কাশবনের ভাষ্কর্য : শুভংকর গুহ

[“নিজের কিছু কথা ভোরের পাখির মতো সত্য হয়, এই পড়ে পাওয়া জীবনে অস্বীকার করি কি করে? নিজের স্মৃতিকথার সাথে এক ঝাঁক ছাতারে উড়ে আসার দৃশ্যকে মেলাতে গিয়ে দেখি, সবটাই বাতাসে উড়ে যাওয়া খইয়ের মতো লুটোচ্ছে বসতখানার উঠোন জুড়ে। কিছু কথা তুলে নিলে অনেক কথাই আবার যেন থেকে যায়, বাকি শুধু কল্পনা কৃষিজমি কর্ষণের মতো এক অভ্যাস, আত্মকথাকে ক্রমশ উর্বর করে তোলে।”- কথাসাহিত্যিক শুভংকর গুহের আত্মকথা ‘কাশবনের ভাষ্কর্য’। বাবার কর্মসূত্রে পানাগড়, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, মথুরা, কানপুর, এলাহাবাদ সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে বসবাস করেছেন লেখক। সেই যাপনের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি এক সময়ের দলিল নিঃসন্দেহে।]

১১

একাকী জোনাকি মানুষের ঘরে ঘরে ঘুরে কীসের সন্ধান করে, আজও জানতে পারিনি। কখনও কখনও দুইটি জোনাকি ঘরের ভিতরে সম্ভবত গাছ খোঁজে। এত বড় বড় ঘর আকাশের উচ্চতায় ছাঁদ। অনতিদূরেই যমুনা নদীর প্রবাহ। সেখানেই সাময়িক অবসরের মতো জঙ্গল। সেখানে হরিণ লঙ্গুর কিছু বুনো শুয়োর, আর ময়ূর ও পরিযায়ী হাঁসের ক্রেংকার। অরণ্যের জোনাকি বাতাসে ভাসতে ভাসতে গৃহস্ত ঘরের ভিতরে ঢুকে এলে, অন্ধকারে দেওয়াল খুঁজে বেড়ায়। পোকা আকারে বড় হলে, অন্ধকারেও বোঝা যায় তার উড়ান বা এখান থেকে ওখানে যাওয়া।
অরণ্যের জোনাকি জ্বলতে জ্বলতে প্রবল ঘূর্ণিতে মশারি দেওয়ালে ধাক্কা খেতে থাকে। জোনাকির আনারি উড়তে দেখে, আঁধার সমুদ্রে ফেলে আসা ঘটনা খুঁজে যাই। খুঁজতে থাকি স্মৃতির সংকলন এই প্রবীণ বয়সে। জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখলে, মনে হয়, পরিবারের এই কাছারিখানায় আমি একজন হলেও, আমি তো কেউ নই। আমার স্মৃতির অভিধানে এমন কোনো শব্দ নেই যার অনুবাদ হয়।
মথুরার কোয়ার্টারে মাঝে মাঝে একজন প্রবীণ কাঠের মিস্ত্রি আসতেন। চশমা পরে কাঠের মিস্ত্রি খুব একটা দেখা যায়না। এক সময়ে যেমন কলকাতা শহরে বাঙালি ট্রামের পাইলট। রোগা পাতলা, চমৎকার ফার্নিচার রিপেয়ারিংয়ের কাজ করতেন। সাথে চকচকে পেরেক আর স্ক্রু। যে সব ফার্নিচার নড়বড়ে হয়ে যেত, সেইগুলিকে শুশ্রুসার জন্য তিনি বিশ্বস্ত হাতুড়ে ডাক্তার। খুব যে পাকা মিস্ত্রি ছিলেন, এমন তো বলা যায়না। চেয়ার বা টেবিল ও টুল তিনি পাকা হাতে বানাবেন, সেই কথা জানবেন মেইনটেনান্স সুপারভাইজার। আমাদের জানার কথা নয়। প্রবীণ কাঠের মিস্ত্রি খুব কথা বলতেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে তিনি খুব উৎসাহী ছিলেন। বিশেষ করে, ভগত সিং, লালা লাজপত রায়, মহামতি গোখলে, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর বিরাট ভক্ত। কাঠের কাজ করতে করতে তিনি নেতাজি সম্পর্কে তার শ্রদ্ধার কথা জানাতেন। কখনও কখনও তিনি, নিজের ব্যাগ থেকে কাঁচে বাঁধানো নেতাজির ছবি বার করে আমাদের দেখাতেন আর প্রণাম করতেন।
আমাদের বড় ভাই তিনি চিরকাল তর্কপ্রিয়। কেউ যদি বলতেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের গান্ধিজিই হলেন রিয়েল হিরো তখন সে বলত না নেতাজিই ছিলেন রিয়েল হিরো। আর কেউ যদি বলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের রিয়েল হিরো ছিলেন নেতাজি তখন তিনি বলতেন গান্ধিজিই ছিলেন রিয়েল হিরো। এই কথার মধ্য দিয়ে সে সন্ধান করতে থাকত স্বাধীনতা আন্দোলনের নানা তথ্য। সেই প্রবীণ কাঠের মিস্ত্রি নাম ছিল রাধেশ্যাম সিং। তার বাপ ঠাকুরদা জাঠ সম্প্রদায়ের কৃষক। বহু বছর ধরে সামরিক বাহিনীর ক্যাম্পে তিনি কাঠের মিস্ত্রি হিসেবে ফোড়নে কাজ করেন। কাজেই আশেপাশের কার কার বাড়িতে কাঠের ফার্নিচারের হালদশা তার মুখস্ত।
মা মোরাদাবাদী দস্তার গ্লাসে ভর্তি করে দুধের চা দিতেন। সে তাই পেয়ে মহাখুশি। তার বিনিময়ে মায়ের রান্নাঘরের পিড়ে, জলচৌকি, বাসন রাখার কাঠের পাটাতন সব কিছু মেরামত করে দিতেন। আর সেই জাল দেওয়া কাঠের বাক্সটিকে মেরামত করিয়ে আরও মজবুত করিয়ে নিতেন। বাবার বদলির চাকরি কোথাও যেতে হলে, সেই কাঠের বাক্সে খাবার বহন করতে লাগে। আমার খুবই প্রিয় ছিল সেই কাঠের বাক্স। মাঝে মাঝে ভেন্টিলেটার থেকে চড়াই পাখির ছানা যখন পড়ে যেত, শুকনো ঘাস রেখে, সেই বাক্সের ভিতরে চুপি চুপি ছানাগুলিকে রেখে দিতাম। মা পরে দেখতে পেয়ে উত্তম মধ্যম দিতেন। বলতেন,- এই বাক্সে খাওয়ার নেওয়া হয় তুমি জানো না?
তখন কি করে জানব পাখির ছানা আর মানুষের খাবারের মধ্যে এত বিভেদ কেন?
আমাদের কালো রঙয়ের বার্ণিশ করা একটি কাঠের টুল ছিল। বারে বারে এখান থেকে সেখানে যাওয়ার কারণে অনেক কিছুই আর আমাদের সাথে থাকেনি। কিন্তু কাঠের টুলটি আমাদের সঙ্গে বহু বহু বছর ধরে ছিল। আমার মনে আছে, মায়ের বাবা, দাদু এসেছিলেন পাকিস্তান অধুনা বাংলাদেশ থেকে আমাদের বাড়িতে। বাবা তখনও কর্মজীবন থেকে অবসর নেন নি। দাদু ওই কাঠের টুলের ওপরে বসে বারান্দায় সংবাদপত্র পড়তেন। আমাদের বাড়িতে বাঙলা সংবাদপত্র খুব একটা আসত না। ইংরেজি সংবাদপত্র আসত। কিন্তু দাদু যতদিন ছিলেন বাঙলা সংবাদপত্র আসত। কাজেই ইংরেজি ও বাঙলা সংবাদপত্র পড়তে পড়তে দাদু নস্যির কৌটা হাতে নিয়ে সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে দিতেন। তিনি যখন সংবাদপত্র ছাড়তেন তখন নস্যির ধকে খবেরের কাগজের পাতাগুলি হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো হয়ে উঠত।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি, বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের পরিবারে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ। বিশেষ করে মা, সারাদিনের কাজের মধ্যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেন। বারে বারে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলতেন, তোমাদের বাবাকে বারে বারে বলেছিলাম, একবার নিয়ে চলো টাঙ্গাইলে, নিয়েই গেল না মানুষটা।
বাবা মায়ের কথার ওপরে খুব একটা কথা বলতেন না। খুব প্রয়োজন না পড়লে দুইজনে পরস্পর কথা বলতেন। এমনটাই দেখে এসেছি। বরাবর দেখেছি তক্তপোষের ওপরে মা, বাবার উল্টোদিকে বসে কাঠের ফ্রেমে সুই ও রঙ্গিন সুতো দিয়ে পাখি ফুলের ছবি রচনা করছেন, কখনও আশাপূর্ণা দেবী পড়তেন, বাবা খুব পছন্দ করতেন প্রবোধ কুমার সান্যালের ‘মহাপ্রস্থানের পথে’। বাবাকে দেখেছি চিরকাল ‘স্টেটসম্যান’ সংবাদপত্র পড়তে। আর রাত নটার সময়ে বাবা ইংরেজি সংবাদ শুনতে শুনতে শর্টহ্যান্ড প্র্যাকটিস করতেন। বেশ মনে আছে, কলকাতা ‘খ’ বিভাগে ইংরেজি খবর সম্প্রচারিত হত। খবর পাঠ করতেন পামেলা সিং, সুরজিত সিং ও ম্যালকম ডিমেলো। যেদিন পামেলা সিং ও সুরজিত সিং খবর পড়তেন, বাবা খুব আনন্দ পেতেন। কপিং পেনসিলের দাগে শর্টহ্যান্ড খাতা ভরে উঠত।
বাবা বলেছিলেন, তোমার মা বুঝতেই চাইছে না, আমি মিলিটারিতে কাজ করি, আমাদের পরিবারের কারও পাকিস্তানে যাওয়া ঠিক নয়। আমি তোমার মায়ের সঙ্গে গেলে বিপদে পড়ে যাব। মন ও মনের চাহিদাকে অনেক সময় বাস্তব পরিস্থিতি অনুমোদন করে না। এইটি কি তোমার মা বুঝতে পারছে না? জানি বাবা মা ও দেশের থেকে অন্য কিছুই বড় নয়।
বাংলাদেশ থেকে, কোনোরকমে গুপ্ত পথ ধরে চলে এলেন মামা। ওই কালো টুলের ওপরে বসে তিনি বলছিলেন, তাঁকে এবং তাঁর সঙ্গীসাথীদের রাজাকার নিয়ে গেছিল খোলা মাঠে, গুলি করবে বলে। আমার দাদু টাঙ্গাইল শহরের প্রখ্যাত আইনজীবী ছিলেন। মামা দাদুর নাম বলাতে, কয়েকজন রাজাকার তাঁকে ছেড়ে দেয়। তবুও নিজেদের মধ্যে অনেক মতান্তর ও বিতর্কের পরে। মামা সেই কথাই বলছিলেন, মাঠের পূর্ব দিকে একটি দেওয়াল ছিল, সেই দেওয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে রাজাকার ও খান সেনারা গুলি করত। এক একদিনে না কি দশ পনের জনকে ওরা গুলি করত। তাঁকেও না কি ওই দেওয়ালের ইটের পাঁজরের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। মোট ছয়জনকে নিয়ে গেছিল, তিনজন মাত্র ফিরেছিল। বাকি তিনজন…মামা এই কথা বলতে বলতে কালো টুলের কোণ খুঁটে যাচ্ছিলেন। পরিবারের বা সংসারের অনেক আসবাব বা টুকিটাকি এমন থাকে যার সঙ্গে এক একটি পরিবারের ইতিহাস যুক্ত থাকে। ওই জাল দেওয়া কাঠের বাক্স ও কালো রঙয়ের টুলের ভুমিকা আমাদের পরিবারে জ্বল জ্বলে স্মৃতির টুকরো হয়ে আছে। স্মৃতিতে আজও টসটসে হয়ে আছে।
কাঠের মিস্ত্রি রাধেশ্যাম সিংয়ের কথা বলছিলাম, দাদা মানে আমাদের বড় ভাই ফিরে যাবেন কলকাতায়। তার বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হওয়ার পরে সে স্থির করে কলকাতায় ফিরে গিয়ে কলেজে ভর্তি হবে। এমনিতেই সে তর্ক প্রিয় মানুষ। সে রাধেশ্যাম সিংয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ বলে ফেলে, নেতাজি আর বেঁচে নেই। তিনি বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। আমাদের জাতীয় স্তরে এমন কিছু বিতর্ক আছে, সেই বিতর্ককে জীবন্ত করে রাখা হয়, রাজনৈতিক স্বার্থে। ঠিক এমন কথাই বড় ভাই বললেন রাধেশ্যাম সিংকে।
পরিবেশ হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। গাঙ্গুলি বাড়ির কমপাউণ্ড থেকে, হু হু বাতাস গড়িয়ে আসছিল, রাধেশ্যাম এই কথা শুনে কিছুক্ষণ থ’ মেরে বসে ছিল। তারপরে সে আচমকাই করাত হাতে উঠে দাঁড়িয়ে দাদাকে বলল,- এই কথা বললে, একদম দুই টুকরো করে দেব। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর কোনোদিন মৃত্যু হয় না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও নেতাজি ভারতবর্ষের ধুলো মাটিতে মিশে আছেন। তাঁদের মৃত্যু হয় না। এই কথা আর কোনোদিন বলবে না। আমরা বেশ কিছু বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকি। তার মৃত্যু হয় না। নেতাজি তেমনই এক বিশ্বাস।
মা দেখে দেখে টুল জলচৌকি চেয়ার টেবিল সব কিছুই রিপেয়ার করিয়ে নিলেন। এমনকি রেডিও রাখার বাক্সটি পর্যন্ত। উত্তরপ্রদেশের বিশেষ এক সবজি তার নাম টিণ্ডা, সেই সবজি মা গোলমরিচ দিয়ে চমৎকার ঝোল রান্না করতেন। রাধেশ্যামকে মা রুটি টিণ্ডার তরকারি দিয়ে তুষ্ট করলেন। রুটি খেতে খেতে মা কে জানালেন নেতাজির কখনই মৃত্যু হতে পারে না।

গাঙ্গুলি বাড়ির জেঠিমা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাঁর বাড়িতে আসবেন আজ বিশেষ অতিথি। দুপুর থেকেই ক্যামেরা হাতে চলে এসেছেন দুইজন ইউরোপীয়, সাথে একজন ট্রাউজার পড়া মহিলা। গোটা গাঙ্গুলি বাড়ি ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর সার্ভে করছেন। ক্যমেরার ফ্ল্যাশে ধরে রাখছেন, গোটা বাড়ির ছবি। পাথরের মূর্তি, পায়ে পায়ে চলে বেড়ানো ময়ূরের খুঁটে খুঁটে খাওয়ার ছবি, প্রাচীন সুগভীর পাতকুয়োর ছবি। পাতকুয়োর নিচে তাকালে চেতনা হুম হুম করে। আর গভীরতার সে কি রহস্যময় শব্দ। কুয়োর গভীরে একেবারে পাতাল থেকে উঠে আসছে পচে যাওয়া জলের একপ্রকার গন্ধ।
ইটের ফাঁকে ফাঁকে বিষাক্ত গোখরোর বিপুল আস্তানা। তাদের উপাদেয় মূলত পাখির ছানা। আমরা দুই ভাই সাহেবদের সঙ্গে পায়ে পায়ে। গাঙ্গুলি জেঠিমা বলে যাচ্ছিলেন, তিনি যখন বিয়ের পরে নতুন এই বাড়িতে এলেন, তখন ঘোড়াশালে মোট চারটি কালো রঙয়ের অস্ট্রেলিয়ান ঘোড়া ছিল। মাদী ঘোড়া ছিল মোট ছয়টি। এই ঘোড়াগুলি ছিল গাঙ্গুলি বাড়ির আদরের সম্পদ। ঘোড়াশাল ভর্তি ছিল জমাদার। যারা ঘোড়ার দেখভাল করত আর রাতের বেলায় গোটা গাঙ্গুলি বাড়ি টহল দিয়ে দিয়ে পাহারা দিত। ইউরোপীয়দের জেঠিমা ঘোড়ার ছবি দেখাচ্ছিলেন। আর বলছিলেন, তাঁর শ্বশুর মশাইয়ের খুব ইচ্ছে ছিল হাতি পোষার। তার আয়োজনও তিনি করেছিলেন। কিন্তু পরের দিকে আর হয়ে ওঠেনি। এই ইউরোপীয় সাহেবদের কাজই ছিল ভারতবর্ষের বিভিন্ন বড় বড় বাড়ির ইতিহাস সংগ্রহ করা। সেই ইতিহাস তাদের কি কাজে লাগবে, আমার মতো সামান্য মানুষের পক্ষে তা জানার উপায় না থাকলেও মূল্য বুঝে ওঠার শিক্ষা লাভ করিনি। সব কিছু বুঝে ওঠার জন্য শিক্ষা অর্জন করতে হয়।
সন্ধ্যা গড়িয়ে আসতেই, গাঙ্গুলি বাড়ির সামনে, গাড়িতে ভরে উঠল। ভারতবর্ষের সব বড় বড় প্রাদেশিক নেতা। আমি চিনতাম না, পরে জেনেছিলাম যিনি নিজের উদ্যোগ নিয়ে আয়োজনটিকে পরিচালনা করছিলেন, তার নাম কে সি পন্থ। ছিল উত্তরপ্রদেশের বিখ্যাত কংগ্রেস দলের নেতৃবৃন্দ। উঠোন অঙ্গন ভরে উঠেছিল বিশুদ্ধ ঘিয়ের গন্ধে। পুরি হালুয়া ও লাড্ডু উত্তরপ্রদেশের যে কোনো অনুষ্ঠানে শুভ খাবার। কোনো অনুষ্ঠানের প্রিয় খাবার। আমরা নাক উজাড় করে গন্ধ নিচ্ছিলাম। জেঠিমার পুত্র যিনি, ইউরোপীয়ান মহিলাকে বিবাহ করেছিলেন, তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের বিখ্যাত আইনজীবী। তিনিই ছিলেন বিখ্যাত কংগ্রেসের নেতা। তার অবাধ যাতায়াত পণ্ডিত জহরলাল নেহরুর দরবার পর্যন্ত ছিল।
অনুষ্ঠান শেষ হল সেই ভোররাত্রে। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মা বললেন, ভোররাত্রি থেকে গাড়ির আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আর ঘুম এল না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিলাম বড় মানুষরা কেমন হয় দেখতে। ভোরের বেলার আঁধার আলোতে, বুঝতে পারলাম না, ভোরের বেলায় মানুষ তার সব ক্ষমতাকে আলোর কাছে সমর্পণ করে।
বেশ বেলার দিকে, জেঠিমা আমাদের ডেকে পাঠালেন। বড় হলঘর পার হয়ে গেলাম। সেই হলঘর জুড়ে, তখনও বড় মানুষদের শরীরের গন্ধে ভরে আছে। জেঠিমা আমাদের হাতে লাড্ডু পুরি ডালমুঠ পেঠা ও ক্ষীরের প্যারা দিয়ে নিজেই আমাদের সামনে বসে, সব খাওয়ালেন, আর কি মায়াবী চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে কি যেন বলতে চেয়েছিলেন।
হাহাকার করে উঠি খুব এখন, বুঝি মানুষ তার জীবনের সবচাইতে গভীর সত্য কথাটি বলতে পারে না। খুব খুব বিস্ময় জাগে, জেঠিমা সেই দিন আমাদের কি বলতে চেয়েছিলেন?

[চলবে…]

Facebook Comments

1 thought on “কাশবনের ভাষ্কর্য : শুভংকর গুহ Leave a comment

Leave a Reply