মহাদেব মাইকেল ও জোনাকি বন : সৌগত ভট্টাচার্য

চোরকাঁটা বনে জোনাকি দেখলে মহাদেবের শহরের কথা মনে হয়! চরের থেকে রাতের বেলায় শহরকে দেখতে চোরকাঁটা বনে জোনাকি জ্বলে থাকার মত লাগে। হু হু করে বাতাস আসে রেল ব্রিজটার দিক থেকে। মাইকেলের আকাশি জামা গায়ে জড়ানো নানা রঙের ছোট বড় পতাকা ফরফর করে উড়তে থাকে বাতাসে। ঠোঁটের বিড়িটা নদীর হাওয়ায় অনেকক্ষণ নিভে গেলেও বিড়িটা ঠোঁটে কামড়ে অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে মহাদেব। মাঝে মাঝে ওর মুখে বালি উড়ে আসে চোখে মুখে, বারমুডাটা কোমরে তুলে নেয়। চেন কাটা প্যান্টের পকেট থেকে কয়েকটা কাগজ দুইটা গুটখার খালি প্যাকেট বের করে সে। পকেট হাতড়ে একটা ভেজা দেশলাই বেরিয়ে আসে। অনেকবার ঘষলেও দেশলাইয়ে আগুন জ্বলে না। থু দিয়ে বিড়িটা ফেলে মহাদেব তাকিয়ে থাকে মাইকেলের দিকে। আজ সকাল থেকে বানোকে দেখেনি মহাদেব। সে আর বানো একই সময় চর থেকে শহরে যায়। সেই কাক ভোরে বাঁধ পেরিয়ে শহরে গিয়েছিল আজকেও। অন্ধকারে মাইকেলের সামনে দাঁড়িয়ে দূরের রাতের শহরকে দেখে ও। শহরটা মিটমিট করে জ্বলে। জোনাকি দেখলে মহাদেবের ভয় করে।

মাইকেলকে বলে গেছিল, রেলের মাঠে আজ পার্টির মিটিং আছে। কিসের মিটিং কাদের মিটিং কেন মিটিং হয় মহাদেব জানে না। শুধু জানে মিটিংগুলো কখনো রাতে হয় না। আজকেও মিটিংয়ের মাঠ থেকে দুই তিনটা পার্টির পতাকা আর প্লাস্টিকের ছেঁড়া ব্যানার কুড়িয়ে এনেছে মহাদেব। ব্যানারগুলো চরের বালির ওপর রাখা। এই ব্যানারের ছবিগুলোর হাসিহাসি মুখ ব্যানারের রং মহাদেবের চেনা হয়ে গেছে। ভিড় ঠেলে আজ চরে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায় ওর। রাতের কালো শহরে আলো জ্বললে মহাদেবের ভয় হয়। চরে ফেরার সময় হাওয়াই চটিতে লাগানো সেফটিপিনটা বারবার খুলে পায়ে বিঁধেছিল। রাত হওয়ার আগে চরে ফিরতে চাইছিল মহাদেব। চরে এমনিতে খালি পায়ে ঘোরে মহাদেব। শহরে গেলেই হাওয়াই জোড়া পড়ে নেয় সে, ফিরে এসে মাইকেলের পায়ের সামনে আবার হাওয়াই চটিটা খুলে রাখে। সেফটিপিনের খোঁচায় বুড়ো আঙুলের মাঝখান দিয়ে রক্ত পড়ছিল। ধুলো লেগে রক্ত দানা পাকিয়ে কালচে হয়ে গেছে, মাইকেলকে সে কথা বলেছে মহাদেব। রক্ত লাগা ছেঁড়া হাওয়াই চটিটা মাইকেল পাহারা দেয়।

নদীটা রোজ রোজ শহরের থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। আপের দিকে পাহাড়ের গায়ে একটার পর একটা ব্যারেজ তৈরি হচ্ছে আর নদীটা শুকনো কাঠ হয়ে যাচ্ছে। শহর লাগোয়া বাঁধ থেকে এখন নদীকে মাঠের মত লাগে। অনেক কাল হল নদীর জল পূব দিকে মুখ ঘুরিয়েছে। পশ্চিমে নদীর বুক উঁচা হয়ে নতুন নতুন চর জেগে উঠেছে। শহরটা যেন রাতের বেলায় চুপ করে নদীর জেগে থাকা চরার দিকে তাকিয়ে থাকে, সুযোগ পেলেই এগিয়ে আসবে, চরকে গিলে খাবে। আশ্বিনের শেষে শ্রাবণের মেঘ সরে গেলে চরের ক্ষেতিতে পাখিদের ফরফরানি বাড়ে। চরের লোক পাখি তাড়ানোর জন্য মাইকেলকে জামাকাপড় পরিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। বানো যদিও মাইকেলকে ডরায় না, আকাশি জামার হাতের উপর মাথার উপর উড়ে এসে বসে মাইকেলের গায়ে লাগানো পতাকায় বসে ঘাড় চুলকায়। চরের লোক বলতে সবাই ভাটির দিকের দূর দূর গ্রাম থেকে চরে আসে ফি বছর সবজি চাষের জন্য। অনেকে আবার অন্যদেশ থেকেও এসেছে বলে শোনা যায়। এখানে এসে পার্টি ধরে আসতে আসতে রেশন কার্ড ভোটের কার্ড তৈরি করে এখন চরের আশেপাশেই থাকে তারা। চর থেকে সবজি নেওয়ার পিকআপ ভ্যানে মাঝেমাঝে চরের মানুষদের তুলে নিয়ে মিটিং এর মাঠে ঢেলে দেয়। মহাদেব অনেকবার পিকআপে চড়ে ভোটের মিটিংয়ে গেছে। যদিও মহাদেবের ভোটে নাম নেই। চরে রাত গভীর হলে লোহার ব্রিজ দিয়ে ঝমঝম করে ট্রেন চলে যায় গভীর রাতের দিকে। বানো মাইকেলের মাথায় বসে শহরের দিকে তাকিয়ে থাকে!

মহাদেবের আসল বয়েস কেউ আন্দাজ করতে পারে না। উঁচা দাঁতের হলুদ রং দেখে চরের লোক পূবের জলের মত মহাদেবের বয়স মাপে। লম্বায় বাড়েনি মহাদেব, তাই বয়েস ঠাহর করা মুশকিল। মিনি বন্যার বছর, যে বছর অনেক কাঠ ভেসে আসে আপের থেকে সেই বছর মহাদেবের জন্ম হলেও হতে পারে। বন্যারও তো এক কুড়ি হল। চরের পুরানো লোক বলে, মহাদেবের জন্ম নাকি টাউনের হাসপাতালে। মহাদেবের বাপ মা কে সেটা কেউ জানে না। একটা শিবের থানে ওকে পাওয়া গেছিল তাই নাম হয় মহাদেব।
ছোটবেলা থেকেই কথা বলার সময় একটা গোঁ গোঁ শব্দ করে, মুখ দিয়ে লালা ঝোলা পোটা পড়ে থুতু ছেঁটে। টাউনের রাস্তার বাচ্চারা ওকে দেখে ঢিল ছুঁড়ত, মহাদেবও দাঁত খিঁচিয়ে তাড়া করত ওদের। বাচ্চারা আবার ঢিল ছুঁড়ত। রেগে গেলে মহাদেব ঢিল নিয়ে তাড়া করে গোঙাতে থাকে। ওর সারাদিনের গোঙানিতে কোনটা রাগ আর কোনটা কথা কেউ বোঝে না। মহাদেব কবে থেকে যে চরে আসা শুরু করল এখনকার কেউ খেয়াল করে নাই।

আজকে শহরে যাওয়ার সময় মুখ দিয়ে লালা পড়লে তা জামার হাতা দিয়ে মুছে নেয়। রাস্তায় জমে থাকা জলের উপর দিয়ে একটা গাড়ি চলে গেলে ও ভিজে যায়। মহাদেব ঢিল নিয়ে তাড়া করে গাড়ির পেছনে। রেলের মাঠে মিটিং শেষ হলে ব্যানার পতাকা কুড়োতে থাকে মহাদেব। মিটিং শেষে গায়ে শহরের বোটকা গন্ধ লেগে থাকে, সেই গন্ধ চরার হাওয়ায় টের পায় সে। যেদিন শহরে যায় না সেদিন চরার পশ্চিমে যায়, যেদিকে নদীর জল বয়ে যায়। নদীতে একের পর এক কাঠ ভেসে যাওয়া দেখে। ভেসে যাওয়া কাঠের গায়ে টিপ করে ঢিল ছোঁড়ে। ভেসে আসা কাঠের টুকরো গুলোর সঙ্গে কিসের যেন একটা মিল পায় সে! নদীর জলে কারেন্ট বসায়, বিষ দিয়ে মাছ মারে চড়ার লোকরা। মাইকেলকে সেই মাছ মারার গল্প হাত পা নাড়িয়ে বলেছে সে। পশ্চিমে নদী থেকে সন্ধ্যা নামার আগে ফেরার সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে বানোকে খুঁজতে থাকে। আশ্বিনের পরিষ্কার আকাশে তখন একটা একটা করে তারা জ্বলে ওঠে। চরের আকাশটা গোল বাটির মত দেখায়, দূরের গাছ গুলো কালো হয়ে যায় সন্ধ্যা নামলে কালো আকাশের গায়ে তারা চকচক করে। পশ্চিম থেকে ফিরতে রাত হলে চোরকাঁটার বনে জোনাকি জ্বলে ওঠে। মহাদেব মনে অল্প অল্প ভয় ধরে, গোঙাতে থাকে সে। কখন মাইকেলের সমানে এসে পৌঁছায় ওর খেয়াল থাকে না, মাইকেলের কাছে চলে আসলে আর কোনো ভয় নেই মহাদেবের।

মাইকেল ছাড়া চরের কারো সাথে কথা নাই মহাদেবের। বানো মাইকেলের ছড়ানো হাতের উপর বসে মহাদেবের কথা শোনে আবার মাঝে মাঝে উড়ে চলে যায় নদীর দিকে। সেফটিপিন দিয়ে খোঁচা লাগা আঙুলে একটা পাতলা ক্যারিবাগের প্ল্যাস্টিক বাঁধে। আজকের শহরের মিটিং থেকে আনা দুইটা ব্যানারের একটা ব্যানারকে দুই ভাঁজ করে নিজের গায়ে জড়িয়ে অন্য একটা দেয় মাইকেলের গায়ে। বাকি পতাকা গুলো মাইকেলের সারা শরীরে লাগিয়ে দেয়। হু হু সন্ধ্যায় গায়ে ব্যানার জড়ানোর সময় কি যেন একটা বলছিল মাইকেলকে, তার জিভ জড়ানো কথার গোঙানির মধ্যে ভয় থাকে। মহাদেবের সঙ্গে যখন কেউ কখনো কথা বলতে আসে সেই কথা মহাদেব বোঝে কি না সেটা যদিও কেউ জানে না। শুধু সে জানে পিকআপে বা হেঁটে শহরে পার্টির মিটিংয়ে যেতে হয়। মিটিং থেকে ফিরে মাইকেল কে সব গল্প করে সে। চরের সবাই জানে মহাদেব রাগ উঠলে শুধু মাঝে মাঝে পাথর নিয়ে তাড়া করে, নাক দিয়ে সিকনি পড়ে। কোনো অচেনা পাখি মাইকেলের সমানে আসলে সে জিগার ডাল নিয়ে তেড়ে আসে। মাটির পাতিল দিয়ে মাইকেলের তৈরি মাথার একটা কোণ একদিন এক পাখি ঠুকরে ভেঙে দেয়। সেদিন মহাদেব খুব কাঁদতে কাঁদতে সারা চর দাপিয়ে বেরিয়েছিল, কিন্তু মহাদেবের কান্নার কারণ কেউ বোঝে নাই। সেই কী চরডাকা কান্না…

সবজির লোড নিতে আসা গাড়িগুলোর দুপুর বেলায় আসা মানেই শহরে মিটিং থাকা।মহাদেব গাড়িগুলোর সামনে ঘুরঘুর করে। চরের লোকেরা সব পার্টিরই মিছিলে যায়, গাড়িগুলোর মত। মিটিংয়ের শেষে চরের লোকেরা নিজেদের মধ্যে অনেক আলোচনা করে। সেই সময় মহাদেব একটা হাফ পোড়া বিড়ি টানতে টানতে রেলের মাঠ থেকে পতাকা কুড়ায়, হাফ খেয়ে ফেলে দেওয়া গুটখা জলের বোতল কুড়ায়। মিটিংয়ের লোক গুলোর মাইকে বলা কথাগুলোকে ভয় পায় মহাদেব। সে ভয় বলতে না পারলেও তার শরীরের ছাপ দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, যতক্ষন মাইক বাজে মহাদেব গোঙাতে থাকে। লোকে হাততালি দেয় সেই কথা শুনে, মহাদেবও গোঙাতে গোঙাতে হাততালি দেয় আর অস্থির হয়ে পায়চারি করে। মহাদেব দেশ বোঝে না, জমি জায়গা খেত বোঝে না, শুধু বোঝে এই মিটিংয়ে না আসলে সব হারিয়ে যাবে। তাই ভয় পেলেও মিটিংয়ে আসতে হয়, সেটা জানে। মিটিং গুলোতে সব দখলের কথা বলে। নিজে নিজে কিছু একটা হারিয়ে যাওয়ার ধারণা করে নেয় সে। যদি কোনো দিন কেউ আকাশ নদী পূবের নদীর চর স্রোত শুকনো কাঠ মাইকেলকে দখল করে নেয় কেউ রাতের বেলার শহরটাই জোনাকির মত উড়তে উড়তে এসে। মিটিংয়ে গলা শুকিয়ে যাওয়া ভয় থাকলেও একটা রাংতা মোড়া প্যাকেটে খাবার পাওয়া যায়। রাংতায় নিজের মুখ দেখে মহাদেব। নিজের মুখকেও আজকাল ভয় লাগে, নিজেকে দেখে গোঙাতে শুরু করে। মহাদেব গোঙালে আশেপাশের লোক ওকে অনেকসময় ঢিল ছোঁড়ে, কেউ লাথ মারে। মিটিংয়ের পর চরায় মাইকেলের কাছে আসলে ভয় চলে যায়। চরে এসে মাঝে মাঝে ঢিল ছোঁড়ে রাতের শহরের দিকে। চরার শূন্যতার মাঝে একটা রেলের মাঠের মিটিংয়ের মঞ্চ, একটা রাতের জোনাকি জ্বলে থাকা শহরকে কে কল্পনা করে মহাদেব। সে ঢিল বেশিদূর যায় না,

মিটিংয়ের কথা না বুঝলেও বানোর চিৎকার বোঝে। বানো আজ খুব চিৎকার করছে, সকাল থেকে চিল চিৎকার। মহাদেব মাথা ঘুরিয়ে মাইকেলের দিকে তাকায়। একটা ধান কাটা মেঠো ইঁদুর রক্তাক্ত হয়ে পরে আছে সর্ষে ক্ষেতের মাঝে। বানো শিকার ধরেছে। মহাদেব নিজের পায়ের দিকে তাকায়। মাইকেলের গায়ে কনকনে নদীর হওয়ায় মিটিংয়ের পতাকাগুলো ওড়ে। মহাদেব শুধু জানে এই পতাকা থাকলে ভয় থাকে না, কেউ কিছু করতে পারে না! মহাদেবের কোমড়ে শিবের থানের একটা ঘুনসি আছে। সেই ঘুনসির মতোই এই পতাকা গুলো। ঘুনসি পড়লে ভূত ধরে না যেমন। মাইকেল তো শুধু ক্ষেতের ফসল বাঁচায় না, মহাদেবকেও বাঁচায় জোনাকিদের থেকে। মহাদেব শুধু বেঁচে থাকার উল্টদিকে মারাকেই বোঝে। চর বেঁচে থাকলে মহাদেব বেঁচে থাকবে। মাইকেল বেঁচে থাকবে।

মাইকেলের চোখের একটা দিক বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে গেছে। সবজি খেতে শুকনো চোরকাটার গাছ দিয়ে আগুন জ্বালায়। মাইকেলের চোখে ধোঁয়া লাগে। আগুন দেখলে বানো এদিকে আসে না, বানো আগুন ভয় পায়। মহাদেব চোরকাঁটার বন হাত দিয়ে সাফ করে চরের বালুতে ফেলে রাখে। রোদে শুকিয়ে গেলে সেগুলো পোড়ায়। চোরকাঁটার বন থেকে জোনাকি নির্মূল করার চেষ্টা করে। শুকনো চোরকাঁটায় আগুন জ্বালিয়ে মহাদেব মাইকেলকে মিটিংয়ের গল্প করে। হাত পা নেড়ে বোঝায় কেমন করে সকালে মাইকে কথা বলে, কী ভাবে হাততালি দেয়। মহাদেবকে একদিন কয়েকটা লোক তাড়া করেছিল সে ভয় পেয়ে কি ভাবে প্যান্টে পেচ্ছাপ করে দিয়েছিল সেটা দেখায় মাইকেলকে। ভয় থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় এই ব্যানার জড়িয়ে পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, পতাকা ব্যানার হাতে তুলে দেখায় মাইকেলকে। পতাকাকে মানুষ যেমন ভয় পায় তেমন পতাকা দেখলে জোনাকিরা আসবে না। রাতের বেলায় গোটা শহরটা জোনাকি বন হয়ে উড়তে থাকে। পতাকা দেখলে চর আকাশ নদী শুকনো কাঠ ফসল কেউ নিতে পারবে না, এরকমই বলে মহাদব মাইকেলকে। জোনাকি মনে রাতের শহর। কিন্তু গোটা শহরটা যদি একদিন রাতের বেলায় নদীর চড়ায় চলে আসে! গোটা চড়াটা যদি শহর হয়ে যায়। মহাদেব মাইকেলকে জিজ্ঞেস করে যে সে কি পারবে এই চরকে বাঁচাতে জোনাকির আলো থেকে। গল্প শেষ হওয়ার আগে একটা ব্যানারের ওপর শুয়ে পড়ে সে। অনেকক্ষণ আগে আগুন নিভে যায়। মহাদেব কখন ঘুমিয়ে পড়েছে মাইকেল জানে না। ঠান্ডা লাগলে মহাদেব আরেকটা ব্যানারকে চাদর করে জড়িয়ে নেয়। ওর চারপাশ সারা শরীর জোনাকিতে ভরে যায়।

বানোর এক বিকট চিৎকারে মহাদেবের ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম চোখে মাইকেলের সামনে এগিয়ে আসে। বানো একটা মেঠো ধানকাটা ইঁদুর মেরে চিল চিৎকার করছে। মহাদেবে আচমকা উঠে দেখে তার গায়ে জোনাকি লেগে আছে মাইকেলের গায়ে জোনাকি জ্বলছে। সারা চর জুড়ে জোনাকি! শহরটা আলো জ্বালিয়ে জোনাকির মত উড়তে উড়তে চরের দিকে এসেছে কী! গোটা চরটাই কি তাহলে শহর হয়ে যাবে! মহাদেবের গলা শুকিয়ে যায়। মাইকেলের দিকে তাকিয়ে গোঙাতে থাকে মহাদেব, অসহায় হয়ে মাইকেলের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে থাকে। কেউ যেন তার রক্ত মাখা পা টা বালির সঙ্গে আটকে রেখেছে। সে নড়তে পারছে না। কিন্তু শহরটা জোনাকির মত উড়তে উড়তে চরকে খেয়ে ফেলতে আসছে। মাইকেলের সারা গায়ে জোনাকি জ্বলছে। মাইকেল এর দিকে তাকিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে মহাদেব। কি করবে বুঝে না পেয়ে সে মাইকেলকে মাটি থেকে তুলে কাঁধে তুলে দৌড় লাগায় বালির উপর দিয়ে। সেফটিপিনে জখম আঙুলের খাঁজ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ে সবুজ সবজি ক্ষেতের ওপর। শহরটা মহাদেবের পেছনে দৌড়াচ্ছে জোনাকি হয়ে, তবু মহাদেব দৌড়ে যায়। মাইকেল যেন মহাদেবের কাঁধে তুলে নেওয়া ক্রুশ কাঠ। সমানে শুধুই নদীর চড়া আর সবজি খেত। মহাদেব দৌড়াতে থাকে আর পেছনে তাকাতে থাকে। যেন বারবার জোনাকির আলোতে চারিদিক ভরে ওঠা চর দেখতে পায় সে। সে দৌড়েই যায় কোথায় যাচ্ছে সে জানে না। দৌড়াতে দৌড়াতে মহাদেবের হাঁফ ধরে যায়। কাঁধ অসাড় হয়ে আসে মাইকেলের ভারে। মহাদেব এক এক করে মাইকেলের গা থেকে পার্টির পতাকা ব্যানারের টুকরো গুলো খুলতে থাকে আর ফেলে দিতে থাকে মাটিতে। মহাদেবের কাঁধে মাইকেল এখন শুধু বাতা দিয়ে তৈরি একটা মাচার ওপর আকাশ রঙের জামা। নানা রঙের লাল নীল সবুজ হলুদ পার্টির ব্যানার পতাকা গুলো উড়ো খইএর মত পড়ে থাকে চরের সবজি ক্ষেতের ওপর। হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে বানো তাদের সঙ্গে সঙ্গে উড়ে যাচ্ছে, মাটিতে পড়ে থাকা ব্যানার পতাকা দেখে যেন বানো পথ চিনে নিয়েছে। অনেক অনেক দূরে এসে মহাদেব নদীর জলের সমানে এসে দাঁড়ায়। এখান থেকে শহর দেখা যায় না। জোনাকিও দেখা যাচ্ছে না। সামনে শুধুই পশ্চিম দিয়ে বয়ে আসা নদীর কালো জল। মাইকেল হাঁফাতে হাঁফাতে বালুর উপর বসে পড়ে। পাশে পতাকা জামাকাপড়হীন মাইকেলের বাঁশের একটা কঙ্কাল। ভোরের আলো ফুটবে তখন। সামনে নদীর কালো জল। মহাদেব দরদর করে ঘামছে, হাঁফাচ্ছে। নদীর সামনে বসে দেখে, নদী দিয়ে শুকনো কাঠের মত একের পর এক কাকতাড়ুয়াদের কঙ্কাল ভেসে যাচ্ছে।

Facebook Comments

Leave a Reply