হাগাম ও তার দেশ : সুপন দে

ওতো… ওতো… শুদু খাবা, শুদু ভেটকে শোবা, ওতো… শুদু গতর বাগালি শিং নাচালি প্যাট চলবে… হারামখোর… ওতো… ওতোন মারাও…খাঁড়ায়ে মারাও…

ভাঁজ করা লুঙ্গির ফাঁক দিয়ে সিড়িঙ্গে ডান পা বিশাল ষাঁড়টার মেরুদণ্ডে বিধিয়ে প্রতি কথায় অনবরত খুঁচিয়ে যাচ্ছে ধনা বোস্টম, অন্য পা খানা প্যাঁচড়ার দাগ সমেত আঙ্গুলের ভরসায় শক্তি জোগাতে গিয়ে টলে যাচ্ছে হরদম, হাতের পাঁচন লাঠি হয়ে ব্যালেন্স রাখার কাজে লগবগে তটস্থ। নিস্ফলা আম গাছটার গুড়িতে পাটকিলে গাই দড়ি ছোট করে উঁচুতে টানটান বাধা, মাটিতে পা রেখে ঝুলছে – যেন শুতে না পারে। শুটকো লেজের প্যাটকা গরুটা আপাতত ডাক বন্ধ করে ভোস ভোস দম নিচ্ছে চোখ নাক একসাথে কাজে লাগিয়ে, হাঁ চোয়ালের কষ থেকে ফ্যানা টুপিয়ে পড়ছে ধুলোয়। গুড়িটার আশপাশে হাত দশেক ব্যাসে কোন ঘাস নেই, কখনও ছিল এমন সন্দেহের অবকাশও নেই। এই দশহাতি বলয়ের কিছু দূরে বিলেনভেদি নব্য ইটের সভ্য রাস্তা আর ধনা বোস্টমের সাজানগোছান সংসারের যোগসূত্রে আহতলম্বা পথটার ধার ঘেষে বসে আছে হাগাম মোল্লা। বয়েস চৌদ্দ, তেরো নয়, পনেরো হতে পারে কিনা সে সন্দেহ স্কুলের খাতা থেকে দূর করতে অনেকটাই সাহায্য করেছে পঞ্চাত মেম্বার। বাপের হাঁটাহাঁটি কিছু হয়েছিল কাজ কামাই দিয়ে, কিন্তু মেম্বার বাপেরও বড় বোস্টমের বড়, ষাঁড়ের বড় এমনকি গাইগরুর দুধের চেয়েও বড় হয়ে হাগাম, স্কুলের খাতায় হায়াৎ গাজীকে রক্ষা করেছিল কবছর আগে। রক্ষা করেছিল, কারন স্কুলে মিড ডে মিল দেয়। আর একটা বছর বাদে স্কুলের খাতায় নাম রাখার মতো কারন হাগাম মোল্লাকে অতি কষ্টে খুঁজতে হবে অথবা স্কুলকেই তাকে স্কুলে পড়ানর অন্তত একটা কারন যাহোক করে জোগার করতে হবে। সে বিস্তর পরের ভাবনা। আপাতত ভোর থেকে ডেকে ডেকে গলা ভাঙা কষে ফেনায়িত প্রস্তুত পাটকিলে গাইকে তিনি দেখাতে এনেছেন, দেখাবেন ধনা বোস্টমের বিখ্যাত ষাঁড় ধবলা ওরফে ধলাকে।

ধনা বোস্টম বা ধলার বেশ নামডাক, আশপাশের তিন চারটে পাড়া গ্রামে যত গাই আছে তাদের পিরিত চাগালেই প্রভুরা দড়ি টানতে টানতে হাজির করে ধনার উঠোনে। ধলার বীজ ভালো, নামডাকও ছড়িয়েছে, পাতি দেশির পেটে যে বকনা বাধায় তারও দুধ হয় এবেলাওবেলা মিলে চার পাঁচ সের। এঁড়ে হলেও হয় তাগড়াই, স্বাস্থ ভালো থাকে, দাম ওঠে। অবশ্য মা মেয়ে সবাইকে এক চোখে দেখে ধনা আর ধলা, এঁড়ে বড় হলে তাদের মন ওঠে না, তখন খ্যাদাতে চায়, মালিককে বেচে দেওয়ার পরামর্শ দেয়। সবচে বড় কথা, আকালে শুকনায় শীতে বর্ষায় ধলার বাছুরগুলো বেশিরভাগ
টেকে, টেসে যায় না, বাঁচে কোনক্রমে। মাইলটাক দূরে একটা পশু হাসপাতাল অবশ্য আছে, সরকারি। সেখানেও কেউ কেউ গিয়েছে, যায়ও লোভে পড়ে। শেষ পর্যন্ত পোষায় না, ফ্রি ফ্রি করেও কম্পাউন্ডার নেয় দেড়শ, হাতে গ্লাভস খাটিয়ে হোগায় হাত পুরে গোবর টেনে টেনে সাফা করে স্যুই দেয়, ভালো বিদেশি ষাঁড়ের বীজ ভরা স্যুইতে না গরুর মন ওঠে না মালিকের। তারউপরে গাভিন হয় না ঠিক, হলেও প্যালাঙা বাছুরগুলোর বেশিরভাগ পটকে যায়। ডাক্তার কে বললে বলে মালিকের দোষ, সব দুধ নিজেরাই চুষে মালিকরা নাকিবাছুরদের শুকিয়ে মারে। তার চে ধনা ভা্লো, লাগে একশ, লাগায় দুবার, কোন মিস নেই, ধলা পিঠে উঠলেই নিশ্চিন্ত, ধনা ঠকায় না, অন্তত দুবারের কমে কাউকে ছাড়েও না, চোখের সামনে সব দেখে শুনে বুঝে নেওয়া যায়, একেবারে ছবি সই ঘটনা প্রসঙ্গ সমেত টাটকা এবং খাঁটি। সুতরাং বিঘে চারেক জমিতে চাষের পাশাপাশি ধলার জয়জয়াকারে ধনার রোজগার ভালো, প্রতিপত্তি খারাপ না, লোকে তার আধো বোলের দু-কথা শোনে, ধারটা মুলোটা চাইলে পায়, মান্যও করে সামনাসামনি। তবে আশপাশে পাড়ায় গ্রামে ধলার প্রেমিকা, নিজের বীজজাত প্রেয়সির সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় তাদের বেশ ব্যস্ত থাকতে হয়, বিশেষত গোন মুখে। আর বয়েস ব্যস্ততা ও ক্লান্তির রেষারেষি সম্পর্কের কারনে ধনার লাথি খোঁচাতেও ধলা আর উত্যক্ত হয় না ইদানিং, এখন যেমন বেশ মনমরা নিস্তেজ।

মেটে পথের ছলবলে ধুলোয় হায়াৎ ওরফে স্কুল ভাষ্যে হাগাম উবু হয়ে বসতেই নোংরা হাফপ্যান্টের সাথে ধুলোরা ঢলাঢলি শুরু করেছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে হাতের বিঘত দুই লম্বা শুকনো ট্যারাব্যাঁকা ডালখানা নাড়াতে নাড়াতে অবাক চেয়ে দেখছে ধনাকার দাপট। অমন তাগড়া ত্যাওটে শিংওলা মদ্দাটাকে ল্যাকপেকে ঠ্যাং দে যে লেথন লেথচ্ছে সেটা হায়াৎকে হাস্যোজ্জ্বল করেছে এইমুহুর্তে, কাচা ঘুমের পরে চোখের জ্বালাটাও একটু কমের দিকে, জল গড়ানো বন্ধ হয়েছে এইমাত্র। তার নাম হায়াৎ না হাগাম সে বিষয়ে খুব না ভাবলেও ইদানিং কিছু সন্দেহ হচ্ছে মনে মনে, কাউর কাছে খোলসা করা হয়নি, তেমন কাউরে পাওয়াও যাচ্ছে না।

আগে ছেল হায়াৎ, ইসকুলির থে নাম হলগে হাগাম, কেরামকরি হতি পারে, ধনা ধলা বা ধলা ধনার মতন হতি পারে কি! গাই ডাকদিলি লোকে বলে ধনারে দে আন, ধনা কি দিতি পারে? দিলি প্যাট হয়? যে গাইগুলান চাগায় উঠলি ডাক না দে ক্ষেপি যায়, বারছুট মারে, তারেও কি ধনাকা দিতি পারে এরাম ল্যাকপেকে ঠ্যাংয়ে খাড়ায়ে? কি দেয়, কেরামবায় দেয়?

নাম নিয়ে কারো কারো নিজের সংশয় থাকা স্বাভাবিক। যখন নাম দেওয়া হয়, ডেকে ডেকে সেই নামে অভ্যস্ত করান হয় তখন পছন্দ অপছন্দ আসে না, যখন
নিজের নাম বানান মানে সমেত বোঝা যায়, নিজের নামে নিজেকে চিনতে জানতে হয় বা নাম পদবি দাগিয়ে চিহ্নিত করার কাজটা সম্পূর্ণ হয় তখন পক্ষ লাগে, পক্ষপাতিত্ব করতে হয়, যাকে পছন্দ বলে। সখে বা প্ররোচনায় কেউ একজন বাপকে পটিয়ে নাম রেখেছিল হায়াৎ। কিন্তু স্কুলে নিয়মিত যেতে আসতে, খালিপেটে গরম গরম মিড ডে মিলের মোটা চালের ভাতে আলু ডাল সবজি খিচুরি আর মধ্যে মধ্যে ডিম পড়ার প্রতিক্রিয়ায় অফুরাণ বায়ু উৎপন্নতা ও নির্গমনের প্রাকৃতিক উপায় অবলম্বন করার কারনে হায়াৎ নাম পালটে হাগাম হয়ে যেতে পারে যখনতখন। যদিও অনেক কৌশল, বুদ্ধি চেষ্টা শ্রম সহ্যের ব্যবহারে লুকিয়ে বা নিঃশব্দে সমাধা করলেও পেট মরা দুবৃত্ত গন্ধটুকুর নির্মম ম-ম বলিষ্ঠতায় অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া নাম ক্রমশ স্যার থেকে স্কুল, স্কুলের পাঁচিল পেরিয়ে পাড়া ঘর সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত। খাতায় কলমে গ্রথিত নামটি বিলুপ্তির মুখোমুখি। সুতরাং হায়াৎ গাজী নিজের কাছেও হাগাম মোল্লা। যিনি ভাঙা ডালের ইশারায় ধুলো নাচাচ্ছেন আর ষাঁড়ের করুন মুখের প্রতি দৃষ্টি বরাবর আটষট্টি গাছের ডগায় একটা হলদে ফড়িঙকে আরেক মেটে ফড়িঙয়ের পীঠে চেপে মস্তি করতে করতে ধলাকে উৎসাহ দিতে দেখছেন। অবশ্য খানিক সময় যেতেই ধনাকার লেথনে ষাঁড় খাড়িয়েছে, নির্বিবাদী ভঙ্গিতে ভোরের জাবনা চেবাতে চেবাতে নৈমিত্তিক অভ্যাসে পাটকিলের পোঁঙা শুঁকছে বারবার। গাইটাও বদ, ধলা যত শোঁকে তত ফিচফিচ করে মুতে দেয় ছটাক খানেক, যতবার শোঁকে তত লেজ তুলে ধুয়ে দেখায় প্রেমিক প্রবেশের রম্য গম্য পথের ডৌল। এ দৃশ্য হাগামকে মনযোগি করে, কেমন একটা ফিচেল শিরশিরে কাঁপুনি সকালের ঝিরঝিরে হাওয়ার সাথে উতলা করে দেখা আর না বোঝার ছায়ারোদময় বেয়াদপি আগ্রহ। তারই ফাঁকে ধলা ফোস করে, মাথা ঘুরিয়ে শিং নাচিয়ে গোটা গতরে কেমন যেন ছটফটানি নিয়ে সামনের পা পাটকিলের পিঠে তুলেও নামিয়ে আনে বারবার, ঘনঘন গাইয়ের মুত শোঁকে চোখ টেরিয়ে নাক ফুলিয়ে। ধলাকার বিড়ি পোড়া কালো ঠোটে একটা হাসি ওঠে ছলবলিয়ে।

সময় খেয়াল ছিলনা ধনা ধবলা পাটকিলে হাগাম কারো, থাকার কথাও না। আধোঘুমে মায়ে পিটিয়ে খিস্তোতে খিস্তোতে হাতে পাটকিলের দড়ি ধরিয়েছে, মুখে জল পড়েনি, ঘুমটা পুরো কেটেছে মাত্র কিছু আগে। আসার পথে প্যালকা পাটকিলেও তাকে বেশ বেগ দিয়েছে, হদ্দ চেনা রাস্তাতে আসতেও হারামিটার টানে তাকে এদিক ওদিক করতে হয়েছে অনেক। ধনাকার দুয়োরে পৌছে অবশ্য বিশেষ খাটতে হয়নি, পাটকিলে নিজেই ডাকাডাকি করে ব্যবস্থা গুছিয়ে নিয়েছে, এমনকি দড়িটাও তাকে বাঁধতে হয়নি, অত উঁচুতে তার হাত পৌছয় না, ডিঙি মেরেও নাগাল পাওয়ার বয়েস হয়নি। বিশেষ কিথাবার্তা বা ভালমন্দ খোঁজ খবরেরও দরকার পড়েনি। ধনাকা শুধু জিজ্ঞেস করেছে – একশ এনেছিস? মার কথামতো সেও ঘাড় কাত করে সরে এসে বসেছে কুচি দিয়ে ভাঁজ করা তিন তিনটে কুড়ি টাকার নোট পকেটে, এতে যে একশ হয় না সেটুকু অঙ্ক তার আয়ত্তে। যদিও খুব চিন্তার কিছু নেই, কাজ মিটে গেলে কিছু গালাগালি আর অভিশাপ দেওয়া ছাড়া ধনাকার কিছুই করার থাকবে না। বীজ আর বিষ একবার ঢেলে দিলে ফেরৎ নেওয়ার উপায় থাকে না, সে ভাবনাও নেই। সুতরাং বেশ খানিক খিদে, চোখে পিঁচুটি, ফাটা ঠোটে প্রথম শীতের রি রি আর গাল ভর্তি এদো গন্ধের সাথে পেটে কলকলে আওয়াজে চিনচিনে ব্যাথা নিয়ে সময় সচেতন থাকার কথা মোটে থাকে না। কিন্তু ধনা বোস্টমের মেজ মেয়ে বৈশালী, ডাক নাম বৈচি, ফিটফাট সাদা জামা খয়েরি স্কাটে ইস্তিরির ভাঁজ লাগা স্কুল ড্রেসে বেরতেই সময়টা ক্যাঁক করে ধরা পড়ে যায়। পৌনে এগারটার স্কুলে একটু তাড়াতাড়ি পৌছনর সঙ্গে যতটা লম্বা সময় বন্ধুদের দেওয়া যায় তার সবটা নির্ভুল ব্যবহারের লক্ষে বেশ ফিটফাট হয়ে স্নান খাওয়া চুকিয়ে শ্যাম্পু করা চুল ফুরফুরিয়ে বেরিয়েছে। হাগামদের “কোয়েট” স্কুল। বৈচি একই ক্লাসে পড়ে, আলাদা বসে, বন্ধুরাও আলাদা, একই গ্রামের ছেলেমেয়েদুটোর চেনাচেনি প্রত্যহে। সামর্থ আর অসমর্থতার প্রতিবন্ধকতার মাঝে যত সারল্য বজায় থাকে সম্পর্কে, ততটুকু এখনও বাড়ন্ত হয়নি এদেরও। মাটির বুকে থোকা থোকা ধুলো পোড়া ঘাস, কয়টা আটষট্টি ধনচে শ্যাওড়া চারার কোনমতে শুঁটকো শরীরে একটেরে হয়ে থাকা এক খাবলা ঘাস জাগাটুকুর মধ্যে দিয়ে অবাধ রাঙা পথটুকু কালো জুতোয় মাড়িয়ে বৈচি স্কুলের পথ ধরেছে। হাগামের বসে থাকা পার হয়ে বিলেনভেদী ভাঙ্গা ইটে হাইতোলা খন্দ পথ টপকে পিচ রাস্তায় মিনিট দশ হাটলে স্কুল। সাইকেল অনেকেই পেয়েছে কিন্তু সবার চালানর দরকার হয় না, সবারটা চালানর যোগ্যও না, বরং হেলতে দুলতে দুটি দশটি কথা বলতে বলতে পাশে পিছনে সাইকেলের ক্রিং বাইকের পোঁ বা খ্যাপলা হাসি টস্‌কোচাউনির উদগ্রীবতা দিতে দিতে নিতে নিতে হেঁটে যাওয়াই বেশি ভালো। কিন্তু আজ মাঝ পথে বসেছে হাগাম। মোল্লার বাচ্চাটার সাথে নিতান্ত ভদ্রতায় আর সময়ের আনুকুল্যে দু-একটা কথা বলতেই হয় পেরিয়ে ছাড়িয়ে যেতে।
ইস্কুল যাবি নে?
কেরাম্বায় বলি ক দিনি, তোর বাপে মেটালি যেতি পারি। টাইম আচে?
এহনও আচে কিচুটা, ধরতি পারবি?
না পারলি কামাই দেব।
আজকেও তালি পিটানির ভয়েতে কামাই দিতি চাচ্চিস? কালকেরেও যে মারডা খেইচিস – তার চে তোর না যাওয়াডাই ভালো। ওরাম মার কেরামবায় খাস? আমারে ওরাম মারলি বাপ দাদারে নে ল্যাঠায় দেতাম, ছ্যার বলি মানতাম না। তোর বাপেরে বলতি পারিস নে?
আব্বায় ইস্কুলি যেতি চাবে না, মারলিউ না, মরলিউ না। তার মরার জন্যিও টাইম নি। সক্কালে গে বেরয়, রাত্তিরি কহন ফেরে বলতি পারি নে। আমারগা অত্যডা জোর নি কিচু বলার। দুপুরি মিলডা না পেলি শালার বইপত্তরে মুতে দে গে বেরতাম, রেস্ত হতো। মায়ে শুদ্দু বলে পড়, পড়ালেখা
দে মানুষ হয়ি ওড বাপ, সেই মাগিই সক্কালে গরুর দড়ি ধরায় দে ষাঁড় দেখাতি পাডায়, উদিকি সক্কলে ইস্কুল চলি যাচ্চে…
তোরগা বড্ড নোংরা হয়ি থাকার স্বভাব, সক্কালে মুখি চোখি জল দিতি পারিস নে, কেরাম দেখায়, ঘেন্না লাগে।
ঘুমের থে ওঠনের আগিই গাই নে ছোটলাম তোরগা ঘরে, পানি দেব কনদে?
তোগের ঘরে জল নি?
ঘরডা কোতায় বলদিনি, বাঁশের ঠেকনা দে একখান ছেল, মেম্বার বললে পাকা ঘর গড়ায় দেবে, দেছেও মাজা পর্যন্তি, বচরটাক পেরোয় গেল এহনও দেওয়াল নি, চালা নি। একখান তেরপলের নিচি রইচি পাঁচজনা, গাই বাচুর নে আরু তিন। পঞ্চাত ট্যাকা দিলি দালান ওঠবে, তোগা যেরাম ঐরাম পাকা।
একখান তেরপলের নিচি গরু বাচুর নে কেরাম করে থাকিস, ঘিন্না লাগে না?
যেরাম দেখতি পাচ্চিস ঐরাম। সব মায়ে বিয়োইছে, গাইডা বাচুরডা আমেগেরও, আব্বায় তাই কয়। ওই জন্যি একখান তেরপলে…
এজন্যিতি ইস্কুলি সক্কলে তোরে নে হাসতি লাগে… সব তোর মায়ে বিয়োইচে… গরুডাও…বাচুরডাও…তোগেরও…
ইরির খোলে হাসির পাচ্চিসডা কি?
তুই বুঝবি নে, ইস্কুল ধরতি পারবি? কবার হচ্চে?

কবার হচ্ছে? প্রশ্নটা ধলা পাটকিলে সম্বন্ধে হওয়ায় দুজনকেই প্রাণীদুটোর বিষয়ে সচেতন হতে হয়, তাকায়ও একযোগে। ধলার পারা না পারা আগ্রহ তখন মাংসলতায় বাহিত হয়ে স্বভাবত দীর্ঘায়িত বৃদ্ধিতে পৌঁছেও স্বাভাবিক পরাঙ্গমে সঙ্গত দৃঢ় দণ্ডের বলিষ্ঠতা আয়ত্ত করতে না পারায় পাটকিলের পিঠে সামনের দুই পা তুলেও সুবিধা করতে পারছে না বলে প্রভু ও ফলাধিকারী ধনা বোস্টম অর্ঘ্য দানের মতো দুইহাতে গাইয়ের উন্মুক্ত উদ্‌গ্রীব গবাক্ষে মাংসল দণ্ডটি স্থাপনে সচেষ্ট হয়ে মুখ দিয়ে আদরের আওয়াজ দিচ্ছে ও-ল-ল-লগ-লগ-লগ-লগ-লে-লে… যেন কোষ করে কোঁচরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে, একেবারে খাপে খাপ।

এ দৃশ্য দুজনেরই পরিচিত। দুই সম বয়স্ক বয়স্কা এমন দৃশ্যে অভ্যস্ত হয়েও চোখ ফিরিয়ে নেওয়া বা উপভোগ্যতা চিনতে শেখার বয়েসে সামান্য আনচান করে দৃষ্টি ঘোরাতে গিয়ে ছলাৎ করে পরস্পরের মুখোমুখি হয়েই পিছলে এদিকওদিক ছানবিন করতে করতে বিক্ষিপ্ত হয় দুই শরীরের নানা স্থান ছুঁয়ে না ছুঁতে পারার কাতরতায়। হাগাম দেখে ধলার মাংসল দণ্ডটির মতো বৈচির তেলচিক্কন পায়ের গোছ সুডৌল লোমহীন, ক্রমশ পুরুষ্টু ফরসা আর উর্দ্ধে আবছা অন্ধকারে আচ্ছন্ন, কিছু বা আলাদাও। হাগামের নোংরা প্যান্টটাকে কাটা হুক সমেত ওর জঘন্য চেহারার অংশ মনে হয় বৈচির, গা ঘিনঘিন করে।
ধরতি পারবি ইস্কুল?
এই পেথথম হচ্চে। আরেকবার হলি…
তালি আর পেরিচিস…বসি থাক…আমারু দেরি হচ্চে…আইজ কি বার খ্যাল আচে?
আইজ? আইজ হলগে…
বুধ
তাতি কি হয়েচে?
হয়েচে আর কি? বুধবার এলি ইস্কুলির মিল কি দে দেয়? তুইতো হ্যাংলার মতোন গে সক্কলের আগে খাড়াস।
কি? আইজ বুধ? আণ্ডা?
তালি বসি থাক। তোর বরাতে আইজ নি।
আমাগের বরাতডাই এরাম, আণ্ডার দিনকেই গাই ডাক দেয়, না হলিও জোটে মার।
মারডা কি এমনিতি খাস? অমিত ছ্যারে কত্তটিবার দেখায় দেছে, তাউ ম্যাফখানায় পয়েন্ট না মারতি পারলি কি হয়?
কেরামবায় দাগাই বলদিনি? ম্যাফের কুনদিকি কুন জাগা থাহে খ্যাল করি কেম্বায়? খ্যাল পেলিউ বা হয়ডা কি?
ম্যাফ বইখানারে বারবার দেখলিই খ্যাল থাহে।
ম্যাফ কি ইস্কুলতে দেয়? ছ্যারে কিনতি বলে কি জন্যি? কেরামবায় কিনি সে খ্যাল রাখে কেডা? আমাগের কি বলদার কামাই আচে?
তুই বসি থাক তালি। আমি চললাম…
একটুসখান খাড়ায় যা, এইখান দ্যাখ, এইখান যদি ধরগে…

কোমল ছ্যাবড়ানো ধুলোয় কাঠি আঙুলে কাষ্ঠ কাঠি ট্যারাব্যাঁকা চলতে শুরু করে হাগামের হাতের বলে, ঘুরে ঘুরে সরু মোটা একটানা দাগ হয়ে ছোটখাট খানাখন্দ ভেঙে গড়ে শুকনো গোবর থ্যাবড়া চোনার থোবনা টপকে ক্রমশ ত্রিভুজ চৌক ডিম্বাকৃতি হবে হবে করেও বক্র রেখা মিলে যায় শুরুর বিন্দুতে, পাটকিলে ধলার মতোই আলাদা শরীরেও একটা মাত্র কম্পমান গোটা শরীর হয়ে ওঠে দৃশ্যত।
ধর, এইখান হলগে আমাগো দ্যাশ…
এইখান দ্যাশ হয় কেরামকরে, কি আঁকিবুকি করিচিস?
তুই কলিনা ম্যাফ, এইখান ধর গে আমাগো দ্যাশ, ধরি নে, একখান ম্যাফ কেমবায় আমাগো দ্যাশ হয় ওইডা আমিউ বুঝিনে, তয় ধরি নে…
এইখানারে কচ্চিস আমাগো দ্যাশের ম্যাফ! এইডারে? কি একখান ব্যাঁকাটেরা তিরিভুজের মুতোন করিচিস, এইটারে দ্যাশ বললি দ্যাশের লোক তোরে হদ্দ প্যাদান দেবে, কেউর খ্যামতা নি বাঁচায় আনে…
আচ্চা তুই ধর দিনি, ধরি নিলিই তো হয়। শেখায় দে দিনি ইরির খোলে…
চুপকর দিনি, কেমবায় কি ধরব, একখান ঢক তো রাখতি হয়, এইখান কিসির ছবি আগে ক।
এইখান হলগে আমাগো দ্যাশ, ধরি নে এই ম্যাফখানার মদ্যি আমাগো গেরাম তোগা দালান আমাগো তেরপল সব আচে।
থাম দিনি। খালি আলফাল বকতি লেগিচিস…
আলফাল বকলাম কনদে? ধরিতো নিতিই হবে, ছ্যারে তাই তো বলেচে। ম্যাফ হলগে একএকখ্যান দ্যাশ। উরির খোলে নিজিরি না পেলিউ, কাউরে না দেখলিউ, নিজিরগা বাপ আম্মা ঘর উডোন গেরাম, গেরামের মানুষরে না পেলিউ ধরি নিতি হয় আমাগো দ্যাশ…
আচ্চা…আচ্চা… নাহয় ধরলাম ওইরাম কিচু একখান, তাতি হচ্চেডা কি?
হচ্চেডা এই, ইরির খোলে ছ্যারের ছিনগরডারে কোতায় দাগাতি হবে? কোনদিকদে?
উত্তর দিকের থে যদিগে ধরিস…
উত্তর কোনডারে বলতিছিস? শুদু বলি দে ছিনগর আমাগের এখান থে কোনদিকি দাগায় দেব? মুখির দিকি? না পোঁঙার দিকি দাগালি ঠিক হচ্চে?

তুই এরাম এরাম কতা কতি লেগিচিস… হাসি সামলাতি জান বেরয় যাচ্চে। তোর সুঙ্গে ফাউ বকলি ইস্কুল ধরতি পারব না। চললাম…

বৈচির লোমহীন পায়ের গোছ উজ্জ্বল মাংসল চকচকা নিয়ে বিলেন রাস্তায় দ্রুত নেমে যায় যেদিকে ঠিক তার উল্টোদিকে ধলা পাটকিলের পিঠ থেকে নেমে হাফায় ফোঁস ফোঁস, তার শ্বাসের করুন ও শূন্য অভিঘাতে ধুলো উড়ে উড়ে ঢেকে দেয় অনামি আগাছা। হাগাম ভেবে কুল পায় না কোথায় তার ভুল? – কোতায় ছিনগর? কিজন্যি বুধে আণ্ডা? সে কেন পেতি পারে না? হাফাতি হাফাতি ধলা ষাঁড়ডা বা গ্যাতন গুতোন খাওয়া পাটকিলে এহন যদি মরে, যদি ধরি নেওয়া যায় প্যাঁচরার দাগ নে ধনাকা ধলার লেথনে এহনি পটকায় তালি কি আণ্ডা নিতি ছুট দে ইস্কুল যেতি পারবে? টাইম কি আচে এহনও?
তাকে স্কুল ধরানর জন্য মরে বা না মরে কেউ ছাড়ছোড় দিতে না চাওয়ায় কি এক তীব্র আক্রোশে হাতের পলকা কাঠিটা সপাসপ যত চালায় তত ম্যাপ ভাঙে,

ধুলোর ফুলকিতে ছিনগর ভাঙে, দেশ ভাঙতে ভাঙতে ওড়ে, উড়ে উড়ে ঘূর্ণি আর শিরশিরে একটা হাওয়ার ভেতর ছিনগর সমেত গোটা দেশ ডিমের চেহারা নিতে থাকে — আস্ত পুরুষ্ট এবং সুবৃহৎ

Facebook Comments

Posted in: June 2021, STORY

Tagged as: ,

Leave a Reply