শব্দের প্রতিশোধ : ফাল্গুনী ঘোষ
পান্ডুলিপিটি নিয়ে সেই কবে থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে মানুষটা। যদি এইটাই শেষ পান্ডুলিপি হয়! কলম মৃত হয়ে ওঠে! দু আঙুলের ফাঁকে ঝুলে থাকা কলমটিকে আরো আঁকড়ে ধরে সে। এ কেমন ভয়!
এটি একটি মানুষের গল্প, যার মান এবং হুঁশ বুদ্ধি খুব কড়া ধরণের। ছোট্টবেলা থেকেই মানুষের না শুনতে অভ্যস্ত নয় সে। তা বলে অন্যায় আবদারও করে না। ঠিক জানে কোথায় কী চাইতে হয়, কতটুকু আশা রাখা প্রয়োজন। পেটে খিদে থাকলেও মুখে চায়নি কাউকে। খাবারের সামনে গিয়ে হেসে হেসে ঘুরে এসেছে। কেউ ভদ্রতা করলে প্রত্যাখ্যান করেছে সে আমন্ত্রণ, পাছে লোভী ভাবে।
তেমন কিছু মারাত্মক করে উঠতে চায়নি মানুষটা। আর পাঁচটা জনগণ যে কারণে আমজনতা হয় সেও তেমনি জুতোর শুকতলা খুইয়ে একের পর এক ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পায় একদিন। বড়সড় পাস দিতে পারেনি। সুতরাং চাকরিটিও আম আদমির মতই। বললে বিশ্বাস করবেন না, এরকম আমজনতা খেয়ে, পড়ে, ঘুমিয়ে মন্দ থাকে না। এপাশ ওপাশ ফিরে টেবিল চাপড়ে, খেলা আর রাজনীতির আলোচনা করতে করতে, রাস্তার চায়ের ঠেকে দাঁড়িয়ে মেয়ে দেখতে দেখতে একদিন এদেরও বিয়ে হয়। ঘর সংসারে ছেলেপুলের আবদার আর খাঁই জোগাতেই আম আদমির বাই জুগিয়ে যায় তখন।
এ মানুষটাও কিছু আহামরি ব্যাতিক্রমী নয়। শুধু তার মান আর হুঁশ একটু বেশি এই যা। সেই মান একদিন তাকে খুব সুড়সুড়ি দিল।
‘এ কি জীবন কাটাচ্ছিস রে! শুধু খাওয়া, শোওয়া আর ছেলেপুলে মানুষ করা! তুই তো তেমনভাবে টেবিল চাপড়াতেও শিখলি না! ‘
‘কে বলেছে, কিছুই শিখলাম না। কেউ তো জানে না আমার ডায়েরিকে কত অনন্য ভাবনা চিন্তার শরিক করে রেখেছি!’
তা ভালো, আর তবে কেউ জেনেই বা কি এমন হবে। সেসব উই পোকার শক্তি বৃদ্ধি করবে একদিন… এ নিশ্চিত ভবিতব্য!
খুব মানে লাগলো মানুষটার। তার এতদিনের অভিনব ভাবনা চিন্তা! সেসব পোকার উদরে যাবে! রাত গভীর হলে টেনে বের করল পুরানো ট্রাঙ্কের থেকে ডায়েরি। হলুদ পাতার ডায়েরি। ক্ষয়াটে কালিতে উজ্জ্বল ভাবনার দলিল। উলটে যেতে থাকল পাতার পর পাতা। এই তো এগুলো এখনও কত মেরুদণ্ডযুক্ত। এদের তাহলে ক্ষয়রোগে ধরেনি। ডায়েরির পাশে রাখা কলমটিকে আলতো হাতে স্পর্শ করল। কী অভিমান তার! ‘ এতদিন কোনো খোঁজ খবর নাও নি যে বড়… ‘
কলম তুলে ডায়েরির বাকি পরে থাকা পাতার দরজায় কড়া নাড়তেই খুলে গেল দুয়ার। দুয়ারের অন্দরে পা রাখতেই সুগন্ধী অভিমান বয়ে এল সারা ঘরে। কত তার কারুকাজ। কখনও জমকালো জরি, কখনও বা সূক্ষ্ম সুতোর বুনন। খোদাই হল ‘রাতকথার অভিমান’। আশ্চর্য হয়ে মানুষটি দেখল সে এখনও পারে। সাহস বেড়ে গেল তার। এখন থেকে প্রায় প্রতি রাতের বুকে খোদিত হতে থাকল অজস্র কারিগরি।
ধীরে ধীরে এই এক নেশায় খেয়ে নিল তাকে। আজকাল কলমের সাথে তার গভীর প্রেম। আফিস, কাছারি, বাজার হাটে, রাস্তায়, বাসে কথার কোনো অন্ত নেই। গভীরভাবে মানুষ দ্যাখে, জীবন খোঁজে, যাপন লেখে। চলছিল ভালোই।
কিন্তু ঐ যে আশপাশের লোকজন যা করে –একটু উঁকিটুকি খেলা। যাতে জানা যায় নরম গরম মুচমুচে সব পরস্ব বৃত্তের কিসসা। তেমনই মানুষটার আফিসের লোকজন এ ওকে বলাবলি করে,
“হল কি বলত! আগে দিব্যি দু আনা পাঁচ আনা মানুষের মত ভাব ছিল। কিন্তু আজকাল বড় আনমনা দেখি, উন্মনাও! কলম তুলে মাথা নামিয়ে খসখস করে কি যে লিখে চলে! মুখে রা টি নেই। এ কেমন ধারা! ”
”নিশ্চয় ছেলেপিলে উচ্ছন্নে গেছে। নাহয় বউ এর সঙ্গে বনে না! …
এসব আলোচনার সমাপ্তি ঘটল রহস্য উদ্ধারের পরে। মানুষজন অবাক হয়ে দেখল ডেস্কের গহ্বরে পাতার পর পাতা জুড়ে গল্প কাহিনীর হাট বসেছে। সেই হাটের হিস্যাদার তারাও।
“আরে! অমুক! কি কান্ড! তুমি গল্প লেখ!”
“কী ভালো লিখেছ ভাই কবিতাটি…. ”
প্রতিভার বিস্ফূরণ ঘটল। পত্র পত্রিকায় জায়গা নিল মানুষটির উজ্জ্বল নাম। দিকে দিগন্তরে একটিই কথা, ‘দয়া করে একটি লেখা দেবেন!’
মানুষটি আজকাল প্লট ভেবে রাখে। চরিত্ররা তৈরিই থাকে। শুধু রঙ ঢঙে সাজসজ্জায় সাজিয়ে দেয় তাদের। সবসময় চিন্তা– সাজগোজ, রঙঢঙ যেন সম্পাদকের মন জুড়ে থাকে। ফোনালাপ চলে হামেশাই, তুলনায় কলম চলে কম। ঘরের মানুষেরা একটু ব্যতিব্যস্ত থাকে সেকারণে। বলে,
” এত যে ব্যস্ত লেখা ছাপা হলো না কি তাই নিয়ে! অত লেখা জমা আছে নাকি… ”
“জমা নেই তো কি! লিখব, লিখে জমা দেব …. ”
আর যদি লেখা না বেরোয় কলমে! লিখতে ভুলে যাও…. ”
শিরদাঁড়া শিরশিরিয়ে ওঠে। এরকম হতে পারে না কি! সত্যিই তার কলম বেইমানি করবে তার সঙ্গে। ভাবনা চিন্তার এইসময়েই তাল মিলিয়ে এল সম্পাদকের ফরমান।
‘খ্যাতনামা এক লেখক লিখতে ভুলে গেছে’ — এই বিষয়টির উপর একটি লেখা পাঠান না দাদা দয়া করে। আগামী দুরাত্তির সময়।
আজকাল খুব কম সময়ে অসাধারণ সব প্লট, চরিত্র মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে। মানুষটি অভ্যেস বশে মাথায় দু চারটে টোকা দেয় শুধু। নাহ মুখে সিগারেট থাকে না। ধোঁয়াতে তার এলার্জি। কেমন খুকখুকে কাশি হয়। দম বন্ধ হয়ে আসে, মনে হয় চারপাশে কোনো অসামাজিক কাজের শুরুয়াত হয়ে গেছে। তার চেয়ে বেশ কড়া করে এক কাপ কফি টেবিলের একপাশে বৌ ঢাকা দিয়ে রেখে যায়। রাত নিশুত হলে ঝিমধরা জগতে শুধু মানুষটার কলম লিখে চলে।
এই অভ্যাসের কারণে দু রাত্তির কেন এক রাত্তির সময়েও কত দুর্দান্ত লেখা নামিয়েছে মানুষটি। নিজের পরে বিশ্বাসের থেকে বেশি বিশ্বাস তার কলমের উপর। কিন্তু এ কি অদ্ভুত বিষয়! লেখক লিখতে ভুলে যাবে!
“মনে মনে একটু হেসে ঘাড় কাত করে প্রায় চোখ বুজেই লেখেন এই বিখ্যাত লেখক। তিনি আজ কলম ধরেছেন। কলম চলছে। খসখস করে পাতার পর পাতা ভরে উঠছে। এ এক জাদুকরী কলম যেন। ঝকঝকে, তকতকে। আজ একটি গল্প লিখবেন। আগামী কাল নাহয় লেখকের লিখতে ভুলে যাওয়ার গল্প হবে। আবার একটু হাসে মানুষটি। লেখক লিখতে ভুলে যাবে! তাই হয় না কি! এই তো সে প্রতি রাত্তিরে পাতার পর পাতা লেখে।
নিজের কলম চালানো পাতাগুলো চোখের সামনে তুলে ধরে। কিন্তু কোনো কালো চকচকে কালির আঁচড় চোখে পড়ে না। প্রথম পাতাটি সাদা কেন! সাদা নিদাগ পাতা নির্মম ভঙ্গীতে তার দিকে চেয়ে আছে। এখানেই তো চরিত্রটির অন্তিম অবস্থার কথা লিখেছিল সে। গল্পের ক্ল্যাইম্যাক্স হয়ে এসেছিল প্রায়। লেখাগুলো কোথায় গেল! তবে কি উলটো পিঠে লিখেছে! পাগলের মত পাতা উল্টায়। নাহ সূর্য কিরণের মত সাদা সতেজ পাতা। কালির আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়নি।
এ কেমন করে হয়! সে তো বেহিসেবি লিখে চলে। তাহলে কি কলমে কালি ছিল না। কলমের দিকে তাকায়। হাত বাড়িয়ে কলমটিকে ধরতে যায়, কিন্তু হাত পৌঁছায় না। এই ঘরের মধ্যেই টেবিলের ওপ্রান্তে তার হাত নাগাল পায় না কেন! কলমটিকে দূর থেকে তাকিয়ে দ্যাখে। কেমন ঝাপসা লাগে। মনে হয় যেন কলমটি হাসছে, বলছে আজ আমার মুক্তি। ঘন নিশুত রাত হা হা করে ওঠে। শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে যায় মানুষটির। তবে কি তার আঙুলগুলো বেঁকে গেল! কলম ধরতে পারছে না!
নিজের দুহাতের দশটা আঙুল টেবিল ল্যাম্পের আলোর সামনে এগিয়ে দেয়। কালো ধোঁয়ার মত কালি মাখানো আঙুল। রেখা, উপরেখা, শিরা, রক্তজালিকা কিচ্ছু খুঁজে পাচ্ছে না সে। আঙুলের মাথাগুলো কলমের নিবের মত সূচালো হয়ে উঠছে ক্রমশ। শিউরে উঠে আলোর সামনে থেকে হাত সরিয়ে নেয়। নিজের বুকের উপর হাত রাখে। লাবডুব লাবডুব শব্দ শোনার চেষ্টা করে। শুনতে পায় অনেক কলরোল,
‘আমি তো খারাপ হতে চাইনি। তোমার মনের ইচ্ছেতে খারাপ হতে হল….’
‘আমি এত তাড়াতাড়ি মরে যেতে চাইনি…’
আমার খুব প্রেমিকা হওয়ার সখ ছিল… কিন্তু তুমি আমাকে ধার্মিক সাজিয়ে রেখে দিলে….. ‘
কানে দুহাত দিয়ে চাপা দেয় মানুষটি। বিগত লেখার চরিত্রেরা আজ তার অন্দরে চেপে বসেছে। নিজের আঙুল খুঁজে পাচ্ছে না সে। বিনবিনিয়ে ঘাম ছোটে শরীরে। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে মেঝের এক কোণে। পুরনো অভ্যেসবশে মাথায় টোকা দেয় । ঢং ঢং করে ফাঁপা আওয়াজ হয়। অতি দূর্বোধ্য এক আওয়াজ। কোনো শব্দতরঙ্গ ছোটে না। তাহলে গতকালকেও যে লিখেছে….. সে লেখাগুলো কই? আছে তো, না কি সমস্ত অভিব্যক্তি মুছে সাদা হয়ে উঠেছে!
টেবিলে, ড্রয়ারে, জানালায়, গভীর রাত্রের কালোয়, বারান্দার গ্রিল গলে আসা চাঁদের আলোয় শব্দ খোঁজে। হাত মুঠো করে গুটিয়ে রেখে দেয়। শব্দ খুঁজে পেলে যদি তার ধোঁয়া ধোঁয়া আঙুলের অলৌকিকে হারিয়ে যায়! মাথা ঠোকে জানালায়। খুলি ফাটিয়ে শব্দগুলো জমিয়ে রাখবে, যদি কোনো শব্দ পায় মানুষটি। বদ্ধ ঘরে আর থাকতে পারে না। হুঁশবুদ্ধি প্রখর তার। সে বুঝে গেছে এভাবে শব্দদের ধরে রাখা যায় না। উদভ্রান্তের মত বেরিয়ে পরে রাস্তায় সে…. মাথা ঠোকে পাথরে….. বুকের মধ্যে গুটিয়ে রাখে হাত…. ”
* * * * *
বড় কাগজের অফিসে কতই না অনামী লেখা জমা পড়ে। এইসব লেখার স্তুপের মধ্যে থেকে একটি লেখা সম্পাদককে ভাবিয়ে দিয়েছে। লেখক অনামী। তাঁর পান্ডুলিপির বিষয় বড় অদ্ভুত—
‘খ্যাতনামা এক লেখক লিখতে ভুলে গেছে’।
Posted in: June 2021 - Cover Story, STORY