শূন্য? মানি না : ত্রিদিবেশ ভট্টাচার্য
‘অপরজন’-এর সংখ্যায় ‘ভোটে যখন আসন শূন্য’ বিষয়ে লেখা পাঠাবার জন্য আমার পরমাত্মীয় কৌশিক চট্টোপাধ্যায় যখন ফোন করলো, তখন অবাক হলেও তা ফেলতে পারিনি। কারণ, আমি যে দু-একটা কবিতা নিজের খেয়াল বসে বা প্রেয়সীকে উদ্বুদ্ধ করার তাগিদে লিখে ফেললেও, এ রকম একটা গুরুগম্ভীর বিষয়ে লেখার কথা কখনো চিন্তাতেও আনতে সাহস পাইনি। ফলে আমার কাছে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো অনুভূত হতে লাগলো।
বুকে তীব্র স্পন্দনের উৎস থেকে উৎসারিত শব্দের দোলায় আন্দোলিত হওয়ার মজাই আলাদা এবং সেখান থেকে লেখার একটা তাগিদ, ইচ্ছাশক্তিকে বাড়িয়ে তুলতে শুরু করলো। সেটা হল ভাবনাকে বাস্তবে রূপায়িত করবার জন্য। কিছু জিনিষ ঘাটাঘাটি করে অজানাকে জেনে নিজেও কিছুটা সমৃদ্ধ হলাম। এই লেখায় এটাই আমার পরম প্রাপ্তি।
আমি জানিনা, কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে এই সময়ে এইরকম একটি বিষয় বিবেচনার মধ্যে আনা হয়েছে, কারণ এর পূর্বেও অনেকে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময়ে তথাকথিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটে হেরেছে, এমনকি দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করেও অনেক জায়গায় অনেক দল তারা কোন আসন পায়নি, এমন অনেক উদাহরণ আছে। কোন একজন ব্যক্তি বা সমষ্টি জয়ী না হওয়া সত্ত্বেও বারবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পিছপা হয় না। যদিও এই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অনেকেই সত্যিকার অর্থেই সমাজের প্রগতি চায়। তবে হ্যাঁ, সবকিছুই তো কোন না কোনদিন শুরু করতে হয়। যাই হোক, যদিও বিষয়টি উপস্থাপিত বিষয়ের পক্ষে আত্মসারশূন্য হতে পারে, তবুও আমি আমার মতো করে উপস্থাপন করবার চেষ্টা করছি। যদি পাঠককুলের চিন্তনে কিছুটাও নাড়া দেয়, তা হলেও আনন্দ পাবো।
‘শূন্য’ এমন একটি অঙ্ক যা ধনাত্মক কিংবা ঋণাত্মক অঙ্ক-এর কোনটিই নয়, এর মাঝখানে অবস্থান করছে। এখন ধরে নেওয়া যেতে পারে, কোনো একটি নির্বাচনে যার বা যাদের আসন শূন্য, সে বা তারা যে সমাজ ব্যবস্থা চলছে তার সাথে সহমত পোষণ যেমন করেন না, ঠিক তেমনি এই ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে যাওয়া যাবে বলেও মনে করেন না। অতএব, সে বা তারা এই সমাজের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য বজায় রাখার চেষ্টা করেন, যাতে সমাজ যে অবস্থায় আছে, তার থেকে যেটুকু সুযোগ পাওয়া যায় সেটা যেন বজায় থাকে এবং তাকে কাজে লাগিয়ে কিছুটা উন্নত ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করা।
মানুষ হয়তো এটা মনে করেছে। এই ধরনের মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তি বা সমষ্টি অবশ্যই বিপদে যে রকম পাশে থাকবে, ঠিক সেইরকম এই চলমান সমাজের খোল-নলচে বদলে ফেলা এঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। যা চলছে, তাই চলবে। দুর্নীতি, স্বজন-পোষণের বিরোধিতা যেমন থাকবে, থাকবে সকলের জন্য শিক্ষা ও শিক্ষান্তে মৰ্য্যাদা সম্পন্ন কাজ সহ সর্বস্তরের সর্বসাধারণের ন্যায়সঙ্গত, সমাজের উন্নতিসাধনের দাবী, কিন্তু সব নির্মল হয়ে বা সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। অতএব, এঁদের অবস্থান মাঝখানে।
এমন ভাবেও ভাবনা আসতে পারে, যেহেতু শূন্যের কিছু মিল রয়েছে ধনাত্মক সংখ্যার সাথে, অর্থাৎ, টানটা ধনাত্মক সংখ্যার বা প্রগতির দিকে, অতএব শূন্য তাঁদেরই প্রাপ্য যারা সমাজের মাপকাঠির ধনাত্মক রাশির দিকে এগিয়ে যেতে চায় বা সমাজের অগ্রগতি চায়।
এবার বিষয়টিকে একটু অন্যভাবে ভাবার চেষ্টা করে দেখি কি দাঁড়ায়, আমরা যখন কোনো নতুন কিছু চিন্তা বা উপস্থাপনা করি এবং চারপাশের কোনো মানুষ সেটা সমর্থন না জানায়, তখন আমাদের চারপাশ শূন্য শূন্য মনে হয়। কিন্তু দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় চলতে চলতে বাস্তব কারণেই সমাজ যেটা সত্য সেটাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়। কারণ, সত্য সবসময়ের জন্য সত্যই, সেটা স্বীকার করা হোক বা না-হোক। তবে, কোন বিষয় সমাজের কাছে কবে গ্রহণযোগ্য হবে, সেটা বলা সম্ভব বলে মনে হয় না। তাও যদি বলতেই হয়, এভাবে বলা যেতে পারে যে, সমাজের চালিকাশক্তি যত তাড়াতাড়ি বিষয়সমূহ উপলব্ধি করবে এবং ততই মঙ্গল।
কিন্তু এমন অনেক উদাহরণ আছে যেখানে অসমর্থনই শুধু নয়, নতুন ধারণার সৃষ্টিকর্তাকে মানসিক যন্ত্রণার পাশাপাশি শারীরিক নির্যাতনও সহ্য করতে হয়েছে। সেটা আমাদের দেশেও যেমন, অন্যান্য দেশেও এইরকম উদাহরণ। বহু উদাহরণ দেওয়া যায়। এখানে দু-চারটে উদাহরণের উল্লেখ রাখছি। ভারতের নবজাগরণের পথিকৃৎ ধর্ম ও সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় যে দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন সেই কারণে তাঁর বাবা-মায়ের সাথে এমন চরম পর্যায়ে বিরোধ পৌঁছেছিল যে, বাবা তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করে দেন। পরবর্তীকালে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সহায়তায় সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলনকে এক নতুন পথ দেখাতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রবল সমর্থক। এজন্য সেই যুগের রক্ষণশীল সমাজের কঠোর বিদ্রূপের সম্মুখীন তাঁকে হতে হয়। তবুও তিনি সমাজের কুপ্রথা নির্মূলের জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। নারীশিক্ষার প্রচারে কলকাতাসহ বিভিন্ন জেলায় যখন বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন, তখন সেই উদ্যোগ তদানীন্তন সময়ের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দ্বারা নিন্দিত হন।
বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি তার বিভিন্ন ধরনের আবিষ্কারের নেশায় চলতে চলতে একসময় যুগান্তকারী দাবি করেন, চাঁদ সমতল নয়, এটি পাহাড় পর্বত ও গর্ত বিশিষ্ট একটি গোলক। এমনকি সূর্যও নিখুঁত নয়, গায়ে তার কালো দাগ আছে যা কিনা সৌরকলঙ্ক। এইসময় থেকেই চার্চের সাথে বিবাদ শুরু। একসময় বিচারে তাঁকে গৃহবন্দী করা হয় এবং আট বছরের মাথায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর প্রায় দুশো বছর পরে চার্চ তার কাজের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে বিজ্ঞান জয়ের মুখ দেখতে পায়।
সুতরাং, একসময় যেটা শূন্য, পরবর্তীকালে সময়ের তালে তালে সেটাই অগ্রগণ্য হতে পারে। বস্তুত দুনিয়ার মানব সমাজ জীবনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সেটাই পরিলক্ষিত হয়। কারণ, চলমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাধারণভাবে সহজে কেউ চলতে আগ্রহী হয় না। সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে, অনেকসময় মানুষ তাঁর অধিকারবোধ হারিয়ে ফেলে। অনেক সময়ই সমাজকে তাঁর কি দেবার এবং সমাজ থেকে তার কি পাবার আছে সেই সম্পর্কেও সঠিক ধারণা থেকে সে বিচ্যুত হয়। কোনরকমে দিন গুজরান হওয়াটাই তার কাছে চরম পাওয়া। তাঁর পাওনা থেকে সে বঞ্চিত হচ্ছে কিনা সে সম্পর্কে ভাবতেও উৎসাহ বোধ করে না। বরঞ্চ অধিকার ফলাতে গিয়ে যেটুকু জুটছে সেটা থেকেও যদি বঞ্চিত হয়, সেই ভয়ে নিশ্চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করে।
একান্তভাবেই স্বার্থান্বেষী হতে হতে প্রথমে পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে থাকতে শেষ অবস্থায় আক্ষরিক অর্থেই শুধুমাত্র নিজের কথা ছাড়া অন্য কিছু সে ভাবতে পারে না। সে ভাবতে পারে না এই পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধসহ সকলকিছুর উপর তারও অধিকার আছে। দিনযাপনের চিন্তায় এতটাই মগ্ন থাকে যে, সমাজের চারপাশের ঘটনা সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতে সে উৎসাহ পায় না।
ক্ষমতা যেখানে মূলমন্ত্র, সেখানে অনেক সময়ই টিকে থাকার জন্য মুষ্টিমেয় কিছু অংশকে তথাকথিত ক্ষমতার আস্বাদন দিতে শাসক পিছপা হয় না। অর্থাৎ যা-যা বা যেটুকু প্রয়োজন তাই করতে ওরা সদা সচেষ্ট। তাই দেখা যায়, ‘ক্ষুধার্ত শিশু চায় না স্বরাজ, চায় শুধু ভাত, একটু নুন’ – এই বাস্তবিক চিন্তায় সে বেঁচে থাকার সমস্ত পথের গোলকধাঁধায় ধাবিত হয়েও নিশানা খুঁজে পায় না। ফলে কিভাবে চললে ভাল হয়, সে সম্পর্কে তার করণীয় কিছু আছে বলে মনের দিক থেকে সে কোন সাড়া পায় না। ফলে যা চলছে তাকেই অবশ্যম্ভাবী বলে মেনে নিয়ে চলাকেই সে শ্রেয় বলে মনে করে।
এই প্রসঙ্গে একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, আমরা যদি মানব ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখি তবে দেখতে পাবো, আদিম সভ্যতা থেকে মানবজাতি ক্রমশ যত বেশি নিজেকে উন্নত করেছে, তত বেশি বেশি একটা অংশের মধ্যে স্বার্থপরতার জন্ম হয়েছে। সেখান থেকে যে গোষ্ঠীগুলো বন্য পশুদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সৃষ্টি হয়েছিল, তারা একটা সময় নিজেদের মধ্যে লড়াই শুরু করলো। লড়াই পরিচালনার সুবিধার জন্য, তৈরি হল গোষ্ঠী নেতা। তার কথাই তখন সেই গোষ্ঠীর শেষ কথা। আস্তে আস্তে সেই নেতার মধ্যে জন্ম নিলো অহমিকা বোধের। সেখান থেকে তার মধ্যে এই বিশ্বের যা কিছু ভাল, সবকিছুর দখলদারি হওয়ার প্রবণতা দেখা দিল।
সেই কারণে, গোষ্ঠী লড়াইয়ের শেষে একসময় বিজয়ী গোষ্ঠী পরাজিত গোষ্ঠীর সবাইকে হত্যা করার যে প্রবণতা ছিল, সেটা বর্জন করে পরাজিত গোষ্ঠীর নেতাকে বাদ দিয়ে বাকিদের নিজের গোষ্ঠীর দাস হিসেবে নিয়োজিত করত। আস্তে আস্তে তার মধ্যে ক্ষমতার লিপ্সা আরও বৃদ্ধি পেল। সে এক দেশ থেকে আর এক দেশে নিজের পরাক্রমতা বাড়ানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। শুরু হল দেশে দেশে লড়াই। পরাজিত দেশের নাগরিকবৃন্দ জয়ী দেশের শাসকের শাসন রীতি-নীতি মানতে না পারলেও সেটাই রেওয়াজ বা বিধান হিসেবে পরিগণিত হলো।
আশ্চর্যজনকভাবে লক্ষ্য করা গেল যে, জয়ী দেশের শাসকের তোষামোদি করতে নিজের দেশের মানুষের উপর নির্বিচারে অত্যাচার চালানোর বাসনায় একটা শ্রেণী তৈরি হল। একান্তভাবেই ব্যক্তি স্বার্থে, নিজে ক্ষমতার অলিন্দে থেকে তার স্বাদ আস্বাদনের তাগিদে। অর্থাৎ খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে, স্বার্থপরতা থেকে তৈরি হয় ক্ষমতার লিপ্সা এবং সেখান থেকে কিভাবে তা আহরণ করা যাবে তার কলা-কৌশল।
অনেক সময় মনের মণিকোঠায় অনেকের মনে নানা রকম প্রশ্নের উদয় হয়। মন বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তখন তাকে নানারকমভাবে ভুল বুঝিয়ে, প্রলোভন দেখিয়ে, মনের ভয়কে কাজে লাগিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলা হয়। এটা করা হয় শাসন ব্যবস্থার নানাবিধ স্তম্ভকে কাজে লাগিয়ে। আমিত্বকে টিকিয়ে রাখবার জন্য সমস্ত ধরনের অস্ত্র ব্যবহৃত হয় শাসনের অধিকারকে হাতিয়ার করে। ভেবে দেখ মন কেউ কারো নয়’ – এইভাবেই মানুষের মনকে চালনা করার চেষ্টা করা হয়।
এই আমিত্ব, স্বার্থপরতা, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার, সমাজের যেকোনো স্তরেই সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক পরিসরগুলোর সর্বত্র প্রযোজ্য। বৈজ্ঞানিকরা যে এই কলুষতা থেকে মুক্ত, সেকথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন স্তরের ইতিহাসের পাতা উল্টালে এমন বহু উদাহরণ আমাদের সামনে আসবে। এই প্রবল পরাক্রমশালী মানুষের চাপে অনেকেই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেন না, তাদের মধ্যে সৃষ্টিশীলতা থাকলেও। আবার এমন উদাহরণও মিলবে যে, সেই পরাক্রমশালী মানুষের ছায়ায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েই নিজেকে ধন্য করে তুলতে উদগ্রীব থাকেন অনেকে।
অর্থাৎ এগুলো সবই সমাজের এক একটি ধারা। এক একজন এক এক ধারায় ধাবমান। সেইরকম গণতন্ত্রও বিভিন্ন ধারায় প্রবাহিত। যেখানে যতটুকু গণতন্ত্র থাকলে শাসকের শাসন বজায় থাকবে, সেখানে ততটুকুই গণতন্ত্র। যদি দেখা যায়, গণতন্ত্রের ফলে শাসনের অসুবিধা হচ্ছে, তবে সেখানে গণতন্ত্র নামধারী বিষয়টিকে উৎখাত করা হয় এবং তা করা হয় শাসন ব্যবস্থার নানাবিধ স্তম্ভকে কাজে লাগিয়ে। যাতে মানুষের মনে খুব সহজে কোনো প্রশ্ন না আসে।
পৃথিবীর দেশে দেশে এমন উদাহরণ ভুরিভুরি। আসলে আমিত্বের এবং ব্যক্তি লালসার শিকড় মানুষের ভিতর এতটাই গভীর যে তার থেকে বেড়িয়ে আসা খুবই কষ্টসাধ্য। এমনকি, জার শাসনের উৎখাতের পর দুনিয়া জোড়া মানুষকে স্তম্ভিত করে রাশিয়ায় যে সমাজতান্ত্রিক চেতনার বীজ সমৃদ্ধ হতে শুরু করলো পুনরায় সেখানেও ধীরে ধীরে জন্ম নিলো ব্যক্তিসত্তা। শুরু হলো, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার গালভরা নামে ব্যক্তি চিন্তার প্রসার।
সমাজতান্ত্রিক চেতনায় বিভিন্ন দেশের মানুষকে সচেতন না করে জোরপূৰ্ব্বক দখলে এনে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর সাথে যুক্ত করার ফলশ্রুতিতে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ কাঠামোটাই ভেঙ্গে পড়ল। যে ব্যবস্থা ধীরে ধীরে দেশে দেশে চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে মানব সমাজ জীবনে আমূল পরিবর্তন আনতে পারত, অঙ্কুরেই তা বিনষ্ট হল।
আমার মতে, এখানে সাম্যবাদের প্রথম নিদর্শন আমরা শ্রী চৈতন্য যার প্রকৃত নাম শ্রী বিশ্বম্ভর মিশ্র – এর মধ্যে দেখতে পাই। যিনি গৌরাঙ্গ চন্দ্র দেব এবং নিমাই পণ্ডিত নামেও পরিচিত ছিলেন। যিনি জাতি, বর্ণ, নির্বিশেষে সকলকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। তিনি তার ধারায় এক নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন। প্রথম যৌবনে তিনি ছিলেন স্বনামধন্য পণ্ডিত, কিন্তু পরবর্তীকালে স্বামী ঈশ্বর পুরীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর তাঁর জীবনে এক পরিবর্তন ঘটে। হিন্দু ধর্মের জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি সমাজের নিম্নবর্গীয় মানুষের কাছে টেনে নিয়েছিলেন। এই সময় তাকে অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হলেও তিনি তাঁর লক্ষ্য থেকে পিছপা তো হননি, বরঞ্চ অত্যাচারী জগাই ও মাধাইকে নিজের মতাবলম্বী হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তাঁর প্রভাবে মুসলিম সমাজের মানুষজনও আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন। চৈতন্যভাগবত-এ আছে জাতিভেদের অসারতা দেখানোর জন্য তিনি শূদ্র রাম রায়কে দিয়ে শাস্ত্র ব্যাখ্যা করিয়েছিলেন। কিছুদিন তিনি এদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান। এই সময় পথে সত্যবাঈ লক্ষ্মীবাঈ নামে দুই বারাঙ্গনা এবং ভীলপন্থ, নারেজীর মতো দস্যুগণ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। জীবন শেষের বেশ কিছু বছর তিনি পুরীতে অতিবাহিত করেন। তাঁর দেহান্ত হওয়ার ঘটনাটি অনেকের মনেই প্রশ্ন চিহ্ন রেখে যায়। অনেকে মনে করেন তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।
এই ঘটনা থেকে মনে করা হয়, দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা জাতিভেদ প্রথা ও তার ধারক বাহকরা চৈতন্যের এই মানসিকতাকে মেনে নিতে পারেনি এবং সুযোগ বুঝে তারা তাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছে। এখানে বলার বিষয় হচ্ছে এই দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা কোন জিনিষ, সমাজের পক্ষে সেটা যত কুৎসিত হোক না কেন, তার বিরুদ্ধাচরণ করে সুন্দর বিষয়কে উপস্থাপন করা এত সহজ কাজ নয়। বৎসরের পর বৎসর, যুগের পর যুগ তার জন্য অতিবাহিত হতে পারে। এটা এমন কোনো বিষয় নয় যে, একজনের মনে হল আর ম্যাজিক করে সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হলো।
ফলে, কারও বা কোনো গোষ্ঠীর মত কোন একটা সময়ে কেউ মেনে নিলো না মানেই তার কোন সারবত্তা নেই বা শূন্য, তা বলা যায় না। প্রকৃত অর্থে কোনও নীতি বা আদর্শ বা কাজ শূন্য, এভাবে দেখা সমুচিত নয় বলেই আমার মনে হয়, হতে পারে সেটা সমাজের পক্ষে ভাল বা খারাপ।
সেইজন্য, কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, কোন এক বা একাধিক নির্বাচনে, আসন না পাওয়া মানেই তাদের নীতি বা আদর্শ বা কাজের কোন মূল্য রইল না তা নয়, বরঞ্চ যদি সেটা সমাজের পক্ষে প্রকৃত অর্থে ভাল হয়, তবে অবশ্যই সেটা ফলপ্রসূ হবে। সকলের মিলবে ভয়হীন মুক্ত বিশুদ্ধ বাতাস, মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করতে পারবে চিন্তা-মনন, লেখায় থাকবে না কোনো আড়ষ্ঠতা, সূর্য উদয় এবং রাত্রিযাপন করতে পারবে নির্দ্বিধায়, নিশ্চিন্তে, হাসিমুখে।
যত সহজে কথাগুলো বললাম, কাজটা কিন্তু সহস্রগুণ কঠিন। বহু মানুষের যুগ-যুগ ধরে একাগ্রচিত্তে নিরলস নিঃস্বার্থ পরিশ্রমের ফসল হবে তা এবং পরবর্তীকালে মানব মনে ব্যক্তি স্বার্থের কোন স্থান দেওয়া চলবে না, উত্তরসূরিদের এ বিষয়ে শ্যেনদৃষ্টি রাখতে হবে। যে কথা বলে এই লেখা শেষ করতে চাই :
আমি তখন শূন্য হব,
যখন আমি মনুষ্যত্ব হারিয়ে,
তোমাদের থেকে দূরে চলে যাব।
[লেখক – প্রয়াত প্রণবেশ ভট্টাচার্য ও প্রয়াত আরতি ভট্টাচার্য – র একমাত্র পুত্র ত্রিদিবেশ ভট্টাচার্য ১৯ শে মে ১৯৬৫ সালে নৈহাটিতে জন্ম। পিতার সাহচর্যে বাল্যকাল থেকেই বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল বা আর এস পি – র আদর্শে উদ্বুদ্ধ। ১৯৮১ সাল থেকে কল্যাণী বসবাস। কবিতা ও বিষয় ভিত্তিক রচনা কিছু পত্র পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে।]
Posted in: ARTICLE, May 2021 - Cover Story