সেলিম মণ্ডল-র কবিতা

কালীদা, এই তো জীবন

সবাই বলে: ফিরে নাও, ফিরে যাও। সত্যিই কি মানুষের কোথাও ফেরার আছে? অহরহ মানুষ মৃত্যুদানা ঠোঁটে নিয়ে উড়ে চলেছে। কোথাও ফেলার জায়গা নেই। মাটিতে ফেললে মাটি থেকে গজিয়ে উঠবে নতুন চারা। জলে ফেললে, ভেসে ভেসে সেই আসবে কাছে। তাহলে কি পুড়িয়ে দেবে? আগুনও সন্দেহজনক৷ বাতাসের সঙ্গে তার সম্পর্ক সৌহার্দপূর্ণ!

ফিরে যেতে হবে, জলজোছনার কাছে। মানুষের পাতা ফাঁদে। ঘুঘুর বেশে। কিন্তু খাঁচায় কি মানুষ পুষেছে ঘুঘু? পাতা ঝরার দিন শেষ হলে, সবাই গাছের কাছেই আশ্রয় নেয়। সোনালী দিন, খাঁচার ভিতর খাঁচাকে বর্ণাঢ্য করবে, এই বিশ্বাসের ভিতর লাশভর্তি গাড়ি চলে যাচ্ছে। কেউ উঁকি দিচ্ছে। কেউ ঝুঁকি দিচ্ছে। কেউ বলছে: কালীদা, এই তো জীবন!

ঠিক যেন, এক টাকা ছোটো কয়েনের মতো। চকচক করবে। কিন্তু কে গ্রহণ করবে, কে গ্রহণ করবে না, তার নিশ্চয়তা নিয়ে হেঁটে যেতে হবে এক দোকান থেকে আরেক দোকান।

পালক ফেলতে ফেলতে, পালক ছিঁড়তে ছিঁড়তে, নিজের ছায়ার ভিতর মানুষ এমনভাবে চরকি কাটবে, তখন পাখিদের চিকিৎসালয়ের জন্য খোঁজ করতে হবে মেঘভর্তি রোদলণ্ঠন…

হাঁ

হতাশার কোনো হাঁ নেই। তবুও মানুষ হাঁ করে আছে। মাস্ক পরে। মাস্ক পরে হাঁ করে থাকার কোনো সুবিধা না-থাকার সত্ত্বেও মানুষ কেন হাঁ করে? এই প্রশ্নটা মাথার মধ্যে যত ঘুরপাক খায়, ততই দুর্বল হয় স্মৃতি। স্মৃতি, দুর্বল হওয়া ভালো। যত ধারালো হবে— কেটে যাবে। ছড়িয়ে যাবে। ধারাবাহিক রক্তপাতের ভিতর ভাসিবে দেবে নিজের বানানো বাড়ি। বাড়ির প্রতি মায়া বাড়লে মাস্ক ভারী হয়। ভারি রহস্য লাগে মুখ। অথবা মুখোশ!
মানুষ, এই রহস্যের সন্ধানে আগুন আবিষ্কার থেকে ভ্যাক্সিন আবিষ্কার পর্যন্ত এসেছে। শেষপর্যন্ত সেই হতাশা হাঁ করে, যাত্রাপথে ধরিয়ে দিয়েছে একটা শিশুর ঝুমঝুমি। মানুষ কেঁদে উঠলে তাঁকে ভোলানোর জন্য যাতে বাজাতে পারে। মানুষ নিজেও বাজতে চায়। সুর হোক বা না-হোক। গলা খুসখুস করলেও মানুষ শিল্পী। কারণ, বাদ্যযন্ত্র হারিয়ে ফেলা অজস্র শিল্পী মাস্ক খুলে দেখেছে, তাঁর দাঁতে পেঁচিয়ে গেছে অজস্র তার!

নেই

‘নেই’ এই শব্দটাকে তাচ্ছিল্য করার মতো শক্তি আমরা অর্জন করতে পারি না। আর পারি না বলেই, শক্তির বিনাশ নেই।

ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে আলো এতটা ছায়া বিস্তার করে তা হিসেবে করা কঠিন। চোখ হতে পারত তুলাযন্ত্র। কিন্তু মন্ত্র শেখার আগেই ছানি নিয়ে দৃশ্য ভাঙতে ভাঙতে দৃশ্যের ভিতর সে অবরোধ ডেকে দেয়। বিপ্লব। মিছিল। স্লোগান। চলে। সেই ‘নেই’ নিজের মতো নাক উঁচু করে, থলথলে সুখী ভুঁড়ি নিয়ে খুলে দেয় জানালা।

রোদ। বৃষ্টি। বাতাস। পাখি।

‘নেই’ শব্দটায় ভূমিকা লিখে, সব ভুল প্রমাণ করতে হয়ে ওঠে মরিয়া।

বিশ্বাস-অবিশ্বাস

বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মধ্যে এক সরু সুতো থাকে। এই সুতো দিয়ে দূর-দিনের কত জামা সেলাই করেছি। এখন না আছে সুতো। না আছে সেলাইয়ের হাত। শুধু পড়ে থাকে জামা।
সব পথ যেন ধ্বংসের পথ। পথে পথে পড়ে থাকে হারিয়ে যাওয়া জুতো। নতুন। পুরোনো। ছেঁড়া। উত্তরাধিকারসূত্রে ওই পথে হাঁটতে হাঁটতে কারো কারো তা চোখেও পড়ে। কেউ কেউ জুতোর ফিতে পা লেগে হোঁচট খায়।
বিশ্বাস আর অবিশ্বাস সেই সুতোর মাঝে— জামা-জুতোর মতো। প্রকরণহীন। অভিমানী। ‘নেই’-এর গাছগাছালি। মরুপ্রান্তর।

নিকানো মায়া

কাজ করতে ভালো লাগে না। খেতে ভালো লাগে না। খালি মনে হয়, ঘুমোই। ঘুম কি আসে? ঘুম আসে না। ঘুম অপেক্ষা করে। অপেক্ষা করতে করতে সে জোরপূর্বক নিয়ে যায় নিজের দেশে। এই দেশ আমাদের চেনা। এখানেও নদী আছে। লাল সাইকেল নিয়ে ধুলো উড়িয়ে তার পাশে বসা যায়। দেখা যায়— মাছের ভেসে যাওয়া। ছোটো ছোটো মাছ। এরা একদিন বড়ো হবে? হয়ত হবে, না হলে নদী বয়ে যাচ্ছে কেন? কারো স্বপ্নে যদি শুকিয়ে যাওয়া নদী আর ভাঙা নৌকা আসে সে কি পাড়ে বসবে? ঘুমের মধ্যেই ভাবি। ঘুম জোরালো হয়। ঘুম ধারালো হয়।
আবার যখন নদী থেকে ফিরে আসি— ঘুমের মধ্যেই জ্বরে কাঁপি। জ্বরই আশ্রয় দেয়। মাথা ব্যথার সময়ে হাতঘড়ি খুলে রাখে।
একদিন ঘুমোব না। ভাবি। অনেকেই ভাবে। ঘুম কি ছাড়বে? তার ওঁত পাতা ধূর্তচোখে মাংসের পরব। রন্ধনশালা না থাক… চোখ আছে এই প্রশান্তিতেই ঘুম থেকে ঘুমের দিকে অনন্তযাত্রায় পড়শির নিকানো মায়া ভিজে যায়…

Facebook Comments

Posted in: June 2021, POETRY

Tagged as: , ,

2 thoughts on “সেলিম মণ্ডল-র কবিতা Leave a comment

  1. বর্তমান সময়ের অসাধারণ জীবন উপলব্ধি। শব্দের বুননে অকল্পনীয় নৈপুণ্য। আগে দাদার এই ধরনের লেখা পড়া হয়নি। খুবই ভালো লাগলো। আরও লেখা পড়ার সুযোগের অপেক্ষায় রইলাম।

Leave a Reply