এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয় : সৌম্যদীপ চ্যাটার্জী

“দুঃস্বপ্নের শেষ সীমানায়, চমকে ঘুম ভেঙে যায়
জেগে দেখি তুমি পাশে নেই, চোখ পড়ে খোলা জানালায়। ”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রোজ সকালে উঠে যখন খবরের কাগজের পাতা উল্টাই, চোখের সামনে ভেসে ওঠে কখনো সারিবদ্ধভাবে সাজানো মৃতদেহের ছবি অথবা অগোছালোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাশের খবর। ফিরে তাকানো যাক ফেলে আসা ছয়মাসের কিছু ঘটনা। করোনাভাইরাসের প্রকোপ কিছুটা হলেও ক্ষান্ত তখন। এই জানুয়ারি মাসের গোড়ার কথা হবে। পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ভোট-পুজোর প্রস্তুতি সবে শুরু হয়েছে হবে। রাজনৈতিক দাঙ্গায় প্রাণ হারালেন মুর্শিদাবাদের তরতাজা এক যুবক। “আমার একমাত্র ছেলে পড়াশুনোয় খুব ভালো ছিলো। বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে একটি রাজনৈতিক পার্টিতে যোগদান করল। নতুন বছর সবে শুরু হয়েছে হবে, কুপিয়ে খুন করে দিল। মুখের ভাতটা ফেলে গিয়েছিল সেই সেইদিন…বিকালে ফোনের রিং যখন বাজল… আমাদের তো আর কিছু নেই। একমাত্র ছেলেই ছিল আমাদের সব, ভেবেছিলাম রোজগার করবে, শান্তিতে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবো। কিন্তু সে আর হলো কই!”, আকাশের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে বলতে চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছিল মরজিনা বিবি (নাম পরিবর্তিত), মৃত যুবকের মায়ের। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর পাতা খুলে দেখা গেল, ১৯৯৯ থেকে ২০১৬ অবধি সরকারি হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবছর ২০ জন মানুষ মারা গেছেন রাজনৈতিক দাঙ্গায়। সম্প্রতি কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের রিপোর্ট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ এর লোকসভা ভোটে রাজনৈতিক দাঙ্গার হিসেব ৬৯৩ টি এবং যার মধ্যে সরকারি ভাবে মৃত্যুর সংখ্যা ১১ টি । ২০২১ এর সরকারি পরিসংখ্যান বলছে ভোট পরবর্তী হিংসার ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গে মারা গেছেন সম্প্রতি প্রায় ১০ জনের বেশি মানুষ।
চারিদিকে হিংসা, অবহেলা আর অসুখের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সমাজ, জনজীবন আর বেঁচে থাকার উপায়। একদিকে ভোটের জন্য প্রাণহানি, দাঙ্গা আর অন্যদিকে করোনা ভাইরাসের দাপটের কারণে কাছের মানুষের মৃত্যু, লাখ লাখ আক্রান্ত বয়ে নিয়ে আসছে হতাশা, দুঃখ আরও অনেক কিছু। “প্রথমে আমার মা, তারপর আমার বাবা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে লড়াইয়ের পরে শেষমেশ পরশুদিন বাবা-মাকে একসাথে পুড়িয়ে এলাম কাশিমিত্তির ঘাটে। কোথায় সরকার? সব পয়সার খেলা বুঝলেন? সরকারি হাসপাতালে ফেলে রেখেছিল। বন্ধুবান্ধবের থেকে টাকা যোগাড় করে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করালাম। ভেবেছিলাম নিজের কিডনিটাই বেচে দেবো, কিন্তু তা আর পারলাম কই? আমি তো অনাথ হয়ে গেলাম, বলুন?”, একরাশ জমে থাকা রাগ আর হতাশার কুঠুরি থেকে বেরিয়ে আশা শব্দগুলি শুনে যেন গাইয়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল বছর কুড়ির মন্টুর সাথে কথা বলার সময়।কিছু মানুষ হারাচ্ছেন তার পরিজনদের, কিছু মানুষ হারাচ্ছেন তার নিজের মা, বাবা কিংবা নিজের সন্তানকে আবার কিছু মানুষ নিজেরাই হারিয়ে যাচ্ছেন না ফেরার দেশে।সদ্য প্রকাশিত দৈনিক সংক্রামণের গড় আমাদের রাজ্যে ৯ শতাংশের বেশি। যেভাবে সংক্রামণ বিগত কিছু সপ্তাহে দ্রুতহারে ছড়াচ্ছে, এবং শয়েশয়ে মানুষের মৃত্যু ঘটছে সেখানে আতঙ্ক আর হতাশা দানা বাঁধছে মানুষের মনে। আমাদের দিশেহারা দেশের চেহারাটা আরও ভয়ানক। যখন পৃথিবীর অনেক দেশ লকডাউনের মোড়ক থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের নাগরিকদের আবার স্বাভাবিক জীবনকে উপহার হিসাবে দেওয়ার জন্য, সেই পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের বেশীরভাগ রাজ্যেই কঠোর থেকে কঠোরতম লকডাউনের পথে পা বাড়িয়ে ফেলেছে সংক্রামণকে রোখার হাতিয়ার হিসাবে। যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ভ্যাক্সিনেশনই একমাত্র পথ করোনাভাইরাসের সাথে লড়াইয়ে জেতার জন্য, সেখানে আমাদের দেশে বেশী সংখ্যক মানুষের কাছে ভ্যাকসিন পোঁছে দেওয়ার নীতি তৈরি করার সময় হিমসিম খাচ্ছে আমাদের দেশের তাবড় মন্ত্রী-আমলারা। তৃণমূল সরকার ২০২১-এ ক্ষমতায় ফেরার আগে ‘দুয়ারে সরকার’ নামে একটি ক্যাম্পেন করেছিল, যার মাধ্যমে প্রতিটা মানুষের কাছে সরকার পৌঁছে যেতে পারে। সেরকম ভাবেই যদি ‘দুয়ারে ভ্যাক্সিন’ নামের একটি প্রকল্প উদ্ঘাটন করা যায়, তবে অনেক মানুষের যেমন অনেক সুবিধা হয়, তেমনি সুরক্ষিতভাবে লম্বা লাইনে না দাঁড়িয়ে মানুষের কাছে অনায়াসে পোঁছে যেতে পারে করোনা থেকে বাঁচার একমাত্র অস্ত্র, ভ্যাকসিন। খবরের কাগজ থেকে নিউজ চ্যানেল, একটাই খবর-শুধু করোনা। কত মানুষ হারিয়ে যাচ্ছেন, কত মানুষ ফিরে আসছেন তবে স্বাভাবিক জীবন থেকে অনেক দূরে থেকে। জীবনদায়ী অক্সিজেন এই কঠিন পরিস্থিতিতে যখন জরুরি ভিত্তিতে পৌঁছে যাওয়ার কথা মুমূর্ষু রোগীর কাছে, সেইখানে অক্সিজেন ব্ল্যাক হচ্ছে প্রায় ৫ গুণের বেশী দামে। কালোবাজারিতে ছেয়ে গেছে চারিদিক, আর মনুষ্যত্ব হারিয়ে গেছে ধ্বংসস্তূপের আড়ালে। যেখানে এই মুহূর্তে নিজেদের সাধ্যমত আমাদের উচিত সকলের পাশে দাঁড়ানোর, সেইখানে অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের লাভের অংশ ঘরে তুলতে ব্যস্ত।

একদিকে ভোট এবং ভোট পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দাঙ্গায় মৃত্যু, অন্যদিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপে লাখ লাখ মানুষের সংক্রমণ এবং প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের এই পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার খবরে যখন চারিদিক ফুলেফেঁপে উঠছে, তখন মানুষ এবং মনুষ্যত্ব কোথায় দাঁড়িয়ে? হাসপাতালে বেড নেই, সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই অক্সিজেনের জন্য হাহাকার, একের পর এক মৃত্যুর খবর, বেসরকারি হাসপাতালে লাখ লাখ টাকার বিল…এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি কবে ঘটবে আমাদের? কবে আমরা ফিরে পাবো আমাদের সেই ফেলে আসা স্বাভাবিক জীবন, যেখানে একে ওপরের সাথে সামনা সামনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা করতাম মাটির ভাঁড়ে চায়ে বেকারি বিস্কুট ডুবিয়ে খেতে খেতে? কবে আবার সকালে ঘুম ভাঙবে দূর থেকে ভেসে আসা সাইরেনের আওয়াজ শুনে? কবে আবার পেটুক বাঙালি রেস্টুরেন্টে গিয়ে ভিড় করবে?
উত্তর ভারতে শোনা যাচ্ছে মৃতদেহ গঙ্গায় ভাসিয়ে দিচ্ছে কারণ শ্মশানে জায়গা অপ্রতুল তাই। অক্সিজেনের অভাবে, সঠিক চিকিৎসার পরিকাঠামোর অভাবে বহু মানুষের চলে যাওয়া কি এভাবেই মেনে নেবো আমরা?

এই মৃত্যু উপত্যকা কি সত্যিই আমাদের দেশ?

[লেখক – Development Communication পেশাজীবী।]

Facebook Comments

Leave a Reply