এক তন্ত্রচিত্র ও অতিমারি সময়ের টুকরো ভাবনা : অর্ক মন্ডল
সম্প্রতি দেখা হল কবি মণীন্দ্র গুপ্তের জীবন, লেখা ও চিন্তা নিয়ে নির্মিত ‘অফুরন্ত মালবেরি’। একটা দুই ঘন্টার ‘তন্ত্রচিত্র’। নিবেদনে কৌরব, নির্মাণে কবি শংকর লাহিড়ী। তন্ত্রচিত্র বা Devotional film- এটাই নির্মাতা বলেছেন অফুরন্ত মালবেরি সম্পর্কে। আর সেই জন্যই হয়তো এতো আবিষ্ট করে। বিশেষত যখন মণীন্দ্র গুপ্তের নানান কবিতা, গদ্যাংশের পাঠ চলে অপূর্ব সব দৃশ্যানুসঙ্গে। এছাড়া রয়েছে কবির ইন্টারভিউ, তাঁর আঁকা ছবি ও অন্যান্য আলোচনা, ভাবনা, কৌরবের পূর্ববর্তী নিবেদন ‘উত্তরমালা, বেরিয়ে এসো প্লিজ’-এর অংশবিশেষ, কবি শংকর লাহিড়ীর অনবদ্য কাব্যময় স্ক্রিপ্ট। আর রয়েছে কবি দেবারতি মিত্রের শান্ত সংক্ষিপ্ত উপস্থিতি। Film-এর শুরুতেই দেবারতি মিত্র ও শংকর লাহিড়ীর কথোপকথনঃ
“স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারছি না আমি…..এতো কষ্ট হয় আমার স্বামীর জন্য…”
“এই সময় কী করতে ভালো লাগে?….চুপ করে বসে থাকতে….প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকতে…বা..”
“ও সব কিছু ভালো লাগে না….”
Here we go round the mulberry bush/ on a cold and frosty morning- আবহসংগীতে ব্যবহৃত এই কোরাসটা একদল শিশুর মতো ঘুরতে থাকে নবতিপর কবিকে ঘিরে।
#
এই যে বলছিলাম, film-এ কবির কবিতা, ভাবনা, গদ্য, অথবা দারুণ কাব্যময় স্ক্রিপ্টটার পাঠ চলে অনবদ্য সব দৃশ্যানুসঙ্গে, এর একটা উদাহরণ দেওয়া যায়-
ভাষ্যকার বলছেন “এক জায়গায় তিনি (কবি মণীন্দ্র গুপ্ত) বলেছেন, সবকিছু নতুন করে ভাবতে হবে আবার। ভুলে যেতে হবে আমরা মানুষ…আমরা আসলে অন্য যে কোনো প্রাণীর মতোই। অনেক আগে একটি কবিতায় লিখেছিলেন- তুমি বহু প্ররোচনা দিয়ে ছিলে, তবু যে এখনো বেঁচে আছি, তার পবিত্র কারণঃ সম্পূর্ণত আমিও মানুষ নই- পাখি সিংহ মক্ষিকা এমন কি কেঁচোর সমবায়- স্বপ্নে উড়ি, ক্রুদ্ধ ফুঁসি, বাক্স ভরি, স্পর্শাতুর মাটিতে সেঁধুই।“
স্বপ্নে উড়ি, পাখি। ক্রুদ্ধ ফুঁসি, সিংহ। বাক্স ভরি, মক্ষিকা। স্পর্শাতুর মাটিতে সেঁধুই, কেঁচো। কবির ওই বাঁচা এই চার কর্ম-প্রাণের সমবায়। মৌপোকাদের গ্রাম কাব্য গ্রন্থের ‘পরিত্রাণ নেই’ কবিতার অংশ।
ওপরের ভাষ্য যখন চলে, তখন স্ক্রিনে যে দৃশ্যটা ফুটে থাকছে, সেটা হল একটা দাগ-ফাট ধরা সিমেন্ট-টাইলসের খুব নিচু রোয়াক বা চবুতরার প্রান্ত, তার পাশেই শুকনো পাতাপুতি, কালো মাটি, আর এই দুয়ের ঠিক মাঝখানে রোয়াকের ধার ঘেঁষে চলা লাল পিঁপড়ের লাইন। একটা স্ক্রিনসট-
#
এখন, এই মহামারির গর্ভে, যা কিছু পড়ি, যা কিছু শুনি বা দেখি, মনের তলায় একটা দুশ্চিন্তা, অদম্য অসহায়তা জেগে বসে থাকে। চরম অব্যবস্থা আর মৃত্যুর যে যজ্ঞ চলছে তার পেছনে বর্তমান শাসকের অমানবিকতা, অন্ধত্ব ও ধূর্তামি তো আছেই, কিন্তু সব সময় ‘বাহিরকে’ দুষতে থাকলে এক সময় ভেতরে ক্লান্তি আসে। মনে পড়ে যায় আমিও তো কোনো না কোনো ভাবে systemized। এই অবস্থাটা খুব দুর্বিষহ। এই সময় এমন কিছু খুঁজে পেতে ইচ্ছা করে, একটা চিন্তারেখা বা সংকেত যার কিছু সদর্থ আছে। একটা দিশা, যেমন, ওই যে সমবায়, ওই সম্পূর্ণত আমিও মানুষ নই- পাখি সিংহ মক্ষিকা এমন কি কেঁচোর সমবায়- ওই অংশটুকু, এই তলাকার করোনাপ্রসূত চিন্তার সূত্র ধরে নিয়ে চলে এক ভাঙনের দিকে। মনে হয় একটা সমবায় ভাঙছে। ভেঙেই চলেছে। আর সেটা মোটে ভালো নয়। ওই কবিতারই শেষ অংশটা খুব রক্তিম হয়ে ওঠেঃ
“স্কাই স্ক্রেপারের গায়ে পাখিদের আত্মহত্যা আমাকে দেখায় শেষ ভয়ঃ
তাহলে কী প্রাণীদের একফোঁটা নিজস্ব আকাশ কিংবা একতিল স্থির জমি নেই?
নিষ্প্রদীপ রাত্রে আমরা সকলেই দুঃখের শিকার? হায়,
এই নীল রাত্রে- জোৎস্নায়-
আমারও কি পরিত্রাণ নেই!”
সকালে বাজার যাওয়ার পথে পিচ রাস্তায় চেপ্টে থাকা সাপের দেহটা দেখে আজ মনে হল এটা শুধু মরা সাপ নয়, অন্য সময় হলে কিছু না ভেবেই নির্ঘাৎ লাফ কেটে পার হয়ে যেতাম, আজ মনে হল, এটা একটা হত্যা। আর যে প্রসঙ্গে কথাটা মনে হয়ে ছিল তা ওই কবিতা, আর একটা সদ্য পড়া লেখা। লেখাটা বেরিয়ে ছিল আনন্দবাজার পত্রিকায়, ২৩শে এপ্রিল, ২০২১, “গাছপালা, কেঁচো, মৌমাছি, মাছ থেকেও কি মহামারি, অতিমারির দিন এসে গেল”, এই শিরোনামে। লেখক সংগ্রাম বাগ, কলকাতার ‘সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’-এর অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এবং অরুণাভ গোস্বামী, বরাহনগরের ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট’-এর প্রফেসর। লেখাটা বেশ ভীতিপ্রদ। কিন্তু এতটা প্রাসঙ্গিক যে পুরো লেখাটা এখানে রাখলাম-
সেই ভয়ঙ্কর দিন আর খুব বেশি দূরে নেই। শুধুই শিম্পাঞ্জি, শুয়োর, বাদুড় বা প্যাঙ্গোলিন নয়। এমন দিনও আসছে, যখন আশপাশের গাছপালা আর অসংখ্য অমেরুদণ্ডী প্রাণীর থেকেও লক্ষ কোটি ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাক ঝাঁপিয়ে পড়বে আমাদের উপর। তাদের সংক্রমণে অতিষ্ঠ হয়ে যাবে মানুষের জীবন, যাপন। হবে একের পর এক মহামারি। উপর্যুপরি অতিমারিও। ঠিক যেমনটা বর্তমানে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে।
যাদের থেকে মহামারি, অতিমারির কথা কল্পনাও করতে পারেন না সাধারণ মানুষ সেই কেঁচো, মৌমাছি বা নানা ধরনের মাছের থেকেও একের পর এক ছড়িয়ে পড়বে বহু অজানা-অচেনা ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া ও ছত্রাক।
বিজ্ঞানীদের অনুমান, আর কয়েক দশকের মধ্যেই ১০ লক্ষ বা তারও বেশি সংখ্যায় বিভিন্ন প্রজাতির জীব পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। পৃথিবী থেকে একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সাধারণ মানুষ তো দূর অস্ত, এটা বেশি দিন আগে বিজ্ঞানীদেরও জানা ছিল না। কয়েক বছর আগে এই উদ্বেগজনক তথ্যের হদিশ মিলেছে।
বিজ্ঞানীরা এও মনে করেন, এদের মধ্যে অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাবে আবিষ্কৃত হওয়ার আগেই।
এই ছোট ছোট জীবগুলি বহু কোটি ভাইরাসের আধার। যে মুহূর্তে এই আধারগুলি ধ্বংস হয়ে যাবে, তখনই সেই সব ভাইরাস বেরিয়ে পড়বে নতুন আধারের সন্ধানে। সেই নতুন আধার হতেই পারে মানবদেহ। যথেচ্ছ বন কেটে বসত বানানোর উৎসাহের জন্য তো মানুষকেই বেশি কাছে পাচ্ছে নতুন নতুন আধার খোঁজা অসংখ্য ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া আর ছত্রাক।
উদ্ভিদের ভাইরাস মানুষের অন্ত্রে!
কয়েক বছর আগে সিঙ্গাপুরের জিনোম ইনস্টিটিউট আর আমেরিকার সান ডিয়েগোর স্টেট ইউনিভার্সিটির একদল বিজ্ঞানী মানুষের অন্ত্রে কী কী ভাইরাস থাকে, তার পরীক্ষা করতে গিয়ে চমকে যান। তাঁরা দেখেন, মানুষের অন্ত্রে রয়েছে অন্তত ৩৫ রকমের এমন সব ভাইরাস, যাদের আদত ‘ঠিকানা’ বিভিন্ন উদ্ভিদের দেহ! বিজ্ঞানীরা দেখেন, উদ্ভিদের দেহের চেনা মুলুক ছেড়ে এসেও ওই সব ভাইরাস মানুষের দেহে বেঁচেবর্তে আছে। নিজেদের বংশবৃদ্ধি করে যাচ্ছে।
গবেষণায় দেখা যায়, বিভিন্ন উদ্ভিদের দেহ থেকে এসে মানুষের অন্ত্রে ঘাঁটি গাড়া ভাইরাসগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে আছে ‘পিপার মাইল্ড মট্ল ভাইরাস’। এই ভাইরাস ক্যাপসিকাম গাছের নানা রোগের কারণ হয়। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মানুষের এক গ্রাম ওজনের মলে এই ভাইরাসের সংখ্যা প্রায় ১০০ কোটি! দেখা যায়, যে মানুষের দেহে এই ভাইরাসের সংখ্যা বেশি তাঁদের মধ্যে জ্বর, পেটব্যথা, চুলকানির প্রাদুর্ভাবও বেশি।
অমেরুদণ্ডী থেকেও ভাইরাস আসছে মেরুদণ্ডী প্রাণীতে
বহু দিন ধরে আমাদের ধারণা ছিল উদ্ভিদ থেকে প্রাণীতে বা কোনও অমেরুদণ্ডী প্রাণী থেকে মেরুদণ্ডী প্রাণীতে ভাইরাস ‘উপচে পড়তে’ পারে না। কিন্তু গত কয়েক বছরের গবেষণায় আমাদের এই ধারণা ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে। মানুষের দেহে যেমন উদ্ভিদ ভাইরাসের দেখা মিলেছে, তেমনই বাদুড়ের রক্তে ৫ রকমের পতঙ্গ ভাইরাসের হদিশ মিলেছে।
আবার টম্যাটো গাছের ‘ইয়েলো লিফ কার্ল ভাইরাস’-কে দেখা গিয়েছে ‘টোব্যাকো হোয়াট ফ্লাই’ নামে একটি পতঙ্গের দেহে বংশবিস্তার করতে। খুব দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটাতে।
বহু যুগ আগে গ্রিসের নগররাষ্ট্র আথেন্স এক অজানা মহামারির কবলে পড়ে। তাতে বহু লোকের মৃত্যু হয়। এর বর্ণনা রয়েছে তৎকালীন আথেন্সের বাসিন্দা গ্রিক ইতিহাসবিদ থুকিডিটিসের লেখায়। যিনি নিজেও ওই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। থুকিডিটিসের লেখায় বর্ণিত রোগের লক্ষণগুলি বিশ্লেষণ করে এখনকার বিজ্ঞানীদের একাংশ মনে করেন, গ্রিসের সেই সময়ের মহামারির কারণ ছিল ইবোলা ভাইরাস। সে দিনের আথেন্স থেকে বহু শতাব্দী আর বহু যোজন দূরে ১৯৯৬ সালে আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর গাবনে ইভিন্ডো নদীর পাশে গভীর জঙ্গলে একটা গ্রামের কয়েক জন মানুষ একটা শিম্পাঞ্জি শিকার করে খান। তার কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁদের প্রায় ৯০ শতাংশ এক অজানা রোগে মারা যান। আমরা এখন নিশ্চিত ভাবে জানি ওই অজানা রোগের কারণ ছিল ইবোলা ভাইরাস।
গ্রিকসভ্যতার সময় থেকে শুরু করে এখনকার সময় পর্যন্ত মানবসভ্যতা বহু মহামারির কবলে পড়েছে। কিন্তু গত কয়েক দশকে সভ্যতার উপর মহামারির আঘাত অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছে।
দায়ী মানুষের লোভ, আগ্রাসী মনোভাব
মানুষই এর এক ও একমাত্র কারণ। যথেচ্ছ বন্যপ্রাণী মেরে কেটে খাওয়া, তাদের দেহাবশেষের অবাধ ব্যবহার ও ব্যবসা আর নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস করে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলকে নির্মূল করে দেওয়া। এর ফলে, বন্যজীবন আর মানুষের মধ্যে যে অদৃশ্য দেওয়াল আছে, তা ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে। আর বন্যপ্রাণীদের মধ্যে থাকা বিভিন্ন ভাইরাস মানবশরীরকে নিজেদের আশ্রয় হিসাবে পরখ করে দেখার সুযোগ পাচ্ছে।
এইচআইভি, ইবোলা, জিকা, নীপা, সার্স, এভিয়ান ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু-র মতো যে মারণ ভাইরাসগুলি গত ৫০ বছরে এসেছে বা ‘উপচে পড়েছে’, তার সবক’টিই এসেছে বাদুড়, শিম্পাঞ্জি, প্যাঙ্গোলিন, বন্য শুয়োর, বন্য পাখির মতো বিভিন্ন বন্যপ্রাণী থেকে।
বাদুড়, শিম্পাঞ্জি, প্যাঙ্গোলিন, বা শুয়োর— এরা সকলেই স্তন্যপায়ী। আর পাখি স্তন্যপায়ী না হলেও বিবর্তনে মানুষের কাছাকাছি থাকা একটি প্রাণী। তাই এদের কোষের সঙ্গে মানবদেহের কোষের জৈব রসায়নের মিল অনেকটাই। ফলে এই বন্যপ্রাণীদের থেকে মানুষের মধ্যে ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়াটা তুলনামূলক ভাবে অনেকটাই সহজ। খুব সম্ভবত এই ভাবেই ‘সার্স-কভ-২’-ও এসেছে বাদুড় বা প্যাঙ্গোলিন, অথবা দু’টো থেকেই।
কিন্তু এর বাইরেও একটা সত্য আছে। হয়তো বা সেটা ভয়ঙ্কর সত্য। আমাদের বন্যপ্রাণী রক্ষার স্লোগানে স্তন্যপায়ী এবং বড় প্রাণীদের (যেমন-বাঘ, বাদুড়, কুমির, পাখি, মাছ) উপস্থিতিই বেশি চোখে পড়ে। এই ধরনের প্রাণী আমাদের জীববৈচিত্রের মাত্র ০.৪ শতাংশ। এর বাইরে লক্ষ লক্ষ ছোট ছোট প্রাণী কীটপতঙ্গ, কেঁচোজাতীয় প্রাণী রয়েছে, যারা বন-জঙ্গল নির্মূল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এরা আমাদের জীববৈচিত্রের ৮০ শতাংশ।
মথ, ফড়িং, মৌমাছি থেকেও হতে পারে মহামারি!
তবে এটাই আতঙ্কের একমাত্র কারণ নয়। বাস্তুচ্যুত, নতুন নতুন আধার খোঁজা কোটি কোটি ভাইরাস বাস্তুতন্ত্র এবং অর্থনীতিতে প্রভাবশালী ছোট ছোট প্রাণীদের ( যেমন, মৌমাছি, মথ,
ফড়িং) মধ্যেও মহামারি সৃষ্টি করতে পারে।
আমাদের চাষবাসের অনেকটাই নির্ভর করে পতঙ্গদের দ্বারা পরাগ মিলনের উপর। বিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের প্রতি ৩ গ্রাস খাবারের ১ গ্রাস এই পতঙ্গদের দান। একটি গণনা দেখিয়েছে, আমেরিকার কৃষিকাজে প্রতি বছর মৌমাছির অবদান ১০০ থেকে ২০০ কোটি টাকা। এখন মৌমাছির সংখ্যা কমে যাওয়ায় আমেরিকায় কাঠবাদাম চাষের খরচ ৩ গুণ বেড়ে গিয়েছে।
আমরা যখন কোভিড অতিমারির মোকাবিলা করছি, ঠিক সেই সময়েই মৌমাছিরা আক্রান্ত অন্য এক মহামারিতে। ইউরোপ, কানাডা আর কেনিয়ায় পালিত মৌমাছিদের মধ্যে ‘নোসমা’ নামে এক পরজীবী ছত্রাক ছড়িয়ে পড়েছে। যার জন্য এই পালিত মৌমাছিরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এমনকি, তাদের শুক্রাণুর সংখ্যাও দ্রুত কমে যাচ্ছে। এই পালিত মৌমাছিরা ফুলে ফুলে মধু সংগ্রহ করে বেড়ায়। সেই ফুলেই বন্য মৌমাছি বসলে বন্য মৌমাছির দেহেও ‘নোসমা’ উপচে পড়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি। বন্যজীবন আর মানুষের ভিতরের দেওয়াল কী ভাবে ভেঙে পড়ে, এটা তার একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
‘নোসমা’ যদি ধীরে ধীরে ২০ হাজার প্রজাতির বন্য মৌমাছির দেহে উপচে পড়ে, তা হলে বাস্তুতন্ত্র আর মানুষের উপর তার কী ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়তে পারে সেটা ভেবে বিজ্ঞানীরা সন্ত্রস্ত।
বন্যজীবন আর মানুষের ভিতরের অদৃশ্য দেওয়ালগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হলে শুধু ভাইরাসই উপচে পড়ে তা নয়; নতুন নতুন ব্যাক্টেরিয়া ও ছত্রাকও উপচে পড়বে। আর তার ফলে অজানা সংক্রমণের আশঙ্কা বেড়ে যাবে কয়েক গুণ।
বিবর্তনেরও নির্দিষ্ট দিক থাকে
বহু দশক ধরেই এটা আমাদের জানা ছিল, জীবজগতে বিবর্তনের কোনও নির্দিষ্ট অভিমুখ নেই। ১৯৮৮ সালে বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘নেচার’-এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী দেখান, বিবর্তনের নির্দিষ্ট দিক থাকতে পারে। কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়লে সেই প্রতিকূলতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ব্যাক্টেরিয়া জিনোমের কোষ বিভাজন বা মিউটেশন ঘটায়। তার মধ্যে কোনও কোনও মিউটেশন ব্যাক্টেরিয়াকে সেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। একে বলা হয়, ‘অ্যাডাপ্টিভ মিউটেশন’।
উন্নত জীবে ‘অ্যাডাপ্টিভ মিউটেশন’-এর কোনও প্রমাণ এখনও পর্যন্ত আমাদের হাতে নেই। কিন্তু ব্যাক্টেরিয়ার ক্ষেত্রে এটা প্রমাণিত সত্য।
ভয়টা এখানেই। বন্যজীবন থেকে উপচে পড়া, নতুন নতুন আধার খোঁজা ব্যাক্টেরিয়ায় ‘অ্যাডাপ্টিভ মিউটেশন’ মানুষের পক্ষে খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
নাসার ক্লিন রুম-এও ব্যাক্টেরিয়ার দাপাদাপি!
বিবর্তনের এই শক্তি মানুষের পক্ষে যে কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, তার একটা সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত মিলেছে নাসার একটি কাজে। যে কোনও মহাকাশ সংস্থায় মহাকাশযান, কৃত্রিম উপগ্রহ আর তাদের বিভিন্ন অংশকে জোড়া দেওয়ার কাজটা করা হয় বিশেষ ভাবে তৈরি ‘ক্লিন রুম’-এ। এই ক্লিন রুম এমন ভাবে তৈরি আর পরিচালনা করা হয়, যাতে কোনও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধুলিকণা, ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়াও সেখানে না থাকতে পারে। যে সব বিজ্ঞানী আর ইঞ্জিনিয়ার ক্লিন রুমে কাজ করেন, তাঁরা সব সময় কোভিড যোদ্ধাদের ‘পিপিই’র মতো পোশাক পরে থাকেন। যাতে মানুষের দেহের ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া এবং বিভিন্ন কোষ-কণা ক্লিন রুমকে ‘সংক্রমিত’ করতে না পারে। এত কিছু করার পরেও এই ক্লিন রুমকে খুব শক্তিশালী জীবাণুনাশক দিয়ে বার বার পরিষ্কার করা হয়।
অথচ কী আশ্চর্য, নাসার ক্লিন রুম পরিষ্কার করার জীবাণুনাশকের মধ্যেই বেশ কয়েক ধরনের ব্যাক্টেরিয়া পাওয়া গিয়েছে। যাদের মধ্যে ‘অ্যাসিনেটোব্যাক্টেরিয়া’ নামে এক ধরনের ব্যাক্টেরিয়ার উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি। এই অ্যাসিনেটোব্যাক্টেরিয়া সাধারণ ভাবে জলে বা মাটিতে থাকে। যেটা আরও অবাক করে দেওয়ার মতো ঘটনা তা হল; এই ব্যাক্টেরিয়া শুধু ওই জীবাণুনাশকের মধ্যে বেঁচেই থাকে না, ওই জীবাণুনাশক খেয়েই বেঁচে থাকে!
শেষের সে দিন বড়ই ভয়ঙ্কর
প্রকৃতির নিয়মগুলিকে একটু একটু করে ভাঙতে গিয়ে আমরা এখন জীবন আর বিবর্তনের শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে ফেলেছি। যা খুব সহজেই আমাদের বেঁচে থাকাকে আরও কঠিন করে তুলতে পারে। তার প্রমাণ আমরা শেষ ক’বছরে পর পর পেয়েছি- ইবোলা, নীপা, কোভিড…।
তাই যত দিন না এই অদৃশ্য দেওয়ালগুলি আবার গড়ে উঠবে, নতুন নতুন রোগ বা একই রোগের ভিন্ন মারণ রূপ শুধু মানুষকেই আক্রমণ করবে না, মানুষের অস্তিত্ব ও অর্থনীতি যে সব প্রাণীদের উপর নির্ভরশীল, তাদেরও আক্রমণ করতে পারে। সেটা যাতে না হয়, তার জন্য এখন দরকার প্রকৃতি, জীবন আর বিবর্তনের শক্তিকে নতমস্তকে স্বীকার করে, বন্যজীবন আর মানবজীবনের অদৃশ্য দেওয়ালের ক্ষতগুলিকে সারিয়ে তোলা। না হলে, শেষের সে দিন খুবই ভয়ঙ্কর। হয়তো বা সেই দিন এসেও পড়বে খুব তাড়াতাড়ি।
তথ্য নির্ভর লেখা। এখন তথ্যের যুগ। হয়তো কেউ অন্য রকম তথ্য ও তত্ত্বের দ্বারা ওপরের লেখাটার সমালোচনা করতে পারেন অবশ্যই। হয়তো দেখাতে পারেন পরিস্থিতি এত ভয়াবহ নয়। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে আমরা যে এরকম একটা দিকে চলেছি, সেটা অন্তত এই মহামারির গর্ভে বসে স্বীকার করতে মন চায়। আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। গভীর সমুদ্রে নাকে মুখে পলি ব্যাগ জড়িয়ে ফেলা সার্কের কথা আমাদের ভাবতে হবে। আবর্জনা খেয়ে পেট ভর্তি করে ফেলা তিমিটার কথা- কেবল সমুদ্র সৈকতে মরে পড়ে থাকা ওদের বিশাল দেহ দেখে বিস্ময়াবিষ্ট হলে চলবে না- উপরিউক্ত ওই দেওয়ালটা মেরামতের জন্য আমাদের উঠে পড়ে লাগতে হবে। দেওয়াল মানে শুধু virus proof paint, anti-bacterial wall putti নয়। দেওয়াল মানে ওপরের ছবিটার ওই লাল পিঁপড়ের সার। ছবিটাতে, as a symbol, ওই সিমেন্টের রোয়াকটাকে যদি মানুষের ঘর ভাবি, আর ওই শুকনো, কোঁচকানো পাতা গুলো যদি হয় বীজাণু বাহিত মৃত্যু, তবে মাঝখানের ওই লাল পিঁপড়ের সার আমাদের বাঁচায়। তাই ওদের বাঁচাতে হবে। পিঁপড়ে, পাখি, মক্ষিকা, কেঁচো…”সব কিছু নতুন করে ভাবতে হবে। ভুলে যেতে হবে আমরা মানুষ, আমরা আসলে অন্য যে কোনো প্রাণীর মতোই।“
#
অফুরন্ত মালবেরি নানান বিষয়, ভাবনা ছুঁয়ে কসমোলজির আলোচনায় এসে পৌঁছয়। স্ক্রিনে ফুটে ওঠে অসম্ভব সব ছবি, মহাশূণ্যের রঙ, এনার্জী, ম্যাটার, ডিশ অ্যান্টেনা, গ্যালাক্সি নাচ, তারার নুপূর ধ্বনি… কথাবার্তা কিছুটা এই রকম-
মণীন্দ্র গুপ্ত, “….যা ঘটে না, তাই ভাবতে ভালো লাগে…মনে হয় পৃথিবীটা সত্যি কি না….”
শংকর লাহিড়ী, “….এটা তো আবার একটা দারুণ আলোচনার জায়গা…..পৃথিবীটা সত্যি কি না, এই নিয়ে কিছু recent লেখালেখি হয়েছে….যে গুলো আমার ভাবনার সঙ্গে মেলে। যেমন, এখন বড় বড় scientist-রা বলছেন….mathematcian এবং physicist যারা…এবং cosmologist যারা…তারা এখন মোটামুটি এক জায়গায় এসে বলছেন যে it is almost proved যে this is designed….”
“undesigned নয়”
“না, designed. So there is a designer…if it is designed then there is a designer…and we are all products of a simulation…we are all…this whole Universe is a simulation……some super natural বা super intelligent being…..”
“… যে design, সেটা কত যে intricate আর কত যে ব্যাপ্ত, সেটা ভাবা যায় না…”
“It’s a grand-scale simulated world…..তার না কি প্রচুর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে…”
আর এই করোনা কালে বসে আমি ভাবছি, সমস্তটা যদি designed হয়, this whole Universe is a simulation- এই যদি হয়, তাহলে এই শয়তান ভাইরাসটাও কি design-এর অন্তর্গত? এই অতিমারিও কি product of this grand simulation? আর, এই grand simulation-এর সবচেয়ে বেয়াড়া অংশ কী? শয়তান বীজাণু? না, লোভী, আগ্রাসী মানুষ?
#
এই সব আলোচনা চলতে চলতে দেবারতি মিত্র প্রশ্ন করেন-
“পরলোক সম্বন্ধে কিছু জানা গেছে?”
শংকর লাহিড়ী, “এই নিয়ে বিজ্ঞানীরা না, ভীষণ নিরুত্তর….এই physical world- এর বাইরে একটা আলাদা চেতন জগৎ থাকতেই পারে….”
মণীন্দ্র গুপ্ত, “একটা হতে পারে, ভাঁড়ার ঘর একটা আছে, যেখান থেকে সবই merge করে…আরেকটা হতে পারে, কিছু ভাঁড়ার ঘর-টর কিচ্ছু নেই….জিনিস গুলো evolve করে… নিজে নিজেই evolve করে….”
কিছুদিন আগে “দ্রাক্ষাপুঞ্জ, শুঁড়ি ও মাতাল” বইটাতে পড়েছিলাম, দেবারতি মিত্রের কবিতার আলোচনায় মণীন্দ্র গুপ্ত এক জায়গায় লিখেছেন-
“আপনজনেরা পর পর মারা যেতে দেবারতি অবুঝের মতো অভেদানন্দের ‘মরণের পারে’, ‘লাইফ বিয়ন্ড ডেথ’ কিংবা অন্যান্য মৃত্যুরহস্যের বই পড়ে তাদের বিলুপ্ত অস্তিত্ব খুঁজবার চেষ্টা করত। এই স্পৃহা প্রায় অবসেশনের পর্যায়ে পৌঁছেছিল। সে জানত ওদের সঙ্গে আর দেখা হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তবু যদি ওরা কোথাও থেকে থাকে! ভাবতে ভাবতে প্রাকৃত ও অতিপ্রাকৃতের মধ্যবর্তী নো ম্যানস ল্যান্ডের সে একটা ছোট্ট জগৎ তৈরি করেছিল। সে জানত, ঐ জগৎটা কল্পনারই বুদ্বুদ তাই বিকেল বেলার হেলানো রোদের মতো তাতে একটা কারুণ্য জড়িয়ে থাকত, একটু শীত-শীত ভৌতিকতাওঃ
আষাঢ়ন্ত বিকেলে একা একা হাঁটতে থাকি-
ঘন চালতা গাছের ফাঁকে পুকুরের ধারে
ভাঙাচোরা বাড়ির বারান্দা থেকে
বাবার পাঞ্জাবি, বোনের হলুদমণি পাখি সাইড ব্যাগ,
মার সমুদ্রফেনা ব্লাউজ ঝুলছে, কাঁধের কাছটা
ছেঁড়া দেখেই বুঝেছি।
ও, তাহলে ওরা কোথাও যায় নি, এখানেই এসে বাস করছে।
আমাকে ধরা দেবে না।
বাতাসের গলা অবধি হাসি উছলোতে থাকে,
গাছের ডালপালায় খিলখিল খিলখিল হাসি।
বাড়িটার অ্যানটেনা ছুঁয়ে পায়রার দল
বকবকম বকবকম করছে।
দেব নাকি দুটো দানা ছড়িয়ে?
পাগলামি ছোঁয়াচে রোগ,
চাপা গলায় একটানা হেসে যেতে থাকি।
……………………………………………
সাদা কালো গান। দেবারতি মিত্র।“
আমি লক্ষ করি মায়া। স্নেহের মতো একরাশ মায়া। নীল-সাদা। যেটুকু ভৌতিক শীত-শীত, সেটুকুও মানুষের অলৌকিক মায়া। এবার কিছু অলৌকিক চাই। অলৌকিক স্নেহ। কবি মণীন্দ্র গুপ্ত বলেছেন, সার্ভাইবাল অব দ্য ফিটেস্ট, এটা হয়তো এক বোগাস ডিক্টাম। মানুষ-ই পারে এর থেকে বেরতে। বলেছেন মঙ্গলকাব্যের কথা, যেখানে মানুষ আর জীবকূলের একই সাথে অবস্থান, যে যার নিজস্ব জায়গায়। সৌন্দর্যের শান্ত অবগাহনের মতো অফুরন্ত মালবেরি শেষ হয়। মনে ভাবি, এই স্নেহ, এ-ই কি হতে পারে না সেই Designer….হতে পারে না কি, A super natural affection! উপনিষদের সেই ধারণার মতো- সামান্য ধূলিকনা থেকে বৃহৎ নক্ষত্র, সবেতেই যেটা আছে। ভাবতে ভালো লাগে, কোলকাতার পথের ধারে একটা মুমূর্ষু গাছের কথা ভাবছে দূরতম গ্রহাণুটা। এই পৃথিবীতে, এই ইউনিভার্সে, সেটা grand-scale simulation হোক বা আলাদা আলাদা আলদা হোক, এখানে মানুষ চিরকাল থাকবে। আশ্চর্যতম প্রাণী হিসেবে তাকে থাকতেই হবে। তার জন্য যত স্বার্থ ত্যাগ করা লাগে, করতে হবে। যত শান্ত হতে হয়, হতে হবে।