সম্পাদকীয়
ভয়, এক শাসন-যন্ত্র। ছোট থেকে আমাদের সেই ভাবেই ভয় পেতে শেখানো হয়। বকার ভয়, মারের ভয়, খেতে না দেওয়ার, বাড়ি থেকে বার ক’রে দেওয়ার ভয়, কিছু আইনি, কিছু বেআইনি ভয়, এমনকি ভূতের ভয়ের মতো বিমূর্ত ভয়ও থাকে শাসকের যন্ত্র-বাক্সে। এ’সবই পোষ মানানোর প্রয়োজনে, নিরস্ত করার প্রয়োজনে… যাতে শাসকের তৈরি সিস্টেমের জন্য আমরা বিপদ না হয়ে উঠি। “আমি ভয় করব না ভয় করব না”, জাতীয় গানগুলি তাই একরকম প্রতিষ্ঠান-বিরোধী গানই। কেউ কেউ এর মধ্যে থেকেই বীর হয়ে ওঠেন — সবাই হয় না, তারা সিনেমার ভয়হীন নায়ককে দেখে হাততালি দেয়। একবার কিছু টাকার বিনিময়ে কোনো চ্যানেলের সাবস্ক্রিপশন কিনলেই সকাল রাত্রি জীবন অজস্র বীরের সাহচর্যে ভ’রে যায়। আরও এক রকম বীর আছেন, যাঁরা ভয় সম্পর্কে বোঝাপড়াটাই বদলে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন, এবং ক্রমশ বীর হয়ে উঠেছেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে — যেমন, চলন্ত ট্রেনের ছাদে উঠে হাই ভোল্টেজ তারে ডাণ্ডা মারা বীর, বাইক নিয়ে রাস্তায় ভেলকি দেখানো বীর, নিজেরই যৌন জীবনের ভিডিও নিজেই পর্ন সাইটে আপলোড করা বীর… ইত্যাদি। এগুলোর কোনোটাই ভাল/খারাপ এসব বাইনারি কিছু নয়, কোনো বিশেষ রেফারেন্স ফ্রেম ছাড়া তেমন কিছু হয়ও না। মানুষের মন সবসময়ই জীবনের ভ্যালিডিটি খোঁজে, যাকে সে “কাজ” ব’লে জানে। ফলে সমাজের হায়ারার্কিয়াল রেফারেন্স ফ্রেমকে সরিয়ে রাখলে এক অর্থে যে বিজ্ঞানী নতুন আবিষ্কারের নেশায় মশগুল, আর যে কাম-অ্যাডভেঞ্চারিস্ট নিজেরই যৌন জীবন পর্ন সাইটে আপলোড করার নেশায় বুঁদ দুইয়ের মধ্যে খুব বেশি ফারাক করা সম্ভব নয়।
ভয় যে শাসনযন্ত্র এটা আজ আর নতুন ক’রে বলারও কিছু নেই। আমরা প্রত্যেকেই তা নিজের মতো ক’রে জানি এবং ক্ষমতা অনুসারে, প্রয়োজনে ভয় দেখানোর চেষ্টাও করি। পয়সা থাকলে বিপদে আপদে বাউন্সার রাখি, নইলে পেশীওয়ালা বন্ধুকে ডেকে নিই সাথে। নিজের ক্ষমতা অনুসারে মানুষ যেমন যে যার মতো বাড়ি কেনে ঘর সাজায়, তেমনই ক্ষমতা অনুসারে ভয়ও দেখায়। আর রাষ্ট্র এই ভয় দেখানোর মধ্যে দিয়েই নানারকম বার্তা দিতে থাকে প্রজাদের।
২০১৪-এর পর থেকে সংখ্যালঘু হত্যার যে ধারাবাহিক অনুশীলন চলেছে, তার পদ্ধতিগত পার্থক্যগুলো লক্ষ্য করলে — পদ্ধতি পরিবর্তন হওয়ার এক গতিপ্রকৃতি নজরে পরে; এই ভয় তৈরির পিছনে রাষ্ট্রের দেওয়া বার্তাটি ক্রমে স্পষ্ট হয়। প্রথম দিকে বিফ খাওয়া, হিন্দুদের কোনো বিশ্বাসকে আঘাত করা এই মামুলি অজুহাতগুলোর প্রয়োজন পড়ত, শেষের দিকে তা-ও পড়ে না। কেবলমাত্র মুসলিম হওয়ার অপরাধেই ১৬ বছরের জুনেইদকে ট্রেনে মেরে ফেলা হয়, হাতে ৭৮৬ উল্কি করার কারণে হাতই কেটে দেওয়া হয় ইকলাখ সালমানির। বার্তাটা স্পষ্ট হচ্ছে না?
কোভিডের ভয় যে ক্ষমতাপুঞ্জগুলোকে ঠিক কী কী ভাবে আরও ক্ষমতাশালী করছে এ’ নিয়ে ইতিমধ্যেই আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। ভবিষ্যৎ আরও বলবে।
এই বলাটুকু বাদে আর কী-ই বা থাকে আমাদের! ভয় পাবো, পাওয়াবো, অথবা নিজের মতো কোনো এক বীরত্বের জায়গা খুঁজে নেবো — এটুকুই। যুগের পর যুগ জীবনের অর্থ খুঁজতে খুঁজতে একসময় যেমন মানুষ বুঝল এ’ সবই আদতে একমুখী। মানুষ যে অর্থই খুঁজে পাবে তা মানুষেরই রেফারেন্স ফ্রেম অনুযায়ী, ফলে তা জীবনের প্রকৃত অর্থ কী-না এ’ মীমাংসা কোনোদিনও হবে না। এটাই নিয়তি।
