মৃগয়া : কৃষ্ণেন্দু তালুকদার

নৈঃশব্দ ভাঙিয়া যায় বারংবার। অমিতবীর্যের অস্থির ক্রুদ্ধ পদচারণায় শুষ্ক মর্মর্দণল দলিত হইতে থাকে।বৈজী কুমারের মৃগয়ার সাধ অপূর্ণ থাকিয়া গিয়াছে বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘের তীব্র বাধায়।তাঁহারা বনপথ অবরুদ্ধ করিয়া শায়িত ছিলেন যাহাতে কুমারের মৃগয়া বাহিনী বনে প্রবেশ না করিতে পারে। ভিক্ষু রতনের ঊদ্ধত ভাষণের চিত্র ক্রমান্বয়ে কুমারের মানসপটে ফুটিয়া উঠিতে থাকে-
“কুমার, আপনি বৈজী গণরাজ্যের একজন নাগরিক হইয়া কি প্রকারে নিজেকে রাজপুত্র ঘোষণা করিয়াছেন। আপনার পিতা অটলবীর্য, আমাদের নির্বচিত শাসক মাত্র – একচ্ছত্র সম্রাট নহেন। আপনি তো আমিষ আহার ও করেন না,তাহা হইলে এই মৃগয়া শুধু মাত্র আপনার ক্ষমতা প্রদর্শনের উৎসব ভিন্ন কিছু নহে।“
– “অনার্য ব্যাধগণ, নিষাদগণ যেক্ষণে পশু হত্যা করে, সেক্ষণে আপনাদিগের এই প্রতিবাদ অহিংসা কোন স্হানে রাখিয়া আসেন ?”
– “ ব্যাঘ্র জীবন ধারণের জন্য হরিণ বধ করে, হরিণ জীবন ধারণের জন্য তৃণ ভোজন করে, নিষাদগণ জীবন ধারণের শিকার করে। তাই গাভী কে তৃণ ভোজনে বাধা দেওয়া যেমত হিংস্র কার্য্য নিষাদগণকে শিকারে বাধা দেওয়াও হিংসা বলিয়া পরিগণিত হওয়া উচিত। এই বনাঞ্চলের আদিমতম বসবাসকারী তাহারা। বনের ভারসাম্য তাহাদের শিকারে ব্যাহত হয় না, আপনাদিগের ভোগবিলাস ও অপচয়ে নষ্ট হয়।“
– “সভা ও সমিতি তে আপনাদিগের প্রতিনিধি কিঞ্চিৎ বেশী আছে বলিয়া আপনাদিগের যে রূপ অহংকার প্রকাশ পাইতেছে তা অদুর ভবিষ্যতে চূর্ণ বিচূর্ণ হইবে। যেদিন এই রাজ্যে বর্ণাশ্রমের ন্যায় প্রতিষ্ঠা পাইবে, আপনাদিগের মত অলস ভিক্ষুদের স্হান আমাদিগের শ্রমশিবিরে হইবে। ততদিন প্র্দযর্শন করিতে থাকুন আপনাদিগের এই ছদ্ম অহিংসা।“
ভিক্ষু রতনের দেহ দলিত করিয়া অশ্বচালনার প্রবল ইচ্ছা সেদিন দমন করিতে হইয়াছিল না হইলে বৌদ্ধভিক্ষু সংঘের প্রভাবে পিতা অটলবীর্য ক্ষমতাচ্যুত হইতেন।
গুরুদেব ভগবত গোবিন্দাচার্য্য শিক্ষা দিয়াছিলেন- বড় লক্ষ্যের জন্য ছোট ছোট ইচ্ছাগুলিকে বলিদান করিতে। অগ্নিহোত্রী ব্রাহ্মণ হইয়াও গণরোষে বৈজীতে যজ্ঞ করিতে পারেন নাই তিনি। তথাপি তিনি ভূ-ভারতে বর্ণশ্রেষ্ঠের শাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন। আর সেই সাম্রাজ্যে কুমার অমিতবীর্য হইবেন একচ্ছত্র সম্রাট।
মৃগয়া লইয়া বেশি জানা জানি হইলে জৈণ শ্রেষ্ঠীরাও সভা সমিতিতে তাঁহাদের সমর্থন করিতে পারেন- এ রূপ ভাবিয়া অধিকাংশ সাথীদের বিদায় করিয়া, তিনি বনাঞ্চলের অগ্রভাগে শিবির স্হাপন করেন। এই বনাঞ্চলের অপর পার্শ্বে কৌশল রাজ্য। একটি বৈভবশালী ক্ষাত্রবংশ রাজত্ব করে সেথায়। কৌশলরাজের অভিষেকে আমণ্ত্রিত হইয়া যে প্রকার আড়ম্বরপূর্ণ যজ্ঞ, বলিদান ও মৃগয়া দেখিয়া আসিয়াছিলেন তাহা আজ ও একটি অতিকাঙ্খিত কিন্তু অতৃপ্ত স্মৃতি হইয়া কুমার কে পীড়া দেয়। বৈজী গণরাজ্য হওয়ায় তাঁহার রাজা হইবার তথা ঐরূপ আড়ম্বরপূর্ণ আমোদ করিবার আশা সুদূর পরাহত।
পরদিন প্রভাতে গুরুদেবের আশ্রমে যাইয়া অমিতবীর্য দেখিলেন গতদিনের ঘটনা গুরুদেবের কর্ণগোচর হইয়াছে। গুরুদেব তিরস্কার করিলেন-
– “ তুমি কাষ্ঠ আহরণ, অগ্নি প্রজ্জ্বলনের পূর্বেই অন্ন প্রস্তুতি করিবে ভাবিয়াছ?”
– “মার্জনা করিবেন গুরুদেব, মূর্খ আমি, আমায় মার্গ প্রদর্শন করুন।“
– “ তিষ্ঠ্য বৎস্য। কোনো রূপ পরিবর্তনই একদিনে সাধিত হয় না। তোমার লক্ষ্য শুধু সিংহাসন তাই হঠকারী আচরণ করিতেছ। আমার লক্ষ্য দেব দ্বিজের শাসন প্রতিষ্ঠা। বর্ণাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হলে তোমরা বংশপরস্পরায় রাজত্ব করিবে। জনগণের মনের অন্তঃস্থলে দৈবভয়, বর্ণাশ্রমের প্রতি দীর্ঘ লালিত বিশ্বাস ও আনুগত্য আজও অটুট। বর্তমানে ক্ষমতাবান গোষ্ঠীগুলির মধ্যে ক্ষুদ্র স্বার্থের দ্বন্দ্ব রহিয়া গিয়াছে। আমরা সেই সকল দ্বন্দ্ব কে তীব্র করিয়া ক্ষমতা দখল করিব ও ক্ষমতায় থাকিব।“
– “আমার পিতা সভা ও সমিতির আজ্ঞাবহ শাসক মাত্র। কৌশলরাজের মত ক্ষমতা তাঁহার হস্তে ন্যস্ত নাই।“
– “মূর্খ। শুধু শান্তিকালীন পরিস্হিতিই দেখিলে, আপতকালীন পরিস্হিতিতে বৈজী শাসকের সিদ্ধান্ত সভা ও সমিতি কে মানিয়া লইতে হয়, তাহা বিস্মৃত হইয়াছ?”
– “কিন্ত গুরুদেব- বর্তমানে তো কোনো আপতকালীন পরিস্হিতি নাই!”
– “ সেই পরিস্থিতি সৃষ্টিই তোমার কর্তব্য।“

কিছু মাস বাদে বৈজী কৌশল সীমান্তের বনাঞ্চলে দুই রাজ্যের সংঘর্ষ শুরু হয়। বৎসর কাল অতিক্রান্ত হয়, দেশে আপতকালীন পরিস্হিতিতে সমস্ত ক্ষমতা অটলবীর্যের কুক্ষিগত হয়। যুদ্ধের ব্যয়জনিত কর প্রবল বৃদ্ধি পায়। প্রজাগণ দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করিতে থাকে। বৌদ্ধ সংঘ বারংবার যুদ্ধের বিরোধীতা করিতে থাকে। কিন্তু এই অহিংস নীতি বৈজীর পক্ষে ক্ষতিকারক বলিয়া প্রচারিত হইতে থাকে। বৈজীর জনগণ যে প্রতিহিংসাস্পৃহতায় আচ্ছন্ন হইতেছিল তাহাতে প্রতিশোধ গ্রহণের পথে আর একটি বাধা হিসাবেই দেখিল বৌদ্ধ সংঘের এই যুদ্ধ বিরোধীতা কে। বৌদ্ধ সংঘের প্রতি জনগণের সমর্থন দ্রুত হ্রাস পাইলো। অমিতবীর্য বারংবার বৌদ্ধ সংঘ কে বৈজীর শত্রু বলিয়া প্রচার করিতে লাগিলে এক সময় অমিতবীর্যের মতটি কেই তাহাদিগকের আপন মত বলিয়া ভাবিলেন। ফলতঃ সভা ও সমিতিতে বৌদ্ধ সংঘের প্রতিনিধিত্ব কমিল। প্রতিশোধ স্পৃহা বৈজীবাসীকে পুনরায় ক্ষাত্রধর্ম মুখি করিল। যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্হিতিতে বৈজীর জৈণ শ্রেষ্ঠীরা কৌশল রাজ্যের মধ্য দিয়া বানিজ্য করিতে যাইলে কৌশলরাজ্য তাঁহাদের উপর উত্তরত্তর শুল্কবৃদ্ধি করিতে থাকে। এমতাবস্থায় শ্রেষ্ঠীদের সমর্থন ধরিয়া রাখিতে বৈজীতে শ্রেষ্ঠীগণের পণ্যের উপর প্রভূত করহ্রাস হয়। কৃষক, কর্মকার, মৃৎশিল্পী, এমন কি অরণ্যবাসী নিষাদ ও ব্যাধগণের উপরেও অসহনীয় করভার আরোপিত হইল। সমরাস্ত্র ব্যবসায়ী জৈণ শ্রেষ্ঠীদের খুশী করিতে চাহিয়া বৈজী রাজ্যে নিরামিষ ভক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয়। শুধু মৃগয়া ও যজ্ঞে মাংস ভক্ষণ ব্যতীক্রম বলিয়া গণ্য হইল। খাদ্য সংস্হান হারাইয়া নিরুপায় হইয়া নিষাদ ও ব্যাধগণ পার্শ্ববর্তী কৌশলরাজ্যে আশ্রয় লইতে থাকে। বৈজীরাজ্যের বর্ণাশ্রমের সমাজে কোনো কালেই ইহারা আদৃত ছিল না। অস্পৃশ্যতা জনিত অবজ্ঞা ও অজ্ঞানতায় সাধারণ বৈজীবাসী ইহাদের অসভ্য, রাক্ষসকুলজাত, এমনকি নরমাংসভোজী বলিয়া কল্পনা করিত। যুদ্ধ জনিত মন্দায় কর্মহীন অর্থবলহীণ বৈজীবাসীগণ তাঁহাদের এই অবস্থার জন্য কৌশলরাজ্যকে দায়ী মনে করিত। নিষাদ ও ব্যাধেরা কৌশল রাজ্যে আশ্রয় লওয়া শুরু করিতেই তাহাদের উপরও সাধারণ বৈজীবাসীর রোষ পড়িল। দিকে দিকে মাংস বিক্রয় করিতে আসা নিষাদ ও ব্যাধগণের গণপ্রহারে মৃত্যুর সংবাদ আসিতে থাকিল।

রাত্রির মধ্যমযামে এক অশ্বারোহী থামিল বৈজী দুর্গের প্রবেশদ্বারে। রক্ষীগণকে ভগবৎ গোবিন্দাচার্য্যের নামাঙ্কিত মুদ্রা ও পত্র দেখাইতে কুমার অমিতবীর্যের সাক্ষাৎ মিলিল। অশ্বারোহী আনিত গুরুদেব গোবিন্দাচার্য্যের সাংকেতিক বার্তাটি এক নিঃশ্বাসে পড়িয়া অমিতবীর্য তাহাকে দ্রুত প্রস্হান করিতে বলিলেন।
পরদিন রাজ্যবাসী জানিল নিষাদ ও ব্যাধগণের সাহায্যে অরণ্যময় পথ ধরিয়া কৌশল সেনাধ্যক্ষ বিশাল বাহিনী সহ বৈজী আক্রমণে আসিতেছে। সভা ও সমিতিতে যুদ্ধের কারণে আপৎকালীন পরিস্হিতি ঘোষিত করিয়া বৈজী শাসক অটলবীর্য যুদ্ধে চলিলেন। প্রশাসনের ভার সমর্পন করিলেন কুমার অমিতবীর্যের হস্তে। সভা ও সমিতি ইহাতে সম্মতিও দিইলো।
বৈজী সেনা রথ ও অশ্বারূঢ় হইয়া অরণ্যপথে প্রবেশ করিতে পারিলো না। বিগত কয়েক দিবসের বৃষ্টিপাত আরণ্যপথকে পঙ্কিল করিয়া তুলিয়াছে। বৈজী শাসক কোনো ক্রমে সন্তরপনে ধীর গতিতে অশ্বরূঢ় হইয়াই অরণ্যে প্রবেশিলেন। পিছনে পিছনে পদাতিক বাহিনী আসিতে থাকিল। গহন অরণ্যে প্রবেশ করিবার পর যখন সূর্য অস্তমিত হইতেছে তখনও তাঁহারা শত্রুর দেখা পাইলেন না। সন্দিগ্ধচিত্তে তাঁহারা সবে মাত্র প্রস্হান করিতেছেন- তখনই অরণ্য মধ্যে চতুর্দিকে অগ্নি জ্বলিয়া উঠিল। সৈন্যগণ “দাবানল দাবানল” বলিয়া আতঙ্কে দিকবিদিকজ্ঞানশূণ্য হইয়া পলায়ন করিতে লাগিল। এমতাবস্থায় সেই ছায়াময়,ধূমে শ্বাসরোধী অরণ্য হইতে রাশি রাশি শর তাঁহাদের বিঁধিতে লাগিল। বৈজী শাসকের অশ্বটিও শরাঘাতে ভূপাতিত হইল। চারি দিক দেখিয়া অটলবীর্য বুঝিলেন যে তিনি শত্রু পরিবেষ্ঠিত ও একা। শত্রুদের দেহে নিষাদের যুদ্ধের সজ্জা থাকিলেও ধস্তাধস্তির সময়ে একজনের উপবীত তাঁর হাতে খুলিয়া আসিল এবং আমৃত্যু তাঁর মুষ্ঠিতেই থাকিল।
বৈজী সেনাবাহিনী যখন ওই স্হানে আসিয়া পৌঁছাইলো, তাঁহার একদল নিষাদ কে অটলবীর্যের নিষ্প্রাণ দেহ লইয়া কৌশল রাজ্যের দিকে যাইতে দেখিলেন। ক্রোধে উন্মত্ত হইয়া তারা কৌশল রাজ্য আক্রমণ করিলেন।
দুর্গ মধ্যে অস্হিরভাবে পদচারনা করিতেছিলেন অমিতবীর্য। একটি পারাবত তাঁর স্কন্ধে আসিয়া বসিল। তাহার পদ হইতে একটি ক্ষুদ্র পত্র খুলিয়া লইলেন কুমার। তাহাতে লিখিত ছিল-
“মৃগয়া সম্পন্ন হইয়াছে। রাজ্যাভিষেকের জন্য যজ্ঞের প্রস্তুতি লও।“

Facebook Comments

Posted in: June 2021, PROSE

Tagged as: ,

Leave a Reply