গূঢ়ৈষা – সাহিত্যে সমালোচনায় : অর্ঘ্যদীপ ব্যানার্জী
কথামুখ –
সাহিত্যগুরুর ভাষা ধার করেই বলা যেতে পারে মানবচরিত্র ও মানবমন নিয়েই সাহিত্যের পথচলা । মনের গহন প্রদেশের হদিশসন্ধান কেবলমাত্র মনস্তাত্ত্বিকের নয়, সাহিত্যিকেরও অন্বিষ্ট । ফ্রয়েড একবার বলেছিলেন, মনোবিশ্লেষক বিচার বিশ্লেষণের পথ ধরে যে সত্যে উপনীত হন, সাহিত্যিক অনুভবের মাধ্যমে সেই জগতে আগেই পৌঁছে যান । স্বজ্ঞা যেখানে প্রত্যক্ষ বিশ্লেষণের সমগোত্রীয় হয়ে ওঠে, কাব্যের জন্ম সেখানেই ।
বর্তমান আলোচনায় আমরা খুঁজে দেখতে চেষ্টা করব, সাহিত্যে মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাত, একটি উপন্যাস (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চোখের বালি’) এবং একটি ছোটগল্প (বিমল করের ‘আত্মজা’) অবলম্বনে । মনস্তাত্ত্বিক পরিভাষায় ইদিপাস ও ইলেকট্রা গূঢ়ৈষা সর্বজনবিদিত । এই দুই মনস্তাত্ত্বিক পরিভাষার সাহায্যে উক্ত সাহিত্যকর্মের হবে বিশ্লেষণ । সেই সঙ্গে মনস্তত্ত্বের দিক থেকে তাত্ত্বিক বিরোধের দিকটিও তুলে ধরা হবে ।
সূচক শব্দ তথা আলোচনায় কেন্দ্রবিন্দু :-
সফোক্লেস, ফ্রয়েড, ইয়ুং, সার্ত্র, রবীন্দ্রনাথ, বিমল কর, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ফেলিক্স গুয়াত্তারি
মূলপর্ব
এক
ঘটনাটি কাকতলীয় । সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ‘The Interpretation of Dreams’ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ প্রায় সমসাময়িক । প্রথমটি মনোবিজ্ঞানের জগতে এবং দ্বিতীয়টি মনস্তাত্ত্বিক সাহিত্যের জগতে নব দ্বার উদ্ঘাটন করে । সুতরাং ‘চোখের বালি’ লেখার সময়ে রবীন্দ্রনাথ ফ্রয়েড পড়েননি । নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই মনের অন্তঃপুরে প্রবেশ করেছিলেন । সাহিত্যতাত্ত্বিক Frederick J. Hoffman ফ্রয়েড পূর্ববর্তী উপন্যাসকে নৈয়ায়িক যুক্তির স্থল (preconscious or conscious revery) এবং সমসাময়িক উপন্যাসকে অবচেতনস্তরের উপন্যাস বলেছেন ।১ রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসকে এর মধ্যবর্তী পর্যায়ে রাখা যেতে পারে । ‘চোখের বালি’র ভূমিকাংশে ঔপন্যাসিক বলছেন – “আমার সাহিত্যের পথযাত্রা পূর্বাপর অনুসরণ করে দেখলে ধরা পড়বে যে ‘চোখের বালি’ উপন্যাসটা আকস্মিক, কেবল আমার মধ্যে নয়, সেদিনকার বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে …এবারকার গল্প বানাতে হবে এ যুগের কারখানা ঘরে । শয়তানের হাতে বিষবৃক্ষের চাষ তখনো হত এখনো হয় …মনের সংসারের সেই কারখানা – ঘরে যেখানে আগুনের জ্বলুনি হাতুড়ির পিটুনি থেকে দৃঢ় ধাতুর মূর্তি জেগে উঠতে থাকে … চোখের বালির গল্পকে ভিতর থেকে ধাক্কা দিয়ে তুলেছে মায়ের ঈর্ষা । এই ঈর্ষা মহেন্দ্রর সেই রিপুকে কুৎসিত অবকাশ দিয়েছে যা সহজ অবস্থায় এমন দাঁত নখ বের করত না … সাহিত্যের নবপর্যায়ের পদ্ধতি হচ্ছে ঘটনা পরম্পরার বিবরণ দেওয়া নয়, বিশ্লেষণ করে তাদের আঁতের কথা বের করে দেখানো ।” [সূচনা । চোখের বালি । বৈশাখ, ১৩৪৭] কিন্তু পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ফ্রয়েডের তত্ত্বকে সর্বান্তকরণে মেনে নিতে পারেননি । সরসীলাল সরকারের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টভাবে জানান – “ Freud-এর School-এর সঙ্গে এইখানে প্রধান ঝগড়া । আমি বলি Sex-instinct একেবারে গোড়ার কথা নয় । আরও গোড়ার কথা হচ্ছে self-assertion, এই শেষোক্ত instinct sex – instinct অপেক্ষা অনেক বেশী পুরাতন এবং ওতপ্রোতভাবে আমাদের জীবনের ওপর প্রভাব বিস্তার ক’রে রেখেছে । মানুষ জন্মাবার সঙ্গে-সঙ্গেই অহংজ্ঞান (Ego consciousness) নিয়ে জন্মেছে । প্রতি পদে এই ego নিজেকে assert করতে চাইছে, হয়তো প্রতিপদে বিফলও হচ্ছে । একটি ছোট শিশু – সেও চায় recognition পেতে আর সব ভাইএদের মধ্য হ’তে মা তাকেই বিশেষ করে স্নেহ করুক, সেটা না হলেই তার আত্মসম্মানে আঘাত লাগে । তারপর সে যখন school – এ যায়, সেখানেও সে চায় – মাষ্টারের কাছে, সমপাঠীদের কাছে recognition পেতে । বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে এই জিনিষটা আরও বেশী ক’রে দেখতে পাওয়া যায় । প্রণয়প্রার্থীরা (Lovers) যেখানে অকৃতকার্য্য হয় সেখানেও তার দুঃখ তার আত্ম-সম্মানে আঘাত লেগেছে ব’লে, – কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ হয়নি ব’লে নয় । এমন কি, আমি বলি Self-preservation এবং self- propagation এই দুটা self-assertion-এর অন্যতম বিকাশ । Ego মর্তে চায় না, নিজেকে জীবিত দেখতে চায় – সন্তানসন্ততির মধ্য দিয়ে । সুতরাং দেখতে পাচ্ছি এই Sex instinct-এর গোড়ার কথা Ego assertion । এমন কি স্বর্গ – সৃষ্টির পরিকল্পনার মূলেও এই রহস্য রয়েছে … ।”২ তাহলে, রবীন্দ্র উপন্যাস বিচারে ফ্রয়েডকে টেনে আনার প্রয়োজনীয়তা কোথায় ? প্রয়োজন, প্রথমত রবীন্দ্রনাথ ‘চোখের বালি’ লেখার সময়ে ফ্রয়েড পড়েননি, এ কথা যেমন ঠিক, তেমনই এও সত্য শতাব্দী প্রাচীন এই মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের বিচার এই আধুনিক যুগে করতে বসে ফ্রয়েডকে এড়িয়ে যাওয়া কোনমতেই সম্ভব নয় । এবং দ্বিতীয়ত, ‘চোখের বালি’র ওই ভূমিকাংশ । সেখানে উল্লিখিত ‘মায়ের ঈর্ষা’ শব্দবন্ধটি । আমরা জানি উপন্যাস রচনার বহু পরে এই ভূমিকাংশটি লেখা হয়েছিল, সংকলন প্রকাশের তাগিদে । ভূমিকাংশ লেখার সময়ে রবীন্দ্রনাথ ফ্রয়েডের তত্ত্ব পড়ে ফেলেছেন এবং তারও আগে ফ্রয়েডের তত্ত্বসম্পর্কিত আলোচনা এবং সমালোচনাও (To-day and To-morrow series ইত্যাদি) তাঁর অধিগত, সমসাময়িক কালে রবীন্দ্রনাথের ‘প্রান্তিক’, ‘রোগশয্যায়’ ইত্যাদি কাব্যেও এক নিশ্চেতনার কথন আমরা লক্ষ করি । – সেক্ষেত্রে কি ফ্রয়েডের প্রভাব একেবারে উপেক্ষণীয় ? বিশেষত যেখানে ‘মায়ের ঈর্ষা’ নির্ভুলভাবে ফ্রয়েডের ‘ইদিপাস গূঢ়ৈষা’ (Oedipus complex) তত্ত্বকে মনে করিয়ে দেয় । তবে এখানেই শেষ নয়, আরও আছে । ভূমিকাংশের দাবি কি উপন্যাস পূরণ করে ? অর্থাৎ ভূমিকা এবং উপন্যাসের মধ্যে কি কোন ব্যবধান থেকে গিয়েছে ? অধ্যাপক সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে বলছেন – “এই ক্ষুদ্র মন্তব্যের ফলে (মায়ের ঈর্ষা) ‘চোখের বালি’ সম্বন্ধে আমাদের আকাঙ্খা উচ্চাশার পাহাড়ে চড়ে বসে । অথচ ‘চোখের বালি’তে তার সমর্থন নেই । মহেন্দ্রর জীবনে বিনোদিনীর সূত্রে যে-সব অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হল, মায়ের ভূমিকা সে অভিজ্ঞতা রচনায় কতটুকু দায়ী ? রবীন্দ্রনাথ যেভাবে বলেছেন যে, মায়ের ঈর্ষা সমস্ত ব্যাপারটাকে দারুণ করে তুলেছে – ঈর্ষার সে জাতীয় কোনো স্থায়ী ভূমিকা ছিল কি না ? ‘চোখের বালি’ দুটি প্রশ্নেরই না-বাচক উত্তর দেবে । রাজলক্ষ্মীর গ্রাম-বাস গমনের পশ্চাতে অবশ্যই পুত্রের প্রতি বিরক্তি এবং আশার পুত্রবধূ হিসাবে অক্ষমতা প্রধানত তার মূলে । রাজলক্ষ্মীর ঈর্ষার ভূমিকা রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট করেই দেখিয়েছেন । বিশেষ বিনোদিনীর আতিথেয়তায় সেবায় আশার বিপরীত তুলনা রাজলক্ষ্মীর মনে ক্রিয়াশীল হয়েছে । ঈর্ষার ভূমিকা এইটুকু ।৩
উপরিউক্ত সমালোচনা সামনে রেখে, এবার উপন্যাস বিশ্লেষণে অগ্রসর হওয়া যাক । তবে তার আগে ইদিপাস ও ইদিপাস গূঢ়ৈষা সম্পর্কে কিঞ্চিত আলোচনা প্রয়োজন ।
সফোক্লেসের ইদিপাস (শিশিরকুমার দাশের অনুবাদে ওইদিপৌস । শম্ভু মিত্রের অনুবাদে অয়দিপাউস ) নিয়তিনির্ধারিত ‘ট্রাজেডি’র মধ্যে নিষ্ঠুরতম নাট্যকর্ম । আমরা জানি, গ্রিক ট্রাজেডির চরিত্ররা প্রাচীন পুরাণ, মহাকাব্য থেকে গৃহীত । ইদিপাসের কাহিনি হয়তো সেই সময়ের যখন সমাজে যৌননীতি নির্ধারিত হয়েছে সবেমাত্র, অজাচার নিষিদ্ধ । এই যুগের সংকটই ইদিপাস চরিত্রের মধ্যে প্রকাশিত । চার্লস সেগাল লিখেছেন, সভ্যতার অন্তর্বিরোধ (পশুত্ব ও মনুষ্যত্ব) ইদিপাসের ক্ষেত্রে যেভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তেমন আর কারোর ক্ষেত্রে ঘটেনি । শৈশব থেকে সাবালকত্ব পর্যন্ত মানুষকে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান, রীতিনীতির মধ্য দিয়ে গিয়ে সভ্যতায় উত্তীর্ণ হতে হয় । ইদিপাসের ক্ষেত্রে ঘটে গিয়েছে বিপর্যয় । সে যেন আবার আদিমতার দিকে ফিরে যাচ্ছে । –
“ওইদিপৌস ।। আমার জীবন ইতিহাস আর প্রাক্-ইতিহাসের সংঘাত, সভ্যতা ও বর্বরতার সংগ্রাম । আমার
অন্ধত্ব এই সংঘাতের ফল ।
ধৃতরাষ্ট্র ।। বুঝতে পারছি না আপনার কথা ।
ওইদিপৌস ।। যেদিন মানুষ রচনা করেছিল সমাজ, সেদিন থেকেই তৈরি হয়েছে কতকগুলি নিয়ম, সেই
নিয়মগুলি বর্বরতা আর সভ্যতার সীমাচিহ্নরেখা । সেই চিহ্নরেখায় দাঁড়িয়ে আছেন –
ধৃতরাষ্ট্র ।। ঈশ্বর –
ওইদিপৌস ।। না, ইশ্বর নয় । ঈশ্বর মধ্যে মধ্যে ইতিহাস প্রবেশ করেন । কিন্তু তিনি ইতিহাসের বাইরে, কালের বাইরে । ওই চিহ্নরেখায় দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের জনক এবং জননী । বা জনক-জননী ও সন্তানের সম্পর্ক ।” ৪
ইদিপাস নিজ মাতাকে বিবাহ করেছিল । যদিও বিবাহের সময়ে প্রকৃত পরিচয় ছিল অন্তরালে । সত্য উদঘাটনে ইদিপাস হয়ে পড়ে দিশাহারা ।
“কোথায় সে, কোথায় আমার স্ত্রী,
স্ত্রী এবং স্ত্রী না,
কোথায় সেই মাটি
যেখানে আমার উদগম
কোথায় সেই মাটি
যেখানে আমার লাঙল ফসল ফলিয়েছে ?
. . .
ওইদিপৌস
মাথার মুকুট আজ মাটিতে লুটায়
যেদিন নারীর বুকে নিয়েছ আশ্রয়
পুত্র ও পিতার এক নারী, অভিন্ন বন্দর,
এ কী বীভৎসতা !” ৫
ইদিপাস বেছে নেয় স্বেচ্ছা অন্ধত্ব । এবং রানী তথা রাজমাতা ইয়কাস্তে – “রানী দুই হাতে নিজের কেশ আকর্ষণ করতে করতে উন্মত্তের মতো নিজের শয়নকক্ষের দিকে ছুটে গিয়ে সেই বিরাট কবাট দুটো সশব্দে বন্ধ ক’রে দিলেন । তারপর মৃত রাজা লাইয়সের নাম ধ’রে তিনি আর্ত চীৎকারে ডেকে উঠলেন । স্মরণ করলেন, যে তাঁরই গর্ভ এক অভিশপ্ত জাতির জন্ম দিয়েছে । রানী আর্ত হাহাকার ক’রে বলতে লাগলেন, যে তিনি স্বামীর ঔরসে স্বামীর জন্ম দিয়েছেন – পুত্রের ঔরসে পুত্রের ।” ৬ আত্মহত্যাই হয়ে ওঠে তার একমাত্র পথ । ফ্রয়েডের মতে ঘটনাচক্রে ইদিপাসের সঙ্গে তার মা ইয়কাস্তের যে সম্পর্ক হয়, তা আসলে ইদিপাসের অবদমিত ইচ্ছা । “King Oedipus is what is called a ‘tragedy of fate’; its tragic effect is said to rest on the contrast between the all-powerful will of the gods and the vain efforts of mankind, threatened with disaster, to thwart it …If King Oedipus is no less unsetting for modern man than it was for contemporary Greeks, the answer can presumably only be that the effect of Greek tragedy does not rest on the contrast between fate and human will but must be sought in the special nature of the material used to demonstrate that contrast …King Oedipus, who struck his father Laius dead and married his mother Jocasta, is simply the wish – fulfilment of our childhood years … our first sexual stirring at our mother, our first hatred and violent wish at our father; our dreams persuade us of that.”৭ স্বপ্নে পিতার মৃত্যু দর্শন আমাদের সুপ্ত ইচ্ছারই কুন্ঠিত প্রকাশ-এমনই ফ্রয়েডের দাবী । এবং তিনি আরও বলেন টোটেম উৎপত্তির ইতিহাসের পিছনেও এটিই কারণ । মাতাকে কেন্দ্র করে পিতার সঙ্গে বিরোধ হেতু পিতৃহত্যা এবং তদ্দজনিত অনুশোচনা তার মধ্যে যে উভবলতা ও দ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছে, তারই বস্তুগত প্রকাশ টোটেম । “টোটেম প্রাণী আসলে পিতার প্রতিরূপ, এই সত্য মনঃসমীক্ষণ আবিষ্কার করেছে । এর সাহায্যে সাধারণভাবে টোটেম প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ করা ছুটির উৎসবের দিনে তাকে হত্যা করা এবং তাকে হত্যা করে আবার তার জন্য বিলাপ করা, এই সমস্ত অসঙ্গতির একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় । যে উভয়বলি প্রক্ষোভীয় মনোভাব আজও আমাদের শিশুদের মনে পিতৃ-গূঢ়ৈষার পরিচায়ক এবং যা প্রায়ই বয়স্ক জীবনেও প্রসারিত হচ্ছে তা-ই পিতার প্রতিরূপ টোটেম প্রাণীর প্রতিও সম্প্রসারিত হয় ।” ৮ শিশুর জন্মের পর স্বতঃরতি (auto-erotism), আত্মরতি (narcissism) পেরিয়ে বস্তুরতিতে (object sexuality) পৌঁছয় । উপস্থস্তুর (Genital phase) মোটামুটি ২ বছর থেকে ৩/৪ বছর অবধি । অপরবস্তুর প্রতি যখন শিশুর কামনা ধাবিত হয় তখন মা-ই হয়ে ওঠে প্রথম প্রেমের ব্যক্তি । কিন্তু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে সে, যে এটি অনুমোদিত নয় । তখন তা অবচেতনে চলে যায়, এর পরেই আসে Latency period । যারা এই ভারসাম্য রক্ষা করতে পারেনা, তাদেরই হয় মানসিক বিপর্যয় । ফ্রয়েড বলেছেন – “Every new arrival on this planet is faced with the task of mastering the Oedipus complex ; anyone who fails to do so falls a victim of neurosis. The Oedipus complex was viewed as the central linear developmental phase driven by libido and aggression and structured by universal unconscious fantasies. These fantasis express, in their positive form, sexual desire for the opposite gendered parent and competitive, aggressive rivalry with the same gendered parents.” ৯ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য উপস্থচ্ছেদ ভীতি (Castration fear) এবং ইদিপাস আখ্যানের বিপ্রতীপে গিরীন্দ্রশেখর বসু ভারতের শিব-গণেশের আখ্যানকে স্থাপন করেছিলেন । সাধারণ দৃষ্টিতে আমরা মা-ছেলে এবং বাবা-মেয়ের সম্পর্কে এক বিশেষ প্রবণতা লক্ষ করি । এবং এই প্রবণতা উভমুখী । অর্থাৎ মাও তার পুত্র সন্তানের প্রতি এবং বাবা তার কন্যাসন্তানের প্রতি অধিকমাত্রায় স্নেহশীল । ফ্রয়েডের মতে ঊর্ধ্বায়িত অভীসা (Sublimited Libido) পরিবর্তিত হয়ে ভক্তি, শ্রদ্ধা, স্নেহের রূপ নেয় । এক্ষেত্রে পুত্র ও কন্যা সন্তানের বড় হওয়ার সঙ্গে তাদের পরিবর্তন এবং তাদের প্রতি অভিভাবকের মনোগত আকর্ষণও কীভাবে পরিবর্তিত হয়, সেই অপরস্বরের চিহ্ন মেলে সাহিত্যে ।
‘চোখের বালি’ উপন্যাসে মহেন্দ্র মাতৃগতপ্রাণ । “কাঙারু শাবকের মতো মাতৃগর্ভ হইতে ভূমিষ্ঠ হইয়াও মাতার বহির্গর্ভের থলিটির মধ্যে আবৃত থাকাই তাহার অভ্যাস হইয়া গিয়াছিল । মার সাহায্য ব্যতীত তাহার আহার বিহার আরাম কিছুই সম্পন্ন হইবার জো ছিল না ।” (পৃঃ – ১৯৫) অর্থাৎ মা ছিল রক্ষাকবচ । এ হেন মহেন্দ্রর কাছে ‘বিবাহের কথা পড়িবার জো’ ছিল না । বিনোদিনীর সঙ্গে বিবাহের একপ্রকার কথাবার্তা হয়েও হঠাৎ মহেন্দ্র পিছিয়ে আসে । মহেন্দ্রর দ্বিধা ও ভয়ের কারণ কি এই যে, স্ত্রী যদি মাতার প্রতিরূপ না হয় ? বিনোদিনী পর্বের বছর তিনেক পরে মা-ছেলের বার্তালাপ হয় এই প্রকার –
“বাবা, লোকে যে আমাকেই নিন্দা করে ।কেন মা, লোকের তুমি কী সর্বনাশ করিয়াছ । পাছে বউ আসিলে ছেলে পর হইয়া যায়, এই ভয়ে তোর বিবাহ দিতেছি না, লোকে এইরূপ বলাবলি করে । মহেন্দ্র কহিল, ভয় তো হওয়াই উচিত । আমি মা হইলে প্রাণ ধরিয়া ছেলের বিবাহ দিতে পারিতাম না । লোকের নিন্দা মাথা পাতিয়া লইতাম । মা হাসিয়া কহিলেন, শোনো একবার ছেলের কথা শোনো । মহেন্দ্র কহিল, বউ আসিয়া তো ছেলেকে জুড়িয়া বসেই । তখন এত কষ্টের এত স্নেহের মা কোথায় সরিয়া যায়, এ যদি-বা তোমার ভালো লাগে, আমার ভালো লাগে না ।” (পৃঃ-১৯৬) এর মধ্যেই ফুটে উঠেছে উভয়ের মনোভাব । এই মহেন্দ্রই আশাকে দেখে অস্থির হয়ে ওঠে । যেমন হঠাৎ করে বিনোদিনীকে বিবাহ করবে না বলেছিল, তেমন হঠাৎ করেই আশালতাকে বিবাহের জন্য জেদ ধরে । আশার মধ্যে কি মহেন্দ্র রাজলক্ষ্মীর আনুগত্যের ছায়া দেখেছিল ? এমনই এক মেয়ে যে মায়ের মতই মহেন্দ্রর অনুগত থাকবে ? কিন্তু এ যদি মহেন্দ্রর মাতৃকল্প আকাঙ্ক্ষার এক দিক হয়, অন্যদিক হল রাজলক্ষ্মীর কর্মপটুতা, দৃঢ় চারিত্রিক জোর । এটা মহেন্দ্র খুঁজে পেয়েছে বিনোদিনীর মধ্যে ।
অন্যদিকে রাজলক্ষ্মীর দিক থেকে ‘মায়ের ঈর্ষা’র যুক্তিযুক্ততা বিচার্য । বিনোদিনী অবশ্যই এসেছে পুত্রবধূর বিকল্পে ছেলের বৌ-এর বিকল্পে নয় । এখানেই আপত্তি তুলেছেন সমালোচক, যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে । বিনোদিনী যখন রাজলক্ষ্মীর তিরষ্কারের উত্তরে বলে – “নিজের মনও কি সবই জানে । তুমি কি কখনো বউয়ের উপর দ্বেষ করিয়া এই মায়াবিনীকে দিয়া তোমার ছেলের মন ভুলাইতে চাও নাই ?” (পৃঃ-২৮০) এর প্রত্যুত্তরে রাজলক্ষ্মী বলে – “হতভাগিনী, ছেলের সম্বন্ধে মার নামে তুই এমন অপবাদ দিতে পারিস ? তোর জিব খসিয়া পড়িবে না !” (পৃঃ-২৮১) যদি বিনোদিনী ছেলের বৌয়ের বিকল্পই হত, তাহলে রাজলক্ষ্মী এমন প্রত্যুত্তর করতে পারত না, বা করলেও পরে অপরাধবোধে জর্জরিত হত । কিন্তু তা দেখা যায় না । মহেন্দ্রর দেখাশোনার ভার দিয়ে ছিল রাজলক্ষ্মী বিনোদিনীর হাতে, গভীর পুত্রগৌরব ও বিশ্বাস থেকে । “এই অকর্মণ্য একান্ত মাতৃস্নেহাপেক্ষী বয়স্ক সন্তানটিকে সর্ব্বপ্রকার আরামে রাখিতে পারিবেন, বিনোদিনীর সহিত রাজলক্ষীর সেই একমাত্র পরামর্শ । এই পুত্রসেবা ব্যাপারে বিনোদিনীর প্রতি নির্ভর করিয়া তিনি নিতান্ত নিশ্চিত, পরম সুখী । সম্প্রতি বিনোদিনীর মর্যাদা যে মহেন্দ্র বুঝিয়াছে এবং বিনোদিনীকে রাখিবার জন্য তাহার যত্ন হইয়াছে, ইহাতেও রাজলক্ষ্মী আনন্দিত ।” (পৃঃ-২৬৬) অর্থাৎ রাজলক্ষ্মী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবেই বিনোদিনীকে নিয়োজিত করেছে । বিনোদিনী তার অন্য অর্থ করে থাকতে পারে । অন্যদিকে বিনোদিনীর মর্যাদা লাভেও তিনি আনন্দিত । কিন্তু ওইটুকুই । মায়ের ঈর্ষার প্রেক্ষাপট আসলে লুকিয়ে আছে অন্য জায়গায় । সেই ঈর্ষার পাত্র আশালতা নয়, কারণ মহেন্দ্রর ওপরে আশার অধিকার খর্ব করার সেরকম প্রয়াস রাজলক্ষ্মীর লক্ষ করা যায় না । ঈর্ষার পাত্র প্রকৃতপক্ষে অন্নপূর্ণা । ‘চোখের বালি’ উপন্যাস দু’জন পুরুষকে ঘিরে চারজন নারীর স্থান ও অধিকার দখলের লড়াই । পুরুষতান্ত্রিক ঈঙ্গিতগুলি উপন্যাসে ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে, যার ভিত্তিতে এক নারীবাদী পাঠও গড়ে তোলা যায় । কিন্তু তা অন্যপ্রসঙ্গ । এখানে উপন্যাসের প্রথম দিকে মহেন্দ্রর বিবাহের বিপক্ষে সাফাই দেওয়ায় অন্নপূর্ণা বলেছিল – “এ তোমার, বাছা, বাড়াবাড়ি । যখনকার যা তখন তাই শোভা পায় । এখন মার আঁচল ছাড়িয়া বউ লইয়া ঘরকন্না করিবার সময় আসিয়াছে, এখন ছোটো ছেলেটির মতো ব্যবহার দেখিলে লজ্জা বোধ হয় ।” (পৃঃ-১৯৬) রাজলক্ষ্মীর উত্তরটি লক্ষণীয় – “এই প্রসঙ্গে তিনি যে-কটি কথা বলিলেন, তাহা সরল হইতে পারে, কিন্তু মধুমাখা নহে । কহিলেন ‘আমার ছেলে যদি অন্যের ছেলেদের চেয়ে মাকে বেশি ভালোবাসে, তোমার তাতে লজ্জা করে কেন মেজবউ ।” (পৃঃ- ১৯৬) এর পরে রাজলক্ষ্মীর হাবভাবেও দেখা গেছে,সে মনে করে অন্নপূর্ণা ডাকিনী, রাজলক্ষ্মী নিজে শুদ্ধ মা । এবং রাজলক্ষ্মী এও মনে করত পুত্রহীনা অন্নপূর্ণা, পুত্রসৌভাগ্যবতীকে ঈর্ষা করছে । অর্থাৎ জটিলতা এইখানেই । এরপর যখন রাজলক্ষ্মীর মনোনীতা পাত্রীকে ফিরিয়ে দিয়ে অন্নপূর্ণার ভাইঝিকে মহেন্দ্র বিবাহের ইচ্ছা প্রকাশ করে, তখন তা সহ্যাতীত হয়ে ওঠে । এ যেন অন্নপূর্ণার জিত । এর সঙ্গে ছিল অনাথা মেয়ের সঙ্গে বিবাহে কুটুম্বিতার অসুবিধা । “বাপ-মা-মরা অলক্ষণা কন্যার সহিত আমার এক ছেলের বিবাহ দিয়া তুমি আমার ছেলেকে আমার কাছ হইতে ভাঙাইয়া লইতে চাও ? এতোবড় শয়তানি !” (পৃঃ-২০০) স্পষ্টভাবে ঈর্ষার জায়গাটি ফুটে ওঠে । এর বাইরে যা ছিল তা তীব্র অভিমান । যে ছেলে মা ছাড়া আর কিছু জানত না, সে আর মায়ের খোঁজ রাখে না । এ বড় অভিমানেরই কথা । এই অভিমানই কাজ করে রাজলক্ষ্মীর বারাসত যাওয়ার পিছনে । একে অনবদ্য উপমায় ঔপন্যাসিক রাজলক্ষ্মীর মনোভাবকে দেখিয়েছেন – “গ্রীষ্মে নদী যখন কমিয়া আসে তখন মাঝি যেমন পদে পদে লগি ফেলিয়া দেখে কোথায় কত জল, রাজলক্ষ্মীও তেমনি ভাবান্তরের সময় মাতাপুত্রের সম্পর্কের মধ্যে লগি ফেলিয়া দেখিতেছিলেন ।” (পৃঃ-২০৮) এই অভিমানই দেখা যায় মহেন্দ্রর গৃহত্যাগের পরে । “বুড়ো মা মরেও না, অথচ কেবল ব্যামো লইয়া তাহাকে জ্বালায় ।” (পৃঃ- ৩১৬) তবে মানুষের প্রক্ষোভ – আবেগ কোন নির্দিষ্ট স্তরায়িত মনোবৃত্তি নয় । একটার খোপে অন্যটা অনায়াসেই বসতে পারে । তাই অভিমান, ঈর্ষা, স্নেহ, প্রেম প্রায়শই স্থানবিনিময় করে । একের মধ্যেই থেকে যায় অন্যটির বীজ ।
রাজলক্ষ্মী ও মহেন্দ্রর চরিত্রের একটিই মিল আত্মপরতা । সেই আত্মপর মনোভাব রাজলক্ষ্মীর, ধূলিসাৎ হয়েছিল মহেন্দ্রর কাছে । মহেন্দ্রর গৃহত্যাগে একসময়ে আশাকে মনে মনে দায়ী করলেও, পরে তাকেই কাছে টেনে নেয় রাজলক্ষ্মী । কারণ, এখন দুজনেরই নিরাশ্রয় অবস্থা । তেমনি মহেন্দ্রর আত্মপরতা ভূলুন্ঠিত হয় বিনোদিনীর কাছে ।
দুই
পিতা-কন্যার সম্পর্কে ফ্রয়েড বলেছিলেন, এটি নেতিবাচক ইদিপাস গূঢ়ৈষা (Negative Oedipus complex) । কিন্তু ইয়ুং এতে সন্তুষ্ট না হয়ে পরবর্তীকালে একে ‘ইলেকট্রা’ (গ্রিক উচ্চারণে ইলেকত্রা/ইলেকত্রে) গূঢ়ৈষা বলে চিহ্নিত করেছেন । ইয়ুঙের মতে – “As far as I can see, the first love of the child belongs to the mother, no matter which its sex. If the love for the mother at this stage is intense, the father is jealously kept away as a rival. Of course, for the child itself , the mother has in this early stage of childhood no sexual significance of any importance. The term ‘Oedipus- complex’ is in so far not really suitable. At this stage the mother has still the significance of a protecting, enveloping, food- providing being , who, on this account, is a source of delight… certainly , a relatively germinating eroticism is also connected with it. This element gradually increases as the year go on, so that Oedipus- complex soon assums its classical form… in the daughter the typical affection for the father develops, with a correspondingly jealous attitude toward the mother. We call this complex, the Electra- complex. As everybody knows, Electra took revenge on her mother for the murder of her husband, because that mother had robbed her of her father”১০ । ফ্রয়েড এ প্রসঙ্গে শরীর গঠনের কথা তুলে ধরেন – “The results , however, are different precisely because the physical, anatomy of boys and girls is different…it is because Anatomy is Destiny”১১ তবে ফ্রয়েড ‘ইলেকট্রা গূঢ়ৈষা’ – এই পরিভাষাটি মেনে নেননি । কিন্তু কন্যসন্তানের মায়ের প্রতি আসক্তি থেকে বাবার প্রতি আসক্তির বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে একে আবর্তিত ইদিপাস গূঢ়ৈষা (Inverted Oedipus complex) বলে অভিহিত করেছেন । মায়ের প্রতি মেয়ের বিরোধিতা গড়ে ওঠার পিছনে রয়েছে লিঙ্গ-ঈর্ষা (Penis envy) এবং সে মাকেই দায়ী করে এর জন্য । এখানে এক হীনন্মন্যতার জন্ম হয় এবং কন্যা আকৃষ্ট হয় পিতার প্রতি, যেহেতু পিতা পুরুষ । লিঙ্গধারী । এবং মাকে মনে করে প্রতিদ্বন্দ্বী ।
এলেক্ত্রে : আমার অল্প বয়সের একগুঁয়েমি ? তাহলে এই তোমার যৌবন যার জন্য অনুশোচনা করছ,
সেইটেই তোমার পাপের চেয়ে বড় । আমার যৌবনকে তুমি ঘৃণা কর । আমার নিষ্পাপ মনকে
তুমি আরও বেশি ঘৃণা কর ।
ক্লিতেমনেস্ত্রে : এলেকত্রে, তোমার মধ্যে আমি যেটা ঘৃণা করি, সেটা আমি । সেটা তোমার যৌবন নয়, না-একেবারে না, তা আমারই ।
এলেকত্রে : আর আমি ঘৃনা করি তোমাকে-তোমাকে ।
ক্লিতেমনেস্ত্রে : কি লজ্জা ! আমরা নিজেদের গালাগালি দিচ্ছি যেন দুজনে একই পুরুষের প্রেমের
প্রতিদ্বন্দ্বী । অথচ আমি তোমার মা …” ১২
তবে পরবর্তী সময়ে মায়ের সঙ্গে মেয়ে একাত্ম হয় নারীত্বের অধিকারী হয়ে ; কিন্তু তার মধ্যে অধিশাস্তার (super ego) বোধ কম থেকে যায়, এমনই ফ্রয়েডের অভিমত ।
‘ইলেকট্রা’কে নিয়ে সফোক্লেস এবং ইউরিপিদিস দুজনেই নাটক রচনা করেন । ট্রয় যুদ্ধ ফেরত রাজা আগমেমননকে হত্যা করে তার মহিষী ক্লিতেমনেস্ত্রে । সেই হত্যার প্রতিশোধ নেয় ইলেকট্রা, ভ্রাতা ওরেসতেসকে দিয়ে মাতৃহত্যা করিয়ে । মাতৃহত্যা ওরেসতেসকে এক পাপরাজ্যের সামনে নিয়ে যায় । এমনই ঘটেছিল আমাদের আখ্যানে পরশুরামের ক্ষেত্রে । আখ্যানকারের লেখনীতে দুজনের কাল্পনিক সংলাপ অনবদ্যভাবে ফুটে উঠেছে, যেখানে দুই ব্যক্তি এবং সংস্কৃতির দ্বন্দ্বও লক্ষণীয় ।
পরশুরাম ।। … যে যুক্তিতে তুমি মাতৃহত্যা সমর্থন করছ, গ্রীক রাজপুত্র, সেই যুক্তিতেই এই পিশাচিনীরা
ছুটছে তোমার পেছনে । তোমার মা হত্যা করেছেন তাঁর স্বামীকে তাই তুমি হত্যা করেছ
তাঁকে । তুমি হত্যা করেছ এক নারীকে, তাই ওই বিধাতার মৃত্যুদূতীরা হত্যা করতে এসেছে
তোমাকে । …
ওরেসতেস্ ।। আমি বুঝতেই পারছি না তোমার কথা, পরশুরাম । তোমার মনে কাজ করছে এক প্রবল
সংস্কার । তুমি এত ভীত, এত দুর্বল কারণ তুমি যাকে হত্যা করেছ সে তোমার জননী । …
পরশুরাম ।। ঠিক বলেছ ওরেসতেস্ । তোমার মনেও কাজ করছে এক সংস্কার । সে সংস্কার পিতার সংস্কার ।
তুমি পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ চাও, তার জন্য জননীর মৃত্যুও তুচ্ছ । আমার সংস্কারও পিতার সংস্কার । আমি তাঁর আদেশ পালন করেছি, তার জন্য জননীর মৃত্যুও উপেক্ষণীয় । একজন জনক, একজন জননী । একজন বীজ, একজন প্রান্তর । কার কাছে বেশি আনুগত্য শস্যের ?” ১৩
প্রসঙ্গত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ইদিপাস গূঢ়ৈষার দৃষ্টিতে উপরিউক্ত বিষয়টির বিচার করা যেতে পারে ।
এবার আসা যাক বিমল কর রচিত ‘আত্মজা’ গল্পটির প্রসঙ্গে । প্রাণবন্ত হিমাংশু আর স্তিমিত হয়ে আসা যূথিকা । এই দাম্পত্যের বৈপরীত্যের মাঝে একমাত্র সন্তান পুতুল । পুতুলের প্রাণোচ্ছলতা হিমাংশুকে করে প্রাণপ্রাচুর্যে পরিপূর্ণ । “হিমাংশু তো সব সময়েই হাসছে । সকাল-দুপুর-সন্ধ্যে-সব সময় ; সর্বত্রই ।” (পৃঃ-১০২) বছর পনেরোর পুতুল সঙ্গী হয় বাবার । মা, যূথিকা যেন সরে যেতে থাকে । যেদিন তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হয় এবং বাড়িতে কেউ থাকে না, সেদিন বাবার সঙ্গে সময় কাটাবার জন্য সে বাবাকে চিরকুট লিখে তারিখ মনে করিয়ে দেয় । “আজই কিন্তু থারটিনথ্, বাবা ; ভুলো না ! সেই রসিদটা আমি তোমার শার্টের বুকপকেটে রেখে দিয়ে গেলাম ।” (পৃঃ-১১১) হিমাংশুরও মেয়েকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে আশ মেটেনা – “হিমাংশু মেয়েকেই দেখছে, সেই মেয়েকেই যার নাম পুতুল, দেখতেও পুতুলের মতনই – অমনই নধর গঠন, সুডৌল, সুশ্রী । টিয়াপাখি রঙের নিউ স্টাইল সোয়েটারে পুতুলকে যেন আরো সুন্দর দেখাচ্ছে, এতই অপরূপ যে, হিমাংশু মেয়ের দিকে তাকিয়ে তন্ময়, তদ্গত ।” (পৃঃ-১০৮) যূথিকা সহ্য করতে পারেনা । “ট্রামে বাসে পৌঁছে দিতে বললে এক্ষুনি বলবে তোমার অফিসের লেট হয়ে গেছে । বুড়ো-ধাড়ি মেয়েকে সঙ সাজিয়ে সাইকেলের পেছনে করে রাস্তা দিয়ে না নিয়ে গেলে তোমার বাহার হয় না !’ (পৃঃ-১০৩) ক্রমশই মেয়ে হয়ে উঠতে থাকে যেন মায়ের প্রতিদ্বন্দী । “চোখাচোখি হল মা আর মেয়েতে । মার চোখ মেয়ের সর্বাঙ্গ লেহন করল । আর পরমুহূর্তেই যূথিকার সারা মুখ থমথমে হয়ে আসে, একটু রোদের আভাস ফুটতে না-ফুটতেই আকাশ যেন আবার কালো মেঘে ছেয়ে যায় ।” (পৃঃ-১০৭) পুতুলও জানে যূথিকার পছন্দ হয়না, হিমাংশু ও তার প্রাণোচ্ছল সম্পর্ক । সে জানে মার ভালো লাগতে পারেনা । তবু সে আর হিমাংশু যূথিকার তাচ্ছিল্য উপেক্ষা করে নিজেদের মত এগিয়ে যায় । যূথিকার অভিযোগ চরমে ওঠে যখন এক রাতে হিমাংশু পুতুলের গায়ে লেপ ঠিক করে দিতে আসে । অভিযোগের সুর সপ্তমে চড়ে যূথিকার – “পাগলামি নয়, যা বলছি তা তোমায় শুনতেই হবে । আমি আর পারছি না – আমার সহ্য-শক্তি আর নেই-নেই … তোমরা-দুজনে-মেয়ে আর বাপে মিলে আমায় শেষ করে ফেলছ । কী চাও তুমি, আমি চলে যাই, আমি মরে যাই ?
এসব কী বলছ !
ঠিক কথাই বলছি । তুমি কী বল ত, মানুষ না পশু ? পুতুল না তোমার মেয়ে ? … (পৃঃ-১১৬) এই অভিযোগ, অপবাদের মত নেমে আসে হিমাংশুর মাথায় । কয়েকটি-মুহূর্ত, যা তাকে ঠেলে দেয় খাদের কিনারায় । হিমাংশুর মধ্যে চলতে থাকে পিতা ও পুরুষের দ্বন্দ্ব । “এই নিষ্ঠুর সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কার কাছে কি গোপন রাখতে পারে সে ? নিজেকে ?” (পৃঃ-১১৭) চরম ঘৃণায় নিজের দিকে তাকায় সে । গায়ের বিষাক্ত রক্ত সে বার করতে থাকে ডানহাতের মণিবন্ধে খুর দিয়ে । কিন্তু রক্তে “কোথাও তো কালো রঙ নেই, সেই কুৎসিত কালো, যাতে পাপের বীজ লুকিয়ে থাকে । নেই, নেই -?” (পৃঃ-১১৯) এক অব্যক্ত যন্ত্রণা সারা শরীর ছেয়ে থাকে । মারা যেতে যেতে দেখে আকাশ ক্রমশ ফর্সা হচ্ছে । সেই আলো-আঁধারিতে দেখতে পায় সদ্যোজাত এক মেয়ে, ধীরে ধীরে পনেরোটি পাপড়ি খুলে সে উন্মোচিত হয় । এ উন্মোচন হিমাংশুর নিজেরও, কারণ মেয়েটি যে তারই নির্মাণ । “ওর আত্মায় এর জন্ম, এর জীবন, এর লীলা … পুতুল আমার আমার কাছে ছোটটি থাক চিরকাল … ও যে আমার ছেলেবেলা, আমার সেই সুখ, সেই মন আর আনন্দ । সেই আত্মা, একটি শুধু অক্ষয় স্মৃতি … একটি মুখ, যা হিমাংশুর আত্মার । যে-ছবি ও নিজেই দেখেছে আর কেউ নয় ।” (পৃঃ-১২১) হিমাংশু পুতুলের মধ্যে নিজের আত্মকেই অনুভব করতে চেয়েছে, মৃত্যুর মুখে তা উপলব্ধি করে । পত্নীকে বলা হয় জায়া । অর্থাৎ যার মধ্য দিয়ে আত্মন পুনরায় জাত হবে । এই সেই ইয়ুং বর্ণিত ‘আত্মন’, যা আদিকল্পের অন্যতম । বা, আরও পিছিয়ে সাংঙ্খ্য দর্শনে অহং থেকে আমিত্বের জন্ম । দেহ, মন, লিঙ্গ পরিচয় ব্যতিরেকে আমিত্বের অনুভব সৃজিত হয় । এইখানেই ফিরে দেখতে হবে এই আলোচনার প্রথমাংশ, যেখানে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, Self-assertionই মূল, Sex-instinct ও তার অঙ্গীভূত । মনস্তত্ত্ববিদ এডলারও প্রায় এমনই মনে করতেন ।
পিতা-মাতা এবং সন্তান । আদিমতম সম্পর্ক । উচিৎ-অনুচিত ব্যতিরেকে এই বন্ধন একান্ত সত্য । সাহিত্যিক-মনস্তাত্ত্বিক প্রমুখ এক দেশকালের গণ্ডিতে নিজেদের মত করে বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করেছেন এই সম্পর্ককে । যুগ ও সভ্যতা পরিবর্তনের সঙ্গে এই সম্পর্কের অনুভাবেরও ঘটেছে পরিবর্তন । নির্মাতা ও নির্মাণ, উৎস ও ফলশ্রুতি একে অপরের অঙ্গাঙ্গী । আমাদের পুরাণের এই জাতীয় একাধিক কাহিনিরও তাই মেলে অন্য তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা । ১৪ কারণ, ফলাফল ও কারণের সম্পর্ক অনির্ণেয় ।
অন্ত্যপর্ব :- (i)
মহেন্দ্র এবং রাজলক্ষ্মীর সম্পর্ক এবং হিমাংশু ও পুতুলের সম্পর্কের প্রধান অমিল হল । রাজলক্ষ্মী বিধবা । তার সর্বস্ব, পুত্র মহেন্দ্রকে ঘিরেই । সেও মহেন্দ্রকে আশ্রয় দিয়েছিল এবং আশ্রয় করেছিল । সেই মাতৃপক্ষপুটে মহেন্দ্র ছিল নিশ্চিন্ত নিরাপদ । ইতরকামিতা যখন অন্য নারীর দিকে ধাবিত হল, তখন সে অবচেতনে হয়তো মাতৃপম কাউকেই চেয়েছিল, কারণ নিজের ভার সে নিজে বইতে পারবেনা । আশালতা আনুগত্য দিয়েছিল ; কিন্তু আশ্রয় দিতে পারেনি । আবার রাজলক্ষ্মীর অনমনীয় ভাব একমাত্র মহেন্দ্রর কাছেই পরাভূত হয় । মায়ের এই দ্বৈতভাবই সে অবচেতনে কারোর মধ্যে কামনা করেছে ।
অন্যদিকে, হিমাংশুর স্ত্রী বর্তমান । কিন্তু স্ত্রীর মধ্যে সে আর পায়না যৌবনের উষ্ণতা । সেই শূন্যতা ভরাট করে পুতুল । পুতুল বয়ঃসন্ধি সদ্য পেরিয়ে এসেছে, Latency period অতিক্রান্ত । সেও পছন্দ করে বাবার সঙ্গ । পনেরোর বছরের মেয়ের বন্ধু হয় বাবা । অচ্ছেদ্য কার্য-কারণ সম্পর্ক ।
(ii)
আচরণবাদী, মানবতাবাদী, অস্তিত্ববাদী মনোবিজ্ঞানীগণ ফ্রয়েডের ইদিপাস গূঢ়ৈষাকে জীবনের লিবিডোর কেন্দ্রে স্থাপন করাকে সমালোচনা করেছেন । তাঁরা মনে করেন, ফ্রয়েড অহেতুক যৌন-প্রেষণার দিকে ঝুঁকে সর্বযৌনতাবাদে (Pansexualism) পৌঁছেছেন । বর্তমানে জীব ও স্নায়ুবিজ্ঞানের সাহায্যে মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, যৌনপ্রেষণার সমস্ত উৎসই অবচেতন নয় । মস্তিষ্কের কার্যাবলির মধ্যে গ্রন্থি ত্থেকে নিঃসৃত জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়াও এর অন্যতম কারণ (Boree,2006) । এডলার সব কিছুর মূল অবচেতনের যৌনাকাঙ্ক্ষা, তা মানতে চাননি, আগেই বলা হয়েছে । ম্যাকডুগাল আবার ফ্রয়েডের পদ্ধতিকেই আপত্তিজনক বলেছেন । কারণ ফ্রয়েডের তত্ত্ব গড়েই উঠেছে মানসিকভাবে অপ্রকৃতিস্থ মানুষদের কেন্দ্র করে । ১৫ তবে ফুকো প্রমুখের পরবর্তীকালে সুস্থতা-অসুস্থতার সীমাবদ্ধতাকে অন্যভাবে দেখা হচ্ছে । যাই হোক, ইদিপাস গূঢ়ৈষাকে সমালোচনা করেছেন নৃতত্ত্ববাদীও নৃতাত্ত্বিক মনস্তত্ত্ববাদীরা । Ruth Benedict ব্যক্তি-অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা কীভাবে অভিব্যক্তির মাধ্যমে সংস্কারের জন্ম দেয়, দেখিয়েছেন (Pattern of culture) । ব্যক্তির সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্ক কখনোই একরৈখিক নয় । Margaret Mead জোর দিয়েছেন পারিবারিক গঠনের ভাঙচুরের ওপর । বিবাহবিচ্ছিন্ন দম্পতির সন্তানের মনোভাব অন্যরকম হতেই পারে । তাছাড়া, ইদিপাস গূঢ়ৈষা বিষমকামী ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে তত্ত্বায়িক ; কিন্তু এর বাইরেও যৌনপরিচয় ও আকাঙ্ক্ষা রয়েছে ।
দ্বিতীয় সমালোচকের পর্যায়ে আছে বামপন্থীরা । মূলত পাভলভ ও রাশিয়াকে কেন্দ্র করে তাদের মনস্তাত্ত্বিক যাত্রা । এর মধ্যে রাজনৈতিক গন্ধ কেউ কেউ খুঁজে পেলেও, তাদের অভিযোগগুলি ভেবে দেখার মত । ধনতান্ত্রিক সমাজের একক পরিবার কাঠামোকে ফ্রয়েড বিকৃতভাবে দেখেছেন বলে তাদের অভিমত । আকাঙ্ক্ষাকে বুভুক্ষায় পরিণত করে ধনতান্ত্রিক ভোগবাদী সমাজ । দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের কলমে – “ওই তথাকথিত Oedipus Complex –এর মধ্যে পিতৃপ্রধান আধুনিক বুর্জোয়া-পরিবারেই অভ্রান্ত প্রতিবিম্ব । ফ্রয়েড তাকে সর্বকালীন মানবচরিত্র বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করলে কেমন করে চলবে ?” ১৬ সবচেয়ে জোরে আঘাত হেনেছেন দেলেউস এবং গুয়াত্তেরি ।
Oedipus restrained is the figure of the daddy mommy-me triangle, the familial constellation in person. But when psychoanalysis makes of Oedipus its dogma, it is unaware of the existence of relations said to be pre-oedipal in the child, exo-oedipal in the psychotic, para-oedipal in others. The function of Oedipus as dogma, or as the ‘nuclear complex’ is inseparable from a forcing by which the psychoanalyst as theoretician elevates himself to the conception of a generalized Oedipus… For what does it mean to say that Freud discovered Oedipus in his own self-analysis ? was it in his self-analysis or rather in his Goethian classical culture ? … The psychoanalyst becomes a director for a private theater, rather than the engineer or mechanic who sets up units of production,…”১৭
বাংলাদেশি মনোবিজ্ঞানী আফরোজ ও ইদিপাস গূঢ়ৈষাকে অনেক দোষে দুষ্ট বলে মনে করেন । ফ্রয়েডের এই অভিক্ষেপণ সম্পূর্ণ নিজস্ব (Subjective), বিজ্ঞানসম্মত নয় । কারণ, ইদিপাস এবং ইয়কাস্তের বিবাহ ঘটনাচক্রে ঘটেছিল । কেউ কারোর প্রকৃত পরিচয় জানত না । তাই এই মত অতিরঞ্জিত । মনোবিজ্ঞানী কোহুতও এই জাতীয় মতই পোষণ করেন । তিনি মনে করেন ফ্রয়েড প্রেষণা ও প্রেষিত কর্মকে এক করে ফেলেছেন অযৌক্তিক ভাবে ।
এছাড়া আরেকশ্রেণির সমালোচনা উঠে এসেছে নারীবাদী মনস্তাত্ত্বিকদের কাছ থেকে । বিশেষত দ্বিতীয়তরঙ্গের নারীবাদী আন্দোলনের তাত্ত্বিকরা অভিযোগ করেছেন । জুলিয়েট মিশেল মনে করেন ফ্রয়েড তাঁর বিজ্ঞান ভাবনায় Overdeterminism-এর শিকার । বিশেষত ‘Anatomy is destiny’ ও ‘Penis-envy’কে বেশিরভাগ নারীবাদীই মেনে নিতে পারেননি । নারীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে মল্লিকা সেনগুপ্তের এই কবিতাটি বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে –
“পুরুষের দেহে এক বাড়তি প্রত্যঙ্গ
দিয়েছে শাশ্বত শক্তি, পৃথিবীর মালিকানা তাকে
ফ্রয়েডবাবুর মত্তে ওটি নেই বলে নারী হীনমন্য থাকে
পায়ের তলায় থেকে ঈর্ষা পৌরুষের প্রতি
… … …
এই লিঙ্গরাজনীতি আদি পুরুষের
ফ্রয়েড আপনি নিজে বাড়তির দলে বলে ধরেই নিলেন
মেয়েরা কমতি, তাই পুরুষের প্রতি তারা ঈর্ষা কাতর ।
আমার শৈশবে কোন লিঙ্গ-ঈর্ষা কখনো ছিল না
আত্মপরিচয়ে আমি সম্পূর্ণ ছিলাম
আজও আমি দ্বিধাহীন সম্পূর্ণ মানুষী…” ১৮
ইদিপাস গূঢ়ৈষার তুল্যমূল্য বিচারে অনেক ত্রুটি থাকলেও, শিশু-যৌনতার বিকাশে এর ভূমিকাকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না । জীবনের সব ঘটনায় এর সরাসরি প্রক্ষেপণ যদিও সম্ভবপর নয় । ১৯
সাহিত্যিক, তত্ত্ব থেকে সেটুকুই গ্রহণ করে যা মানবমনকে অনুধাবন করতে সাহায্য করে । সেই হিসাবে কোন তত্ত্বই বাতিলযোগ্য অথবা শিরোধার্য নয় । একটা সমগ্র মানুষ সুকৃতি, বিকৃতি, লোভ, আশা, প্রেম, অভিমান, ঈর্ষা, রিরংসা, শ্রদ্ধা সবকিছু নিয়েই গড়ে ওঠে, এবং তার মৌল আকরও কোন স্থিরবিন্দু নয় । এই সমগ্র মানুষটিকেই ধরতে চায় সাহিত্যিক । সামগ্রিকতাই সাহিত্যের অন্বিষ্ট ।
____________________________________________________________________________
তথ্যসূত্র ও উল্লেখপঞ্জি :-
আকরগ্রন্থ – চোখের বালি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । রবীন্দ্ররচনাবলী, সপ্তমখণ্ড(উপন্যাস) পশ্চিমবঙ্গ সরকার
সংস্করণ । প্রকাশ আশ্বিন, ১৩৯২ । প্রকাশক – শিক্ষাসচিব, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, মহাকরণ, কলিকাতা – ৭০০০০১ । (N. P) আত্মজা – বিমল কর । বাছাই গল্প । মণ্ডল বুক হাউস । কলিকাতা – ৯ । প্রকাশক – শ্রীসুনীল মণ্ডল । প্রথম প্রকাশ – আশ্বিন ১৩৮৭ । অষ্টম মুদ্রণ – ভাদ্র ১৪১৪ ।
১। সাহিত্যতাত্ত্বিক, অধ্যাপক Frederick J. Hoffman তাঁর ‘Freudianism and literary mind’ (1945) বইতে উপন্যাসকে ৪টি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন ।
(ক) চৈতন্য-যুক্তিবিন্যাস – প্রথম স্তর । (খ) দ্বিতীয় স্তর – প্রাক ফ্রয়েডীয় – নৈয়ায়িক যুক্তি ও চেতন স্তর । (গ) অবচেতনস্তরের উপন্যাস (অস্পষ্ট আত্মকথন, চেতনাসূত্র) (ঘ) অচেতনস্তরের উপন্যাস (স্বপ্ন)
২। রবীন্দ্রনাথ ও মনোবিশ্লেষণ – অধ্যাপক শ্রীঅনিলকুমার বসু (অনুলিখন) । সরসীলাল সরকার রবীন্দ্রনাথের কাব্যের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা পাঠ করেছিলেন বোম্বাই সর্বভারতীয় বিজ্ঞান সম্মিলনীতে । সেই সূত্রেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর আলোচনা হয় । এখানে অংশটি গৃহীত হয়ছে ‘গিরীন্দ্রশেখর বসুর অগ্রন্থিত বাংলা রচনা’ বই থেকে । সংকলন, সম্পাদনা এবং অবতরণিকা – অমিত রঞ্জন বসু । প্রকাশক – অনিল আচার্য । অনুষ্টুপ সংস্করণ – জুন ২০১৭ । কলকাতা – ৯ । পৃঃ- ১৪০ ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই আলোচনার ভিত্তিতে গিরীন্দ্রশেখর বসু মনোবিশ্লেষণের পক্ষ নিয়ে একটি খোলা চিঠি লেখেন প্রবাসীর শ্রাবণ সংখ্যায়, ১৩৩৫ ।
৩। বাংলা উপন্যাসের কালান্তর (রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা উপন্যাসের নব-নিরীক্ষা) – সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় । দেজ’পাবলিশিং । কলকাতা – ৭০০০৭৩ । প্রকাশক – সুধাংশুশেখর দে । প্রথম প্রকাশ – ১৯৬১ । পঞ্চম সংস্করণ (গৃহীত পাঠ) – ২০০৩ । পৃঃ- ১২৯ ।
অলৌকিক সংলাপ (তিন অন্ধ) – অনুবাদক শিশিরকুমার দাশ । এক প্রাচীন গ্রিক ও সংস্কৃত মিশ্রিত সংলাপের পাণ্ডুলিপি থেকে তিনি অনুবাদ করেছেন । পাণ্ডুলিপিটি এক ভারততত্ত্ববিদের কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন । কারিগর । কলকাতা – ৪ । প্রকাশক – দেবাশিস সাউ । প্রথম কারিগর সংস্করণ জানুঃ, ২০১১ । পৃঃ- ৩৪ ।
৫। রাজা ওইদিপৌস (গ্রীক নাটক সংগ্রহ) ভাষ্য-ভাষান্তর – শিশিরকুমার দাশ । দে’জ পাবলিশিং । কলকাতা -৭৩ । প্রকাশক – সুধাংশুশেখর দে । প্রথম প্রকাশ – আগস্ট, ২০১২ । পৃঃ- ১৫৩, ১৫৬ ।
৬। অয়দিপাউস – অনুবাদ – শম্ভুমিত্র । অয়দিপাউস ও পুতুল খেলা । এম. সি.সরকার অ্যাণ্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড । কলকাতা – ৭৩ । প্রকাশক শমিত সরকার । প্রথম সংস্করণ – ১৩৯৪ । ষষ্ঠ সংস্করণ (গৃহীত পাঠ) – ১৪২২ । পৃঃ- ৫১ ।
৭। Interpreting Dreams – Sigmund Freud. Translated by J. A. Underwood. Penguin, England. 1950. P – 275-276 ।
৮। টোটেম ও টাবু – সিগমুণ্ড ফ্রয়েড । ভাষান্তর – ধনপতি বাগ । সুবর্নরেখা । কলকাতা – ৯ । প্রথম প্রকাশ – ১৯৯৩ । চতুর্থ মুদ্রণ (গৃহীত পাঠ) – ২০১৬ । পৃঃ- ১১৪ ।
৯। Three Essays on the Theory of sexuality. The dissolution of the Oedipus Complex In on sexuality, Vol – 7 । Penguin Freud Library – Trans – James Strachey Ed Angela Richards. 1976. P – 313-322.
১০। The Theory of psychoanalysis-Carl Gustav Jung. E-book (http://monoskap.org> File:Jung) . New York . The Journal of nervous and mental disease publishing company. First edition – 1915. P – 69.
১১। Female Sexuality – Sigmund Freud. Standard Edition of the complete psychological works Vol – XXI (1927-1931) Penguion । P – 320.
১২। Fliies – satre. [মক্ষিকা – অনুবাদ : মৃণালকান্তি ভদ্র] বিজ্ঞাপন পর্ব । কলকাতা – ১ । প্রকাশক – রবিন ঘোষ । প্রথম সংস্করণ – ১৯৯৩ । দ্বিতীয় সংস্করণ (গৃহীত পাঠ) -২০১২ । পৃঃ – ৩৬ । সার্ত্র এই নাটকে সফোক্লেসের থেকে বেশি ইউরিপিদিসের আখ্যানকে গ্রহণ করেছেন । এবং সার্ত্র যখন লিখছেন, তখন ইলেকট্রা গূঢ়ৈষা সুবিদিত । তাই সেই Interpretation সার্ত্রর নজর এড়ায়নি । এছাড়া ধনতান্ত্রিক সমাজ ও সমাজতান্ত্রিক সমাজের সংঘাতকে এই নাটকে ঈঙ্গিতে তুলে ধরেছেন ।
১৩। ঐ – ৪ [অলৌকিক সংলাপ । দুই মাতৃঘাতী] । পৃঃ-৫৫ ।
১৪। সন্ধ্যা, ঊষা ইত্যাদি আখ্যানে এই ছবি পাওয়া যায় । একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে – ব্রহ্মা তাঁর সৃষ্ট সরস্বতীকে মুগ্ধতাবশত গ্রহণ করলেন । এর তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা হতে পারে এরকম – স্রষ্টা / আদিপিতা গ্রহণ করলেন বাকশক্তি (বাগ্দেবী – বাক্+দেবী)কে, সৃষ্টি হল শ্রুতি । ব্রহ্মা – বেদ উদ্গাতা ।
১৫। “… Freud formula for the interpretation of dreams may be true of some dreams, more especially of some dreams of some neurotics ; but there is no sufficient ground for trying to force the interpretation of every dream to fit the formula.” [MC Dougall, outlines of Abnormal psychology METHUEN & CO.LTD. LONDON. [http://archiveory/details/in.ernet.dli.2015] . First published – 1926, p – 186.
১৬। ফ্রয়েড প্রসঙ্গে [বিজ্ঞান, সহজবৃত্তি আর ইদিপাস কমপ্লেক্স] – দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ।
অনুষ্টুপ । কলকাতা – ৯ । প্রথম প্রকাশ – ১৩৫৯ । দ্বিতীয় অনুষ্টুপ সংস্করণ (গৃহীত পাঠ) – ২০১৭ (পুনর্মুদ্রন) । প্রকাশক – অনিল আচার্য । পৃঃ- ১৩৬ ।
১৭। Anti – Edipus. Capitalism And Schizophrenia – Gilles Deleuze and Felix Guattari. Translated by Robert Hurley, Mark Seem, Helen R. Lane. University of Minnesota Press. 1972. [Edition – 2000] p – 51-55.
১৮। ফ্রয়েডকে খোলা চিঠি – মল্লিকা সেনগুপ্ত (মূল কাব্য – ‘অর্ধেক পৃথিবী’) বর্তমান উদ্ধৃতাংশটি গৃহীত হয়েছে লেখিকারই ‘স্ত্রীলিঙ্গ নির্মাণ’ বই থেকে । আনন্দ পাবলিশার্স । প্রথম সংস্করণ – ১৯৯৪ । সপ্তম মুদ্রণ – (গৃহীত পাঠ) – ২০১৭ । প্রকাশক – সুবীরকুমার মিত্র । পৃঃ- ৩৭ ।
১৯। মাতৃআকল্প ও ভাবনা চিরন্তন । এঙ্গেলেস ও নারীবাদী দ্বন্দের প্রেক্ষিতে ব্যতিরেকেও এটি বলা যায় [নারীতান্ত্রিক ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দ্বন্দ্ব] । “The most important arehetype to be actualized in the personal psyche of a child is the mother archetype. [Jung – Anthony Stevens, Oxford Press . 1994 P- 50 ] বর্তমানে মুক্তবাণিজ্য ও বিশ্বায়নের যুগে নতুন নীতির কালে আত্মীয় – সংগম (Incest) কে অন্যভাবে দেখার চেষ্টাও চলছে । Rene Guyon তাঁর Sex Life & Sex Ethics (১৯৩৩) বইতে এই যুগ আসার আগেই যেন তার ইঙ্গিত দিয়েছেন – “এই (ইদিপাস) নাটকে সফোক্লেস দেখিয়েছেন, অনেক মানুষের মনে চিরকালই সহজাত প্রবৃত্তি (basic instinct) ট্যাবুর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও প্রকাশিত হয় । ইয়কাস্তে নীতি লঙ্ঘনের ভীতির চেয়ে অবদমনের প্রতি ঘৃণা পোষণ করতেন বেশি ।” (এটি কি ফ্রয়েডের নারীর শিথিল অধিশাস্তার দিকে ঈঙ্গিত করছে ?) তিনি ‘La Fille Perdue’ নাটকের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, আধুনিক যুগে ইদিপাস ও ইয়কাস্তের এমন পরিণতি হয়ত হতনা । যেমন – Perdita প্রেমিক পিতার সঙ্গে ঘর বেঁধেছে ‘La Fille Perdue’ নাটকে, তেমনই কিছু ভাবা যেত । আমাদের মনে পড়ে, জগদীশ গুপ্তের ‘আদিকথার একটি কথা’ ছোটগল্পটি আপাত বৈসাদৃশ্য সত্ত্বেও ।
_____________________________________________________________________
[লেখক – গবেষক, বিশ্বভারতী]