মহাকাশ, মহাবিশ্ব : শংকর লাহিড়ী
[বিস্ময় আর খোঁজ মানুষের এই দুটো গুণই ক্রমবিকাশ ঘটিয়েছে মানব সভ্যতার। নিজের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ও তারই মাঝে নিজের আপাত অবস্থানকে চিনে নিতে চেয়েছে সে চিরকাল। ধীরে ধীরে আমরা জানতে পেরেছি আমাদের পৃথিবীকে, তারপর পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশ, মহাবিশ্ব। কত অজানা খবর, কত আবিষ্কার ঘটে চলেছে দিনের পর দিন। সেই সমস্ত কথা নিয়েই এবার কলম ধরলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, চিত্র-পরিচালক ও প্রকৌশলী শংকর লাহিড়ী। কসমোলজি নিয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ ও জ্ঞানের কথা অনেকেই জানেন। যে দক্ষ শৈল্পিক ভঙ্গিতে তিনি এই সমস্ত জটিল তত্ত্ব ও আবিষ্কারের কথা লেখেন তার সাথে ইতিমধ্যেই অনেক পাঠক পরিচিত। শুরু হলো অপরজনের নতুন ধারাবাহিক বিভাগ – “মহাকাশ মহাবিশ্ব”।]
১০
গভীর রাতের স্টার পার্টি:
আমরা যারা শহরবাসী, অফিসফেরত আলোঝলমলে সন্ধ্যায়, অথবা কলেজফেরত বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মশগুল হতে ভালোবাসি, কখনো উইকএন্ডে গাড়ি নিয়ে ঝকমকে শপিং মলের আলোকিত উজ্জ্বল রোশনাইয়ে বিভোর হই। কখনো মেঘ ডাকলে, অথবা গায়ে বৃষ্টিফোঁটা পড়লে, শুধু তখনই, একমাত্র শুধু তখনই আমরা মাথা তুলে এক-আধবার তাকিয়ে দেখি আকাশকে। আর যদি কখনো চাঁদনি রাতে বারান্দা বাগান মাঠঘাট ভেসে যায় জ্যোৎস্নায়, পাড়ার ছোট্ট দিঘিটা ঝলমলিয়ে ওঠে, মনের গভীরে তখন যেন কাঁপন লাগে, গান আসে প্রাণে। মহানগরীর সন্ধ্যায় লোডশেডিং অথবা, মফস্বলের প্রান্তে ঘুটুঘুটে অমাবস্যার রাত তাই আমাদের একেবারেই অপছন্দ। করোনার এই যাচ্ছেতাই বছরগুলোর আগে, যখনই পরিচিত মানুষজনদের দেখেছি বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান শুরু করেছেন, সে সমুদ্রসৈকত হোক, অথবা অরণ্য-পর্বত-মরুভূমি, ঠিক খেয়াল রেখেছেন যেন একটা পূর্ণিমা সেই সফরের মধ্যমণি হয়ে ঝলমল করে। সচরাচর এঁদের কাউকে আমি অমাবস্যাকে কেন্দ্র করে ভ্রমণের দিনক্ষণ বেছে নিতে দেখিনি।
অথচ ঠিক এর উল্টোটা দেখেছি আমার মহাকাশ-পাগল বন্ধুদের মধ্যে। এঁরা নানা অ্যাস্ট্রোনমিকাল সোসাইটির তরুণ সদস্য, বিশেষতঃ ব্যাঙ্গালোর। অধিকাংশই বিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কলাবিভাগেরও আছেন। সবাই মনে মনে প্রায় সর্বক্ষণ নক্ষত্রলোক নিয়ে মগ্ন থাকেন। সখের জ্যোতির্বিদ, অ্যামেচার অ্যাস্ট্রোনোমিস্ট, কেউ কেউ সিরিয়াস কসমোলজিস্ট। একটা মালদহ, হুগলি, লন্ডন, প্যারিস, কলকাতা, আমাজন রেন-ফরেস্ট, বা গোটা আফ্রিকা নয়, এঁদের চিন্তা ভাবনা স্বপ্ন মনোযোগ সবই ছুটে বেড়ায় ব্রহ্মান্ডের সবটুকু জুড়ে। এঁদের কালো টি-শার্টে ছবি থাকতে পারে হাওয়াই দ্বীপের কোনও মানমন্দির, টেলিস্কোপ, অথবা কোনও নীহারিকা, বা নক্ষত্রপুঞ্জের। কিন্তু স্ট্যাচু অফ লিবার্টি বা, ফিদেল কাস্ত্রো কখনো নয়। এঁদের অনেকেই ধূমকেতু শিকারি বা ‘কমেট হান্টার’। এঁদের স্বপ্ন হোল নতুন একটা কমেট অথবা একটা নতুন কোনও গ্রহাণুকে নিজেরা আবিস্কার করে বিশ্বকে জানানো।
পৃথিবীর মাটি থেকে গভীর মহাকাশকে খালিচোখে বা টেলিস্কোপে দেখার জন্যে প্রয়োজন হয় সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত বাতাবরণ। ধোঁয়ায় ভাসমান অজস্র ধূলিকণা অথবা, রাসায়নিক গ্যাস, জলীয় বাস্প, কুয়াশা– সবই তো স্বচ্ছতার অন্তরায়। তাছাড়াও আছে শহরের আলোকসজ্জা, বিপুল আলোকদূষণ। আমরা যারা রাতের আকাশে নক্ষত্রজগতে চোখ রাখি, তাদের জন্য চাই নিখুঁত নির্মেঘ অন্ধকার আকাশ, যা সত্যিই স্বচ্ছ। রাতের এমন আকাশে চোখ রাখলে, খালি চোখেই দেখা যাবে কত নক্ষত্র নীহারিকা ধূমকেতু ছায়াপথ, বিজ্ঞানীরা যাদের চিহ্নিত করেছেন, দিয়েছেন নাম ও নম্বর। অ্যাস্ট্রো সোসাইটির তরুণ ছেলেমেয়েরা তাই অন্ধকারের উপাসক। আর যারা পূর্ণিমা নিয়ে গান গায়, শুধু শুধু কাব্য করে, তাদের নিয়ে এইসব অ্যামেচার জ্যোতির্বিদদের কোনও মাথাব্যথা নেই। তারা তাই পরস্পরকে চিঠি অথবা চ্যাটের শেষে বিদায় জানানোর সময়ে লেখে– লেট দেয়ার বি ডার্কনেস। আরও ঘন অন্ধকার নেমে আসুক রাতের পৃথিবীতে। আমরা চাই মাথার ওপরের সুনীল ঢাকনা সরিয়ে, কাচের মতো স্বচ্ছ, কালো আকাশ।
জীবনানন্দ তাঁর ‘হাওয়ার রাত’ কবিতায় লিখেছিলেন—‘জ্যোৎস্নারাতে বেবিলনের রানীর ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার শালের মতো জ্বলজ্বল করছিলো বিশাল আকাশ’। -অধ্যাপকরা একে দারুণ ইমেজারি বলেন। কিন্তু এইখানে এসে থমকে গেছি আমি। কবি জ্যোৎস্নারাতের উল্লেখ করেছেন দেখে সন্দেহ হয়েছে, উনিও বুঝি গৃহকোণে বসে এক কল্পিত আকাশের ছবি এঁকেছেন। অথবা হয়তো পৃথক দুটো দৃশ্য। কোনও এক জ্যোৎস্নারাতে ঐ উজ্জ্বল শাল গায়ে রানীকে কল্পনায় দেখেছিলেন তিনি। এবং কোনও এক ঘন অন্ধকার নিশিরাতের নক্ষত্রখচিত আকাশকে দেখে কবির মনে পড়েছিল সেই উজ্জ্বল শালের কথা। সে যাই হোক, জ্যোৎস্নারাতকে শত্রু মনে করেন মহাকাশ-প্রেমিকরা। চাঁদের আলোয় আকাশ যখন ভেসে যায় তখন তো চর্মচক্ষে হাজার হাজার নক্ষত্র নীহারিকা সকলই প্রায় অদৃশ্য !
*
নক্ষত্রজগতের প্রতি কেন এই দুর্নিবার আকর্ষণ? জিগ্যেস করলে ওঁরা বলেন—‘বিকজ ইটস দেয়ার’। ‘বিকজ ইটস রিয়েল’। ‘বিকজ উই বিলং টু ইট’। গভীর মহাকাশের কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের সমস্ত নক্ষত্রমন্ডল– গ্রহ উপগ্রহ, গ্যালাক্সি, পালসার, কোয়াজার, কৃষ্ণগহ্বর—সবই তাঁদের চিরন্তন বিস্ময়, আগ্রহ ও অনুসন্ধানের বিষয়। মানুষের লোভ, হিংসা, নির্বুদ্ধিতা আর অহংকার পৃথিবীকে আজ ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। হয়তো সত্যিই আর পরিত্রাণ নেই। শেষের সেইদিনটি কি তবে শুধু সময়ের অপেক্ষা? ওঁরা কবি নন, তরুণ অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞানী। ওঁরা হয়তো ভাবছেন। চাইছেন ওঁদের ভাবনাকে সাধারণের মধ্যে চারিয়ে দিতে।
ওঁদের কাছে এইটাই যেন এক অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম। জাম্বেজি নদীতে র্যাফটিং, অথবা হিমালয়ান, কিংবা অ্যালপাইন ট্রেকের চেয়েও রোমাঞ্চকর। এঁরা দল বেঁধে দিনক্ষণ ঠিক ক’রে, আবহাওয়ার খবর জেনে নিয়ে, বেরিয়ে পড়েন। গাড়িতে খাবার-দাবার, টেন্ট, টেলিস্কোপ, ক্যামেরা, ল্যাপটপ ও প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিয়ে, শহর থেকে তিন-চার ঘন্টার ড্রাইভে, কোনও প্রান্তিক গ্রামের কাছে উন্মুক্ত ময়দানে বা টিলার ওপরে, কোনও ডাকবাংলো বা ছোট ইস্কুলের নিরালা চৌহদ্দিতে।
[ছবিঃ মোটরহোম বা, ক্যাম্পার ভ্যান]
আমার মনে পড়ে যায়, আশির দশকে জামশেদপুরের দিনগুলোয় আমাদের পরিকল্পিত মোটরহোমের কথা। দুয়ারসিনির কাছে ভালোপাহাড়ে, আমলি নদীর ধারে জঙ্গলের মাঝে একটা ক্লিয়ারিং-য়ে, আমি তো চেয়েছিলাম একটা উঁচু কাঠের ডেকের ওপরে কৌরবের আট ইঞ্চির টেলিস্কোপটা বসাতে। আবহে, হাওয়া-বাতাসের শব্দ, পাতা ঝরার শব্দ, আমলি নদীর কুলকুল জলশব্দ, আর হর্নবিল কিংবা কপারস্মিথ পাখির ইতস্তত ডাক। মাথার ওপরে গাঢ় নীল অন্ধকারে, নক্ষত্রখচিত রাত-আকাশে কালপুরুষ, সপ্তর্ষি, ছায়াপথ, ক্যাসিওপিয়া, অ্যান্ড্রোমিডা। একবার সশব্দে তারা খসে পড়তে দেখেছি আমি। ওই ভালোপাহাড়ের রাতে।
[ছবিঃ কর্নাটকের এক গ্রামের মাঠে, ব্যাঙ্গালোর অ্যাস্ট্রোনমিকাল সোসাইটির স্টার পার্টির প্রস্তুতি]
স্টার পার্টিতে যারা খালি চোখে পর্যবেক্ষণ করেন, যেটুকু করা যায়, তাঁদের প্রায় সমস্ত কাজ আলো নিভিয়ে করতে হয়। শুধু নোটস নেওয়ার জন্যে লাল আলোর টর্চ ব্যবহার করা যায় অল্প সময়। আলো থেকে চোখ সরিয়ে আকাশের দিকে তাকানোর আগে অন্তত দশ মিনিট চোখ বন্ধ করে থাকতে হয়, যাতে চোখের মণি কিছুটা বড় (ডাইলেটেড) হয়ে খুলে যায়, লো-লাইটে ক্যামেরার যেমন অ্যাপার্চার সেটিং। যৌবনে জামশেদপুরে হেমন্তের রাতে, উন্মুক্ত ছাদে টেলিস্কোপ পেতে, আমি বিশেষ কোনও নক্ষত্রকে খুঁজে পেতে ঘর্মাক্ত হয়ে গেছি। গরম কালেও আকাশ পরিষ্কার থাকে, বিশেষতঃ যদি এক পশলা বৃষ্টির পরে মেঘমুক্ত হয়।
[ছবিঃ স্টার পার্টিতে বিশ্রাম নেওয়া ও যন্ত্রপাতি রাখার জন্যে টেন্ট]
কর্নাটকে অ্যাস্ট্রো সোসাইটির বন্ধুদের দেখেছি খোলা মাঠে সারি সারি টেন্ট পেতেছেন। এছাড়াও কিছু গরম জামাকাপড়। ঘন অন্ধকার মাঠে এক সারি টেন্ট, একধারে কার পার্কিং, আর ইতস্ততঃ ট্রাইপডের ওপরে ছোট বড় নানা আকারের টেলিস্কোপ, ক্যামেরা, অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফি। বিকেলের মধ্যেই পৌঁছে যান সব সদস্য, শুরু হয়ে যায় প্রস্তুতি। তৈরি থাকে সেদিনের যা কিছু বিশদে পর্যবেক্ষণ করা হবে, তার তালিকা, মেসিয়ার নাম্বার, এনজিসি নাম্বার। তারপর রাত নেমে আসার প্রতীক্ষা ও যাবতীয় শিহরণ। সঙ্গে আছে ফয়েলে মোড়া স্যান্ডুইচ, পাকোড়া, ফ্লাস্কে গরম কফি। দুশো কিলোমিটার ছুটে এসে এসইউভি গাড়িগুলো তখন জিরোচ্ছে। রাতের শিশির জমছে তাদের বনেটে। [নীচে ছবিতে, ব্যাঙ্গালোর অ্যাস্ট্রোনোমিকাল সোসাইটির ভার্চুয়াল স্টার পার্টির ছবি।]
*
অনন্ত মহাবিশ্বের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ মানুষ জেগে বসেছিল কতকাল। তারপর কত গান গাওয়া হল, লেখা হল কত কল্পকাহিনী, ছবি ও কবিতা। এখন সে আর রূপকথায়, কল্পবিজ্ঞানে সন্তুষ্ট নয়। এখন তার সহায় হয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। মহাকাশ গবেষণার হাত ধরেই আবিস্কৃত হয়ে চলেছে কত উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, কত নতুন নতুন পদার্থ, যা সুরক্ষা দিচ্ছে মানুষকে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আজ এগিয়ে চলেছে, অনেকটাই মহাকাশ গবেষণার হাত ধরে।
কত শক্তিশালী টেলিস্কোপ এখন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর হাতে। তারা কেউ দেখছে দূরাগত ক্ষীণ আলোক রশ্মি ও তার রঙকে, কেউ মেপে দেখছে ইনফ্রারেড রশ্মি, রঞ্জন রশ্মি, বা রেডিও তরঙ্গকে, যা ছুটে আসছে মহাকাশের গভীরের গ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকা, সুপারনোভা, পালসার, আর কৃষ্ণগহ্বর থেকে, কোটি কোটি আলোকবর্ষ পেরিয়ে, এই পৃথিবীতে। প্রশ্ন অনেক—এই মহাবিশ্বে আমাদের মতো আর কি কোথাও কেউ আছে? ওই কোটি কোটি নিহারিকা-নক্ষত্রমন্ডলের মধ্যে আমরাই কি একমাত্র ঠিকানা, যেখানে জল পড়ে, পাতা নড়ে, পাখি ডাকে, আর বায়ু বয় বনময়? যেখানে আছে প্রেম, ভালোবাসা, স্বপ্ন, সঙ্গীত, শিল্প, আশ্রয় ও শুশ্রূষা?
মানুষ তাই সন্ধানে আছে, মহাকাশে, সৌরমন্ডলের বাইরে, কোথাও আমাদের মতো আর কোনও পৃথিবী আছে কিনা, যাদের বিজ্ঞানীরা বলেন ‘এক্সোপ্ল্যানেট’। খুঁজে পাওয়াও গিয়েছে অনেক, প্রায় চার হাজার। কিন্তু তারা কেউই পৃথিবীর মতো সুন্দর নয়, বাসযোগ্য নয়। তাদের সূর্য হয়তো নিভন্ত, ক্ষুদ্রকায়, রেড ডোয়ার্ফ। তাদের কোনও আলো নেই, শুধু ক্ষতিকর বিকিরণ। ফলে গ্রহগুলোতে রোদের আলো আসে না, তারা হিমশীতল। অথবা তারা গ্যাসে পরিপূর্ণ, বা মহাজাগতিক বিকিরণে জর্জরিত ; আমাদের মতো জল-মাটি-উদ্ভিদের সম্ভাবনা সেখানে নেই।
তবে এইবার বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করেছেন একটি গ্রহকে এবং উল্লসিত হয়েছেন আশায়, কারণ আমাদের পৃথিবীর সাথে তার অনেক মিল, যেন প্রতিচ্ছবি। তবে আমাদের পৃথিবীর চেয়ে আয়তনে প্রায় দ্বিগুণ। এখান থেকে ৩১৪০ আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে সে, আমাদের ছায়াপথেই। সেই গ্রহের নাম- KOI 456.04, আর তার সূর্যটির নাম Keplar-160, আয়তনে যে আমাদের সূর্যের চেয়ে সামান্য (১০%) বড়, সূর্যের মতোই আলো ছড়ায়। আমরা যেমন রোদ্দুর পাই, তার প্রায় ৯৩% পায় ওই গ্রহটি। তাই সেখানে তাপমাত্রা সহনীয়, আমাদের গড় তাপমাত্রার চেয়ে ৫-১০ ডিগ্রি কম। জল, বায়ুমন্ডল আর প্রাণের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। সেখানেও দিনরাত্রি হয়, এবং একবছর হয় ৩৭৮ দিনে। যেন হুবহু আমাদের প্রতিচ্ছবি। পৃথিবী যেমন আছে সূর্যের নাতিশীতোষ্ণ ও বাসযোগ্য অঞ্চলে (হ্যাবিটেবল জোনে), তেমনই কেপলার-১৬০ নামক নক্ষত্রের হ্যাবিটেবল অঞ্চলে আছে পৃথিবীসদৃশ এই (KOI-456.04) এক্সোপ্ল্যানেট বা গ্রহটি (নীচে ছবি)। অর্থাৎ সেখানে নিশ্চয় পাওয়া যাবে তরল জল, হয়তো পাওয়া যাবে জলজ প্রাণীও। কিন্তু সে যে রয়েছে ৩১৪০ আলোকবর্ষ দূরে, মানুষের সাধ্যের এখনও অনেক অনেক বাইরে। সেখান থেকে আমাদের পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছতেই তো লেগে যায় ৩১৪০ বছর।
জার্মানি দেশের গোটিনজেন শহরের ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটের একদল আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী সম্প্রতি জানিয়েছেন তাঁদের এই আবিস্কারের কথা, যা প্রকাশিত হয়েছে বিখ্যাত ‘অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স’ পত্রিকায়। তবে এই নিয়ে এখনও ১০০% নয়, ৮৫% নিশ্চয়তায় রয়েছেন তাঁরা। আরও কিছু পর্যবেক্ষণ দরকার। যখন ৯৯% নিশ্চয় হওয়া যাবে, তখন ওই এক্সোপ্ল্যানেট নিয়ে জানতে পারা যাবে আরও অনেক কিছু। তবে আজ আমাদের হাতে যে প্রযুক্তি, তাতে ৩১৪০ আলোকবর্ষ পথ পাড়ি দিয়ে কখনও কি যাওয়া সম্ভব হবে সেই পড়শির বাড়ি? নাকি দূর থেকেই জানতে হবে তাকে? অতএব সুরক্ষিত রাখতেই হবে আমাদের এই সবেধন পৃথিবীর প্রকৃতি ও জীবজগতের সকল সৌন্দর্য।
*
গভীর মহাকাশ ও অনন্ত নক্ষত্রবীথি। করোনার ভয় থেকে মনকে মুক্ত রাখার পথ খুঁজে চলি। এখানে, শেরউড এস্টেটে, আমার দোতলার ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে এখন সব শুনশান। মেঘলা আকাশ, ঝোড়ো বাতাস বইছে। সেই হাওয়ায় সামনের ওই ভরপুর দীর্ঘাঙ্গী চাঁপাগাছটা, প্রস্ফুটিত থোকা থোকা গোলাপী ফুলে ভরা, কেঁপে কেঁপে উঠছে। গত বছর এমনই দিনে আম্ফানের সময় কত যে ফুল ঝরে পড়েছিল ওই গাছের নীচে। দিনের এই সময়, তিন থেকে তেরো বছরের বাচ্চাগুলো ঘাসের ওপর ছূটোছুটি করত, ছোট ছোট সাইকেল নিয়ে দাপিয়ে বেড়াত রাস্তায় ; আজ আর দেখা যায় না তাদের।
আমার ওপরে পাঁচতলার একটা ফ্ল্যাটে কিছুদিন আগে করোনা হয়েছিল। সাইরেন, অ্যাম্বুলেন্স, পিপিই পরা মানুষের যাতায়াত। তারপর একদিন হল চার তলার ফ্ল্যাটে। সিকিউরিটি ফোন করে জানালো। আরও কিছুদিন কাটলো ভয়ে ভয়ে। তার পরেরবার হল তিন তলায়, আমার ঠিক ওপরে। আমি চিন্তায় পড়লাম। সিঁড়ি, লিফট, সব আবার স্যানিটাইজ করা হল। ক্রমে একদিন সেও সেরে উঠলো। আমি ভাবছি দোতলা হয়তো এযাত্রা বাদ পড়ে যাবে, ঢের হয়েছে। আমাদের এখনও তো ভ্যাক্সিনের দ্বিতীয় ডোজ হয়নি। ভাবতে ভাবতে আজ বিকেলে সিকিউরিটির ফোন। বললো, দোতলায় আপনার দরজার ঠিক পাশের ফাঁকা ফ্ল্যাটে কদিন হল একটি শিশুকে নিয়ে দুজন এসে থাকছিলেন, তাদের মধ্যে মহিলাটির করোনা হয়েছে।
অনেকে এসময়ে হয়তো ভয় পেয়ে ঘরের আলো নিভিয়ে ফেলে, কিংবা কী করবে ভেবে না পেয়ে অসময়ে স্নান করতে বাথরুমে ঢোকে। -আমি ভাবলাম, এই মুহূর্তে আমার ঘরের আয়তনটা অনেক বাড়িয়ে নেওয়া দরকার। আমি টিভি খুললাম।
টিভির স্ক্রিনে তখন গাযা, জেরুজালেম। রাতের আকাশ চিরে ছুটন্ত মিশাইলস। অথবা, আরব সাগরে জড়ো হয়েছে অস্ত্রবোঝাই এক ঝাঁক জেহাদি নৌকো ; তাদের ঘিরে ফেলেছে ইউ এস মেরিন। আর বিহার, উত্তরপ্রদেশ থেকে শব ভেসে আসছে গঙ্গায়। -আমার ভেতরে তখন কিছু একটা কাঁপছে। মনে হল, গভীর মহাকাশ থেকে কয়েক কোটি নিউট্রিনো বুঝি সহসা ছুটে এসে আমার শরীরের মধ্য দিয়ে পার হয়ে গেল তীব্র বেগে।
বালুতে প্রোথিত ঝাউ, বালুতে প্রোথিত শবদেহ। .. নদীবালুচরে শবদেহের ওপর দিয়ে হুহু হাওয়া বইলে, আমার কেন জানি মনে পড়ে যায় মাধব মালঞ্চি কইন্যার কথা। মৈমনসিংহ গীতিকা।
আমি চ্যানেল পাল্টালাম। আফ্রিকার বিস্তীর্ণ সাভানা অঞ্চল। জঙ্গলের মধ্যে একটা ছোট্ট স্রোতা সারি দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে একপাল বুনো কুকুর। তাদের গায়ে চাকা চাকা দাগ। ঘাসফুল হাওয়ায় দুলছে। আমার কাপে গরম চা, ধূমায়িত। –এ সময়ে ভারী বই পড়তে ভালো লাগে না, টিভি সিরিয়ালও না। কল্পবিজ্ঞান নয়, ক্রাইম থ্রিলার নয়, কোনও ফিকশান নয়। কিছুটা তবু দেখা যায় বিদেশের নিউজ চ্যানেলগুলো। কার হাতে আজ এই ভুবনের ভার, জানতে ইচ্ছে করে।
ক্রমে রাত গভীর হলে আমি বিছানায় শুয়ে আলো নিভিয়ে লিখতে বসলাম, মোবাইলের কী-প্যাডে। মনে হল, মাথার ওপরে যেন ছাদ নেই আমার। আছে উন্মুক্ত গভীর মহাকাশ ও অনন্ত নক্ষত্রবীথি। আজি যত তারা তব আকাশে! আমি প্রশ্ন করলাম– আজি কত তারা তব আকাশে?
মনে পড়ল, এখন আমার কোনও টেলিস্কোপ নেই। আমি নাসার ওয়েবসাইট হাতড়ে খুঁজতে লাগলাম সেই অনন্ত নক্ষত্রবীথিকে। হাবল টেলিস্কোপ, চন্দ্র এক্সরে টেলিস্কোপ, স্পিটজার ইনফ্রারেড টেলিস্কোপ।
বছর দশেক আগে নাসার ওই স্পিটজার টেলিস্কোপই ছবি তুলে দেখিয়েছিল অনন্ত নক্ষত্রবীথির খুব ছোট্ট এক অংশকে। প্রায় পঞ্চাশ ঘন্টা ধরে নানাভাবে সে ইনফ্রারেড আলোয় তুলেছিল ছবিটা, আকাশের এক ডিগ্রিরও পাঁচভাগের একভাগ অংশের ছবি। খন্ড খন্ড করে, একসাথে জুড়ে।
কতটা হয় আকাশের সেই এক ডিগ্রির মাপ? এর জন্য একটা সহজ উপায় মেনে চলেন স্কাই ওয়াচাররা। অন্ধকার রাত-আকাশের দিকে নিজের একহাত বাড়িয়ে দিয়ে দূরে নজর করলে কড়ে আঙুলের ডগায় আকাশের যেটুকু আড়াল হয়, সেইটাই মোটামুটি ১-ডিগ্রি। এভাবে দেখলে, মাঝের তিন আঙুলের মাপ হবে ৫-ডিগ্রি, আর হাতের মুঠোর পেছনের আকাশের মাপ হবে ১০-ডিগ্রি ; নীচে ছবিতে যেমন দেখানো হয়েছে। তো, ০.১৬ ডিগ্রি আকাশের ছবি তুলে দেখিয়েছে স্পিটজার টেলিস্কোপ।
একটা ভারী নাম আছে সেই পর্যবেক্ষণ প্রকল্পের : S-CANDELS. অর্থাৎ, Spitzer- Cosmic Assembly Near-Infrared Deep Extragalactic Legacy Survey.
ওই ছোট্ট অঞ্চলের ছবিটা লক্ষ করলে দেখা যাবে, অজস্র ফুটকির মতো নক্ষত্র। সংখ্যায় তারা এক লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজারেরও কিছু বেশি। কিন্তু না, ওগুলো মোটেই নক্ষত্র নয়। ওরা প্রত্যেকে এক একটি নক্ষত্রপুঞ্জ বা গ্যালাক্সি, যার প্রত্যেকটির মধ্যে আছে প্রায় বিশ-তিরিশ হাজার কোটি নক্ষত্র, যারা আমাদের সূর্যের মতোই অথবা আরও অনেক বড়, যাদের ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে অনেক গ্রহ উপগ্রহ।
ওই স্পিটজার-ছবিটার দিকে আমি তাকিয়ে থাকি। এ তো কল্পবিজ্ঞান নয়, বাস্তবিক। আমার মাথার ওপরেই রয়েছে, একটা কড়ে আঙুলের ডগায় যতটুকু আকাশ, সেখানেই। এখনই তো রয়েছে তারা। ওই অ সী ম, অ ন ন্ত নক্ষত্রবীথি, আমারই সপক্ষে। করোনা তবে আর কাবু করতে পারবে না আমায়।
*
গতকাল রাতে শুতে যাবার আগে রূপসা আমায় ফোন করেছিল। রূপসা আমার নাতনি। সবে তার আট বছর পূর্ণ হয়েছে। এবার ক্লাস থ্রি। কালরাতে আমাকে সে জানালো : এই যে জল বাতাস আকাশ ঘর বাড়ি এমনকি আমরাও, এসবের থেকেও গড আরও বড়। সে বোঝালো, তার থেকে যেমন তার মাম্মা বড়, মাম্মার চেয়ে বড় প্ল্যানেট, প্ল্যানেটের চেয়ে বড় ইউনিভার্স, ইউনিভার্সের চেয়ে বড় গ্যালাক্সি, এবং গ্যালাক্সির চেয়েও বড় নাকি গড। আমি বললাম, গডের থেকে বড় কে? রূপসা বললো—গডের থেকে বড় কেউ না, কিন্তু (চেঁচিয়ে) আমার কাছে সবচেয়ে বড় আর ফেভারিট হচ্ছে জাঙ্ক ফুড, সুইটস, আইসক্রিম, টিভি আর মোবাইল। এবার একটু দম নিয়ে বললো, জুপিটারের নাকি প্রায় নাইনটিটা মুন আছে, আর স্যাটার্নের একটা মুনের নাম মিমাস আর ডাইওনি। বললো, সায়েন্টিস্টরা হয়তো ঠিক জানে না, কিন্তু সে নাকি খবর পেয়েছে যে অ্যালিয়েনরা আছেই। তারা থাকে প্লুটোতে। তারা নাকি ম্যাজিকাল পাওয়ার দিয়ে একটা কিছুকে ট্রান্সফর্ম করে দিতে পারে, সে দেখেছে নিউজে। আমি বললাম, প্লুটো তো একটা ডোয়ার্ফ প্ল্যানেটে। রূপসা বললো—ডোয়ার্ফ প্ল্যানেট, হোয়ার্ফ প্ল্যানেট, উলফ প্ল্যানেট যাই হোক, প্ল্যানেটে তো ওরা থাকবেই। ওরা একটা পুরো ফ্যামিলি, তার থেকে মাঝে মাঝে একজন পৃথিবীতে আসে, একটু টেস্ট করতে। আর ওদের সবচেয়ে ফেভারিট খাবার নাকি টমেটোর চাটনি। আমি বললাম—কী কান্ড, এতকিছু জেনে গেছিস তুই !! আরেকটু বড় হ, তোকে আমি স্টার পার্টিতে নিয়ে যাব।
[ক্রমশঃ]
Posted in: June 2021 - Serial, PROSE