অর্ধেকের খোঁজে: নিজস্ব বুননে ভারতীয় নারীদের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ – অমৃতা সরকার

চতুর্দশ কিস্তি

পাতার কর্কশে ফুটে থাকা আয়াসেঃ কুন্তলা কুমারী সবতের কবিতা

কুন্তলা কুমারী সবত ( ১৯০৮-১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দ) আধুনিক সময়ে ওড়িয়া ভাষার প্রথম নারীবাদী কবি। তাঁর জন্ম বাস্তারের জগদলপুরে। ড্যানিয়েল ও মনিকার কন্যা কুন্তলার ছোটবেলার কয়েক বছর কাটে বার্মায়। অল্পবয়সেই তাঁকে মায়ের সাথে ফিরতে আসতে হয় ওড়িশার খুরদায় কারণ তাঁর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সামাজিক ছক না মেনে চলা শৈশব কুন্তলাকে জীবনের শুরু থেকে নির্ভীক করে তোলে। কুন্তলা একজন পেশাদার চিকিৎসক ছিলেন। চিকিৎসার পাশাপাশি সাহিত্যের প্রতিও ছিল তাঁর ঝোক। সাহিত্যের জগতের সন্ধান তিনি পান তাঁর শিক্ষক কৈলাশ রাওয়ের কাছ থেকে। এই সময়েই কুন্তলা ‘নববিধান’ ও ‘ব্রাহ্ম সমাজ’-এর সদস্য হন। “অঞ্জলি” কাব্যগ্রন্থের জন্য কুন্তলা ভূয়সী প্রশংসা পান। ‘উৎকল ভারতী’ শিরোপা দেওয়া হয় তাঁকে। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লিতে চলে আসেন তিনি। দিল্লিতে আসার পর তাঁর লেখক-জীবন নতুন বাঁক নেয়। ইংরেজি, বাংলা, হিন্দি, ওড়িয়া চারটি ভাষাতেই সাবলীল ছিল তাঁর কলম। ওড়িয়াকেই নিজের রাজনীতির ভাষা হিসেবে বেছে নেন তিনি। ওড়িয়াতে লিখেই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত করতে চান ওড়িয়াভাষী প্রান্তিক মানুষ, বিশেষত নারীদের। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের ‘বন্দেমাতরম’ যেমন ‘বর্ণহিন্দু’ বাঙালির জাতীয়তাবাদ উন্মেষে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, ঠিক তেমনই কুন্তলার “ স্ফূলিঙ্গ” ও “আহ্বান” কাব্যগ্রন্থ দুইটি ওড়িয়া জনমানসে জাতীয়তাবাদ উন্মেষে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। প্রবল পিতৃতান্ত্রিক ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পরিসরে কুন্তলার এই স্বর নারীবাদের জরুরি পদক্ষেপ। ‘স্বাধীন’ ভারতের ধারণায় কুন্তলার স্বর ব্যতিক্রমী। তিনি কেবলমাত্র শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরকেই ‘স্বাধীনতা’ বলে ভাবতেন না। তাঁর মতে আগামী দিনের ‘স্বাধীন’ ভারতে পিছিয়ে থাকা শ্রেণি, বর্ণ ও লিঙ্গ যদি নিজেদের অবস্থান দৃঢ় না করতে পারে, তাহলে একটি শোষণমুক্ত, সংস্কারমুক্ত, বৈষম্যমুক্ত স্বাধীন ও সুস্থ ভারতবর্ষ গঠিত হওয়া সম্ভব নয়। তাঁর এই প্রকৃত মুক্তির ডাক আমরা শুনতে পাই “ গজরাট কৃষক” কাব্যগ্রন্থে। তিনি লিখছেন, “ ও আমার লড়াকু সাথীরা! বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়ার জন্য জন্মায় না মানুষ”। দলিত ও প্রান্তিকের প্রবল উপস্থিতি দেখা যায় “ অর্চনা”য়। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ২রা অগস্ট ‘উৎকল সম্মিলনী’র একটি সভায় হাজারেরও বেশি ওড়িয়া মহিলারা যোগ দেন। সেখানে কুন্তলার নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘ অল ওড়িয়া উইমেন অ্যাসোসিয়েশন’। এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল ওড়িশার নারীমুক্তির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া।
ভারতীয় নারীবাদে কুন্তলার অবদান অনস্বীকার্য তাঁর “ ওড়িয়াঙ্কা ক্রন্দনা” সংকলনটির জন্য। একজন মেয়ের বিয়ের পর শিকড়চ্যুত হওয়ার হিংস্রতা কতটা ‘স্বাভাবিক’ করে তোলে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ, তা এই সংকলনটির ভিতর দিয়ে ধরেছেন তিনি। কবিতা ছাড়াও অসংখ্য ছোটোগল্প ও উপন্যাস লিখেছেন তিনি। তাঁর উপন্যাস “ কালি বহু” , “ না থুন্ডি” ( “পরচর্চা”) মেয়েদের রোজকার জীবনের ছোটোবড়ো সংকট, জিজ্ঞাসা তুলে ধরে একজন নারীর প্রেক্ষিত থেকে। কুন্তলা নারীবাদের পরিসরকে শেষ অবধি বিস্তৃত করতে চেয়েছেন মানবতাবাদের বৃহত্তর পরিসরে। তিনি ‘কবি ও লেখকের উদ্দেশ্যে’ প্রবন্ধে স্পষ্ট জানিয়েছেন যে কবিকে কখনো বাঁধা যায় না তাঁর সময়, দেশ, জাতির গণ্ডিতে; কবি সব সীমানা ছাড়িয়ে শেষ অবধি মানবতার।

ছোটো ও বড়ো

ছোটো হলেও মুখচোরা নই,
কখনো বড়োও হতে পারি।
পুরোটা ফুটলে, ফুলের
আর বাকি থাকে না কিছু ফোটার
শুধু ফুটতে পারে কুঁড়ি ।

চাঁদ পুরে গেলে কাণায় কাণায়,
ছাপিয়ে তাকে আর হয় না বড় হওয়া ।

পুরোটা ফুটলে, ফুলের
আর বাকি থাকে না কিছু ফোটার
শুধু ফুটতে পারে কুঁড়ি ।

স্বরাজের পথে

আমার দেশের মানুষ, সঙ্গী, আত্মজন! সকলে
ভয় পেয়েছো আমায় জেলের এপাশে দেখে?
দুঃখ পাচ্ছো কেন? এ’তো আগেই ছিল জানা।
ভীরু ভয় পায়,
বীর হয় মারে, নয়তো নিজেই মরে।
বীরের ললাটে নেই পিছুহটা,
শুধু পার্থিব পিছুটানে বাঁচে না সে।
জানি এখনো শান্তির পথেই রয়েছে এই লড়াই;
প্রয়োজন নেই গুলি, বারুদ, বন্দুক ।
পেশিশক্তি, অর্থবল চাই না কিছুই।
হাতি, ঘোড়া, রথেরও নেই প্রয়োজন।
দানবিক শক্তিকে খণ্ডাতে এ যুদ্ধ
আত্মার ।
অর্থ, স্বজন, ঘর ছেড়ে
নিজেকে খুঁজেছে যে অসহযোগ আর অহিংসায়
তাকে ঠিক খুঁজে নেবে তার স্থান।
প্রথমে হয়তো জ্রল,
মৃত্যু হয়তো তারপর।
যুদ্ধ করতে নামলে কীইবা সম্মান, কীইবা অপমান!

শেফালি

আলতো শরীর তোমার, মধুতে জীবন্ত,
অকল্পনীয় সৃষ্টি, কারণহীন হয়ে
ফুটে আছে অজানা দূরে, পাতার ফাঁকে, গভীরে।
বাতাসে ভেসে আসা তোমার সুবাস
এখনো চায় আমার মন।
খুলে বলো আমায়, দূরদেশী ফুল , কে রচেছে তোমায়?

কী মোহময় নরম মুখ তোমার,
চারদিকে আঁধারের জঙ্গল,
পাতার কর্কশে ফুটে থাকো কী আয়াসে,
বাতাসে পৃথিবী জুড়ে তোমার বাস!
ছোটোর মাঝেই তো সেই বৃহৎ ঈশ্বরের বাস।

দেখো কী আদরে তাঁর পদ্ম ফোটে কাদায়,
ঝিনুকের পেটে জন্মায় মুক্তো অমূল্য,
কালো মেঘের আলিঙ্গনে চমকায় বিজুরি,
কোকিলের কন্ঠ উপচানো মধুর।

শেফালি তোমার মুখ কি ভেসে আসে আমার স্বপ্নে?
তোমার গন্ধে ডুব দি শুধুই একটি রাতের জন্য,
খুঁজে পাই আনন্দ।
মূহুর্তের তরে যে মর্যাদায় ফুটে ওঠো
তা স্মরণ করে নিজেকে তুচ্ছ ভেবে কাঁদবো কেন?
ধূলিময় ধরায় ক্ষুদ্র আমি,
মহাবিশ্বের ব্যপ্তি কল্পনাতেও আনতে পারি না।

তুচ্ছ, তবু, জন্ম অকারণ নয় আমার;
চিরতরে মুছে যাওয়ার আগে
ফুটে উঠি একটি রাতের তরে, ঝরে পড়ি সকাল এলে।

Facebook Comments

Leave a Reply