কালিম্পং : ঋদ্ধি রিত
ডিসেম্বর মাস। ঠাণ্ডা বেশ জাঁকিয়েই পরেছে শহরে। রবিবার নিলয়ের ঘরে গরম বেগুনী, মুড়ি, চা আর সিগারেট সহযোগে সাগ্নিকের আড্ডাও তখন জমাটি। দুজনই দুটি সংবাদ পত্রের সাংবাদিক। এইদিন আড্ডায় ঘুরতে যাওয়ার কথাই হচ্ছিলো। নিলয় আর তার স্ত্রী ফারহার দু বছর হল বিয়ে হয়েছে। এখনও পর্যন্ত মধুচন্দ্রিমা করে আসার সময় হয়নি তাদের। সাগ্নিকই এনিয়ে বেশী ব্যাস্ত। সেই মূল উদ্যোক্তা হিসাবে প্রস্তাব করলো কালিম্পং যাওয়ার। আসলে সেও তার বান্ধবী রণিতাকে নিয়ে যাবে, এটা তার কথায় স্পষ্ট। এমনিতে বহুদিন একসাথে ঘুরতেও যায়নি। আর পাহাড় নিলয়ের এমনিতেই প্রিয়। পাহাড়ের প্রতি বাঁকে প্রকৃতিকে নতুন রূপে আবিষ্কার করা যায়। যা মস্তিষ্কের কল্পনা শক্তিকে খানিক পুষ্টিও যোগায় এনিয়ে কোন দ্বিমত অন্ত্যত লেখক কুলের না থাকাই অভিপ্রেয়।
ঠিক হল সপ্তাহান্তে বেরনো হবে। সেই মতো রণিতা টিকিট বুকিং আর থাকার বন্দবস্ত করলো। তিন দিনের ছোট ট্রিপ। পরের শনিবারের রাতের দার্জিলিং মেল ধরা হল। পরদিন সকালে ষ্টেশনে পৌঁছে একটা বড় গাড়িতে উঠে সবাই থাকার বাংলোর দিকে এগোলো। সাগ্নিকই কথা বলে গাড়ির ব্যবস্থা করেছিলো। তার উত্তরবঙ্গে একটু চেনা থাকায় একটু সস্তাতেই গাড়িও পেয়েছে তারা। শুধু ড্রাইভারের থাকা, খওয়া আর তেল খরচ দিলেই হবে।
পাহাড়ি রাস্তার বাঁকের সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে তারা তাদের গন্তব্যেও পৌঁছালো। মহীধরের ঢাল ঘেঁসে ধাপে ধাপে সিঁড়ি, তার একেকটা চাতালে এক একটা টিনের ছাউনি দেওয়া ছোট ছোট কটেজ। শেষ ধাপে কোনের দিকে একটা দোতলা বাড়ি, তার নিচের তলায় সামনের দিকে রিসেপসন, পেছনে ড্রাইভারদের আর কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা এবং ওপর তলায় রান্নার ব্যবস্থা আছে। কটেজগুলোর সামনে ঢোকার মুখে একফালি করে প্যাসেজ। প্যাসেজের পাশে নানা রঙের পিটুনিয়া আর প্যাঞ্জী ফুটে আছে। ধাপগুলোর মাঝে লাল বোগেনভিলিয়া ফুটেছে। আকাশ পরিষ্কার এখন। ঝলমলে রদ্দুরে অনেক দূর অব্দি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ফারহা আর রণিতা দুজন দুটো কটেজে ঢুকলে, নিলয় আর সাগ্নিক বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধয়ায়। ইতিমধ্যে আরেক দম্পতি তারাও উপস্থিত হয়েছে প্রায় তাদের সাথেই। নিলয়দের পরের ধাপে সাগ্নিকদের কটেজ, তাদের পরেরটায় ফাঁকা, তার ওপরেরটা আগত দম্পতিদের, তার ওপরে রিসেপসন বিল্ডিং। সিগারেট প্রায় শেষের দিকে, এমন সময় রণিতা “সাগ্নিক” বলে চিৎকার করে ওঠে।
সাগ্নিক আর নিলয়ও প্রায় ছুটে ঢোকে কটেজে, রণিতা কটেজের জানলার সামনে দাঁড়িয়ে, পেছনে গিয়ে বাকি দুজনও দাঁড়ালো। জানলার বাইরে মেঘমুক্ত আকাশের নিচে সোনায় মোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা। আহা! সাগ্নিক নিলয়কে তার ডিএসেলার আনতে বললে, নিলয় স্বর্ণচূড়ার দিকে তাকিয়েই বলে, “কিছু ছবি শুধুই চোখের লেন্সে তুলে রাখাই ভালো”।
মধ্যাহ্ন ভোজনের শেষ করে দুপুরে খানিক ঘুম দিলো, আসার একটা ধকল গেছে। এমনিতেও ছুটি কাটাতেই এসেছে তারা। বিকালে চারজন সামনাসামনি ঘুরলো। সন্ধ্যের দিকে রণিতাদের কটেজে সবাই আড্ডায় বসলো। সেখানেই রাতের খাবারও দিতে বলা হয়েছিলো। সেসবের সমাপতন ঘটিয়ে চারজন কটেজের বাইরে শীত উপভোগের জন্য প্যাসেজের চিয়ারে এসে বসেছে। এমনিতে ঘরের দরজা জানলা বন্ধ থাকায় ধূম্রসেবনের ফলে ঘরের বাতাস ভারি হয়েছিলো। ফারহা লক্ষ্য করলো, সমস্ত এলাকা কালো চাদরে আবৃত হলেও, কেবল সাগ্নিকদের বাদে ওদের ওপরের কটেজে হাল্কা আলো জ্বলছে। ওই কটেজটি ফাঁকা, তাহলে সেখানে আলো কেন? সে এই ঘটনা বাকিদেরও নজরে আনলো। সে ঘরে কিছু শব্দও হচ্ছে। সাগ্নিক তার উত্তরে জানায়, সম্ভবত আগত দম্পতিরা সে ঘর পরিবর্তন করে এই ঘরে আছে। নিলয়ের যদিও একটু সন্দেহ হলো, কারণ খাবার অর্ডার দিতে যাওয়ার সময়ও সে ওই কটেজে তালা ঝুলতে দেখেছে। তবে সে ভুলও দেখে থাকতে পারে, তাই আর কথা বাড়ালো না।
পরের দিন ঠাণ্ডা আরো জাঁকিয়ে পড়ে। তারা সকালে গাড়িতে ঋষভে ঘুরে ম্যালের দিকে গেছিলো, সেখানেই দুপুরের খাবার সারে। কিছু কেনাকাটাও সারা হয়। সন্ধ্যের দিকে তারা হোটেলে ফেরে। ফিরে আবারো তারা জড়ো হয় তাদের আড্ডার স্থানে। সাগ্নিকদের কটেজে ঢোকার সময় নিলয়ের চোখ পরে পাশের কটেজে, দরজায় তালা ঝুলছে। রাতের খাবার অর্ডার দিতে যাবার সময় ও দিয়ে ফেরার সময়ও নিলয় ও সাগ্নিক দুজনেই ভালো করে তালা বন্ধ দরজা লক্ষ্য করে। কিন্তু তাদের মনে হয় ভেতরে কোন মোমবাতির আলোর মত ক্ষীণ আলো যেন কটেজের ভেতর থেকে আসছে। তারা দুজনে নিজেদের মধ্যে ঠিক করে আজ রাতটা তারা দেখবে, আপাতত কাউকে কিছু জানাবে না। ঘরে ফিরেও দুজন বেশ কয়েকবার সিগারেট খাবার নাম করে বাইরে এসে কটেজটা দেখেছে। তখনও বাকি কটেজগুলোয় আলো ছিলো।
রাতের খাবারের পর কয়েক ঘন্টা কেটে গেছে গল্পে আড্ডায়। আবার গত দিনের মত শব্দ আসছে পাশের ঘর থেকে, চারজন বেরিয়ে বাইরে এসে দেখে পাশের কটেজের আলো বেশ উজ্বল হয়েছে। নিলয় একটা সিগারেট ধরিয়ে সাগ্নিককে বলে, “মার্কস বলেছেন, ডাউট এভ্রিথিং, চলতো দেখি, কি কেস…”।
সাগ্নিক ও নিলয় সিঁড়ি ভেঙে ওপরের দিকে এগোয়। রণিতা একটা সিগারেটে টান দিয়ে বলে, “এরা এখানে মার খাওয়াবে। কোন কাপল এসেছে নিশ্চই, তাদের মাঝে এসব কোন মানে হয়? ফারহা চলো ভেতরে গিয়ে বসি, এই ঠাণ্ডায় এখানে জমে যাচ্ছি”।
পিছনে ফিরে ঘরের ভেতরে যাবার সময় ফারহার মনে হলো কেউ তাদের পাস দিয়ে চলে গেলো, একটা ছায়া সে যেন লক্ষ্য করলো। কিন্তু কাউকে দেখা যায়নি, তাই সেটা মনের ভুল ভেবেই ঘরে ঢুকল।
সাগ্নিক আর নিলয় ঘরের সামনে গিয়ে দেখে দরজায় তালা খোলা, তালাতেই ঝুলছে চাবির রিং। তারা বুঝতে পারলো কেউ ইচ্ছে করে এসই করছে। তারা ওখানে দাঁড়িয়েই ঠিক করলো এর যোগ্য জবাব তারা দেবে। সেইমতো বাইরে থেকে সন্তর্পনে হুড়কো টেনে তালাতে চাবি দিয়ে সেই চাবির রিং নিয়ে রিসেপশনে দিতে যায়। রিসেপশন বন্ধ, সবাই ঘুমোচ্ছে, এমুহুর্তে ডাকাডাকি করলে ‘কালপ্রিট’টিও জেনে যাবে। তাই রিসেপশনের দরজার বাইরে চাবির গোছটা রেখে তারা আবার নামার রাস্তা ধরল। পরের দিন সকালে যে রিসেপশনের দরজার খুলবে সে চাবি পেয়েই যাবে। আপাতত অনাহুত ‘কালপ্রিট’-এর ব্যবস্থা করা গেছে।
নামবার সময় তারা সেই কটেজের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। যে চাবির গোছা তারা এক্ষুনি রিসেপশনের দরজার বাইরে ফেলে এসেছে সেই চাবির গোছ তো এখনও তালায় ঝুলছে। তারা নিজেদের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। সাগ্নিক এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে নিলয়ের হাত ধরে হিড়হিড় করে টান দিয়ে নিজের কটেজে উপস্থিত হলো। তাদের চোখ-মুখের অবস্থা স্বাভাবিক নয়। এই ঠাণ্ডাতেও দুজনে দরদরিয়ে ঘামছে দেখে বাকি দুজন বিস্মিত। ফারহা জানতে চাইলো, “কি হয়েছে তোমাদের?”
নিলয় উত্তরে শুধু বলে, “আজ রাত চারজনেই এক সাথে থাকবো, তাও আমাদের কটেজে, তাড়াতাড়ি চলো”। সেই কথা মতো চারজনেই ফারহাদের কটেজে পৌঁছায়। রাতে মেয়েরা ঘুমলেও বাকি দুজন জেগেই কাটায়। পরদিন এমনিতেই তাদের এনজিপি রওনা হবার কথা।
পরদিন সকালেই কটেজ থেকে চলে যাবার সময় সাগ্নিক আর নিলয় বিল মেটানোর জন্য রিসেপশনে গিয়ে ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে চায়। রিসেপশনের ভদ্রলোক জানান তিনি ম্যানেজার, কিন্তু কি হয়েছে তা জানতে চাইলে নিলয় সংক্ষেপে বিষয়টা জানায়। ম্যানেজার, তখন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে জানান, এটা মূলত একটা কবরস্থান ছিলো। তার ওপরেই পরে এই কটেজ গুলো বানানো। ওই বিশেষ কটেজে প্রথম থেকেই একটু অসুবিধা থাকায় ওটা স্টোররুম করে দেওয়া হয়েছে। ওখানে কাউকে থাকতে দেওয়াও হয় না। শেষে হাত জোড় করে অনুরোধ করেন, একথা বাইরে না বলতে, তাহলে তাদের ব্যবসা লাটে উঠবে।
গাড়িতে এনজিপি ফেরার সময় ফারহা আর রণিতা অনেক সাধাসাধি করলেও সাগ্নিক বা নিলয় আগের রাতের ঘটনা কেউই জানায়নি। বরং তারা ঘুমে ব্যস্ত হয়। কলকাতা ফেরার পর এক রবিবার সাগ্নিকের বাড়িতে আবার চারজন আড্ডায় বসলে নিলয় সে রাতের ঘটনা বাকিদের জানায়।
Posted in: June 2021 - Cover Story, STORY