শংকরাচার্য্যের মায়াবাদ: ধারে কাটে কি ভারে! : রঞ্জন রায়
প্রস্তাবনা
[অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ভারতীয় দর্শনের আধুনিক যুক্তিসিদ্ধ বিশ্লেষণের নিষ্ঠাবান পথিকৃৎ। আমরা পেরিয়ে এসেছি তাঁর জন্মশতাব্দী। তিনিই প্রথম জোর দিয়ে বলেন যে আমাদের ঐতিহ্যবাহী দার্শনিক স্কুলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জীবনবিমুখ হল শংকরাচার্য প্রণীত অদ্বৈত বেদান্তদর্শন যাকে আমরা সবাই মায়াবাদ বলে জানি।
আজ যখন গোটা দেশ জুড়ে ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নামে কেবল হিন্দুধর্ম, এবং একপেশে ভাবে তার একটা খন্ডিত বিকৃত রূপের প্রচার হচ্ছে তখন একটা কথা বারে বারে হাটেবাটে শোনা যাচ্ছে, তা’হল ‘সনাতন হিন্দুধর্ম’। কাজেই জরুরি হয়ে পড়েছে ওই ‘সনাতন হিন্দুধর্ম’ নামপদটির প্রচারক শংকরাচার্য্যের দার্শনিক উপস্থাপনা ‘মায়াবাদ’ কতটা যুক্তির কষ্টিপাথরে টেঁকে সেটা খুঁটিয়ে দেখা। সেই অর্থে এই সামান্য প্রবন্ধটি এক অর্থে অধ্যাপক দেবীপ্রসাদকে আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।]
মনে করুন, আগামিকাল অফিসে গিয়ে দেখলেন –– সব কিছু বদলে গেছে। ওটা আর আপনার চেনা অফিস নেই, হয়ে গেছে একটা রেস্তোরাঁ বা মল; কেমন লাগবে? ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল! গিয়ে জানতে পারলেন আসলে কোন একটা ভুলে আপনি ভুল নামে ভুল ঠিকানায় ভুল অফিসে এতদিন চাকরি করেছেন। এমনকি আপনি এতদিন নিজেকে যা ভাবতেন আদতে তাও নন। আপনার নাম-গোত্র-পিতৃমাতৃপরিচয় সব আলাদা।কম্পিউটারে আপনার বায়োডেটা, আইডিনটিটি, সিভি সব পালটে গেছে।
এতদিন ঘুমঘোরে ছিলেন, এখন জেগে উঠলেন। তারপর? হয় পাগল হয়ে যাবেন, নয় আত্মহত্যা করবেন!
আরেকটা তৃতীয় পথ খোলা আছে –– জানতে চাইবেন আসলে আপনি কে? কোনটা আপনার সঠিক পরিচয়—আগের আপনি, নাকি আজকের? কিন্তু আগে তো ঠিক করতে হবে সঠিক/বেঠিক নির্ণয়ের পদ্ধতি কী হবে, কী করে বোঝা যাবে কোনটা ভুল আর কোনটা নিশার স্বপন? তাও নাহয় হলো, এরপরে জানতে চাইবেন এই বিভ্রমের জন্যে দায়ি কে? আপনি নিজে? নাকি অন্য কেউ? যদি নিজে হন, তো এর কারণ কি আপনার মধ্যেই নিহিত, যেমন ব্রেনে টিউমার বা চোখে ছানি-অথবা বাইরের কোন শক্তি যা আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে?
এই তৃতীয় পথটি দর্শনের ছাত্রের পথ।
এতসব ভণিতা কেন করছি? কারণটা হল ভারতে বেদে আস্থাবান ছ’টি ‘আস্তিক’ দর্শনের[১] মধ্যে একটি ঠিক এমনই কথা বলছে—ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। বলছে আপনার চারদিকের যে নামরূপের জগৎ তা আসলে অস্তিত্বহীন, একটা বিভ্রম বা মিথ্যে। ঠিক যেমন আলো-আঁধারিতে আমরা রজ্জুতে সর্প দেখে আঁতকে উঠি বা মরুভুমির উতপ্ত বালুতে সরোবর দেখে খুশি হই। একটু পরে ভুল ভেঙে যায়।
এই দর্শনটির নাম অদ্বৈত বেদান্ত । এর প্রবক্তা হলেন আদি শংকরাচার্য, যদিও এই দৃষ্টিভঙ্গী ওঁর আগে বেদবিরোধী বৌদ্ধদর্শনের মহাযানী শাখার দুটি স্কুল—শূন্যবাদ ও বিজ্ঞানবাদে বিকশিত হয়েছে।তাই ওঁর অদ্বৈত বেদান্ত মতকে অনেকে ‘প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধমত’-ও বলে থাকেন।
ভারতে হিন্দু সমাজে সনাতন ধর্মচর্চার আজ সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক স্কুল হল এই অদ্বৈতবেদান্ত।
এই দর্শনের মূল কথাটা—‘এ সংসারটা ধোঁকার টাটি’ যদি মেনে নেই তাহলে আমাদের দেশ-কাল-সমাজ-ইতিহাস, আমাদের সুখ-দুঃখ, দৈনন্দিন জীবনসংগ্রাম সব তুচ্ছ অকিঞ্চিৎকর হয়ে যায়। আমাদের বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে যায়। ‘কা তব কান্তা, কস্তে পুত্রাঃ’ অর্থাৎ ‘কে তোমার প্রিয়া, কে তোমার সন্তান’ ভাবলে আমাদের বাস্তব জীবনে দুঃখের নিদান খোঁজা অর্থহীন।যখন বাস্তবে বাহ্যজগতের অস্তিত্বই নেই তবে কিসের দুঃখ, কিসের জীবনসংগ্রাম? মাথাই নেই তো মাথাব্যথা!
মানুষ এই জীবনকে একটা স্বপ্নের ঘোরে থাকা ধরে নিয়ে অপেক্ষা করবে কবে তার মোহমায়া থেকে মুক্তি মিলবে।
কাজেই একটু খুঁটিয়ে দেখতে চাই যে শংকরের ‘মায়াবাদ’ দার্শনিক স্তরে কতটা যুক্তিসম্মত।
শংকরের মায়াবাদের মূল বিন্দুগুলো:
ব্রহ্ম কী?
শংকরের মায়াবাদ নামের দার্শনিক তত্ত্বকে এককথায় বলতে গেলে দাঁড়ায়ঃ “ব্রহ্ম সত্য জগন্মিথ্যা জীবোব্রহ্মৈচ নাপরঃ”।[২]
অর্থাৎ, উপনিষদে বর্ণিত ব্রহ্ম হলেন একমাত্র সত্য, একমাত্র অস্তিত্ববান; অন্য কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। আমরা চর্মচক্ষে যে বিশ্বব্রহ্মান্ড দেখি তা অবাস্তব, সাময়িক, ক্ষণস্থায়ী; আদৌ স্থায়ী শাশ্বত সত্যবস্তু নয়। জীব বা ব্যক্তি আত্মা সেই এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্মের থেকে অভিন্ন, তার কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই।
ব্রহ্ম হলেন অনাদি অনন্ত। তাঁর জন্ম-মৃত্যু নেই। তিনি নিরাকার ও নির্গুণ। তিনি সচ্চিদানন্দ, অর্থাৎ একমাত্র সত্য ও বিশুদ্ধ চেতনস্বরূপ।[৩]
সত্যি ও মিথ্যের মাপদন্ড কী ? কেন শুধু ব্রহ্মই সত্য, আর সব মিথ্যে?
যা সময়ের সঙ্গে বদলে যায়, যার অস্তিত্ব ক্ষণিক, অর্থাৎ যা উৎপন্ন হয়ে আবার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় তা’ অন্তিম বিচারে অসত্য বা মিথ্যে। তাই এই নামরূপের পরিবর্তনশীল জগত হল মিথ্যে। যেমন দড়িকে সাপ ভেবে ভয় পাওয়াটা ক্ষণস্থায়ী। একটু পরে ভুল ভেঙে যায়। দড়ি আগে যা ছিল, পরেও তাই থাকবে। এখানে দড়ি হল সত্য, সাপ হল মিথ্যা।
আর যার জন্ম-মৃত্যু নেই, যা উৎপন্ন ও ধ্বংস হয় না, যা শাশ্বত তাই হল সত্যি। তাই নির্গুণ ব্রহ্ম হল একমাত্র সত্য। তাই একে কোন গুণ বা উপাধি বা বৈশিষ্ট্যে বেঁধে ফেলা যায় না।কারণ সমস্ত বিশেষণ গুণদোষ- সব সীমাবদ্ধ, সব পরিবর্তনশীল ।
এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের স্রষ্টা কে?
নির্গুণ ব্রহ্ম আদৌ কোন এক ক্ষণে এই ব্রহ্মান্ড বা জগৎ সংসার এসব সৃষ্টি করেন না, এবং কোন বিশেষ মুহুর্তে ধ্বংসও করেন না। যা সৃষ্টি হয়নি তার ধ্বংসের প্রশ্ন অবান্তর। এই বিশ্বের আসলে কোন অস্তিত্ব নেই। এর মায়াবী অস্তিত্ব রয়েছে শুধু জীবের আবিল বা ময়লা হয়ে যাওয়া চেতনায়।
অর্থাৎ, প্রচলিত অর্থে সৃষ্টি বা ধ্বংস বলতে যা বুঝি তা বাস্তবে হয় না। যা হয় তাহল একটা ধোঁকা, একটা বিভ্রম।
অবিদ্যার প্রভাবে আমাদের মলিন চেতনায় এই মায়ার সংসারের বিভ্রম নির্মিত হয় এবং সত্য জ্ঞান হলে মায়ার কাজল মুছে গিয়ে চোখের থেকে পর্দা সরে যায়। তখন বুঝি এ’বাহ্যজগত বাস্তবে অস্তিত্বহীন। এ রয়েছে আমাদের খন্ডিত চেতনায়। যেমন দড়ি দেখে সাপ ভেবে ভয় পেলাম। তারপর যেই কাছে গিয়ে ভাল করে দেখলাম যে ওটা সাপ নয়, আসলে দড়ি—অমনই ভয় কেটে গেল।
[ক্রমশ…]
________________________________________________________________________________
তথ্যসূত্রঃ-
[১] ভারতীয় পরম্পরায় ‘আস্তিক’শব্দের অর্থ বেদে আস্থাবান, দর্শনটি ঈশ্বরবিশ্বাসী হোক বা না হোক। তাই বেদকে নির্ভুল বা স্বতঃপ্রমাণ মানে যে ছয়টি দর্শন—সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, পূর্বমীমাংসা ও উত্তর মীমাংসা (বেদান্ত) হল আস্তিক দর্শন। যদিও এদের মধ্যে সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক ও পূর্বমীমাংসা নিরীশ্বরবাদী; কিন্তু বেদান্ত বা উত্তরমীমাংসা ঈশ্বরবাদী। বলা যেতে পারে যে ন্যায় সৃষ্টির আদিকারণ বা ‘মেটিরিয়াল কজ’ হিসেবে ঈশ্বরকে স্বীকার করে না বটে, কিন্তু নিমিত্তকারণ বা ‘এফিশিয়েন্ট কজ’ হিসেবে স্বীকার করে।
অথচ তিনটে দর্শন -চার্বাক, জৈন ও বৌদ্ধ- শুধু বেদবিরোধী বলে নাস্তিকের তকমা পেয়ে গেল।
[২] বীরেশ্বরানন্দ সম্পাদিত ‘ব্রহ্মসূত্র”(শাংকরভাষ্য),অধ্যাস, পৃ ১,(অদ্বৈত আশ্রম প্রকাশিত)।
[৩] বিভিন্ন উপ্পনিষদ যেমন বলছেঃ-
“ব্রহ্ম হলেন সত্য,জ্ঞান ও অনন্ত”,(তৈত্তিরীয় উপনিষদ,২.১.১)।
“ব্রহ্ম হলেন জ্ঞান ও আনন্দস্বরূপ”,(বৃহদারণ্যক উপনিষদ,৩.৯.২৮)।
“হে শ্বেতকেতু, তুমিই ব্রহ্ম -তত্ত্বমসি”(ছান্দোগ্য,৬.৮.৭)।
“আমিই ব্রহ্ম—অহম ব্রহ্মোস্মি”(বৃহদারণ্যক, ১.৪.১০)।
শেষ দুটো বর্ণনার অর্থঃ ব্যক্তি জীব ব্রহ্মের থেকে আলাদা স্বতন্ত্র কিছু নয়। সম্যক জ্ঞান হলে আমি-তুমি-পরব্রহ্ম সব এক এবং অভেদ।
______________________________________________________________________
[লেখক – জন্ম কোলকাতায়; গ্রামীণ ব্যাংকের চাকরিসূত্রে ছত্তিশগড়ের গাঁয়ে-গঞ্জে বনেবাদাড়ে কয়েক দশক ধরে ঘুরে বেড়ানো। অবসর জীবন কাটে বই পড়ে, লেখালিখি করে।
প্রকাশিত বই: বাঙাল জীবনের চালচিত্র (গাঙচিল); রমণীয় দ্রোহকাল (লিরিক্যাল); দেকার্তঃ জীবন ও দর্শন (অনুষ্টুপ); যে আঁধার আলোর অধিক (সৃষ্টিসুখ); ফেরারী ফৌজ (ঋতবাক); ছত্তিশগড়ের রূপকথা (ঋতবাক); শহুরে ছত্তিশগড়ের গল্পগুচ্ছ (ঋতবাক); ছত্তিশগড়ের চালচিত্র (সুন্দরবন প্রকাশন); আহিরণ নদী সব জানে (জয়ঢাক প্রকাশন); তিনটি রহস্য গল্প (জয়ঢাক প্রকাশন)।]
Posted in: ARTICLE, June 2021 - Serial