বর্ণাশ্রম, অপর, সমাজ এবং দুটি রামায়ণ কেন্দ্রিক সংস্কৃত নাটক : রাম চরিত্রের বিবর্তন তথা রামায়ণের বহুপাঠ – শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ

চতুর্থ পর্ব

পঞ্চম অঙ্ক – হিংসা-অহিংসা, দর্প, সংস্কার, খাদ্যবিধি এবং দক্ষিণ ভারতে রাবণ

ভরত ফিরে গিয়েছেন অযোধ্যা। রাম সন্তপ্ত। পিতার বাৎসরিক কাজের সময় উপস্থিত। ভরত যেমন করে অযোধ্যায় সে কাজ করবে তিনি করতে পারবেন না। বনবাসজনিত দারিদ্রই এর কারণ। এ সব দুঃখের কথা জানাচ্ছেন জানকীকে। জানেন তাঁর পক্ষে বিশেষ কিছু করা কঠিন। পিতৃপুরুষেরা জানেন তাঁর অবস্থা। যে কোনো অনুষ্ঠানেই তাঁরা সন্তুষ্ট হবেন। কিন্তু তিনি তো রাম। কাজেই নিজের এবং দশরথের যোগ্য শ্রাদ্ধ তিনি করতে ইচ্ছুক। যোগ্যতার মান নানা মানুষের কাছে স্বাভাবিক ভাবেই নানান হবে। রামের যোগ্যতার মান রাম নির্ধারণ করবেন, সেও স্বাভাবিক। কোন হিসেবে করবেন? রাজপুত্র রামের যোগ্যতায়? বনবাসী রাম নিজেকে মানতে পারছেন? নাটককার এই অঙ্কে উদাসী রামকে ভেঙে আরেক রামকে আমাদের সামনে উপস্থিত করলেন। যে রাম অভিষেকে ও বনবাসে উদাসীন বা নির্লিপ্ত ছিলেন, কর্তব্য বোধে চালিত হয়েছিলেন, নিতান্ত মানুষী শোক যাঁকে তেমন করে স্পর্শ করেনি বলে এতক্ষণ আমরা দেখেছি, সেই রাম এই অঙ্কে আর নেই। এবারে তিনি নিজের যোগ্যতার কথা ভাবছেন।
প্রচলিত রামায়ণ কিন্তু এদিক থেকে রামকে সোজাসুজিই নিজ অবস্থানের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখেই উপস্থিত করেছে। রাম যখন ভরতের মুখে সংবাদ পেলেন দশরথের প্রয়াণের, তখন লক্ষ্মণকে বলছেন তিনি মন্দাকিনীতে পিতৃ-তর্পণ করবেন। তাই লক্ষ্মণ যেন ইঙ্গুদীফল ও নতুন বল্কল আনয়ন করেন। ইঙ্গুদী একধরণের কাঁটাগাছ, যার ফল থেকে তেলও তৈরী হয়। তাপসগণ এই ঐঙ্গুদী ফল থেকে তেল বের করে ব্যবহার করতেন। লক্ষ্মণ সেই ফল ও বল্কল আনলে, মন্দাকিনীতে দর্ভময় (ঘাস) আস্তরণে বদরীমিশ্রিত (কুলগাছের ফল কুল মিশ্রিত) ইঙ্গুদীপিণ্ড জলসহ তর্পণ করলেন। বললেন, বনে তাঁরা এমনই আহার করে থাকেন। পুরুষের যে বস্তু ভোগের তা পিতৃলোকেরও উপযোগী হয়। এই রামায়ণ পাঠে কিন্তু রাম কোনোভাবেই নিজ যোগ্যতার কথা ভাবছেন না। বরং কৌশল্যা দুঃখিত হচ্ছেন রাম সন্দর্শনে আসার পথে, নদীতে ঐ পিণ্ড ভেসে যেতে দেখে। রামের বনবাসী অবস্থা এবং তাই পিতৃগণের অবস্থা পিতৃলোকে ভেবে কষ্ট পাচ্ছেন।
অথচ এই নাটকে রাম, ভরত চলে যেতে, নিজ যোগ্যতা নিয়ে চিন্তিত কেন? কারণ নাটককার প্রচলিত রামায়ণ থেকে তাঁর বিশেষ নাট্য-উদ্দেশ্যেই দূরত্ব তৈরী করছেন। এই অঙ্কে নাটককার প্রচলিত রামায়ণের বহু ঘটনাকে একত্রে অতিক্রম করে যাবেন। ভরত চলে যাবার পরে মুনি-ঋষিদের সঙ্গে দেখা হওয়া ইত্যাদি ছাড়াও ক্রমে ক্রমে দণ্ডকারণ্যের রাক্ষসদের সঙ্গে রামের যে বিবাদ তা নাটককার নাটকের পরিসরের বাইরে রেখেছেন। তাই বিরাধ বধ থেকে শূর্পণখার নাক-কান কাটা এ সব কিছুই তাঁর নাটকে স্থান পায়নি। বরং এই অঙ্কে রাবণ যখন পরিব্রাজকের বেশে প্রবেশ করছেন তখন বলছেন – রাম, খর রাক্ষসকে হত্যা করে তাঁর শত্রুতা করেছেন। তাই তিনি এবারে সীতা হরণে প্রবৃত্ত হলেন। তার কিছু পরে জানাবেন শূর্পণখার বিকৃতরূপ, দুই ভায়ের হত্যা সংবাদ শুনে গর্বোদ্ধত রামকে ছলনায় প্রলুব্ধ করে সীতাহরণ করতে এসেছেন।
কেন মঞ্চে আনলেন না নাটককার রাক্ষসবধাদি? নাট্যশাস্ত্র হত্যা ইত্যাদি মঞ্চে নিষেধ করে, কিন্তু তিনি তো নাট্যশাস্ত্র মেনে চলেননি। অথবা স্বয়ং তাঁর রচিত কোনো নাট্যশাস্ত্র থাকতেও পারে, যার আলোচনা আমরা আগে করেছি। তাহলে তাতে কি সেই হত্যা না রাখার বিধান তিনিই রেখেছিলেন? অথবা তৎকালে প্রচলিত কোনো নাট্যশাস্ত্র অনুসরণ করছিলেন, যাতে এই নিষেধ ছিল? নাকি তিনিই বিশেষ কারণে রাখতে ইচ্ছুক হননি এই সব? নিশ্চিত উত্তর জানা কঠিন।
কিন্তু প্রচলিত রামায়ণ থেকে আমরা একটি অংশের উল্লেখ করতে পারি যা সচরাচর আলোচনাতে আসে না, অথচ রাক্ষসবিরোধ প্রসঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে অংশে রাম ঋষিদের সহায়তার জন্য তাঁদের আবেদনে মনস্থ করেছেন রাক্ষসবধের। মহর্ষি সুতীক্ষ্ণের আশ্রম থেকে তাঁরা প্রস্থান করছেন। এমন সময় সীতা, রামকে রাক্ষসবধ প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলছেন। সীতা বলছেন কামজ ব্যসন তিন প্রকার – মিথ্যাকথন, পরস্ত্রীগমণ ও বৈর ব্যতীত রৌদ্রভাব ধারণ – যাদের প্রভাবে মানুষ পড়লে সুক্ষ্ম ধর্ম পেতে পারে না। রাম প্রথম দুটির দ্বারা কোনোদিন কোনোভাবেই দূষিত হবেন না। কিন্তু তৃতীয়টিতে রাম সম্প্রতি আসক্ত। জীবের প্রাণহিংসারূপ কঠোর ব্যসন রামের রাক্ষসবধের সংকল্প। সীতা চাইছেন না রাম দণ্ডকারণ্যে গমন করেন। সেখানে গেলে রাক্ষসদের সঙ্গে নিশ্চিত যুদ্ধ হবে। শরাসন গ্রহণ করলে ক্ষত্রিয়দের তেজ সবিশেষ বর্ধিত হয়। এই প্রসঙ্গেই সীতা একটি কাহিনী বলছেন রামকে। কাহিনীটি নানা কারণেই গুরুত্বের।
একদা এক সত্যশীল ঋষি ছিলেন শান্ত মৃগ-বিহঙ্গ পূর্ণ অরণ্যে। তপস্যা করতেন। ইন্দ্র একদা তপস্যার বিঘ্ন ঘটানোর জন্য যোদ্ধার বেশে তাঁর কাছে অসিহস্তে আসেন। নিজের ন্যাসস্বরূপ ঐ খড়্গ ঋষির কাছে রেখে চলে যান। ঋষি, ন্যাস বা গচ্ছিত খড়্গ নিয়ে ন্যাসরক্ষা বা বিশ্বাসরক্ষার দায়ে এরপর সর্বত্র গমন করতে লাগলেন। ফলমূল আনতেও অস্ত্র নিয়ে যাচ্ছেন। এই করে করে একদিন সম্পূর্ণ রৌদ্রভাব অবলম্বন করে ফেললেন। প্রাণিহিংসা শুরু করলেন, তপস্যা বন্ধ। তাঁর অন্তিমে নরকবাস হল।
এই কাহিনী বলে সীতা জানাচ্ছেন রামকে অকারণ দণ্ডকারণ্যের রাক্ষসদের হত্যা করা ঠিক হবে না। অপরাধ না পেলে হত্যা অনুচিত। বনবাসে আছেন তাঁরা। এখানে শস্ত্র, ক্ষত্রিয়ের ধর্ম এ সকল উপযুক্ত নয়। তপস্যা, বন, অস্ত্র, ক্ষাত্রধর্ম এ সব পরস্পরবিরোধী। বনে বরং তাঁদের তপস্যানিরত থাকাই উচিত।
রাম, সীতার কথা শুনলেন। কিন্তু যুক্তি দিলেন ঋষিরা তাঁর সহায়তা চেয়েছেন। রাক্ষসেরা ঋষিদের যজ্ঞে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। তাঁদের হত্যা করছে, আহার করছে। ঋষিরা তপোবলে তাদের ধ্বংস করতে পারেন, কিন্তু অনেক কষ্টে তপোবল পেয়েছেন, তা এই কাজে ব্যয় করতে ইচ্ছুক না। তাই রাম যেন তাঁদের রক্ষা করেন এই আবেদন। রাম সত্যনিষ্ঠ। ঋষিদের কথা দিয়েছেন তিনি রক্ষা করবেন। সুতরাং তাঁকে অস্ত্রধারণ করতেই হবে। প্রচলিত রামায়ণ ঋষিদের অলৌকিক প্রভাব থাকা সত্ত্বেও রামকে রাক্ষস বধ করতে লাগবে কেন তার উত্তরে এই যুক্তিক্রম বানিয়েছে। তপোবল রাক্ষস ধ্বংসে চলে গেলে স্বর্গাদির জন্য কী থাকবে! সে যুক্তিক্রমকে আজকের দিনে আমাদের প্রশ্ন করার আর বিশেষ প্রয়োজন নেই। কিন্তু কাহিনীটিকে দেখার প্রয়োজন আছে। সঙ্গে বিচার করার আছে নাটককারের নাট্যরচনার উদ্দেশ্যটিও। তার আগে আমরা নাটকে কাহিনীর গতি আরেকটু জেনে নেব।
রাম যখন দুঃখপ্রকাশ করছেন তাঁর অবস্থার জন্য, নিজের যোগ্যতার উপযুক্ত আচারের কথা ভাবছেন তখন সীতা খুব সহজ কথায় রামকে বোঝাচ্ছেন এ নিয়ে দুঃখিত হবার কারণ নেই। মৈথিলী বলছেন, ভরত আড়ম্বরে বাৎসরিক করবেন, কিন্তু রাম ফল ও জল দিয়েই করুন তা। নিহিতার্থ ভরত রাজা, তার ধনসম্পদ অনুযায়ী চলুক। তাঁরা বনবাসী, তাঁদের অবস্থা অনুযায়ীই তাঁরা কাজ করবেন। প্রচলিত রামায়ণের পাঠের সঙ্গে সীতার এ ভাবনা সঙ্গত, তা আমরা কিছুটা আগেই দেখেছি। কিন্তু রাম তাতে সায় পাচ্ছেন না। এমতাবস্থায় রাবণ প্রবেশ করছেন পরিব্রাজকের বেশে। তিনি স্বগতোক্তিতে জানাচ্ছেন তিনি সংযমী, কিন্তু রাম জিতেন্দ্রিয়। খরকে বধ করায় তাঁর শত্রু। তিনি এসেছেন সীতাহরণের উদ্দেশ্যে।
অতিথি বলে নিজেকে ঘোষণা করেন তিনি। রাম-সীতা তাঁর পরিচর্যা শুরু করেন। কিন্তু রাবণ ছদ্মবেশ ধরা পড়ে যাবে ভয়ে শুধু সম্বোধন দিয়েই সেবা নিলেন। তারপরে জানালেন তিনি কাশ্যপ গোত্রীয়। অঙ্গ-উপাঙ্গ সহ বেদ, মনুর ধর্মশাস্ত্র, মহেশ্বর ভাষিত যোগশাস্ত্র, বৃহষ্পতির অর্থশাস্ত্র, মেধাতিথির ন্যায় শাস্ত্র এবং বরুণ রচিত শ্রাদ্ধবিধি তিনি অধ্যয়ন করেছেন। রাবণের পাণ্ডিত্যর প্রকাশ এভাবে ঘটালেন নাটককার। সঙ্গে রামের জন্য একটি ফাঁদ সৃষ্টি করলেন। শ্রাদ্ধ শুনেই রাম আগ্রহ দেখালেন। জানতে চাইলেন পিতৃপুরুষের পিণ্ডাদি দানের মধ্যে কোনটি দিয়ে পিতৃপুরুষের তৃপ্তি বিধান করবেন। রাবণ প্রথমে স্বাভাবিক কথাই বললেন। শ্রদ্ধায় যা দেওয়া হয় তাই শ্রাদ্ধ। রাম বললেন তিনি জানেন অনাদরের দান পরিত্যক্ত হয়। কিন্তু বিশেষ বিশেষ কী দিলে তৃপ্তি তা জানতে চাইলেন।
সেই অবসরে রাবণ শ্রাদ্ধের উপযোগী দানের কথা বলতে থাকলেন। তৃণের মধ্যে কুশ, ওষধির মধ্যে তিল, শাকের মধ্যে কলাই, মাছের মধ্যে মহাশঙ্কর, পাখিদের মধ্যে বার্ধ্রানস, পশুদের মধ্যে গো বা গন্ডার – এইসব লোকবিহিত। বার্ধ্রানস একপ্রকারের পাখি। তাদের ঘাড় নীল, মাথা লাল, পা কালো, পাখনা শ্বেত। টীকাকারেরা বলছেন। সঙ্গে বলছেন শব্দটি অপ্রচলিত। রাম গো বা গন্ডারের ‘বা’ শব্দটিকে লক্ষ্য করে বললেন আরো কিছু নিশ্চয়ই আছে, যা পরিব্রাজকের ‘বা’ বিকল্পবিধানে তাঁর মনে হচ্ছে।

রাবণ এইবারে তাঁর ফাঁদটিকে বিস্তৃত করলেন। কাঞ্চনপার্শ্ব নামে এক মৃগের কথা বললেন, যা হিমালয়ের সপ্তম শিখরে পাওয়া যায়। শিবের মস্তকাধৃত গঙ্গাজল তারা পান করে। বায়ুগতি এই জীবদের শ্যামবর্ণ পৃষ্ঠদেশ। বৈখানস, বালখিল্য, নৈমিষীয় প্রমুখ মুনিরা তাদের স্মরণ করলেই তারা মূহুর্তে এসে প্রাণত্যাগ করে। সেই মাংসে এঁরা শ্রাদ্ধ করেন। সেই মাংসে তৃপ্ত হলে পিতৃপুরুষেরা পুত্রপ্রাপ্তির ফললাভ করে, জরাহীন দেহে দেবতাদের মতো স্বর্গবাস লাভ করেন। রাম এ কথা শুনে মনে করলেন এই তাঁর যোগ্য হবে। জানকীকে বললেন, তাঁর স্নেহলালিত পালিত মৃগ, তরুরাজী, বিন্ধ্যপর্বত ও সখীস্থানীয় লতাগুলির থেকে বিদায় নিতে। তাঁরা এবারে ওষধিরঞ্জিত হিমালয়ে বাস করবেন গিয়ে।
এইখানে আমরা কিছুটা অন্য প্রসঙ্গে যাব। আহার এবং পশুহত্যার প্রসঙ্গে যাব। হিংসা-অহিংসা এবং আমিষ-নিরামিষের প্রসঙ্গে যাব। রাবণ শ্রাদ্ধের উপাদান হিসেবে মাছ এবং মাংসের কথা বলছেন। নাটককার বানিয়েছেন এ বিধি? তা যে নয় তা আমরা একটু পরেই দেখব। তবে কল্পনাতে এতটাই গিয়েছেন যে মৃগেরা ঋষিদের স্মরণমাত্র এসে শ্রাদ্ধের মাংস হতে প্রাণত্যাগ করে এও বানিয়েছেন। ঋষিদের মৃগ বধ করার প্রসঙ্গটিকে অলৌকিক কাহিনী দিয়ে পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন। তবু যদি সন্দেহ থাকে রাবণের শাস্ত্র বিধানে মাংস-মাছের উপস্থিতিতে, তাহলে প্রচলিত রামায়ণের পাঠেই একবার ফিরি। সেখানে বারংবার রাম মৃগবধ করছেন। এমন কী মারীচ হত্যার পরেও মৃগ বধ করে ফিরছেন। অর্থাৎ মাংস একেবারেই বর্জ্য নয় খাদ্য হিসেবে।
রামায়ণেও যদি না কুলোয় তাহলে আমরা উনবিংশতি সংহিতার দ্বারস্থ হতে পারি। অত্রি থেকে বশিষ্ঠ এইপ্রকার ঋষিদের নামে প্রচলিত উনিশটি সংহিতার অনুবাদ উনবিংশ সংহিতার সহায়তা নিতে পারি। শ্রী পঞ্চানন তর্করত্নের অনুবাদ। সেখানে বলছে পিতৃগণ শ্রাদ্ধের হবিষ্যান্ন অর্থাৎ তিল-ব্রীহ্যাদি দ্বারা একমাস, পায়স দ্বারা একবৎসর, ভক্ষ্য মৎস্য, তাম্রবর্ণ মৃগ, মেষ, ভক্ষ্যপক্ষী, ছাগ, চিত্রমৃগ, কৃষ্ণসার, রুরু, বন্যশূকর এবং শশ মাংস দ্বারা যথাক্রমে এক এক মাস অধিক কাল তৃপ্ত হবেন। অর্থাৎ হবিষ্যাদি দ্বারা একমাস, ভক্ষ্য মাংসে দুই মাস, তাম্রবর্ণ মৃগে তিনমাস এভাবে তৃপ্তির কালপ্রভাব বাড়বে। শ্রাদ্ধে প্রদত্ত গন্ডার মাংসে, মহাশঙ্কর (মৎস্য বিশেষ), ক্ষৌদ্র, মধু, রক্তচ্ছাগ মাংস, কালশাক, বাদ্ধীণস (বার্ধ্রীণস-এর কাছাকাছি শব্দ – এখানে বলছে অর্থ হল বৃদ্ধ শ্বেত ছাগ) ইত্যাদি গয়াতে যা প্রদত্ত হয় (এবং তিথিবিশেষে) তা অনন্ত ফলদায়ক হয়।
এ প্রসঙ্গে আসার কারণ, হিংসা-অহিংসার দ্বন্দ্ব একপ্রকার বেধে গিয়েছে তখন। সীতা যে সত্যাশ্রয়ী মুনির কথা বলছেন, রামকে অকারণ হিংসা করতে নিষেধ করছেন সে সবই এই দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতি। বিশেষ করে প্রচলিত রামায়ণে প্রক্ষিপ্ত হলেও বৌদ্ধদের উল্লেখ পাচ্ছি আমরা। নাটককার যে সময় নাটকটি রচনা করছেন সে সময় তার প্রভাব অবশ্যই আছে। কিন্তু তখনো বর্ণাশ্রমী সমাজ এমন অবস্থায় পৌঁছোয়নি যেখানে ব্রাহ্মণ মাত্রেই নিরামিষ আহার করবেন এমন দাবী উঠবে। অর্থাৎ সে কাল আরো পরের।
কিন্তু দ্বন্দ্ব বেধে গেছে। একদিকে মাংস ভক্ষণের নিন্দা চলছে, অন্যদিকে মাংস ভক্ষণের নিয়ম-নীতি করে তাকে চালু রাখাও হচ্ছে। ভোজনের নিমিত্ত প্রাণী হত্যার ক্ষেত্রে জন্ম-জন্মান্তরে প্রাণ নাশ হয়। অন্যদিকে আবার পারলৌকিক ক্রিয়াদিতে, ব্রাহ্মণের নিমিত্ত হত পশুর মাংস, মন্ত্রদ্বারা প্লুত করে নিলেই হল। তাতে সমস্যা নেই।
মৃগয়ার ক্ষেত্রে যেমন মাংস ভক্ষণ বৈধ। কারণ ঋষি অগস্ত্য সমস্ত পশুকে মন্ত্রদ্বারা পরিমার্জন করেছেন। এই সব কাহিনী দিয়ে মাংস ভক্ষণ অন্তত ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের জন্য চালু রাখা যাচ্ছে। আবার ব্রাহ্মণের ক্ষেত্রে আঁশহীন মাছ নিষিদ্ধ এ সংবাদও আমরা পাচ্ছি। ক্রমে ক্রমে, আমিষ বনাম নিরামিষ দ্বন্দ্ব বাড়ছে। কৃষি থেকে অন্যান্য কাজের জন্য পশুসংরক্ষণ প্রয়োজন একদিকে, অন্যদিকে মাংস খাবার প্রাচীন অভ্যাস এবং শারীরিক পুষ্টি। যিনি যে পক্ষকে যৌক্তিক মনে করছেন তিনি সেই পক্ষে। নাটককার নিশ্চয়ই এ দ্বন্দ্ব বিষয় অবগত একপ্রকার। সীতার ফল-জলের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দিলেন রাবণ কথিত কাঞ্চনপার্শ্ব মৃগ।
তাছাড়াও আছে নাটককারের হিংসা সম্পর্কিত ভাবনা। নাটকচক্রমের মধ্যকার নাটকগুলির অন্যতম দুটি নাটকের কথা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা চলে। একটি মধ্যমব্যয়োগ, অন্যটি পঞ্চরাত্র। দুটিই মহাভারত আশ্রিত। দুটি নাটকেই নাটককার সযত্নে কাহিনীর পরিবর্তন ঘটিয়েছেন হিংসা বর্জন করতে। তাঁর রচনা পড়তে পড়তে মনে হয় তিনি যদি বৈষ্ণব হয়ে থাকেন তাহলে তাঁর আদর্শ প্রায় অহিংসার পর্যায়ে পৌঁছোচ্ছে। কিন্তু পরিচিত শ্লোকটির মতই হিংসা-অহিংসার সম্পূর্ণ দ্বন্দ্বকে অতিক্রম করতে পারছেন না। অহিংসা পরমো ধর্ম, ধর্মহিংসা তথৈব চ। অহিংসা পরম ধর্ম বটে। কিন্তু ধর্ম রক্ষার্থে হিংসাও সেই ধর্মেরই অন্তর্ভূক্ত। এই যে বিরোধ এ তাঁর রচনাতেও ছায়া ফেলে যাচ্ছে। শুধু খাদ্যাভ্যাসেই নয়, রাক্ষসবধের প্রতিজ্ঞাতেও ধর্মের জন্য হিংসা বৈধ, এই ভাব ছায়া ফেলে যাচ্ছে। তাই রাবণের ফাঁদে রাম পা দেবেনই।
নাটকে মারীচের উপস্থিতিও নেই। রাম কাঞ্চনপার্শ্ব মৃগের কথা শুনে সেই মৃগের সন্ধানেই যখন হিমালয়ে যাবেন স্থির করলেন তখন রাবণ বললেন সকল মানুষ এই মৃগ দেখতে পায় না। যে রামকে নির্লিপ্ত, উদাসীন দেখেছি সেই রাম এই দৃশ্যে পাল্টে গিয়েছেন। দর্পের সঙ্গে তিনি বললেন তারা যদি হিমালয়েই থাকে, তাহলে হিমালয় হয় তাঁকে দেখাবে তাদের, নইলে ক্রৌঞ্চত্ব লাভ করবে। ক্রৌঞ্চ পর্বত পুরাণানুসারে মৈনাক পর্বতের পুত্র, হিমালয়ের পৌত্র। কার্তিক এবং পরশুরাম দুজনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তাকে বিদীর্ণ করেন। রামও দর্প ভরে বললেন হিমালয়কে বিদীর্ণ করার কথা। এই দর্প অবধি রামের আগমন নাটককারের প্রয়োজন ছিল। রাবণকে স্বগতোক্তিতে বলাচ্ছেনও রামের অসহ গর্বের কথা। সেই গর্বের বশে রাম বশীভূত যখন, দেখা দিল সে হরিণ।
নাটককার কিন্তু এখানে মারীচের কথাও বলেননি, বলেননি রাবণের মায়াতে তৈরী হওয়ার কথাও। এ জায়গায় আমাদের আশ্চর্য বোধ হওয়াই উচিত। কার্য-কারণ সম্পর্ককে অগ্রাহ্য করে চলে গেলেন কেন? যিনি খুঁটিয়ে মানুষ দেখেছেন, বুঝেছেন এক প্রকার, চিত্রিত হয়েছে সে সব খুঁটিনাটি যাঁর রচনায়, তিনি আচমকাই রাবণের কথাক্রমে হরিণ এনে ফেললেন?
না। কিছু পরেই জানাচ্ছেন মায়ার কথা। রাম মায়াবলে দূর। এইবারে রাবণ সীতাহরণ করবেন ঘোষণা করছেন। নাটককার, নির্লিপ্তি-কর্তব্যবোধ সে সবের বিপরীতে দর্পকে জাগিয়ে তুলে নাটকীয় ব্যঞ্জনাই শুধু সৃষ্টি করলেন না, মানুষের চরিত্রগত বিবর্তনকেও স্পষ্ট করলেন যেন। যে রাম পারেন পিতৃ-আজ্ঞা পালন করতে সম্পদে নিস্পৃহ হয়ে যেতে সেই রাম এভাবে ভাবলেন কেন? ভরতের সঙ্গে এই শ্রাদ্ধায়োজন নিয়ে কি পরোক্ষে হলেও যোগ্যতা এবং সম্পদের দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়লেন না? নাটককার সচেতনেই হোক কিম্বা অচেতনে, জানিয়ে দিলেন মানবচরিত্রের সেই ভঙ্গুরতার কথা, যার থেকে দর্প-ঈর্ষা ইত্যাদির সৃষ্টি হয়। উপলক্ষ্য দশরথের প্রতি রামের শ্রদ্ধা-ভালবাসা হলেও, উপলক্ষ্যের নেপথ্যে রয়ে গেল সম্পদের প্রতি মায়া। এ হরিণ সেই মায়ার হরিণই কি, যে ছুটিয়ে বেড়াতে শুরু করল রামকে? এ সকল বিবেচনার ভার পাঠকের। আমরা শুধু মনে রাখব এর পরেই রাবণ গর্বোদ্ধত অমিতবলশালী রামকে ছলনার কথা সীতাকে বলছেন।
প্রচলিত রামায়ণ কিন্তু এই পর্ব অবধি পৌঁছোনোর আগে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে রাম-রাক্ষস দ্বন্দ্বের। নাটককার কিন্তু কেন রাম রাক্ষস বধ শুরু করলেন তার কোনো কারণ দর্শাননি। অথচ প্রচলিত রামায়ণ, ঋষি-তাপসগণের রামকে এ কাজে নিয়োগের কথা সোচ্চারে বারংবার ঘোষণা করেছে। এই ভেদাভেদ কেন? আমরা প্রচলিত রামায়ণের এই বনবাসে রাক্ষসবধ অংশের বিস্তারিততে এই নাট্যালোচনায় যাব না। অন্য নাটকটি প্রসঙ্গে সে আলোচনা করব। কিন্তু এখানে আমাদের রামের জন্ম থেকে রাবণ বধ উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু ধারণা করার প্রয়োজন। সে আলোচনাতেই আপাতত আমরা মনোনিবেশ করি।
প্রচলিত রামায়ণে দশরথ সন্তান কামনায় যখন অশ্বমেধ যজ্ঞ শেষ করে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করছেন, অথর্ববেদ অনুসারে, তখনই দেবলোকে ব্রহ্মাদি দেবতারা বিষ্ণুকে রামরূপে জন্মগ্রহণের কথা বলছেন, রাবণ বধের নিমিত্ত। অর্থাৎ রামের জন্মের আগেই অলৌকিক দৈবী কার্যকলাপে রাম-রাক্ষস দ্বন্দ্ব স্থির হয়ে গেছে। শুধু রামই নয়, অন্যান্য দেবগণ দ্বারা বানরকূলের নানা বীর বানরের উৎপত্তিও বিষ্ণুর মানবতারকে সহায়তা করার জন্য স্থির হয়ে গিয়েছিল। তারপরে রাম-লক্ষ্মণ বালকাবস্থা থেকে উত্তীর্ণ হতেই বিশ্বামিত্র, তাঁর যজ্ঞে উপদ্রবকারী রাক্ষসদের, মারীচ ও সুবাহুকে দমনের জন্য দশরথের কাছে প্রার্থনা করেন। দশরথ, রাবণ এবং এই সকল রাক্ষসদের ভয়ে তাদের পাঠাতে প্রথমে অস্বীকার করেন। তারপরে নিজ কুলগুরু এবং পুরোহিত বশিষ্ঠর কথায় সম্মত হলেন। এইখান থেকে সরাসরি রামের সঙ্গে রাক্ষসদের বিরোধ সৃষ্টি হচ্ছে।
বিশেষ করে এই বিশ্বামিত্রের যজ্ঞাংশে প্রচলিত রামায়ণের কাহিনী দুটি সূত্র সূচনা করছে যা বাকী অংশকে গ্রন্থন করে রাখবে। এক, ইন্দ্রের বৃত্রবধ পরবর্তী ব্রহ্মহত্যার ভয়ে ঐ স্থানে আত্মগোপনের কাহিনী। সে কাহিনী থেকে জানা যাচ্ছে ইন্দ্রের বৃত্রহত্যা পর্বের পরে মুক্তিকালে ইন্দ্রেরই বদান্যতায় ঐ অঞ্চলে মলদ ও করুষ নামে দুটি দেবনির্মিত জনপদ ছিল। সে জনপদ আবার তাটকা বা তাড়কা রাক্ষসী কর্তৃক উৎসন্ন হয়ে ভয়ঙ্কর বনাঞ্চলে পরিণত হয়েছে। রামের তাড়কা বা তাটকা বধ দিয়ে তার একপ্রকার মুক্তি ঘটবে।
দুই, তাটকা একদা যক্ষী ছিল। সুকেতু নামক এক যক্ষীর কন্যা। সুকেতুর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা তাঁকে বিপুল বলশালী কন্যা দেন, কিন্তু পুত্র দেন না। পুত্র হলে লোক-নির্যাতন করবে সেই ভয়ে। তাটকা বা তাড়কার বিবাহ হয় জম্ভ নন্দন সুন্দের সঙ্গে। সুন্দকে আবার ঋষি অগস্ত্য কোনো কারণে বিনাশ করেছিলেন। তাটকা বা তাড়কা, পুত্র মারীচ সহযোগে তাই অগস্ত্যকে বিকটবেশ ও বিকটাস্য ধারণ করে বধ করতে গেলে অগস্ত্যের অভিশাপে রাক্ষসী হয়ে যায়। তাড়কাকে বধ করার জন্য রামের যাতে স্ত্রী-বধ জনিত অস্বস্তি না হয় তাই বিশ্বামিত্র তাঁকে চতুর্বর্ণের হিতের জন্য স্ত্রী বধে অধর্ম নেই জানাচ্ছেন। বিরোচন কন্যা মন্থরাকে ইন্দ্রের হত্যা অথবা শুক্রমাতা পতি-পরায়ণা ভৃগুপত্নীকে বিষ্ণুর বধের উদাহরণ দিচ্ছেন। রামও তাটকা ও সুবাহু বধ, মারীচ তাড়ন ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে রাক্ষসদমন প্রকল্পে যুক্ত হয়ে পড়ছেন বিষ্ণুর অবতারাংশ হয়ে। সে প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপ হল বনবাস কালে অগস্ত্যেরই নির্দেশিত পঞ্চবটী বনে শূর্পণখার অঙ্গচ্ছেদন। এই দিয়ে আবার রাক্ষসবধ পালা শুরু।
নাটককার কি এই সকল অংশকে তাঁর ভাবোপোযোগী মনে করেননি? তিনি বৈষ্ণব হলেও, সেই ধারার বৈষ্ণব যাঁর কাছে রাম আদর্শস্থাপনের জন্য নির্মিত চরিত্র। কিন্তু সে আদর্শ নিছক রাক্ষসবধের আদর্শ নয়। তাঁর কাছে, নাটক পাঠে বোধ হয়, রাম চরিত্রের মূল কর্মই হল সংসারে সন্তান, ভ্রাতা, পতী ইত্যাদি ভূমিকার তৎকালের জন্য আদর্শ নির্মাণ। তাতে সাময়িক দর্পের মত বিচ্যুতিও আছে। কিন্তু রাক্ষসবধই একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। এখানে আমাদের আলোচনার পরবর্তী নাটককার ভবভূতির সঙ্গে তাঁর যথেষ্ট পার্থক্য আছে। যথাস্থানে আমরা তার আলোচনাও করব। আপাতত আমরা এটুকুই জানি রাক্ষসবধে রামের পারঙ্গমতা দেখানো এই নাটককারের মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। তাই এই অঙ্কে রামের দর্পের ফলে মায়াবলে ভোলা এবং রাবণের সীতাহরণ মুখ্য থেকেছে।
সীতাহরণ প্রসঙ্গে আমরা এখানে রাবণের ভূমিকাও কিছুটা আলোচনা করে নিতে পারি। রামের বিপরীতে রাবণও পুরুষই। কাছাকাছি সংস্কৃতিরও পুরুষ সেই অর্থে। কারণ রাবণ ব্রাহ্মণ সন্তানও। প্রচলিত রামায়ণে রাবণের এই আশ্রমে প্রবেশ ঘটবে রাম-লক্ষ্মণ দুজনেই ক্রমে ক্রমে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার পরে। রাম, মারীচের মায়ামৃগ রূপে সীতার মুগ্ধতার জন্য সে মৃগ ধরতে অথবা মারীচ বলে নিঃসংশয় হলেও তাকে রাক্ষস বলে বধ করতে বেরোবেন। লক্ষ্মণ তারপরে সীতা কর্তৃক তিরস্কৃত হয়ে রামের সাহায্যার্থে বেরোবেন। সেই অংশও আমরা পরবর্তী নাটক প্রসঙ্গে আলোচনা করব, যেহেতু সে নাটকে এ অংশ গুরুত্ব দাবী করে।
এই নাটকে কিন্তু লক্ষ্মণ এ দৃশ্যে একেবারেই অনুপস্থিত। সীতাই জানাচ্ছেন রামকে, যে কুলপতিকে আনার জন্য রাম লক্ষ্মণকে প্রেরণ করেছেন। অতএব সীতাকে রাম অতিথি সেবা করতে বলে পরিব্রাজক ছদ্মবেশধারী রাবণের কাছে রেখে চলে গিয়েছেন। রাবণ, যখন নিশ্চিত হলেন যে রাম মায়াবলে ভুলে মৃগের পশ্চাতে দূরে চলে গেছেন তখন সীতাকে স্বপরিচয় জানাচ্ছেন। স্বরূপ প্রকাশ করছেন। শুধু তাই নয়, নিতান্ত দর্পপ্রকাশ করছেন রাম-লক্ষ্মণ বা ইক্ষ্বাকু বংশীয় সকলের বীরত্ব সম্পর্কে। দেবতাদিদেরও কোনোভাবেই ধর্তব্যের মধ্যে আনেন না যে জানাচ্ছেন। অর্থাৎ রাবণ যে স্বয়ং দর্পী তার প্রকাশও ঘটছে। তাঁর দর্প রামের তুলনায় কম নয়, বরং বেশীই।
প্রচলিত রামায়ণে রাবণ প্রবেশ করে প্রথমে সীতার রূপবন্দনা করছেন। তারপরে জানতে চাইছেন তিনি কে এবং কোথা থেকে এলেন। সীতা, পরিব্রাজকরূপী রক্তবসনধারী রাবণকে ব্রাহ্মণ জ্ঞান করে আসন ও পাদোদক দিচ্ছেন এবং অন্ন গ্রহণ করতে অনুরোধ করছেন। তারপরে রাম-লক্ষ্মণ সমেত নিজ দুঃখদ বৃত্তান্ত বর্ণনা করছেন। তারপরে রাবণের পরিচয় জানতে চাইলে রাবণ সগর্বে আত্মপরিচয় দান করে সীতাকে লঙ্কায় গিয়ে তাঁর ভার্যা হতে বলছেন। এই নাটকে কিন্তু ভার্যা হবার কথা বলছেন না রাবণ। নিজের গুণ ও বলমহিমা বর্ণনা করে বলছেন সীতাকে অপহরণ করবেন। আবার বলছেন সীতা যেখানে আছেন সেই ভূমি ধন্য।
প্রচলিত রামায়ণে সীতা রাবণের প্রস্তাব শুনে তাঁকে কঠোর ভাষায় নিন্দা করেন। শুধু তাই নয়, রামের গুণাগুণ ব্যাখ্যা করে রাম ভিন্ন তিনি যে কারো অভিলাষিণী না তাও স্পষ্ট করেন। এই সব চলতে চলতেই সীতাকে রাবণ অপহরণ করলেন। একদা প্রচলিত রামায়ণ রাবণের গর্ধভ বাহিত রথের কথা বলে থাকলেও অপহরণকালে কিন্তু এসেছিল সুদিব্য স্বর্ণবিমান। অর্থাৎ কোনটি বাহন তা নিয়ে সেখানে সমস্যা আছে। আমরা আপাতত বিমানই ধরি।
রাবণ তাতে আকাশপথে সীতাকে নিয়ে লঙ্কাভিমুখে গমন করতে শুরু করলে জটায়ুর আগমন ঘটে। জটায়ুর এই আগমন খুবই আচমকা এমনও নয়। পঞ্চবটীর এই আশ্রমে যখন রাম-সীতা-লক্ষ্মণ প্রথম এসেছিলেন তখনই পক্ষীরাজ জটায়ু জানিয়েছিলেন তিনি তাঁদের রক্ষা করবেন। বিশেষত, রাম-লক্ষ্মণের অবর্তমানে সীতাকে দেখভাল করা, প্রহরা দেওয়ার কাজ করবেন। যদিও সীতাহরণকালে তিনি বৃক্ষে নিদ্রিত ছিলেন, তবু রাবণ নিয়ে যাচ্ছে এমন সময় সীতা তাঁকে দেখতেও পেয়েছেন। সীতারই কাতর কথায় তাঁর নিদ্রা ভঙ্গ হয়। কিন্তু তিনি আশ্রমের ধারেকাছেই ছিলেন।অতএব সীতা হরণের সময় তাঁকে পাওয়া যাবে এ বিচিত্র নয়। কিন্তু নাটকে জটায়ু আসছেন আচমকাই। তার আগে তাঁর ন্যূনতম উল্লেখও নেই। দর্শকগণ, রামকাহিনী জানেন ধরে নিয়ে রচনার ফলেই কি এ দুর্বলতা নাটককারের?
আমরা বলছিলাম দর্পের কথা। এ নাটকে রাবণের সেই দর্প এ অঙ্কে অন্যভাবেও প্রকাশিত। সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে যাবার সময় রাবণ চিৎকৃত ঘোষণা করছেন, জনস্থানবাসী তপস্বীদের প্রতি। তিনি সবলে নিয়ে যাচ্ছেন সীতাকে। ক্ষাত্রধর্মে যদি রামের প্রীতি থাকে তাহলে যেন রাম পরাক্রম প্রকাশ করেন। প্রচলিত রামায়ণে সীতাই গাছ-পালা-নদী সকলকে ডেকে ডেকে রাবণ তাঁকে অপহরণ করছেন এ কথা যেন রামকে জানানো হয় বলছেন। এই নাটকে রাবণ বলছেন। রামের দর্পের বিপরীতে রাবণের এই দর্প যেন শাসক পুরুষের এক চরিত্রের প্রকাশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু এখানে রাবণের দর্প, আজকের প্রেক্ষাপটে স্বতন্ত্র বিচারের দাবীও রাখে। কেন সীতা হরণ করলেন রাবণ? রামায়ণের কাহিনীক্রম আমরা জানি। কিন্তু সে কাহিনীক্রমের কথা মাথায় রেখেও এ প্রশ্ন রাখাই যায় রাক্ষসবধ যুদ্ধ রামের দায়, শূর্পণখার অঙ্গচ্ছেদের মত কুৎসিত কাণ্ড রামের আদেশে লক্ষ্মণ ঘটিয়েছেন এ কথাও সত্য, সঙ্গে এও সত্য শূর্পণখা কাহিনী অনুসারে সীতাকেই আক্রমণ করেছিলেন। তাঁকে অন্যভাবে নিবারণ করা যেত কী না সে এক ভিন্ন আলোচনা! অথবা কাহিনীকার শূর্পণখাকে এভাবে চিত্রিত করেছেন কেন সে নিয়েও প্রশ্ন তোলা চলে। তবু সীতার অপরাধ কি?
এখানেই শাসক পুরুষের নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীর প্রশ্নে আমরা আরেকবার চলে আসি। রামশরণ শর্মা, তাঁর ‘পোজিশন অফ শুদ্র’স ইন এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া’-তে উল্লেখ করছেন পুরুকুৎস-র পুত্র ত্রসদস্যুর কথা, যিনি পঞ্চাশজন নারীকে উপহার হিসেবে দিচ্ছেন। ঋগ্‌বেদ থেকেই উদ্ধৃত করছেন রামশরণ। তিনি বলছেন, ঋগ্‌বেদের প্রথম যুগে সম্ভবত শত্রু পুরুষদের হত্যা করে তাঁদের সমাজের নারীদের দাসী বানানো হত। খুবই সম্ভব এমনটা। ইতিহাসে, পৃথিবীর নানা জায়গায় এ বিষয় ঘটতে দেখা গিয়েছে।
অন্তত পশুপালক সমাজে প্রচুর দাস পুরুষও সমস্যার বিষয়। বিশেষ করে যে পশুপালকেরা পশুচারণের জন্য বারংবার জায়গা পরিবর্তন করতো তাদের পক্ষে সারাক্ষণ এক বিরোধী শক্তিসমাবেশকে সঙ্গে নিয়ে চলাটা একদিক থেকে অন্তত বিপজ্জনক ছিল। কিন্তু নারীদের সেই পর্যায়ের ভীতকর বলেও পুরুষশাসিত পশুপালকরা মনে করতো না। বিশেষ করে কোনো একটি অঞ্চলকে তারা নিজেদের বাসস্থান হিসেবে স্থির করে ফেললে।
সেক্ষেত্রে নারী দাসী, গৃহকর্ম (যার একটা বড় অংশই পশুকেন্দ্রিক) থেকে দাস পুরুষের জন্ম দেওয়া সব ক্ষেত্রেই সুবিধেজনক। এই যে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী তা কৃষিজীবি সমাজে কমেনি, বরং বেড়েইছে। নানা যাগ-যজ্ঞে ব্রাহ্মণকে গাভী ইত্যাদির সঙ্গে দাসী দেবার বহু উল্লেখ মহাকাব্য-পুরাণেও ছড়িয়ে আছে। আবার ক্ষত্রিয় বিবাহে, মেয়ের পিতৃকূল থেকে সঙ্গে নানা বর্ণের দাসী আসছে তাও আমরা জানছি। যেমন গান্ধারীর সঙ্গে আসা বৈশ্যা দাসীর গর্ভেই ধৃতরাষ্ট্র যুযুৎসু-র জন্ম দিচ্ছেন। এই অবমাননাকর অবস্থান, যদি গৃহের নারীদের একাংশের প্রতি প্রযোজ্য হয়, সেক্ষেত্রে বাকীদেরও আজ নয় কাল, পুরুষের থেকে সে ব্যবহার পেতেই হবে। বা হওয়ার সম্ভাবনা বেশীই। বৈদিক থেকে পৌরাণিক যুগের দিকে আসতে আসতেই নারী, সম্পূর্ণত, পুরুষের অধীন হয়ে গিয়েছে। বাল্য ইত্যাদিতে পিতার অধীন, যৌবনে স্বামীর, বার্ধক্যাদিতে সন্তানের (পুরুষ) অধীন। স্বাধীনতা তার জীবন থেকে একেবারেই গিয়েছে।
এই যদি একদিক হয়, অন্যদিক হল নারী, সন্তান, গবাদি পশু ও জমি – সব কিছুকেই নিতান্ত সম্পদ জ্ঞান করার সংস্কৃতি জন্মিয়েছে। যার সন্তান নেই সে দরিদ্র। ঋগ্‌বেদ এমনই বলছে এক জায়গায়। তাহলে সন্তানধারণ যে করবে তার ভূমিকা? ভাল কথাও আছে। নববধূকে বলছে, শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ-দেবরের উপর সম্রাজ্ঞী হতে। কিন্তু এই ভাল কথাটিও বড় গোলমেলে। সম্রাজ্ঞী হলে বাকীরা শাসিত হল। অবস্থা সাম্য এলো না। সম্রাট-সম্রাজ্ঞী হওয়াকে মহীয়ান করার মধ্যে দিয়ে কি আদৌ ক্ষমতার-দায়িত্বের-কর্তব্যের সমবন্টন সম্ভব? এই অবস্থার যে আবেগ সে স্তিমিত হয়েও যায়।
পরের দিকে তার উদাহরণ আমরা পাচ্ছি অবিরল। মৈত্রায়ণী সংহিতা নারী, সুরা, পাশাকে এক করছে। ঐতরেয় বলছে কন্যা দুঃখের উৎস সংসারে। সেই কন্যাই সৎ যে প্রত্যুত্তর করে না। আপস্তম্ব ধর্মসূত্র বলছে নারীকে হৃদয় দিয়ে প্রার্থনা উচিত নয়, কিন্তু যথেচ্ছ ভোগ করতে বাধা নেই। অজস্র উদাহরণ আছে। আরো সূচীমুখ করি বরং। কালে কালে নারীর ভূমিকা দাঁড়িয়েছে জমির মত পুত্র ফসল উৎপাদনের। জমিকে ধরিত্রী দেবী বলার মত নানা নারী দেবতার সৃষ্টিও হচ্ছে পৌরাণিক কালে। কিন্তু নারীর অবস্থান সম্পদের নিরীখেই বিবেচিত। সেক্ষেত্রে রামের যা সম্পদ তার মধ্যে অযোধ্যা চলে গিয়েছে। অতএব রাবণ আঘাত করছে তাঁর দ্বিতীয় গুরুত্বের সম্পদ স্ত্রী-কে। এতে রাবণ আরেকজন পুরুষমাত্র বলেই প্রমাণিত হন।
আর্য-অনার্য দ্বন্দ্বে ভারতের রাজনীতি আবর্তিত হয়ে চলেছে অনেককাল ধরেই। এম এস এস পান্ডিয়ান যেমন ‘আউটলুক’-এ একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন এ নিয়ে। প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘উত্তরের সাম্রাজ্যবাদের হিন্দু-হিন্দি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে রাবণের পুনরাবিষ্কার’। প্রবন্ধ শুরুই হচ্ছে প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী করুণানিধির বিখ্যাত উক্তি দিয়ে, ‘যদি আপনি রাবণকে অপমান করেন, তার মানে আমাকে অপমান করছেন’। করুণানিধির তীব্র সমালোচক হিন্দু মুন্নানির রামাগোপালন সঙ্গে সঙ্গেই বলেছিলেন করুণানিধি বিন্দুমাত্র বদলাননি। তিনি ক্ষুব্ধই ছিলেন তার কিছুকাল আগে পেরিয়ার দ্রাবিড় কাজাগম-এর সদস্যরা রামের কুশপুতুল দাহ করায়। ওঁরা আবার রামের কুশপুতুল দাহ করেছিলেন উত্তর ভারতে রাম লীলাতে রাবণকে দাহ করার পাল্টা হিসেবে।
আর্য-অনার্য, উত্তর-দক্ষিণ, হিন্দু-দ্রাবিড় ব্রাহ্মণ-দলিত এই সব নানা বর্গে দ্বিভাজিত হয়ে দ্বন্দ্বটা চলে এসেছে ব্রিটিশ শাসন পরবর্তী যুগেও। সে দ্বন্দ্বের অন্যতম উপাদান থেকেছেন রাম-রাবণ। রামের চরিত্র এবং রাবণের চরিত্রও বিবর্তিত হতে থেকেছে দ্বন্দ্বের স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী। করুণানিধিই শুধু নয়, দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাগম-এর প্রতিষ্ঠাতা আন্নাদুরাই নিজেই একটি নাটক লিখেছিলেন ‘নিদি থিবন মায়াক্কম’ (নিথি দেবন মায়াক্কম-এই নামও চলে) নামে, ১৯৪৭-এ। এই ২০১৮-তে আলাগাপ্পা বিশ্ববিদ্যালয়, তামিল স্নাতকোত্তর সিলেবাস থেকে সরিয়ে দিচ্ছিল নাটকটিকে। সে নিয়ে বিতর্ক হতে আবার ফিরিয়ে আনে। নাটকের নামটির বাংলা করলে মোটামুটি ভাবে দাঁড়ায় ‘বিচারকের দ্বিধা’। দ্বিধা কিসের?
তামিল সঙ্গম সাহিত্যের যুগের কবি কম্বন একটি রামায়ণ লিখেছিলেন বাল্মীকি রামায়ণ অবলম্বন করেই। লিখেছিলেন বলছি এই কারণে, কম্বন সে অর্থে অনুবাদ করেননি। তিনি তাঁর মত করে বাল্মীকির রামায়ণ বলে যা সেকালে পরিচিত তার থেকে সূত্র নিয়েছেন। কাহিনী কাঠামোর প্রবল পরিবর্তন না করলেও চরিত্রের ক্ষেত্রে নানা স্বাধীনতা নিয়েছেন। তাঁর রাবণ, বাল্মীকির রাবণের থেকে অনেকটাই আলাদা। সে প্রসঙ্গে পরবর্তী নাটকের আলোচনায় আমাদের আসতেই হবে। তাই এখানে এটুকু উল্লেখই যথেষ্ট।
আমরা এখানে লক্ষ্য করি যে প্রাক্‌-স্বাধীনতা যুগের (১৯৪২) থেকে কম্বনের রামায়ণ তামিলদের অপমান করছে এমন একটি অবস্থান পেরিয়ার নিজেই নিয়েছিলেন। তাঁর ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধিতার জায়গা থেকে। তিনি কম্বনের লেখা নিষিদ্ধ করা উচিত, পুড়িয়ে দেওয়া উচিত ইত্যাদি বলেছিলেন। আন্নাদুরাই কিন্তু অন্য রাস্তা নিয়েছিলেন। তিনি নাটকটি লিখলেন। কম্বনকে প্রশ্ন করালেন রাবণকে দিয়ে। রাম সম্পর্কে অজস্র প্রশ্ন – যা নৈতিকতা সম্পর্কিতও, তার উত্তরে দয়াশীল সহানুভূতি প্রবণ রামের যে চরিত্র কম্বন এঁকেছিলেন তাঁর মহাকাব্যে, তাকে ধ্বস্ত করেছে এই নাটক। রাবণের সঙ্গে শম্বুক এবং সীতাও যোগ দিয়েছেন তাতে।
নীতি-নৈতিকতা অচল অনড় কিছু নয়। যে কোনো দেশ-কালে তার নানা চেহারা। নীতি-নৈতিকতা নির্দিষ্ট দেশ-কালেও সার্বজনীন হতে পারে না। সুতরাং প্রতিটি বিষয় নিয়েই প্রশ্ন করা চলে যে কোনো কাহিনীকে। কিন্তু প্রশ্ন করার সময় এ কথাও বিবেচ্য, যে মানদণ্ড সকলের ক্ষেত্রে একই থাকছে কী না! রামের বালি বধ ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন উঠলে রাবণের সীতাহরণ নিয়েও প্রশ্ন থাকার কথা।
ব্রাহ্মণ্যবাদ নারীকে যেভাবে দেখে তার বিরোধীরা কি অন্য রকম ভাবে দেখেন? যদি দেখেন তাহলে এ সমালোচনার দায় তাঁদের বর্তায়। যদি না দেখেন, তাহলে একটি শাসনতন্ত্র গিয়ে আরেকটি আসবে মাত্র, পরিস্থিতি বদলাবে না নারীর। সুতরাং তা সর্বতোভাবে সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। নাটককার এই অঙ্কে রাম এবং রাবণ দুজনের দর্পই প্রতিষ্ঠা করেছেন। যে পুরুষতান্ত্রিক দর্পকে ভুললে চলবে না।

Facebook Comments

Leave a Reply