ফ্যাসিবাদ ও ভয়ের অনুনাদ : সুদীপ ঘোষাল

শ্যামসুন্দর ছেলেটাকে সঙ্গে নিতে চায় না। কি একটা মনের রোগ শ্যামকে জ্বালিয়ে মারছে। কাউকে বলতে পারছে না। জমির ৭১ সালের আগের দলিলটা হারিয়ে গেছে। সেই থেকে মনে একটা ভয় ঢুকে গেছে শ্যামের। হয়ত কিছুই হবে না। সে খবরে শুনেছে, গুজবে কান দেবেন না। তবু একটা ভয় মনের তৃতীয় স্তরে বাসা বেঁধে বসে আছে। কিছুতেই ভয়টা বেরোচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথের গান সে ভালই গায়। কিন্তু এখন ছেলেটা বলছে, বাবা তোমার গান বন্ধ কর। বাবা গো গাধার গলা। ছেলেটা মেট্রোরেল দেখবে বলে ঝোঁক ধরেছে। ওর মা বার বার বলছে, একবার যাও ঘুরিয়ে নিয়ে এসো। তোমার পাগলামিটাও দেখবে চলে যাবে বাইরের হাওয়া পেয়ে। আবার ভয়। ছেলেটাকে নিয়ে যদি মেট্রোরেলের নিচে লাফ দিয়ে পড়ি তো পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে সব ভয় শেষ হবে। কিন্তু ছেলেটা কি দোষ করল। ওর জন্য একটা বাড়ি করেছি। ওকে পৃথিবীতে এনেছি। কর্তব্য একটা আছে তো। কিন্তু ডিটেনশন ক্যাম্পে যদি রাখে তাহলে বাড়িটা কার হবে। খোলা হাওয়া কি বইবে? সবুজ মাঠ কি হাসবে? আমার তো ভয় হচ্ছে নাগরিকত্ব বিষয়ে।বন্যায় প্রমাণ ভেসে গিয়েছে।
আবার ছেলেটার মা বলল, যাও না কলকাতা ঘুরিয়ে নিয়ে এস ছেলেটাকে। ওর মা কি ছেলেমানুষ , একটা বদ্ধ পাগলের সঙ্গে ছেলেকে পাঠিয়ে দিচ্ছে কলকাতা। না নিয়ে গেলে হবে না। ছেলেটার প্রাণ আগে। তারপর যা হয় দেখা যাবে।শ্যামসুন্দর ফুল বিক্রি করে। ফুলওয়ালার কাছে বিচিত্র রঙের সব ফুল। বাহারি শত রঙ। ছেলেটা বলে, বাবা ফুলের রঙ কে বাছাই করে। গোলাপ লাল, টগর সাদা, জবা লাল। যদি টগর লাল আর জবা সাদা হত তাহলে কি দোষ হত?শ্যাম বলল,কি করে কি হয়, ফুল কেন সাদা হয় আমি বলতে পারব না। এ সব কারিগরের খেলা।ছেলে বলে, কে সেই কারিগর?

—- জানি না

—- কোথায় বাড়ি তার?

–_ জানি না

—-আমি একবার দেখব তাকে।

ছেলেরা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। শুধু প্রশ্ন করে। কিছুই বুঝতে চায় না। শুধু অবাক চাহনি। অবাক প্রশ্ন।

গ্রামে শ্যাম আজ চোদ্দ পুরুষ ধরে বাস করছে। তার দেশ ভারতবর্ষ। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে আজ শ্যাম সন্ধ্যাবেলা মদ খেতে বসেছে।খবরের কাগজ পেতে বিলের সবুজ মাঠে পাঁচজন বন্ধু বসেছে হতাশা আর ভয় নিবারণের জন্যে। শ্যাম বলে, এই দ্যাখ খবরের কাগজে ভারতবর্ষের মানচিত্র।আমি এই দেশের লোক। এইখানে আমার বাড়ি। আমি একজন নাগরিক এই দেশের। কিন্তু আমার প্রমাণপত্র ঠিকঠাক নেই। বাবা অশিক্ষিত লোক ছিলেন। তৈরি করা হয় নি কাগজপত্র। আমরা খেতে পাইনা ঠিকমত। কাগজ কি করে হবে বল।আমরা কাগজ চাই না সবাই ভাত চাই। মজদুরি করে সংসারের টাকায় মদ খেতে চাই না। অভাবের ব্যাথা ভোলার জন্য মদ খেতে হয়। বাড়িতে গেলেই শুধু অভাব আর অভাব। ভাল লাগে না, মা, মাগো আমার দেশমাতা। তিন পেগ পেরিয়ে চার পেগেই সকলে নিষিক্ত নেশায়। চলছে এখনও ফোয়ারা। ম্যাপের ওপরে রাখা কষা মুরগির সস্তা মাংস।শ্যাম বাড়ির পথে আসে। এখন নেশা করে বেশ ভাল লাগছে। ভয়টা এখন শ্যামকেই ভয় পাচ্ছে। শ্যাম রাস্তায় একা চলেছে ভয়কে জয় করে। হঠাৎ পাশের বাড়ি বিরাজুলের সঙ্গে দেখা পেয়ে শ্যাম খুশি হল। নেশা হলেও সে তালে ঠিক থাকে সবসময়। কোন খারাপ ব্যবহার রাস্তায় সে করে না। ভাল ছেলে বলেই সকলে জানে। বিরাজুল বলল,আবার মদ খেয়েছিস। আর খাস না ভাইজান। শ্যাম বলল, সাধে কি খেয়েছি, এখন আমার বাবা নেই একাত্তর সালের দলিল নেই। আমি আর ভারতবর্ষের নাগরিক নই। আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হচ্ছে ভাই। শ্যাম আর বিরাজুল পাশাপাশি রাতের অন্ধকারে চলেছে অজানা উদ্দেশ্য। বিরাজুলের আব্বা যখন ছোট তখন শ্যামের বাবার সঙ্গে স্কুল যেত। শ্যাম বলে, বুঝলি বিরাজুল এখন নতুন বিল পাশ হয়েছে। নাগরিকত্বের প্রমাণ লাগবে। বিরাজুল বলে, এ তো ভাল কথা। তবে আমাদের ৭১ সালের আগের সমস্ত নথি বন্যার জলে ভেসে গিয়েচে। টাকা পয়সা খরচা করলে ব্যবস্থা হতে পারে। তবে সে সামর্থ্য আমার নাই। আব্বা মরে যাওয়ার পরে সংসারের দায়ীত্ব আমার ঘাড়ে পরেছে। চাকরি বাকরি নাই। কি করব বল দেখিনি। শ্যাম বলে, দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।গল্প করতে করতে ওরা বাড়ির কাছে চলে এলো। শ্যাম বাড়ি ঢুকে গেল। বিরাজুল নিজের মনে বলতে থাকল, সব ঠিক হয়ে যাবে, সব ঠিক হয়ে যাবে। আম্মি বেরিয়ে এসে বলল, কি বলছিস রে আপন মনে। তোর নানা এই উঠোনে দাঁড়িয়ে অই একই কথা বলত। তু কি বলছিস বল।
তখন ইংরাজী ১৯০৫ সাল।বৃটিশদের বিরুদ্ধেলড়াই চলছে। ভয় ভয় আর ভয়।তবু লড়াই জোর কদমে চলছে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়ে, রায় পরিবারের,’ শ্যামের ঠাকুরদা’ সুমনবাবুর জীবনের ঘটনা।সুমনবাবু যাত্রাদলে বাঁশি বাজান।আর গোপনে বিপ্লবীদের সাহায্য করে নানারকমভাবে। বিরাজুলের দাদু জাহাঙ্গীর সাহেব, সুমনের ভালো বন্ধু ছিল। দুজনেই তাঁরা স্বাধীনতার আন্দোলনের সৈনিক ছিলো। তারপর ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হল। অনেক ঝড়ঝাপটা সহ্য করেও জাহাঙ্গীর সাহেব ভারতবর্ষেই থেকে গেলেন। তিনি বলতেন, এখানকার মাটি আমার জীবনের সবকিছু , আমার জান। আমি কবর নিলে এই দেশের মাটিতেই নিব। সুমনবাবুর প্রিয় মানুষ ছিলেন এই জাহাঙ্গীর সাহেব। সুমনবাবুর বাড়িতে আজ খুব আনন্দের দিন। পাঁচ ছেলের পরে আবার পুত্রসন্তান হয়েছে রায় পরিবারে।খুব সুন্দর দেখতে হয়েছে।কোনো লোকের যাতে নজর না লাগে তাই নাম রাখা হলো কালো। সুমনবাবু খুব খুশি।সুমনবাবুর বোন সুমিতাও খুব খুশি।সুমনবাবু খুব ভালো বাঁশি বাজান।যাত্রাদলে রাতের পর রাত তাকে বাঁশি বাজাতে হয়।আড় বাঁশি।তাই বেশির ভাগ রাতে তিনি বাড়ি ছেড়ে থাকেন।যাত্রাদলের মেয়ে রূপসী, সুমনকে ভালোবাসে।সুমন সুদর্শন।ভালো চিত্রশিল্পী। কিন্তু তার এলোমেলো জীবনে ঘরবাড়ি, জমিজায়গার ওপর কোন টান নেই।নিজের চাষের জমিও চেনেন না তিনি। দলিলের কোন খোঁজ খবর নেই। বন্যায় হয়ত নষ্ট হয়ে গেছে। আত্মভোলা লোক এই সুমনবাবু। সংসারে এদের মত লোক অনেক আছেন। যারা নিজের শিল্পসাধনা নিয়ে থাকতে ভালোবাসেন। সুমনরা দুই ভাই।বিমল তার ছোটো ভাই।সুমনের বৌ খেনী আর বিমলর বৌ কুড়ো।একদিন খেনী,কুড়ো আর বিমল গঙ্গায় স্নান করতে গেলো।বিমল সাঁতার জানে না।তাই কুড়ো বললো,বেশিদূর যাবে না। ভয় লাগে।
—-ঠিক আছে যাব না।
কিন্তু জোয়ারের টানে ভেসে গেলো কুড়োর সিঁদুর।বিমলকে খুঁজে পেলো না কেউ। কুড়ো বিধবা হল।

তারপর কুড়োর সুন্দর চুলের বেণী কেটে ঝুলিয়ে রাখা হলো বাড়ির মাচায়।কুড়ো বাল্যবিধবা হলো।চিরজীবন বয়ে বেড়াবে কয়েক দিনের বিয়ের জীবনের স্মৃতি।খেনীর ছেলে কালো।খেনী নিজেওযেমন সুন্দরী আবার ছেলেটিও তাই।মহিলামহলে খেনীর রূপের খুব সমাদর। সুমন বাড়ি এলে বলে,তোমাকে আর বাঁশি বাজা তে হবে না।জমি জায়গা দেখাশোনা করার পর আমাদের আর কোন অভাব থাকবে না ।
সুমন বললো,দেখো আমি শিল্পী মানুষ।জমি জায়গা নিয়ে আমি থাকতে পারবো না।
—-পারবো না বললে হবে না। ছেলে মানুষ করতে হবে।জমি বেদখল হয়ে যাবে।

—-আমাকে বোঝার চেষ্টা করো দয়া করে।আমি শিল্পী মানুষ।আমি বাঁশি ছাড়া মৃত।আমাকে রেহাই দাও।

খেনী চোখের জলে অন্য ঘরে চলে গেলো।তার সংসারের চিন্তায় মন খারাপ হয়ে গেলো।সেই সময়ে সুমনের বন্ধু জাহাঙ্গীর খেনীকে বোঝাত, সুমন শিল্পী মানুষ। তুমি চিন্তা কোরো না ভাবি একদিন দেখবে তোমাদের ভাল হবে। সুখসমৃদ্ধি হবে। সুমন অনেক বড় শিল্পী হবে। জাহাঙ্গীর যতদিন বেঁচে ছিল গ্রামে শান্তি ছিল। গ্রামের ন্যায় অন্যায় সমস্ত কিছু দেখাশোনা করত। আজ রাতে গান নেই সুমনের ।তাই ছুটি। বাড়িতেই আছে। তাই আজ জাহাঙ্গীরকে নিয়ে গ্রামে ঘুরতে বেড়িয়েছে। ভালমন্দ সবলোকই এই মাণিকজোড়কে ভালবাসে। তবু রাতে বৌ এর কাছে না থেকে বাগানে বাঁশি বাজায় সুমন।তার সুর শুনে খেনীর ভয় হয়।এই আপদ বাঁশি তার সংসার ভেঙ্গে দেবে না তো? এই চিন্তায় খেনী রাত কাটায়। আর সুমন সারা রাত রূপসীকে মনে রেখে বাঁশি বাজায় ক্ষণে ক্ষণে। খেনী কিন্তু এই গোপন ভালবাসার কথা জানত না। জাহাঙ্গীর বন্ধুকে বলত, ভাবিকে কষ্ট দিবি না। ভাবি খুব ভাল। তারপর রাত পোহালেই চা, মুড়ি খেয়ে বেরিয়ে পরে সুমন।আজ যাত্রা আছে।মীরার বঁধুয়া।মুরা রী বাঁশি মুখে ধরে থাকবে আর আড়াল থেকে বাজবে সুমনের বাঁশি।আজ কৃষ্ণ সাজবে মুরা রী। মীরা মুগ্ধ হবে সুরে।রূপসী আজ মীরা সাজবে।কত লোকে হাততালি দেবে।পুরষ্কার পাবে মুরারী।রূপসী জানে, দলের সবাই জানে বাহাদুর বংশীবাদকের বাহাদু। তবু মুরারী নামের কাঙাল সেজে কপটতা করে।সুমনের তর উপর রাগ হয় না। কৃপা হয়। রূপসীর পিছন পিছন ঘুর ঘুর করে মুরারী।কিন্তু রূপসীর মন পায় না। রূপসী আড়ালে সুমনকে বলে,ডিম,দুধ খাবে।আমার কাছে আসবে।আমি দেবো।
—আমার বেশি খেলে বদহজম হয়।হাল্কা মুড়ি আমার প্রিয়।
—-না না।মুখ দিয়ে রক্ত উঠবে।
—-বেশি খেলে আমার বাজাতে কষ্ট হয়।
—-ঠিক আছে।আমার কাছে এসে তুমি যখন বাঁশি বাজাও আমার মনটা কেমন হারিয়ে যায়।
—-জানি আমি।তোমার জন্য আমি বাঁশি বাজাই।তুমি আমার বাঁশি শুনলেই হবে।আর কাউকে চাই না।
সুমন বাঁশি বাজানোর সঙ্গে কোনো আপোষ করে না। তাতে না খেয়ে থাকতে হলেও থাকবে।কোনো আপত্তি নেই।অপরদিকে রাবণ অপেরা এদের প্রতিদ্বন্ধি।তারা সুমন কে নিজেদের দলে আনার জন্য নানারকম রাজনীতি করে। কিন্তু সুমন দল ছাড়বে না। মুরারী অপেরায় তার প্রিয়া রূপসী আছে। তাকে ছেড়ে কি করে সে বাঁশি বাজাবে।রাবণ অপেরার ম্যানেজার বললো , তোমার খুব অহংকার। আচ্ছা তোমাকে আমরা দ্বিগুণ টাকা দেবো।আমাদের দলে এসো।
—-না আমি পারবো না। আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।
—আচ্ছা তোমাকে দেখে নেবো।
পাশের গ্রামের মেয়ে, মেনকা সম্পর্কে খেনীর আত্মীয়।রূপে,গুণে,সংগীতে মেনকার জুড়ি মেলা ভার।পড়াশোনায় তার সমকক্ষ কেউ নেই।মেনকা গ্রামের আপদে বিপদে সকলের আগে এগিয়ে যায়। গ্রামের লোকেরা খুব ভালোবাসে মেয়োটিকে। শ্যামের সঙ্গে মেনকার সম্পর্ক খুব ভাল।
গ্রামের একটা গরীব বুড়ি মরে গেলে মেনকা চাঁদা তুলে পাড়ার দাদাদের নিয়ে তার শবদাহ করেছিলো।গ্রামের বয়স্ক লোকেরা তাকে দুহাত তুলে আশীর্বাদ করেছিলেন।মেনকা নিজে একজন স্বাধীনচেতা তরুণী। নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে সমাজের মঙ্গল করাই তার লক্ষ্য।তার জন্য তিলে তিলে নিজেকে সে উপযুক্ত করে তোলে। লেখাপড়ায় তার সমকক্ষ কেউ ছিল না। এই গ্রামে এক সুদখোর লোক ছিলো।গরীবদের কাছে সে দশ শতাংশ হারে সুদ নিত।দেনা শোধ না করতে পারলে জমি জায়গা সোনাদানা কেড়ে নিত।মেনকা এই লোকটাকে দেখতে পারত না। তাকে দেখলেই রাগ হয়ে যেত।জব্দ করার ফন্দি আঁটত দিনরাত।
মেনকা কৃষক পরিবারের সন্তান।সে হাঁস পুষত।তার হাঁসগুলো যখন ডানা ঝাপটে জলে নেমে ডুব দিত তখন সেও হাঁস হয়ে ডুব দিত অতল জলে।মুক্ত খোঁজার আশায় তার ডুব। ডুবে ডুবে কখনও তার বেলা বয়ে যেত।কিন্তু মুক্ত তার অধরা রয়ে যেত। পাশে হাঁস নিয়ে সে সরস্বতী হয়ে যেত। আপনমনে আউড়ে চলত পুরোনো পড়া।রাতে সে শিক্ষা নিত চাঁদের বাগানে।তার শিক্ষক বলতেন,চাঁদের বুকে অই যে কালো কালো দাগ দেখছো অইগুলো কলঙ্ক।তবু একটা তৃণ অবধি পৌঁছে যায় তার আলো।কাউকে বাদ দেয় না সে।তিনি মেনকাকে বলতেন, জীবনে যতই বাধা আসুক। এগিয়ে যাবার পথ থেকে সরে আসবে না। একদিন ঠিক সফলতা তোমার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটবে। তুমি এই গ্রামের আলোর দূত হয়ে ওঠ। কয়েকদিন ধরেই মেনকা নাগরিকত্বের বিল সম্পর্কে াঅনেককিছু শুনেছে। মনে মনে প্রমাদ গুণেছে। মেনকা ৭১ সালের কাগজ সম্পর্কে বন্ধুদের বলত, কতবার স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের গ্রামে বন্যা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সকলের মাটির বাড়ি। একমাত্র সুদখোরের মত ধনীদের কাগজপত্র আছে। তাছাড়া গরীবদের কাগজপত্র নেই। তার মানে তারা নাগরিক নয়? আমরা আসল নাগরিক। প্রতিবাদি কন্ঠ সোচ্চার হয়ে উঠত মেনকার। একদিন গ্রামের লোকেদের নিয়ে এর বিরুদ্ধে মোমবাতি মিছিল করেছে, মুখে কালো কাপড় বেঁধে। তারপর সকালে উঠেই মেনকা বই হাতে যায় শিক্ষকের বাড়ি। সঙ্গে ছাগল,ভেড়া, হাঁস।তাদের যথাস্থানে রেখে তারপর শিক্ষকের বাড়ি যায় । সুদখোর মহাজন মেনকাকে দেখে বললো,এই সুন্দরী শোন। এদিকে আয়।
মেনকা বলে,কি বলছেন বলুন?
—–একবার দুপুর বেলায় আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে দেখা করিস তো।
—কেন? আমার সঙ্গে কি কাজ?

—গেলেই জানতে পারবে।মহাজন এমনি ডাকে না। তোমার কপালে আজ প্রাপ্তি্যোগ আছে। যেও বেশ। ৭১ সালের কাগজও তৈরি করে দেব। আমার টাকার জোর আছে। যাস কথা হবে।
—এমন আদরের ডাক কি আর ফেলতে পারি।যাব।
ঠিক দুপুরবেলায় মেনকা ভয়ভুলে তার দলবল নিয়ে হাজির হলো মহাজনের বাড়ি।সবাই মুখোশ পড়ে এসেছে। তাহলে মহাজন আলাদা করে কাউকে দোষারোপ করতে পারবে না। আর মেনকার ওসব মুখোশের প্রয়োজন হয় না। তার এসব ভয় নেই। মহাজন মেনকাকে বলে, মা আমি ভুল করেছি। তোর দলবলকে একটু বুঝিয়ে শান্ত কর। তা না হলে আমার মান সম্মান থাকে না যে মা। মেনকা বলে, দাঁড়ান, আপনার পাপের ফল একটু উপভোগ করুন। সবাই ভূতের সাজে উঠে পড়েছে আম গাছে।পাকা আম। সব পেড়ে খাচ্ছে সকলে।মেনকা সাদা শাড়ি পরে কড়া নাড়লো মহাজনের দরজায়।মহাজন বাইরে বেরিয়ে মেনকাকে দেখে পাগলপ্রায়।গায়ে হাত দিয়ে বলে, আয় ভেতরে আয়।
—-যাব,?আমরা ভূত পেত্নির দল তোর বাগান ডছনছ করব।
আজ মেনকার রূপ তোকে দেখাতে এলাম। অই দেখ তোর বাগানে কত বিপক্ষের ছেলে। এই আগামী প্রজন্ম তোকে ভয় পায় না।
মহাজন দেখল, গ্রামের প্রচুর ছেলেমেয়ের দল মুখোশ পরে বাগানে বসে আছে। আর স্লোগান দিচ্ছে, মহাজন নিপাত যাও। তোমাকে গ্রাম ছাড়তে হবে। মেনকার সঙ্গে খারাপ ইঙ্গতের বিচার চাই। বিচার চাই।
বাবারে, আমার সব সম্মান শেষ করে দিলো রে।সঙ্গে সঙ্গে মহাজনের গালে এক থাপ্পড়।মেনকা বলল, কি রে গ্রাম ছাড়বি না পুলিশ ডাকব। মহাজন বল, জোড় হাতে ক্ষমা চাইছি।আমাকে ছেড়ে দাও। আমাকে গ্রামে থাকতে দাও। আমি আর কোনদিন খারাপ কাজ করব না।
—-ছেড়ে দিতে পারি।একটা শর্তে।যত দলিল,সোনা তুই চুরি করেছিস, বেইমানি করে নিয়েছিস সেগুলো সবাইকে ফেরত দিবি।তা না হলে আবার আসবো। দিবি তো বল। কথা দে। গরীব মালিকদের জমির সব দলিল ফেরৎ দিবি। চিটিংবাজি করবি না। তা না হলে বাধ্য হয়ে পুলিশ ডাকব।
—না না। আমি সব দিয়ে দোবো।আমি আর সুদের কারবার করবো না। দলিল সব দিয়ে দোব।
তারপর কিছুদিন পর সুদখোর লোকটি মেনকার দলের ভয়ে, মেনকার বাবার জমির দলিল ফেরত দিয়েছিল। হয়ত মেনকার ভয়ে তা না হলে লোকবলের ভয়ে।মেনকার বাবা বলতেন,মনে রাখবি মা,জল জল গঙ্গাজল।আর বল,বল লোকবল। বল বা শক্তির মধ্যে লোকবল শ্রেয়। তার প্রমাণ মেনকা হাতেনাতে পেলো।সুদখোর মেনকার সামনা সামনি হয়নি আর কোনো দিন।মেনকা জানে,ওরা সবলের ভক্ত আর দূর্বলের যম। মেনকা প্রয়োজনে লড়তে জানে। মেনকার সঙ্গে সবসময় বন্ধুরা থাকত।প্রায় বিশ পঁচিশজন গ্রামের ছেলেময়ে খেলা করত একসাথে। দলবল নিয়ে গ্রামের বিভিন্ন সমাজসেবা মূলক কাজ করত নিঃস্বার্থভাবে।
মেনকা এইভাবে বড় হতে লাগলো।তারপর সে গ্র্যাজুয়েট হলো।তার বাবা এখন খুব খুশিমনে কৃষিকাজ করেন। মেনকার বিয়ের যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন তার বাবা। কিন্তু মেনকা বলেছেন, ও এখন পড়াশোনায় ব্যস্ত। এখন বিয়ে করবে না সে, সাফ জানিয়ে দিয়েছে বাবাকে।কলকাতায় পড়াশোনার সূত্রধরে বিরাজুল আর শ্যামের আর এক বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় হয় মেনকার। এই সব পরিবারের দেশ একটাই। তার নাম ভারতবর্ষ। কিন্তু এদের পরিবার প্রত্যন্ত গ্রামে থাকে। তারফলে যখন নাগরিকত্বের প্রমাণের বিল পাশ হল তখন এদের কাছে প্রামাণ্য নথি কম ছিল। ফলে তাদের ভয় ছিল ভিতরে। যদি সরকার থেকে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য একাত্তর সালের আগের নথি চায় তাহলে সেটা জোগাড় করা খুব মুস্কিল হবে। এর ফলে আন্দোলন চলছে। লোক মরছে। তাই এরাও চিন্তিত, কি হবে, কি হবে, এইরকম ভয়ের ভাব বা পরিবেশ, বিরাজ করছে বিরাজুলের মত অনেকের অন্ততরে, দেশ জুড়ে।মেনকা অনেক ছাত্র ছাত্রীদের একত্র করে একটা মিছিল বার করল কলকাতায়, এন আর সি র বিরুদ্ধে। শান্তিপূর্ণ এই মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিল অনেক সাধারণ মানুষ। মেনকা আজ বিরাজুলকে বলছে, জানিস আজ গ্রামের একটা লোক আত্মহত্যা করেছে ভয়ে,শুধুমাত্র ভয়ে। এর কি কোনো পথ নেই সমাধানের?গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে দেশজুড়ে। এই আন্দোলনকে গণআন্দোলনে রূপ দিতে হবে, তবেই যদি কিছু হয়, বুঝলি বিরাজুল।বিরাজুল বলল,আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। কিন্তু আমাকে গ্রামের বাড়ি যেতে হবে। আমাদের কথাই ধর। কোনো নিশ্চয়তা নেই কখন কি হবে? বাড়ির সবাই চিন্তিত। আমার আর পড়াশোনা হবে না। আমাকে এক সপ্তাহের মধ্যেই গ্রামে যেতে হবে। এখান থেকে পুরোপুরিভাবে সংসারের দায়ীত্ব নিতে পারছি না। তুমি আর শ্যাম পড়াশোনা কর। তোমরা ভাল থাকলে আমার ভাল লাগবে।মেনকা এই প্রথম এতটা হতাশ হল। সে ভাবল, কি বলবে বিরাজুলকে, কোন মুখে সান্ত্বনা দেবে। ওর দলিল, কাগজপত্র আমি কি জোগাড় করে দিতে পারব? অথচ বিরাজুলের দাদু, আমার দাদু, শ্যামের দাদু সবাই একসঙ্গে বড় হয়েছে। ভারতবর্ষের জ্যোৎস্না জড়িয়ে ওদের বড় হওয়া। এই দেশ সকলের চোদ্দপুরুষের কবরভূমি বা শ্মশানভূমি। আমরা গ্রামের ছেলে মেয়েরা সব দেখছি ছোট থেকে। এখানে যারাই থাকে তাদের ভোটার কার্ড, আধার কার্ড সবই আছে। তবু তারা বলছে, এগুলো প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট নয়। কিন্তু প্রমাণ চাই সত্যের। সত্যেরও প্রমাণ। হায় রে আমার মাতৃভূমির বর্তমান সন্তানদল। শুধু নিজের আখের গোছানো এই রাজনীতি বন্ধ হোক। প্রবেশ করুক সত্যের আলো। মেনকা মনে মনে ভারতমাতার প্রতি এই আবেদন করে। বিরাজুল বাড়ি ফিরে এল পড়াশোনা বাদ দিয়ে। সে হন্যে হয়ে ঘুরল অনেক অফিস,আদালত। কোন ব্যবস্থা করতে পারল না। আদালতে মামলা উঠল। বিরাজুল প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে পারল না। সে বলল, আমার নানা, জাহাঙ্গীর সাহেব স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন, এই দেশ আমার দেশ,আমার প্রাণ, আমার রক্ত। মাই লর্ড,আপনি বিশ্বাস করুন, এই দেশের নাগরিক আমি….।আমি এই দেশের নাগরিক।বিরাজুলের মামলা এখনও চলছে।

Facebook Comments

Leave a Reply