খুরা জোঁকের চাঁদ আর বিলের গল্প : সিন্ধু সোম
ও জোঁক আলাদা। জলের জোঁককে বলে খুরা জোঁক। ও পড়ে কড়ার মতো। কড়া বোঝো?
দীপক ঘাড় নাড়ায়। এই নাড়তে থাকা ঘাড় চোখের মধ্যে দিয়ে মাথায় ঢুকে পড়ে নদী, তার তীর বেয়ে ঘাস জমি, চরতে থাকা ছাগল গরু ভেড়ার পালকে খালি খালি ঘেঁটে দিতে থাকলে আরতির ভুরুর ওপর এসে বসে একরাশ বিরক্তি। সে বিরক্তি ভুরুর রক্ত চুষে ডুমো ডুমো হয়। তাতে আরতির ভুরু দেখায় মেলা কোঁচকানো। নিজের চোখ এবং ভুরুর ব্যাপারে আরতি ইদানীং একটু বেশি সচেতন। তাতে করে ভেতরে বোনা কাপড়খানি ফেলে তাকে চলে যেতে হয় তার ছোটবেলার সাগরিদ ফজলুর কাছে। মুসলমান ঠিকই, তবে বন্ধুলোক। তখন আরতির গাঁয়ের বেবাক লোক অনেক ছোট। উঠানের কোণে হাঁটুর বাতকে গরম সরষার তেল শুঁকাতে থাকা ঠাকুমা রান্নাঘরের জানলায় উঁকি দেয়। ঠাকুমা দেশ ছেড়ে আসার কত গল্প রুইত। সেই কত জমিজমা থেকে এসে বাস বিঘা পাঁচেকের বাঁধুনিতে। আশেপাশে ছোট জাত, মুসলমান। যখন তখন আলের নিচে টেনে নিবার ভয়ে আরতিরা বেরাত না পাঁচ বিঘা ছাড়ায় কখনও। তবে ফজলু…তার কথা থুই আলাদা পাতে। ফজলুর হাত মনের মধ্যে টেনে এনে আরতি দীপককে বোঝায়…
কড়া কড়া! মোটা বালার মতো। বুঝছ? কড়া দেখ নাই? খুরা জোঁক হয় মোটা মোটা। হাতের এই খানে ধরলে পাক দিয়ে তার পাশে ধরে আরেকটা মুখ। দুইখানা মুখ। ও ধরলে ছাড়ানো খুব কঠিন। আর একটা হয় ঘাসের জোঁক। বাবা! তিনবার লাগছে, তিনবারই কাণ্ড! জোঁকে খুব ভয় লাগে।
চোখ চেয়ে দেখলে বোঝা যায় দীপকের মাথা এবার কিছুটা এগিয়ে এসেছে। এই ভঙ্গিতে তার চোখেমুখে লুকিয়ে রাখা কৌতুহল গলা বেয়ে ঝুলোঝুলি করে। নিছক সেই আবেশেই দীপক একবার নাক টেনে নেয়। তাতে আরতির চোখের কোণ থেকে ঝিলিক দেওয়া আদর এসে পড়লে দীপকের নাক ও নাকের দুপাশ হয়ে আসে অস্বাভাবিক লাল। এগোনো মাথার ঔৎসুক্যেই হোক, আর তাড়াতাড়ি মনের ভেতর থেকে জোঁক ছেড়ে ফেলার তাগিদেই হোক, আঁটা মাখতে মাখতে দীপকের প্রশ্নের অপেক্ষা না করেই আরতি আবার শুরু করে,
ছাগলকে খাওয়াব, তা মা বলে কি, ঘাস নিয়ে আয় তো কেটে। বললাম, মা, ঐ দিকে নদীর পাশে কিন্তু মেলা জোঁক, আমার ভয় লাগে। বলে কি, ধুর কিছু নাই। যা তো…আমি গেছি দা হাতে…ঘাস কাটি কাটি…হঠাৎ পায়ে কি খলবল করে, দেখ চেয়ে, হ্যাঁ ঠিক জোঁক…হাতে ছিল দা, এক কোপ…
দীপকের হাঁ করা মুখ থেকে ভুরভুর করে ভেসে আসতে থাকে মাখো মাখো অবাক হওয়ার গন্ধ। তাতে আরতি কিছু সমবেদনাও পায়। কিন্তু সেই ঝাঁঝ বেশি হয়ে উঠলে অবাক হওয়া উপভোগ করা তার আর হয় না। হাঁটুর নিচে শুকিয়ে আসা পায়ের ওপর নিজের নজরকে চরতে দিয়ে দীপক বলে,
বোঝো! দা দিয়ে কোপ! তারপরে?
সেই দৃষ্টির খচখচানি ক্রমে মসৃণ হয়ে পা বেয়ে উঠে পড়ে আরতির কোমরে। আরতি নিজের গায়ে জড়ানো হলুদ গোলাপি চাদরটা একটু টেনে নিজের পিঠটা বের করে আনে। এই পথ দীপকের ঠেকে বেশুমার চেনা। এই পথে নদীতে নামছে সে কতবার। নদীর পাড়ে ক্ষেত…ক্ষেতে বেয়ে গড়িয়ে যায় বাপ ছেলে, পিছনে কুত্তা, তার বাপের আদি বাড়ি ছিল পাবনা…ঠাকুর্দার পিছন পিছন দেশভাগের সময় সে এসে ওঠে এইপারে…দীপকের জন্ম অবশ্য মালদায় নয়, তখন বাপ তার চাকরিসূত্রে বরাকরের ধারে বাসা বেঁধেছে, একদিকে বরাকর অন্যদিকে অজয়…দুই নদী দুইদিক ঠেলে নিয়ে এলে অববাহিকার পিঠ তার খাঁজ ও খোঁচা খোঁচা হাড়ের টেউ সমেত রান্নার ঘামে চকচকাতে থাকে…আরতির মাস্ক ঢাকা ভুরুর তিখা পাড় থেকে ঝুরা ঝুরা সময় ভেঙে আসে…
আরে চোখ বন্ধ ছিল তো! দা পড়ছে গিয়ে মাটিতে। ঘাস! কই ঘাস? সব ফেলাই দিছি। কাছে ছিল পিসি, সেইই এসে ধরে, দা সরায় রাখে…জোঁক ছাড়ায়…আরেকবার…আমার জীবনে অনেক গল্প আছে তো…সময় করে বলব…মেজদি জামাইবাবু নিয়ে গিয়ে রাখছিল…তখনও বিয়ে হয় নাই…উঠান দিছে ঝাড় দিতে…দিছি ঝাড়…আসন পেতে জামাইবাবুকে ভাত দিছি…তা হাঁড়ি থেকে হাত সরাইছি, দেখি, এই…বাম হাত…তখন ফ্রক পরতাম তো…কী ছাই হাতা হত, মনে নাই…মানে ফোলা হাতা, বুঝছ? সেই হাতার নিচে…আমি বলি কীরে…ঝাড়ছি, পড়ছে গিয়ে জামাইবাবুর লুঙ্গির ভিতর…আর সে কি নাচ…জামাইবাবু নাচে, দিদি নাচে…মুখে তো কিছু বলতে পারে না…আর আমার এদিকে রক্ত পড়েই যাচ্ছে, পড়েই যাচ্ছে…জোঁকে ধরলে রক্ত বন্ধ হয় না, জানো তো…
এতক্ষণে দীপক হালে একটু পানি পায়। মেজো কালো নাও তার এপাশ ফিরে, ওপাশ ফিরে। কেওট পাড়ার শ্মশানে চিতা জ্বলে। চিতা ভেসে যায়। নাও তার নিজের না। মোটরবাইক পাড়ে রাখতে রাখতে মাগরিবের আজান ধকেলে ধকেলে নাও ছিটায় নদীর স্রোত খেয়ে। বাপ মারা যাবার পরে রোজ মদ খেয়ে বাড়ি ফিরলে আর কেউ মুখ করার ছিল না। মার্ক্স হাতে নাওয়ে চিৎ। মদ চারায় পায়ের বুড়ো আঙুলের ডগে। কেওটপাড়ার মেয়েটিকে মাঝে মধ্যে নেমে যেতে দেখা যায়। এই আর কি! ঘন পল্লবিত শোয়ার ঘরের দরজার সামনে থেকে টুলখানা একটু রান্নাঘরের দিকে টেনে নিয়ে দীপক বলে,
হ্যাঁ, জোঁকের লালায় হিরুডিন থাকে। সেটা রক্ত জমাট বাঁধতে দেয় না…তাই রক্ত পড়ে যায়…থামতে চায় না…
আরতির মুগ্ধ নজর দীপকের নড়তে থাকা মুখে ধাক্কা খেয়ে এক লাফে তার চোখ জোড়া দখল করে ফেলে। সেখানে কতশত অক্ষরের নাচ। দীপকের এই অনাবশ্যক জ্ঞান শুনতে শুনতে আরতি একটু কোমরে হেলান দেয় রান্নাঘরের স্ল্যাবে। মুখ থেকে বুকের খানিকটা তার এদিকে ঘোরানো। কিন্তু চোখের নিচে যেন বিল। অপার রহস্যে জবুথবু। বাপের মুখে ছোটবেলার বিলের স্মৃতি, কলমি শাক, মাছ ধরার গল্প। ঢিল ছুঁড়ে বাইচান্স বনমোরগ মারছিল বাপ। অথচ মা শীতেশ কাকার সঙ্গে পাড়ার লোকের সামনে বেরিয়ে যাবার সময় একটা থাপ্পড়ও মারতে পারে নাই। গোঁ গোঁ শব্দ…খালি গোঁ গোঁ শব্দ। বাঁড়া তুমি ছেলের গায়ে খই ফুটাও, বৌ গোঁফে তা দিল এমন যে গোঁফ কুঁকড়ে ঝাট হয়ে গেল বাল। অথচ বাপের দেশের স্মৃতি মার্ক্সের গ্রুন্ডেরিসের হিসাব নিকাশে মিশে থাকে। মুকুন্দপুর যাওয়ার সেই পথ…বোল্ডারের দুপাশে বাপের রক্ত চিকচিকায় চাঁদ…গোড়ায় একটা বেড়ে বট…তার ছায়ার অংশটুকু বেশি অতল ঠেকে…বাপ তার কেমন বেঁচে আছে দেখ! কে বলে মরছে!! তাতে ভয় খানিক কমে…এতদিন হয়ে গেল…তবু শিরশিরাইথে ছাড়ে না বাপ…মরা হোক বাঁচা হোক…তার থেকে বিল দেখ…দূরে এক বিশতলা বিল্ডিং বেড়া ধরে…সেই বেড়ার নানান উচ্চতা ঝাপসা হয়ে মাস্কের বুনন হলে আরতির চোখ সেখানে ছিপ ফেলে চাট্টি কথা তুলে! দীপকের জীববিজ্ঞানের সঙ্গে বাঁধন আঁটোসাঁটো করতে চায় সে,
হ্যাঁ, থামতেই চায় না। আর আমি তখন সাদা রঙ বেশি পরতাম, পছন্দ করতাম তো, তাই…এদিকে ফ্রকটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে…এ বলছে ন্যাকড়া পুড়া লাগা…ও বলছে আর…রক্ত থামেই না…আমি দিদিকে বললাম ছাড়, স্নানের পরেও আমি সাদা কাপড় পরব, সেটাও নষ্ট হবে…কী করে থামিয়েছিলাম জানো?
কী করে?
সাবান দিয়ে। ওদের তখন লাক্স সাবান ছিল, নখ দিয়ে তাই চেঁছে লাগিয়ে দিলাম…ব্যাস, রক্ত বন্ধ…সেইবারও কাণ্ড…আরেকবার বিয়ের পর…এইখানে এসে। শাশুড়ি বলে, যাও তো, পিছন থেকে কচুর লতি নিয়ে এসো…বারবার বললাম, মা জোঁক নাই তো? জোঁক নাই তো? বলে কি, নাহ্! নাই তো! আমরা কতবার যাই! আর গেছি, আমাকেই লাগছে। কোথায় ছিল কে জানে! সেইবার লাগছিল ঘাড়ে…উঃ, বাবারে! আমি তো দিছি চেঁচায়ে, ঘরের বাইরেই, বারান্দায়, অত কী আর জ্ঞানগম্যি থাকে তখন…শাড়ি খুলে লাফাই আর শাশুড়ি এসে করে কি, আমাকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে ঘরের ভিতর, গিয়েই ঠাস্ করে এক চড়…আমার দেওর, ভাসুর…ভাসুরের বড় ছেলে, সেই যে বলেছিলাম না, আমার বয়েসি, চীৎকারে সব বেরিয়ে এসছে…ভয় পাইছিলাম খুব…কতই বা বয়েস বলো তখন…
বয়সের কথায় দীপক একটু কুঁকড়ে যায়। দুই বেটির মা আরতির বয়েস তার থেকে বছর চার পাঁচ বেশিই। কিন্তু এই কান টানতে গিয়ে মাথা এনে ফেলে এই ব্যাপারটা আরতির মনে বুড়বুড়ি কাটার সম্ভাবনায় অস্বস্তিটা সে সামলাতে চায়। শাশুড়ির প্রসঙ্গ টানাতেই তার উৎসাহ দেখা যায় বেশি…
চড় মারল? ঐটুকুতেই?
গলায় তার বিস্ময় যেন বাধ মানে না…
মারল তো! কম মেরেছে? যবের থেকে এসেছি। বাড়িতে বাবা বই দিত না, খাতা দিত না…ক্লাস সেভেনের পর থেকে পড়া চালাইছি চেয়ে চিন্তে…আমি ছিলাম দু চক্ষের বিষ…তাই বিয়ের পরে পিসি বলেছিল, মেয়েটাকে তোমরা হাত পা বেঁধে জলে ফেলে দিয়ে এলে? একবার ছেলেটাকে চোখের দেখা দেখলে না! আমাদের সব বোনদের এই…মেজদিকে বলছিল জামাইবাবু, বাবা খুব অসুস্থ, তোমায় বৌ সাজায়ে দেখাব নি, বুড়া মরার আগে খুশি হবে। বিয়া নাই বা করলে, দেখা নাই শোনা নাই বাপ আমার মেয়েকে পাঠায়ে দিল। সে মেয়েকে আর ঘরে ফেরাবে? তালেই হৈছে! কত বড় জামাইবাবু, মানুষ ভালো…কিন্তু ঐ…ওইই তো দেছিল আমার বিয়ে…পরে চুপ করে থাকত…কতবার বলছি, এইটা কি আপনি ঠিক করলেন বলেন তো? চুপ…আর বড়দির বর…জেঠির ঘরে একা পেয়ে কতক্ষণ ধরে যে…এখনও ফোন করে ঢলানি, এদিকে এলে বাড়ির চারপাশে ঘুরঘুর করে… বড় মেয়েটা তখন পেটে, কতদিন খেতে দেয় নাই জানো আমার ননাস? দিনের পর দিন না খেয়ে কাটাই, মেয়ে আমার হল, তা বুদ্ধিসুদ্ধি কম, কিছুই বোঝে না! হবে না! পেটের মধ্যে থাকতেই খাবার পেত না!
কথা এই খাতে গড়ালে দীপক একটু আরাম পায়। এ গল্প তিন মাসে সে শুনেছে প্রায় সাতবার। তবু আরতির রিনরিনে গলার আঁচে নিজের চোখের নিচে জ্বলতে থাকা লালচে ঘোরটা আরেকটু পাকিয়ে তুলে সে বাইরে দিকে তাকায়। কুয়াশা আজ নাই। তবে রোদও খুব একটা উঠবে বলে মনে হয় না। সামনের দুইটা দেয়ালে রোদ ঠিকরে আসার পরিমাণ দুইরকম ঠেকে তার। একটা পুট্টি করা অতি মসৃণ রোদ, আরেকটা চুনকামের পাতি খসখসে। এক রোদ ছেড়ে বাড়িওয়ালা উঠে গিয়েছে আরেকটির দিকে। মসৃণ রোদের ছায়ায় ছায়ায় পুরনো বাড়িটার সামনে জবাগাছটা একটু ঝিমিয়ে নিচ্ছে। এতদিন তার সুযোগ ছিল অল্প। তার পিছনে জালিঘেরা যে বাড়িটা দীপকের দিকে তাকায় আড়চোখে, সেই জালির পিছনে বন্ধ ঘর দুটো আঁতিপাঁতি করে খুঁজে নিয়ে তার খেয়াল ফিরে আসে আরতির গাল আর ঘাড়ের মাঝে গেঁথে থাকা গভীর খাঁজে। মেয়েটার শরীরে বিল আছে। ঢাকা। তবে আছে। আর পাঁচটা কাজের লোকের মতো না। ঠ্যাকায় পড়ে এই কাজ। প্রথমদিন এসেই বলেছিল, কখনও ভাবি নাই এই কাজ করতে হবে! তা আরতির পক্ষে ভাবতে না পারা, বা ভাবতে পারলেও বিশ্বাস করতে না পারা সম্ভব বৈকি! কায়স্থ বাড়ির মেয়ে। বাংলাদেশের জমিজমা ফেলে তাড়া খেয়ে চাউলহাটির ওদিকে থানা গাড়ে বাপ। সেই বাপের বাড়িতে সূর্য গড়ায়, ফসল ওঠে বিঘা পাঁচেক জমি…ওপর ওপর পড়াশোনায় ভালো, মাধ্যমিক ফার্স্ট ডিভিশন…দৌড়ে ভালো, ইস্কুলের টিচার একজন একটু বেশি যত্ন নিত, তার আবদারেই বাপ মাধ্যমিক দিতে দিল…কিন্তু রেজাল্ট বেরানো অবধি বাপের তর সইল না…চল্লিশের বুড়ো বরের সঙ্গে কেউ পনেরো বছরের মেয়ের বিয়ে দেয়! দীপকের বাপের সঙ্গেও মায়ের বয়সের পার্থক্য ছিল বছর পনেরোর। সে নয় অতদিন আগে! আর মা তার শোধ ছেঁচেছে কড়ায় গণ্ডায়। ঐ ঘটনার পর বাপটা কেমন ভ্যাবলা হয়ে গেল! এদিকে দীপককে বাবা বাছা করত, সঙ্গ খুঁজত হয়তো, মায়ের নেশাটা কাটিয়ে উঠতে পারে নাই, কিন্তু দীপক মদ খায়ে বাড়ি ফিরলে ওদিকে বাপের ঝাঁট ফের খাড়া খাড়া ঝাঁটার কাঠি বাঁড়া! সেই খেজুরে লোক ক্ষইতে ক্ষইতে বাড়তি পড়ে? মিইয়ে গেসলো ঠিকই, তবে মরার বয়েস হয় নাই। লিভার সিরোসিস বাজে রোগ। অনেকেই বলেছিল। হবার কথা দীপকের, হল তার বাপের। গা-টা আবার শিরশির করে দীপকের। গলাটা খালি টানতে থাকে। মায়ের উপর শোধ নিতে সে লোক ছেলের সামনে মুখ দিয়ে লিভার হেগেমুতে মরল। না মরে নাই তো! বিলে বাঁচে তার বাপ। মুকুন্দপুরের বিল বিল্ডিং দিয়ে বুজিয়ে দিলে অনেকদিন দীপক বিল দেখে নাই। আর এই মেয়েটাকে দেখ! মাস্কের তলায় মুখে একটা আস্ত বিল নিয়ে ঘুরে! আর এর শ্বশুরবাড়ি এর গুণ চিনল না? রোজ মার রোজ লটঘট। কেইই বা চেনে? বাদিয়াকেও মুখ ঢেকে কারিমা চিনতে পারে নাই। চেনে নাই বলেই বিল থেকে যায়, তার বাপ সেইখানে মাছ ধরে, কলমি তোলে, বনমোরগ মারে। ফুলসজ্জার দিন আরতির ননাস এসে দেখে, মেয়ে দরজার প্রায় বাইরে খাটের পায়ার পাশে বসে ঠকঠক করে কাঁপছে একা। “ওমা! দেখ মেয়ের কাণ্ড! তুই এখানে বইসে কী করিস ছুঁড়ি! ভিতরে যা!” এই বলে ঘরে উঁকি দিয়ে ননাস দেখে গোটা খাট জুড়ে শুয়ে রয়েছে আরতির বর…মনে লাগে ভালোই মাল টানিছে। আর মেয়ে ভয়ে…তা আরতির দোষটা কী! ঘরজোড়া খাট আর খাটজোড়া বর দেখে ঐ টুকু মেয়ে ঘাবড়ায় গেছে। তারপর তো গালাগালি রোজ। দেওর করে বড় ঘরের চাকরি, বড় ভাসুর, মেজ কিছুই করে না, তার কথার দুর্গন্ধে আরতির বাপের বাড়ির সম্মান হড়হড় করে বমি হয়ে বেরায় আসতে চায়। বাপ মাকে কম গালি দিছে? একদিন টিকতে পারে নাই, মেয়ের বাড়ি আসছিল। দরজার পিছন থেকে আরতি হাসে। ঠিক হয়েছে। হবার ছিল। তারপরে দেওরের কোন আত্মীয় এসে, তাকে বললে, মা, তুমি তো শুনছি খুব ভালো আসন পারো…শীর্ষাসন দেখাবা? আরতি এক পায়ে খাড়া…সে দিন কী মার কী মার…বাপ তো জীবনে দেখতে পারল না…আর মদ…বরের ছিল মদের নেশা…শ্বশুরবাড়ির মানুষগুলা দশ বারো বছরের বেশি জ্বালাতে পারলো কই? সব মরল একে একে, দুটি মরে নাই এটি থাকেও না। বর ছিল, যখন জ্বালাবার আর লোক নাই, আরতি একটু শান্তিতে সংসার পাতে…ঠিক তখন বরের অত্যাচার গেল বেড়ে। রোজ মদ, কী সব গাল দিত, আরতি এখনও বোঝে না…আর তার সঙ্গে লাত্থি…
লাত্থিও মারছিল তো, ছোট মেয়েটা তখন পেটে, পাঁচমাস যায়…সকালে উঠি, সারাদিন খাটি বলো, আমার একটু শুতে ইচ্ছে করে না? রাত আটটা নটার দিকে ফিরত মদে চুর…আমি একটু শুইছি সেদিন…না, আমি কেন শোব! বলি সারাদিন কাজ করছি তো, বলে, বাঙ্গি ফাটাইছিস মাগী, ছাড় বিসনা, ছাড়…বলে এত্তোজোর লাত্থি মারছে…আমি বিসনা ছাইড়ে উল্টায় গেছি মেঝেয়…কম করেছে? আমি কাউকে বলি না তো! শেষের দিকে রোজ বড় মেয়েটাকে বলত, এই মা রেখে অন্য আনব…সে আনছে…এক বছর ধরে…
এতদূর এসে আরতির গলা একটু স্যাঁতস্যাঁতে ঠেকে। দীপক জিভ দিয়ে একটা শব্দ করে একটু অদ্ভুত হাসে। আরতির চোখের কোণে সেই হাসি প্রশ্রয় হয়ে ভেসে উঠে গলা তার তাজা করে তোলে। মেকি দাপটে আরতি বলে, শুধু হাসি! শুধু হাসি, বাবা! ঐতেই বান্ধবীরা কাৎ…ইসসস্!
কী হল?
বাঁধাকপিটা বাজে, মজেই না…এতক্ষণ ভাপালাম, তাও তাকায় আছে…
মানুষ মজলে তাকিয়ে থাকে, বাঁধাকপি তাকায় না মজলে…তুমি মাস্কটা কি খুলবে না?
আরতির হাসি চোখ ফালি করে আনলে সেই ফালি সবটুকু নিজের ঠোঁটের নিচে ঢাকা দেবার ইচ্ছায় দীপক উশখুশ করে। আঁচলটা টেনে একটু ব্লাউজটা নাড়িয়ে নেয় আরতি।
মাস্ক খুলে কী হবে? দেখানোর মতো কিছু নাই! দেখতে পাচ্ছ না? না পাইলেও দেখানোর নাই কিছুই…বুঝলা?
“বুঝলা”-র মিঠা টানের দীপক উত্তর দেয় না…
তোমার কি চেহারাটা খারাপ হয়েছে এ কদিনে? হ্যাঁ, মনে হচ্ছে যেন।
দীপকের প্রশ্নে আরতি আরো রোগা হয়ে পড়লে মুখের মাস্কটা এই খোলে ঐ খোলে করে নাকের ডগায় ঝুলতে থাকে। তিন মাস। দীপক আরতির নাক মুখ থুতনি দেখে নাই কোনো দিন। তবু, বিলে চাঁদ পড়ে…কলমি হয়…মাছ জন্মে…আরো নিচে বনমোরগের হয়রানি…বাপ সব দেখে, ছুঁয়ে বেঁচে ওঠে…
না, আগের দিন সালোয়ার পরে এসেছিলে, তাতেও দেখছিলাম ফিট হচ্ছে না, আজ শাড়িতেও অস্বস্তি করছে…
আগের থেকে রোগা হয়েছি তো! তা বেশ হয়েছে…এই শরীরের ওপর আমার জন্মের ঘেন্না…রাগ…শরীর অমন ছিল বলেই তো…আর কালো বলেই তো বাবা আগে বিয়ে দিলে…অমন করত খালি সবাই…এখন দেখ, ঊনত্রিশ কেজি…মোজা পরে শুই তো…হাত পা কেমন হিম…দেখ…
আরতির বাড়িয়ে দেওয়া হিম হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে দীপক একবার দরজার বাইরেটা চকিতে দেখে নেয়। একে সকালবেলা, তায় দীপকের ঘরে কমবয়েসি মেয়েছেলে…মহিলা…মেয়ে, মেয়ে রান্না করতে আসে…বাড়িওয়ালার বাঁড়া শকুনের দৃষ্টি…গন্ধ পেলেই দরজার সামনে এদিক থেকে ওদিক আর ওদিক থেকে এদিক…মর বুড়া…আরতির হাতের সমস্ত নরম দুই হাত দিয়ে শুষতে থাকলে দীপকের ঠোঁট আপনিই সেই রুগ্ন হাতের শিরার ওপর নেমে আসে…আরতি হাত সরায় না, কিন্তু বলে,
এই শরীরের জন্যই সব! রক্ত বেশি ছিল তো! রক্তের কত কেরামতি বাবা! সারাক্ষণ ভয় ছোঁক ছোঁক করে। জোঁকের ভয় দেখ, শরীর না থাকলেই নাই, শাশুড়ি শ্বশুর ভাসুর জা ননদ…এখন মানুষ গুলা নাই, সে দুই মেয়ে আমার কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে দিব্যি চলে গেল, খেটে মরি আমি…শরীর না থাকলে খাটনিটা তো বাঁচে…আর পারি না, একটু হাত পা গরম হয় না…রক্ত কমতে কমতে তলানিতে…তবু সুখ…রক্ত আমি কমায়েই রাখি…
বলতে বলতে মিথ্যে বলে ফেলার আশঙ্কায়, এতক্ষণে, গাল তার কিঞ্চিৎ লাল হয়ে আসে! তার বর মরেছে মদ খেয়ে সাইকেল উল্টে। মাথায় সেই যে লাগল, মানুষটা আর দাঁড়াতে পারল না। ও বাড়ির মামি অবশ্য বলেছিল, শনি পড়েছে। চার পাঁচটা মাস মেডিক্যালে যে কী করে কাটিয়েছে তা আরতিই জানে। মাঠে তাঁবু খাটিয়ে শোওয়া, বৃষ্টি হলে সেই তাঁবু যেত ভেসে…গ্যাদগেদে কাদায় শোওয়া যেত না…সেই মাস্ক উঠল মুখে আর নামে নাই…মেডিক্যাল থেকে ডিসচার্জ করার মাসখানেকের মাথায় স্ট্রোক করে বর মল…দুই মেয়ে সমেত পেটের তাগিদে রান্নার কাজ, তখন চারিদিকে করোনা আর করোনা…মাস্ক আর খোলা হয় নাই…আয়নায় নিজের ঢাকা মুখে খেলা বাহারি চোখ নজরে আসে এই আঠাশ বছর বয়সে, ছোট থেকে মুখ সে চমকায় ফিরছে বেহায়ার মতো, ঢাকা থাকলে তার বাপ তার বিয়া দিত এমন করে কি? বর আর শ্বশুরবাড়ির লোকের চোখে বিষ অল্প ঝরত না? দিনে দিনে অপয়ার বদনাম যে আর যায় না …করোনাও যায় না……সেই ফাঁকে ধীরে ধীরে মাস্কে আরতির বাপের, বরের মায় শ্বশুরবাড়ির বিড়ম্বনা খেয়ে ফেলে…এবং পয়দা করে আরো আরো মাস্ক…আরো আরো…ধীরে ধীরে তা হয়ে ওঠে মুখের চামড়া…………মাস্ক খোলার কথায় আরতির দম যেন ধক ধক করে…উফফ্…থাক! ওসব থাক………সে নাছোড় অতীত ফেলে আরতি আর একটু পিছনে ঝোঁকে…মেডিক্যালে কীভাবে দিন কাটছে…বাড়ির একটা লোক গেছে তখন? একা ঐ মানুষকে দেখভাল করেছে আরতি…ডাক্তার পর্যন্ত বলত, আপনার বাড়ি থেকে কেউ আসে না কেন! আর ঐ ভাসুর, জা তখন পাড়ায় পাড়ায় রটিয়ে বেড়িয়েছে আরতি নাকি মেডিকেলে রোজ সন্ধেবেলায় কার সঙ্গে দেখা করতে যায়…মরণ! তা যদি তখন সত্যি হত, আরতি এত ফালতু ঝামেলার থেকে বাঁচে। তারপরে শ্বশুরবাড়ির ইলেকট্রিক বিল! কয় বছর দেয় নাই কে জানে! বাড়ির বিল হয়েছিল পঁয়ষট্টি হাজার টাকা। তখন বড় কেউ নাই। সেই বিল চোদ্দবার অফিস ছুটে মাফ করায় নাই আরতি? ভাগ্যিস তখন মাস্ক ছিল! তাই নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় কত কানাকানি! সেও যদি সত্যি হত! আজ সেই বহুকাঙ্ক্ষিত সত্যির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে নিজের শরীরকে গাল দিতে তার নেহাৎ মন্দ লাগে না এবং হঠাৎ করে মিথ্যে বলে ফেলার ভয় তার শরীরকে আরো গাঢ় করে। এই গাঢ় স্তর দীপকের গলা চুঁইয়ে এলে, আরতি শোনে,
ভোর চারটেয় ওঠো! সারাদিন না খাওয়া! এভাবে কী করে চলবে বলো তো?
এই সময় পাশের বন্ধ দরজার তালা খোলে ভিতরদিক থেকে দুটি হাত। গ্রিল কাটাকাটা রোদ মুখে নিয়ে একটি রাজবংশী মেয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করে। সঙ্গে সঙ্গে হাত ছেড়ে দীপক সোজা হয়ে বসে। তার পাজামার নিচে বেশ খানিকটা জুড়ে তখন আঁঠালো অনুভূতি। আরতি ধীরে ধীরে পিছিয়ে এসে বসে রান্নাঘরের পিঁড়িতে। বেগুন কাটে। তালাখোলার শব্দের অনুরণন গলায় নিয়ে দীপক বলে,
মেয়েদুটোর কী হবে? তুমি না হয় কেটে পড়লে! মাসকলাই বাড়ির স্বর্গ তোমার একা খেতে মুখে রুচবে?
আরতি বেগুন ভিজিয়ে রাখে জলে।
ভগবান দেখবে…
ভগবান তোমাকে দেখেছে?
দীপকের গলা হঠাৎ ঝুরঝুরে হয়ে এলে এই শুষ্কতার সামনে আরতি একটু অস্বস্তি বোধ করে…
না…
তাহলে?
আরতি চুপ।
একটু পরে নুন হলুদ মাখাতে মাখাতে আরতি বলে,
আর একটা কাজের খোঁজ এসেছিল। চারজন ছেলেমানুষ। মেসবাড়ি। বারোশো টাকা দিবে। ঘরদোর নোংরা! মুসলমান তো! রান্নাঘরে হেগেমুতে রেখেছে…
কেন হেঁদুরা কি রাখে না নাকি…ব্যাচেলর এই বয়েসি ছেলে, মেয়ে …দেখ…বেশির ভাগই ল্যাদ খায়…ঘর নোংরা করে রাখে। মুসলমানটা ফ্যাক্টর নয়!
বেগুনভাজা কাঁচা তেলে ছেড়ে আঁচ বাড়ায় আরতি।
নয়? বাব্বাহ্! আমাদের বাপের বাড়িতে তো দেখ নাই…কাকার অত ভালো গরুটা…আমি ভোরে দেখি কি…গোয়ালের পিছনের পাঁচিলটা ভাঙা…কাঁচা পাচিল…অনেক সময় গরু গা ঘষা দেয় তো…ভেঙে যায়…সেদিন এমনি কুয়াশা…ঘরেও রান্না করতে হত…আমি উঠছি চারটায়…আলো ফোটে নাই…টুপটাপ কুয়াশার মধ্যেই মাঠের কাজ সেরে ফিরি…ফিরি…দেখি কি…ঐরম ভাঙা…আমি এগায় গিয়ে দেখি গরুটা নাই…আর দুইটা লোক…মুসলমান…একটু আগে একটা বাছুর কোলে নিয়ে যাচ্ছে…পিছনে পিছনে কাকার গরুটা…আমি ভাবছি কাকা যায়…যাই…যাই…আর ডাকি…ডাকি তো…কেউ সাড়া দেয় না…একসময় খেয়াল হল আরে! এ তো বর্ডারের কাছে এসে পড়েছি…ফিরে গিয়ে তখন কী হল্লা…কাকার নতুন বিয়ে হয়েছে তো…বাড়ির সবাই উঠে গেছে…কাকা ওঠে না…তারপর কাকা যখন উঠল, নদীর ধারে যাওয়া হল…ওখানে কয়েকজন চাষ করছিল…ওদের জিজ্ঞেস করল…বলে, হ্যাঁ দেখছি তো! ঐ দিক দিয়ে দুইটা লোক গরু নিয়ে গেছে…সে গরু আর পাওয়া গেল না…মুসলমান নাকি কিছু নয়! দোষ হয় শুধু আমারই অপয়া বলে!!!
তুমি বুঝলে কী করে মুসলমান? নিজেই বললে কুয়াশা ছিল।
মুসলমান আমি গন্ধে চিনি। যাক গে, না করছি। তা ছাড়া, কিছু মনে কোর না, শুধু ছেলেমানুষের ঘরে কাজ করব, কেমন দেখায় না!
কেন কিছু বলছিল নাকি?
কে?
এরপরে যেখানে কাজ কর! দুদিন পরে তো ছাড়িয়ে দেবে বললে! তাদের আবার অত কৌতুহল কেন? পাবে কোথাও তোমার মতো রান্নার লোক? একটা দিন কামাই নাই, এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কাজ! তোমায় পেয়ে বর্তে যাওয়া উচিত…
সে আর কী বলবে বলো! আমাদেরও তো সংসার চালাতে হয়, এরা বোঝে না সেইসব…উফফ্! ঘাড়ের ব্যাথাটা আবার চাগাড় দিচ্ছে…
আরতি ঘাড়ে হাত বোলালে সেই হাত নেমে যেতে থাকে দীপকের ঠোঁটের ফাঁক গলে। দীপকের গলায় আটকে থাকা একটা কিছু সরিয়ে সেটা পেট হাতড়ে বার করে আনে,
তোমার তো ঘাড়ের ডুগিটাও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে! বেড়ালের ঐ খানটায় কিছু একটা থাকে, জানো তো…আমাদের ছানাগুলোকে ওখানে ধরলেই প্যারালাইজড…নড়তে চড়তে পারে না…ওদের মা ঐখানে ধরেই এদিক ওদিক নিয়ে যায়।
ধুর, বেড়ালের লোম ওঠে খুব। ছাগলের বাচ্চা হাতে নিছ? ভেড়ার বাচ্চা! নরম তুলতুলে…কান চেটে দেয়, মুখ চেটে দেয়, নাক চেটে দেয়…
বলতে বলতে আরতি চাদরটা খুলে এবার তারের ওপর ঝুলিয়ে রাখে। ব্লাউজের পিছনে বেরিয়ে থাকা পিঠে তার কশেরুকার এক একটা হাড় চামড়া ঠেলে যেন এক্ষুনি বেরিয়ে আসবে। দীপক আরতির কান লক্ষ করতে করতে মাস্কের চামড়ার মধ্যে ঢুকে পড়ে। ফুটে থাকা অস্পষ্ট নাক ও চিবুকের শেপের মধ্যে দৃষ্টি দিয়ে খোদাই করে সে বের করে নিয়ে আসে ছাগলের লালায় ভেজা আরতির নাক মুখ। এরম হতেও পারে, নাও হতে পারে। তবে না হওয়ার সম্ভাবনা এখন মুলতুবি রাখলে ভাপিয়ে নেবার সুযোগ মেলে বেশি। তাতে করে নাক মুখ কানের বিলভর্তি ভেজাপন চাখতে চাখতে চোখের ঘরে ঢুকে পড়া যায়। বেগুনভাজা নামাতে নামাতে আরতি সরু চোখে এইদিকে বারবার তাকায়। তাওয়া চড়ায়। রুটি বেলে। ঘটর ঘটর আওয়াজ মাঝে মাঝে কেটে আরতি মেয়েদের গল্প করে! বড়টা হল বাপের মতো! একবছর হল বাপ মারা গেছে, মেয়ে খালি আউলে আউলে যায়। বোধবুদ্ধি কম, কথা শোনে না, অবাধ্য! পড়াশোনা করে না, শুধু কার্টুন দেখে! ছোটমেয়েটার বেশ বুদ্ধি…কিন্তু মা কে আর দেখল কতটুকু! সারাদিন মা বাইরে! মেয়ে মায়ের কাছে থাকতেই চায় না, হয় কার্টুন দেখে, নয় পাশের বাড়ির মামির কোলে! মাঝে মাঝে আরতির মনে হয়, কোল থেকে নামিয়ে হিড় হিড় করে মেয়েটাকে টেনে আনে ঘরের ভিতর…দরজায় তালা মেরে ঘর থেকে বেরায় যেন মামির কোলে চাপার সাত জনমের শখ যায় মিটে, কিন্তু বাচ্চা মানুষ! তা কি করা যায়! বাবাকে চিনল না, মাকে চিনল না! ওর দোষ কোথায়? তাই তো বলে আরতি, কার জন্য করছি, কী করছি কিছু ভেবে পাই না! যে চাপিয়ে গেল বোঝা, সে তো আনন্দ করছে, ফট করে মরে গেল…
আরেকটা কাজ এসেছিল, ছয়জন লোক, পাঁচ রকম পদ, বলে দেড় হাজার দিব…বলো…দেড় হাজার…আমি বাবা বলে এসেছি, আমি এক জায়গায় একজনের রান্না করি, শুধু রুটি আর দুটো সবজি, তাতেই দেড় হাজার নেই…বলে তো এসেছি, এবার তুমি আমাকে যা মনে করবে দিবা…
টাকার কথাটা উঠতেই দীপক গুটিগুটি এগিয়ে আসে ভিতরে। বারোশোর বেশি মাইনে না বাড়ানোর চাড় একটা ছিল। কথাটাকে আঁতুড়েই নুন গেলে নেওয়া যায় এই ফাঁকে। তবে সেটা বড় কথা না। আরতির মুখ জুড়ে একটা বিষণ্ণতা দানা ধরে এই টাকার কথা বলার সময়। বিলের উপর আক্ষেপ ফোঁসে। দিগন্ত স্থির…কালবৈশাখীর মেঘ তখন আরতির বুকে… এতে করে দীপকের বাপের বিল গতরের সবটা নিয়ে তলপেটের নিচটায় চাগাড় দিতে থাকে…দীপক খুব আস্তে আস্তে বিলের কাছে মুখ নিয়ে আসে…শোঁ শোঁ গরম বাতাস… আরতির গল্পের মাঝে ঢেউ ওঠে বিলে…কানের সুড়ঙ্গ গলে দীপকের অতীত যাবতীয় দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ঢুকে পড়লে ‘উঃ’ জাতীয় একটা শব্দ করে শিউরে ওঠে তার মেয়েদের গল্প…দীপক আরো ঘেঁষে দাঁড়ায়…তার বাপের বিল থেকে মৃদু মৃদু জলের ছুবছুবো আওয়াজ আসে…দীপক আরতির আঙুলের ডগে আঙ্গুল ঘষে…আরতি আবার শিউরে চুপ করে যায়…সকাল সকাল রান্নাঘরময় মাগরিবের আজান…প্রথমবার শাড়ি তুলতে বাধা দেয় আরতি…হাত ধরে বসে পড়ে…মুখ ঘষে বুকে…নাও ছেটায় কে রে হারামজাদা! মাঝির নাও জাল জমেত তখন জলে…আলতো করে তুলে আরতিকে কোলের ওপর বসায় দীপক…ঊনত্রিশ কেজি…নৌকার খোলে একা এখন তার বাপ শুয়ে আছে…বিলে কলমি তুলতে নামবে সে আরেকটু পরে…মাছের গুবগুবি…চাঁদসমেত বিল পেয়ে বাপ তার আনন্দে দৌড়ে বেড়ায়…পিঠের নিচে হাত নামায়, খামচে ধরে আরতি…প্রতিটা ঠাপে বিলে তরঙ্গ ওঠে…মাস্ক…একদিন মুখ ঢেকে কেওট পাড়ার বাদিয়া এসেছিল…কিন্তু তাতে নদী আর ছাঁদন জাল ডানা কাটে…বিল এখন বাপে হাতের মুঠোয়…আজানের সঙ্গে মিশে মাখো মাখো কীর্তনের সুর…এই দুইয়ে জোড়া দিয়ে যায় ধীরে ধীরে রান্নাঘরের দেয়াল বেয়ে চড়তে থাকা আরতির শ্বাসের শব্দ…কিন্তু বিল না দেখে দীপকের একদমই আরাম হচ্ছে কই? বাপ কি বিলে নামছে তার? না দেখে স্বস্তি নাই…এভাবে কতক্ষণ? বাপ না থাকলে দীপকের নাওয়ের নেশা কি জমতে পারে? বাঁড়ার মাতলামির মধ্যেই ঘোরে দীপক আরতির মাস্ক ধরে টান দেয়…এতক্ষণে আরতি আর্তনাদ করে ওঠে…না না…নাআআআআ…যেন এতক্ষণে তার স্তনের মোটা বোঁটাটা জোঁক হয়ে উঠতে চাইছে…খুলে নেওয়া হচ্ছে তার গুদের আবরণ…এতকিছুর মধ্যেও দীপক একটু অবাক হয়…কী হল…ব্লাউজ খোলায় মেয়েটার হেলদোল নাই…শাড়ি তুলতেও একবারের বেশি আপত্তি করে নাই…অথচ মাস্কে হাত দিলে ক্লিটসে আঙুল পড়ার ছটফটানি কেন…আচ্ছা বিপদ! ওটা যে মাস্ক না, ঢেকে রাখা বিল এখন তা মেয়েটাকে বোঝাবে কেমন করে…হল টা কী আরতির…জানার আকাঙ্ক্ষাটা এই জন্যেই দীপকের চোখে মুখে জড়িয়ে যেতে থাকে…আরতির নজর দ্বিধাভর্তি পিঁপড়ে হয়ে তার মাথার এ কোণা থেকে ও কোণা ছেয়ে ফেলে…”মাস্ক খুলবা না, মাস্ক…ওমা…নাহ্…তুমি জানো না”…দীপক নিজের মুখ খানিক দূরে নিয়ে গিয়ে আরতির প্রচণ্ড আতঙ্ক ছিঁড়তে চায়…”কী জানি না?”…”খুব খুব সাধারণ…কালো মুখ…এই চেহারা আমার বাবা পর্যন্ত সহ্য করতে পারে নাই গোওও…” …”অ্যাঁ?” “কেউ দেখতে পারে না, কেউ থাকে না…অপয়া অপয়া”…আধো আধো কয়েকটি শব্দ ভাসে… দীপক হেসে ফেলে। পাগলি! গালিতে সে খানিক ভরসাই পায় নাকি, এবার আরতির হাত নরম…দুজন আবার বেঁকে বেঁকে উঠছে……হয়তো এতদিন পরে বিশ্বাস…অতর্কিতে দীপক বিলের আবরণ সরিয়ে ফেলে এক ঝটকায়…এবং ছিটকে আসে…আরতি ততক্ষণে দুইহাতে মুখ ঢেকে বসে পড়েছে…সব শেষ…সব শেষ…
“এত সাধারণ!!!!” অস্ফুট শব্দ যেন ফুটতে সাহস পায় না… মুখ ভর্তি নোনা স্বাদে লালায় গলা প্রায় বন্ধ…তার বাপের বিল…মাছ…কলমিশাক…বনমোরগ…প্রচণ্ড নোনা ধরে ওয়াক দেয় শরীর…মাথায় ঘুরপাক খায় বিল নাই বিল নাই…চাপচাপ কাঁচা খুনের সুতা কাটে কেউ…গোঁ গোঁ শব্দ…মাঝে মাঝে চিৎকার কুঁদে কুঁদে কাশি ফোটে…লিভার বেরোচ্ছে শালা…কাঁচা মাংসের টুকরার পারা…বাপের মুখের যাবতীয় লালা কেমন কালচে…অঁক অঁক করে ঘাই দেওয়া লিভারের কাঁচা জং ধরা গন্ধে সমস্ত কালচে হয়ে আসে…ভয়…পাক দিতে থাকে এতক্ষণ শুষে নেওয়া সবটুকু অস্তিত্বে, পাকস্থলীর গভীরে…ঠাঁটানো বাঁড়া কুঁকড়ে তেঁতুল…বিল ভর্তি চাঁদ ও মুখ ভর্তি নুন নিয়ে দীপক ল্যাংটো হয়ে ছিটকে নেমে আসে রাস্তায় ও দৌড়তে থাকে…সিসিলির চিৎকার তখন আর্ত…তার বিল ও চাঁদ কলমিহীন ফ্যাকাশে…চামড়ার রঙ কাপড় চোপড়ে তুলে লাল লাল খাবি খাওয়া বাপ আবার মরে যাচ্ছে…বিল নাই…বিল নাই…সাধারণ আছে…গভীর কালোর পিছন থেকে তার মায়ের ঘুমপাড়ানি গান ভাসে…বিল নাই…চাঁদ নাই…আছে অনন্ত সাধারণ ঘা…এবং হিরুডিন…
Posted in: June 2021 - Cover Story, STORY