অক্সি-‘মরণ’ : প্রত্যয় চৌধুরী

দুই ভিন্ন মেরুর সত্তা যে পরস্পর পরস্পরকে আকর্ষণ করে একথা বহুল প্রচলিত। ওরাও এই প্রবাদ নিয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহল ছিল। দুজনেই দুজনকে পছন্দ করত খুব। পছন্দ বলা ভুল, মারকাটারি প্রেম ছিল দুজনের। এই নিয়ে আবার ওদের আফশোসের শেষও ছিল না। ভালবাসা যে সুখের থেকেও জ্বালাময়ী হতে পারে সেকথা ওদের থেকে কেউ ভাল জানত না। সম্পর্কের এই রসায়নেই অভ্যস্ত ছিল ওরা। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গেলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরা ছাড়া উপায় ছিল না। ওরা জানত ঝগড়া যদি থামে এভাবেই থামবে, নয়তো ওরা চুলোচুলি করে মরে যাবে, অথবা বেঁচে থাকবে কেউ একজন। ওদের মধ্যে একজন অল্পেই বেজায় চটে যেত। মুখ খারাপ করা থেকে শুরু করে খিস্তি-খেউর, মারধোর কিছুই বাদ দিত না। অন্যজন ছিল ততটাই শান্ত, বরফের মতো। তার হিমশীতল দেহ দিয়ে সারাক্ষণ যেন বরফ জল গড়াত। প্রথম থেকেই ও একটা প্রতিজ্ঞা করেছিল, নিজের সমস্তটা দিয়ে পাশের জনের মাথা গরম শুষে নেবে সে। হার মানবে না; অকারণ চটে যাবে না। এটাই তো ভালবাসা— জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতে ধৈর্য্যশীল হয়ে সবটা সামলে ওঠা। কিন্তু প্রতিবার ওকেই সব সামলাতে কেন হবে– এই প্রশ্নের উত্তর কখনও চেয়ে দেখেনি ও। অন্যদিকের মানুষটি ছিল রগচটা। না চাইতেও হুটহাট মাথা গরম করে ফেলত। হয়ে যেত কোনও না কোনও ভুল। ভুল করার এক সহজাত ক্ষমতা ছিল তার। সবকিছু প্রজাপতির মতো সুন্দর দেখলেও ওর মনে হতো কিছু একটা যেন ঠিক নেই। আর এই কারণেই একের পর এক ফাউল করে ফেলত সে।

একদিন সন্ধেবেলা ওদের একটা অ্যানিভার্সারি পার্টিতে যেতে হয়েছিল। অতিথি হিসাবে নয়, শ্রমিক হিসাবে। একটা বার-এ ওদের কাজে লাগতে হয়েছিল কয়েক ঘণ্টার জন্য। এই মূহুর্তে বলে রাখা প্রয়োজন, নিজেদের পেশার পাশাপাশি ওরা মাঝে মাঝে এই ধরনের খুচরো কাজ করত। একটু বেশি পারিশ্রমিক আসবে এটাই ছিল লক্ষ্য। শান্ত স্বভাবের প্রাণটি এই বাড়তি ইনকামের জন্য সবসময়েই খুব হুঁশিয়ার থাকত। সিরিয়াস ছিল না অন্যজন।

সেদিন রাত্রি ৯ টা বাজে, তখনও বার-এ এসে পৌঁছায়নি একজন। ঝকমকি আলো জ্বালিয়ে, টেবিল সাজিয়ে বার কর্তৃপক্ষ পার্টির প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিকে একজনের অকারণ দেরী হওয়া ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে নীরব শান্ত প্রাণটিকে। আবার একটা ঠাণ্ডা লড়াই শুরু হবে— মনে মনে আভাস পেয়ে গিয়েছে সে। অভিমান জমে জমে শ্বেত পাথর হয়ে গিয়েছে। কিন্তু নিথর হয়নি এখনও। ধীরে ধীরে দেহ ঠাণ্ডা হতে শুরু করেছে। বরফ হওয়ার অপেক্ষা শুধু। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে সে। যত সামলে উঠছে ততই শরীর ঠাণ্ডা হয়ে উঠছে তার।

ধৈর্য্যের শেষ সীমায় পৌঁছানো বাকি, ঠিক সেই সময়েই হন্তদন্ত হয়ে বারটিতে প্রবেশ করল তার নিকটজন। কিন্তু একি অবস্থা, তেলে বেগুনে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে সে। তার আপাদমস্তক দপদপ করছে। অনেকবার অনুনয় বিনয়ের পর অবশেষে সে জানায়, সরাসরি বড়বাজার থেকে ফিরছে। রাস্তায় এত ভিড় সেই কারণে নাকি ঢুকতে দেরী হল। ভিড় ঠেলে অন্য কোনও ট্রান্সপোর্ট না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ছোট হাতি করে আসতে হয়েছে তাকে আর সেই জন্যই ক্ষেপে বোম হয়ে রয়েছে। অপেক্ষারত প্রাণীটি কিন্তু বাড়তি কথা না বাড়িয়ে টেবিল-চেয়ার সরিয়ে তাকে বসার জায়গা করে দিল। ঘাম ঝড়িয়ে ঠাণ্ডা হওয়ার সুযোগ করে দিল। এই কাজ সে আগেও করেছে। কাছের মানুষটি রেগে গিয়ে যতই মেজাজ দেখাক, ততই সে তাকে আরামের ব্যবস্থা করে দেয়। মনে মনে বরাবর একটা কথাই সে ভেবে এসেছে- এতেও কোনওদিন কাজ না হলে একটা মোক্ষম অস্ত্র ট্রাই করবে। আজ হয়ত সেই অস্ত্র চালনারই প্রথম দিন ছিল।

এদিকে অন্যজন ততক্ষণে জামাকাপড় খুলতে শুরু করেছে। প্যাচপ্যাচে গরমে এতটা পথ জার্নি করে আসার পর তার আর কিছুই সহ্য হচ্ছিল না। চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘উফ! গরম লাগছে, পারছি না আর, সরে যা সামনে থেকে।’ অপেক্ষা, ধৈর্য্য, ভালবাসা, সম্মান—সবকিছুর প্রতিদানে ‘সরে যা সামনে থেকে’ কথাটা ওকে আগেও শুনতে হয়েছে। কিন্তু কখনওই আশাহত হয়ে দমে যায়নি সে। এইবারে যেন নতুন উদ্যমে সব কিছু সামলে ওঠার নতুন অভিপ্রায় জন্মাল তার ভিতর। মন কষাকষির দাওয়াই হিসাবে সামনের জনকে জড়িয়ে ধরল শান্ত সুরভিত প্রাণ। নিজের হীমশীতল হাত দিয়ে ওর গা, হাত-পা, কপাল মুছিয়ে দিল। তারপর জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে টানা পাঁচ মিনিটের এক দীর্ঘ চুম্বন সঁপে দিল। চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “হয়েছে, এবার?” এরপর কোথায় আর সেই মাথা গরম? সামনের মানুষটি মুহূর্তে যেন গলে জল হয়ে গেল। তার গোটা শরীরটা কিরকম হাল্কা আর ভারহীন হয়ে গেল। কোথায় আর সেই তিতিবিরক্তি, কোথায় অনর্থক জেদ। মনে হল জগৎ সংসারের যাবতীয় সুখ আর আরাম যেন তার পায়ের তলায় আত্মসমর্পণ করেছে। এক গভীর প্রহেলিকায় তন্ময় হয়ে একথা-সেকথা ভাবছিল সে। তখনই তার অন্যমনস্কতায় জল ঢেলে পাশের জন বলে উঠল, “চল, দেরী হয়ে যাচ্ছে।“

এরপর দুজনেই হাত ধরে সোজা হেঁটে গেল কিচেনের দিকে। ক্লান্ত, ভারহীন শরীর ছেড়ে দিয়ে একজন শুয়ে পড়ল কিচেনের স্ল্যাবে। দূরে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে তাকে বিদায় জানাল আরেকজন। কিচেনের এক কর্মচারী এসে তার দেহ মুছিয়ে তাকে তুলে দিল একটা রেফ্রিজারেটারে। কাঁচের ভিতর থেকে শেষ বারের মতো নেভা নেভা চোখে প্রেমিককে দেখে নিল সে। অন্যদিকে আরেকজন স্ল্যাবে শুয়ে চোখ বুজে ফেলেছে চিরতরে। ওরা মাছ-ভাজা আর বিয়ার। কিছুক্ষণ পর পার্টিতে ওদের সার্ভ করা হবে।

Facebook Comments

Posted in: June 2021, STORY

Tagged as: ,

Leave a Reply