‘ফায়ার’ এর আগুন এবং তারপর… : অপূর্ব ঘোষ
“মেয়ে-মেয়েতে প্রেম করেছে, বেশ করেছে বেশ করেছে!”
গোটা জুন মাস হল প্রাইড মান্থ বা গর্বের মাস ক্যুইয়ার গোষ্ঠীর মানুষদের কাছে। এই মাস ক্যুইয়ার গোষ্ঠীর মানুষদের অধিকারের দাবিতে লড়া যোদ্ধাদের সম্মান জানানোর মাস। সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে আমরা কম-বেশি সকলেই অবগত সে বিষয়ে এবং এখন আলোচনাও হচ্ছে ‘ভালোবাসার অনেক রঙ’ নিয়ে। ছেলের সাথে মেয়ের, মেয়ের সাথে মেয়ের, ছেলের সাথে ছেলের বা আরো অনেক রঙ আছে ভালোবাসার। আজ মেয়ের সাথে মেয়ের ভালোবাসার রঙেই সীমাবদ্ধ রাখা যাক আলোচনা। যে সমস্ত নারী অন্য নারীর প্রতি মানসিক ও শারীরিকভাবে আকৃষ্ট হন তাঁরাই হলেন লেসবিয়ান বা নারী সমকামী (পড়ুন সমপ্রেমী)। লেসবিয়ানরা আজ যতটুকু দৃশ্যমানতা অর্জন করেছেন তা সহজে আসেনি, পেতে হয়েছে অসহনীয় লড়াইয়ে মধ্যে দিয়েই। ভারতবর্ষে নারী সমকামী বা লেসবিয়ান আন্দোলনের ইতিহাসে দীপা মেহতার ফায়ার সিনেমাকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া বিতর্ক এবং বিক্ষোভ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ ছিল যা লেসবিয়ানদের পর্দার আড়াল থেকে টেনে এনে দৃশ্যমান হতে সাহায্য করেছিল। কীভাবে ফায়ার সিনেমা গোটা লেসবিয়ান আন্দোলনের মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছিল সেই ইতিহাস জানা জরুরী। এই ইতিহাস নিছকই লড়াই এর গল্প নয়, বরং ভালোবাসার অধিকারের দাবিতে লড়াইয়ের গল্প।
ইন্দো-কানাডীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা দীপা মেহতার ফায়ার সিনেমাটি ভারতবর্ষে মুক্তি পায় ১৯৯৮ সালের নভেম্বর মাসে। সিনেমা টির মূল বিষয়বস্তু স্বামীর দ্বারা বঞ্চিত-লাঞ্ছিত দুই গৃহবধূ রাধা ও সীতার বিকল্প যৌনসত্তায় উত্তরণের গল্প। বোঝা-ই যাচ্ছে ভারতবর্ষের নিরিখে নব্বইয়ের দশকে এমন বিষয়বস্তুর সিনেমা কতটা যুগান্তকারী ও বিপজ্জনক ছিল। দক্ষিণপন্থী দল ও সংগঠনগুলি চিল চিৎকার শুরু করে দিল এবং তাঁরা ফায়ার যাতে ভারতে না দেখানো হয় তার দাবিতে সোচ্চার হলেন। তাঁদের প্রধান দাবিই ছিল এই যে, লেসবিয়ানিজম ভারতীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের বিরোধী এবং তা অপ্রাকৃতিক-বিকৃত। উল্লেখ্য, ১৯৯৮ এর ৭ এপ্রিল ভারতে মুক্তি পাওয়ার আগে ফায়ার সর্বপ্রথম দেখানো হয়েছিল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ছোট্ট একটা মেয়েদের কলেজে। এবং সেখানে ছাত্রীদের মধ্যে থেকে কয়েকজন দক্ষিণ এশীয় সিনেমার বিষয়বস্তু, বিশেষত সিনেমাতে যে ভাবে ভারতীয় পৌরুষ কে দেখানো হয়েছে তা নিয়ে আপত্তি করেন! আমেরিকার পাশাপাশি কানাডা সহ পাশ্চাত্যের কিছু দেশে ফায়ার মুক্তি পায়। কিন্তু একটা মজার বিষয় হল, যেখানে পাশ্চাত্যে ফায়ার সিনেমাকে নিছকই একটি লেসবিয়ান সিনেমা হিসেবে দেখা হয়েছিল, ভারতে কিন্তু বিষয়টা অতটা একমুখী বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি। লিঙ্গ রাজনীতি থেকে শুরু করে ভারতীয় সংস্কৃতি-ঐতিহ্য, অশ্লীলতা, ধর্মীয় ভাবাবেগ ইত্যাদি প্রশ্ন ফায়ার এর সাথে যুক্ত হয়ে গেছিল। ফায়ারের প্রথম রিভিউ বের হয় টাইমস অব ইন্ডিয়া তে ১৯৯৮ এর ২০ নভেম্বর। এবং সেখানও লেখা হয় যে, ফায়ার কে কেবল লেসবিয়ান সিনেমা বলে দাগিয়ে দিলে ভুল হবে, বরং এর গুরুত্ব আরো বেশি সুদূরপ্রসারী। এর পাশাপাশি ভারতবর্ষে লিঙ্গ রাজনীতির ক্ষেত্রে ফায়ার যে গুরুত্বপূর্ণ তাও স্বীকার করা হয়।
দক্ষিণপন্থীদের বিক্ষোভ প্রথম দেখা যায় মুম্বাইয়ে। ১৯৯৮ এর ৩ ডিসেম্বর প্রায় ২০০ জন শিবসেনা কর্মী মুম্বাইয়ে দুটো প্রধান সিনেমা হল নিউ এম্পায়ার ও সিনেম্যাক্স এ চরম ভাঙচুর চালায়। অন্য দিকে শিবসেনার মহিলা শাখাও আলাদা ভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।একজন মহিলা বিক্ষোভকারী আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন,”যদি নারীর শারীরিক চাহিদা লেসবিয়ান যৌনতার মাধ্যমের পূর্ণ হয়ে যায়, তবে তো বিবাহ প্রতিষ্ঠানটাই ভেঙে পড়বে, মানব প্রজাতির সৃষ্টি থমকে যাবে।“ স্বাভাবিকভাবেই এটা বোঝা খুব একটা কঠিন নয় যে, এই বক্তব্য আসলে পুরুষতন্ত্রের।বিকল্প লিঙ্গ-যৌনতাকে পুরুষতন্ত্র ভয় পায়, কারণ তা পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে ব’লে। যাইহোক, বজরং দল সহ প্রায় সব উগ্র হিন্দুত্ববাদী দক্ষিণপন্থী সংগঠন গুলিও প্রতিবাদে যোগ দেয়। দিল্লি তেও বিভিন্ন সিনেমা হলে শিবসেনার দিল্লি শাখা ভাঙচুর চালায়। উল্লেখ্য, ফায়ার মুক্তি পাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট পরাজিত হয় বিশ্রী ভাবে। এছাড়াও মূল্যবৃদ্ধি সহ বিভিন্ন কারণে জনগণে মধ্যে কেন্দ্রের এনডিএ সরকারের উপরও ক্ষোভ রাড়ছিল। এই অবস্থায় দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী দল তথা বৃহত্তর সংঘ পরিবার ফায়ার সিনেমা কে ইস্যু করে ভারতীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের প্রশ্নকে জোর করে সামনে এনে নিজেদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধতে সচেষ্ট হয়। তাঁরা বারবার ভারতীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের কথা তুলে ধরে ফায়ার সিনেমা বন্ধের দাবি করতে থাকেন। এমনকী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরাও মন্তব্য করতে শুরু করেন ফায়ার এর বন্ধের দাবিতে। যেমন, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাল কৃষ্ণ আদবানি প্রশ্ন তোলেন: “কেন এই ধরনের সিনেমা ভারতে তৈরি হবে? এগুলো আমেরিকা বা পাশ্চাত্যে দেশগুলিতে চলতে পারে।“ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুক্তার আব্বাস নকভি মন্তব্য করেন যে, লেসবিয়ানিজম এর বিষয়টা ভারতীয় পরিবেশে বেমানান। আরএসএস এর তরফ থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়, এটা হল পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি দ্বারা অনুপ্রাণিত একশ্রেণির এলিটদের দ্বারা ভারতীয় সংস্কৃতির উপর আঘাতের উদাহরণ। এবং শিবসেনার ধ্বংশাত্মক আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে আরএসএস এর থেকে আরো বলা হয় যে, শিব সৈনিকদের এই বিক্ষোভই প্রমাণ যে সিনেমার বিষয়বস্তু একেবারেই ভারতীয় সংস্কৃতির অংশ নয়।
সিনেমাতে ভারতীয় নারীদের উপস্থাপনার পাশাপাশি যে ভাবে ভারতীয় পৌরুষ কে প্রদর্শন করা হয়েছে, তা নিয়েও বিক্ষোভকারীদের আপত্তি ছিল। এর সাথে সাথে ধর্মীয় ভাবাবেগ কেও যুক্ত করে দেওয়া হয়। সিনেমাতে দুই লেসবিয়ান চরিত্রের নাম, অর্থাৎ রাধা ও সীতা হিন্দু ধর্মের সাথে যুক্ত। এই যুক্তি সামনে এনে দাবি করা হয়, ফায়ার সিনেমা দ্বারা হিন্দু ধর্ম কেও আঘাত করা হয়েছে। মানে ওই “হিন্দুধর্ম খতরে মে” জাতীয় তত্ত্ব সামনে আনার চেষ্টা আরকি! এমনকি, শিবসেনার তৎকালীন প্রধান বাল থাকরে দাবি করেন যে, তাঁরা বিক্ষোভ বন্ধ করে দেবেন যদি সিনেমার দুই লেসবিয়ান চরিত্রকে মুসলিম হিসেবে দেখানো হয়। অর্থাৎ, এর অর্থ হল মুসলিমদের মত লেসবিয়ানদের কে সমাজ থেকে বহিষ্কার করতে হবে হিন্দু রাষ্ট্র তৈরি করবার জন্য! মুসলমানদের মতো লেসবিয়ানরাও ভারতীয় সংস্কৃতির তথা হিন্দু রাষ্ট্রের অংশ নয়।
শুধু দক্ষিণপন্থীরাই নয়, এমনি অনেক ফেমিনিস্টরাও ফায়ার এবং লেসবিয়ান ইস্যুর উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়াকে নিন্দা করেন। যেমন, ১৯৯৯তে মানুষী পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদিকা (পড়ুন সম্পাদক) মানুষী তে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লেখেন যে, ভারতবর্ষের সংস্কৃতিতে নাকি হোমোফোবিয়ার কোনও অস্তিত্ব নেই। এবং লেসবিয়ান ইস্যুর উপর গুরুত্ব দিয়েই নাকি ফায়ার হোমোফোবিয়াকে বাড়িয়ে তুলেছিল! নিঃসন্দেহে অদ্ভুত যুক্তি। এটা কার্যত লেসবিয়ানদের অস্তিত্ব কে অস্বীকার করার চেষ্টা। তবে এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ভারতবর্ষে ক্যুইয়ার আন্দোলনের ইতিহাস ঘাঁটলে চোখে পড়বে যে বিভিন্ন সময় নারীবাদীদের থেকে নিন্দা ও বাঁধা ক্যুইয়ার গোষ্ঠী পেয়েছে। যেমন, ১৯৯৪ তে যখন মুম্বাইতে নাজ ফাউন্ডেশন এর সহায়তায় হামসাফার ট্রাস্ট দক্ষিণ এশীয় পুরুষ সমকামীদের নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিল, তার আগে সিপিআই এর মহিলা শাখার (ন্যাশনাল ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ওমেন) প্রধান নারী আন্দোলন কর্মী বিমলা ফারুকী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও কে চিঠি লিখে এমন ধরনের সম্মেলন বন্ধের আর্জি জানান। তিনি চিঠিতে সমকামিতার প্রবণতাকে ‘ভালগারিটি অব ওয়েস্টার্ন কালচার’ বা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অসভ্যতা বলে অভিহিত করেন। আবার ওই একই বছরে যখন কেরালার ত্রিপুরি তে পঞ্চম নারী আন্দোলনের জাতীয় সম্মেলন (ন্যাশনাল কনফারেন্স অফ ওমেন’স মুভমেন্টস্) অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে লেসবিয়ানরা তাঁদের অধিকারের প্রশ্নকে নারী আন্দোলনের অন্যতম ইস্যু করবার দাবি জানিয়ে মঞ্চে উঠে বক্তব্য শুরু করেন, তখন তথাকথিত নারীবাদীরাই আপত্তি জানান। এমনকি তাঁরা সভাস্থলের বিদ্যুৎ সংযোগ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন করে দেন যাতে লেসবিয়ানরা তাঁদের বক্তব্য রাখতে না পারেন! অর্থাৎ, নারীবাদীদের একাংশ বরাবরই হোমোফবিক।
যাইহোক, ফায়ার সিনেমা ভারতীয় সমাজের জড়ত্বে আঘাত হানতে সফল হয়েছিল। আকাদেমিক জ্ঞান পরিসরের বাইরেও সংবাদমাধ্যম, সুশীল সমাজ সহ বিভিন্ন পরিসরে লেসবিয়ানিজম নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয় যা লেসবিয়ানদের দৃশ্যমানতার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছিল। লেসবিয়ান আন্দোলনের ক্ষেত্রেও ফায়ার সিনেমার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। যখন দক্ষিণপন্থী দল, সংগঠন ব্যাপাক হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু করে এবং লেসবিয়ানিজম কে ভারতীয় সংস্কৃতি বিরোধী বলে চিহ্নিত করে, তখন লেসবিয়ানদের একাংশ অনুভব করেন যে, এটাই আসল সময় আওয়াজ তোলার- গর্জে ওঠা অধিকারের দাবিতে। তাঁরা অনুভব করেছিলেন “আভি নেহি, তো কভি নেহি”। তাই ফায়ার নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই দিল্লি ও মুম্বাই এর কিছু লেসবিয়ান সংগঠন (যেমন, সখী, সঙ্গিনী, স্ত্রী সংগম ইত্যাদি) এবং আরোও কিছু সংগঠন ও মুক্তমনা ব্যক্তিবর্গ সম্মিলিত হয়ে একটি যৌথ সংগঠন তৈরি করেন দিল্লিতে ১৯৯৮ এর ৭ ডিসেম্বর এবং সংগঠনের নাম দেওয়া হয় ক্যাম্পেইন ফর লেসবিয়ান রাইটস্ (ক্যালেরি)। মিছিল-মিটিং থেকে শুরু বিভিন্ন ভাবে লেসবিয়ান অধিকার আন্দোলন কে ক্যালেরি জোরালো করে তোলে। পোস্টার হাতে লেসবিয়ানরা দিল্লির রাজপথে প্রকাশ্যে নিজেদের অধিকারের দাবিতে হাঁটছে- এই দৃশ্য ভারতের ইতিহাসে যুগান্তকারী ঘটনা তো বটেই। ১৯৯৮ এর ৭ ডিসেম্বর প্রথম মিছিল আয়োজিত হয় ক্যালেরি’’র উদ্যোগে দিল্লিতে এবং পরের দিন দিল্লির অধিকাংশ সংবাদপত্রে মিছিল সম্পর্কে খবর প্রকাশিত হয়। এটা কিন্তু একটা বিরাট ব্যাপার ছিল। এ সম্পর্কে সেই সময়কার ক্যালেরি’র এক লেসবিয়ান সদস্য বলেন যে, ৮ ডিসেম্বর সকালে তিনি যতগুলো সংবাদপত্র দেখেন তার প্রত্যেকটার প্রথম পাতায় মিছিলের খবর ছিল। এটা নিঃসন্দেহে বিশাল বড় ব্যাপার লেসবিয়ান দের দৃশ্যমানতার ক্ষেত্রে। কারণ, যে লেসবিয়ানদের সমাজ অদৃশ্য করে রেখেছিল, তাঁরাই কিনা সংবাদপত্রের প্রথম পাতার খবরে! ১৯৯৯ এর আগস্ট মাসে ক্যালেরি একটা ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করে যখানে এর উদ্দেশ্য ও কর্মপন্থা সম্পর্কে উল্লেখের সাথে সাথে ফায়ার সিনেমাকে কেন্দ্র করে যাবতীয় ঘটনার বিবরণ তুলে ধরা হয়। আর ম্যানিফেস্টোর শিরোনাম টিও চমৎকার : ‘খামোশ! এমারজেন্সি জারি হ্যায়: লেসবিয়ান এমারজেন্স’। দিল্লি বা মুম্বাইতে লেসবিয়ান সংগঠন ফায়ার বিতর্কের বহু আগে তৈরি হলেও কলকাতাতে লেসবিয়ানদের একমাত্র সংগঠন স্যাফো তৈরি হয় ফায়ার এর অভিঘাতেই। কার্যত ফায়ার নিয়ে চলা তর্ক-বিতর্ক, লেসবিয়ান আন্দোলনের প্রভাব কলকাতাতেও এসে পৌঁছাতে দেরি হয়নি। ১৯৯৯ এর ৩ এপ্রিল আনন্দবাজার পত্রিকা তে ফায়ার-বিতর্ক ও লেসবিয়ান আন্দোলন নিয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ‘ছাই চাপা ফায়ার’ শিরোনামে। প্রবন্ধে লেখা হয় যে, ফায়ার বিতর্কের ফলে লেসবিয়ান আন্দোলনের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে এবং অবস্থারও পরিবর্তন হচ্ছে। এবং আরো লেখা হয় যে, দিল্লি ও মুম্বাইয়ে পরিবর্তন আসলেও কলকাতার লেসবিয়ানরা মধ্যবিত্তীয় মানসিকতার বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেদের অধিকারের দাবিতে সামনে আসতে পারছেন না। এই প্রবন্ধ ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করে কলকাতার লেসবিয়ানদের। ফায়ার বিতর্ক ও দিল্লি-মুম্বাইয়ের লেসবিয়ানদের পথে নেমে আন্দোলন কলকাতার লেসবিয়ানদের আত্মবিশ্বাস দিয়েছিল। ফলস্বরূপ, ১৯৯৯ এর জুন মাসে মালবিকা, আকাঙ্খা সহ মোট ছয়জন লেসবিয়ান কলকাতায় গড়ে তোলেন স্যাফো নামের সংগঠন। পরবর্তীতে ২০০৩ সালে স্যাফো’র বৃহত্তর পরিবার স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি লেসবিয়ান, উভকামী ও নারী থেকে পুরুষ ট্রান্সজেন্ডারদের সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ফায়ার এর গুরুত্বকে স্বীকার করে স্যাফো’র পত্রিকা স্বকন্ঠে’ র একটি সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়:”আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগে ‘ফায়ার’ নামক চলচ্চিত্র ‘লেসবিয়ান’ নামক শব্দকে আমাদের সমাজের শব্দভান্ডারে সশব্দে ঢুকিয়ে দিয়ে তোলপাড় তেলার সঙ্গে সঙ্গে আর যে কাজটা করেছিল তা হল- কলকাতাবাসী তিন জোড়া মেয়ের মনের ছাইচাপা ‘ফায়ার’-এ আবেগ আর সাহসের ইন্ধন জুগিয়ে সঙ্ঘবদ্ধ হতে। সেদিনের সেই সঙ্ঘবদ্ধ প্রচেষ্টার নাম ‘স্যাফো’।“ স্যাফো নামে একজন মহিলা কবি ছিলেন খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের প্রাচীন গ্রিসে যিনি তাঁর নিজের লেখা কবিতার মাধ্যমে নিজের বিকল্প যৌনসত্তা প্রকাশ করতেন। তাই সংগঠনের নামও স্যাফো রাখা হয়। স্যাফো পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র লেসবিয়ান সংগঠন হিসেবে লেসবিয়ান অধিকার আন্দোলনে অসামান্য কাজ করে চলেছে। শুধু স্যাফো নয়, সারা দেশে অসংখ্য লেসবিয়ান সংগঠন এখন সক্রিয় ভাবে কাজ করে চলেছে।
ফায়ার-বিতর্ক থেমে গেছে। কিন্তু ফায়ার যে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে তা এখনও জ্বলছে। লেসবিয়ানদের ভালোবাসার অধিকারের দাবিতে লড়াইও জারি আছে। লড়াই চলবে। এই লড়াই ‘ভালো’, ঠিক সার্ফেক্সের বিজ্ঞাপনের দাগের মত।
গ্রন্থপঞ্জী:
১) গীতা প্যাটেল, ‘অন ফায়ার: সেক্সুয়্যালিটি এ্যন্ড ইটস্ ইনসাইটমেন্টস’, রুথ ভানিতা, (সম্পা.), ক্যুইয়ারিং ইন্ডিয়া: সেম-সেক্স লভ এ্যন্ড ইরোটিসিজম ইন ইন্ডিয়ান কালচার এ্যন্ড সোসাইটি, নিউইয়র্ক ও লন্ডন: রুতলেজ, ২০০২, পৃ.২২২-২৩৩।
২) অমিত রঞ্জন বসু, লেসবিয়ানিজম ইন কলকাতা, কলকাতা: স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি, ২০০৬.
৩) নাইসার্গি এন. ডাভে, ক্যুইয়ার অ্যাক্টিভিজম ইন ইন্ডিয়া: এ স্টোরি ইন দ্য অ্যান্থ্রোপলজি অব এথিকস্, ডারহাম ও লন্ডন: ডিউক ইউনিভার্সিটি প্রেস,২০১২।
৪) খামোশ! এমারজেন্সি জারি হ্যায়: লেসবিয়ান এমারজেন্স, দিল্লি: ক্যাম্পেইন ফর লেসবিয়ান রাইটস্, ১৯৯৯।
৫) শ্রদ্ধা চ্যাটার্জী, ক্যুইয়ার পলিটিক্স ইন ইন্ডিয়া: টুওয়ার্ডস সেক্সুয়াল সাবল্টার্ন সাবজেক্টস্, লন্ডন ও নিউইয়র্ক: রুতলেজ, ২০১৮।
[লেখক – গবেষক, ইতিহাস বিভাগ, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়]