ভয়জনিত শীত : সোমনাথ ঘোষাল

চেপে শুয়ে আছে। একটা অন্ধ কুকুর। মাটি কামড়ে পড়ে আছে। গতকালের ছায়া। আমার মধ্যবর্তী অবস্থান জুড়ে কিছু আলোচনা চলছে। ঠিক বুঝতে পারছি না। সকাল থেকেই ঝাঁটের বৃষ্টি। বাজার থেকে আসা গায়ে মাছের গন্ধ। তেলাপিয়া কাটার পরেও বেঁচে থাকে। নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে গেলেও কীভাবে প্লাস্টিকের ভেতর ডাকাডাকি করে। তখন একটু ভয় হয়। মাছের আত্মা রান্নাঘরে জমে থাকে। এক টুকরো তেলাপিয়া অন্ধ কুকুরের মুখে দিয়ে আসি। আত্মা কুকুরকে ভয় পায়। রান্নাঘরের নিচে আরও একটা রান্নাঘর আছে। বন্ধ। গত জন্মের ছাপ লেগে আছে। সঙ্গে তীব্র সাদাকালো যৌনতা। ওখানে আজও মাছের গন্ধ পাওয়া যায়।

এই একই চিত্রনাট্য মাথার ভেতর ঘুরে বেড়ায়। ঠিক ভয় নয়! কিছুর অস্তিত্ব। শূন্য কিছু নয়। মাছের কাঁটায় আমার লালা লেগে থাকে। সেটা কাক খায়। মানে কাক আমাকেও খায়। রোজ। জিভের জড়তা নিয়ে বারান্দার কোণে নিজেকে রেখে দেখি। গাল ভর্তি দাড়িতে অচেনার মতন করে ভয় দেখাই। আয়নাতে। এই দাঁতক্যালানে সময়ে মানুষ যখন মৃত্যুর পাঁজর ধরে বেঁচে থাকার বিজ্ঞাপন লিখছে, তখন আমি জ্যান্ত মাছের নাড়িভুঁড়ি পেঁয়াজ দিয়ে ভেজে খাচ্ছি। গন্ধ লাগছে না। আমাদের নাগরিক ক্যালেন্ডারে প্রতিটা দিন আসলে উৎসব।

রাষ্ট্র আমাকে ভয় পেতে শেখায়। ভয় পেলেই ব্যবহার করা যাবে। যে কুকুরটা গতকালের ছায়া জড়িয়ে মাটি কামড়ে শুয়ে আছে, তার কোনো রাষ্ট্র নেই। এযাবতকাল ঘরের প্রতিটা কোনা, ডেবোঢাকনা যা আছে সবকিছু খুলে দেখেছি। কোথাও ভয় লুকিয়ে আছে কি না! কোথাও আত্মা। রাত বাড়লেই আমার একা থাকার অভ্যাসটা আমাকে গিলে খায়। মদের গেলাসে খুঁজতে থাকি ভাঙা ভাঙা দেহ। গিলে ফেলি। নিজস্ব রাতের একলামোকে। পায়চারি করতে করতে ছায়াদের ওজন বাড়ে। পেচ্ছাপ করে থুতু দিলে মনে হয় আমার আত্মাটা মুতের সঙ্গে বেরিয়ে গেল। এখন মৃত চরিত্রদের সঙ্গে ভয় জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়বো। ঘুমের মধ্যে একটা লম্বা দাগ কেউ টেনে রাখে। সেখানে অন্ধ কুকুরের দাঁত আর রাষ্ট্রীয় উত্তেজনায় আমি খিঁচতে থাকি মৃত মানুষের কথা ভেবে। আমার জন্যেও নির্ধারিত চিতা সাজানো আছে। লক্ষ লক্ষ চিতা দেখেও রাষ্ট্র ঠিক এইভাবেই খিঁচে যায়।

আমি যে খাটে শুই। সেই খাটেই আমার বাবার বমি পায়খানা ঘাম রক্ত আর মৃত্যুর ছাপ লেগে আছে। মাঝে মধ্যেই মনে হয় একটা ভয় আমাকে ওই অসুখের গল্প বলছে। কানের কাছে খুব চাপা গলায়। আসলে মৃত্যুর ভেতর যৌনতা ঢুকে থাকে। সেই সময় একটা শরীর পেলে তার যৌনাঙ্গ চাটতে চাটতে ভয়ের ভেতর মৃত্যুকে আদর করা যায়। প্রতিদিনের মৃত্যুর ভেতর আমার যৌনতা লেগে যায়। একটা চ্যাপ্টা শরীরের মধ্যে কিছু মথ বসে খেলা করে। মাসিকের গন্ধে ঈশ্বরের সিঁড়ি ভেঙে, ঢুকে পড়ে রান্নাঘরে। এঁটো মাছ কামড়ে শোয়ার ঘরের খাটের তলায় স্বপ্নরা মৃত্যুর ভেজা পোশাক আদর করতে থাকে। তখনও ভয়ের জন্ম হয়। ঈশ্বর সেই ভয়ের জিভ চাটতে থাকে। মৃত্যুর পোশাকে।

তেলাপিয়ার সঙ্গে অন্ধ কুকুরের দাঁত পড়ে আছে। পাশে একটা শুকনো কাকের আস্তরণ। এখানে এখন আর কোনো ভয় নেই। আত্মাগুলো আমার নিচের রান্নাঘরে শুয়ে আছে। রাত বাড়লেই জল খায়। এরাই ভয়ের স্বপ্ন দেখে। রাষ্ট্র এখনও সমস্ত তলপেটের নিচে মৃত্যুভয় চুষে দিচ্ছে…

Facebook Comments

1 thought on “ভয়জনিত শীত : সোমনাথ ঘোষাল Leave a comment

  1. চিত্রকল্পগুলি সুন্দর। মাছের বিশেষ করে তেলাপিয়া মাছের ছবি ব্যবহার তাৎপর্যপূর্ণভাবেই কথক ব্যবহার করেছেন, সেই চেষ্টা সফল হয়েছে। তবে যেহেতু ছবি গুলির মূল একটি বিষয়ে কেন্দ্রীভূত তাই পড়ার রেশ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। যাঁরা একটু ভিন্নধর্মী গদ্য ভালবাসেন, তাঁদের ভাল লাগবে।

Leave a Reply