অপ্রকাশিত কবি
[বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি, বহু প্রতিভাশালী কবিই অপ্রকাশিত অপ্রচারিত থাকেন – কখনও বা তাঁদের ভাষা আঙ্গিক শৈলীর বিশেষত্বের কারণে, কখনও জনসংযোগ করতে অক্ষম বা অনিচ্ছুক ব’লে, আবার কখনও হয়ত কেবলমাত্র তাঁর ভৌগোলিক অবস্থান বা পরিবেশের কারণে। এমন কত কারণই ঘুরে বেড়ায়। একজন প্রকৃত কবির কাজ লুকিয়ে থাকে অপ্রকাশের আড়ালে।
“অপ্রকাশিত কবি” – অপরজন পত্রিকার একটি প্রয়াস, এমন কবিদের কাজকে সামনে আনার, যাঁরা ব্যপকভাবে প্রকাশিত বা প্রচারিত নন। যাঁদের লেখা হয় এর আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি, অথবা কেবলমাত্র দু’ একটি পত্রিকাতেই প্রকাশ পেয়েছে। অথচ যাঁরা লেখার মাধ্যমে আমাদের দেখাতে পারেন ভবিষ্যত বাংলা কবিতার বাঁক।
বিভাগ সম্পাদনা করছেন, রাহেবুল।]
ইলিয়াস খান
জন্ম: ২৫/০২/১৯৯১
জন্মস্থান: পূর্ব বর্ধমান জেলার উজালপুর গ্রামে।
কবিতা লেখার উদ্দেশ্য-বিধেয়: নিজেকে খোঁজা। অসংখ্য শব্দ যা আমার ভেতর ভেসে বেড়াচ্ছে। যেন গভীর জলে ঘুরপাক খাচ্ছে আর আমি কমফোর্ট জোন খুঁজছি। ফলে লেখা হয়ে উঠছে আপাত ভ্রমণবিলাস। তাছাড়া আমি প্রায়শই দেখি একটা ট্রেন স্টেশন ছেড়ে চলে যাচ্ছে আর পেছনে পড়ে থাকা ধাতব কিছু শব্দ রক্তাক্ত এবং ডানা-ভাঙ্গা পাখির মতো ছটফট করছে। সেই সব শব্দগুলোকে একটা অবয়ব দেওয়ার জন্যই আমার লেখালেখি।
প্রথম প্রকাশ: বায়স পত্রিকায়।
বয়স হিসাবে ধরলে ইলিয়াস খানকে খুব একটা তরুণ কওয়া যায় না। কিন্তু লেখার পরিমাণ ওর খুব বেশি নয় বরং কমই। এখনও অব্দি কোনো বইপত্র নেই। এই সময়, এই জীবন আর স্বয়ং কবিতাকেই নিয়ে কবির সংশয়, দ্বিধা-দ্বন্ধ জটিলতা। তার প্রত্যক্ষ প্রভাব কবিতাতেও যেন। আর পাঁজনের আর পাঁচটা গড়পড়তা কবিতার মতো নয় ইলিয়াসের কবিতা তেমনি লেখায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড় গড় করে বলে যাওয়াটাও নেই। কবির ব্যক্তিগত দর্শন ভাষায় যেন কুলোচ্ছে না কুলোচ্ছে না ভাব, কিন্তু কবিও নাছোড়, এবং এক সময় কথা ঠিকই কবিতা হচ্ছে। পড়া যাক ইলিয়াসকে।
ইলিয়াস খানের কবিতা
অস্তিত্বের এপিটাফ
ঘুম থেকে জেগে ওঠা খুবই অলৌকিক ব্যাপার। অন্দরের জগতে কয়েকশো বছরের
পথ পার করে আসার রোমাঞ্চ কলরবহীন। মধ্যপথে ফেলে আসা গাছপালা, প্রান্তর,
রাজকুমারীর বিমুগ্ধ টান, ঘোড়া এবং নৌবহর পেরিয়ে ভিন্নতর জগতে উপনীত হয়ে,
বোধের সংস্পর্শে, আমি অগণিত মানুষের মাঝে সৌভাগ্যপ্রাণ। বালিশ বিছানায় সুঘ্রাণ।
গত দিনের বিস্মৃতপ্রায় সময়, যা কবিতার নিহিত অস্তিত্ব। সত্যি কথা বলতে কি,
দিনলিপির পাতাগুলো ভরাট হয়ে যায় দুর্ভোগের পরম্পরায়।
মাঝি হাল করে থাকে! ইন্টারনেট-কবলিত ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস শেষের ক্লান্তি ঘুমের মধ্যে
চাপা পড়ে যায়।
অহং বর্জন আয়াসসাধ্য মনে হয় (আসলে কি তাই!)। মানুষকে খেলনা-দোকানের সম্ভার
মনে করা যদিও অনুচিত, সেই নৈতিকতার গন্ডি অতিক্রম অসম্ভব। দেখি, হাড় মজ্জায়
বংশপরম্পরার সীমাহীন জেদ এবং আমার পূর্বপুরুষের অতীতচারিতায় সতত সময়
ক্রিয়াশীল।
সুড়ঙ্গের অন্তর্বর্তী প্রকোষ্ঠে শত শত কবুতরের উড়ান আমার অস্তিত্বের প্রাণভোমরা।
বিনম্র নিশ্বাসের চকিত প্রণতি—গত জন্মদিনের স্বচ্ছ খোলসের উন্মোচনের অঙ্গীকার।
যেন ঋতু শেষে ম্রিয়মান পাতা-ঝরা মরশুম। তারপরেই শুরু হবে মজ্জায় ও বোধে
সবুজাভ পত্রের শোভা।
একটা নদী, একটা জন্মভূমি, কয়েকটি স্বজন-হারানো বাড়ি-এর বাইরে পদচারণা মানে
ওই সুড়ঙ্গ অন্তর্বর্তী প্রকোষ্ঠে বর্ষার অকাল বৃষ্টির পূর্বাভাস, অথচ অবধারিত। কিন্তু আমি
যে আমার অস্তিত্বের ইতিহাস প্রযত্নে খোদাই করি। সেই সংগ্রাম আমাদের টিকিয়ে রাখে।
অনবরত আমরা সৃষ্টি করি যাবতীয় অঘটন-ঘটন-পটীয়সী কার্যশৃঙ্খলা।
আধ্যাত্মিক সংস্পর্শহীন গানের কলির মুহূর্মুহ ওঠাপড়ায় মধ্যরাতের নৈঃশব্দে অনন্ত
সময়স্রোতে ভাসতে ভাসতে ভিন্ন তটে বিক্ষিপ্ত ঢেউ এর আছাড়—আমার বেঁচে থাকার
স্বরূপ। ঈশ্বরকে তখন যাযাবর মনে হয়। শুধু ওই পারাপারের উজ্জ্বলতায় ধুয়ে মুছে সাফ
হয়ে যায় যত গ্লানি অপমান দৈনন্দিন সংবর্ত তুচ্ছতা। আর একবার সকালে ঘুম থেকে
জেগে ওঠার ধক্ আরোহণ করে জীবনের প্রাচুর্য পেয়ে যাই। প্রাণের খোঁজ মোহময়।
যাত্রাপথ সুদীর্ঘ।
প্রত্যেক দিন আমি নতুন মানুষ হয়ে উঠি। শূন্য থেকে শুরু করে মনুষ্যত্ববোধের উন্মোচন
ঘটে। আমাদের প্রত্যেক দিনই শেষ বিচার।
প্রেম ও নিরালা হাওয়া
একটা নিরালা ঘরে গুচ্ছের অক্ষরবিলাস সতত সুখের নয়।
নাম জানি সেরকম কিছু চিত্র; রেখায় রেখায় বর্ণসুখী চাষী।
প্রত্যেক ক্ষমতাশালী হাওয়ারা সম্ভাবনার প্রেম লিখে আকাশে
উড়িয়ে দিচ্ছে।
বাহুল্য-সমেত আবিল সাতরঙা প্রদীপ!
বিস্ময় আর স্বজন-সংযুক্ত কয়েক শতাব্দীর মানুষের বীরদর্প।
অথচ কুঁকড়ে আছে নয়নযুগল।
পরাভূত ঘর, নিরালা পেয়ারা গাছ—সবাই সন্দেহ পোষণ করছে…
একটি পলাশ গাছ ও বিভ্রান্তি
একটা পলাশ গাছ তাকে ঘিরে সাদা বকের উতলা রব। মানুষ গাছের নিচে
দাঁড়িয়ে খুচরো পয়সা গুনছে। কেনাবেচার হিসেব আগলে পুকুরের ঢেউ
এখন ম্রিয়মাণ। ক্লান্ত হরিণশাবক ফুলের বালিশে রাতঘুম—দিব্যি সুখ আর
পরিতৃপ্তির দৃশ্য।
হালকা কুয়াশামাখা সকালে দূরের রাস্তা বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে গত রাতের
স্বপ্নের রেশ থেকে যাচ্ছে। আমি চাইছি না অমোঘ টান কেটে যাক। নিঃস্ব
প্রান্তরের সবটুকু নিঃশেষ হলেও অতীন্দ্রিয় আমি বাতাসের মতো বিলীনপ্রায়।
বিভ্রান্তির চূড়ান্ত সীমায় মানুষের অস্তিত্ব। যে-কোনো গোত্রভুক্ত ভয় আমাদেরই
অজ্ঞানতার যোগ বিয়োগ গুণ আর ভাগফল। অঙ্কের সঠিক নিয়মকানুন না জানলে
অর্ধবৃত্তাকারে অসম্পূর্ণ যাপন; বোধ ও বোধের অতীত যা কিছু, মহাশূন্যেরও শূন্যতায়
অচিন আলোর প্রতিফলন অধরা।
Posted in: May 2021 - Serial, POETRY