আফজল গুরু-র ফাঁসি – একটি আইনি আলোচনা : অতীন্দ্রিয় চক্রবর্তী

[অতীন্দ্রিয় পেশায় আইন- ও কলমজীবি। কলকাতায় বাড়ি ও বর্তমানে কাজের জায়গা। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে পীপলস ইউনিয়ন অফ সিভিল লিবার্টি-র একটি দলের সাথে হাফতাখানেক কাশ্মীর উপত্যকার আজাদি-স্পর্ধিত বিভিন্ন অস্থির অঞ্চলে কাজের সূত্রে গিয়ে, সেখানের নানান বন্ধুবান্ধবদের সাথে থেকে, কথা বলে, জেনে-দেখে-শুনে-বুঝে-চলে-ফিরে অনুপ্রেরণা আহরণ ও সেই থেকে আজাদির আন্দোলনের বিভিন্ন দিক নিয়ে পড়াশুনা করার চেষ্টা করেছেন। সে’সকল উৎস থেকে তিনি আইনি পর্যালোচনা করেছেন আফজল গুরুর ফাঁসির আদেশের। ‘অপরজন’-এর পাতায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সেই আইনি পর্যালোচনা। এই সংখ্যায় দ্বিতীয় কিস্তি।]

‘স্টেয়ার ডিসাইসিস’

অর্থাৎ, এমন-ও বলা যেতে পারে যে, লিখিত, লেজিস্লেচার-নিবন্ধিত আইনের সাথে সাথে স্বীয় কম্যোন ল্য উপনিবেশ-উত্তরাধিকারায়ত্ব বলে মহামান্য শীর্ষ আদালত সহায় হয়েছে “স্টেয়ার ডিসিয়াসিস” ডক্ট্রিন-এর। অত লাতিন কচকচানিতে গিয়ে লাভ নেই। “স্টেয়ার ডিসাইসিস”-এর মোদ্দা অর্থ হল উপলব্ধ কোনো স্বদেশ ও অন্যান্য কমোন ল্য এক্তিয়ারকে মান্য করে এমন সকল বিদেশ-এর উচ্চ্ব ন্যায়ালয়সমূহের বিভিন্ন একই ধরণের আইনি ইশ্যু ও ঘটনাক্রমিক সাযুজ্যমণ্ডিত জাজমেণ্ট-গুলি-র দিকে – ‘স্টেয়ার’ করা, এবং সেই সব আলোচনার সহায়তা নিয়ে নির্দিষ্ট ইশ্যুগুলিকে ‘ডিসাইড’ করা।

তবে শুধু আগের জাজমেণ্টসমূহ নয়, এই মামলায় স্বীয় সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর অভিপ্রায়ে মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট সহায়তা গ্রহণ করেছেন একাধিক স্বদেশী লেজিস্লেচারাশিসধন্য আইনি ধারার। সেগুলির আলোচনা-প্রসঙ্গ যথাক্রমে আসবে। এখন, এই যে মামলাটার, যেটায় সর্বপ্রথম ট্রায়াল স্তরে থাকার সময় ফরিয়াদিপক্ষ ছিলো দিল্লী রাষ্ট্র তথা ন্যাশানাল ক্যাপিটাল টেরিটোরি অফ দিল্লি-র তরফের পাব্লিক প্রোসিকিউটার এবং অভিযুক্তগণ ছিলেন নভজ্যোৎ সান্ধু ওরফে আফসান গুরু, এস-এ-আর গিলানি, সৌকৎ হোসেন গুরু এবং, মহঃ আফজল, সেটার ধরে এগিয়ে যাওয়া যাক তথ্য ও ক্রম তথা ক্রনোলজির পক্ষে।

ঘটনাক্রম

১৩.১২.২০১১। পাঁচজন ব্যক্তি, যাঁদের মহামান্য সর্বোচ্চ্ব ন্যায়ালয়, ভারতরাষ্ট্র-র তরফ থেকে এই পরিচয়ে ব্যক্ত করা – ‘ফিদায়েঁ মিলিট্যাণ্ট-স’ – ভারতের পার্লামেণ্ট-এ হামলা করলেন। তারপর ১৭-দিন ব্যাপী ইনভেস্টিগেশনের নীটফল হিসেবে চালান হলেন চার অভিযুক্ত – আফসান, আফজল, সৌকৎ এবং এস-এ-আর। এই চারজনের “জৈশ-এ-মহম্মদ” নামক কোন আণ্ডার্গ্রাউণ্ড সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে চার্জশীট জমা পড়লো ২০০২ সালের ১৪-ই মে। ৬ মাসে ট্রায়াল সম্পন্ন হল – যা, সুপ্রীম কোর্টের ভাষায়, ‘রেকর্ড’। ট্রায়াল কোর্টের হুকুমনামা মারফৎ আফজল, সৌকৎ এবং এস-এ-আর-এর তাঁদের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ ও খুনের অভিযোগে, ভারতীয় দণ্ডবিধি সংহিতা, ১৮৬১ -র ধারা ১২১, ১২১-এ, ১২২, ১২০-সি (রাজদ্রোহ) তথা ৩০২ এবং ৩০৭ (খুন)-উল্লঙ্ঘনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলেন, সাথে সাথে দোষী সাব্যস্ত হলেন তদনীন্তন প্রিভেনশান অফ টেররিসম অ্যাক্ট তথা ‘পোটা, ২০০২’-এর ধারা নং ৩ উপধারা নং ‘২’, ‘৩’ এবং ‘৫’ তথা ধারা নং ৪-বি উল্লঙ্ঘন মারফৎ টেররিস্ট কার্যকলাপে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগে, এবং, একই সাথে, ‘কম্পাউন্ডেবল অফেন্স’ হিসেবে, এক্সপ্লোসিভস সাবস্ট্যান্সেস অ্যাক্ট-এর ধারা নং ৪ এবং ৫-এর উল্লঙ্ঘণ করার অভিযোগেও দোষী সাব্যস্ত হলেন তাঁরা। তদুপরি পোটা আইনের ধারা নং ৩ উপধারা নং ৪-এর অভিযোগে-ও দোষী সাব্যস্ত হলেন।
একই ধরণের অভিযোগে ট্রায়াল হয়েছিলো নভজ্যোৎ সান্ধু ওরফে আফসান গুরু-র-ও। তবে তাঁর বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগ প্রমাণে নাকামিয়াব হন ফরিয়াদি রাষ্ট্র। কেবলমাত্র ভারতীয় দণ্ডবিধি সংহিতা-র ধারা নং ১২৩-এর ভায়োলেশন-এর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়ে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের দণ্ডিত হলেন আফসান। এদিকে ফাঁসির আদেশ হল আফজল, সৌকৎ এবং এস-এ-আর-এর। তারপর বছর দুয়েক ধরে আপীল প্রক্রিয়ার প্রয়োগ মারফৎ যা চলল তা খুব নিদারুণ, হৃদয়বিদারি-ভাবে ‘হারাধনের-দশটি-ছেলে’ বা ‘ফাইভ-লিটল-ইন্ডিয়ান বয়েস’-এর সাথে তুলনীয়। অবশেষে, সুপ্রীম কোর্ট-এর এই ২০০৫-এর ৪-ঠা অগাস্ট প্রদত্ত জাজমেণ্ট-এর নীটফল হিসেবে, এস-এ-আর গিলানি প্রমাণাভাবে বেকসুর খালাস হলেন, সৌকতের হল জাবজ্জীবন আর আফজলের ফাঁসি।
এহ বাহ্য, সুপ্রীম কোর্ট ডিভিশান বেঞ্চের সেই ১৯৭ পাতা ও ৩৪৯ অনুচ্ছেদে ব্যপ্ত জাজমেণ্ট নিয়ে আলোচনে করতে গেলে আসে ট্রায়ালের প্রসঙ্গ, আসে উপরে যে আইনি ধারাগুলোর কথা বলা হল, সেগুলোর আলোচনা আসে। ১৭ দিনের পুলিশি ইনভেস্টিগেশন ও ‘রেকর্ড’ ৬-মাসে নিপ্টিয়ে ফ্যালা ট্রায়ালে যে সকল আইনি ধারা-উপধারার প্রসঙ্গ এসে গিয়েছিলো, সেইগুলি হলো –
ভারতীয় দণ্ডিবিধি সংহিতার ধারা ১২০-বি, ১২১, ১২১-এ, ১২২, ১২৩ (রাজদ্রোহ) তথা ৩০২ এবং ৩০৭ (খুন), পোটা আইন-এর ধারা নং ৩, উপধারা নং ২, ৩ এবং ৫ তথা ধারা নং ৪(বি) – (কোনো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সদস্য হিসেবে সশস্ত্র ভাবে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে লিপ্ত হওয়া) এবং এক্সপ্লোসিভ সাবস্ট্যান্সেস অ্যাক্ট, ১৯০৮-এর ধারা ৩ ও ৪ (সচেষ্টভাবে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রাণনাশ এবং/ অথবা জান-মালের হানি-লোকসান-অবক্ষয়ের উদ্দেশ্যে সচেষ্টভাবে বিস্ফোরণ ঘটানো) – এই যে সেকল ধারা চাপানো হলো আফজল, সৌকৎ আর আফসানের উপর – তারও নীটফল হিসেবে, ২০০৩ সাল আসার আগেই, ট্রায়াল কোর্ট-এর হুকুমনামা মারফৎ মৃত্যদণ্ডে দণ্ডিত হলেন আফজল, সওকৎ ও এস-এ-আর। আফসানের হলো ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।

এইখানে কিছু প্রশ্ন উঠতে পারে। যে পুলিশি ময়নাদন্তনের ফলে আলোচ্য চার অভিযুক্তর বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল প্রোসিডিওর কোড-এর ধারা ১৭৩ মোতাবেক চার্জশীট দাখিল করলেন ট্রায়ালকোর্টের মাননীয় ধর্মাবতার সমীপে, সেই ইনভেস্টিগেশন-এর মেয়াদ ছিল ১৭ দিন। আর সেই যে ট্রায়ালের মাধ্যমে এই চার অভিযুক্ত দণ্ডিত হলেন – তিনজন তাঁদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডে – তার মেয়াদ ছিলো ‘রেকর্ড’ ছয় মাস। ট্র্যায়াল কোর্ট স্বীয় হুকুমনামা জারি করেছিলো ২০০২ সালের ১৮-ই ডিসেম্বর – ভারতীয় পার্লামেণ্ট হামলা-র ঠিক এক বছর পাঁচ দিনের মাথায়। এই আদেশের বলে আফজল ও সৌকতের থেকের ১০ লক্ষ টাকা বাজেয়াপ্ত করলো দিল্লি সরকার।
চার দণ্ডিত ব্যক্তিই এই ট্রায়াল কোর্ট জাজমেণ্ট-এর বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল আপীল আনলেন দিল্লি কোর্ট-এ। ২০০৩ সালের ২৯শে অক্টোবর, অর্থাৎ ট্রায়াল কোর্টের সেই আদেশ জারি হওয়ার ও তার বিরুদ্ধে আফজল-সৌকৎ-এস-এ-আর-আফসান-দের আপীল জমা পড়ার এক বছরের মধ্যেই, দিল্লি হাই কোর্ট তার জাজমেণ্ট ঘোষণা করলো। আফজল গুরু ও সৌকৎ হোসেন গুরু-র ফাঁসির আদেশ যথার্থ ধার্য করে নিদান দিল মাননীয় দিল্লি হাইকোর্ট। তবে এস-এ-আর গিলানি এবং নভজ্যোৎ সান্ধু ওরফে আফসান গুরু-কে প্রমাণাভাবে বেকসুর খালাস ঘোষণা করে দিলো মাননীয় দিল্লী হাই কোর্ট। সেখানেও একই প্রশ্ন ওঠে – এমন কি প্রমাণ ছিলো অথবা ছিলো না যার ভিত্তিতে এই সকল দণ্ডমুণ্ডের বিধান দেওয়া হলো? আবারও ফিরে আসতে হয় ওই রেকর্ড ৬-মাসকালীন ট্রায়াল স্তরে কী হয়েছিলো, কী কী সাক্ষ্যপ্রমাণ ছিলো বা ছিলো না – সেই সব দিকে।
তথ্যের নিরিখে, সুপ্রীম কোর্ট জাজমেণ্ট-এ যে সকল তথ্য দেওয়া রয়েছে সেগুলি অনুরূপ –
আফজল ও সৌকৎ একই পরিবারের সদস্য, একে অপরের তুতো ভাই, সৌকতের স্ত্রী হলেন আফসান, যার বিবাহপূর্বক নাম ছিলো নভজ্যোৎ সান্ধু, এবং চতুর্থ অভিযুক্ত এস-এ-আর গিলানি, যিনি পেশায় দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি শিক্ষক এবং যিনি ২০০০ সালে নভজ্যোৎ এবং সওকৎ-এর শুভপরিণয়টি অফিশিয়েট করেছিলেন। সওকৎ ও এস-এ-আর গিলানীর আলাপ হয় ১৯৯২ সালে। দিল্লিতে গ্র্যাজুয়েশন করতে কলেজে ভর্তি হয়ে এসেছিলেন সওকৎ। সেই সময়ে কাশ্মীরের সোপর-জেলার মূলনিবাসী এস-এ-আর আরবি নিয়ে দিল্লি ইউনিভার্সিটি থেকেই পোস্ট-গ্র্যজুয়েশন করছিলেন সেই সময়ে। সেই আলাপের বছর দুই আগেই যদিও এস-এ-আর-এর সঙ্গে ওই দিল্লির কলেজে পড়তে এসেই আলাপ হয় আফজলের। সওকৎ-এর তুতো ভাই আফজলের মূলনিবাস কাশ্মীরদেশের সোপোর জেলায়। এই সকল তথ্যই দিল্লি পুলিশের সামনে স্বীকারোক্তির মাধ্যমে জ্ঞাপন করেছেন সওকৎ – পুলিশি বিয়ান তাই-ই বলছে, এবং সেই বয়ানকেই বেদবাক্য ধার্য করে এগিয়েছে মহামান্য আদালত। – (তথ্যসূত্র – ২০০৫ ১১ এস-সি-সি, অনুঃ ৩, পৃঃ ৬৪৫ অনঃ ২৯৯ পৃঃ ৭৭৭)।

২০০১-সালের ১৩-ই ডিসেম্বর পার্লামেণ্টের পথে হিংসা ও তার ফল-আউট

এইবারে আসে যাক সেই পার্লামেণ্ট হিংসা-র সময় থেকে ঘটনাক্রম কোন পথে বাঁক নিয়ে পুলিশ হয়ে আদালতের দরবারে পৌঁছালো, সেই আলোচনায়।
সাদা অ্যাম্বাসাডর-গাড়িতে ছেপে ১৩-ই ডিসেম্বর ২০০১-এ সকালবেলায় যে পাঁচজন পার্লামেণ্টের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের কেউ আর জীবিত ফেরেন নি। সেই পাঁচ মরহুম ব্যক্তিকে মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট অফ ইণ্ডিয়া-র ভাষ্যে চিহ্নিত হয় এই ভাবে – “দ্য ডিসীসড টেররিস্ট-স”। (তথ্যসূত্র – (২০০৫) ১১ এস-সি-সি পৃঃ ৬৪৫, অনুঃ ৪ (iii))।

ইতিমধ্যে, হামলার দিন সেই সাদা অ্যাম্বাস্যাডর-টি সাথে একটুর জন্য সম্মুখ সংঘাত থেকে রক্ষা পায় ভারতবর্ষের তদনীন্তন উপরাষ্ট্রপতি-র মোটোরকেড। সেই মোটরকেড-এর প্রথম এস্কোর্ট-ভেহিকল-টির যাঁর নেতৃত্বে ছিলো তেমন এক পুলিশি-গ্রেড-এর অ্যাসিস্টান্ট সাব ইন্সপেক্টর – সাবেককালে হয়তো তাঁর ধরণের পদকে এইড-ডে-ক্যাম্প, বা সংক্ষেপে এ-ডি-সি – তেমন অভিধায় অভিধিত করা হয়ে থাকবে। এক্ষেত্রে, উক্ত এ-এস-আই, ট্রায়াল কোর্ট-এ প্রসিকিউশান উইটনেস নং ০৫ হিসেবে রাষ্ট্রের তরফ থেকে বয়ান পেশ করলেন। তিনি যে পাঁচজন ব্যক্তিকে তিনি দেখেছিলেন সাদা অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে চেপে ভারতীয় পার্লামেণ্টের দিকে আছড়ে পড়তে, তাঁরা পাঁচজনেই যে মৃত, সেই বিষয়টি এমনকি থানা, পুলিশ প্রোসিকিউশান বা জজ-ম্যাজিস্ট্রেট কেউই অস্বীকার করেন নি, বরং, তুলে ধরেছেন ফরেনসিক-বিদ্যার প্রয়োগ, আলোকচিত্র এবং লিখিত বয়ানের মাধ্যমে।
ফরিয়াদী রাষ্ট্র তথা দিল্লি সরকারের তরফ থেকে প্রসিকিউশান উইটনেস (পি ডব্লিউ) নং ১ হিসেবে ব্যক্তিসাক্ষ্য দিয়েছেন দিল্লির পার্লামেণ্ট স্ট্রীট পুলিশ স্টেশনের স্টেশন হাউস ইনস্পেকটার, বাংলায় অনুরূপ পদ ও পদস্থকে সচরাচর থানা-র ওসি বলা হয়। পার্লামেণ্ট স্ট্রীট থানার তদনীন্তন ওসি তথা এস-এইচ-ও ছিলেন শ্রী জি-এল মেহতা। গুলিবিনিময় বন্ধ হলে তিনিই প্রথম সেই পাঁচজন, যারা এমনকি সুপ্রীম কোর্টের ভাষাতেও, ‘মৃত টেররিস্ট’ – তাঁদের মরদেহ পার্লামেণ্ট-এর প্রথম এবং পঞ্চম গেট-এর সামনে শনাক্ত করেন। ইনভেস্টিগেশন আরম্ভ হয়। বুলেট জ বারুদ-বিহীন খোলা, কিছু ভরতি কার্তুজ, বিস্ফোরক, রক্ত-এর স্যামপ্লেল নিয়ে যাওয়া হয়। আরম্ভ হয় ইনভেস্টিগেশন। ওই পাঁচ ‘মৃত টেররিস্ট’-এর মরে থাকা মড়াগুলোর ফটোগ্রাফিক এভিডেন্স সংগ্রহ সমাপনান্তে পোস্ট-মর্টেম প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্যে মরদেহগুলি পাঠিয়ে দ্যাওয়া হলো হাসপাতাল-মর্গ-এ।

পার্লামেণ্ট হাউস স্ট্রীট থানার এস-এইচ-ও মারফৎ পার্লামেণ্ট হিংসার ঘটনায় গৃহীত এফ-আই-আর

এই পি-ডব্লিউ -১ তথা পার্লামেণ্ট হাউস স্ট্রীট-এর তদনীন্তন স্টেশন হাউস ইনস্পেক্টর শ্রী জি-এল মেহতা গুলিবিনিময়ের আওয়াজ বন্ধ হলে স্বীয় অধঃস্তন তিন সাব ইনস্পেক্টর (এস-আই)-কে নিয়োগ করেছিলেন পরিস্থিতি পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে, তাঁরা প্রোসিকিউশান উইটনেস নং ২-৪ হিসেবে ট্রায়াল কোর্টে স্বীয় প্রত্যক্ষজ্ঞাপন জাহির করেন। উপরাষ্ট্রপতির মোটরকেড তথা সিকিউরিটি-র তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত অপর এক সাব ইনস্পেক্টর শ্রী শাম সিং – তিনিও উক্ত এস-এইচ-ও- শ্রীমেহতা-র সমক্ষে স্টেটমেণ্ট জ্ঞাপন করেন। উক্ত শ্রীসিং-ও ফরিয়াদী পক্ষের পি-ডব্লিউ নং ৫৫ হিসেবে ট্রায়াল কোর্টের সামনে স্বীয় জ্ঞাপন প্রদান করেন।
আইনেরও কিছু নিজস্ব ‘আনফিশিয়াল’ বয়ান রয়েছে। যেমন প্রভুত উকিলপ্রবর অদ্যবধি রসিকতা করে স্বীয় ফী-এর পরিমাণ ‘জেমস’ তথা ‘মোহর’-এ মেপে বলতে কৌতুক পান। তেমনই আরেক্টি শব্দ, যা পুলিশি প্রোসিডিওরে বেশি ব্যবহার হয়, তার নাম ‘রুক্কা’। কোন থানার ও-সি তথা স্টেশন হাউস ইনস্পেকটর-কে আমজনতার কোন সদস্য যদি কোন অপরাধ ঘটার কথা জ্ঞাপন করে তাহলে, সময়াভাবে, সেই জ্ঞাপনের ভিত্তিতে একটা প্রাথমিক রিপোর্ট খাড়া করে পুলিশ। দিল্লি অঞ্চলে তা ‘রুক্কা’। আবার মধ্যভারত জুড়ে, বা পূর্বভারতের-ও কিছু কিছু অংশে, স্থানীয় উপ-থানা তথা ফাঁড়ি থেকে মূল থানায় ‘জিরো’-নম্বরি রিপোর্ট-পাঠায় – এই প্রথাও জাহির। উক্ত শ্রীশাম-এর বয়ানের ভিত্তিতে প্রাথমিক ‘রুক্কা’ রিপোর্ট তৈরি করে। এইখানে একটা খটকা জাগে। শ্রীমেহরা ও শ্রীশাম উভয়েই পুলিশ। যদিও শ্রীশামাপেক্ষা শ্রীমেহরা পদমর্যাদায় জ্যেষ্ঠঃ – তবুও প্রথমজন দ্বিতীয়জনের ‘চেইন অফ কম্যাণ্ড’-এর আওতাধীন নন। এই পরিস্থিতিতে শ্রীশামকে আমজনতা-সাধারণের সদস্য হিসেবে ধার্য করে সেই জ্ঞাপন কি গ্রহণ করতে আদৌ সক্ষম শ্রীমেহরা? এ’বিষয়ে পুলিশ আইন বেবাক, মহামান্য ট্র্যায়াল কোর্ট, হাই কোর্ট ও সুপ্রীমকোর্ট নির্বাক। তো, সে যাই হোক, সেই ‘রুক্কা’-র ভিত্তিতে, সেই হামলার তারিখের ভারতীয় সময় বিকেল পাঁচটার মধ্যে পার্লামেণ্ট হাউস থানায় এফ-আই-আর জারি হয়ে যায় পার্লামেন্ট হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সেই এফ-আই-আর-এ আফজল সহ সেই চার অভিযুক্তের কারুর নাম ছিলো না। স্পষ্টতঃ-ই তা জ্ঞাপ্ত ছিলো যে সেই যে ১৩-ই ডিসেম্বর ২০০১-এর সকাল ১১:৩০ নাগাদ পাঁচজন ব্যক্তিকে ভারতীয় পার্লামেণ্ট-এ আক্রমণ করবার সম্ভাব্য অভিপ্রায়ে সফেদ অ্যাম্বাস্যাডরারোহী হয়ে পার্লামেণ্টের পথে দেখা গিয়েছিলো ধাবমান, তাঁরা প্রত্যেকেই, দিনান্তের পুর্বভাগে-ই, ‘মৃত টেররিস্ট’।

[ক্রমশ…]

Facebook Comments

Leave a Reply