লাল ঘুঁটি কালো ঘুঁটি : রাণা রায়চৌধুরী
আরশোলা!
চাকুর মতো ধারালো আরশোলা! ততোধিক ধারালো তোর ভয়। ভয় তোকে রোগা রুগ্ন করে তুলছে।
শিবু আরশোলার ভয়ে, জড়োসড়ো হয়ে, গুটিয়ে বিন্দু হয়ে বসে আছে ক্লাবঘরের এক কোণে। আমি শিবুর দাদার দাদা। শিবু জানে আমি ওর থেকেও বেশি ভিতু। আমরা সবাই ভিতু, তাই না? শিবু জিগ্গেস করে।
আমি মনে মনে ভাবি ভয় বোরোলীনের মতো, জীবনের অঙ্গ। এ্যন্টিসেপটিক ক্রিম। ভয়ক্রিম মাখলে অন্যকে ভয় দেখিয়ে বশে রাখা যায়।
কিন্তু আমি যে ভীতু তা বন্ধুর ভাইকে বলবো কেন? জামাকাপড়ের নিচে চাপা থাকে আমার ভয়, আমার আতঙ্ক।
তবু ভয়কে আড়াল করে বরং শিবুকে বলি পুরনো হয়ে যাওয়া, ফুরিয়ে যাওয়া আমার প্রাচীন সাহসের কথা – মর্গ থেকে আমার আত্মহত্যা করা মাসির লাশ বা দেহ বা ডেডবডি আমিই বুড়ো আঙুল চিনে শনাক্ত করেছিলাম। মর্গ বলে কথা। খুব সাহস লাগে। শিবু ‘মর্গ’ বুঝতে না-পেরে মুখে চুকচুক আওয়াজ করে। আসলে শিবু মর্গের থমথমে আতঙ্ক দেখেনি।
আমি শিবুকে মর্গ বোঝাই। লাশ বোঝাই। লাশ মানুষের হয়। গাছের লাশ হয় না।ছাগলের লাশ হয় না, জলের লাশ হয় না।
আমরা আসলে তো মর্গেই আছি। দ্যাখ আমরা কেমন ছিন্নভিন্ন লাশ! শিবু বোকার মতো – বালকের ভয় হাতে – আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি বলি দ্যাখ আমরা ছিন্নভিন্ন, আমরা বিচ্ছিন্ন। আমাদের হাত নেই পা নেই মন নেই। কেউ আড়াল থেকে সবসময় আমাদের ছিন্নভিন্ন করছে। এই দ্যাখ শিবু আমার/আমাদের তোর ও আমার বুক-পেট চেরা। কিডনি লিভার কেউ নিয়ে গেছে। কে নিয়েছে আমি জানি না। আসলে আমি তুই আমরা সবাই একটা জড়। অসার একটা স্থির সমুদ্রের নিচে ডুবে আছি যেন। এই যে শিবু তুই কিন্তু ক্লাবঘরে ক্যারাম খেলছিস না আমার সঙ্গে। আমরা দু’জন আসলে ভয়কে নিয়ে খেলছি। সাদা ভয় কালো ভয় লালভয়কে আমরা টিপ করছি, কিন্তু মিস হচ্ছে। সাদাভয় কালোভয় পকেটে যাচ্ছে না। খালি ঘুরপাক খাচ্ছে তোর আর আমার মনে।
একটা অচেনা – অন্যরকম – ভয়ঙ্কর এক ধারালো আরশোলার ভয়ে সরতে সরতে শিবু তুই একটা অজানা ঠাণ্ডা ক্যারামবোর্ডের ভিতর লুকিয়ে পড়তে চাইছিস। আমিও একটা সবুজ, একটা লাল, একটা কমলা, একটা গেরুয়া রঙের ভয়ের থেকে পালিয়ে – শিবু তুই আমার বন্ধুর ভাই – আমি তোর বয়সের ভিতর লুকিয়ে পড়তে চাইছি।
শিবু আমি ছোট হয়ে গেছি। তোর বয়সের সঙ্গে লুকোচুরি খেলবো। শিবু তুই কোথায়? তুই আমার মতো বড়ো হয়ে গেছিস? তুই এখন আর মর্গকে ভয় পাস না? ওমা তুইই তো দেখছি আমার পায়ের বুড়ো আঙুল চিনে আমার লাশ শনাক্ত করছিস! শিবু তুই এখন লাশ বুঝিস?
শিবু তুই আর আরশোলাকে ভয় পাস না?
পাস? আসলে আমরা নিজেরাও জানি না কোন ভয়কে আমরা ভয় পাই, আর কোন ভয়কে আমরা ভয় পাই না! তাই না?
দূরে কাছে খুব জোরে বাজ পড়ল কোথাও। করকর করকর শব্দ।
একটা ক্যারামবোর্ডের ওপর আমরা দুই ভয়ার্ত খেলোয়াড় অর্ধমৃত পড়ে আছি রং বেরঙের লাল সাদা কালো ঘুঁটির পাশে।
Posted in: June 2021 - Cover Story, STORY