জন্মদিন : সাদিক হোসেন

      রাতুল হালিমাকে জিজ্ঞেস করল, তোর ছেলের বয়েস কতো?
      হালিমার গতরাতের এঁটো বাসনগুলো ধোয়া হয়ে গিয়েছিল। এখন জল ঝরিয়ে সেগুলো গুছিয়ে রাখছিল। আঁচলে হাত মুছে বলল, এইতো, আট।
–    স্কুলে ভর্তি করিয়েছিস?
–    জ্বি দাদা।
–    কোন্ স্কুল?
–    আমাদের ওখানেই। সরকারি স্কুলে।
–    ভালো। পড়াশোনা করে তো?
      হালিমা হেসে ফেলল। রাতুল এমনিতে বেশি কথা বলার লোক না। এইসব কেন জিজ্ঞাসা করছে সে বুঝতে পারছিল না। বলল, বই নিয়ে বসে। কী যে পড়ে, সে-ই জানে। এখন তো আবার স্কুল বন্ধ।
–    হুম। তোর কাজ হয়ে গেছে?
–    রান্নাঘরটা পোঁছা বাকি।
–    আচ্ছা, শোন, চা-ছাকনিটা ঠিক জায়গায় রাখিস না কেন? কাল তোর বৌদি চা করতে গিয়ে খুঁজে পাচ্ছিল না। কত খোঁজাখুঁজি বাপরে। শেষে একটা বাটির নিচে পাওয়া গেল। তোকে কিছু বলেনি?
      হালিমা হাসল। না, বৌদি তাকে কিছু বলেনি। আজ সকাল থেকেই সে বৌদিকে ব্যস্ত দেখেছে। এইতো কিছুক্ষণ আগে ছেলেকে নিয়ে বাজারে গেল।
      হালিমা রান্নাঘরটা মুছে রাতুলকে বলল, দাদা, আজ যাই?
–    তোর ফোন নম্বর বৌদির কাছে আছে?
–    হ্যাঁ, দিয়েছিলাম তো। কেন, কিছু বলবেন?
      রাতুল কী যেন ভাবছিল। একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, তোর ছেলের বয়েস আর বিনুর বয়েস এক, না?
–    ক্লাস থ্রি-তে পড়ে তো।
–    বিনুরও ক্লাস থ্রি। তাহলে একই বয়েস হবে। কাল বিনুর জন্মদিন, জানিস তো?
–    বৌদি বলেছিল। কাল সন্ধে অব্ধি থাকতে বলেছে।
–    হুম। আর কিছু বলেনি?
–    না তো। কিছু বলবেন?
–    না, তেমন কিছু না। একগ্লাস জল দিয়ে যা।
      এরমধ্যে সৌমি বিনুকে নিয়ে ফিরে এলো। তারা জন্মদিনের জন্য কেনাকাটা করতে গিয়েছিল। ঘরে ঢুকেই বিনু চেঁচিয়ে উঠল, বাবা দ্যাখো কী কী কিনেছি।
      রাতুল সৌমিকে ইশারা করল। সৌমি চাপা স্বরে বলল, এতো ব্যস্ত হচ্ছো কেন? তারপর হালিমাকে ডেকে বলল, কাল তাহলে সকালে চলে আসিস। তোর ছেলের নাম কীরে?
–    হাফিজ।
–    এক কাজ কর, হাফিজকেও সঙ্গে করে নিয়ে আসিস। ও তো বিনুর বয়সী। বিনুর জন্মদিনে ওর নেমতন্ন রইল।
      হালিমাকে এর আগে কেউ জন্মদিনে নেমতন্ন করেনি। সে জিজ্ঞেস করল, আমার সঙ্গেই নিয়ে আসব? জন্মদিন তো সেই সন্ধেবেলা।
      সৌমি কিছু বলতে যাচ্ছিল। রাতুল তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, হ্যাঁ তোর সঙ্গেই নিয়ে আসিস। দুপুরেও এখানে খাবে।
      হালিমা চলে গেল।
      বিনু সবকটা ব্যাগ উপুড় করে দিয়েছে। জন্মদিনের টুপি, মোমবাতি, বেলুন তো আছেই, তার সঙ্গে রয়েছে রিটার্ন গিফট। সৌমি তাকে একটা রোবোট কিনে দিয়েছে। সেইটাকে আবার রিমোটে কন্ট্রোল করা যায়।
      রাতুল বলল, বাচ্চা তো। আসুক না।
–    আমি আবার বারণ করলাম কখন? সৌমি বাথরুমে যেতে গিয়ে বলল, আর তুমিই বা এতো উতলা হচ্ছো কেন? আসুক। এলে ভালোই হবে। তোমার কজন কলিগ আসছে?
      রাতুল ল্যাপটপ অন্ করছিল, মৃণাল আসবে। কৌশিকও আসবে মনে হয়।
      মুখে ফেস-ওয়াশের ফ্যানা তু্লেছে সৌমি, ও বাবা, কৌশিক আসবে!
–    কেন?
–    ওর ফেসবুকের পোস্ট পড়ে তো বোঝা যায় বিজেপি হয়েছে। তাকে বাড়িতে নিয়ে আসছ দেখে অবাক হচ্ছি।
      রাতুল হেসে ফেলল, সেরকম ব্যাপার না। ফেসবুকে ও আবোলতাবোল লেখে। অতটাও ডেঞ্জারাস নয়।
–    আমাকে হোয়াটস-আপে ম্যাসেজ করত।
–    তাই নাকি?
–     আজ্ঞে। নব্য হিন্দুত্ববাদ। কোথা থেকে যে এদের জোটাও।
–    কতজনকে আর বাদ দেবো? ঠগ বাঁচতে গাঁ উজাড় অবস্থা হবে।
–    তবে তাই হোক। সৌমি বাথরুম থেকে ফিরে এলো, সেইটা হলে খারাপ কী?
      বিনু রিমোটটা টিপেই যাচ্ছে। রোবোটের কোনো সাড়াশব্দ নেই। সে চেঁচালো, দেখো মা, দোকানদার ঠকিয়ে দিয়েছে। চলছে না।
–    ধুর। আমাদের সামনেই তো চালিয়ে দেখালো। সৌমি এবার নিজেই রোবোটটা নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করে দিল। সত্যিই যন্ত্রটা কোনো রেসপন্স করছে না। হলোটা কী?
      বিনুর চোখ ছলছল। সৌমি বলল, কী মুশকিল! এখুনি পাল্টে নিয়ে আসতে হবে।
      রাতুল মেইল চেক করছিল। বলল, রিমোটে ব্যাটারি লাগিয়েছ?
–    ব্যাটারি কোথায় মা?
      সৌমি জিভ কাটল, ইস!
      রাতুল বউকে ঠেস মেরে হাসতে লাগল।
      পেন্সিল ব্যাটারি কেনা হয়নি। ঘড়ি থেকে খুলে রিমোটে লাগানো হলো। সবুজ রঙের বোতামটা টিপতেই রোবোটটা বলে উঠল, ওয়েলকাম…
      বাকি দিনটা রোবোটটাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকল বিনু। সন্ধেবেলা তারা পার্কে গেল।
      আগামীকাল জন্মদিন। তাই আজ কিছু ছাড় পেয়েছে বিনু। মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিজেই আইসক্রিম কিনতে গেল।
      সেই সুযোগে সৌমি রাতুলকে জানাল, তোমার বাবা বিনুকে টাকা পাঠিয়েছে।
–    বিনুকে?
–    আজ সকালেই ফান্ড ট্রান্সফার করিয়েছে আমার একাউন্টে। আমি ফোন করেছিলাম। বিনুও কথা বলল।
      রাতুল মুখ ফিরিয়ে নিল, আমাকে জানাওনি কেন?
–    জানালে সারাদিন ব্যাজার মুখে ঘুরতে।
–    এখন শুনে বুঝি খুব ভালো লাগছে? রাতুল পার্কের বেঞ্চ থেকে উঠে পড়ল, টাকাটা ফেরত পাঠিয়ে দিও।
      সৌমি সঙ্গে সঙ্গে কোনো উত্তর করল না। বিনু ফিরে এলে বলল, আজ রাতে আর রাঁধব না। স্যুইগিতে অর্ডার দিলে কেমন হয়?
–    আমি কিন্তু পিজ্জা খাব।
–    পিজ্জা খাবি? আমি ভাবলাম বিরিয়ানি, চাঁপ… এইসব খাব।
–    ওগুলো তোমরা খেও। আমি পিজ্জা খাব। আর একটা হট চকোলেট দিয়ে আইসক্রিম।
–    আবার আইসক্রিম?
      রাতুল তখনো বিরক্ত। সৌমিকে পাশ কাটিয়ে বিনুকে বলল, চল্, এবার বাড়ি যাই।
–    এখুনি?
–    এখন আর কোথায় যাবি?
–    মা তোমাকে কিছু বলেনি?
–    কী বলবে?
–    মা যে বলল আজ দাদনের সঙ্গে দেখা করতে যাব!
      সৌমি হয়ত ভেবেছিল কথাটা অন্যভাবে জানাবে রাতুলকে। বিনু বলে ফেলায় সে বেশ তটস্থ হয়ে উঠল। কীভাবে ম্যানেজ করবে বুঝতে পারছিল না।
      রাতুল অন্যদিকে তাকিয়েই বলল, তুমি প্যাথেটিক হয়ে উঠছ।
      সৌমি জানে এখন তর্ক করতে নেই। বিনু এতো কিছু বোঝে না। দাদনের সঙ্গে ফোনে কথা ছাড়া তার দেখা হয়েছে মোটে এক-দুবার। লোকটিকে তার খারাপ লাগেনি। প্রতিবার সাক্ষাতে সে কিছু না কিছু গিফট পেয়েছে।
      রাতুল এবার চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে শুরু করল, আমার মাঝে মাঝে আশ্চর্য লাগে। ঐ লোকটা তোমাকে কী নজরে দেখতো তুমি ভুলে গেছ? কথায় কথায় ছোটোজাতের মেয়ে ব’লে খোঁটা দেয়নি? তোমার জন্যই ঐ বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি। ছেড়ে যখন আসতে পেরেছি আর কোনোদিন যাব না। আজকেই তুমি কৌশিকের প্রসঙ্গ তুললে। হ্যাঁ, ও বিজেপি করে। সারাদিন উল্টোপাল্টা পোস্ট করে। কথাবার্তাও ভয়ংকর। কিন্তু ও তো আমার কলিগ। সারাদিন ওর সঙ্গে থাকতে আমি বাধ্য হই। চাইলেই তো ও-কে অফিস থেকে তাড়াতে পারব না। আর কৌশিকের সঙ্গে ঐ লোকটার পার্থক্য কী? কোনো পার্থক্য নেই। ঐ লোকটা আরো ডেঞ্জারাস। ঐ লোকটাকে ছেঁটে ফেললে আমাদের কোনো অসুবিধা নেই। অসুবিধা যখন নেই, তখন ছাঁটব নাই বা কেন?
–    রাতুল, আমাদের সঙ্গে বিনু রয়েছে কিন্তু!
–    থাকুক। ওর জানা উচিত।
–    প্লিজ!
      বিনুর আইসক্রিম খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। বিনুর দিকে তাকিয়ে রাতুল নিজেকে সামলে নিল। বলল, চলো।
      রাতে জমিয়ে অর্ডার করা হল। পিজ্জা উইথ স্পাইসড চিকেন বল, স্মোকড চিকেন, মাসালা মিরান্ডা, চকো ভলক্যানো…
      সৌমি কথা দিয়েছে সেই পাঁচ হাজার টাকায় সে হাত দেবে না। তবে এই ট্রিট-টা তার। বাড়ি ফিরেই হুইস্কি নিয়ে বসে পড়েছিল রাতুল। সৌমিও দু-পেগ খেল। বিনু রোবোটটার নাম দিয়েছে, আরাকান।
–    আরাকান কেন?
      এই উত্তর জানে না বিনু। বলল, নামটা সুন্দর। অ্যাডভেঞ্চারাস!
–    তা বটে।
      রাতুল হেসে উঠল। তার নেশা হয়নি। তবে মাথাটা ঝিমঝিম করছে। রাতে যখন বিনু ঘুমিয়ে পড়েছে, সৌমি রাতুলকে ডাকল, তোমার সঙ্গে একটা কথা ছিল।
      রাতুল মুখ গুঁজে দিয়েছিল বালিশে। বলল, কী?
–    এদিকে ফেরো।
–    কী?
      সৌমি উঠে রাতুলের কাছে গেল। চুলে বিলি কেটে দিল। বলল, তোমার বাবার শরীরটা ভালো নেই।
–    বয়েস হয়েছে তো।
–    বয়েসের কারণে নয়।
–    তবে?
–    ক্যানসার ধরা পড়েছে। লাং-এ। ভালো কিছু আশা করা যাচ্ছে না।
      রাতুল আর কথা বলল না। একদম চুপ। পাশফিরে সৌমিকে জড়িয়ে শুয়ে থাকল কিছুক্ষণ। একবার উঠে জল খেল। বিনুর কপালে চুমু খেল।
      সৌমি বলল, কাল ফোন করলে কথা বলবে?
      দু-দিকে মাথা নাড়ল রাতুল। না সে তার বাবার সঙ্গে কথা বলতে চায় না। শুতে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, কাল কৌশিক আসুক। ইচ্ছে করে ওকে নেমতন্ন করেছি। এসে দেখুক আমরা কেমন লাইফ কাটাচ্ছি!
      গিয়াসুদ্দিনের বাড়ি ফিরতে আজকাল বেশ রাত হচ্ছে। ১১টার আগে ফিরতেই পারে না। কাজ যে বেড়েছে তা নয়। বাস বন্ধ থাকায় তাকে প্রতিদিন ২০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে গোডাউনে যেতে হয়। সেখানে ট্রাক আনলোড করে সে। ফেরে আবার সেই ২০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে। ঘরে ফিরে তাই আর কোনোদিকে তাকাতে পারে না। দু-মুঠো মুখে গুঁজে যাহোক শুয়ে পড়ে। একবার শুলে হুশ থাকে না কোনো।
      হালিমা অন্যদিনের থেকে আজ একটু তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছিল। স্টোভে ভাত চাপিয়ে যখন হাফিজকে তৈরি করছে, তখনো গিয়াসুদ্দিন ঘুমিয়ে।
      হাফিজ বলল, গেঞ্জিটা অনেক বড়ো। এইটা পরবো না।
      টি-শার্টটা অন্য কারো নয়। হাফিজেরই। ইদে কিনে দেওয়া হয়েছিল। ছেলে দ্রুত বেড়ে যেতে পারে, এই ভয়ে দু-সাইজ বড়ো নেওয়া হয়েছিল। হালিমা ছেলেকে ধমক দিয়ে বলল, ছোটোরা এইরকমই পরে।
–    ঢলঢল করছে তো।
–    করুক।
      হাফিজ ছলছলে চোখে মায়ের দিকে তাকাল। গিয়াসুদ্দিনের ঘুম ভেঙে গেছিল। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলল, এতো সকালে করো কী?
–    কাল তো বলেছিলাম, আজকে দিদি দাওয়াত দিয়েছে। ছেলের জন্মদিন।
–    ও। গিয়াসুদ্দিন বউকে ডেকে বলল, এইদিকে একবার এসো তো।
      হালিমা কাছে গেলে লুঙ্গির গিঁটটা খানিক আলগা করে বলল, কী যন্ত্রণা হচ্ছে। মাগো।
      হালিমা গায়ে হাত দিয়ে দেখল ফোঁড়ার জেরে জ্বরও এসেছে, ব্যথা কমার ওষুধটা খাওনি?
–    কাল তিনটে খেয়েছি। খেলে একটু কমে। তারপর আবার যেই-কী-সেই।
–    দুটো মুখ বেরিয়েছে।
–    আর দুদিন দেখি। তারপর কাটিয়ে নেব।
      হালিমা বলল, পানি গরম করে আনছি। সেঁক দিও।
      চায়ের সঙ্গে দুটো বিস্কুট খেয়ে একটা ওষুধ গিলে নিল গিয়াসুদ্দিন।
–    সাইকেল চালাতে পারবে?
      এই প্রশ্নের কোনো উত্তর হয়? হয় না। হালিমা তাই টুকিটাকি কাজ শেষ করে বলল, খেয়ে নিও। হারুনদা তাগাদা দিচ্ছে। ওর টাকাটা দিতে হবে এবার।
      গিয়াসুদ্দিন বউকে পাত্তা দিল না। হাফিজকে বলল, যা কেক খেয়ে আয়। আধার কার্ডটা সঙ্গে আছে তো? দেখাতে হবে কিন্তু।
      যেতে গিয়েও থেমে গেল হালিমা। বরকে বলল, ওকে আবার এসব কী বলো?
      ফোঁড়ার জেরে মুখ কুঁচকে রয়েছে গিয়াসুদ্দিনের, ছাড়ো তো। কাজে যাবার আগেই আধার কার্ডের জেরক্স দাও। ভোটার কার্ডের জেরক্স দাও। কেন আমরা কি ডাকাত? টেররিস্ট?
–    এখন সবাই ঐসব চায়।
–    চাইলেই দিতে হবে? আমরাই এখানে রয়েছি তিন পুরুষ ধরে। ওরাই এসচে নতুন। এইতো কদিন আগে দিঘিটা বুজিয়ে বিল্ডিংটা হল। কদিনের লোক আমাদের কাছে কার্ড চাইছে। ক’জন খুন হয়েছে এতোদিনে? ক’টা ডাকাতি হয়েছে? কার্ড চাইতে এসেছে। শুয়োর।
–    ছাড়ো তো।
–    ছেড়েই তো দিয়েছি।
      হালিমা আর কথা বাড়াল না। ছেলেকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল।
      তাদের বস্তি থেকে রাতুলদের ফ্লাটবাড়ি বেশিদূরে না। অটোতে ৭টাকা নিত। এখন লকডাউনে বাস-অটো বন্ধ থাকায় হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। তবে হাঁটলে একখানা শর্টকাট মারা যায়।
      বড়ো রাস্তায় ওঠার আগেই ডানদিকে বেঁকে যেতে হবে। তারপর খানিকটা গেলেই খাল। সেই খাল ধরে নাক বরাবর হাঁটলে ১৫ মিনিটেই পৌঁছে যাওয়া যায়।
      এই রাস্তাটা হাফিজের কাছে নতুন। সে বলল, মা ওরা খালপারে থাকে?
      হালিমা ছেলের কথা শুনে হেসে ফেলল। উত্তর দিল না।
      উত্তর না পেয়ে হাফিজ আবার জিজ্ঞেস করল, এইদিকটায় তো ছলিমদের পাড়া। ঐ হাজামপট্টি। ঐখানে থাকে?
      হালিমা এবারেও চুপ থাকল।
      আরো খানিকটা হাঁটার পর, বড়ো রাস্তায় ওঠার আগে আবার বাঁক নিল, ঐ যে!
      হাফিজ বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখল, তার সামনেই একখানা লম্বা লোহার গেট। গেটে আবার একজন দারোয়ান দাঁড়িয়ে। দারোয়ানটাকে দেখে সে মায়ের হাত টেনে জিজ্ঞেস করল, আমাদের ঢুকতে দেবে?
      হালিমা ছেলেকে অভয় দিল, আমি তো রোজ আসি।
      এই প্রথম লিফট চড়ল হাফিজ। কলিং বেল বাজাতেই সৌমি দরজা খুলে দিল, ভালোই করেছ ছেলেকে নিয়ে এসে। ওর নাম কী যেন?
–    হাফিজ।
–    হ্যাঁ, হাফিজ। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। তোমার দাদা এখুনি বাজার থেকে ফিরবে। তার আগে ঘরটা মুছে নিও। আমি বিনুকে ডেকে দিচ্ছি। হাফিজ ততক্ষণ বিনুর সঙ্গে খেলুক।
      বিনুকে বলতে হল না। নিজেই হাফিজের হাতে স্যানিটাইজার মাখিয়ে ঘরে নিয়ে চলল। রোবোটটাকে দেখিয়ে বলল, এইটার নাম আরাকান। তুমি আরাকান মানে জানো?
      হাফিজ আরাকান মানে জানে না।
      বিনু ও-কে বোঝাতে লাগল, আরাকান একটা জায়গার নাম। ঐ মায়ানমারের দক্ষিণ দিকে। মায়ানমার কোথায় জানো?
      হাফিজ সেটাও জানে না। বিনু এই সবকিছু গতকাল বাবার কাছ থেকে শিখেছে। এখন টেবিল থেকে গ্লোবটা নিয়ে দেখাল মায়ানমার ইন্ডিয়ার ঠিক কোন দিকটায়। বলল, ঐটা দেখছ, যেন দুই হাত ছড়িয়ে রয়েছে, ঐটা বাংলাদেশ। ঐখানটায় চিটাগাঙ। আরাকানরা কোন ভাষায় কথা বলে জানো?
      হাফিজকে বাঁচালো রাতুল। সে বাজার থেকে চলে এসেছে। ওদের দুজনকে বলল, কত কাজ পড়ে আছে, আর তোরা এখানে বসে বসে গল্প করছিস?
–    আবার কী কাজ বাবা?
–    বেলুন ফোলাতে হবে, বৈঠকখানায় লাইট লাগাতে হবে…সে-অনেক কাজ পড়ে আছে।
      রাতুল দুজন-কে নিয়ে বেলুন ফোলাতে শুরু করে দিল। সৌমির হাত ফাঁকি যাচ্ছে না। পায়েস করা শেষ। এখন ভাত চাপিয়ে চিংড়ি বাছতে বসেছে। হালিমাকে বলল, তুই বারান্দা থেকে কাপড়গুলো তুলে নে’। রাতুলকে চেঁচিয়ে বলল, তিনটের সময় কেক নিয়ে আসতে হবে কিন্তু।
–    সেতো যাব। তার আগে একটু চা দাও।
–    এখন আবার চা কেন? একটু পরেই তো ভাত খেতে বসবে।
      হালিমা কাপড়গুলো গুছিয়ে নিয়েছিল। সৌমিকে বলল, দিদি আমি চা করে দেবো।
–    একদম না।
      হালিমা হেসে ফেলল।
      ডাইনিং টেবিলে ছয়টি চেয়ার। তবু হালিমা চেয়ারে বসল না। বিনু হাফিজকে নিয়ে বসেছে। হালিমা বলল, আমি রান্নাঘরে খেয়ে নেব’খন।
–    তা কেন? আজ তো তুমি নিমন্ত্রিত। এখানে এসো।
–    না দিদি। হালিমা হেসে বলল, আমি রান্নাঘরেই খেয়ে নেব।
      থালাবাসন ধুতে দুপুর পেরিয়ে গেল। রাতুল দুজন-কে নিয়ে কেক আনতে গিয়েছিল। যখন ফিরল, সঙ্গে রয়েছে মৃণাল।
      মৃণালকে একা দেখে সৌমি বলল, কেয়াদি আসবে না?
–    আর বোলো না। জাস্ট বেরোতে যাব, কেয়ার ফোন এলো অফিস থেকে। এই রোব্বারে হঠাৎ নাকি ক্লায়েন্ট মিটিঙ। অগত্যা আমিই চলে এলাম।
–    ইস! কেয়াদি কিন্তু নিজে বলেছিল আজ আসবে। মিটিঙ কতোক্ষণ? পরে আসতে পারবে না?
–    তুমি ফোন করে নিও।
      মৃণাল একখানা দুরবিন নিয়ে এসেছে বিনুর জন্য। বিনুর আবদার, বাবা এই ঘরের মধ্যে দুরবিন নিয়ে কী করব। চলো না ছাদে। প্লিজ চলো।
      অগত্যা ছাদে যাওয়া হলো।
      রোদ নেমে গেছে। আকাশের খানিকটা গোলাপি। রাতুল দুরবিনে চোখ রেখে বলল, ঐ দেখ সাউথ সিটি দেখা যাচ্ছে।
–    দেখি, দেখি।
      বিনুকে সামলানো যাচ্ছে না। বলল, ইস, কী কাছে।
      মৃণাল বলল, এবার বল্ তো যাদবপুর কোন্দিকে?
      বিনু সাউথ সিটি থেকে চোখ সরিয়ে খানিকটা ডানদিকে তাকাল, এইদিকটায়?
      মৃণাল খেলাটায় বেশ মজা পেয়েছে। আবার জিজ্ঞেস করল, দেখতো এখান থেকে সেকেন্ড হুগলি সেতুটা দেখা যায় কী না?
–    বাবা সেকেন্ড হুগলি ব্রিজটা কোনদিকে?
–    খুঁজে দেখ।
      বিনু সত্যিই কী কী দেখতে পেল বোঝা গেল না। এক ঝাঁক কাক দেখে বলল, প্যারোটস। তারপর মনুমেন্ট এলো, ভিক্টোরিয়া এলো, লেক-মল এলো। এই শহরের যে-সব জায়গায় সে যেতে পেরেছে, সেই সব কিছু যেন দেখে নিল। ভুল ধরিয়ে দিলে কিছুতেই মানতে চাইল না।
      হাফিজ খালি চোখেই ছাদ থেকে নিচের দিকে তাকাচ্ছিল। অত উঁচু থেকে নিচের সবকিছুই সুন্দর মনে হয়। সে খালটাকে দেখা পেল। কিন্তু কোন রাস্তা দিয়ে তাদের বস্তিতে যাওয়া যাবে তা চিনতে পারল না। শেষে একবার দুরবিনে চোখ রাখার সুযোগও পেল। কিন্তু ততক্ষণে আলো কমে এসেছে। খালের কালো জল সেই আলোয় আরো কালো। কোনোকিছুই স্পষ্ট বোঝা গেল না।
      ছাদ থেকে নেমেই রাতুল সৌমিকে ডেকে নিল। বলল, এখুনি কৌশিক এসে পড়বে তো। হাফিজকে একটা বিনুর জামা পরিয়ে দাও না।
–    বিনুর জামা?
–    দেখো না ভালোমতো কী আছে। বিনু তো সব পরে না।
      সৌমি বিরক্ত হলো না। বলল, দাঁড়াও হালিমাকে ডাকছি।
–    আবার ও-কে ডাকার কী আছে? তুমি যাহোক চয়েজ করে দাও।
      কৌশিক এলো সাড়ে ছ’টায়। সঙ্গে মেয়েকে নিয়ে এসেছে। তার মেয়ের নাম অম্বালিকা। সকলে অমু ব’লে ডাকে।
      রাতুল কেকের বাক্সটা থেকে কেক বের করে টি-টেবিলে রাখল। ওদিকে অমু আর বিনু ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আরাকান কখন সোফার নিচে ঢুকে যাচ্ছে, কখন খাটের নিচে ঢুকে যাচ্ছে। আবার কখনো ঠিক রোবোটের মতো হেঁটে হেঁটে মৃণালের পায়ে ধাক্কা দিচ্ছে। মৃণাল চেঁচিয়ে উঠে বলছে, বাঁচাও। কে আছো আমাকে বাঁচাও। আরাকান আমাকে নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছে।
      মৃনালের নাটক দেখে হাফিজ আর হাসি থামাতে পারে না।
      রাতুল হাততালি দিয়ে বলল, এইবার, এইবার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! সকলে চলে আসুন।
      কেকে ছুরি ছোঁয়াতে সৌমি গান গেয়ে উঠল। তার সঙ্গে গলা মেলাল সকলেই। হালিমা রান্নাঘরে ছিল। এদিকে আসেনি।
      রাতুল বিনুকে বলল, এইবার তোমরা কেক খাও। আমরা বড়োরা ব্যালকনিতে বসছি।
      বিনু বলল, আমি জানি তোমরা কী খাবে।
      মৃণাল আবার নাটক শুরু করল, বাঁচাও। আরাকান আমাকে নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছে!
      সৌমি হালিমাকে ডাকল, তুই ওদের কেকটা খাইয়ে দে’ তো। আমি তোর দাদাদের সঙ্গে বসছি।
      ব্যালকনিতে ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছিল। মৃণাল বলল, যা হাওয়া দু’পেগেই নেশা চড়ে যাবে।
–    চড়ুক না। রাতুল গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, আমি তোকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসব।
–    সে তোমাদের যতই চড়ুক, সৌমি গ্লাসটা হাতে নিয়ে বলল, এখানে বমি করা চলবে না। গতমাসে কি করেছিলে মনে আছে?
      কৌশিক হেসে উঠল, আমাদের মৃণালবাবু আজকাল বমিও করে?
      মৃণাল আর লুকোবে কোথায়! বলল, আজ মৌরুলা মাছ ভাজা নেই?
–    আছে, আছে। সৌমি হালিমাকে ডেকে বলল, ফিশ ফ্রাইগুলো গরম করে নিয়ে আয়।
–    এইবার জমবে! মৃণাল উৎপল দত্তকে নকল করতে গেল।
–    হলো না। সৌমি ভেঙচি কাটল।
      রাতুল বলল, তা কৌশিকবাবু লাইফটা তো খারাপ কাটছে না। খামোকা এতো ঘৃণা পুষে রাখো কেন?
–    তুই কিন্তু আবার পলিটিক্স আনছিস। কৌশিক হাসতে হাসতে বলল।
–    পলিটিক্স আনবো না? এভ্রিথিং ইস পলিটিক্স।
      গরম ফ্রিশ ফ্রাই নিয়ে এলো হালিমা। রাতুল তাকে বলল, তোর ছেলেকে একবার ডেকে দিবি?
–    এখানে?
–    এখানেই ডাক। আমাদের কারো নেশা হয়নি।
      সৌমি বাধা দিল, আবার ও-কে ডাকছ কেন?
–    আহ্, ডাকছি। কারন আছে বলেই ডাকছি।
      হালিমা কী করবে বুঝতে পারছিল না। সৌমির দিকে তাকাল। সৌমি বলল, আচ্ছা, ডেকে আন। আমি আছি। ভয় নেই।
      মৃণাল ফিশফ্রাই-এ কামড় দিয়ে বলল, কোথাকার?
      কৌশিক চুপ করে গেছে।
      হাফিজ আসতেই রাতুল উঠে দাঁড়াল। কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বলল, মিট হাফিজ। বিনুর বেস্ট ফ্রেন্ড। ওরা আজ সকাল থেকেই খেলছে। কী বিনু কেমন লাগছে এখানে?
      বিনু হাবা বালকের মতো চারদিকে তাকাচ্ছে। কী বলতে হবে সে জানে না। সৌমি ও-কে বাঁচালো, এবার যাও বিনু। কাকু তোমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল। তাই ডেকেছি।
      বিনু চলে যেতে কৌশিক বলল, মানে?
–    মানে তো আমরা তোর কাছে জানতে চাইছি।
–    কী জানতে চাইছিস?
–    সারাদিন এতো ঘেন্না নিয়ে থাকিস কীভাবে? এই ছেলেটাকে দেখে তোর টেররিস্ট মনে হল।
–    আহ্ রাতুল, কী হচ্ছে। সৌমি উঠে পড়ল।
      মৃণাল তাকে বসিয়ে বলল, জানাই তো হলো না ফিশফ্রাইটা কোথাকার!
      কৌশিক গ্লাসের তলানিটুকু শেষ করে চুপচাপ বসে রইল।
      রাতুল বলল, কীরে বল্ কিছু।
      কৌশিক বলল, যদি বলি ওর মধ্যে টেররিস্ট হবার সম্ভাবনা আছে, ভুল বলছি কিছু?
–    মানে?
–    মানে তুই জানিস।
      মৃণাল দুজনকেই থামিয়ে দিল। বলল, চলো, বাচ্চাগুলোর সঙ্গে একটু আড্ডা দিই।
      বাচ্চারা তখন খেলায় মশগুল। বিনু বলল, অমু একটা নতুন খেলা শিখিয়েছে। খেলাটা কিন্তু সবাইকে খেলতে হবে।
–    আগে তো বল্ কী খেলা।
–    খুব সোজা। বিনু বলল, অমু বাবাকে বোঝাও না।
      সৌমি হালিমাকেও ডেকে নিল। খেলাটা আর কিছু নয় – কোনো একটি শব্দকে অভিনয় করে দেখাতে হবে। কিন্তু মুখ নাড়া চলবে না।
      ডাইনিং টেবিলের চেয়ারগুলো সরিয়ে জায়গা ফাঁকা করা হলো। প্রথম সুযোগ – বার্থ ডে বয় বিনুর। সে যন্ত্রের মতো হাত-পা শক্ত করে এদিক-ওদিক হাঁটল খানিক।
      সৌমি বলল, রোবোট।
      বিনু দু-দিকে মাথা নাড়ল। হলো না।
      মৃণাল চেঁচিয়ে উঠল, আমি জানি। আরাকান।
      বিনু বলল, ইয়েস।
      এরপর সকলে চেপে ধরল সৌমিকে। উত্তর দিল কৌশিক, মাদার টেরেসা।
      মৃণাল সাজলো, উৎপল দত্ত।
      রাতুল যা করল তা দেখে সকলেই হেসে কাহিল। সৌমি কারোকে চান্স দিল না। বলে ফেলল, রাবণ।
      হাফিজ শুধু হাসছে। কিন্তু খেলতে রাজি নয়। রাতুল ভয় দেখাল, না খেললে বাড়ি যেতে দেব না।
      হাফিজ মায়ের দিকে তাকালো। মা ইশারা করতে তবে উঠল।
      সে দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়ালো খানিক। তারপর সকলের দিকে ফিরল। দু-হাত দিয়ে একটা ত্রিভূজাকৃতির নক্সা তৈরি করল। একবার বসে পড়ল। আবার উঠে হাতের তালু দুটো কাঁপাতে লাগল।
      অমু বলল, ওয়েভ?
      হাফিজ বলল, না।
      মৃণাল বলল, ভূমিকম্প?
      এবারও না।
      বিনু অনেক ভেবে বলল, কেক!
      সবাই হেসে ফেলল।
      রাতুল কৌশিকের দিকে তাকাল। কৌশিক বলল, ফুল।
      সৌমিও চেষ্টা করল। বলল, লকডাউন।
      হাফিজ জানাল সেটাও হয়নি।
      রাতুল হেসে ফেলল, বাপরে এইবার তুই-ই বলে দে’।
      হাফিজ রাজি হলো না। তার ইশারা অত সহজে সে অন্য কারোকে বলবে না।
      অমু ঠোঁট ওল্টালো, ইস, কী বোকা!

       ভেবেছিল সাড়ে দশটা। ঘড়িটা বন্ধ খেয়াল করেনি। বাড়ি থেকে বেরতে তাই এগারোটা বেজে গেছিল হালিমার। রাস্তাঘাট এখন ফাঁকা। সৌমি তাকে বাড়ির জন্য খাবারও পাঠিয়েছে। হাফিজের হাতে রিটার্ণ গিফট – একখানা ডার্ক চকোলেট।
      হাফিজ তার মাকে জিজ্ঞেস করল, এই জামাটা আবার ফেরত দিতে হবে?
      হালিমা ছেলের মাথায় হাত দিয়ে বলল, এইটা ওরা তোকে দিয়ে দিয়েছে।
–    আর নেবে না?
–    আবার নেবে কেন? দেখলি না দাদা-বৌদি কতো ভালোবাসে আমাদের।
      হাফিজ বলল, তাহলে ওরা ভালো, বলো?
      

      হালিমা দূর থেকে দেখে বুঝেছিল ঘরে আলো নেভানো। তারমানে গিয়াসুদ্দিন তখনো ফেরেনি।

Facebook Comments

Leave a Reply