২০২১: পশ্চিমবঙ্গে বাম বিপর্যয় – ঐতিহাসিক ভুল থেকে ইতিহাস হয়ে যাবার পথে? : শোভনলাল দত্তগুপ্ত

(নির্বাচন সংক্রান্ত পরিসংখ্যানের জন্য আমি অধ্যাপক জাদ মাহমুদের কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ)

।।১ ।।

শিরোনামে যে প্রশ্নটি রাখা হয়েছে, তার উত্তরটা নেতিবাচক হলে যাঁরা বামপন্থী বা বামপন্থার প্রতি আস্থাশীল তারা অবশ্যই খুশী হবেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও জবাবটা ইতিবাচক না হলেই স্বস্তি পাব। কিন্তু উত্তরটা যেহেতু নিহিত রয়েছে ভবিষ্যতের গর্ভে সেই কারণে এই নেতিবাচকতাকে সুনিশ্চিত করার জন্য এখন থেকেই যাঁরা বামপন্থার পক্ষে তাদের প্রয়াসী হওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। এই তাগিদ থেকেই এই লেখা।

২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল দুটি সত্যকে ক্রমেই জনমানসে প্রতিষ্ঠা করতে পারছে। একঃ আপাত সত্য এটাই যে, বামপন্থীরা স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গে এই প্রথম চূড়ান্তভাবে পরাজিত, ভূলুণ্ঠিত, কারণ বিধানসভায় তাঁদের আসন এবারে শূন্য। দুইঃ প্রকৃত সত্য এটাই যে, কট্টর বামবিরোধী এবং রাজনীতি, সমাজ এ সব বিষয়ে যাঁরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ ও নির্লিপ্ত তাঁদেরকে বাদ দিয়ে সাধারণভাবে সুস্থ বুদ্ধি ও চেতনাসম্পন্ন মানুষ কিন্তু এই ঘটনাটিকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একটি সদর্থক পদক্ষেপ এমনটা মনে করছেন না। বামপন্থীরা নানাভাবে সমালোচিত হচ্ছেন এবং হবেনও, — এটা যেমন ঠিক, — অপরদিকে বামপন্থার এই পরিণতিতে তাঁরা কিন্তু যথেষ্ট উদ্বিগ্নও বটে। এই উদ্বেগের একটি চমৎকার নিদর্শন আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত (৭-৮ জুন, ২০২১ ) অমর্ত্য সেনের একটি সাক্ষাৎকার, যার দ্বিতীয় পর্বে তিনি বামপন্থাতেই তার আস্থা ব্যক্ত করেছেন, যদিও বারেবারেই সতর্ক করে দিয়েছেন যে বামপন্থার নবায়ন প্রয়োজন, প্রয়োজন অনেক কিছুই নতুন করে ভাবার। অর্থাৎ, একই সঙ্গে দুটি ভাবনা ক্রমেই জোরদার হয়ে উঠেছে। বামপন্থাই বিকল্প, বামপন্থাই ভরসা, বামপন্থাই পথ দেখাতে পারে, এই ভাবনার পাশাপাশি একই সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে এ কথাটাও যে, বামপন্থীরা ভুল করেছেন, ভুল করছেন এবং তার জন্য প্রয়োজন বাম ভাবনার ব্যাপক পরিমার্জন ও সংশোধন। অর্থাৎ, এ কথাটা ভাবা বোধ হয় খুব ভুল বা অন্যায় হবে না যে, এবারের নির্বাচনে মানুষ বিরোধিতা করেছেন বামপন্থার নয়, তঁরা আপত্তি জানিয়েছেন, বামপন্থা পশ্চিমবঙ্গে যে আদলে অনুশীলিত হয়ে চলেছে দীর্ঘকাল ধরে, তার বিরুদ্ধে। তার সূচনা হয়েছিল ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে, যখন বাম জমানার ৩৪ বছরের শাসনের অবসান হয়ে তৃণমূল সরকারের প্রতিষ্ঠা হল। এই নির্বাচনে তৃণমূলের পক্ষে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ ভোট দিয়েছিলেন, তাঁরা সবাই তৃণমূলকে ভালবেসে এই দলটিকে সমর্থন করেছিলেন এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। ভোটদাতাদের এক লড় অংশ তৃণমূলের পক্ষে ভোট দিয়ে এই বার্তাটি দিতে চেয়েছিলেন যে বামফ্রন্ট অনুসৃত বামপন্থা তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। এই বার্তাটিই তার চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করল ২০২১ সালের নির্বাচনে। দর্শন বা ভাবনা হিসেবে বামপন্থায় আস্থা, কিন্তু নীতি ও অনুশাসন প্রসঙ্গে বামপন্থীদের সম্পর্কে অনাস্থা, — এই সূক্ষ্ম টানাপড়েনকে বামপন্থীরা কোন সময়েই অনুধাবন করার চেষ্টা করেন নি, যেটা কিন্তু গত এক দশক জুড়ে বিভিন্ন নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ভোটদাতারা বুঝিয়ে দিয়েছেন।

।। ২।।

এই বিষয়টির একটি সুচারু বিশ্লেষণ প্রয়োজন, অর্থাৎ, জনমানসে দীর্ঘ তিন দশকের বাম শাসনের অভিজ্ঞতা বামপন্থার কী ধরনের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছে। দুটি কথা এখানে বলা প্রয়োজন। একঃ স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত, সমাজের এই উভয় স্তরের মানুষের মধ্যেই বামপন্থা সম্পর্কে একটি ইতিবাচক ভাবনা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, যার অনেকগুলি সামাজিক-অর্থনীতিক-সাংস্কৃতিক কারণের পাশাপাশি একটি বড় কারণ ছিল বিভিন্ন গণ আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা, তাদের সততা, জীবনচর্চা ও মূল্যবোধ। ১৯৬৭ সালে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রীসভাতে তার প্রতিফলন ঘটেছিল।এই ধারা বেশ কিছুদিন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার পরেও, যখন দেখা গেল অপারেশন বর্গা এবং যথার্থ একটি পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে বামপন্থীরা চাইলেন শ্রমজীবী মানুষের ক্ষমতায়ন। অর্থাৎ, সাধারণ মানুষের চোখে দীর্ঘদিন পর্যন্ত বামপন্থীরা ছিলেন বামপন্থা এই শব্দবন্ধের সমার্থক। দুইঃ বামপন্থার প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মানুষের একটি বড় অংশের এই যে ইতিবাচক মনোভাব, তাকে যদি কেউ একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের পার্টি লাইন বা কর্মসূচির প্রতি আনুগত্য হিসেবে গণ্য করে, তাহলে সেটি হবে একটি মারাত্মক ভুল। সাধারণ বাঙ্গালির বামপন্থার প্রতি আকর্ষণ, বামপন্থাতে আস্থা এর ব্যাখ্যাটি রীতিমত জটিল। সামগ্রিকভাবে এই কথাটা হয়ত বলা যতে পারে যে, এই বাম-বাঙ্গালির মধ্যে রয়েছেন তাঁরা সবাই যাঁরা দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে প্রগতিশীল, সহনশীল, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী, অর্থাৎ, সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে তাঁদের অবস্থান। এঁদের অনেকটাই গড়ে দিয়েছে রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্র-উত্তর গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বহমান ঐতিহ্য। গণতন্ত্র, সহনশীলতা ও বহুমাত্রিকতার এই ভাবনাই বাঙ্গালির প্রাত্যহিক জীবনবোধের বনিয়াদকে অনেকটাই নির্মাণ করে দিতে সক্ষম হয়েছে, যার ওপরে ভিত্তি করে রচিত হয়েছে বামপন্থার সঙ্গে এক ধরনের ভাবগত নৈকট্য। সেই কারণে বামপন্থী বলতে যদি কেউ এক জাতীয় ছাঁচে ঢালা বাম-বাঙালির কথা ভাবেন, সেটি হবে সত্যের অপলাপ মাত্র। বাম-বাঙ্গালির বাম মানসিকতা মূলত নেতিবাচক এবং সেই অর্থে সে রেডিক্যাল। এই রেডিক্যাল নেতিবাচকতা যে বাম-বাঙালিয়ানাকে প্রশ্রয় দিয়েছে, তার সুবাদেই তার চোখে অনেক প্রথাসিদ্ধ, বহুদিনের স্বীকৃত মুল বাম ভাবনাও সমালোচনার বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ, বাম-বাঙ্গালির বামপন্থার পরিসরটা পার্টিতান্ত্রিক বামপন্থার চেয়ে অনেকটাই বড় আর সেই কারণেই পার্টিতান্ত্রিক বামপন্থার নিরিখে বাঙালির বাম মানসিকতাকে বিচার করা যাবে না।

এই বিষয়টি যদি খেয়াল রাখা যায়, তাহলেই অনেকটা বোঝা যাবে যে বামপন্থার প্রতি আস্থা রেখে বামপন্থীদের অনুশীলিত পথকে বাম-বাঙ্গালি ধীরে ধীরে কেন বিগত এক দশক জুড়ে প্রত্যাখ্যান করার কথা ভাবল। এই প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার প্রায় দুটি দশকের পর থেকে। এই প্রক্রিয়াটির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিল বেশ কিছু সাফল্যের সঙ্গে একাধিক ঐতিহাসিক ভুল ভাবনা বা সিদ্ধান্ত, যার মাশুল গুণতে হল বঙ্গবাসীকে। এর একেবারে মূলে ছিল পার্টিকেন্দ্রিকতার ভাবনা, যা প্রশ্রয় দিল এই চিন্তাকে যে, বামফ্রন্টের বৃহত্তম শরিক দলটির সমালোচনা আবশ্যিকভাবে জনস্বার্থবিরোধী এবং এই সমালোচনার পক্ষাবলম্বী যাঁরা, তারা গণশত্রু। এই সংকীর্ণতাবাদ তিনটি বিপদের দরজা খুলে দিল: (ক) নির্মোহ আত্মসমালোচনার দরজা বন্ধ হয়ে গেল; (খ) অগ্রাধিকার পেল, অশোক মিত্রের ভাষায়, দক্ষতার বদলে বশ্যতার রাজনীতি, যার সুবাদে অতি দ্রুত বামফ্রন্টের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে চলে আসতে শুরু করলেন এমন বহু মানুষ, সরকারের আস্থাভাজন হয়ে উঠলেন এমন অনেক ব্যক্তি, যাঁদের সঙ্গে বাম আদর্শ বা ভাবনার সম্পর্ক ছিল নিতান্তই পোষাকি। আর এভাবেই জন্ম নিল স্তাবকতার সংস্কৃতি। (গ) ব্রাত্য হয়ে যেতে শুরু করলেন এমন অনেক মানুষ যাঁরা এই ভাবনার সঙ্গে এক মত হতে পারলেন না, যাঁরা বামফ্রন্টেরই স্বার্থে, বাম ভাবনায় ঋদ্ধ থেকেই বামফ্রন্ট সরকারের নীতি ও পথ সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করাকেই শ্রেয় মনে করেছিলেন। সরকারের অন্দরে প্রকাশ্যে মুখ খুলেছিলেন বিনয় চৌধুরি ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁরা রয়েই গেলেন, কাজের কাজ হল না কিছুই। বামফ্রন্টের ছোট শরিক দলগুলির ক্ষোভ কিছু কম ছিল না, কিন্তু প্রকাশ্যে বড় শরিকের সমালোচনা করা থেকে তাঁরা বিরতই রইলেন। নন্দীগ্রামের ঘটনা এবং বামফ্রন্ট সরকারের শেষ পর্বে শিল্পবান্ধব নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে দেশী, বিদেশী শিল্পপতিদের কাছে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, যেভাবে স্থানীয় মানুষ এবং কৃষকসভাকে উপেক্ষা করে চরম ঔদ্ধত্যের পরিচয় দিয়েছিলেন, বামফ্রন্টের ছোট শরিকরা তাতে যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছিলেন সব কিছুই।

পার্টিকেন্দ্রিকতার দাপট যে শেষ পর্যন্ত বামমনস্ক বাঙ্গালিকে বামপন্থীদের সম্পর্কেই সন্দিহান করে তুলতে পারে, তাঁদেরকে জনবিচ্ছিন্ন করে বামপন্থারই বিকৃতি সাধনকারী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে, এই হিসেবটা বামফ্রন্ট কোনদিনই করে নি। এই একরৈখিকতার ভাবনা যে মানসিকতার জন্ম দিল তার পরিণতিতে নেয়া হল একের পর এক ভুল পদক্ষেপ যেগুলিকে এক অর্থে ‘ঐতিহাসিক’ বললে বোধ হয় অন্যায় হবে না। ভুল একঃ পার্টিকেন্দ্রিকতার অনুষঙ্গ হিসেবে প্রাধান্য পেল পার্টির সাংগঠনিক প্রভাব বৃদ্ধির বিষয়টি। নীতিগতভাবে এর মধ্যে অন্যায় কিছু নেই। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল যখন সংগঠন বৃদ্ধির সুবাদে পার্টির বিভিন্ন স্তরে জায়গা করে দেয়া শুরু হল এমন বহু মানুষের, যাঁরা পার্টির খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন নিজস্ব স্বার্থে। এই বেনো জলের অনুপ্রবেশে বামফ্রন্টের সর্ববৃহৎ দলটির অবশ্যই কলেবর বৃদ্ধি পেল, কিন্তু একই সঙ্গে শুরু হল অভ্যন্তরীণ ক্ষরণ। ভুল দুইঃ প্রথম দুটি দশকে বামফ্রন্টের শিল্পনীতিতে অবশ্যই অনেক খামতি ছিল এবং নব্বই-এর দশকের শেষ পর্ব থেকে সঠিকভাবেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে আগামী প্রজন্ম এবং সামগ্রিকভাবে রাজ্যের অর্থনীতিক উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে একটি যথার্থ শিল্পবান্ধব নীতি প্রবর্তন করা প্রয়োজন। এই ভাবনার মধ্যে কোনও ভুল ছিল না। কিন্তু এই ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে হলে যে বহু মানুষের কৃষিজ জমিতে, তাঁদের রুজিতে হাত পড়বে এবং তার ফলে সমাজের এক বড় অংশের মানুষের সঙ্গে সরকারের একটা ভুল বোঝাবুঝির জায়গা তৈরী হতে পারে, এই বিষয়টা পার্টিনেতৃত্ব সম্পূর্ণ বিস্মৃত হলেন। এই নতুন নীতিকে সুনিশ্চিত করার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ছিল তৃণমূল স্তর থেকে মানুষকে সঙ্গে নেয়া, তাঁদের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করা, তাঁদেরকে বোঝানো কেন নতুন শিল্পনীতির প্রয়োজন। বাস্তবে ঘটলো তার উল্টোটা। সম্পূর্ণ আমলাতান্ত্রিক কায়দায় মানুষকে বলে দেয়া হল শিল্পায়ন প্রক্রিয়া কোথায়, কীভাবে বাস্তবায়িত হবে। এই ভ্রান্ত চিন্তার নেপথ্যেও এই ভাবনাই কাজ করেছিল যে পার্টির সর্বময় উপস্থিতিই প্রমাণ, পার্টি অফিসগুলিতে মানুষের ভিড় ও উড্ডীয়মান লাল ঝাণ্ডাই প্রমাণ যে পার্টি ও সরকারের পাশেই মানুষ আছেন। স্ফীতকায় পার্টি সংগঠন যে আত্মপ্রবঞ্চনার রাস্তা তৈরী করে দেয়, তার জাজ্বল্য নিদর্শন হল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের ঘটনাবলি। পার্টিতান্ত্রিকতার ভাবনাকে আশ্রয় করেই এই দেশগুলিতে বিশেষ বিশেষ দিনে সুনিশ্চিত করা হত শ্রমজীবী মানুষের জমায়েতকে, যাঁদেরকে রক্তিম অভিবাদন জানাতেন পার্টিনেতৃত্ব, যে ভিড়ের বহর দেখে তাঁরা হতেন আনন্দে আপ্লুত। এই ভাবনার মধ্যে যে একটা বড় রকমের ভুল ছিল, তার হদিশ শাসক কমিউনিস্ট পার্টিগুলি কোনদিন পাওয়ার চেষ্টা করে নি। ভুল তিনঃ পার্টিকেন্দ্রিকতা ও নির্বাচনী সাফল্য এক ধরনের আত্মসন্তুষ্টি ও নিশ্চিন্ততার রাজনীতির জন্ম দেয়, যা রুদ্ধ করে দেয় পার্টি ও জনগণের মধ্যে কথোপকথনের পরিসরটি। কথোপকথনের জায়গাটা দখল করে নেয় একমুখী বাক্যস্রোত, যেখানে পার্টি বক্তা, জনগণ শ্রোতা। পার্টি তার কথা মানুষকে বলে, জনগণ কী বলতে চায়, পার্টির কানে পৌঁছয় না। অতি সম্প্রতি সি.পি.আই (এম)-এর অতি পরিচিত মুখ তন্ময় ভট্টাচার্য এ কথাটিই বলেছেন অত্যন্ত খেদের সুরে।

এখানে একটি গভীর তাত্ত্বিক প্রশ্ন উঠে আসে। মানুষ যে কোনও নীতি বা পদক্ষেপকে বিচার করে তার সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে, আনতোনিও গ্রামশি যাকে বলেছিলেন common sense | গ্রামশির গভীর দূরদৃষ্টি তাঁকে সচেতন করে দিয়েছিল যে, মানুষের মনকে বুঝতে হলে কমিউনিস্ট পার্টিকে এই সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের গুরুত্বকে প্রথমে অনুধাবন করতে হবে। কিন্তু এই সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের ভিত্তিতে মানুষ যেটাকে সত্য বলে মেনে নেয়, তা যে সত্য নয় সে কথাটা কমিউনিস্ট পার্টিকে বোঝাবার দায়িত্ব নিতে হবে, জনমানসের গভীরে প্রবেশ করাতে হবে এক বিকল্প, উচ্চতর কাণ্ডজ্ঞান এবং সেখানে একটা বড় ভূমিকা পালন করতে হবে পার্টির বুদ্ধিজীবীদের। আর এই উন্নততর, উচ্চতর কাণ্ডজ্ঞানের ঠিকানা কমিউনিস্ট পার্টি পাবে তখনই যখন সে হয়ে উঠতে পারবে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখের, গোটা সমাজের ও জাতীয় চেতনার প্রতীক, গ্রামশি যাকে national popular — collective এই অসাধারণ শব্দবন্ধ দিয়ে চিহ্নিত করেছিলেন। এই ভাবনার কোন চিহ্নই বামফ্রন্টের রাজনীতি ভাবনায় পরিলক্ষিত হয় নি।

একের পর এক এই ভুলের পরিণতিতে একদিকে যেমন বাড়তে থাকে বামপন্থীদের সঙ্গে বাম-বাঙ্গালির ও সাধারণভাবে বঙ্গসমাজের জনবিচ্ছিন্নতা, অপরদিকে মানুষের মনে জমতে থাকে বামপন্থা নয়, বামপন্থীদের বিরুদ্ধে প্রবল বিদ্বেষ। পশ্চিমবঙ্গে কোনও যথার্থ বিরোধী দলের অনুপস্থিতি পরিস্থিতিগত কারণেই বামফ্রন্টের শাসনকে প্রলম্বিত করেছিল। ১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা ও গোড়ার দিকে এই দলটির অপরিণত রাজনীতি বামফ্রন্টকে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার যে সুযোগ করে দিল, তার সুবাদে বামফ্রন্ট যেন আরও নিশ্চিত বোধ করল এই ভেবে যে তৃণমূলের মত অপরিপক্ক ও অসংগঠিত বিরোধী দলের পক্ষে বামফ্রন্টকে নির্বাচনে পরাজিত করা কার্যত অসম্ভব। এঁরা নিজেরা একবারও টের পেলেন না যে জনগণের একটা বড় অংশ তাদের দিক থেকে ইতিমধ্যেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, যার পরিণতি হল ২০১১ সালের নির্বাচনে প্রথম বাম বিপর্যয়।

।। ৩।।

২০১১-২১ বিগত এক দশকে পশ্চিমবঙ্গে বাম রাজনীতির সংকট গৰ্ভীরতর হয়েছে।তার একটি কারণ ইতিমধ্যেই ব্যাখ্যা করেছিঃ সাধারণ মানুষের চোখে, বামপন্থায় আস্থাশীল বাঙ্গালির জনমানসে বামপন্থার ভাব ও আদর্শ থেকে বিযুক্তি ঘটে গিয়েছিল বামপন্থীদের। উভয়ের মধ্যে পুনরায় সংযোগ সাধনের জন্য যে পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রয়োজন ছিল, এই কালপর্বে সেটিও করা হল না। প্রয়োজন ছিল নির্মোহ, কঠোর আত্মসমালোচনা, জনসমক্ষে নিজেদের ভুল স্বীকার করা এবং একটি বিকল্প দিশার সন্ধানে লিপ্ত হওয়া। বামপন্থায় আস্থাশীল বাঙ্গালির দুর্ভাগ্য এটাই যে বাম নেতৃত্ব সেই পথ যেমন মাড়ালেন না, অপরদিকে মানসিকভাবে ২০১১ সালের নির্বাচনে পরাজয়কেও মেনে নিতে পারলেন না। এর ফলটা দাঁড়াল এক ধরণের রাজনৈতিক স্থবিরত্ব, যা সব বাম দলেরই বহু রাজনৈতিক কর্মীকে ঠেলে দিল এক দিশাহীনতার পথে। অনেকে পার্টি থেকে সরে এলেন, অনেককে পার্টির সমালোচনা করার জন্য সরিয়ে দেয়া হল, আবার কিছু মানুষ তৃণমূল কংগ্রেসই হল বিকল্প বাম—এই বিচিত্র ভাবনার দ্বারা তাড়িত হয়ে এই দলটির খাতায় নাম লেখালেন এবং অবশ্যই পুরষ্কৃতও হলেন।

বামেদের এই রাজনৈতিক দুর্বলতার পূর্ণ সুযোগ নিল তৃণমূল কংগ্রেস ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার অব্যবহিত পরে। মুখে বলা হল বদলা নয়, বদল চাই। কার্যত তৃণমূল কংগ্রেস যেটা করে দেখাল সেটি ছিল ঠিক এর বিপরীত। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ঘোষণা করা হয়েছিল যে, এই দলটির কর্মসূচি হল একটিইঃ পশ্চিমবঙ্গ থেকে সি.পি.আই (এম)-কে উৎখাত করা। ২০১১ সালের নির্বাচনী পরাজয়ের পর এবারে শুরু হল কার্যত সি.পি.আই (এম) খতম অভিযান, যার সঙ্গে বহুলাংশে সাদৃশ্য ছিল সত্তরের দশকে সিদ্ধার্থশংকর রায়ের নেতৃত্বে সি.পি.আই (এম) বিরোধিতার। সেই একই দৃশ্যপটঃ সি.পি.আই(এম) কর্মীদের ঘরছাড়া, পাড়াছাড়া করা, তাদের বাড়িঘর পোড়ানো, পার্টি অফিস দখল করা, অসংখ্য মিথ্যে মামলায় তাদেরকে ফাঁসানো, কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ইত্যাদি।

বামপন্থীদের বিরুদ্ধে, বিশেষত সি.পি.আই(এম)-এর বিরুদ্ধে তৃণমূল সরকার একদিকে যেমন প্রবল অত্যাচার ও আক্রমণ নামিয়ে আনল, অপরদিকে প্রবর্তন করল এক কদর্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি। নেত্রীপূজা, আত্মম্ভরিতা, আত্মপ্রচার ও নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করে বিরোধী দল, বিশেষত কংগ্রেসকে ভাঙ্গিয়ে নিজের দলকে পুষ্ট করার অনৈতিক রাজনীতিকে মান্যতা দেয়া হল। বহুক্ষেত্রেই প্রবল চাপের মুখে পড়ে এই দল বদল ঘটল, যার ফায়দা লুঠল শাসক দলটি। ক্রমে ক্রমে মানুষের মনে এই ধারণা গেড়ে বসতে শুরু করল যে এই দলটির কোনও মতাদর্শ নেই, এটি এমনই একটি দল যেটি পুরোপুরি নেত্রী নির্ভর, যেখানে গণতন্ত্রের কোন বালাই নেই এবং প্রশ্রয় দেয়া হয় সীমাহীন দুর্নীতিকে নিচু স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত। ২০১১ সালে বাংলায় পরিবর্তনের ডাক দিয়ে বঙ্গসমাজের অনেক কেষ্টবিষ্টু মানুষ যাঁরা তৃণমূল কংগ্রেসকে ক্ষমতায় বসাবার জন্য বিপুলভাবে তৃণমূলনেত্রীর পক্ষে সওয়াল করেছিলেন, তাঁদের অনেকেরই মোহভঙ্গ হল এবং সরে যেতে শুরু করলেন তৃণমূলের রাজনৈতিক বৃত্ত থেকে। যাঁরা রয়ে গেলেন, তাঁরা ইতিমধ্যেই স্তাবকতার সংস্কৃতিকে ভালভাবেই রপ্ত করে নিয়েছিলেন। বিভিন্ন পদ ও পারিতোষিকের যুগলবন্দী তাঁদেরকে অবশ্যই স্বস্তি দিয়েছে। এঁদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যাঁরা ছিলেন বামফ্রন্টের আমলে মুখ্যমন্ত্রীর ছায়াসঙ্গী, ক্ষমতার অলিন্দে যাদের যাতায়াত ছিল অগাধ ও অনায়াস। গত দশ বছরে তৃণমূল সরকারের এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি বাম শাসনের শত দুর্বলতা সত্ত্বেও তার এক নিকৃষ্ট বিকল্প হিসেবেই গণ্য হবে।

এসবের সঙ্গে যোগ হল আরও একটি আত্মঘাতী ভাবনা, যার মুল কথা হল পশ্চিমবঙ্গকে বিরোধীশূন্য করা, অর্থাৎ, বিরোধী পক্ষের কণ্ঠরোধ করা, বিরোধীদের কোনও বক্তব্যকে আমল না দেয়া, বিরোধীদের কোনও পরিসর না দেয়া। গণতন্ত্রহীনতা ও নীতিবিবর্জিত রাজনীতির এটি ছিল এক চরম নিদর্শন। ২০১৮ সালের গ্রাম বাংলায় পঞ্চায়েত নির্বাচনে এই ভাবনার চূড়ান্ত বাস্তবায়ন ঘটল, যেখানে যথেচ্ছভাবে বলপ্রয়োগ ও ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা ঘটল অবাধে। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও বহু ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছিল, যার সাক্ষী টিভি ফুটেজ।

স্বৈরতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করে বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করা যায় ঠিকই, কিন্তু তা দিয়ে জনগণের আস্থা যে অর্জন করা যায় না, তৃণমূলনেত্রী সেটি ভালভাবেই বুঝেছিলেন। গোড়া থেকেই এই সরকারের কোনও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছিল না, না অর্থনীতিতে, না শিল্প, স্বাস্থ্য বা শিক্ষানীতিতে। তাই এই দলটি আশ্রয় নিল জনমোহিনী (populist) কর্মসূচির, যার মূলে ছিল এক ধরনের তাৎক্ষণিকতার রাজনীতি (politics of immediacy)। চালু হল এক গুচ্ছ সরকারী প্রকল্প, কন্যাশ্রী থেকে স্বাস্থ্যসাথী। এই সব প্রকল্পের স্বল্পমেয়াদী আর্থিক ও সামাজিক মূল্য সাধারণ মানুষের কাছে কিন্তু অপরিসীম। নিরন্ন মানুষের জীবনে এগুলিই কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হল আর্থিক নিশ্চয়তার প্রতীক হিসেবে, – কর্মসংস্থান নাই বা হল। খোলা হল একের পর এক কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, যেখানে যাচাই করা হল না তাদের গুণমান, প্রয়োজনীয়তা, পরিকাঠামোগত ব্যবস্থা। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল যে আপাত দৃশ্যমানতার জন্ম দেয়, তার রেশ থাকে অনেক দিন। মানুষের মন পাওয়ার জন্য প্রবর্তিত হল সারা বছর জুড়ে বিভিন্ন মেলা ও উৎসবের ব্যবস্থা। যথেচ্ছ অনুদান দেয়া হল পাড়ার ক্লাবগুলিকে। স্বল্পমেয়াদী ভাবনাভিত্তিক তাৎক্ষণিকতার এই রাজনীতি তৃণমূল সরকারের স্বৈরাচারী মুখকে আড়াল করতে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে, এ কথা অস্বীকার করে কোনও লাভ নেই।

সমস্যা হল বামপন্থীরা তৃণমূল সরকারের এই রাজনৈতিক কৌশল, অর্থাৎ, একই সঙ্গে দমন ও সম্মতির মিশেল ঘটিয়ে ক্ষমতায় থাকার প্রকল্পটিকেই ধরতে পারেন নি। ফলে তাঁরা যখন তৃণমূলের সমালোচনা করেন, সেখানে এই দুটি কৌশলের মধ্যে পার্থক্য না করে যখন এই সরকারকে সার্বিকভাবে জনবিরোধী ও স্বৈরাচারী আখ্যা দেন, সমাজের অবহেলিত, নিরন্ন, দুর্গত মানুষের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয় না। সাধারণ মানুষ যদি তার প্রাত্যহিক কাণ্ডজ্ঞানের নিরিখে সরকারের পদক্ষেপকে ইতিবাচক মনে করেন, কৌশলগত কারণে তাকে মান্যতা দিতে হয়। তা না করে বামফ্রন্টের সর্ববৃহৎ দলটির তৃণমূল সরকারের সমস্ত কর্মসূচিকে পরিহাস ও কটাক্ষ করার যে নীতি গ্রহণ করেছে, বামেদের ভুলের তালিকায় সেটি হয়েছে আরও একটি সংযোজন।

মুশকিল হল, এ কথা বললেই অনেকে ভেবে বসবেন লেখক বোধ হয় তৃণমূলের পক্ষে সওয়াল করছেন কিংবা তাঁর বোধ হয় তৃণমূলের প্রতি দুর্বলতা আছে। এই কথাটা স্পষ্ট করে বলে দেয়া প্রয়োজন যে, লেখকের তৃণমূল সম্পর্কে এই দলটি জন্মলগ্ন থেকেই কোনও মোহ ছিল না এবং এই দলটির বিভিন্ন অপকীর্তি ও কুকীর্তি সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ সচেতন। লেখকের বক্তব্য এখানে খুবই স্পষ্টঃ বামপন্থীরা যে রাজনীতি করেন, তার প্রধান উপজীব্য শ্রমজীবী মানুষ। মানুষ তৃণমূল সরকারের নীতি নিয়ে কী ভাবছেন, তার হদিশটি তাই সর্বাগ্রে পাওয়া প্রয়োজন। বামপন্থীরা তৃণমূলের নীতিকে কীভাবে বিচার করছেন, তার নিরিখে যদি মানুষের তৃণমূল সম্পর্কে ভাবনাকে বিচার করা হয়, তাহলে সেটি হবে চরম রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার পরিচয় মাত্র। তৃণমূল সম্পর্কে পার্টির মূল্যায়ন আর জনমানসে তৃণমূল সম্পর্কে ধারণা এই দুটি বিষয়ের পার্থক্যটি যদি খেয়াল না করা হয়, তাহলে কোন মতেই ব্যাখ্যা করা যাবে না, তৃণমূলের স্বৈরাচার, শত অপৰ্কীতি ও হাজারো দুনীতি সত্ত্বেও কেন সমাজের এক বিরাট অংশের মানুষ বামেদের দিকে না ফিরে সমর্থন যুগিয়ে চলেছেন এই দলটিকেই বিভিন্ন নির্বাচনে।

।। ৪।।

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এক বড় রকমের পরিবর্তনের সূচনা হল ২০১৪ সালে কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি-র ক্ষমতায় আসীন হবার পরে। ২০১৪-১৯ এই পর্বে মোদি অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে ভারতবাসীর এক বড় অংশের মানুষের কাছে এক অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হলেন। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল মোদির হাতকে আরও শক্ত করল।শোনা গেল গৈরিক ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটল একের পর এক হাড় হিম করা ঘটনায়।যে পশ্চিমবঙ্গকে মনে করা হত সাম্প্রদায়িকতার ভাবনা বিবর্জিত একটি রাজ্য, সেখানে এই প্রথম বি.জে.পি. পা ফেলতে শুরু করল, যার উদ্বেগজনক দৃষ্টান্ত হয়ে রইল ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী, ফ্যাসিস্ত মতাদর্শে বিশ্বাসী এই দলটির ১৮টি আসন দখলের ঘটনাটি। রাজ্য রাজনীতিতে বি.জে.পি-র এই উত্থানের প্রভাব ছিল দ্বিবিধ। একঃ এতদিন পর্যন্ত তৃণমূলের বিরোধী ছিল মূলত বাম দলগুলি, যার নেতৃত্বে ছিল সি.পি.আই(এম)। এই প্রথম তৃণমূল বিরোধিতায় সামিল হল বি.জে.পি.। দুইঃ ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনকে মাথায় রেখে বি.জে.পি.-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ঘোষণা করলেন যে আগামী দিনের এই নির্বাচনে তৃণমূল সরকারকে হঠিয়ে বি.জে.পি.-কে যে ভাবেই হোক পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসতে হবে। আর এই লক্ষ্য পূরণের জন্য বি.জে.পি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রাজ্য বি.জে.পি.-র সহায়তায় কী ধরনের কৌশল অবলম্বন করেছিল, কী ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল এবং তার পরিণতি কী হল, এ সবই এখন বঙ্গবাসীর কাছে দিনের আলোর মতই স্পষ্ট। বি.জে.পি.-র ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন সফল হয়নি, – যে কোনও সুস্থ মানুষের কাছে সেটি অবশ্যই স্বস্তিদায়ক ঘটনা। কিন্তু একই সঙ্গে প্রবল অস্বস্তি ও উদ্বেগজনক ঘটনা হল তৃণমূলের অভূতপূর্ব নির্বাচনী সাফল্য, বিধানসভায় বামেদের স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গে শূন্য হয়ে যাওয়া এবং একমাত্র বিরোধী দল হিসেবে ৭৭টি আসন জিতে বি.জে.পি-র উত্থান।

নির্বাচনে বি.জে.পি সাফল্য পায় নি একথা মেনে নিয়েই কিন্তু দুটি বিষয় অতীব গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন। এক ও ধর্মনিরপেক্ষতা ও উদারবাদের ভাবনায় সিঞ্চিত বাংলার মাটিতে বি.জে.পি-র এই উত্থানের ব্যাখ্যা কী? দুই আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গে এই উগ্র দক্ষিণপন্থী দলটির সম্ভাব্য গতিপ্রকৃতি কী ধরনের হতে পারে? বঙ্গীয় বামেরা যদি এই দুটি বিষয়ের গুরুত্ব এখনও অনুধাবন না করে থাকেন, তাহলে আশু প্রয়োজন এই বিষয়গুলি সম্পর্কে সচেতন হওয়া।

বিষয় একঃ এ কথা ঠিক যে এবারের নির্বাচনে বি.জে.পি. তীব্র ধর্মীয় মেরুকরণকে আশ্রয় করে যে সাফল্য পাবে বলে আশা করেছিল, সেই আশা পূরণ হয়নি। কিন্তু এ কথাও অনস্বীকার্য যে বি.জে.পি-র পক্ষে যে ৩৮.১৩% ভোট পড়েছে, তার একটি বড় অংশ হিন্দু ভোট। সংখ্যালঘুদের ভোট বি.জে.পি পায় নি। কিন্তু এই মেরুকরণের প্রচার চালিয়েই তারা তফশিলী ও আদিবাসী ভোটে থাবা বসিয়েছে। সুতরাং মেরুকরণ অবশ্যই হয়েছে, যদিও সেটি বি.জে.পি-র প্রত্যাশা মত হয় নি। বি.জে.পি-র এই উত্থানের নেপথ্যে আমি অন্তত তিনটি কারণ নির্দেশ করব।

একঃ সাধারণভাবে আমরা এরকম একটি ধারণা পোষণ করতে অভ্যস্ত যে, বাঙ্গালি উদারমনস্ক, ধর্মনিরপেক্ষ, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী। বঙ্গমানসের এই মূল্যায়ন কতটা সঠিক, তা নিয়ে কিন্তু ভাবার যথেষ্ট অবকাশ আছে। বঙ্গ সমাজের এক বড় অংশ এই ভাবনার শরিক হলেও খোঁজ নিলে দেখা যাবে যে এই তথাকথিত উদারমনস্ক অনেক বাঙ্গালির রক্তেই রয়েছে রক্ষণশীলতার বীজ। জাতপাত, ধর্মাচরণের প্রশ্নে তাদের অবস্থান, সামাজিক মিশ্রণের ক্ষেত্রে মুসলমানদের সম্পর্কে এক ধরনের দেয়াল তুলে দেবার মনোবৃত্তি, ঐস্লামি সংস্কৃতি সম্পর্কে অজ্ঞতা ও অনীহা, প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে কী ধরনের চর্চা হচ্ছে সে বিষয় সম্পর্কে জানার ব্যাপারে আশ্চর্য নির্লিপ্ততা ও অনাগ্রহ পরোক্ষে কিন্তু প্রশ্রয় দেয় হিন্দুত্বের ভাবনাকেই। আরও স্পষ্ট করে বললে অনেক বাঙ্গালির ধমনীতেই রক্ষণশীলতা ও ধর্মীয় মৌলবাদের একটি চোরাস্রোত মুখেই বহমান, যার সূত্র নিহিত রয়েছে বাঙ্গালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসের মধ্যেই। এই ইতিহাসে যেমন রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন, এদের বিরোধীরাও সংখ্যায় এবং প্রভাবে কিন্তু কম ছিলেন না। ব্রাহ্মণ্যবাদের পক্ষে, হিন্দু সমাজের কুসংস্কারের পক্ষে, মহিলাদের ঘরবন্দী করে রেখে স্ত্রী স্বাধীনতার বিপক্ষে রাধাকান্ত দেব প্রমুখেরা কিন্তু তাদের প্রগতিবিরোধী লড়াই জারি রেখেছিলেন বহুকাল পর্যন্ত। বাঙ্গালির রক্তে তার বীজ যথেষ্টই অবশিষ্ট আছে। তাই আশ্চর্য হই না যখন দেখি যে আজও হিন্দু পাড়ায় মুসলিম পরিবারের পক্ষে বাড়ি ভাড়া পাওয়া রীতিমত কঠিন কিংবা বাংলাদেশ থেকে আগত কোনও মুসলমান মহিলাকে হিন্দু পরিবারে পরিচারিকার কাজ করতে হলে তার প্রকৃত নাম গোপন করে কোনও ছদ্ম হিন্দু নামের আশ্রয় নিতে হয়। বিবাহের ক্ষেত্রে হিন্দু বাঙ্গালি জাতপাতের প্রশ্ন নিয়ে কতটা রক্ষণশীল ও স্পর্শকাতর, তার নিদর্শন হিসেবে প্রতি রবিবারের পাত্রপাত্রী কলমই যথেষ্ট। বি.জে.পি-র কাছে এগুলিই অস্ত্র। হিন্দু বাঙ্গালি, তথাকথিত সংস্কৃতিমনস্ক বাঙ্গালি, এমনকি বাম-বাঙ্গালিরও একাংশ এই বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন না হলেও বি.জে.পি কিন্তু প্রবলভাবে সচেতন। এই চোরাস্রোতে সাঁতার কেটেই বি.জে.পি পশ্চিমবঙ্গে ঘাঁটি গাড়তে চায়।

দুইঃ সংখ্যায় বা সংগঠনের বিচারে বি.জে.পি-র মত সাম্প্রদায়িক শক্তি এই রাজ্যে কোনদিনই শক্তিশালী ছিল না। এই দলটির উপস্থিতি দৃশ্যমান হতে শুরু করল ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে। এর দায় কিন্তু নিতে হবে তৃণমূল সরকারকেই। এই দলটির কোনও নীতিবোধ ও মতাদর্শগত ভিত্তি না থাকার কারণে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বিপদ দলনেত্রী ও তার অনুগামীরা কখনই অনুধাবন করতে পারেন নি। এই দলটির কাছে একমাত্র বিচার্য বিষয় ভোটের অংক। তাই একদিকে নরম হিন্দুত্ব ও অপরদিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের মন কেনার জন্য তোষণের রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে বি.জে.পি-র জমিকে প্রস্তুত করে দেয়। এ কথা অস্বীকার্য যে আর.এস.এস-এর বাড়বাড়ন্ত তৃণমূল জামানাতেই হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে, ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতার পক্ষে কোন কর্মসূচিই এই দলটির নেই। সর্বোপরি বামেদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল গ্রাম বাংলায় যে রাজনৈতিক শূন্যতার পরিবেশ সৃষ্টি করল, সেটি ভরাট করতে আসরে অবতীর্ণ হল বি.জে.পি। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বাম ভোটের যে এক বড় অংশ রামে গিয়ে বি.জে.পি-র ১৮টি আসন দখল করার ব্যবস্থা করে দিল, তার ব্যাখ্যাটাও মেলে এখানেই। বামেদের পক্ষে এটি ছিল অবশ্যই আত্মঘাতী ভাবনা, কিন্তু সি পি আই (এম)-এর অনেক কর্মীকেই বলতে শুনেছি যে, তৃণমূলের অত্যাচার ও প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতির মোকাবিলা করতে হলে আপাতত বি.জে.পি-র হাত ধরতে হবে, অর্থাৎ, কাঁটাকে তুলতে হবে কাঁটা দিয়েই। এও এক অদ্ভুত সমাপতন দেখল পশ্চিমবাংলার মানুষ। ২০১১ সালে বাম সরকারের অবিমৃষ্যকারিতা তৃণমূলকে ক্ষমতায় আনল। ২০১৯ সালের নির্বাচনে তৃণমূলের হঠকারী রাজনীতি এই রাজ্যে বি.জে.পি-র উত্থানের ব্যবস্থা করে দিল, যার পরিণতিতে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে একমাত্র বিরোধী দল হিসেবে বি.জে.পি ৭৭টি আসন দখল করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হল। এ কথা তাই বলতেই হবে যে তৃণমূলের সংকীর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও চূড়ান্ত অপরিণামদর্শিতা পশ্চিমবঙ্গে বি.জে.পি-র উত্থানের জন্য সরাসরি দায়ী। ইতিহাসের কাঠগড়ায় তৃণমূলই চিহ্নিত হয়ে থাকবে অভিযুক্ত আসামী হিসেবে।

তিনঃ এবারে যে কথাটা বলব সেটি বামপন্থীদের উদ্দেশে। অনেকেই রুষ্ট হবেন হয়ত। কিন্তু সময় এসেছে বি.জে.পি-র উত্থানের বিষয়টিকে গভীরভাবে তলিয়ে দেখার। নতুবা বামেরা আরও বড় ভুলের পথে পা বাড়াবেন। বাম আমলে যেহেতু সাম্প্রদায়িকতার বিপদ কোনদিনই সেভাবে মাথা চাড়া দেয় নি, তাই দীর্ঘ তিন দশক জুড়ে এরকম একটি ধারণা বামপন্থীদের মধ্যে গেঁড়ে বসে যে, পশ্চিমবঙ্গে উগ্র দক্ষিণপন্থী শক্তি কোনদিনই মাথা তুলতে পারবে না। এর নেপথ্যে কাজ করেছিল সেই প্রচলিত ভাবনা যে, বাংলার মানুষ প্রগতিবাদী, সহনশীল, সেকুলার ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এই ধারণার বশবর্তী হয়েই কিছুকিছু বিক্ষিপ্ত সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছাড়া কেন্দ্রীয়ভাবে দক্ষিণপন্থী ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতা, রক্ষণশীলতা ও মতান্ধতার বিরুদ্ধে কোনও লাগাতার সাংস্কৃতিক গণআন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা বামপন্থীরা তাদের শাসনকালে করেন নি। সর্বভারতীয় স্তরে হিন্দুত্বের বিপদ সম্পর্কে পি.সি. যোশি, ই. এম. এস. নামবুদিরিপাদ প্রমুখেরা বহু আগেই যে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে সি.পি.আই(এম)-এর মধ্যে কেরল বনাম বাংলা লাইনের যে বিরোধ দেখা দিয়েছিল, তার মূল কথাই ছিল হিন্দুত্ব তথা সাম্প্রদায়িকতার বিপদ সম্পর্কে অবহিত হওয়া এবং এই বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া। পশ্চিমবঙ্গে এক ধরনের আত্মসন্তুষ্টির কারণেই এই বিপদের গুরুত্বকে বোঝার চেষ্টা হয় নি।

এই পটভূমিটি খেয়াল রাখলে ২০২১ সালের নির্বাচনে বামপন্থীরা বি.জে.পি-র মূল্যায়ন করতে গিয়ে কোথায় ভুল করলেন সেটা বোঝা যাবে। এই ভুলের সিংহভাগ দায় সি.পি.আই(এম)-এর, কারণ তাঁরা যে নীতি গ্রহণ করলেন অন্য শরিক দলগুলিও তাকেই অনুমোদন দিল, যার পরিণতি দাঁড়াল অভূতপূর্ব বাম বিপর্যয়। গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়াতেই বামপন্থীরা আওয়াজ তুলেছিলেন যে তৃণমূল ও বি.জে.পি একই মুদ্রার এপিঠ এবং ওপিঠ। তৃণমূল থেকে বি.জে.পি-তে সারিবদ্ধভাবে নাম লেখার যে ছবি সবাই দেখলেন তাতে এই ধারণাটি আরও বদ্ধমূল হল এবং সি.পি.আই (এম) নেতৃত্ব প্রবর্তন করলেন একটি বিচিত্র শব্দবন্ধ ‘বিজেমূল’। এই ভাবনাকে আশ্রয় করে যদিও মুখে বলা হল যে, বি.জে.পি এবং তৃণমূল উভয়ের বিরুদ্ধেই আক্রমণ হানতে হবে, কার্যত, বিশেষত নির্বাচনী প্রচারে প্রাধান্য পেল তৃণমূল। মানুষের কাছে এই বার্তাটাই গেল যে বামেরা, বিশেষত সি.পি.আই (এম) এই নির্বাচনে বি.জে.পি-কে নয়, তৃণমূলকেই প্রধান শত্রু হিসেবে গণ্য করতে চায়। বলা বাহুল্য, নির্বাচকমণ্ডলী এই ভাবনাকে সম্পূর্ণ খারিজ করে দিয়েছে। একই সঙ্গে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে সংযুক্ত মোর্চার ধারণাটিও। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই সত্যটি যে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের এক বড় অংশই বি.জে.পি-কেই প্রধান বিপদ মনে করেছে এবং তার বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছে তৃণমূলকে।

বামপন্থীদের বিশেষত সিপিআই(এম)-এর চিন্তায় তিনটি গুরুতর তাত্ত্বিক ভুল বা বিভ্রান্তি ছিল, যার পরিণতি এবারের নির্বাচনী বিপর্যয়। এক আপাতদৃষ্টিতে বি.জে.পি এবং তৃণমূল দুটি দলই চূড়ান্ত স্বৈরতান্ত্রিক এবং তারা যে স্বৈরতন্ত্রের অনুশীলন করে সেখানে উভয় দলের অবশ্যই যথেষ্ট নৈকট্য আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই দুই-এর মধ্যে একটি বড় ফারাক আছে। বি.জে.পি ফ্যাসিস্ত ভাবাদর্শে বিশ্বাসী, সুসংঘবদ্ধ একটি দল যার প্রধান চালিকাশক্তি আর.এস.এস। তৃণমূল স্বৈরতন্ত্রী একটি দল কিন্তু তাকে ফ্যাসিস্ত আখ্যা দেয়া যাবে না। অর্থাৎ, স্বৈরতন্ত্র ফ্যাসিবাদের মধ্যে তার চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে, কিন্তু যে কোন ব্যক্তিনির্ভর স্বৈরাচারী দলকে ফ্যাসিস্ত আখ্যা দেয়াটা ভুল। বি.জে.পি ও তৃণমূলকে একাসনে বসিয়ে তৃণমূলকে বি.জে.পি-র তুলনায় বড় শত্রু আখ্যা দেওয়ার ভাবনাটা উৎসারিত হয়েছিল এই ভ্রান্ত চিন্তা থেকে। দুইঃ বি.জে.পি-র বিপদকে খাটো করে দেখার এই যে প্রবণতা তার ব্যাখ্যা মিলবে তিরিশের দশকে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির ফ্যাসিবাদের মূল্যায়ন সংক্রান্ত ভাবনায়। সেই সময়ে তৃতীয় আন্তর্জাতিক বা কমিনটার্নের নির্দেশিত পথকে অনুসরণ করে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি এই সিদ্ধান্তে এসেছিল যে জার্মানিতে ফ্যাসিবাদের বিপদ নিয়ে শংকিত হবার কারণ নেই, কারণ হিটলারি ফ্যাসিবাদের কোনও গণভিত্তি নেই। কমিউনিস্টরা এককভাবেই ফ্যাসিস্তরা ক্ষমতায় এলেও তাঁদের মোকাবিলা করতে সক্ষম। ১৯৩৩ সালে নাৎসিরা ক্ষমতায় আসার পরে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির কী পরিণতি হয়েছিল ইতিহাসই তার সাক্ষী। বি.জে.পি-র বিপদকে গুরুত্ব না দেবার কারণটি অনেকাংশেই এই ভুলের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। তিনঃ বামেদের মধ্যে এরকম একটি বদ্ধমূল ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, এবারের নির্বাচনী লড়াইতে মূল দ্বন্দ্বটি হল তৃণমূলের অসংখ্য দুর্নীতি ও জনস্বার্থবিরোধী কার্যকলাপ বনাম মানুষের প্রতিবাদ এবং সেই কারণে তৃণমূলের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানোকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। কিন্তু বাস্তুৰে মুখ্য দ্বন্দ্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হল বি.জে.পি-র মেরুকরণের রাজনীতি ও অ-বঙ্গীয় হিন্দি সংস্কৃতির আক্রমণ বনাম এই আগ্রাসনের বিরোধিতা, বঙ্গবাসীর সাংস্কৃতিক সত্তা আক্রান্ত ও অবদমিত হওয়ার বিপদ।

এর ফলে বি.জে.পি পর্যুদস্ত হল নিশ্চয়ই, কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতি হল বামেদের এবং সবচেয়ে বেশী লাভবান হল তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূলের সমস্ত অপকীর্তি, সমস্ত দুর্নীতি ধামা চাপা পড়ে গেল এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তৃণমূল নেত্রীই হয়ে দাঁড়ালেন বি.জে.পি বিরোধিতার প্রধান মুখ রাজ্যে এবং দেশে। “বহিরাগত” তত্ত্বকে আশ্রয় করে প্রমাণ করে দেয়া গেল যে, বি.জে.পি-র বঙ্গবাসীর সাংস্কৃতিক মানসে কোনও ঠাই নেই। নীতিজ্ঞানবর্জিত, মতাদর্শহীন একটি দল সাফল্যের সঙ্গে এই বার্তাটি দিতে পারল যে বি.জে.পি-কে ঠেকাবার হিম্মত আছে একমাত্র তৃণমূল কংগ্রেসেরই। অদৃষ্টের পরিহাস এটাই যে, এই দাবিটা করার কথা ছিল বামেদের, কিন্তু তাঁরা পুরোপুরি ব্রাত্য হয়ে গেলেন।

বিষয় দুইঃ এবারে প্রশ্ন এটাই যে, বি.জে.পি-র পশ্চিমবঙ্গে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা কী হতে পারে? এ কথা ঠিক যে এই দলটির কোনও সাংগঠনিক গণভিত্তি পশ্চিমবঙ্গে নেই। দল বদলের যে অপসংস্কৃতি তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে প্রথম চালু করে, বি.জে.পি অর্থ ও কেন্দ্রীয় ক্ষমতার জোরে তাকে এক ব্যাপক চেহারা দিতে সমর্থ হয়, যার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত এখন গোটা দেশ জুড়েই মানুষের সামনে উপস্থিত। নির্বাচনোত্তর ঘটনাবলি আবারও প্রমাণ দিচ্ছে যে, তৃণমূল থেকে যারা বি.জে.পি-তে এসেছিলেন, তাঁদের চালনা করেছিল সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ। সেই ব্যক্তিস্বার্থের কারণেই এবারে তারাই আবার তৃণমূলে প্রত্যাবর্তন করতে উদগ্রীব। ফলে আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গে বি.জে.পি দলটির অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠে যেতে পারে। তাকে বাংলার মাটিতে ঠাই পেতে হলে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনকে মাথায় রেখে ঘুটি সাজাতে হবে, যার আর এক নাম ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি। বি.জে.পি-র নির্বাচনী অস্ত্র এটিই এবং একে আশ্রয় করে হিন্দু ভোটকে সংহত করাই হবে বি.জে.পি- আগামী দিনের রণকৌশল।

।। ৫।।

যা আলোচনা করলাম তার সপক্ষে এবারে কিছু নির্বাচনী পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন যার ভিত্তিতে বাম বিপর্যয়ের চেহারাটি আরও নির্দিষ্ট ও স্পষ্ট হবে। সি.এস.ডি.এস-লোকনীতি এবং আরও বেশ কিছু সংস্থা এই নির্বাচনকে নিয়ে যে তথ্য পরিবেশন করেছে, সেগুলির তাৎপর্য যথেষ্টই গভীর এবং বামেদের পক্ষে বেশ উদ্বেগজনকও বটে। এক নজরে যে চিত্রটি উঠে আসছে সেটি এরকমঃ

১. তৃণমূল ভোট পেয়েছে ৪৭.৯৪%, বি.জে.পি পেয়েছে ৩৮.১৩%। সি.পি.আই (এম) পেয়েছে ৪.৭৩%। ২০১১ সালে এই হিসেবটি ছিল যথাক্রমে ৩৮.১৯, ৯.১% এবং ৩০.১%। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই হিসেবটি ছিল যথাক্রমে ৪৪.৯%, ১০.২% এবং ১৯.৮%। অর্থাৎ, ২০১১-২১ পর্বে বামভোট ক্রমাগত কমেছে, বেড়েছে তৃণমূল ও বি.জে.পি-র ভোট।

২. মোটামুটি হিসেব করে দেখা যাচ্ছে যে বি.জে.পি-র এবারের নির্বাচনে একেবারে নিজস্ব ভোট ছিল ১৫%। প্রশ্ন ওঠে, তাহলে বি.জে.গির বাকি ভোট আসছে কোথা থেকে? ২০২১ সালের হিসেব এখনও হাতে আসেনি। কিন্তু ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে যে হিসেব পাওয়া যাচ্ছে সেখানে দেখছি ২০১৪ সালে বি.জে.পি-র পক্ষে হিন্দু ভোট ছিল ২১%, মুসলিম ২%, উঁচু জাত ২৪%, ও.বি. সি ২১%, দলিত ২০%, আদিবাসী ১১%। ২০১৯-এর নির্বাচনে বি.জে.পি-র পক্ষে হিন্দু ভোট ছিল ৫৭%, মুসলিম ভোট ৪%, উঁচু জাত ৫৭%, ও.বি.সি ৬৫%, দলিত ৬১%, আদিবাসী ৫৮%। তৃণমূলের ২০১৪ সালের হিসেবটা ছিল এরকমঃ হিন্দু ভোট ৪০%, মুসলিম ভোট ৪০%, উঁচু জাত ৪৩%, দলিত ৪০%, আদিবাসী ৪০%। ২০১৯-এর নির্বাচনে মুসলিম ভোট ছাড়া বাকি সব অংশেই তৃণমূলের ভোট হ্রাস পায়। হিন্দু ভোট ৩২%, মুসলিম ৭০%, উঁচু জাত ৩৮%, ও.বি.সি ২৮%, দলিত ২৭%, আদিবাসী ২৮%। তুলনায় বামফ্রন্টের হিসেব ছিল এরকমঃ হিন্দু ভোট ২৯% (২০১৪), ৬% (২০১৯), মুসলিম ৩১% (২০১৪), ১০% (২০১৯), উঁচু জাত ২৭% (২০১৪), ৯% (২০১৯), ও.বি.সি ২৬% (২০১৪), ৪% (২০১৯), দলিত ২৯% (২০১৪), ৬% (২০১৯), আদিবাসী ৪১% (২০১৪), ১২% (২০১৯)। অর্থাৎ, বি.জে.পি হিন্দু ভোটের বাইরে ও.বি.সি, দলিত এবং আদিবাসী ভোটের এক বড় অংশ নিজের ঘরে তুলতে সক্ষম হয়েছে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত সমাজের এই শ্রেণির মানুষদের ভোট বামেদের পক্ষেই যেত। কিন্তু সেই অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে।

৩. ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে যাঁরা চিরাচরিত বাম ভোটার, তাদের ৩০% বামেদের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন, ৩৯% বি.জে.পি-তে সমর্থন করেছিলেন এবং ৩১% তৃণমূলকে সমর্থন করেছিলেন। আবার যারা চিরাচরিত কংগ্রেস সমর্থক, তাদের ৩২% বি.জে.পি-কে, ২০% তৃণমূলকে এবং ৪% বামেদের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। আরও উল্লেখযোগ্য যে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিধানসভার নিরিখে ১১৮টি আসন বি.জে.পি-র পক্ষে যায় (মূলত বাম এবং তৃণমূল থেকে) এবং ৩৮টি আসন যায় তৃণমূলের পক্ষে (বাম এবং কংগ্রেস থাকে। অর্থাৎ, বাম এবং তৃণমূল উভয় পক্ষের ভোটেই বি.জে.পি-র পক্ষে গিয়েছিল, যার দৌলতে বি.জে.পি ঐ নির্বাচনে ১৮টি আসন দখল করে নেয়। উদ্বেগের বিষয় এটাই, বামেদের চিরাচরিত আর্থ-সামাজিক ভিত্তিতে ভাঙ্গন ধরিয়ে বি.জে.পি এবং তৃণমূল লাভবান হয়েছে।

৪. বামেদের ক্ষেত্রে এর নীট ফল হয়েছে এরকম। সি.পি.আই (এম) এবারের নির্বাচনে ১৩৮টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জামানত ধরে রাখতে পেরেছে মাত্র ১৮টি আসনে, বাকি ১২০টি আসনে জামানত জব্দ হয়েছে। আর মাত্র ৪টি আসনে (ডোমকল, জলঙ্গি, ভগবানগোলা এবং যাদবপুর) দলটি দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছে।

৫. মুসলিম এবং মহিলা ভোটারদের সিংহভাগ অংশ গেছে তৃণমূলের পক্ষে। সামান্য দু-একটি অঞ্চল ছাড়া আই.এস.এফ-এর পক্ষে মুসলমানরা ভোট দেন নি।

৬. বি.জে.পি ধর্মীয় মেরুকরণকে আশ্রয় করে তীব্র সাম্প্রদায়িক প্রচার করলেও ভোটদাতারা এই মেরুকরণকে মেনে নেন নি, অর্থাৎ, হিন্দু ভোটের একটি ভগ্নাংশ মাত্র বি.জে.পি-র পক্ষে গেছে। কিন্তু মেরুকরণ হয়েছে একটি ভিন্ন স্তরেঃ বাঙ্গালির সামাজিক-সাংস্কৃতিক সত্তা বনাম বি.জে.পি-র ভিনদেশী রাজনীতি ও সংস্কৃতি। মানুষ মনে করেছে সে বিপন্ন এবং তার আত্মরক্ষা প্রয়োজন। বামেরা বি.জে.পি-র তুলনায় তৃণমূলের বিপদকে বড় করে দেখতে গিয়ে এই বিষয়টা একেবারেই খেয়াল করলেন না আর সেই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে তৃণমূল কংগ্রেস ও দলটির সর্বাধিনায়িকা ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। তত্ত্বগত ভুল বা বিভ্রান্তির কারণে বাস্তবে অনুসৃত পদক্ষেপ বা নীতি কতটা আত্মঘাতী হতে পারে, এই পরিসংখ্যানগুলিই তার প্রমাণ। তথ্যের ভিত্তিতেই বামেদের আগাম সতর্কতা অবলম্বন করতে হলে, করতে হবে নির্মোহ আত্মসমালোচনা, দেখাতে হবে নতুন পথের দিশা।

।। ৬।।

এই নতুন পথের সন্ধান করাটা অবশ্য খুব সহজসাধ্য নয়, কারণ তার জন্য প্রয়োজন যে মানসিকতা ও চিন্তার নমনীয়তা সেটিকে সুনিশ্চিত করার মত পরিস্থিতি বর্তমানে আছে বলে মনে হয় না। তার চেয়েও বড় কথা, বাম রাজনীতির নবায়ন ঘটাতে হলে কেন্দ্রীয় স্তর থেকে সেটি শুরু করতে হবে। আমি তাই এই প্রবন্ধটি শেষ করব পশ্চিমবঙ্গে বামেদের সম্ভাব্য নীতি ও পথ কী হতে পারে সেই বিষয়ে কয়েকটি প্রস্তাব দিয়ে।

১. আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে ২০১১ সালে বামফ্রন্ট সরকার যখন ক্ষমতাচ্যুত হল, তখন বামেদের যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল তার তুলনায় এবারের পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। ২০১১ সালে বামেরা, মূলত সি.পি.আই(এম) ছিল তৃণমূলের প্রধান টার্গেট। এবারে মূল বিরোধটা তৃণমূলের সঙ্গে বি.জে.পি-র। সেই অর্থে বাম এবং তৃণমূল উভয়েরই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত বি.জে.পি-কে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সমূলে উৎখাত করা এবং ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে কেন্দ্রে বি.জে.পি-কে ক্ষমতাচ্যুত করা। এই প্রশ্নে তৃণমূল এবং বামেদের একটি সমঝোতায় আসা অসম্ভব বলে মনে করি না। উভয়পক্ষই নমনীয় হয়ে যদি তাদের নিজেদের মত করে বি.জে.পি বিরোধিতায় সামিল হন, তাহলে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সেটি হবে একটি সদর্থক পদক্ষেপ।

২. সংযুক্ত মোর্চার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এখনই কিছু বলা সম্ভব নয়। কিন্তু সংযুক্ত মোর্চার ভরসায় না থেকে বামফ্রন্টের অন্দরে ও বাইরে সমস্ত বামপন্থী দলকে নিয়ে একটি বৃহত্তর বাম মোর্চা গঠন করার কথা বামপন্থীরা ভেবে দেখতে পারেন। সেখানে বি.জে.পি-বিরোধী কর্মসূচিকে যেমন অগ্রাধিকার দিতে হবে, এ কথাটা বলতে হবে যে তৃণমূল সরকারের ঘে কোন ধরনের অন্যায়, জনস্বার্থবিরোধী পদক্ষেপ তাকেও রেহাই দেয়া চলবে না।

৩. বামেদের এ কথাটা বুঝতে হবে যে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক চালচিত্রটির অতি দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। শুধুমাত্র শ্রেণিদ্বন্দ্বের নিরিখে নিপীড়িত মানুষের মন পাওয়া যাবে না। সংরক্ষণের রাজনীতি, পরিচিতির রাজনীতি ইত্যাদির সুবাদে মানুষের অস্তিত্বের খন্ডীকরণ ঘটছে। এই খণ্ড পরিচিতিকে তৃণমূল একভাবে, বি.জে.পি আর একভাবে ব্যবহার করে ভোটের বাক্সে সাফল্য পেয়েছে। এই বাস্তব সত্যকে উপেক্ষা করে কেবলমাত্র শ্রেণি মেরুকরণের পথে হটিলে হবে না, কারণ খণ্ড পরিচিতির স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে শ্রেণিভাবনার দর্পণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না।

৪. বামপন্থীরা যে বিপুল সাংস্কৃতিক সম্পদ ও ঐতিহ্যের অধিকারী তার পূর্ণ ও সৃজনশীল ব্যবহার করতে হবে। বাম মতাদর্শকে যথার্থভাবে অনেকটা ক্ষয়ে যাওয়া বঙ্গমানসে যদি ফিরিয়ে আনতে হয়, তার জন্য প্রয়োজন হবে নতুন ধাঁচের ভাবনা, নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার, নতুন ধরনের কর্মসূচি। শুধুমাত্র অতীত গৌরবের রোমন্থন নয়, শুধুমাত্র সলিল চৌধুরী বা জর্জ বিশ্বাস বা শম্ভু মিত্র বা হেমাঙ্গ বিশ্বাস নয়, এঁদের তৈরি করে দেওয়া ঐতিহ্যের সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটাতে হবে বর্তমান পৃথিবীতে জায়মান পুঁজিবাদবিরোধী, দক্ষিণপন্থাবিরোধী, জাতিদম্ভ ও রক্ষণশীলতা বিরোধী বিকল্প সাংস্কৃতিক ভাবনার।

৫. শুধুমাত্র মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন নয়, বাম মতাদর্শকে জুড়তে হবে ভারতীয় তথা বঙ্গ সংস্কৃতির সমস্ত প্রগতিশীল ধারার সঙ্গে, যাতে বি.জে.পি মতাদর্শগত স্বরে গান্ধি, বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্রের চিন্তার যে বিকৃতি ঘটাতে চায়, রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগরকে নিয়ে যে ছেলেখেলা করতে চায়, নেহেরুকে একভাবে, আম্বেদকরকে আর একভাবে উপেক্ষা করতে চায়, সেই অপচেষ্টা রুখে দেয়া যায়।

৬. সাম্প্রদায়িকতাবরোধী কর্মসূচিকে ঢেলে সাজাতে হবে। রেড ভলান্টিয়ার্সরা যেমন একটি অসাধারণ সামাজিক দায়িত্ব পালন করছেন, সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত পরিবেশ ও মেরুকরণ থেকে যদি পশ্চিমবঙ্গকে মুক্ত করতে হয়, তাহলে সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করাটাকেও একটি সামাজিক কর্তব্য হিসেবে গণ্য করতে হবে। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির ভাবনাকে নিয়ে যেতে হবে সমাজের গভীরে, মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে, যা ভেঙ্গে দিতে পারে মুসলমানদের প্রতি তথাকথিত শিক্ষিত হিন্দু বাঙ্গালির রক্ষণশীল মনোভাব ও মনের জড় তাকে।

স্বাধীনতার পরে পশ্চিমবঙ্গ আজ এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। বামেরা ভুল করেছেন বিস্তর। সেই ভুলের সংখ্যা যেন আর না বৃদ্ধি পায়। সুস্থ বুদ্ধি ও চেতনাসম্পন্ন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ অবশ্যই চান না যে বামেরা ইতিহাসের পাদটীকায় পর্যবসিত হন। সেই সম্ভাবনাকে ঠেকাবার জন্য প্রয়োজন দেখা দিয়েছে নয়া ইতিহাস রচনার আর সে দায়িত্ব নিতে হবে নতুন প্রজন্মের বামপন্থীদের। এই আশায় বুক বেঁধেই প্রবন্ধের ইতি টানলাম।

[লেখক – বিশিষ্ট মার্কসবাদী চিন্তক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত এস. এন. ব্যানার্জী চেয়ার অধ্যাপক।]

Facebook Comments

Leave a Reply