আত্মরক্ষা, অজ্ঞাতবাস ও অন্যান্য বিপন্নতার অংশ : কৌশিক চক্রবর্তী

এই হননের কালে ঘুমোই না এতটুকু। কীসের যে ভয় করে! আলো নিবে গেলে অসংখ্য চেনা অচেনা মুখ ভিড় করে আসে দেওয়ালের গায়ে। সারি সারি মুখ। ফ্ল্যাশ করে করে সরে যায়। কোনো কথা বলে না। ঘুম পায়। কিন্তু ঘুম আসে না। মাথার ভেতর কষ্ট হয় খুব। শুয়ে শুয়ে এ পাশ ও পাশ… ছটফট করে যাই… ভয় হয়… যদি ঘুম থেকে উঠে দেখি উঠিনি আসলে ! যদি দেখি চিনতে পারছি না কাউকে, কেউ চিনতে পারছে না আমায়। হারিয়ে যাওয়ার ভয় করে, হারানোর ভয় করে খুব। ওই মুখগুলো যে কাদের, আমি জানি না। কেন যে তারা আমার দেওয়ালে এসে সরে সরে যায়, আমি জানি না। হয়ত জানি না বলেই খুব ভয় করে আজকাল। ঘুমোই না আমি। রাত বয়ে চলে। আর সেইসব রাতে গোপনে গোপনে খুন হয়ে যায় আমি আর আমার কলকাতা শহর। ঘুম আসে না ওই উঁচু ফ্ল্যাটবাড়িটার মাথায় আটকে থাকা হলদে রঙের চাঁদেরও। আর ছাদের মাথায় জেগে থাকা মোবাইল টাওয়ার। অথচ কথা ভুলে যায় এই শহর।
দীর্ঘক্ষণ ফোন ধরে বসে থাকি। মনে হয় কেউ আমার সঙ্গে কথা বলুক। কিন্তু আমি কাউকে ফোন করি না। যদি সে ফোন না ধরে? যদি সে বলে, ব্যস্ত আছি। আমার ফোন পেতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে তার সঙ্গে আমার দেখা হোক। কোনো না কোনো আছিলায়। সে রাগ দেখায়। আমি তবু ছুটে ছুটে যাই। তার পাড়ার মোড়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি। আমি জানি, এই সময়ে তার বেরোবার কথা নয়। দেখা হবে না। জানি সে বেরোলে তার মুখ ঢাকা থাকবে নীল মুখোশে। তবু তাকে দেখতে না পেয়ে আমার ভয় করে।
কথা ভুলে যায় ঋতুরাও। যেরকম চড়াইপাখিরা উড়তে ভুলে গেছে এই কলকাতা শহরে। আর এই গতিময় পৃথিবীর অজস্র সিনেমাকাহিনির মধ্যে কে-ই বা পাখিদের কথা মনে রাখে? তাই অন্ধকার সোফাসেটে বসে রাত্রিবেলাগুলো পুড়ে যায়… পুড়ে যায়… আর গুপ্ত আততায়ীর দল তখন কলকাতার দেওয়ালে দেওয়ালে লেখে আমাদের সম্মিলিত আত্মহননের ইতিহাস। পাণ্ডুলিপি ওড়ে। তারপর অনেকদিন পর হয়ত কোনো ছাদের গায়ে একে একে নেমে আসে তারা। আর বহুদিনকার পুরোনো গল্প মনে পড়ে যাওয়ার মতন অনেকদিন পর হু হু করে কান্না পায়। আরও একবার কলকাতার ঘোলাটে আকাশ থেকে জল পড়ে। আরও একবার এই শহরকে কেমন অচেনা লাগে। ব্যক্তিগত সীমান্তে জেগে থাকে কাঁটাতার…

ঠিক তখনই নীরবতা ভেঙে ফোন বাজে। আমি দেখি না। আমি জানি, আমার এ মরে যাওয়ার অসময়ে ডাকবে না কেউ। দেখতে চাইবে না, ক্রমাগত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছি কি না। আমি জানি, কেউ ডাকছে না আমায়। দেখতে চাইছে না, আমি নিজেই নিজের মতন থাকতে পারছি, নাকি আমারও কিছু মায়া, কিছু মাথায় হাত বুলোনো হাতের অপেক্ষা…
তোমাদের কাঠামোয় আমি তো সামাজিক নই, জানি তো ! তাই তো ভয় করে… তোমাদের মতন হয়ে যাই যদি… এই ধ্বংসবিলাসী হাওয়া… যে হাওয়ার গন্ধে জাটিঙ্গার দল আগুনের শীৎকারে অমরত্ব তাচ্ছিল্য করে। মাঝেমাঝে মনে হয় আমার আসবার কথা ছিল না এখানে। হয়ত বা আচমকা এসেছি বলেই এই জীবনের যাপনের মোহনসঙ্গীত উপভোগ করিনি কোনোদিন। অথচ যখন সময় তো দাবী করেছিল প্রত্যাঘাতের। আজ যখন মাটি থেকে উঠে আসছে মৃত করোটির স্তুপ, তীরে কী প্রচণ্ড কলরব… দূরে ভেসে যায় কার শব… তখনও আমাদের দিন যায় কামনাকুসুম অনুসন্ধানে। নিজেরা কি নিজেদেরই সবচেয়ে বেশি ভয় করি না? তাই তো নিজেদের কাছ থেকে নিজেরাই ক্রমাগত পালাই। আর শেষমেশ কানাগলিতে ঢুকে পড়ে দেখি, পেছনে যা ফেলে এসেছি, তা-ও আসলে মুছে যাওয়ার রাস্তা। তাই কখন যে বুকের ভেতর থেকে নিজেদেরই বার করে এনে ঢেকে দিয়েছি মিশকালো কুয়াশায়।
তবু শেষ হয় না যে। সেখানেও লুকিয়ে থাকে এক অপরিসীম ক্লান্তি, এক অচেনা ভয়ের আখ্যান। অনুষ্ঠান শেষে যেমন করে নহবতের বাজনদারেরা তেহাই বাজায়। তারা জানে, এ ভাঙা সভাঘরে এ বাজনা শুনছে না কেউই। অথচ সেই তেহাইটুকু না বাজালে সমাপ্তিটুকু লেখা হয়ে ওঠে না। যেমন প্রচণ্ড বিস্ফোরণের পরেও হত্যাস্থলে আগুন জ্বলতে থাকে। গুঁড়ো গুঁড়ো ছাই ওড়ে। তারপর যা পড়ে থাকে, তা হল অনন্ত শূণ্যতা। আমাদের বেঁচে থাকাও এখন সেই সমাপ্তি উৎসব। আমরা জানি, সব শেষ, তবু সমাপ্তির এই দীর্ঘায়ন করে চলি প্রতিদিন। প্রতিদিন একটু একটু করে মরে যাওয়া। অদৃশ্য অসুখে। যে অসুখ কাউকে কাউকে হয়ত বা ফিরে আসার চান্স দেয়। কাউকে দেয় না। মাঝেমাঝে মনে হয়, লাস্ট চান্স বলে সত্যিই কিছু হয় না। ওই লাস্ট চান্স-ও আসলে কেবলই আনুষ্ঠানিক এক সমাপ্তিরই আয়োজন।

এই যেমন, প্রতিবার আমি বলে চলেছি আমার একা থাকার কথা। এই যে আমি কিছুদিন ছুটি চাই। অথচ তোমাদের ভাবনায় তোমরা তার মান্যতা দিতে পারছ না। তোমাদেরও ভেতরে এক গোপন ভয় শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। প্রতিমুহুর্তে তাই আমার অবস্থান জানবার প্রয়োজন তোমাদের। নিঃশব্দে ঘাড়ের কাছে তাই নিঃশ্বাস ফেলছে তোমাদের স্যাটেলাইট ক্যামেরা। আমার প্রতিটা পদক্ষেপ মেপে নিচ্ছে তোমাদের ভয়ের ন্যানোবট। আছা, তোমাদের কি মনে হয় না… এই ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে আমিও বারবার মিথ্যের উপনিবেশ গড়ে তুলছি? আর প্রতিদিন সেই মিথ্যের মায়ায় ভেসে যাচ্ছি গ্রহণ বরাবর। এইসব মিথ্যেকথাগুলো বেঁচে থাক আরও অনেক শীতকাল। আমাদের প্রসাধনলাঞ্ছিত বাক্যগুলো আরও কিছুদিন টবে টবে প্রদর্শিত হোক। আর তার মধ্যেই আমি ভাবতে থাকব কোনো গোপন বাঙ্কারে আত্মগোপনের কথা। প্রস্তুতি নেব প্রত্যাঘাত ফিরিয়ে দেওয়ার। তারপর হয়ত আচমকা কোনো আণ্ডারগ্রাউণ্ড রেলস্টশনে তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। আচ্ছা, কীসের ভয়ে তোমাদের এই ঘনঘন ঘড়ি দেখা? জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার… তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার? মনে হয় না? এই দেখা হয়ে গেলেই তো সব অপেক্ষার শেষ! ততক্ষণ এই দূরত্বই স্থায়ী আর প্রলম্বিত এই শেষের প্রক্রিয়া। এই শেষের ভয়ই তবে পাও তুমি? ভয় পাই আমিও। মুখোমুখি হতে ভয় পাই। বাসের সিটে বসে মুখ লুকোই। ভয় হয়… যদি টের পেয়ে যাও, কেমন করে ট্রেঞ্চে বসে লিখে রাখছি ব্যক্তিগত যুদ্ধের খসড়া… যদি ঘড়ি দেখা শেষ করে উঠে পড়ো এই বাসেই?
আমরা যতই অস্ত্রের সিম্ফনি রচনা করি না কেন, উল্টোদিক থেকে আসা আঘাত সহ্য করার সাহসই আমাদের নেই… আমাদের রহস্য যদি কেউ জেনে যায়, সেই ভয়ে আমরা ত্রস্ত। আমাদের শরীরে তাই এত বর্ম, গোপন ডেরায় তাই এত লুকোনো অস্ত্রসম্ভার। এই যে কত কত হননের রেখা জমে আছে আমার তালুতে। পোকামাকড়ের মতন সেইসব রেখা এগিয়ে যাচ্ছে দুরূহতম কোণে… রেখাগুলো মুখের ওপর জটিলতম কাটাকুটি করে… যে কারণে আমার আত্মগোপন করে থাকা… যে কারণে আয়না দেখতে ভয় করে। ভয় কি শুধু তুমি? ভয় কি শুধু আমি? হাত নিশপিশ করে খুব। হেরে যাওয়ার ভয়ে লুকোচুরি খেলা ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে আমিও হয়ে যাই প্রতিরক্ষাহীন। নিজেকে ক্রমাগত খুন করে চলাই তখন এক এবং একমাত্র পরিত্রাণ।

এই তাহলে সাব্যস্ত হলো। বিষণ্ণ আততায়ী অথবা বধির জোকার – এ ছাড়া আর কিছু হওয়ার ভবিতব্য নয় আমাদের। তাই বহন করে চলা বিগত জন্মের দোষ। এই বেঁচে থাকা অপরাধগুলো। সেখানে প্রতিদিন মরে যাওয়ার ভয় লেগে। আর তাই আজ যখন আমাদের ভয়গুলো পোষাকহীন, প্রতিরক্ষাহীন – তখন সহ্য করতে পারছি না। এই যে ভয় পাচ্ছি – উল্টোদিকের আয়নায় একটা মুখচেনা লোক, উশকোখুশকো চুল – পাঁচদিনের দাড়ি নিয়ে দাঁত নখ শানাচ্ছে – তাকে যদি চিনে ফেলি – তখন? অথচ তাকে স্রেফ দেখে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই…
অসহ্য লাগছে… এই যে আধো অন্ধকারে বিমর্ষ শুঁড়িখানায় ক্রমশ ভরে উঠছে চারপাশ… আমার অসহ্য লাগছে… এই যে কেবলই মাংসের ম্যানিকুইনদের শোভন রতিভংগিমার বিজ্ঞাপন আর উঁচু উঁচু প্রাসাদে ঢেকে যাচ্ছে একচিলতে জানলার আকাশ… আমার অসহ্য লাগছে… এই যে কাফেটেরিয়ায় আজও বাজছেন জন কোলট্রেন আর সারা ঘর ভর্তি রঙিন যুবক যুবতীরা… আর আমার বসবার জায়গা নেই কোথাও… আমার অসহ্য লাগছে… ফুটপাথগুলো মধ্যরাতে বেদখল হয়ে যাচ্ছে রোজ… আর আমার দাঁড়াবার জায়গা নেই কোথাও… আমার অসহ্য লাগছে…

বিশ্বাস করো ভয় করছে আমার… মাথার ভেতর থেকে অসংখ্য চিহ্ন বেরিয়ে এসে পোকামাকড়ের মতন হাঁটছে… আমার ভয় করছে… এত করে ডাকছি – সাড়া দিচ্ছ না যে… আমার বুঝি ভয় করে না?
একেকটা সকালে কী একা লাগে আমার… ভয় করে
চোখ বন্ধ করলেই সারি সারি মুখ… ফ্ল্যাশলাইট হাতে কাকে যেন খোঁজে… আমার ভয় করে
একটা করে জন্মদিন যায় আর আমি আরও একটু পুরোনো হয়ে যাই
সারারাত কারা যেন হুইস্‌ল বাজাতে বাজাতে হেঁটে যায়
সারারাত কারা যেন ভয় দেখায়…

বেঁচে থাকার ভয়
শ্বাস নেওয়ার ভয়
ভুলে থাকার ভয়
ভুলে যাওয়ার ভয়
মনে রাখার ভয়
মনখারাপের ভয়
মনকেমনের ভয়
না চেনার ভয়
চিনে ফেলার ভয়
থাকার ভয়
শেষ হওয়ার ভয়
হারানোর ভয়
হারাবার ভয়

ভয় পাওয়ার ভয়

একটা ঘামের সরলরেখা নেমে আসছে সোজা… পিঠ বেয়ে। সাপের মতন শিরশিরে … আর আমার কী ঘুম পাচ্ছে… সব গুলিয়ে যাচ্ছে… সব… আমি একবার আয়নার দিকে তাকাচ্ছি… অথচ তার দিকে নিজেকেই ছুঁড়ে মারব কি না, সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না… আমি দেওয়ালে টাঙানো ক্যালেণ্ডারের দিকে তাকাচ্ছি… অথচ তার সারা গায়ে আলকাতরা লেপে দেবো কি না সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না…
তাই সোজা এগোচ্ছি রাস্তা ধরে… রাস্তাটা মাঝপথে অন্য দিকে ঘুরে যেতে পারে। তেমন হলে আচমকা থেমেও যেতে পারে সরু কোনো কানাগলিতে
আয়না থেকে সেই মুখচেনা লোকটা কী বিশ্রিভাবে হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে … আমার ভয় করছে… ওই যে পার্কের গায়ে পোস্টার টাঙানো – here you march … you classical ভাঁড় … সারা কলকাতা সোল্লাসে হাততালি দিচ্ছে আমার মধ্যবিত্ত ভীতু অক্ষরবিলাসে…
আমার মনে হচ্ছে ভয় পেতে পেতে হয়ত একদিন এই লোকটাকে খুন করে ফেলব আমি… হয়ত আজই… আমি আন্দাজ করছি ফাইনাল কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেছে… কিন্তু কোনদিকে যে নিয়ে যাচ্ছে এই ভুলভুলাইয়ার রাস্তাঘাট, আমি ঠাহর করতে পারছি না। এই রাস্তাটা কি মাঝপথে অন্য দিকে ঘুরে যেতে পারে? আচমকা থেমেও যেতে পারে সরু কোনো কানাগলিতে? নাকি এই রাস্তা আমায় অরণ্যের দিকে টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়ে আসবে একা?
আর একা একা মরে যাবো তবে?
কী করব বলো তো? আমার ভয় করছে… আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না…
হাতের ইঁটটা কি তাহলে ছুঁড়ে দেব আয়না থেকে বিশ্রিভাবে হাসা ওই মুখচেনা লোকটার দিকে?
সেই classical ভাঁড় …
তাকে খুন করে শেষ করে দিলে তবে ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন
কী করব বলো তো? হাতে সময়ও তো খুব বেশি নেই
আমি হাঁটছি… আমায় কেউ থামতেও তো বলছে না
একবার… একবার প্লিজ একটু কথা বলো
একটু কথা বলো না গো

[এই লেখায় ব্যবহৃত সমস্ত ছবি ও আলোকচিত্র লেখকের]

Facebook Comments

Leave a Reply