ভয়? : প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
IRREAL—শব্দটিকে বড়ো হাতের অক্ষরে লিখেছেন জিজেক। অতঃপর খুল্লমখুল্লা জানিয়েছেন যে মানুষ এক “fake’ ভোগবাদী দুনিয়ার নাগরিক। বিশাল এক মেগা-কম্প্যুটারের সহযোগিতায় তৈরি অপার্থিব, অসৎ ও বস্তুবাদী দুনিয়ায় আমাদের বসবাস। আমরাই নাকি —ম্যাট্রিক্স সিনেমার (১৯৯৯) নায়কের মতো ‘আস্লি বাস্তব’ দুনিয়ায় জেগে উঠে ‘ডেজার্ট অব দি রিয়্যাল’–এর পরিত্যক্ত ধ্বংসাবশেষটি দেখতে পাই। স্ল্যাভোজের এই লেখাটির সঙ্গে দুরন্ত সঙ্গত করেছেন জর্জিও আগামবেন। লিখেছেন : “আমরা এখন এক চিরস্থায়ী জরুরি অবস্থার মধ্যে বসবাস করি, যেখানে ভয়ানক কোনো বিপদের কথা পাড়লেই তা ট্রাম্প-কার্ডের মতো কেবলমাত্র গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোকেই ট্রাম্প করার=(নিকেষ করার?)—ব্রহ্মাস্ত্রটি নিক্ষেপ করে”। ২০২০-র মার্কিনী গণতান্ত্রিকতার হাল-হালাতটিকে নাজি জার্মানির সঙ্গে তুলনা করে জঁ পল সার্ত্র-র অ্যান্টি-সেমাইট এণ্ড জিউ’ (১৯৪৪) প্রবন্ধটির প্রসঙ্গ পেড়ে জুডিথ গ্রীনবার্গ লিখেছেন—“ট্রাম্প ম্যানুফাকচারস অ্যাংজাইটি”। অর্থ হয়—ভয় উৎপাদনযোগ্য। এবং,‘বিক্রিযোগ্য’ বলেই ভয়াবহতা উৎপাদিত হয়। একুশশতকীয় আমাদের অতি-আধুনিক মনের বাঁধুনিটিও এমনই পলকা যে এসময়ের বেশিরভাগ ‘ভয়’গুলোকেই যেন অতি আবশ্যিকভাবেই নেতিবাচক ও ভয়ঙ্কর হতে হবে। এমনও ভাবি যে অধিকাংশ ভয়কেই বহুপ্রসূও হতে হবে। ‘বিয়িং হিউম্যান’ যাপনচিত্রের এমন এক পটভূমিকাকে সামনে রেখে নোবেলবিজয়ী নাইজিরীয় লেখক ওলে সোয়িঙ্কা বলছেন যে বিশ্বমানবতার উচিত আমাদের চারপাশে ঘিরে থাকা ভয়ের আবহাওয়াটিকে নির্মূল করে ফেলা । সেই কব্বে পড়েছিলাম মানি বিগেটস্ মানি। তারই একটি নিখুঁত প্রতিলিপি বানাই তবে: “নিরাপত্তা-সুরক্ষা-প্রতিরক্ষা“ প্রভৃতিরা সব ভয়ের সন্তান। উপস্! মূল বিষয়ে ঢোকার দারুণ এক সূত্র পেয়ে গেলাম আমি; টাঙ্গিয়ে রাখলাম প্রারম্ভিক কিছু জিজ্ঞাস্যঃ—
প্রশ্ন – ভয় কয় প্রকার ও কী কী ?
উঃ- স্যর,ভয় মাত্র একপ্রকার। যা কেবলমাত্রই মানসিক।
প্রশ্ন- অর্থাৎ ?
উঃ- ভয়ের অন্য কোনোও শাখা অফিস নেই। ভয়ের কোনো নির্দিষ্ট আকার–প্রকার নেই। ভয় দৃশ্য নয়, সচরাচর। এবং
ভয় স্বয়ম্ভূও নয়। ভয়ের আত্মপ্রকাশের জন্য একটি মাধ্যম,অর্থাৎ,—মিডিয়াম বা এজেন্ট ‘অতি’ আবশ্যিক। ভয়
ও ভূত, বস্তুত, একই গোত্রীয়। একটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ তোলা দরোজা চাই, নিভু নিভু জোছোনারাতে গাছ থেকে ঝুলে
পড়া সাদাশাড়ি চাই; ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না জাতীয় জল-অচল ভয়বিহ্বল সামাজিকতা চাই, বস্তুত, ভয় পাওয়ার জন্য রজ্জুতে
সর্পভ্রমও পারমিসিবল ইত্যাদি প্রভৃতি। সারকথায়, জল যেমন চিবিয়ে খাওয়া যায় না, ঠিক তেমনি—ভয় না পেলে
ভয় পাওয়ানোও যায় না। ১৯৪৯ সালের আগে মাউণ্ট এভারেস্ট একটি শ্রদ্ধা-মিশ্রিত ভয় ছিল; শির নেহারি ওই
শিখর হিমাদ্রির সামনে নতশির হইত আ-বিশ্ব মানবসমাজ; আজ সেখানে নিত্য-নোঙ্গর ফ্যালে ঢেরগুচ্ছের সাহসী
পাখিডানা। বাড়ি থেকে মোট্টে বেরোবেন না। আই মীন—ঝড় ফুরোবার আগে নিজ নিজ ঘরেই থাকুন। ছাড় আছে
কেবল চিত্র-সাংবাদিকদের। উপ্স! অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল পাশের বাড়ির এক agoraphobic লোক। অর্থাৎ, এমন
এক ব্যক্তি, সাতজন্মে যিনি ঘরের বাইরে পা রাখেননি। (উইকিপিডিয়ার ভাষায় ও তুয়ান ই ফিউ-য়ের কথায়)
এমনধারার মানুষেরা নিজের বাটীটি ছাড়িয়া ভিড়ভাট্টায় আদপেই ভেড়েন না। কেননা, সেখান থেকে নিষ্কৃতি
পাওয়া (agoraphobic-এর মতে) খুবই কঠিন। এমন এক নন্দলাল-এর কাছে নিজের বাড়ীটিই হল সবচেয়ে
নিরাপদ স্থল। সাফকথায়, প্রমাণিত হইল যে ভয় একটি মানসিক ব্যাধি? বছর পাঁচেক আগেই লিখেছিলামঃ—
“ভয়কে ভয় পেতে থাকি যদি ভয় ক্রমে ভয়ানক হয়ে ভয় দেখাতে দেখাতে থাকবে ভীতি-
ভাব দাবিয়ে রাখতে তাই জল চিবিয়ে খাওয়ার মতোই সচেষ্ট হই, ঠিক এসময়ে
সবচেয়ে হাবাগবা, সুপরিচিত লোকটাকে দেখে ফেল্লাম
মন-মগজের নিজস্ব আয়নায়…”
(‘চার বছর অন্তর একদিন লিপ-ইয়ার’—সাদামাটা কালোস্লেট,২০১৬) ।
তা সে নজর টানার জন্যই হোক কিংবা একটিমাত্র শব্দের ওজনদার কারিকুরিতে ঘোর অবাস্তবতাকে আরো খানিক ভীতিজনক ঢঙ্গে পেশ করার জন্যই হোক—IRREAL—শব্দটা বসিয়েই ‘দি ট্রুম্যান শো’ (১৯৯৮) নামের এক চলচ্চিত্রের কথা পেড়েছেন জিজেক। এই ট্রুম্যান প্রাক্তন ইউ.এস প্রেসিডেন্ট নন। এবং এই ট্রুম্যান নিশ্চিতই ট্রুম্যান ডক্ট্রিনের-ও কেউ নন। কিংবা উপন্যাস-লিখিয়ে ট্রুম্যান কাপোতেও নন। এমনকি, ছোটবেলার স্ক্র্যাপবুকের নায়ক ফাস্ট বোলার ফ্রেডি-ও নন। তিনি হলেন হলিউডি সিনেমার এক নায়ক, যিনি বিশ্বাস করেন যে তিনি একটি ‘ফেক’ পৃথিবীর বাসিন্দা। তার চারপাশের লোকগুলোও আদতে পাক্কা অভিনেতা কিংবা এলেবেলে অতিরিক্তের দলবল। জিজেক এরপর ‘টাইম আউট অফ জয়েন্ট’ নামে আরও একটি সিনেমার (১৯৫৯) নায়কের কথা পেড়েছেন। সেই নায়ক ভাবতেন তাঁর বসবাসের শহরটাই যেন তাঁকে খুশি রাখার জন্য ’বানানো’ হয়েছে। জিজেক বলছেন এইসময়ের ভোগবাদী ধনতন্ত্রের ক্যালিফোর্নিয়ান স্বর্গের সামাজিক বাস্তবিকতা নাকি এইধরনেরই—‘somehow acquires the features of a staged fake [real social life] …the ultimate truth of the capitalist utilitarian de-spiritualized universe… the de-materialization of the ‘real life itself,its reversal into a spectral show’. (‘ওয়েলকাম টু দি ডেজার্ট অফ দি রিয়েল ’-স্লাভোস জিজেক)। দাঁড়াও পথিকবর! জিজেক যতই ‘spectral show’ বা ভূতুড়ে দেখনদারি-র কথা বলুন বা তাঁর মন্তব্যের মূল সুরটি যতই সাররিয়াল বা irrreal = (সারবত্তাহীন, বস্তুবাদী অলীককথা) হোক, ভয় পাবেন না প্লিজ—১৭ শতকের বিশ্বখ্যাত দার্শনিক John Locke মন্তব্য করেছিলেন— ‘fear is “an uneasiness of the mind,” স্বেণ্ডসেন লার্স-ও প্রশ্ন তুলেছেন যে সাধারণত যে বিষয়গুলোর সম্বন্ধে আমরা ভয় পাই, পেয়ে থাকি—তার সবকটিই কি ভয় পাবার যোগ্য?
বৃহস্পতিবারের বারবেলা, পয়লা জানুয়ারি, ২০০৯। দুপুর ১টা । ওয়াশিংটন ডিসি থেকে উড়ানের জন্য AirTran flight 175 একেবারে প্রস্তুত । CNN-ওয়াশিংটনের সূত্র উল্লেখ করে উলি লেঙ্কে ও দানিয়েলা তানা স্মিথ জানিয়েছেন যে যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন আতিফ ইরফান, তাঁর ভাই কাশিফ ইরফান, এক বোন আর তিনটি শিশু; বয়স যথাক্রমে ৭, ৪ আর ২। প্লেনের ভেতরে সিট খোঁজার সময়ে তাঁদের বলতে শোনা যায় ‘সবচেয়ে সেফ জায়গা কোনটা ?’ প্লেন ছাড়ার পূর্বনির্দিষ্ট মুহূর্তটি এগিয়ে এসেছে। উড়োজাহাজের ক্যাপ্টেন বেরিয়ে এসে ১০৪ জন যাত্রীদের সবাইকে নেমে যেতে বললেন। যাত্রীদের সুরক্ষা বিবেচনার্থে প্যাসেঞ্জার, বিমানকর্মীবৃন্দ ও ব্যাগেজ পরীক্ষা হয়ে যাবার পর ৯৫ জনকে প্লেনে চড়ার অনুমতি দেওয়া হয়। প্লেনের ভিতরে ‘সেফ’ জায়গা খোঁজায় আগ্রহী ওই যাত্রীদের অনুমতি দেওয়ার বদলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। সহযাত্রীরা ‘safe’ শব্দটি নিজের কানে শুনেছিলেন। ফলে, নিজেদের সুরক্ষা বিষয়ে তাঁরা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। (দ্রষ্টব্য, কালচার অব ফিয়ার)। নিজেকেই প্রশ্ন করি—ভয়ের চরিত্র কি?
ভয় আদতে একটি কমোডিটি। মাইক্রোস্কোপ লাগে না, খালিচোখেই নজরে পড়ে যে ভয়ের সূত্রেই আদতে মানুষ মানুষকে কাছে টেনে নেয়; ভয়ার্তজনই আরো এক মানুষের পাশে দাঁড়ায়। আর এই রীতিটি বহুলপ্রচলিত, আবিশ্বচর্চিত সামাজিক প্রক্রিয়া। এবং সেই পথ ধরেই তো আজ সামাজিক সুরক্ষা-র উদ্ভব। সেই সূত্রেই তো কোয়ারান্টাইন। সেই সূত্রেই নিজেকে দূরে রাখার প্রয়াস = যদি আমার থেকে আরো ছড়িয়ে পড়ে, আক্রান্ত হয় কেঊ!! সেই সূত্রেই—সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় ঢের ঢের দেশের ‘গণতান্ত্রিক’ যূথবদ্ধতা কিংবা করোনাযুদ্ধের সম্মুখসমরে রেড ভলান্টিয়ার্স-এর সলতে পাকানোও তো তেমনই এক অনুভব। এককথায়, প্রত্যেকে আমরা সকলের তরে। বাট্রান্ড রাসেল-এর ‘an outline of intellectual Rubbish’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন স্বেণ্ডসেন লার্স—“Fear is the main source of superstition, and one of the main sources of cruelty. To conquer fear is the beginning of wisdom.’। পাশাপাশি উল্লেখ করেছেন মনোবিজ্ঞানী অ্যাডাম ফিলিপস-এর ছোট্ট গল্পঃ—‘লন্ডনের বাড়ীর বাইরে গমের দানা ছড়াচ্ছিল একজন মোল্লা। এক ইংরেজ তাকে কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে বলেছিল যে বাঘ যাতে না আসে সে কারণে সে গমের দানা ছেটাচ্ছে। ইংরেজটি বলল লন্ডনে তো কোনো বাঘ নেই। প্রত্যুত্তরে মোল্লাটি বলল তাহলে তো মানতেই হয় যে দানা ছেটানোয় কাজ হচ্ছে।’ (সূত্র-‘A philosophy of Fear’)।
‘শতশত বৎসর ধরে ইওরোপের প্রধান খেলা ছিল মানুষকে কুচিয়ে টুকরো টুকরো করা। ১৯৪৫-এ এটা বন্ধ হওয়ার কারণ গণতন্ত্র বা একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ব না জাতীয় ফ্যাশানদুরস্ত রুচিসম্মতি গোছের কিছু নয়…আসলে [রাষ্ট্রনায়কদের] প্রত্যেকেই বুঝতে পেরেছিলেন এর পরের বারের ওই খেলাটিই হবে পৃথিবীর শেষ খেলা।’(লেখক—নোম চমস্কিঃ “দি নিউ ওয়ার এগেনস্ট টেরর (সূত্র; কালচার অব ফিয়ার)। তাহলে কি ভয়েরই মধ্যে ভয়ের বাসাবাড়ি? তাহলে তো ভয়ই হল একটি কসমোপলিটান খণ্ডহর । কতো রকমের ভয় থাকে সেই স্যানাটোরিয়ামে—রাজনৈতিক, আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, চারিত্রিক, ব্যক্তিক-সামূহিক…কতশত বোর্ডার। একুশের একবিশ্বে ভয়ই এখন একমাত্র রুগণাবাস। বিশ্বব্যাপী—‘সবেধন’ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। অনুবীক্ষণ লাগালেই নজরে পড়বেই যে ভয়ও মানুষের মতো প্রায় নিত্যদিনই পোষাক পাল্টায়। কখনো তার গায়ে চড়ে লাল টুকটুকে সামাজিক জামা। রক্তের রঙের সঙ্গে মিল রেখে পরের দিন ঘননীল ‘অর্থনৈতিক’ পিরান। তিন নম্বর দিনে রংবেরঙ্গের এক্সট্রালার্জ ফিট টু অল স্কার্ট-ডেনিম-ধম্মোফতুয়া ওর্ফে নামাবলি-ফেজটুপি-আলখাল্লা।
“যেমনটি ছিল, এখনো তেমনই—আমাদের সমাজব্যবস্থা—খুবই, প্রভুত্বব্যঞ্জক। পুতিন আর রাশিয়া, বেলারুশ আর লুকাশেঙ্কো। এগুলো এখন একটি যুদ্ধ-সমাজ ।…যুদ্ধবিগ্রহকে সুন্দর ভেবে নেয় বা বীরত্বের বিষয় মনে করে । ভেবে নেয় এটাই পুরুষ হিসাবে করণীয় সর্বসেরা এক কাজ। কিন্তু একজন নারীর জন্য যুদ্ধ এক ভিন্ন জিনিস। যুদ্ধ হচ্ছে হত্যা। আর এমন এক নতুন দৃষ্টিকোণের জন্য তোমায় নতুনভাবে ভাবনাচিন্তা করে প্রশ্ন সাজানো জরুরি। হত্যা করার অর্থ কিছু আছে কি? একজন মহিলার যুদ্ধরত হওয়ার অর্থ কী? মহিলাদের কাছে যুদ্ধের রঙ ভিন্ন হয় কীভাবে? কাউকে হত্যা করে একটি মানুষ কীভাবে এতো খুশি হতে পারে? আমি হয়ত জিজ্ঞাসা করতাম – ‘এতো খুশি কীসের? মানুষটাকে মারার অধিকার কীভাবে হাসিল করলে?’ — উদ্ধৃতিটি স্বেতলানা অ্যালেক্সিভিচের কলম-নিঃসৃত প্রশ্ন-শস্ত্র! তেল থাকলেই হয় না। সলতেটি উস্কেও দিতে হয়। ভয়ও তেমনই। রাষ্ট্র যদি ভয়ের মাধ্যম বা বাহক হয় তখন তাকে রাষ্ট্রিক ভয় বলা যেতে পারে। যেমন ধরা যাক যুদ্ধ, মহামারী,দেশ-ভাগ, নাসবন্দি, এন-আর-সি, এমারজেন্সি-তথ্যবিলুপ্তি ইত্যাদি-প্রভৃতি। ভয় যখন ত্রাস, তখন নির্বিবাদী ইহুদি-নিধন। ভয় যখন স্মৃতি, তখন দিকে দিকে শহীদ-বেদীর রীতি—গড়ে ওঠে ঢেরগুচ্ছের মিউজিয়ম-স্মৃতি।‘ডর লাগে তো গানা গা’ : গুয়ান্তানামোর গুহায় বসে তাঁরা (আই মীন, সন্ত্রাসবাদীরা) লিখেছেন কবিতা। বিশ–শতকের চারের দশক থেকেই স্থানে-অস্থানে হাজির হচ্ছে ‘ভয়’। অনাগত ভবিষ্যতের সাম্প্রদায়িক পরিবেশে কি হবে, কী হতে পারে—কেবল সেই অনুমানের ভিত্তিতে একটা দেশের মানুষ হাজার বছরের বেশি কালখণ্ডের লালিত-পালিত-উজ্জীবিত সংস্কৃতিকে ভুলে যেতে পারে, নাগরিক জীবনের একমাত্র সত্য হয়ে ওঠে উচ্ছেদ-উদ্বাসন-উৎপাটন। ভিনদেশে পুনর্বাসন। চারের দশক =‘মানুষ মেরেছি আমি—তার রক্তে আমার শরীর ভরে গেছে ; পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার ভাই আমি…’। অবাধে চলেছিল আ-বিশ্ব আয়ুধপূজা = বিশ্বযুদ্ধ,প্রাণ-সংশয়,মৃত্যুভয়। হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ধনের মতো কোত্থেকে উড়ে আসে মিলিট্যারি ব্যাণ্ডে বেজে ওঠা জ্যাকসনের গানঃ—“হিল দি ওয়ার্ল্ড…মেক এ বেটার প্লেস। এক অর্থে এও তো এক ভয়-সঞ্জাত আশাবাদ।
‘There are people dying
If you care enough for the living
Make a better place for you and for me’
মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয়—ভয়ের প্রতিশব্দটি লিখি—‘ডর’। ১৯৮৯ পর্যন্ত ভয়ের একটা উৎস ছিল কম্যুনিজম। আমাদের যৌবনে, ঠাণ্ডা যুদ্ধের অত্যুষ্ণ তাপপ্রবাহে,সর্বজনীন ভয়ের বিষয় ছিল ‘আইসকুল’ আণবিক যুদ্ধ। যদি যুদ্ধ করতে হয়—সেই ভয়ে কতো শত রুশ-মার্কিন অস্ত্রসম্ভার। লংরেঞ্জ ব্যালিস্টিক মিসাইল-ড্রোন-ট্যমাহক, বি-৫২ বোম্বার। বার্লিন ওয়াল ধ্বসে পড়তেই গায়েব আণবিক বিশ্বলড়াই। নব্বইয়ের নতুনতর ভয় ঘোষিত হল পরিবেশ, এনভায়নমেন্টাল ডিজাস্টার=পরিবেশের বিনাশ। শূন্যদশকের ৯/১১ জন্ম দিল বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের ভয়। আর ২০১০ লাগোয়া আ-বিশ্বঃ সার্স-ইবোলা-এইচ আই ভি-করোনাজনিত নানাবিধ স্বাস্থ্যসমস্যা। অর্থাৎ, প্রতি দশকেই প্রায় ‘ভয়’-এর বিষয়বস্তু পালটে যাচ্ছে। নেগেটিভ শক্তির উৎস হয়ে উঠছে। ভয় এখন কোটিডিয়ান, থুড়ি, প্রতিদিনের বিষয়। ব্যক্তিগত ভয়ের বোলবালা ছিল আধুনিকতার বহু বহু আগে। আজকের মাপকাঠিতে সেদিনের ভয়গুলো ছিল কেমন নরম-তুলতুলে গোছেরঃ—সাপের ভয়, একাকীত্বের ভয়, উচ্চতার ভয়, ভূতের ভয়, রাজানুশাসনের ভয়, ভীড়ের ভয়, বোকা বনে যাওয়া্ বা অপদস্থ হওয়ার ভয়, লুটপাটের ভয়, গ্রেফতারির ভয়…এই লিস্টের কোনো শেষ নেই। কিন্তু সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সাথে এইসব ভয়ের কার্যক্ষমতা ব্যাপকভাবে কমছে। ১৯৫০ পরবর্তী টেকনোলজির আ-বিশ্ব বৃদ্ধির কারণে ভয়গুলোর গোত্র পাল্টেছে। আর ২০২১-য়ে তো ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার বদলে ভয় এখন সামূহিক। ভয় এখন একটি বিক্রিযোগ্য পণ্য। এ মার্কেটেবল থিং। কেননা, ‘ভয়’ আদতে একটি শাহরুখীয় অবশেসন। টকভিলের মার্কিনী গণতন্ত্রের প্রসঙ্গ তুলে ‘Fear: the history of a political idea’ তে কোরি রবিন মন্তব্য করেছেন যে ‘ the new agent of fear was majority wielding power not through traditional offices or weapons of state , but through the social mechanisms of popular opinion and common belief ’। আমি popular opinion (জনমত) আর common belief (লোক-বিশ্বাস) শব্দবন্ধ দুটিকে মার্কার দিয়ে দাগিয়ে রাখলাম।
পৃথিবী কি আদৌ ‘ভয়’-শূন্য হতে পারে? ‘ভয়’-এর ভয়ংকরতা থেকে বরং আমাদের চূড়ান্ত ‘অপ্রকৃতিস্থতা’-র কথাটাই কি নির্ভয়ে প্রোজ্জ্বল হয়ে ওঠে না? জুডিথ উল্লেখ করেছেন যে পুনঃনির্বাচনপ্রার্থী মার্কিন প্রেসিডেণ্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন—“Real power is—I don’t even want to use the word—fear,”। আর ‘টেরর ম্যানেজমেন্ট থিয়োরির’ মতো ‘সোশ্যাল সাইকোলজি’-র কথা বলেছেন ববি আজারিয়ান। বলেছেন ট্রাম্পের ভোটাররা নাকি ভয়গ্রস্ততার কারণেই ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছিলেন। ‘fear keeps his followers energized and focused on safety’। জুডিথ-এর উদ্ধৃতিটির অর্থ হয় ভয় হল সেই শক্তি যা বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেঃ ‘Real power’। আর তেমন এক নির্দিষ্ট ধরণের শক্তিকে সুরক্ষিত করার জন্যই উদ্বেগজনক ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। প্রকৃতপ্রস্তাবে, ভয় এখন যুক্তির সঙ্গে (আ-বিশ্ব) যুদ্ধরত। কত্তো রণাঙ্গণ। যুক্তি লড়ছে। বলছে—মুনাফা নয়। জীবন আগে। নিওলিথিক মানুষই নাহয় আবার ধান বুনবে ক্ষেতে।
ইয়াস সবেমাত্র আলিবাবাদের ঘরদুয়োরে ‘কন্ডেমড্’ ঢ্যারা টেনে দিয়ে গেছে। কিছুকাল আগে উৎফুল্ল ফিরে গ্যাছে ফণী-বুলবুল-আয়লা-আম্ফান । মন্তেন লিখেছিলেন “The thing I fear most is fear.”। ক্রন্দনরতা সাংবাদিকের সমর্থনে হাজির হয়েছেন গুটিকয়। সাংবাদিকসুলভ নয়—ইত্যাকার তক্মা জুড়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। মেয়েটি তো মৃত্যুভয় ছাড়াও অন্য এক ভয়গ্রস্ততার শিকার— ব্যর্থতা + জব-লস = দানাপানির অনিশ্চয়তা । প্যালেস্তাইনে হাতে মারণাস্ত্র তুলে নিচ্ছে মানুষ। ঘরে থাকা মানেও তো দারিদ্র্য, অন্নাভাব, মেঠো ইঁদুর আর স্কন্দমূল ছিটফুট। ক্ষুৎতৃষ্ণার ভয়ের হাত থেকে পরিবারের সুরক্ষা ছিনিয়ে আনা যাবে বরং রোদেঝড়ে-যুদ্ধাঙ্গনে; এই ভয়গুলো কি স্রেফ ইকনমিক? নাকি জিওলজিক কাম পোলিটিক্যালও বটে? জীবন শুধুমাত্র ‘nasty, brutish & short’-ই নয়,অসুরক্ষিতও কিঞ্চিৎ ! ভুঁইফোড় তাই নানাবিধ অস্তিত্বিক সমস্যা। বিশ্ব-অর্থনীতির মূল কাঠামোয় ফাটল আনতে পারে মহামারী-সাবপ্রাইম-ডিমনিটাইজেশন-বেরোজগারী ! সামাজিক সুরক্ষাহীন আধুনিকতায় গড়ে উঠছে সামাজিক দূরত্বের বিশাল-ব্যাপক প্রাচীর। অথচ, যে কোনো আর্থ-সামাজিক দুর্যোগে এই সেদিনও ছিল গহীন সমাজবদ্ধতা, যুগযুগান্তের বেঁধে বেঁধে থাকার সামাজিক প্রবণতা। ‘প্রোটেকশন’ ও ‘প্রমোশন’ভিত্তিক সামাজিক সুরক্ষার কথা বলেছেন জঁ দ্রেজে-অমর্ত্য সেন। কিন্তু ২০২১-এর আমরা কি প্রতিরোধের ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে‘প্রোটেকশন’-প্রধান হয়ে উঠছি না কি? ভয় পাবেন না, প্লিজ। সভ্যতার সাজানো বাগানে ননস্টপ চলছে মিডিয়ার প্রচারমল্লার। অক্সফোর্ড-পিফাইজার হ্যায় তৈয়ার।
আমরা কি ভুলে যেতে পারি যে ভয় হল আমাদের প্রথম অনুভব। বাইবেল অনুযায়ী আদমই সর্বপ্রথম ‘ভয়’গ্রস্ত হয়েছিল এবং সেইমতো রিয়াক্ট করেছিল। আদমের সময়কালকে পিছনে ফেলে এসেছি কব্বে। আমরা অবশ্যই বিবর্তিত হয়েছি নিশ্চিতই, পুষ্টিলাভ করেছি অথচ ‘নানাবিধ’ ভয়ের রক্ত-মাংস-মজ্জায়!!!Titanic ডুবে যাওয়া কি একটি ভয়ের বিষয় নাকি সাউথাম্পটন থেকে ন্যু-ইয়র্ক যাওয়ার একটি ‘বিপন্ন” প্রযুক্তিবিস্ময়? হিরোশিমা কি কেবলই ক্ষয়-ক্ষতির অনাদর্শগত ক্যারিশ্মা? কর্তৃত্বের চাবিকাঠি নয়? ভয় = ‘ culturally conditioned habit.’(স্বেন্দস্বেন লার্স) আর ভয়ের বিষয়ে ফ্র্যাঙ্ক ফুরেডি-র মন্তব্যের অর্থ করা যায় যে ভয় হল একটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য ঝুঁকি কিংবা এমন এক বিপদের সম্ভাবনা,যার সুরক্ষাও অতি আবশ্যিক। অর্থাৎ, ‘রিস্ক’ ম্যানেজমেন্ট। সুরক্ষার প্রাবধান। নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টার নীরজ চোকশি লিখেছিলেন যে অর্থনৈতিক নয়, অতীতের রাগ-ক্রোধ নয়, মার্কিনী সাধারণ মানুষ বরং তাঁদের অস্তিত্বের ব্যাপারে এক সিম্বলিক (প্রতীকী) ভয় পেয়েছিলেন বলেই ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। চোকশির নিজের ভাষায়— ‘White,Christians and male voters turned to Trump because they felt their status was at risk”. Svendsen Lars–এর ‘বিয়ণ্ড ফিয়ার’ থেকে একটি দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেওয়ার লোভ সম্বরণ করতে পারলাম নাঃ-
“ I believe that the fear society is a product of Utopian thinking. ‘Utopia’ means ,literally,a ‘non-place’,but people like to think of it as a ‘good place’, that is ,as a ‘utopia’ (the Greek prefix eu means ‘good’ and ‘topos’ means ‘place’….Utopias are societies that, by definition, do not contain fear. Precisely, against this background, fear becomes so intolerable, and every misfortune so unacceptable.’
মধ্যযুগের ভয়ের হদিশ দিয়ে রেখেছেন চার্লস ডিকেন্স। অর্থ হয়, ভয়ের একাল-ও যেমন রয়েছে, তেমনই ভয়ের সেকালও ছিল একসময়। ১৭৩৮-এর লন্ডনে মাথার ওপর বজ্রাঘাতের মতোন বাড়ি ভেঙ্গে পড়ার কাহিনিকে সামনে এনেছিলেন ডরোথি জর্জ। বস্তুত, রেনেশাঁ-কালীন ইউরোপের উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর মাথার দিকটা ভারী আর বড়োসড়ো হত। রাস্তার দিকে ঝুঁকে থাকত। ডিকেন্স লিখেছিলেন—
“ধ্বস নামল আবার আর তার সঙ্গে মেঘবরণ ধুলো…যতবার বাড়ি ভেঙ্গে পড়েছে…
খবরের কাগজের শিরোনাম হয়ে উঠেছে। হাসপাতালের দু-একটা বিছানা্র দখল
নিয়েছে কেউ। ধ্বংসস্তূপে কোনো অপছন্দের বাড়ি ছিল না। আরো অনেক বাড়ি লাইনে
প্রস্তুত, আশা করা যাচ্ছে যে টম-অল-অ্যালোনে পরবর্তী ধ্বসটি খুবই আকর্ষণীয় হবে’।
না, এটি কোনো ‘ভয়ার্ত’ প্রতিবেদন নয়। ‘ভয় জাগাবার অছিলাও নয়। বরং অব্যবস্থার প্রতি সুতীক্ষ্ণ অঙ্গুলিনির্দেশ। আদতে আপদ-বিপদ-শংকা, ত্রাস-তরাস–সন্ত্রাস ইত্যাদি সবকটিই হল অনুভববেদ্য অভিজ্ঞতা এবং প্রতিকারযোগ্য ‘ভয়ংকরতা’। ভয়ের “সেকাল’ থেকে শিখে মানুষ নিজেই বার করেছে নির্ভয়তার ‘একাল’। নজর পড়ল একুশের বুর্জ দুবাই-য়ের দিকেঃ শিখরদেশ ক্রমশ সরু হতে হতে শেষমেশ একদম ছুঁচাল।
ভয় একটা সংস্কারও বটে। কেউ ঝুঁকি নিতে চায় না। সকলেই চায় সুরক্ষার প্রতিবিধান। প্রিভেনশনকে জরুরি মনে করে আমাদের অত্যাধুনিক সমাজ। কিওর-এর আগে স্থান দেয়। সত্যিই তো, ভয়ের অস্তিত্ব নেই তবু যেন সাধ করে ভয় পাওয়াও আছে; খালি মনে হয় অযথা ঝুঁকি নিলে অকল্যাণ ঘটতে পারে। গুটিয়ে শামুক হয়ে ইতস্তততা আর উদ্বেগের আবহে দিন কাটায়। দুনিয়া জুড়ে তাই পয়লা জানুয়ারি,২০০৯-এর “অ্যাকশ্ন রিপ্লে’-র রিপিট টেলিকাস্ট। সুরক্ষা তাই একটি এহসাস এসময়ঃ সিসিটিভি ক্যামেরা, সোয়াইপ কার্ড, ম্যাগ্নেটিক চিপ্স্, CVV… সামাজিক সুরক্ষার কথা বলতেন ওয়েলফেয়ার ইকনমিস্টরা। সুরক্ষা এখন অতিমাত্রায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক। গোলার্ধহীন WWW ডট্ কম্-এর ঘেরাটোপে এখন অতিনিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিসুরক্ষার দিনকাল। সমষ্টি নয়, ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে নেটিজেন সমাজ।
আমেরিকা ভারী কল্পনাপ্রবণ। রহস্যরোমাঞ্চ তাদের ভারী পছন্দের। রহস্য কাহিনী লিখতে হবে, কলকাতাকে নিয়ে ডান সিমন্স তাই এক আজগুবি রহস্যকাহিনী-‘সঙ অব কালী’ লিখলেন। এই সেদিন, ১৯৮৪-র মার্কিনমুলুকে সেটি সেরা রহস্যকাহিনীর শিরোপা পেল। সিমন্স চেঁচিয়ে বললেন, (শব্দাক্ষরে যতটুক বিস্ফোরক হওয়া যায় আর কী!)—‘কতকগুলো জায়গা এমনই জঘন্য যে তার অস্তিত্বকে টিকে থাকতে দেওয়া যায় না।…কলকাতা তেমনই এক জায়গা।… কলকাতার পরিচয় পাবার আগে পরমাণু অস্ত্রের বিরুদ্ধে মিছিলে অংশ নিতাম। এখন আমি স্বপ্ন দেখি পরমাণু অস্ত্রের কালো মেঘ ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠুক একটা শহরের ওপরে। বাড়িগুলো গলে-পচে কাচের হ্রদে বদল হয়ে যাক। বাঁধানো রাস্তাগুলো লাভাস্রোতে ভাসুক ও বাস্তবের নদীগুলো চড়বড়িয়ে ফুটতে থাকুক। জ্বলন্ত পোকার মতো হাত পা ছুড়ুক মানুষগুলো—লম্বা লম্বা ঠ্যাং-ওয়ালা পোকামাকড়ের মতো প্রার্থনা করতে করতে, থুতু ফেলতে ফেলতে খাক্ হয়ে ফেটে পড়ুক বিপুল বিনাশের আগুনে। সেই শহরটি হল কলকাতা। এমন স্বপ্নগুলো অপ্রিয় নয়। এমনই কিছু বিশ্রী জায়গা আছে যেগুলোকে টিকে থাকতে দেওয়া যায় না।’ ইনভার্টেড কমা শেষ। চেষ্টার কোনো কসুর করেন নি সিমন্সসাহেব। বিস্তর ভয় দেখালেন! কিন্তু আপনি ভয়ার্ত হলেন কি? অর্থ হয় ভয়, নিঃসন্দেহেই, একটি কালচার।
দীপেশ চক্রবর্তীর ভারী সুন্দর একটি লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিতে চাইঃ “আজকে একটা অবস্থা হয়েছে – মানুষকেই আজ ভাবতে হচ্ছে মনুষ্য–পরিবর্তিত পৃথিবীর সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে পারে কি না। এভাবে চললে দেখা যাবে আমরা সিক্সথ্ গ্রেট এক্সট্টিঙ্কশনের প্রথম ধাপে এসে পৌঁছেছি। এবার যে ডেভেলাপমেন্টের পথে আমরা চলেছি,যে ডেভেলাপমেন্টের পন্থা নেতারা অনুসরণ করছেন, তাতে অনেক প্রাণিবিজ্ঞানী বলছেন ৩০০ থেকে ৬০০ বছরের মধ্যে গ্রেট এক্সটিঙ্কশন হবে। পৃথিবীটাকে সার্বিকভাবে দেখে একটি নতুন কথা উঠেছে—গ্রেট অ্যাক্সিলারেশন থিসিস। ‘আর্থ সিস্টেমে’র বিজ্ঞানীরা বলতে চান ১৯৫০-এর পর থেকে খুবই দ্রুতগতিতে অনেকগুলো জিনিস বেড়েছে যেগুলো মানুষ করেছে – সাধারণ জনসংখ্যা,আর্বান পপুলেশন, এনার্জি ইউজ,জনসংকট, গ্রীনহাউস গ্যাস নিষ্ক্রমণ ইত্যাদি।” । (সূত্র-দীপেশ চক্রবর্তী ঃ মানবিকতা ও অমানবিকতা,পৃ-৪৯)।
ভয় নিয়ে কথা বলব আর আমাদের যৌবনের সেরা ভয়—‘আণবিক তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ নিয়ে কথা হবে না, তাও কি হয়? নজর ঘুরিয়ে পড়ি বরং অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের ‘এখনো নামেনি,বন্ধু, নিউক্লিয়ার শীতের গোধূলি’ বইয়ের বিভাব কবিতাঃ
“কাঁথা স্টিচ মেঘে-মেঘে কবিতার মূল্যবোধগুলি
লেগে আছে,লিট্ল ম্যাগাজিনের ব্রতীরা নেয়নি
বেয়নেট তুলে, শুধু থেকে থেকে ত্রস্ত হায়নারা
জোট বেঁধে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা করে ক্ষমতার লোভে,
এবং ধ্বংসাবশেষ রেখে যায়, কবিদের কাজ
সে সব বিয়োগফল ধরে রাখা, ওরা বৈতালিক—
শালবনে এখন নয়, ভাঙ্গাচোরা নিয়তির ব্যূহে
অভিমন্যুতায়,দ্যাখো, কবিতার এই তো সময়ঃ
এখনো নামেনি, বন্ধু, নিউক্লিয়ার শীতের গোধূলি
কবি হোন বা নাই হোন, ‘অভিমন্যুতায়’ অভিব্যক্তিটির সামনে ‘নতশির’ হবেনই আপনি, হে পাঠক—প্রেমে পড়বেন, পড়বেনই। বিবর্তনবাদের পথে হাজার বছর পথ চলে আমরা—টাইটানিকের যাত্রীরা, করপোরেট রাজতন্ত্রের অত্যাধুনিকতায় এসে পৌঁছেছি এমন এক জায়গায়, যার চারিপাশে বরফশৃঙ্গের ঢের; জলই বটে, তবে জমাটবদ্ধ ও ছুঁচালো। চার ধরণের স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টঃ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, অভাব থেকে মুক্তি, ধর্মোপাসনার স্বাধীনতা আর ফ্রিডম ফ্রম ফিয়ার বা সন্ত্রাস থেকে অব্যাহতি। এমন মন্তব্যের আশি বছর পরে আমাদের অবস্থান হল ১) মতপ্রকাশের স্বাধীনতা শঙ্কিত-কুন্ঠিত। ২) অ-ভাবের তিনভাগ নোনা জলের বদলে একুশের চর্চা-বিষয় হল ক্রমশ ঊর্ধমুখী একভাগ স্থল ৩) ধম্মোগারদে সগৌরবে চলিতেছে ইসলাম (they) আর খ্রিশ্চান (we)-এর ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন। কম্যুনিজম পরাস্ত এবং উৎক্ষিপ্ত। ৪) উবে গেছে পরিবেশবাদ, বিশ্ব এখন ওয়ার্ম হয় দুনিয়াজোড়া সন্ত্রাসবাদের নবলব্ধ নারকীয় ক্যারিশমায়। আর ভয় দখল করেছে সবকটি পুণ্য রাজসিংহাসন। (আমাদের সুরক্ষাস্বার্থে) উনিশশো পঞ্চাশ-ষাটে—সৈন্যসমাবেশ হত শুধু বর্ডার এলাকায়। লড়াই চালাত শুধু মিলিটারিম্যান। দুহাজার একুশের মিলিটারিম্যান-ই (কেবল) লড়াই করে না বর্ডার এলাকায়। আরে, আমরাও তো লড়ছি। ঘরে ঘরেই সীমান্ত। ড্রাগ-ইমিগ্রেশন-জালিয়াতি-ব্যাঙ্ক তছরুপ-NPA/ATM হালাল-‘কুলকুল’ টেররিস্ট অ্যাটাক-দারিদ্র্যডুয়েল-মহামারীর সাফাই অভিযান, ফি-বছর ঝড়-সাইক্লোন-ঘূর্ণিবাত; আহ্! জীবনযুদ্ধ এর নাম। একুশশতকীয় চেতনাভূগোলের চৌকাঠ পেরোলেই সীমান্ত—সর্বত্র। বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন আগোর্যাফোবিক আমরা। মোড়ে মোড়ে ঘোষণা জারিঃ—ঝড় চলে যাওয়ার পরই ‘কেবল’ বাহিরে বেরোবেন।
জাহাজ ত্যাগ করিনি এখনও। আমরা যে নই গণেশ-বাহন। শেয়ার করছি Weart, Spencer –এর ‘দি রাইজ অব নিউক্লিয়ার ফিয়ার’ সূত্রে পাওয়া এক-দুটি তথ্য—
“১৯৬১-তে ইউ.এন.ও-তে প্রেসিডেন্ট কেনেডি একটি বক্তৃতায় স্বভাবসিদ্ধ ঢঙ্গে বলেন–“The weapons of war must be abolished before they abolish us.” আমরা ভিয়েতনাম-গালফ-ইরাক-আফগানিস্তানের কথাই পাড়বো না। প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন নাকি ১৯৬৪-র এক টিভি সম্প্রচারে বলেছিলেন যে সারা বিশ্বের প্রতিজন পুরুষ, নারী ও শিশুর জন্য মাথাপিছু ১০ টন TNT মজুত রয়েছে। স্পেন্সার লিখেছেন যে ভবিষ্যত শূন্যগর্ভ। কোবাল্ট বম্বটি বস্তুত উচ্চ চেতনাসম্পন্ন মানুষেরা বানিয়েছেন who want to use this specter to frighten us into a heaven of peace’. পাশাপাশি তিনি নেভিল এস নরওয়ের ১৯৫৫-র উপন্যাস ‘অন দ্য বিচ’-এরও উল্লেখ করেছেন। নেভিল সেই উপন্যাসে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে ১৯৬৩ নাগাদ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর গোলার্ধের সমস্ত প্রাণধারাকে মুছে দেবে। শুধুমাত্র অস্ট্রেলিয়াই একমাত্র বোমার আঁচ না পাওয়ার জন্য ভয়ানক মৃত্যুভয়ের অপেক্ষায় কোনোক্রমে ধুঁকতে থাকবে। ১৯৫৭-য় প্রায় চল্লিশটি সংবাদপত্রে গল্পটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল আর ১৯৮০ পর্যন্ত বইটির চার মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছিল। আমি আকৃষ্ট হয়েছি সন-তারিখটি দেখে। ১৯৮০-কেন, ২০২০ অবধি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘটেনি। কারণ সুরক্ষা চেতনা ওর্ফে দুনিয়াজোড়া গব্বরদের নোম চমস্কি কথিত ভয়ে সিঁটিয়ে পড়া। অথবা, আমাদেরই যত্নে-প্রযন্তে সামূহিক বিশল্যকরণীর সার্থক সন্ধান—‘রিস্ক ম্যানেজমেন্ট’-এর সময়োচিত সঠিক সুরক্ষা-প্রতিবিধান।
[এই প্রবন্ধে উল্লিখিত সমস্ত বঙ্গানুবাদ লেখককৃত]
Posted in: ARTICLE, June 2021 - Cover Story