কয়েকটি ঘ্রাণ ও অবাস্তব প্রসঙ্গ : সঞ্জীব নিয়োগী
।।ভূমিকা।।
প্রবন্ধ লেখার মতো লেখাপড়া আমার নেই বলেই জানি; সেকারণে নানান বিষয়ের মধ্যে মশগুল হয়ে থাকলেও, তা অন্যকে জানানোর সাহস জোটাতে পারিনি কোনওদিন।
তবে প্রবন্ধ না লিখেও বাকি কিছু উপায় ব্যবহার করা যায় অপরের সাথে কমিউনিকেট করার জন্য, একথাও যে ভাবিনি তা নয়।…গল্প-কবিতায় আলাদা রকমের এলেম লাগে, যা নিয়ে জন্মাতে হয়; আমি ওসব নিয়ে নামিনি।
তাহলে সেই কাজ কীভাবে আরম্ভ করা যায়? আমার স্কুল জীবনের এক শিক্ষক বলতেন, যদি তোমার কোনও শব্দের বানান নিয়ে সন্দেহ থাকে, তাহলে বিকল্প শব্দ বসাও।
এখান থেকেই সমস্যাটা জন্ম নেয়।
সব ওলটপালট হয়ে যেতে থাকে।
যা বলতে চেয়েছি, বরাবর তার থেকে ভিন্ন দিকে চলে যাই। আমার এরকমভাবে প্রসঙ্গান্তরে চলে যাওয়ার জন্য আসলে শব্দের বানান বিষয়ে সমস্যাই দায়ী।
অর্থ বিষয়ক এরকম একটা অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি কোনও দিন তাই প্রবন্ধ ফাঁদার কথা ভাবতে পারলাম না। …এক্ষেত্রে কি যারা প্রবন্ধ লিখতে পারে তাদের থেকে আমার জীবনটা অন্যরকম হলো? হয়ে গেল? বা, হতে পারল না?
ভাত রান্না হচ্ছে, সেদ্ধ হয়ে আসা চাল এখনও ফুটছে আর কিছুক্ষণের জন্য, গন্ধ আসছে বাতাসে ভেসে সঠিক বানান বিধি মেনে। …এ কোনও কবিতা নয়, যা ফেনিয়ে, উথলে উঠেছে; এটা খুব বস্তুনিষ্ঠ এক অনুভূতি; সমস্ত যতিচিহ্ন দিয়ে ভাগ করা এক সত্য।
তারপর ‘জল’ লেখা সহজ হলো। পানি না পানী নাকি পাণি ভাবতে হয়নি অথবা বারি না বারী নাকি বাড়ি! …আমি এই পৃথিবীতে বাইরে থেকে এসেছি বলে যে সমস্যা শুধু আমার তা নয়, দেখছি এই গ্রহের অনেকেরই এরকম সমস্যা বেশ ভালোরকমই আছে। হয় তারা সেটা বুঝতে পারে না অথবা লুকিয়ে রাখে।
লিখে রাখা নিয়ে যত সমস্যা, এসব কিন্তু তেড়েফুঁড়ে কথা বলার সময় হয় না। উচ্চারণে জড়তা বা সন্দেহ দানা বাঁধলে শব্দের পাশ কাটিয়ে যাওয়া খুব অল্প কিছু ক্ষেত্রেই ঘটে।
…যা আসা মাত্র লিখে না রাখলে হারিয়ে যায়, তাকেই কবিতা বলে।
সারাদিন কতবার একটা কলার টিউন শুনি; যার ফোন সে তোলে না। অন্য কেউও তোলে না। শুধুমাত্র কলার টিউন শোনানোর জন্য একটা আস্ত ফোন পোষা যায় নাকি তাই ভাবি। …হঠাৎ তিরতির করে ঘাম হতে থাকে কপালময়, তবে কি ফোনটা কবরের তলায় মালিকের সাথে দাফন হয়ে গেছে এবং এখনো ব্যাটারির চার্জ শেষ হয় নাই!
।।বিষয় প্রবেশ: ০১।।
সেবার হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলাম। পরিমাপের গর্ত থেকে বিপন্ন চোখ ঠিকরে বেরোনোর নাটকীয় মুহুর্তে গলায় ফিসফিস শব্দ তুলে ঘটনাটা অতুলনীয় ঘৃণ্য আর জঘন্য অপরাধ প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট ও যথোচিত আবেগ গলায় বজায় রেখে বাসন্তী প্রশ্ন করে,
তুমি ব্রেসিয়ারের ঘ্রাণ নাও?
গন্ধ কে ঘ্রাণ কেন বলল জানিনা। তবুও অনিচ্ছা মিশিয়ে উত্তর দিলাম, নাকের সামনে ব্রেসিয়ার থাকে ঠিকই, আসলে আমি তোমার বুকের, শরীরের গন্ধ নিই; …বুঝলে না? … বা, বলতে পারো আরও গভীর কিছুর গন্ধ নিই, বুঝতে চাই। ভালো লাগে।
ছিঃ!
কেন?
ছিঃ!
সে কি!
থুহ!
লেব্বাবা…
সংলাপের শব্দগুলো এক্কেবারে যে ঠিক এমনই ছিল, তা হয়তো নয়। আমার সেইসব বিকল্প মনে পড়ে, যেগুলোর বানান আমি জানি আর হয়তো সেই কারণেই ওরা সহজভাবে আসে।
নানা নামের পুরুষ কি বাসন্তীর কাছে আসেনি? আসে না? পুরুষের মধ্যে নামগুলো বেছে বেছে দেখতে চায়নি কখনো?
একই নামের বহু পুরুষ কি তাকে বিভিন্ন ইন্টারভালে ছুঁয়েছে? হাঃ হাঃ, ইয়ে, বাসন্তীইইই? কই গেলে গা? উঁ? কানা নাকি শালি! নাম এক শুনলেই ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে? চোখে পরখ করে দেখবি না একবার? আচ্ছা, পরখ মানে জানিস? বাসন্তী রে…জানিস না? সত্যি রে মা? জানিস না? পরখ মানে পরশ … ছোঁয়া! চোখ দিয়ে ছোঁয়া যায়, উঁ?
বাসন্তী, আয়, শুঁকি…
উঃ, পাগলা একটা! ভাগ!
হুঁ…ফর ইউ!
তুমি কাছে নাক নিয়ে যাও তখন তোমার নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের অনুভবে আমি ভিজে যাই…
তবে যে, আমি ব্রেসিয়ার নাকের কাছে এনেছি বলে চিৎকার করছিস?
পারভার্সন না? ওটা?
তাই? তুই ঠিক করে দিবি? কোনটা কী?
আমরা কিন্তু অনেক বছর হলো নিজেদের তুমি সম্ভোধন করি। আজ হঠাৎ তুই তুই করছ?
তোর ব্রা নাকের কাছে নিতেই মনে হলো সেই সতেরো বছর আগের সব কল্পনা…আশরীর হিমাচল হুরহুর করে বেরিয়ে এলো আমাদের মাঝখানে, বাসন্তী রে…
আমার এ নাম তুমি জানো?
জানি না?
আমার আরও নাম তুমি জানো?
না
জানো
না
জানো, জানো
না, জানতে চাই না আর কোনও নাম
(এইরূপ মেলোড্রামাটিক সংলাপ ও শারীরভাষ্য বাস্তবে হয় কি? কেমন অযৌক্তিক মনে হয় না? হতে পারে? ভ্যাট!…কিন্তু হয়েছিল। আমার আপনার সমস্ত অহংকার চূর্ণ করেই, হয়েছিল। দাঁড়ান, বলছি, ব্র্যাকেট থেকে বেরিয়ে আসি)
…হ্যাঁ, বলছিলাম কী, বেশি চালাকি করলে কিন্তু বাপু আমি নেই!
ধুর, আজকাল হয়েছে কী তোমার, চমকপ্রদ একটা খাপছাড়া বিশেষণ বসিয়ে এবস্ট্র্যাক্ট করে দিতে চাচ্ছ তুমি আমাদের সহজ, জৈবিক রিলেশনটা!
তাতে কি সম্পর্ক বিপন্ন হয়, নাকি আরও বিপুল অনাঘ্রাত মাত্রা চলে আসে? আসে না?
একটা বড় প্রবন্ধ লেখা যেত, এ নিয়ে; কিন্তু পারি না। তাই এত কথা বল তুমি। মুখ বন্ধ করে দেব এমন ক্ষমতা নেই সেটা বুঝতে পেরেছ।
ঘ্রাণ অন্ধকে প্রাণ দেয়, সে ঘ্রাণের চিহ্ন ধরে সন্ধান পায় আজবের। হাঃ হাঃ। আজব, না?
আচ্ছা যাক, বলো দেখি,
প্রেম-প্রস্তাবের চেয়ে ঢের বেশি বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে সেক্স-প্রস্তাব। কেন?
কেন না, সেটা ধরা যায়…
কী দিয়ে?
কেন, শরীর!
এইখানে এসে, তার অনেকদিন পরে পুরোনো সূত্র ধরে সালাউদ্দিন জানায়, নামকরণের বই লিখে সে কিছু রোজগার করতে চায় এবং অভিনবত্ব এটা হবে যে, একটা বিশাল পান্ডিত্য জাহির করা ভূমিকা থাকবে তাতে যেখানে নামকরণের ইতিহাস মানব জাতির ক্রমবিকাশের রাজনৈতিক পরিচয় ইত্যাদি থাকবে। মানুষের নামের অর্থ নিয়ে সেখানে কাজ হবে। ক্লাসিফিকেশন, আন্তঃসম্পর্ক ও বিভিন্ন প্রবণতা বিষেশভাবে আলোচিত হবে।
সেই আধারে কেউ কি বুঝে নিতে চাইবে একজনের একাধিক নাম, একই নামের একাধিক জন কিংবা একই নামের অনেক পুরুষ ও একই নামের অনেক নারীর শরীর থেকে আলাদা আলাদা গন্ধ কেন নির্গত হয়। …এইভাবে নাম তার গুরুত্ব হারাবে।
……
।।বিষয় প্রবেশ: ০২।।
কুহু ঘরময় ঘুরে ঘুরে নানা কাজ করছে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঘরের এক এক জাগায় সমান্য বসে নিয়ে আবার কাজ করছে। পুলক চেয়ে চেয়ে দেখছে আর ভাবছে, কুহুর বসার স্থান যতবার বদল হচ্ছে, ততবারই এই ঘরের মানে বদলে যাচ্ছে, একটু হলেও অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে, সম্পর্কের অভিঘাত বদলে যাচ্ছে যেন। …কোনও বাক্যের একটি বিশেষ শব্দকে তুলে নিয়ে এক এক বার বাক্যের এক এক জাগায় বসালে যেমন হয়, ঠিক সেরকম।
যেখানে পিথাগোরাসের সুর-জ্ঞান বা শ্রুতিমধুরতা বিষয়ক গবেষণাটির সাথে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের নানান উপলব্ধি মিশিয়ে একটা জাগায় যাবার চেষ্টা চলছে।…হাস্যকর, না? আচ্ছা হ্যাঁ, বিশেষ সতর্কতা: এই গল্পে কোনও কিশোর পুকুর পাড়ে লুকিয়ে পাড়াতুতো দিদির স্নান দেখে না। সরি।
কুহু এবার ঠ্যাং তুলে বসল। ক্যামেরা রেডি হয়, বুক দুরু দুরু, কী জানি, কুহু কি প্যান্টি না পরে শরীর বিষয়ক ক্লাস নিবে? কুহকচারিণী!
তখন, নাটকীয় ভাবে কূলবধূগণ গোপনাঙ্গ গোপন করিয়া সাধ্বী রূপ ধরত: হারামি পুং গণের বেদনা সাধনার্থে প্রবৃত্ত হইলেন।
সমস্ত অতীতকাল জুড়ে, অতীতের সমস্তটায় মাখামাখি হয়ে। অনেকগুলো অতীত আসলে, মনে হয় আমার, মাঝেমাঝে, পেছনের দিকে টিকে থাকে।
হাপিত্যেস করে একটা জীবনকাল পার করতে থাকা জীবগণের মধ্যে বিরল কেউ কেউ সুদীর্ঘকাল প্রধানত মিথ্যার ফাঁপানো জগতে একদিন এমনভাবে নিজেকে খুঁজে পায় যেখান থেকে গল্পগুলো বাড়াবাড়ি রকমের অর্থহীন হয়ে পড়ে; মূলত ধারাবাহিকতার বাণিজ্য হারিয়ে ফেলে নিজেকে ভারমুক্ত ও স্বাভাবিক মনে হয়। কোথাও দাঁড়ানো যায় না, কিন্তু তাই বলে অর্থহীন হয়না একটুও বরং আরও গভীর ও বহুমুখী হয়ে ছড়িয়ে পড়ে জীবনের ব্যঞ্জনা।
পৃথিবীর গোপন ও অনাঘ্রাত অঙ্গগুলো, আহা নাসিকা, ঘ্রানশক্তির অতুলনীয় বিপুল, তুমি জানো। বেঁচে থাকার বানানবিধি তখন তুচ্ছ হয়ে যায়।
কথা হচ্ছে, মাঝখানের গল্পটুকু কে বলবে! কত রকমের সম্ভবনা নিয়ে টলটল করে কাঁপতে থাকে জন্ম ও মৃত্যুর, উত্থান ও পতনের, প্রেম ও অনাসক্তির মধ্যবর্তী সময়কাল! কাউকে তো স্বীকার করতে হবে যে, সত্য কোনও আইন ও বিধানের, কৃত্রিম মূল্যবোধের আওতায় আসে না; স্বীকার তো করতে হবে যে, হৃদয়লগ্ন নারীটির লবণাক্ত যোনি-আস্বাদন ব্যতিরেক পুরুষ হিসেবে সে পৃথিবীকে অন্যভাবে চিনতে পারত না। হ্যাঁ, হৃদয়লগ্ন, অবশ্যই; সেটাই প্রধান শর্ত, সাধনার। বাকি পৃথিবীকে, তারপর, মাথা তুলে চিনে নিতে হয়।
….
।।বিষয় প্রবেশ: ০৩।।
প্রবন্ধ লেখার মতো জামাকাপড়ও নেই আমার। গভীর কিছু পরিধানের বড়ই অভাব বুঝতে পারি।…এভাবে সাজানো গোছানো প্রবন্ধ হয় না। নিবিড় লাগে। পরিধেয় কি কাঙ্খিত নিবিড় দিতে পারে? যেমন সুফি, সন্ন্যাসী, ফকির, সাধু? যেমন …। যেমন…। থাক। যোনি-সন্নিহিত পোষাক কি পুরুষকে মানায়? নারীকে, যাকিছু পুং অধিকৃত কাশ্মীরি শাল? ফুহ, শালা!
তবে নামগান বিষয়ে চিরদিন আলাপ আলোচনা চলতেই পারে।..
নানা নারী-নাম ও যাপন একভাবে বাঁধা পড়ে না। পুরুষ বিষয়েও ওই, নারী সম্বলিত নোনতায়। হাঃ হাঃ। বোধগম্য হলো না, বেশ তো খুখুমনি।
তেমনি উল্লিখিত নারীদের নানা নামের পুরুষ থাকে। নারী, পুরুষ-গন্ধে কানামাছি ন্যায় যুক্তিপূর্ণ। তাহার আর্দ্র ঘটে, গোপনে। কোমর বন্ধনী ও বক্ষবন্ধনী বিজ্ঞানের বীজ বহন করে।
বেশ তবে।
প্রবন্ধ লিখতে হলে যে ঘ্রাণশক্তি, সুচিবাই আর উদারতা লাগে, যে সুবিচার, উপলব্ধি আর তরবারি লাগে, যে নুনজল, লাগে। তা আমার ছিল না কোনও দিন। আমি এইভাবে প্রবন্ধ থেকে সরে দাঁড়ালাম।
কুহু নামের মেয়েটি একদা বাসন্তী নাম নিয়ে আসে। হ্রস্ব ই কার হবে না দীর্ঘ ই কার এই নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে করতে তার নাম সরল করে বলতে ইচ্ছে হয়। যথা, বাসনা, কমলা, রেখা ইত্যাদি। এতে বানান বিষয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় ও লোকের হাসাহাসি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
…ছুটতে ছুটতে এসে খুব নাটকীয় ভাবে একটা গুলিবিদ্ধ মানুষ কোনও এক দিন আমার চোখের সামনে এসে আছড়ে পড়ে ও মারা যায়। বানানের সমস্ত চোখরাঙানিকে তোয়াক্কা না করেই সে হয়তো প্রাণ ত্যাগ করেছে। কয়েক কোটি বছরের পুরনো করোটি পড়ে থাকে ধুলোয়, আমার পায়ের কাছে। নিজেকে অপূর্ব মনে হয়। ‘অপূর্ব’ শব্দটা হঠাৎ করেই একাধারে নিজের বিশেষ্য ও বিশেষণ হয়ে ওঠে এইখানে এসে।
মহুয়া খেয়ে খেয়ে খেয়ে ঝিমিয়ে পড়া আদিম পুরুষের অকেজো লিঙ্গটি যেমন, প্রশ্রাবও ঠিক মতো ত্যাগ করতে অপারগ, গায়ে, পরনের কাপড়ে ফোঁটা ফোঁটা পড়ে; কখনও আবার মুখ থুবড়ে পুরো শরীরটাই ঘাসের উপর পড়ে যায় ও দীর্ঘকাল পড়েই থাকে। তেমনই অকেজো, মৃতপ্রায় সম্পর্কের বন্ধনে ঘুমিয়ে থাকে আমি, বাসন্তী, আর কে যেন…অনেকেই…অনেক অনেক নামের বাহার শুয়ে থাকে।
তবু, নাম বিষয়ক এত বাস্তবতা ও বৈচিত্র্য জানার পরও আমি একেকদিন কোনও একটা নাম শুনে আচমকা বিমর্ষ হয়ে পড়ি বা উৎফুল্ল হয়ে উঠি। ভাবি, এই নামের প্রয়োজন কি পৃথিবীর না হলেই চলছিল না! মুছে দেওয়া যায় না কি এই নাম বাসন্তী, কুহু, বাসনা বা আমার জীবন থেকে!
।।বিষয় প্রবেশ: ০৪।।
একদিন দেখা গেল, প্রবন্ধ লেখার মতো সেক্স হ্যাবিটও আমার নেই।
সেটা কেমন? খুব গূঢ় হাসি নিয়ে এমন ভাবে জানতে চাইলেন আপনি যখন, আমি তবে বলি।…
নাকে পরাগ রেণু লাগিয়া থাকিলে সেই নাসিকা পুনঃ পুনঃ সঙ্গীর নাসিকায় ঘর্ষণ করিবার ফলে যে উদ্ভাসিত পৃথিবী, তা কি অসম্ভব বলে ধরে নিয়ে আপনার পরিত্যাজ্য মনে হয়?
…হয়?
…আমার কিন্তু হয় না।
প্রতিটা অঙ্গের জন্যই শুধু প্রতিটা অঙ্গ কাঁদবে, সেটুকুই যথেষ্ট নয় আমার অভ্যাসে; …চাকরির জন্য বিভাগীয় জেলা আধিকারিকের দেওয়া পনেরো লাখ টাকার ঘুষ প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে ফেরার পথে একটা অপ্রাসঙ্গিক ফাইন্ডিং মাথায় এলো যে, আসলে আমার নাক জিভ আর চোখ আজকাল বেশি একটিভ। পুরুষাঙ্গ ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে।
…আর প্রায়ই এমন সংলাপ উঠে আসে বুকে।
আস্তে আস্তে চাঁদ বয়ে যাচ্ছে কিংবা হাতুড়ি বাটালি ইত্যাদি আমার স্বর্গ… এইজাতীয় বিটকেল কোনও ভাবনা কখনো আমি ভাবতে পারিনি। কিছু উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তথ্য, কোনও দেশের রোমান্টিক ইতিহাস বা এগজাগারেটেড ব্যক্তি-মহিমা আমাকে কখনও গিলে খেতে পারেনি। …গ্রাস হইতে সর্বদা রক্ষা পাওয়া ও সমন্বয়সাধনজাত প্রশান্তি চেয়ে এসেছি চিরদিন কেননা ধর্ম অন্ধবিশ্বাস রাজনৈতিক গোঁড়ামি বড্ড ক্লান্তিকর ও নিজেকে এক চিরায়ত ঠকবাজির পাঠে মগ্ন রাখা। তাত্বিক ক্রীতদাসত্বের নামান্তর।
এই, ভোট দিতে গেলেন্না?
নাহ…
বাঁড়া, পাড়ায় থাকতে হবে না, নাকি!
কেন!
বোকাচোদা বেটাচ্ছেলে, চুদির ভাই, ঢেমনাগিরি মোরানো হচ্ছে!
দেখুন, মুখ সামলে কথা বলুন কিন্তু!
কেন বে, কী করে নিবি বে খানকির ব্যাটা! চোদন আমার আঁতেলামো মারছে, ভোট দিতে যাবেন্না বাবু! দাঁড়া বোকাচোদা খবরটা দাদাকে একবার দিয়ে আসছি বে শালা!
সে তো তবু জানে, দুটো সম্পর্কের মাঝে অনেক গন্ধ লেগে থাকে, এ বিষয়ে প্রায় সকলেই সচেতন নয়। আপাদমস্তক রুচিকর গন্ধের অনুষঙ্গ ও ব্যাখ্যা, যা প্রধানত বহুমুখী ও একজীবনে শেষ হবার নয়, যদিও জীবন একটাই- এইরকম না ভাবলে কুসংস্কার মাথা চাড়া দেয়, হাঃ হাঃ! …খুব খাপছাড়া ভাবেই বেঁচে থাকাটা বুঝে নিতে হয়, যখন ব্যাপার গুলো আচমকা ঘটতে থাকে আর নিজেকে প্রবোধ দেবার জন্য ভাবতে থাকি যে সবই ছিল পূর্বনির্ধারিত। অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে ভারমুক্ত হবার সহজ উপায় আকাশের দিকে আঙুল তুলে দেখানো আর কপালে অল্প অল্প চাপড় মারা।
অথচ বলা হয়েছিল, সব ছন্দে বাঁধা পড়বে যদি বিশ্বাস রাখো।
প্রবন্ধ লেখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে একদা একটি সূচনা পেয়ে যাই, “নারী লতার ন্যায় আবেগে ও নির্ভরতায় পুরুষ বৃক্ষকে আবিষ্ট করিয়া থাকেন”।
“তুমি গোল্লায় যাও!” … সুলেখা ইতি পিউ নামের নারীজাতীয় জীবটি নারীকঠিন ছদ্ম গলায় বলেছিল, “পাঁচশো বছর পিছিয়ে গিয়ে জন্ম নাও গে যাও!”
আরে, এই তো, পুরোটা শোনো!
কী শুনব ছাই, আমি তো নিজেই কতবার ডুআর হয়েছি, তোমার জন্যই, ভালো লাগে বলো, তাই…
হয়েছ তো, বেশ তো, তাই কী হলো?
হবে না? নারী লতার ন্যায়…কী এসব?
ওটা আমি বলছি না পিউ, ওই সূত্রে দেখাবো মধ্যযুগ থেকে আজ অব্দি কীভাবে পঙ্গু বানিয়ে রাখা হয়েছে …
এত কথা হতে হতে ফোন কেটে গেল। ইন্টারন্যাশনাল কল হয়তো ট্র্যাপ হয়, যা চলছে চারিদিকে। নিজে কেটে গেল নাকি কেটে দিলো সুলেখা ইতি পিউ কে জানে।
পাড়ার মুদিকাকু বলল, তিন শো পঁচাত্তর। আরও বলল মৃদু হেসে, ফোনে গল্প করতে করতে মাল কিনবেন না, দোকানদার ঠকিয়ে দিবে অন্যমনস্ক দেখে, হাঃ হাঃ! তবে আমার কথা আলাদা, আমি অনুকূল ঠাকুরের ভক্ত, ধর্মপথে চলি। আচ্ছা, ওরা জিতলে সবাইকে ফ্রি তে কোভিডের ভ্যাকসিন দেবে?
বাল দেবে!
কী?
ব এ আকার, ল…
এই! কী বলছেন এসব?
কী বলব বলুন, দেশ-গাঁয়ের মাথা হয়ে যদি জনতার স্বাস্থ্যের সাথে ঘটিয়া কিসিমের সৌদা করতে আসে, কী বলব তবে, কত ফুলচন্দন দেব? ভোট দেবে তবে টিকা দেবে? না দিলে দেবে না?
মুদিকাকু চুপ মেরে ইলেকট্রনিক ওজন যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেক পরে আরেকদিন জিজ্ঞাসা করে, “দেওয়াল লিখনের বানান গুলো সব ঠিকঠাক ছিল?”
বানান বিষয়ে আমরা সাধারণ মানুষ অত হিসেব রাখি না কাকা। ওসব স্কুল কলেজে পরীক্ষায় লাগে আর তারপর কোনও উৎপাদন ক্ষমতা ধরে না। বানান পাশ কাটিয়ে বিকল্প শব্দে চলে গেলে ভালো হয়, কিন্তু তাতে পুরো বিষয়টাই হয়তো কোথাও কোথাও বদলে গিয়ে এক্কেবারে বিপরীতে চলে যেতে পারে। তখন আর ওই দলে থেকে কাজ করা যায় না।
হুঁ…। বুঝেছি…।
একেকটা শব্দ থেকে একেক রকম গন্ধ বেরোয়, বুঝলেন, একেক রকম রং থাকে একেকটা শব্দের। বেঁচে থাকার রাজনীতি জড়িয়ে থাকে শব্দের বর্ণে আর গন্ধে।
।।বিষয় প্রবেশ: ০৫।।
একবার ভাবলাম, মারমুখী জনতার সাইকোলজিক্যাল ডিসেকশন নির্ভর প্রবন্ধ নামবো। …তৃপ্ত মানুষ সহজে শব্দ করে না। এরকম একটা দিকে যাবে বিষয়টা। আমি বরাবরই খুব হীনম্মন্যতা নিয়ে কুঁকড়ে থাকি তাদের সামনে, যারা খুব যত্নে প্রবন্ধের মতো স্নানের আয়োজন করতে পারেন। ওটা একটা বড় সক্ষমতা, যখন কিনা গন্ধহীনতা আতঙ্কের অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে আসে। বুঝলে, বাসন্তী, অন্ধের তো গন্ধই সহায়। ইউনিয়ন কার্বাইডের তীব্র গন্ধ সেই ভোরবেলা থেকে বুকে নিয়ে আমার ভারতীয় জীবন আজও বিকৃতি সহ বেঁচে থাকার চেষ্টা করে যায়; ওসব আজ তামাদি হয়ে এসেছে গ্লোবাল ঋণ আর ভোগবিলাসের চাপে।
প্লেটে কন্টিনেন্টাল খাদ্যবস্তু সাজিয়ে রাখা হয় আর একটা চড়া দামের বোতল বের করে সাজ্জাদদা রবিবারের সন্ধ্যায় হাসতে হাসতে সামনে এসে বসে। …এরকম ফ্রেম আজ গল্পের মধ্যেও ভালো লাগে।
“মানুষের মতোই, কারেন্সিরও অনেক নাম হয়” সাজ্জাদদা বলে। …এটা ফ্রেঞ্চ, ওরা চাম্পানিয়া বলে শ্যাম্পেন কে, তার সুদৃশ্য বোতল খাদ্যবস্তুর পাশে রেখে নিজেও বসে ও তার মধ্যেই বলতে থাকে, আজকাল ঠিকঠাক গন্ধ পাওয়াটা তোমার সুস্বাস্থ্যের অন্যতম ইন্ডিকেটর।
আজকাল কেন, চিরদিনই…
চিরদিনই?
হ্যাঁ! আমি তো সেই কিশোর বয়স থেকেই মেয়েদের শরীরের গন্ধে এডিক্টেড। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নানাভাবে উদ্ভাসিত হয়, এক্ষেত্রে।
না, বলছিলাম যে, গন্ধ যে স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সুফলদায়ী, সেটা কি জানতে আগে?
বরাবরই জানতাম।
আচ্ছা?
দেখো সাজ্জাদদা, খাস জমির দখল নিতে পারল না যে হতভাগা, সে কীরকম গন্ধ পায় মাটির, বাহুবলী দাদার হাতে কান্নাভেজা টাকা গুনে গুনে দিতে হলে, মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে বলে, সেই টাকা কয়টার গায়ে একরকম গন্ধ হয়, যা উঁচু তলার পুরুষ নিচু তলার মেয়েকে ধর্ষণ করে শেষে ধামাচাপা দিতে আর্থিক ক্ষতিপূরণ অফার করলে মেয়েটির মন যেমন হয় সেরকম একটা ভাবের জন্ম দেয় এবং যা বাকি জীবনের চিরকাল ধরে স্মৃতিতে ঘর বেঁধে বসে থাকে।
শোনো দাদা, সাজ্জাদ আলম চৌধুরী বলে, “একটা জীবনকাল পার করতে থাকা জীবগণের মধ্যে বিরল কেউ কেউ সুদীর্ঘকাল প্রধানত মিথ্যার ফাঁপানো জগতে একদিন এমনভাবে নিজেকে খুঁজে পায় যেখান থেকে গল্পগুলো বাড়াবাড়ি রকমের অর্থহীন হয়ে পড়ে।”
তারপর বাসন্তী বলবে, পুরুষের শরীরের গন্ধ নারী যখন রাখ-ঢাক না করেই পায় ও তা গোপন করে না, গল্প তখন আরও ভালো জমে; শতাব্দীপ্রাচীন রাজনীতির, সেক্ষেত্রে, পুনর্বিবেচনা ঘটতে থাকে। জীবন আর হ্রস্ব থাকে না।
Posted in: June 2021 - Cover Story, STORY