে পারলো যে সেই মোটরসাইকেলদুটোর মধ্যে একটার মালিক সওকৎ আরেকটার মালিকানা রয়েছে ‘মৃত টেররিস্ট’ মহম্মদের নামে।
পুলিশি তদন্তের যে সব ফাঁকফোকর কোনোদিন ভরা হবে না
এইখানে এসে বলা ভালো যে উক্ত ‘মৃত টেররিস্ট’ মহম্মদ ব্যতিরেকে বাকি চারজন যাঁরা সেইদিন শহীদ হয়েছিলেন তাঁদের কোন সূত্র, কোন লীড তো দূরস্ত, কোন নাম-বিবরণটুকু পর্যন্ত অনুপস্থিত কোর্টের রেকর্ডে।
আরো বলা ভালো যে, কি কারণে নিজেদের নামেই ফোন-বাইক কিনে, তারপরে ছদ্মনামে গাড়ি ভাড়া নিয়ে, হাতে-আঁকা টপোশীটের ভিত্তিতে, একটা সাদা কাগজে বেফজুল কিছু ফোন নম্বর লিখে সেটাও ট্যাঁকে গুঁজে পার্লামেণ্ট-এ হামলা করতে গিয়েছিলো সেদিনের আজাদীর সেই পাঁচ শহীদ, ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টের ভাষায়, ‘ডীসিইসড টেররিস্টস’ – এই ঘটনাক্রম কতটা বাস্তবসম্মত, অথবা, এই যে হামলার ৪৮-র ঘণ্টার মধ্যে সকল অভিযুক্ত পুলিশী হেফাজতে আবদ্ধ হলো একে অপরের আধা-ঘণ্টাখানেকের ব্যবধানে, অথচ, একে অপরের জবানবন্দীর উপর ভিত্তি করেই – এই ন্যারেটিভের অবান্তরতা নিয়ে কোন আলোচনা মহামান্য আদালতত্রয় করেন নি। পুলিশের ন্যরেটিভ অখণ্ড ও অক্ষুণ্ণ রয়ে গ্যাছে শেষ অবধি। গ্রেফতার হওয়ার পৌনে চার বছরের মাথায় তার ফাঁসির আদেশ আপহোল্ড করে মহামান্য শীর্ষ আদালত, ভারত। ২০১৩ সালের ৩-রা ফেব্রুয়ারি আফজল গুরুর ‘মার্সি পিটিশান’ নামকুব করেন ভারতবর্ষের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি। এই (অ-)ঘটনার ৬ দিনের মাথায়, ০৯-ই ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তারিখে ফাঁসি হয়ে যায় আফজল গুরু-র।
[ক্রমশ…]
Posted in: ARTICLE, July 2021 - Serial