ভয় : আইভি চট্টোপাধ্যায়

‘আমি যেতে চাই কুশলদা । প্লিজ ।‘
‘তুই যাবি? আদিত্যকে পাঠাব ভাবছিলাম ।‘
‘না না,মেয়েদের যাবার দরকার নেই । আদিত্য না গেলে প্রসূন বা জয় যাক ।‘
‘কেন? মেয়েরা যাবে না কেন? ছত্তিশগঢ়ে রিস্ক নিয়ে খবর করতে যাই নি আমি? পরে তো জেনেছিলে সবাই,ওই এরিয়ায় আটটা ল্যান্ডমাইন পাওয়া গেছিল ।‘
‘এটা রিস্কের ব্যাপার না রে । সৈকত ঠিকই বলছে । যতই হোক,তোদের মানে মেয়েদের নার্ভ তত স্ট্রং নয়,এ কথাটা তো মানবি? শোন নীলু,তুই বরং কিসান-আন্দোলনের খবরটা করে আয় । কালাদিবস পালন । ওটাও যথেষ্ট থ্রিলিং ।‘
‘আমি থ্রিল নিয়ে ভাবছি না কুশলদা । একটা মৃত্যু-উপত্যকা । একটা মৃতদেহের গ্রাম । কেউ যেতে পারছে না সেখানে । প্রেতাত্মারা নাকি ঘুরে বেড়াচ্ছে । নিজের চোখে দেখে আসতে চাই আমি । মেয়েদের নার্ভ উইক,এই মিথটাও তো ভাঙা দরকার ।‘
‘তুই বুঝি ভূতে ভয় পাস না? ওটা ভুতুড়ে গ্রাম । মুর্দা-গাঁ । সারি দিয়ে লাশ । কার সঙ্গে কথা বলে স্টোরি করবি?’ লিপি মজা করল ।
‘বরং আদিত্যই ভূতের ভয় পায়,জিজ্ঞেস করে দ্যাখ ।‘ ঝাঁঝিয়ে উঠল নীলাঞ্জনা,‘কুশলদা,প্লিজ ।‘
‘ভূতের ভয় সবাই পায় নীলু । তবু সবাই বলে,ভূত ভগবান কিছু মানি না । নাহয় ভয় নেই তোর,কিন্তু মেয়েঘটিত যে কোনো ঘটনায় তুই ইমোশনালি জড়িয়ে পড়িস । সর্বক্ষণ শোকে দু:খে ইমোশনাল,তুই করবি রিপোর্টিং?’ আদিত্য বলল ।
‘মেয়ে বলেই মেয়েঘটিত ব্যাপার ওকে নাড়া দেয়’,ইপ্সিতা বলে উঠল ।

হৈহৈ শুরু হয়ে গেল । পুরুষ বনাম নারী বিতর্ক । যোগ দিয়েছেন সিনিয়ররাও । কুশলদা সৈকতদা তো আছেনই,প্রসূনদা অমরেশদা,সোমাদি,গীতালিদিরাও যোগ দিয়েছেন । মেয়েরা নরমসরম,আবেগে ভাসে। একটু ভীতু টাইপ,অতিরিক্ত প্রোটেকশন দিতে হয় । সব জায়গায় সবসময় পাঠানো যায় না । সেই সূত্র ধরে সুবিধাভোগী বলা যেতে পারে । পুরুষদের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেল । মেয়েরাও গলা ছেড়ে তর্ক করবে না কেন?
জমজমাট বিতর্ক,হাসিঠাট্টা ।
অবশ্য খবরের কাগজের অফিসে এই রোজকার দৃশ্য । খুনজখম-রাহাজানি-সন্ত্রাসের ঘটনা প্রবাহ রিপোর্ট করতে করতে কর্মীরা এমনিই নিস্পৃহ নির্লিপ্তি শিখে ফেলেছে ।
‘আমি একটা কথা বলি?’ জয়ন্ত হাত তুলে থামাতে চাইল,‘ভয় কি শুধু ভূতের হয়? এক্ষুণি যে কৃষক আন্দোলনের কথা বললেন কুশলদা,ওখানে ভয় নেই? বিপন্নতা,অসহায়তার ভয়? কিংবা এই যে ধরো,ডাক্তাররা কালাদিবস পালন করবেন,একটা অবৈজ্ঞানিক অশিক্ষার দাপট সমাজের ওপর এসে পড়েছে,সেটা ভয়ের নয়? নাকি এই যে হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক,ওটা একটা ভয় নয়? এই মারণ-ভাইরাসের জন্যেই কতরকম ভয় তৈরি হয়েছে নতুন করে । অসুখের ভয়,ডিপ্রেশনের ভয়,চাকরি হারানোর ভয়,চাকরি থাকলেও মাইনে কমে যাবার ভয়,নতুন রোজগারের রাস্তা বন্ধের ভয় । ভয় কি একটা?‘
সবাই চুপ । বাতাসটা ভারি হয়ে উঠল ।
কুশলদা ভারি গলায় বলে উঠলেন,‘ঠিক বলেছে জয় । কারো মাথার ওপর ছাদ নেই । কারো রোজগার চাই,কারো দু’বেলা দু’মুঠো ভাত । সব জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দাম,খেতে না পাবার ভয়। ভয় অনেকরকম । নীলু যেতে চাইছে,যাক । অনিমেষকে সঙ্গে দিচ্ছি । ক্যামেরার কাজটা করবে,দরকার মতো নীলুকে নিয়ে বেরিয়ে আসতেও পারবে । জয়,তুই ডাক্তারদের কালাদিবসের কথাটা তুলে ঠিক করেছিস । আমি আগেই ভেবেছি এই নিয়ে । তুই,মৌমিতা,লিপি,কমল… জেলায় জেলায় ঘুরে ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে একটা রিপোর্ট তৈরি কর । ক্যামেরায় কে কে থাকবে,অমরেশ তুমি দেখে নাও । আর আদি,তুই দিল্লি চলে যা । কিষান-আন্দোলনের লেটেস্ট রিপোর্ট । তোর সঙ্গে ক্যামেরায় ঋষি যাক ।‘
প্রসূন উঠে দাঁড়ালেন,‘নীলাঞ্জনা,তুমি আমার ঘরে এসো । এই স্টোরিটা করতে গেলে আরো কিছু জানা দরকার। তুমি তারপর নিজের মতো হোমওয়ার্ক করে নিও ।‘
‘অনিমেষকেও কি ডেকে নেব,প্রসূনদা?’ নীলাঞ্জনা উঠে দাঁড়িয়েছে সঙ্গে সঙ্গেই ।


এই জায়গাটা বিহার-উত্তরপ্রদেশের বর্ডার । এদিকে বিহারের বক্সার জেলার চাউসা গ্রাম,আর ভুতুড়ে গ্রাম পেরিয়ে উল্টোদিকে খানিক গেলেই ইউপির গাজীপুর জেলার গাহমা গ্রাম । দু’দিক দিয়েই গ্রামে ঢোকা যায় । কিন্তু এখন সাংবাদিকদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না । প্রসূনদা বলে দিয়েছিলেন আগেই । নিজের পছন্দের বড় ক্যামেরা আনার রিস্ক নেয় নি অনিমেষ ।

দেহাতী একটি বউ আর তার স্বামী । চাউসা ছাড়িয়ে আরো দু’টো গ্রাম পেরিয়ে এসে আটকে পড়েছে।
‘উস মুর্দো কা গাঁও মে? মত যাও’….সবাই বলছে । ও গ্রামের দিকে কেউ যাচ্ছে না । বেওয়ারিশ কুকুর,শেয়াল আর আকাশপথে চিল শকুন কাক । তাছাড়া কেউ না ।
‘দিনের বেলায় আঁধার ওখানে । ওই দ্যাখো,দেখতে পাচ্ছ? কেমন কালো ধোঁয়া? আর ওই কালো মেঘ দেখছ,ও কিন্তু মেঘ নয় । তেনাদের নি:শ্বাসে অমন হয়েছে ।’
‘তুই কথা বলবি না নীলু’,আগেই বলে দিয়েছে অনিমেষ,‘তোর হিন্দী শুনলে সন্দেহ হবে । যা বলার আমি বলব ।‘ অনিমেষ পাটনায় ছিল সাত-আটবছর । হিন্দীভাষীদের মত বিহারের মগহী ভোজপুরী ভাষা বলতে পারে ।
সেই ভোজপুরী ভাষায় বলছে এখন,‘আমার শ্বশুর এসেছিল ওখানে । রিস্তেদারের কাছে । বাস ট্রেন বন্ধ হয়ে গেল বলে ফিরতে পারে নি । হয়ত আটকে আছে ওখানেই । তাই আমি আর আমার বিবি এসেছি। আমাদের যেতেই হবে ।‘
‘নহি নহি । কোই জিন্দা নহি হ্যায় উধর । জো ভি গয়া উস তরফ,ওয়াপস নহি আয়া ।‘
বক্তাদের চোখে ভয় । গলার স্বরে ভয় ।

মস্ত একটা অশ্বত্থ গাছ । দশ বারোটা মোটা মোটা ঝুরি নেমেছে । কোনটা আসল কান্ড বোঝা দায়। মোটা ঝুরি লম্বা লম্বা শিকড় হয়ে অনেকখানি ছড়িয়ে পড়েছে । সাত-আটজন গ্রাম্য মানুষ শিকড়ের ওপর বসে । কৌতূহলী চোখে চেয়ে আছে ।
‘নিউজ নহি দেখা? সুনা নহি?’ একজন প্রৌঢ়া মহিলা এসে নীলাঞ্জনার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মাথার ঘোমটা ইচ্ছে করে নামিয়ে দিল নীলাঞ্জনা । কমলা মোটা সিঁদুর । মহিলা বললেন,‘নঈ দুলহন? অব ইয়ে সব খতরনাক জগহ পর বিলকুল মত যা ।‘
‘হমনে দেখা হ্যায় পগদন্ডিয়োঁ পর কঙ্কাল সব ঘুমতে রহতা হ্যায়,জম্হাই লেতা হ্যায় । তভি তো আসমান তক কালা ধূঁয়া হো জাতা হ্যায়। কালা সায়া ।‘ ফিসফিস করে বলল একটি অল্পবয়সী বধূ ।
হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল ‘নঈ দুলহন’ নীলাঞ্জনা,‘বাপু,বাপু ।‘
‘দেখছেন তো,কেমন কাঁদছে? বাপুর কোনো খবর না নিয়ে যেতে পারব না ।‘ অনিমেষ বলল ।
গ্রামের পুরুষমানুষরা জড়ো হয়ে বোঝাতে লাগলেন,‘যাবেই বা কি করে? ও গাঁয়ে যাবার রাস্তা কেটে দিয়েছে পুলিশ । গাছ কেটে গাড়ি যাবার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে । যাতে মিডিয়া থেকে নিউজ করতে না আসে ।‘
‘আহ মোহনচাচা,কেউ শুনতে পেলে কি হবে জানো না? কেন এসব বলছ ওদের?’
এদিক ওদিক তাকিয়ে চুপ করে গেলেন বৃদ্ধ ।
সাবধান করে দেওয়া মানুষটি বললেন এবার,‘আমি এখানের স্কুলের হেডমাস্টার । ওই ছোট জঙ্গলটা পেরোলে মুর্দা-গাঁ যাবার আগেই এই এলাকার একমাত্র স্কুল । সরকারী স্কুল । করোনার জন্যে স্কুল একবছর ধরে বন্ধ,গাঁ থেকে স্কুলে যাবার রাস্তাটাও জঙ্গলে ঢেকে গেছে । নইলে এখান থেকেই দেখা যেত । আমি বলছি,ওই গ্রামে যাবার কোনো উপায় নেই । রাস্তা নেই । আর ওদিকে দ্যাখো,আমাদের নদী । ডজন ডজন পচা ফুলে ওঠা লাশ ভেসে আসছিল নদীতে । ভেসে আসা লাশ আটকানোর জন্যে পুলিশ নদীতে জাল পেতেছে । নৌকো করেও যেতে পারবে না ।‘

ডজন ডজন না,শত শত । বিবিসি নিউজে দেখিয়েছে,ইউপির কান্নাউজের মেহন্দি ঘাটে মানুষের শরীরের আকৃতির সমান সার সার ঢিবি । মাহদেভি ঘাটে নদীর চরে বলি চাপা দিয়ে রাখা সারি সারি মৃতদেহ । কান্নাউজ,কানপুর,উন্নাও,প্রয়াগরাজে নদীর তটে বহু অগভীর কবর । কুকুর শিয়ালরা কবর খুঁড়ে মৃতদেহ ছিঁড়ে খাচ্ছে ।
শিউরে উঠেছে মানুষ । অসহায় বিপন্ন মানুষ । ভয় । করোনা নামক মারণ-ভাইরাসের ভয় । অসুখের ভয় । ভ্যাকসিন নেই । অসুখ হলে হাসপাতালে ভর্তি হবার উপায় নেই । হাসপাতালে বেড নেই,ভেন্টিলেটার নেই,জরুরী ওষুধ নেই । সেই ভয় । হাসপাতালে ভর্তি হলেও ভয় । ভর্তি থাকা অসুস্থ মানুষের জন্যে অক্সিজেন নেই । কোথায় যেন হাসপাতালে আগুন লেগে কত কত শয্যাশায়ী মানুষের জীবন শেষ হয়ে গেছে । মৃত্যুভয় । মৃত্যুর পরে দেহ-সত্‍কারের উপায় না থাকার ভয় ।
সব শ্মশানে,ক্রিমেটোরিয়ামে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা মৃতদেহ জ্বলছে । সারি সারি চিতা । শ্মশানের,ক্রিমেটোরিয়ামের বাইরের খোলা মাটিতে কাঠ দিয়ে লাশ পোড়ানোর ব্যবস্থা করেও সব সত্‍কার সম্ভব হয় নি । দাহ করার জন্য কাঠ নেই,টায়ার জ্বালিয়ে দাহ করেও কাজ শেষ হচ্ছে না ।
এত মৃতদেহ । নদী তীরে এত লাশ ভেসে এসেছে যে,এখান থেকে পচা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে ।
এখানে এসে দেখছে,বিপর্যস্ত মানুষের আরেকরকম ভয় ।
গাঁয়ের মুখিয়া আর এলাকার বিধায়ক দু’জনেই সাবধান করে দিয়েছেন,কেউ যেন বাইরের লোকের কাছে মুখ না খোলে । একটা ভিডিও বা অডিও যদি বাইরে যায়,তাহলে ‘গাঁও সে নিকল জানা পঢ়েগা ।‘


‘ভূখে কঙ্কাল হ্যায় সব ।‘ গলা নামিয়ে বলল ছেলেটা । ওর নাম শ্যামলাল । একটা স্মার্ট-ফোনের খুব শখ ওর । ভাগ্যিস পুরোনো মোবাইল-সেটটা এনেছিল নীলাঞ্জনা । আগেরবার আসামে ছিটমহলে নিউজ করতে গিয়ে মোবাইল খোয়াতে হয়েছিল । ছবি,ভিডিও সমেত মোবাইল বাজোয়াপ্ত করেছিল এলাকার প্রভাবশালী এক নেতা । ক্যামেরা,মোবাইলসুদ্ধ টিমের চারজনকে আটকে রেখেছিল দু’রাত । কি ভয় যে পেয়েছিল সেবার! আর বুঝি বাড়ি ফেরা হল না । সাংবাদিকতার ঝুঁকি অনেক ।
তারপর থেকেই অন্তত দু’টো এক্সট্রা মোবাইল সেট সঙ্গে রাখে নীলাঞ্জনা ।

গ্রামের লোক একটা রিক্সাভ্যান জোগাড় করে দিয়েছিল । মুর্দা-গাঁও যাবে না কথা দিতে হয়েছিল । ভ্যানচালকও বলছিল,‘উয়ো কঙ্কাল সব জিধর ভি ঘুমতা হ্যায়,বিলকুল অন্ধেরা হো জাতা হ্যায় । ঢীলে পঞ্জরোঁ কা খড়খড়াহট ইধর তক সুনাই দেতা হ্যায় ।‘
‘কি বলছে রে?’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করেছিল নীলাঞ্জনা,‘তখনও কি একটা জমহাই না কি বলল!’
‘জমহাই না,জম্হাই । মানে ঘুম থেকে উঠে হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙা । আর ওই ঢীলে পঞ্জর… মানে কঙ্কালের পাঁজরের হাড় । ঠকঠক আওয়াজ করে ।‘
এই শ্যামলাল দৌড়ে দৌড়ে এসেছিল তখন । কি একটা বলল উত্তেজিত হয়ে ।
‘আপনারা একটু অপেক্ষা করুন,আমি আসছি । আমার বাড়িতে একটা সাপ বেরিয়েছে ।‘ ছুটে চলে গেল ভ্যানচালক ।
‘কি সাপ?’
‘কালী নাগিন ।‘ ছেলেটা তেমন উত্তেজিত নয় । এমন খবর গ্রামে প্রায়ই হয় । ওর চোখ অনিমেষের হাতের দিকে । বারবার হাতের মোবাইল-ফোনের দিকে তাকাচ্ছে ।
নীলাঞ্জনা বলে উঠেছে,‘কালকেউটে । বুঝেছি ।‘
হাতের মোবাইল-সেটটার দিকে ইশারা করেছিল তারপর । অনিমেষ বুঝতে পারে নি,‘কি বলছিস?’
বুঝিয়ে বলার সময় নেই,ভ্যানচালক ফিরে আসতে পারে । সাপের খবর শুনেই বোধহয় গাঁয়ের লোক ওদিকে ভিড় জমিযেছে,এই সুযোগটা নিতে হবে । ভাঙা ভাঙা হিন্দীতে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল নীলাঞ্জনা,‘দেখবে এই ফোনটা? তোমার মোবাইল ফোন কই? আমাকে দেখাও ।‘
‘নহি হ্যায় । বাপু কে পাস হ্যায়,ছোটা ফোন । ইয়ে তো স্মার্ট-ফোন হ্যায় না?’ চকচকে হয়ে উঠেছিল দু’চোখ ।
পাঁচমিনিট সময় লেগেছিল তারপর ।

ভুতুড়ে গ্রামে যাবার কথা শুনে ভয় পেয়েছিল শ্যামলাল,‘ভূখে আত্মা হ্যায় সব । জব উয়ো নিকলতে হ্যায়,আসমান কে গিদ্ধড় ভি ভাগ জাতে হ্যায় ।‘
আকাশের শকুন পালিয়ে যায়,চিল ডানা দিয়ে শরীর ঢেকে গাছের আগায় বসে পড়ে,কাকেরা ভয়ে গাছের পাতার আড়ালে ঢুকে যায় । এমনকি শেয়াল কুকুরগুলো পর্যন্ত ভয় পেয়ে পালিয়ে যায় । শ্যামলাল নিজের চোখে দেখেছে । তবু যেতে রাজি হয়েছে শেষপর্যন্ত । কারণ একটা স্মার্ট-ফোন ।
মানুষের অন্যতম আদিম রিপু । লোভ । লোভের জন্যে ভয়কেও কাটিয়ে ওঠা যায় ।
ক্ষমতাশালী প্রতিপত্তিশালী লোকেরা পর্যন্ত ভয়কে কাজে লাগিয়ে কতরকম লোভের কাছে বিকিয়ে আছে । কেউ এই ভয়কে হাতিয়ার করে রাজনীতির পাশাখেলার চাল দিচ্ছে,কেউ এই ভয়ের সুযোগে ব্যবসা বাড়িয়ে নিচ্ছে । কালোবাজারি থেকে হোর্ডিং । কেউ রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীর ভয়ের সুযোগে বিলাসবহুল বাড়ি কিনে ফেলছে,কেউ ওষুধ-অক্সিজেনের কুপ্রভাবের কথা বলে অবৈজ্ঞানিক জড়িবুটির ব্যবসায় কোটি কোটি টাকা লাভ করছে ।
আর এ তো একটা গ্রাম্য ছোট্ট ছেলে ।


রাস্তা কেটে দিয়েছে প্রশাসন । শ্যামলাল তাই জঙ্গলের পথ ধরেছে । এমন জঙ্গলের পথে চলা এই প্রথম। জারুল কুর্চি শিমুল পলাশ । আরো অনেক নাম-না জানা গাছ । জঙ্গলের গন্ধ । ছায়া ছায়া পথ । মায়া মায়া শান্তি । কিন্তু পথিকরা জানে,সবটাই এমন নিবিড় শান্ত নয় ।
সারি দিয়ে গাছ । বুনোখেজুরের ঝোপ । কালচে পাথুরে জমিতে সবুজের মেলা । এপ্রিলমাসের জঙ্গল,ঝোপঝাড় শুকিয়ে গিয়ে পাতা ঝরে গিয়ে মাঝেমাঝেই জঙ্গলে অনেকখানি করে খোলা জায়গা । ধানক্ষেত,তাল গাছ,বুনো খেজুরের ঝোপ,মহুয়া,অশ্বত্থগাছ একে একে পার ।
গাঁয়ের দেখা নেই । এত গাছ,তবু মাঝে মাঝেই গরম হাওয়ার ঝোঁক । এদিকের গ্রামে এখনো শহুরে মানুষের পা তেমন করে পড়ে নি ।
দু’টো বাঁশবন পার হয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আরো অনেকখানি । তারপর একটা ছোট টিলাপাহাড় । বুনো পাখি,মেঠো ইঁদুর । বুনো পেঁপে,কুঁদ্রু,ঝিঙে,নেনুয়া । অল্প ধান । চাষের জমি । জমিতে ধান কাটা হয়ে গেছে,এখন ধু ধু করছে । শুকনো শিকড়ে হোঁচট খেতে হচ্ছে মাঝে মাঝেই । যেমন গরম,তেমন ধূলোবালি ।
‘কিসের চাষ হয়?’
শ্যামলাল বলল,বুনো আলু,মেটে আলু । খেতি হয় মেটে আলুর । ধান যব বাজরা,আর আলু । কেউ কেউ তার মধ্যেই ফুটিয়ে তোলে লাউ,ঝিঙে,নেনুয়া,বেগুন ।
কথা শেষ হয় নি,গলা দিয়ে অস্ফূট চিত্‍কার বেরিয়ে এসেছে । চাষের জমিতে ইতস্তত পড়ে আছে অনেকগুলো প্রাণহীন দেহ । পায়ের শব্দে বিরক্ত হয়ে সরে গেল দু’চারটে শিয়াল । কুকুরগুলো তেড়ে এল। গাছের ডাল ভেঙে হাতে নিয়ে শিয়াল কুকুর তাড়াতে লাগল শ্যামলাল ।
গরম হাওয়ার হলকা । হাওয়ার সঙ্গে দুর্গন্ধ । ডাবল মাস্ক মুখে,তবু গা গুলিয়ে উঠল । সেলফোনে ছবি তুলে নিচ্ছে অনিমেষ । শ্যামলালকে নিয়ে গ্রামের দিকে এগিয়ে গেল নীলাঞ্জনা ।
ছোট গ্রাম । গ্রাম না বলে বস্তী বলাই ভালো । বারো-চোদ্দ ঘরের বস্তী ।

একটা ছোট্ট কুঁড়ে । একটাই ঘর,সামনে অনেকখানি উঠোন । পরিষ্কার করে নিকোনো । ঘরের পাশে একটা লম্বা ছায়া ছায়া সজনে গাছ । ভয়ের মনটা শান্ত হয়ে আসছে মায়ায় । তারপরই চমকে উঠল নীলাঞ্জনা । সজনে গাছের তলায় একটা ঢিবি । একদিকে বেরিয়ে আছে দু’টো পায়ের পাতা । সবুজ শাড়ির একটুখানি পা ঢেকে রেখেছে । পায়ের নিচে গর্ত থেকে বেরিয়ে এল একটা ধেড়ে ইঁদুর । ছুটে এল । ভয়ে লাফিয়ে উঠে সরে গেছে নীলাঞ্জনা ।
এখানেই দেহটিকে মাটি চাপা দিয়েছিল কেউ? ইঁদুর মাটি খুবলে নিয়েছে,তাই পা বেরিয়ে এসেছে ।
‘অনিমেষ’,ডাকতে চাইল জোরে,গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোলো না । শ্যামলালই বা কোথায় গেল?
আনমনে পিছিয়ে এসেছে কুঁড়েঘরের দিকে । ‘পিছে.. পিছে..’শ্যামলালের ভয়ার্ত গলা ।
পেছনে তাকিয়ে ভয়ে চমকে উঠল আবার । কুঁড়েঘরের দরজা খোলা,আর দরজার ঠিক সামনেই একটা কঙ্কাল ।
‘উয়ো সাঁস লে রহা হ্যায়,দেখা আপনে?’ কঙ্কালের গায়ের জামা হাওয়ায় উড়ছে ।
‘আহা,একেবারে দরজার কাছে পড়ে আছে । ঘর থেকে বেরোতে চাইছিল বোধহয় ।‘ অনিমেষ ।
‘আর ওই দেহটা বোধহয় ওর স্ত্রী । কিংবা মা ।‘

জরাজীর্ণ শ্রীহীন গ্রাম । নিদারুণ দারিদ্র্য । পাথুরে জমিতে ফলন নেই । বাথানে গোবর নেই,গরুগুলো কোথায় গেল কে জানে । বাড়িগুলোয় পাতার চাল,কাঁকড় আর মাটি মিশিয়ে দেয়াল ।
হাত তুলে দূরের একটা বাড়ি দেখাল শ্যামলাল,‘মেরা দোস্ত সোহন কা ঘর । উ উনলোগকা নাও ।‘ বাড়ি না,বাড়ির কঙ্কাল । ছাদ নেই,মাটির দেয়াল ভেঙে পড়েছে । ভাঙা দেয়ালের পাশে একটা নৌকো।
নৌকোর ওপর আধপোড়া একটা শরীর । ‘চাচা! সুধীরচাচা!’ শ্যামলাল ডেকে উঠল ।
অর্ধদগ্ধ দু’চারটে টুকরো কাঠকুটো,আর ঘাসপাতা । দেহ জ্বালানো হয়েছিল কোনোরকমে,হয়ত হাওয়ায় আগুন নিভে গেছে ।
‘কি করবি? আর গিয়ে কি হবে? কেউ বেঁচে নেই । ওই দ্যাখ,ওই বাড়িটার সামনে তিনটে ঢিবি, নিশ্চয় মৃতদেহ ।‘ অনিমেষ এগিয়ে গেল ছবি তুলতে । তারপরই লাফিয়ে পিছিয়ে এল । ঢিবির তলা থেকে বেরিয়ে এসেছে মোটা একটা বেজী ।
ঝোপের আড়ালে আর একটা শরীর । নীল চেক লুঙ্গি,গায়ে একটা হলুদ চাদর,মাথায় চৌকো টুপি, হাতে মোটা কালো বালা,গলায় তাবিজ । এই মৃতদেহটাকে মাটি দেবার লোক পাওয়া যায় নি । প্রবল দুর্গন্ধ। দশ বারোটা ঝাঁপি ছড়িয়ে আছে ইতস্তত । সাপের ঝাঁপি? সাপগুলো বেরিয়ে কোথায় ঘুরছে কে জানে ।
নিঝুম গা-ছমছম । রহস্যময় সুদূর । কোথায় হারিয়ে গেল গ্রামসুদ্ধ সব মানুষ? সবাই মরে গেছে?
নাহ,আর কিছু দেখার নেই । এবার ফিরলেই হয় ।

‘একটাও ছোট শরীর দেখলি অনিমেষ?’ নীলাঞ্জনা জিজ্ঞেস করল,’বাচ্চাগুলো কোথায় গেল? আচ্ছা শ্যামলাল,তোমার বন্ধুর কথা বললে না তখন?’
‘পতা নহি । মর গয়া হোগা ।‘ নির্বিকার গলায় উত্তর এল ।
এদিকে পাশাপাশি তিনটে কুঁড়েঘর । একটা গর্ত খুঁড়ে রাখা । পুরোটা খোঁড়া হয় নি,কেউ যেন গর্ত খোঁড়া ফেলে রেখে হঠাত্‍ চলে গেছে । পাশে একটা খুরপি পড়ে আছে । একটা শব,আধখাওয়া । এখনো রক্ত লেগে আছে । পাশেই গাছের ওপর তিনটে শকুন । মানুষের আওয়াজে খাওয়া ছেড়ে উঠে গেছে ।
একটা মাটির উনুন । পাশেই কানাউঁচু থালায় নুন আর ভুট্টা সেদ্ধ । একটা কলাইকরা থালায় কিছু শেকড়,বুনো আলু । যেন এখুনি কেউ রেখে গেছে,এসে খেতে বসবে । অনিমেষ ছবি তুলে নিল ।
কুঁড়েগুলোর ঠিক পেছনে একটা পুকুর । আনমনে পুকুরটার দিকেই চেয়ে ছিল নীলাঞ্জনা । টলটলে জল,গাছের ছায়া পড়ে মায়াবী সবুজ । ভারি সুন্দর । রুক্ষ রুদ্র মায়াহীন গ্রামে প্রকৃতির দান ।
ও কি? একটু চমকে উঠল তারপর । জলের মধ্যে অমন ভুরভুরি দিয়ে উঠল কেন?
তারপর চমকে উঠেছে তিনজনেই । জল থেকে উঠে আসছে ও কে? প্রেতাত্মা বুঝি এমনই হয়!
‘ভূত । ভূখে কঙ্কাল!’ শ্যামলাল ভয়ে আঁকড়ে ধরেছে অনিমেষের হাত ।


মানুষের মতো,কিন্তু মানুষ তো নয় । এই কি তবে বনমানুষ? নাকি প্রেত? মাথার একদিকে লম্বা চুল,কঙ্কালের গায়ে চামড়া জড়ানো,দুটো লম্বা দাঁত,দাঁতে লাল রঙ । রক্ত নাকি? এই আধ-খাওয়া মৃতদেহের রক্ত?
হাতে একটা ধারালো লম্বা লোহার শিক,আরেকহাতে মাটিমাখা শামুক-গেঁড়ি-গুগলি ।
ভয়ে অবশ সারা শরীর । ছুটে পালানোর ক্ষমতাও নেই কারো ।
গেঁড়িগুগলি মাটিতে রাখল পিশাচের মতো বনমানুষটি । খুরপি হাতে তুলে নিল । হাতে একটা লোহার বালা । নারীসূচক আর কোনো চিহ্ন না থাকলেও মনে হচ্ছে মূর্তিটি মেয়েলী ।
তারপর ঘুরে দাঁড়াল । অনিমেষের পেছনে লুকিয়ে পড়তে চাইল শ্যামলাল । সেদিকেই হাত বাড়িয়ে দিল প্রেতিনী । কি করতে চাইছে? ভয়ের হিমেল স্রোত, শিরশির করে উঠল শরীর । তবু নড়তে পড়ছে না কেউ । চিত্রার্পিত অবস্থা বুঝি একেই বলে ।
জিভ বার করে দাঁতের রক্ত মুছে নিল পিশাচ । তারপর আবার হাত বাড়িয়ে দিল । মুখের কাছে একবার নিয়ে গেল হাতটা । খাবার চাইছে? খাবার চাইছে যখন,তাহলে তো ভূত নয় । মানুষ ।
ব্যাগ থেকে বিস্কুট আর কেক বার করে দিল নীলাঞ্জনা । খাবার দেখে খলখল করে হেসে উঠল । হাসির আওয়াজ মেয়েলী । কিন্তু ভয়ঙ্কর হাসি । দাঁতগুলো বেরিয়ে এসে আরো ভয়ানক লাগছে ।

শ্যামলাল হঠাত্‍ দৌড় দিল । ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে গ্রামের দিকে । এই অবস্থায় ওই গ্রামে পৌঁছে গেলে সমূহ বিপদ । অনিমেষ আর নীলাঞ্জনাও ছুটতে শুরু করল । অজান্তেই অনুসরণ করছে ।
প্রেতিনী মূর্তিটিও ছুটে আসছে । একলাফে টেনে ধরেছে অনিমেষের কাঁধের ব্যাগ । হাতের লম্বা ধারালো নখে পিঠের জামা ছিঁড়ে আঁচড় পড়েছে অনিমেষের । হাতেও নখের আঁচড়ে রক্তের লম্বা দাগ ।
ব্যাগ খুলে সব জিনিস ছত্রাকার । হুমড়ি খেয়ে পড়েছে না-মানুষ না-প্রেত প্রাণীটা । কলা বিস্কুট চিপস কেক । দু’হাতে সব জাপটে নিয়ে আবার ছুটতে শুরু করেছে ।
খিদে পেয়েছে ওর । মানুষটি ক্ষুধার্ত । সম্ভবত এ গ্রামে একমাত্র জীবিত মানুষ । মহিলা ।
নীলাঞ্জনা দৌড় দিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে । ‘দাঁড়া নীলু, আমিও যাব ।‘
’তুই ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে আয়,নইলে ওকে হারিয়ে ফেলব ।‘ হাওয়ায় চিত্‍কার করে ভাসিয়ে দিল নীলাঞ্জনা ।
জঙ্গলের রাস্তায় কাউকে অনুসরণ করা সহজ নয় । এদিকে কোথায় যাচ্ছে মহিলা? খাবার নিয়ে ছুটছে। তাহলে কি আরো কেউ বেঁচে আছে?

একতলা একটি বাড়ি । পাকা বাড়ি । মহিলাকে দেখা যাচ্ছে না আর । ওই বাড়িতেই ঢুকেছে?
‘মনে হচ্ছে এটাই সেই স্কুল ।‘ অনিমেষও এসে পড়েছে ।
‘চল,ভেতরে দেখি ।‘
‘ওর মতো আরো কেউ যদি থাকে? যদি অ্যাটাক করে?’
‘করবে না । তুই বুঝলি না অনিমেষ? ও একা একা বেঁচে থাকার লড়াই করছে । গর্ত খুঁড়ে মৃতদেহ কবর দিচ্ছে । আরো কেউ যদি থাকত,ও কি একা থাকত?’
‘ঠিক বলেছিস’,সামলে নিয়েছে অনিমেষও,‘এক এক করে সবাই মরে গেছে । মরে যাবে ও নিজেও । মরার আগে প্রাণপণ লড়াই করছে । চল,একজনকেও যদি বাঁচাতে পারি ।‘
‘একমিনিট । কুশলদাকে একটা ফোন করে ব্যাপারটা জানিয়ে দে । আমি ডিএম ভদ্রলোককে জানিয়ে দিই ।‘
‘হ্যাঁ,এতক্ষণে শ্যামলাল নিশ্চয় গ্রামে পৌঁছে সব বলে দিয়েছে । আমাদের যদি আটকে দেয়…’
‘কুশলদা সব ব্যবস্থা করে ফেলবে,পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে তো ।‘

নয়জন বালক বালিকা । হাপুস হুপুস খাচ্ছে । কলা চিপস বিস্কুট কেক । লম্বা দাঁত বার করে হাসছে প্রেতিনী,আনন্দে লুটোপুটি খাচ্ছে । ছোট্ট প্রাণগুলোকে মারণ-ভাইরাসের কবল থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে এতদিন । মেটে আলু,ফলপাকুড়,গেঁড়িগুগলি,শেকড়বাকড় খাইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে মাযের মতো ।
হাতের প্যাকেট থেকে বিস্কুট বার করে একজন খুদে বাড়িয়ে ধরল মাযের মুখে । কুকুরের মতো ঘন ঘন লালা ঝরছে মাযের মুখ দিয়ে । বড় বড় শ্বাস পড়ছে । কচি হাত থেকে বিস্কুট নিয়ে খাইয়ে দিল তাকেই ।
অনিমেষ ছবি তুলে নিচ্ছে টুকটাক । মুর্দা-গাঁয়ের জীবনের ছবি । মৃতদেহের গ্রামে ভালোবাসায় বেঁচে থাকার ছবি ।
চোখ ভরে জল এলো নীলাঞ্জনার । ঝাপসা হয়ে এল চারদিক । ভয় না থাকলে সাহস চেনা যায় না । ভয় আছে বলেই মানুষ তাকে জয় করার আশা করে । জেগে ওঠে মানুষ । জেগে থাকে মনুষ্যত্ব ।

Facebook Comments

Leave a Reply