এতো তত্ত্ব কেন? – তাপস কুমার দাস

স্বাধীনতার পর এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় কোনো বামপন্থী দলের প্রতিনিধি থাকবেন না। সংসদীয় বামপন্থী রাজনীতিতে এই অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের কারণগুলি বিবিধ ও বহুমাত্রিক। তার পূর্ণ বিশ্লেষণ এই প্রতিবেদনের স্বল্প পরিসরে করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ বিশ্লেষণও আশা করা যায় না, কারণ ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতাদর্শ সেই বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলবে। ফলতঃ, এই বিপর্যয়ের উত্তর খুঁজতে গেলে আত্মমাত্রিকতার কিছু চিহ্ন সেই প্রয়াসে রয়ে যাবে, এটা প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো।

এই বিপর্যয়ের পেছনে সংসদীয় রাজনীতিতে যুক্ত বাম দলগুলির ভূমিকা খুব একটা কম নয়। যেহেতু সিপিআইএম পশ্চিমবঙ্গের সংসদীয় বামপন্থী রাজনীতির প্রধান মুখ (পার্টিকর্মীর সংখ্যার দিক থেকে ধরলে), সেই দায়িত্বের সিংহভাগ তাই তাদের ওপরেই এসে পড়ে। সাম্প্রতিক অতীতে সিপিআইএমের (এবং তার শরিক দলগুলির) একাধিক রাজনৈতিক কার্যকলাপ প্রকৃতই আত্মঘাতী ছিল, যেগুলি সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে, এবং সেই দোলাচলের সুযোগে তাদের ভোট লুটে নিয়ে গেছে শক্তিশালী অবাম রাজনৈতিক দলদুটি। বামপন্থী দলগুলির এই ব্যার্থতার দায় প্রধানতঃ তাদের নেতৃত্বের। বয়োবৃদ্ধ নেতারা পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেননি, ফলে রাজনৈতিক ভাবে দিশাহীন থেকেছেন।

এটা দুর্ভাগ্যজনক যে সিপিআইএমে এবং শরিক বামপন্থী দল গুলিতে এমন কোনো উল্লেখযোগ্য নেতা এই মুহূর্তে নেই যাঁদের বয়েস চল্লিশ বা পঞ্চাশের কোঠায়। মধ্য চল্লিশ থেকে মধ্য পঞ্চাশের নেতারা যে কোনো সংসদীয় রাজনৈতিক দলের প্রকৃত সম্পদ। এই বয়ঃক্রমের মধ্যেই একজন মানুষের রাজনৈতিক পরিপক্কতা, এবং শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা এবং নমনীয়তা যৌথভাবে সর্বোচ্চ মানে পৌঁছয় – এটি বিজ্ঞানসম্মত সত্য। বামদলগুলির অশীতিপর নেতৃত্ব সময়মতো এমন কাউকে তুলে আনতে পারেননি – আনার চেষ্টা করেন নি বলাই ভালো – যাঁরা এই মুহূর্তে ওই বয়ঃক্রমে পড়েন । ২০২১ এর নির্বাচনে একঝাঁক অল্পবয়েসী, শিক্ষিত, পরিশ্রমী এবং উজ্জ্বল কর্মীদের প্রার্থী করেছিল বাম দলগুলি। নবীন প্রজন্ম কে এগিয়ে আনার এই প্রস্তুতি, দুঃখজনকভাবে, সিপিআইএম শুরু করেছিল অনেক দেরিতে। মাত্রই শেষ ছ মাস বা তার সামান্য কিছু বেশি সময়ে প্রোজেক্ট করা হয়েছে এই উজ্জ্বল মুখগুলিকে। এবং অনেকসময়েই এই তরুণদের কার্যকলাপের রাশ রয়ে গেছে আলিমুদ্দিনের অশীতিপর নেতাগোষ্ঠীর হাতেই। ফলতঃ, প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এই উজ্জ্বল নবীনেরা কার্যক্ষেত্রে সেভাবে কিছু করে উঠতে পারেননি – অর্থাৎ ভোট টানতে পারেননি।

সংসদীয় রাজনীতিতে, যে কোনো নির্বাচনে, যে কোনো রাজনৈতিক দলের মুখ্য উদ্দ্যেশ্যই ভোট টানা। ক্ষমতায় আসার প্রধান শর্তই হলো সংখ্যা, মেজরিটি অফ নাম্বারস – সেই সংখ্যাকে প্রভাবিত করতে নবীন মুখগুলি ব্যর্থ হয়েছেন প্রবীণ নেতৃত্বের সময়োপযোগী সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার তৎপরতার অভাবে। এ কথা আমাদের ভুললে চলবে না, যে, যে কোনো রাজনৈতিক দলের দ্বারা যতই প্রচার হোক না কেন – তাঁরা ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করেন না, সাধারণ মানুষের জন্য রাজনীতি করেন – সংসদীয় রাজনীতিতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করা মানেই জেতার জন্যই মরণপণ করা, তত্ব আওড়ানোর জন্য নয়। ফলত বৃহৎ জনসংখ্যার ওপরে প্রভাব বিস্তার করা ছাড়া একটি রাজনৈতিক দলের অন্য কোনো প্রধান লক্ষ্য থাকতে পারেনা। মেজর ফোকাসটি সংখ্যার ওপরেই থাকতে হবে। রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথে ব্যবহারিক রাজনৈতিক কর্মকান্ড এমনভাবে মেলাতে হবে যাতে করে বৃহৎ সংখ্যাকে আকর্ষণ করা যায়। কে ক’পাতা মার্ক্স পড়েছেন বা গ্রামশি – শুধু তা দিয়ে সাধারণ নির্বাচনে উতরানো সম্ভব না ভারতবর্ষের মতো দেশে – সম্ভবত কোনো দেশেই।

মতাদর্শ এবং ব্যবহারিক রাজনীতির ভারসাম্য বজায় রাখার এই খেলায় বামপন্থী দলগুলি এবারে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে সাধারণ মানুষ ভয় পেয়েছে যে আপৎকালে বামদল গুলি তাঁদের পাশে থাকবেনা না। যেখানে দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত দলীয় বিধায়ক এবং কর্মীদের সমর্থনে কালক্ষেপ না করে ধর্নায় বসে যাচ্ছেন বর্তমান শাসক দলের সুপ্রিমো, এবং তাঁর কর্মীরা আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্থ জেনেও দাবি তুলছেন কেন্দ্রীয় সরকার তাদের গ্রেপ্তার করলে তাঁকেও গ্রেপ্তার করতে হবে, সেখানে রোজ যত্রতত্র শাসকের আক্রমণের শিকার হওয়া দলীয় কর্মীদের পাশে দাঁড়িয়ে রাস্তায় নামছেন না আলিমুদ্দিনের নেতারা। বদলে বিভিন্ন তাত্ত্বিক আলোচনা এবং বিবৃতি দেওয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকছে তাঁদের কার্যকলাপ। সাধারণ মানুষ ফলতঃ নিরাপত্তাহীনতার বোধ থেকে এই ভয়ই পেয়েছেন, যে, বিপদে নেতৃত্ব তাঁদের পাশে দাঁড়াতে অক্ষম। ফলস্বরূপ, বামপন্থী দলগুলিকে সমর্থন করতেন এরকম দলে দলে মানুষ বিজেপি কে ভোট দিয়েছেন শুধুমাত্র শাসকদলের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার আশায়।

শাসকগোষ্ঠীর ধামাধরা কিছু তথাকথিত অতিবাম বুধদ্ধিজীবী এবং স্বঘোষিত লিবারেলরা সংসদীয় বামদলগুলির (প্রধানত সিপিআইএমের) সম্পর্কে ব্যাঙ্গার্থে যে রামবাম তত্ত্ব (বামপন্থীরাই তলায় তলায় দায়ী ফাসিস্ত শক্তিকে এই বাংলায় নিয়ে আসার জন্য) খাড়া করেছেন শাসকদলের সুবিধা করে দেওয়ার জন্য – তা যে সম্পূর্ণ উদ্যেশ্যমূলক অনৃতভাষণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এটা না বোঝার কোনো কারণই থাকতে পারেনা, যে, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গঞ্জে প্রত্যন্ত জনবসতি গুলিতে বা শহরের বস্তিতে যাঁরা জীবনযাপন করেন, তাঁরা মনু বনাম মার্ক্স নিয়ে চিন্তিত নন সে অর্থে। তাঁরা শুধু যে সেগুলি বোঝেন না (না বুঝলে সেটা তাঁদের দোষ নয়, তাঁদের বোঝানোর দায়িত্ব যাঁদের ছিল সেই বাম নেতৃবৃন্দের দোষ) তা নয়, তাঁদের যাপনপ্রক্রিয়ায় তা সরাসরি বোঝার প্রয়োজনও পড়ে না। তত্ত্বকথায় পেট ভরে না, পেট ভরাতে লাগে ভাত – যে তত্ত্ব ও রাজনৈতিক কৌশলের সমন্বয় একথালা গরম ভাতের প্রাপ্তি সুগম করে, নিশ্চিত করে নিরাপত্তা – সাধারণ মানুষ সেদিকেই ঝুঁকে পড়েন। এতে করে সাধারণ মানুষকে দোষারোপ করার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই কোনো। আরামকেদারায় বসে তত্ত্ব আওড়ানো ছদ্ম বাম , অতিবাম বা লিবারেল রা বিশেষ উদ্যেশ্যবশতঃ যাই প্রচার করার চেষ্টা করুন না কেন, বামপন্থীরা বিজেপিকে সমর্থন করেছে তৃণমূল কে হারাতে – এই বক্তব্য শুধু হাস্যকর ই না, উদ্যেশ্যপ্রনোদিত ভাবে মিথ্যা। বর্ষীয়ান, কনটেম্পোরারি পলিটিক্স এর পালস বুঝতে অক্ষম বাম নেতৃবৃন্দের ভুলে সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে অল্টারনেটিভ নিরাপত্তার সন্ধান করেছে শাসক দলের দুর্নীতি বা অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে – এটিই সারসত্য। রিকশাওয়ালা, কাজের মাসি, নিজস্ব জমিহীন চাষমজুর – পশ্চিমবঙ্গের এইসব প্রান্তিক মানুষের সাথে কথা বললেই এই তথ্য উঠে আসে যে তাদের প্রতিটি ভোট আক্ষরিক অর্থেই কেনার জন্য বিজেপি এবং তৃণমূল কিভাবে টাকা ছড়িয়েছিলো। সেই টাকা যে সোজা পথে আসেনি, সে টাকা যে তস্করবৃত্তির অর্জন, তা কি আর আলাদা করে বলে দিতে হয়?

বাম নেতৃত্ব এখানে আবারো ভুল করলেন নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা সাধারণ মানুষের ভোট অন্যদিকে চলে যাওয়াতে, সাধারণ মানুষের `বুদ্ধিহীনতার’ প্রতি উষ্মা প্রকাশ করে। সাধারণ মানুষ তাতে আহত হলেন, এবং প্রতিপক্ষ সুযোগ পেয়ে গেলো এই সূত্রে বামপন্থী দলগুলিকে উদ্ধত হিসেবে দেগে দিতে। সাধারণ মানুষ ভুল করেছেন বলার মধ্যে আত্মম্ভরিতা আছে একথা অনস্বীকার্য। এতে করে এমন মেসেজ যায়, যে, বামপন্থী দলগুটির নেতৃত্বের ঠিক করে দেওয়া আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক দিশা ই একমাত্র সত্য। সেই পথনির্দেশ যারা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বিনা প্রশ্নে মেনে চলার আনুগত্য না দেখাবেন, তাঁরাই ভুল, তাঁদের চিন্তাভাবনা অসঙ্গত। অথচ ব্যাপারটা হওয়া উচিত ছিল অন্যরকম। জনগণের চলার দিশা কোন দিকে হওয়া উচিত জনগণের স্বার্থেই, তা যাতে সাধারণ মানুষ প্রকৃত উপলব্ধি করতে পারেন – নেতৃত্বের দায়িত্ব ছিল দিনের পর দিন, ধৈর্য এবং ডেডিকেশনের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া সাধারণ মানুষের সঙ্গে, মানুষের মাঝে সদাসর্বদা থাকা, দিনের পর দিন, রাস্তায় মাঠে ঘটে তাদের নিয়েই পড়ে থাকা যাতে ফাসিস্ত কিংবা দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনৈতিক দলগুলির লোভ দেখানোর এবং অপপ্রচারের হাতছানিতে বিভ্রান্ত না হয়ে পড়েন সাধারণ মানুষ :

..ফিরে যাও মানুষের কাছে। আবার নতুন করে শুরু করো।
ফিরে যাও মানুষের কাছে – তুমি তাকে ছেড়ে গেছো বলে
সে এখন দিশেহারা, যথার্থ শিশুর মতন
যখন যেখানে পারছে পরে নিচ্ছে গেরুয়া বা গান্ধী পোশাক,
সেই সঙ্গে ছিঁড়ে ফেলছে অন্যের স্বপ্ন উদ্যম।
তার হাত ধরো। যে ভাষা সে বোঝে তার সাথে সেই ভাষা বলো। ..

(জয়দেব বসু)

অতীতে তিন দশকেরও বেশি বাম-শাসন থাকার পরও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে চিনতে না পেরে এই ‘ ভুল’ কেন করতে পারেন পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ, সেই উত্তর খোঁজার প্রয়োজন ছিল অনেক আগেই। আর যদি বোধ ও চেতনার সেই স্তরে পৌঁছাতে না পেরেই থাকেন জনগণ এতো বছরেও, সে দায় কাঁধে নেওয়া উচিত ছিল নেতৃত্বের। হাতে ধরে ধরে, প্রতিটি পাড়া, প্রতিটি বাড়ি, প্রতিটি মানুষকে টার্গেট করে করে তাদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা না করে, তাঁদের ঘাড়ে এই ‘ভুলের’ দায় চাপিয়ে দেওয়া সাধারণ মানুষ ভালো চোখে দেখবেন না, এটা বোঝা উচিত ছিল। নেতারা উচ্চ মঞ্চে আসীন, সাধারণ মানুষের মুক্তিদাতা তাঁরাই, তাঁদেরই আনুকূল্যে বা করুণায়ই কেবল, অশিক্ষিত গেঁয়ো ভূতের দল বামপন্থার রাস্তায় হাঁটতে পারবেন। এমন অহংকার নিয়ে – তাঁরাই ত্রাতা – অশিক্ষিত হাটুরেদের মার্ক্সবাবার দেখানো রাস্তায় তরিয়ে দিচ্ছেন তাঁরাই – এও তো একপ্রকার রাজনৈতিক ব্রাহ্মণ্যবাদ। এ কখনো সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের নমুনা হতে পারেনা।

মজার কথা, নেতৃত্বের বাইরেও, সরাসরি পার্টিকর্মী নন এমন তত্ত্ববিলাসী তথাকথিত `প্রোগ্রেসিভ’ এলিটসমাজ, যাঁরা কিনা কথায় কথায় পার্টি নেতৃত্বের সমালোচনা করে থাকেন, তাঁদের ভূমিকাও তথৈবচ। তাঁরা ধরেই নিয়েছেন হরেদরে পাঁচ বছরে একবার তর্জনীতে ইলেকটোরাল ইঙ্ক লাগিয়ে এবং সেই ছাপ লাগানো আঙুলের ছবি সগর্বে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে, তাবৎ রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীদের দুর্নীতি এবং সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক বোধহীনতার সমালোচনা করার পূর্ণ অধিকার তাঁরা পেয়ে গেছেন। হাটে বাজারে চায়ের দোকানে অফিসে সোস্যাল মিডিয়ায়। সাধারণ মানুষের প্রতি আর কোনো কর্তব্য বা দায় তাঁদের নেই। কি অবলীলায় সেইসব এলিটরাও সাধারণ মানুষদের নির্বোধ বলে দেগে দেন নিজেদের পছন্দমতো রাজনৈতিক দলকে (তা সে যে দল ই হোক না কেন) ভোট না দিলে। নিজেদের ‘অসাধারন মানুষ’ ভাবার কতবড় স্পর্ধা এই দ্বিচারী এলিট বোদ্ধাদের। কতটা আত্মদম্ভ থাকলে `সাধারণ মানুষ নির্বোধ’ – এই শব্দবন্ধ অক্লেশে ব্যবহার করা যায় ভেবেও লজ্জিত হতে হয়।

বাম নেতৃত্ব তাঁদের ভিশন এবং ডেডিকেশনের অভাব পূরণ করার চেষ্টা করলেন জনগণের কন্সট্রেইন্ড চয়েসকে ন্যাচারাল চয়েস ভেবে, এবং ক্ষেত্রবিশেষে সেই চয়েসকে মানুষের নির্বুদ্ধিতা বলে ঘোষণা করে। ফলতঃ বামদলগুলির গায়ে ছাপ পড়ে গেলো ঔদ্ধত্যের। অথচ এই ঔদ্ধত্য যদি তাঁরা সময়মতো দেখতে পারতেন, সিঙুরে আইনরক্ষকদের সাহায্যে ছত্রভঙ্গ করে দিতে পারতেন বর্তমান শাসকদলের দুরভিসন্ধিমূলক ছদ্ম আন্দোলনকে, তাহলে পশ্চিমবঙ্গের পলিটিক্যাল ল্যান্ডস্কেপ সম্পূর্ণ অন্যরকম হতো। পেটে দুটো বেশি ভাত পেতো সাধারণ মানুষ।

আন্দোলনকারীদের রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে সরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবে যে সমস্ত প্রোগ্রেসিভ বুদ্ধিজীবীর আঁখি বেদনায় অশ্রুসজল হয়ে আসছে বাম দলগুলির, প্রকারান্তরে সিপিআইএমের নিষ্ঠুরতার কথা ভেবে, যাঁদের বৌদ্ধিক মস্তিষ্কে ঝলসে উঠছে পবিত্র রাগ – তাঁদের সবিনয়ে মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে টেটের রেজাল্ট, প্রাথমিক শিক্ষকের স্থায়ী পদ ইত্যাদি অজস্র বিষয়ে, সঙ্গত দাবিতে আন্দোলন অবস্থাকারীদের সাথে বর্তমান শাসকদলের এবং তাঁদের পোষা আইনরক্ষকের ভূমিকা। স্মরণ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে অনিতা দাসের গর্ভস্থ ভ্রুনটির কথা – যা ফুল হয়ে ফুটে ওঠার আগেই রক্তের আকারে ঝরে পড়ে ২০১৯ সালের দশই মার্চ। স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগের পরীক্ষায় পাশ করেও চাকরি না পাওয়ার অসহায়তায় যখন সাড়ে তিনশো মানুষ ২০১৯ সালের আঠাশে ফেব্রুয়ারী থেকে মেয়ো রোডে অবস্থান অনশনে বসেন এস এস সির ইন্টারভিউর মাধ্যমে নিয়োগের দাবিতে তখন অনশনকারী অনিতা দাশের গর্ভপাত হয়। রানী সোরেন এবং কান্তলাল হেমব্রম ছিলেন অনশনকারীদের মধ্যে, তাঁদের এক বছর তিন মাসের সন্তান কে নিয়ে। সেই শিশুটিও অসুস্থ হয়ে পড়ে। চুয়াল্লিশ জনকে হাসপাতালে ভর্তি ভরতে হয় অনশনরত অবস্থায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে।

পরিবর্তনের মত্ত দাপটে মুগ্ধ বিশিষ্টজনেরা ছিলেন নির্বিকার। কিছু কিছু বিদগ্ধজন, অবস্থানের জায়গাটিতে গিয়ে সেলফি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় তা আপলোড করেছিলেন বটে। কোনো প্রথম সারির সংবাদপত্র এই নিয়ে খবর করেনি:

ফুল ফোটার ছিলো। অথচ একদলা রক্ত হয়ে
মেয়ো রোডে ঝরে গেছে স্তম্ভিত শিশুভ্রুণ –
অন্ধকার ফুলগাছ। পরীক্ষায় পাশ দিয়েও তবু নুন
ও পান্তা আনার চাকরির দাবীতে পক্ষকাল দৃপ্ত রয়ে
অনশনে নেবেছিলো। রানী সোরেন ও আছে,
কান্তলাল হেমব্রম, এক সাল তিন মাসের অঙ্কন সাথে।
দু-মাসের অন্তঃসত্বা মুষ্টিবদ্ধ ভাতের দাবীতে
ফুল ছিঁড়ে পড়ে গেলো শেষে, মা’ও আজ বাঁচে কী না-বাঁচে
এ শহর চুপ তাতে, কবি ও শিল্পীর দল
মত্ত পলাশের রঙে, বসন্ত এসে গেছে – মেয়ো রোডে রক্তের দাগে
কার কী’ বা আসে যায়। কোনো অস্ত্র নেই হাতে, থুতুই সম্বল
আমার, আমারই স্বার্থপর মুখে দিবারাত্র ছেটাই নপুংসক মাধবিত্ত রাগে।

(অপরজন পত্রিকা, মার্চ, ২০১৯ সংখ্যা)

গত দশ বছরে আইনরক্ষকদের ব্যবহার করার এমন নানা ইতিহাস এই রাজ্যবাসী দেখে এসেছেন। সাধারণ মানুষ ভয়ে চুপ থেকেছেন সব দেখেও। রাজনৈতিক উচ্ছিষ্টভোগী কিছু তথাকথিত অতিবাম গোষ্ঠী, বিশিষ্টজন এবং লিবারেল রা চুপ থেকেছেন ভবিষ্যতে তাঁদের আনুগত্যের পুরস্কার পাওয়ার আশায়। সংসদীয় বামপন্থী দলগুলির নেতৃত্বের এমনই হতদরিদ্র রাজনৈতিক অবস্থান হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যে, তাঁরা পথে নেবে প্রতিবাদ টুকুও করে উঠতে পারেন নি এই সমস্ত ঘটনার। লেসারদের ইভিলত্ব এভাবেই ক্রমশঃ আরো গেড়ে বসেছে এই রাজ্যে।

তাই আজ `মানুষ ভুল করেছে’ বলে দায় এড়িয়ে গিয়ে উদ্ধত হিসেবে পরিগণিত হওয়ার বদলে সিঙুরে যদি প্রকৃত উদ্ধত হয়েই থামিয়ে দেওয়া যেত ছদ্ম কৃষকদরদী `আন্দোলন’, কারখানা গড়ে উঠলে ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা হতো বহু মানুষের। সাধারণ মানুষ দলে দলে ফিরে আসতেন বামপন্থী দলগুলির দিকেই – কারণ এ কথা কে না জানে তত্ত্ব নয়, ভাত ই সব – এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির ধারা হয়তো আজ সম্পূর্ণ উল্টোখাতে বইতো। মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারতো না কোনো গ্রেটার ইভিল। একথা কোনোভাবেই ভুললে চলবে না, যে, এই রাজ্যে গ্রেটার ইভিলের যাবতীয় রমরমা লেসার ইভিলের শাসনকালেই। আশিটি আসন নিয়ে বিধানসভায় একমাত্র বিরোধী দল হয়ে বসছে একটি আদ্যন্ত ফাসিস্ত রাজনৈতিক শক্তি – বাম আমলে অতিবড়ো দুঃস্বপ্নেও সেটা ভাবা যায়নি। এবং এই গ্রেটার ইভিলের এক্টিভ ম্যানপাওয়ারের যোগানদার ও যে লেসার ইভিল ই – বর্তমান বিধানসভা নির্বাচনের আগে দলবদলের বাজারে সেই তথ্য তো জলের মতোই পরিষ্কার।

তারই প্রতিফলন ঘটেছে নন্দীগ্রাম বিধানসভার ফলাফলেও। যে নন্দীগ্রামকে (সিঙুর এবং নেতাইয়ের সাথে) মূলধন করে বর্তমান শাসকদলের ক্ষমতায় উঠে আসা, ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনে সেই নন্দীগ্রামেই স্বয়ং শাসকদলের সুপ্রিমোর, তাঁর একদা নয়নের মণি শ্রী অধিকারীর হাতে ল্যাজে গোবরে অবস্থা দেখেই বোঝা যায় এই বাংলায় গ্রেটার ইভিলের যাবতীয় রমরমা লেসার ইভিলের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের দৌলতেই, কারণ `সিপিআইয়েমের নিষ্ঠুর অত্যাচারের বিরুদ্ধে একজোট হওয়া কৃষকদের শক্তি’ নয় – নন্দীগ্রামে নির্বাচন হয়েছে সম্পূর্ণ মেরুকরণের ভিত্তিতে। এবং নন্দীগ্রামে গুলি চলার প্রসঙ্গে – আসলে কি ঘটেছিলো, নির্বাচনপূর্ব ব্যানার্জি-অধিকারী তরজায় তা আজ সারা দেশের যুক্তিবাদী মানুষের কাছেই পরিষ্কার ।

বাম আমলে কৃষি ও শিল্পের বিরোধের প্রশ্নে, বামপন্থীরা কি ভাবে পুঁজিপতিদের সাথে জোট বাঁধতে পারে আদর্শবিচ্যুত হয়ে – এই বেদনায় হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন যে সকল বিশিষ্টজন, বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানিতে কর্মরত বুদ্ধিজীবী ও প্রোগ্রেসিভ লিবারেল রা (বহুজাতিক কোম্পানি কাদের পুঁজিতে চলে তা একজন স্কুলপড়ুয়াও জানে আজকাল), এবং মার্কিন দেশে `কলকাতার জন্য মন কাঁদলেও বাধ্য হয়ে পড়ে থাকা’ ডলার কামানো প্রোগ্রেসিভ অভিবাসীগণ, যাঁরা দিনান্তে একবার সর্বহারাদের জন্য অশ্রুপাত না করলে পাচনক্রিয়ায় সমস্যা বোধ করতেন – তাঁরা সিঙুর এপিসোডের আগে ও পরে সেখানকার কৃষকদের অন্নসংস্থানের জন্য কি ব্যবস্থা করে উঠতে পেরেছিলেন সেই প্রশ্ন আজ বিনীতভাবে রাখা যেতেই পারে। তত্ত্বের ধোঁয়ায় ভাতের গন্ধ থাকে কিনা তা সিঙুরের মানুষ ই সবথেকে ভালো বলতে পারবেন – বলছেন ও এখন, প্রায়শই, মুখ খুলে। কারণ তাঁরা বুঝে গেছেন তাঁদের এখন, অপরিশীলিত গ্রাম্য ভাষায় যাকে বলে – `আম ও গেলো ছালাও গেলো’ – দশা।

সাম্প্রতিক অতীতে বাম নেতৃত্বের এখানেই ব্যর্থতা, যে, না তাঁরা সময়মতো দৃঢ়ভাবে `ঔদ্ধত্য’ দেখাতে পেরেছেন, না বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিরাপত্তাহীন জনগণের প্রকৃত অবস্থান বুঝতে পেরে তাঁদের নিজেদের দিকে টানতে পেরেছেন বিনীত হয়ে, বা বিপদে তাঁদের পাশে আলিমুদ্দিন রাস্তায় নামবে, এই ভরসা নিশ্চিত করতে পেরেছেন। তার বদলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে জনগণের `নির্বুদ্ধিতার’ সমালোচনা করে যেচে ঔদ্ধত্যের তকমা লাগিয়েছেন নিজেদেরই গায়ে। ফলস্বরূপ শেষবেলায় মীনাক্ষী ঐশী দীপশিতা পৃথা শুভম সায়নদীপ শতরূপদের মরণপণ লড়াই পারতপক্ষে কাজে এলো না কোনো।

এই ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ, আগেই বলা হয়েছে, জনগণের পাশে থেকে তাকে বোঝাতে না পারা। দীর্ঘদিন ক্ষমতা ভোগ করলে আত্মতুষ্টি আসে। নিজেদের সম্পর্কে এমন ধারণা হয়, যে, নেতৃত্ব যা করছেন, যা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তা’ই সঠিক – জনগণের কাজ সেই সিদ্ধান্তকে এন্ডোর্স করা মাত্র। নেতৃত্ব ভুলে যান পার্টির কোনো কোনো সিদ্ধান্তে জনগণ বিভ্রান্ত হতে পারে। কিংবা, তাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করতে পারে প্রতিক্রিয়াশীল বিরুদ্ধশক্তি। ফলতঃ প্রতিটি সিদ্ধান্ত কার্যকর করার আগে সেই নিয়ে ব্যাপক প্রচার এবং সেই সিদ্ধান্ত কেন যথাযথ (যদি তা প্রকৃতই সময়োপযোগী এবং যথাযথ হয়) তা বোঝানোর জন্য ব্যাপক জনসংযোগের প্রয়োজন আছে। নেতৃত্ব তা করেননি বহুক্ষেত্রেই। কেন কংগ্রেসের সাথে জোট – সেই নিয়ে দীর্ঘ ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি – যার প্রয়োজন ছিল। সাধারণ মানুষের স্মরণে উঠে আসতেই পারে সত্তরের দশকে বাম দলগুলির সাথে তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের নিপীড়নমূলক কার্যকলাপের স্মৃতি। পাড়ায় পাড়ায় এখনো যে শহীদবেদীগুলি টিকে রয়েছে সত্তরের দশকের শহীদদের স্মরণে, বাম-কংগ্রেস জোটকে সেই শহীদবেদীর প্রতি অপমান বলে ভেবে আহত হয়েছেন অনেক মানুষ। আপাতদৃষ্টিতে সেই ভাবনা সঙ্গত। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কোন রাজনৈতিক শক্তিকে আটকানোর জন্য কোন ধরণের রাজনৈতিক জোটের সার্থকতা আছে তা বোঝানোর প্রয়োজন ছিল নেতৃত্বের। বোঝানোর প্রয়োজন ছিল সত্তরের দশকে কংগ্রেস চালাতেন যাঁরা যে রাজনৈতিক দর্শন থেকে, বর্তমান কংগ্রেসের নবীন প্রজন্মের রাজনৈতিক দর্শন তার থেকে আলাদা হতেই পারে। এবং রাজনৈতিক দর্শনের সেই পার্থক্যর ওপরে ভিত্তি করে জোট তৈরি করলে তা সত্তরের শহীদদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হয় না। তাই যদি হতো তাহলে ঈশপের গল্পের সেই ধূর্ত নেকড়ের যুক্তিকেই শেষ কথা বলে মেনে নিতে হয় – মেষশাবক জল ঘোলা করেনি তো কি হয়েছে, তার বাবা নিশ্চয়ই করেছিল!

সাধারণ মানুষকে এভাবে বোঝানো হয়নি। এটাও বোঝানো হয়নি যে কংগ্রেসের সাথে জোট বাঁধায় বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে যদি বামপক্ষের মানুষ ভোট দেন তৃণমূল কে, তাহলে তাঁরাও সেই এক ই ভাবে বিশ্বাস-হন্তারক হলেন, কারণ বর্তমান তৃণমূল নেতৃত্ব সত্তরের দশকে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের হাত ধরে বাম কর্মী নিধনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল।

মানুষকে এগুলো বোঝানো দরকার ছিলো। পথে নেবে, বাড়ি বাড়ি ঘুরে, একদম ম্যান টু ম্যান ইন্টারাকশনের মাধ্যমে। তা না করায়, একদিকে যেমন নিরাপত্তাহীনতার জন্য বাম ভোটব্যাঙ্কের অনেকটাই চলে গেলো বিজেপির দিকে, অপরদিকে গ্রেটার ইভিল – লেসার ইভিল ডাইকোটমির ধূর্ত চক্করে, আর নো ভোট টু বিজেপির নৈকতলীয় স্লোগানে সাধারণ মানুষকে আরো বেশি বিভ্রান্ত করে এবং ভয় পাইয়ে বর্তমান শাসকদলের ভোট ব্যাংক বাড়িয়ে দেওয়ার খেলায় জিতে গেলেন শাসকদলের রাজনৈতিক উচ্ছিষ্ঠভোগী কিছু তথাকথিত অতিবাম এবং স্বঘোষিত লিবারেলরা।

এ বিষয়ে যদিও বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই যে একটি সর্বভারতীয় ফাসিস্ত দল একটি আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্থ (রাজ্যভিত্তিক) স্থানীয় রাজনৈতিক দলের থেকে বহুগুন বেশি বিপজ্জনক, কিন্তু এই fuzzily directed নো ভোট টু বিজেপি স্লোগান প্রকারান্তরে পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে প্রথম একটি ফাসিস্ত দলকে বিরোধী দলের গুরুত্ব পেতে সুবিধা করে দিলো। স্লোগানটি নতুন ধরণের – ভারতীয় রাজনীতিতে সম্ভবতঃ এই প্রথম কাকে ভোট দিতে হবে তা নিয়ে না বলে, কাকে ভোট দেওয়া ঠিক হবেনা সেই ব্যাপারে নির্দেশিকা / পরামর্শ দেওয়া হলো। বলার চেষ্টা করা হলো, যে, প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্রে, বিজেপি বিরোধী প্রধান শক্তিকে নির্বাচিত করা সচেতন জনগণের কর্তব্য। সেই প্রস্তাবের মধ্যে প্রধান যে হেত্বাভাস টি রয়ে গেলো তা হলো এই – কোন বিধানসভা কেন্দ্রে সেই মুহূর্তে কোন রাজনৈতিক দল শক্তিশালী তা কি ভাবে আগাম জানা যাবে? সংখ্যার নিরিখে দেখতে গেলে, প্রাক নির্বাচন মুহূর্তে যে কোনো বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপি বিরোধী প্রধান শক্তি হিসেবে কোনো প্রার্থীকে চিহ্নিত করা মানে আগের বিধানসভায় ওই কেন্দ্রে যে রাজনৈতিক দল জিতেছিল তাকেই বেছে নেওয়া। যেহেতু ২০১৬ র বিধানসভায় ২১১ টি আসন পেয়ে ল্যান্ডস্লাইড ভিক্টরি হয়েছিল বর্তমান শাসকদলের, সেহেতু নো ভোট টু বিজেপি স্লোগান মানেই যে পরিষ্কার ভোট টু তৃণমূল কংগ্রেস স্লোগান – সেটা বোঝার জন্য খুব বেশি বুদ্ধিমান হওয়ার দরকার পড়ে না। ফলে যেটা হলো, যে কটি আসন আগের নির্বাচনে জেতা ছিল বামপন্থীদের, সেখানকার বাম মনস্ক ভোটারদেরও বিজেপি আসতে পারে এই ভয় দেখিয়ে তাদের ভোট ঠেলে নিয়ে যাওয়া হলো তৃণমূলের দিকে – অন্তত সেই চেষ্টা করা হলো। যদিও গ্রামে গঞ্জে এই স্লোগানের ছাপ প্রকৃত অর্থে কতটা পড়েছে তা বিশদ সমীক্ষা ছাড়া বলা এখনই মুশকিল, কারণ অতিবাম ও লিবারেলদের প্রভাব প্রধানত সোশ্যাল মিডিয়াতেই। সত্যিকারের মেহনতি জনতা এঁদেরকে পোঁছেননা আদৌ। তত্ত্ব আওড়ানো, সেমিনার করা কিংবা কিছু বৈপ্লবিক সিনেমা নিয়ে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল করা, ইত্যাদি এলিট কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকা ছাড়া এঁদের সামান্যতম রাজনৈতিক মূল্য নেই , সত্তরের দশকের পরে কোনোকালেই ছিল ও না সেভাবে। সাধারণতঃ এঁরা আর্বান সেট আপে পারস্পরিক পৃষ্ঠ কণ্ডূয়ন বা আকচাআকচিতেই বৈপ্লবিক কালাতিপাত করে থাকেন।

সত্তরের দশকের শ্রদ্ধা এবং সমীহ জাগানো (প্রকৃত অর্থেই) নকশাল আন্দোলনের পরে, অতিবাম নামে যে সংসদীয় বা অসংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলি পড়ে আছে রেসিড্যু হিসেবে, খুব সামান্য কিছু উজ্জ্বল ব্যতিক্রম বাদে, তাদের অধিকাংশেরই না আছে কোনো জনসংযোগ, না আছে গ্রাম গঞ্জের প্রকৃত মেহনতি মানুষের সাথে মেলামেশা বা একযোগে রাজনৈতিক আন্দোলন চালানোর অভিজ্ঞতা অথবা রাজনৈতিক যোগ্যতা। এইসব দলের সভ্যরা অধিকাংশই বিভিন্ন নামকরা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী হওয়ার ফলে ভালো লেখাপড়া জানেন, এবং সেই সূত্রে খানিক বলিয়ে কইয়ে, অনেকেই বিভিন্ন সংস্থা বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সম্মানজনক পদে কর্মরত, ফলে এলিট নাগরিক সমাজের থেকে সাময়িক সম্ভ্রম আদায় করে নিতে পারেন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় বিদগদ্ধ কথাবার্তা বলার সুবাদে খানিক ফ্যান ফলোয়ার আছে – ব্যাস এইটুকুই। ভারবর্ষের গ্রাসরুট লেভেল রাজনীতিতে এইসব `বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই’দের ভূমিকা শুধু যে সম্পূর্ণ অকিঞ্চিৎকর তাই নয়, ক্ষেত্রবিশেষে হাস্যকর ও বটে। তাঁদের থাকা না থাকায় তাই, সাধারণ মানুষের সেভাবে কিছু আসে যায়না এ রাজ্যে।

এদেরই মধ্যে একটি দল, অতিবাম রাজনীতিতে কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, এবং তুলনামূলক ভাবে (অতিবাম দলগুলির মধ্যে) বড়ো দল, চূড়ান্ত রাজনৈতিক দ্বিচারিতা এবং অসততার উদাহরণের পরাকাষ্ঠা বিশেষ। সেই দলটি বর্তমান শাসকদলের বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে (তৃণমূল সুপ্রিমো এবং আলোচ্য অতিবাম দলটির সুপ্রিমো পরস্পরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে পরস্পরের পৃষ্ঠকণ্ডূয়ন করেছেন), আবার এক ই সঙ্গে দুটি বিধানসভা কেন্দ্রে বামদলকে আগাম সমর্থন জানিয়েও রেখেছিল যাতে কোনোভাবে সব হিসেবে উল্টে বামেরা ক্ষমতায় এলে বামেদের ক্ষমতার ছিটেফোঁটা দানসামগ্রী হিসেবে পাওয়া যায়। প্রকৃতই লজ্জা পেতে হয় যখন দেখা যায় বামপন্থী (শুধু বাম ই না, অতিবাম) বলে দাবি করা এই দলের সুপ্রিমো সামাজিক মাধ্যমে মিম শেয়ার করছেন যেখানে লালজামা পরা বামপন্থী প্রার্থীর হাস্যকরভাবে উল্টে পড়ে যাওয়ার ছবি রয়েছে। নিজেকে একজন বামপন্থী বলে দাবি করা মানুষের, লাল রঙের এই অপমান করার মধ্যে দিয়ে কী পরিমান রাজনৈতিক এবং চারিত্রিক দৈন্য প্রকাশ পায় তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। আরো একটি তথাকথিত অতিবাম দল, যারা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কোনো এক বিধানসভায় প্রার্থী দিয়েছিলো, তাদের ভিতরেও এই রাজনৈতিক দ্বিচারিতার প্রকট ছাপ দেখা গেছে।

এঁরা, ফলতঃ, সমষ্টিগতভাবেই নেমেছিলেন ক্যানোনিক্যাল বাম দলগুলিকে হারাতে, নো ভোট টু বিজেপি শীর্ষক আকর্ষণীয় স্লোগানের আড়ালে। উদ্দেশ্য একটাই, বর্তমান শাসকদলের থেকে অনুগ্রহ পাওয়া এবং সেই অনুগ্রহ লাভের আশায় শাসকদলের রাজনৈতিক উচ্ছিষ্টভোগী হয়ে থাকা। যদিও সামাজিক মাধ্যমের বাইরে এঁদের অনেকেরই বিন্দুমাত্র পরিচিতি ই নেই, তাও শিক্ষিত সমাজের মানুষদের মধ্যে মেরুকরণ ঘটানোর প্রচেষ্টা তাঁরা আপ্রাণ চালিয়ে গেছেন, এবং অনেকাংশে সফল ও হয়েছে আপাতভাবে। কেউ বর্তমান শাসকদলের বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই সে ফাসিস্ত বিজেপির প্রতি সহানুভূতিশীল, এরকম একটা বাইনারি পোলারাইজেশনের চেষ্টা নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। যাঁরা একই সঙ্গে তৃণমূল বিরোধী এবং বিজেপিবিরোধী, অর্থাৎ কিনা বামদিকে ঝুঁকে রয়েছেন, তাঁদের ভয় দেখিয়ে একঘরে করে দেওয়া গেছে এভাবে লেসার আর গ্রেটারের তত্বের খেলার চাতুরীতে। এ কাজে কিছু অতিবাম এবং লিবারেলরা অনেকটাই সফল হয়েছেন, বাম ভোটব্যাংক ক্ষীণ হয়েছে। একই সাথে বেড়ে গেছে বিজেপির ভোটব্যাংক – ফলে গ্রেটার ইভিলের হাতেই ভবিষ্যতে বাংলার কর্তৃত্ব চলে যাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে – বাম আমলে যা কল্পনাও করা যেতোনা।

সত্তর দশকের কথা আলাদা, কিন্তু বর্তমানে অসংসদীয় অতিবামদলগুলির অধিকাংশরই, এবং তথাকথিত লিবারেল বুদ্ধিজীবীদের একটা বড়ো সুবিধা আছে। জনগণের কাছে তাঁদের কোনো রাজনৈতিক দায় থাকেনা যেহেতু তাঁরা ভোটে দাঁড়ান না। ফলত আজ এইমুহূর্তে একরকম রাজনৈতিক স্টেটমেন্ট দিয়ে কাল সম্পূর্ণ উল্টো কথা বললেও তাঁদের কৈফিয়ত দিতে হয়না জনতার আদালতে। এই সুযোগে তাঁরা রাজনৈতিক দ্বিচারিতা চালিয়ে যান এবং জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করে যাওয়ার কাজটি মসৃন ভাবে করে যেতে পারেন নিজেদের ভেস্টেড ইন্টারেস্ট চরিতার্থ করতে। শুধুমাত্র সিপিআইএমের প্রতি গাত্রদাহ মেটাতে এঁরা চতুরভাবে জনগণের মস্তকধৌতির রাস্তা নিয়েছিলেন জনগণকে বিভ্রান্ত করে। এবারের বিধানসভা নির্বাচনে যার বহু উদাহরণ দেখা গেছে, স্থানাভাবে যার মাত্রই দু একটির বিশদ ব্যাখ্যা উপরের অনুচ্ছেদগুলিতে করা হয়েছে।

বহিঃশত্রুর (ফাসিস্ত বিজেপি এবং দুর্নীতিগ্রস্থ তৃণমূল কংগ্রেস) সরাসরি আক্রমণ, অতিবাম ও লিবারেলদের চক্রান্ত ও দ্বিচারিতা, নেতৃত্বের দূরদর্শিতা এবং নমনীয়তার অভাব – এসবের সাথেই যোগ হয়েছিল বাম দলগুলির নিজেদেরই অন্দরের রাজনৈতিক ব্রাহ্মণ্যবাদ। লেফটিস্ট এলিটিজম, শব্দবন্ধ হিসেবে খানিকটা সোনার পাথরবাটির মতো শোনালেও, দুঃখজনক ভাবে বাস্তব। ইন্টেলেকচুয়াল এলিটিজম দিয়ে, মার্কসিস্ট এলিটিজম দিয়ে, প্রতিক্রিয়াশীল বিরুদ্ধশক্তির হাত শক্ত করে এসেছেন বাম নেতৃত্ব অনেককাল ধরেই। এ দুঃখজনক সত্য অস্বীকার করে লাভ নেই। তাত্ত্বিক এলিটিজমের, বামপন্থী এলিটিজমের অনভিপ্রেত বোঝা ভারতবর্ষকে বহন করে আসতে হয়েছে বহুকাল – নেতৃত্বে এলিটিজম, কর্মপন্থা নির্ধারণে এলিটিজম, এমনকি `বিপ্লবী’ চিহ্নিতকরণে এলিটিজম। সজ্ঞানে এবং অজান্তেও। তাই দেবলীনা হেমব্রমের মতো আগুনঝরানো বক্তাকে ব্রিগেডে তোলা হয় সবার শেষে।

দেবলীনা হতে পারতেন এবারের নির্বাচনে পার্টির মুখ। দেবলীনা মহিলা, দেবলীনা দারিদ্র প্রান্তিক জনতার প্রতিনিধি, দেবলীনা নির্ভীক, সুবক্তা – বামদলগুলি সংযুক্তভাবে তাঁকে প্রজেক্ট করতে পারতো সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে। প্রকৃত সর্বহারার পার্টির প্রতিনিধিত্বকারী আদর্শ সাংবিধানিক প্রধানের যেমন হওয়া উচিত, দেবলীনার মধ্যে তার সবকটি গুণ এবং বৈশিষ্ট্যই রয়েছে। তাঁকে সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে খাড়া করলে, তত্ববিলাসী তথাকথিত অতিবাম বা লিবারেল, যাঁরা রাজনীতিতে পলিটিক্যাল কারেক্টনেস, লিঙ্গসাম্য, সাবল্টার্নের নেতৃত্ব ইত্যাদি নিয়ে গলার শির ফোলান, তাঁদের ও মুখ বন্ধ করে দেওয়া যেত। দেবলীনাকে সংযুক্ত বামদলগুলির মুখ হিসেবে তুলে ধরলে অনেকাংশেই রাজনৈতিক লাভ হতো, শুধু সিপিআইএমের ই নয়, সম্পূর্ণ সংযুক্ত মোর্চার ই। বাকি অনেক কিছুরই মতো, হায়, আলিমুদ্দিনের অশীতিপর নেতৃবৃন্দ, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির অভাবে সে সুযোগ হেলায় হারালেন।

শূন্য আসন পাওয়ার এ বিপর্যয় এমনি এমনি ঘটেনি।

দু হাজার একুশের বিধানসভা নির্বাচন কি তাহলে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী আন্দোলনের অবসান ঘটালো?

..রাজছত্র ভেঙে পড়ে
রণডঙ্কা শব্দ নাহি তোলে
জয়স্তম্ভ মূঢ়সম অর্থ তার ভোলে
রক্তমাখা অস্ত্র হাতে যত রক্তআঁখি
শিশুপাঠ্য কাহিনীতে থাকে মুখ ঢাকি
.. শত শত সাম্রাজ্যর ভগ্নশেষ পরে
ওরা কাজ করে l..

(ওরা কাজ করে – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

মানবসভ্যতার অনাদি অতীত থেকে `ওদের’ কাজের খতিয়ান এবং মর্যাদা দিতে পারে একমাত্র বামপন্থাই। বামপন্থার তাই মৃত্যু নেই। বামপন্থীদেরও না। সিপিআইএম (বা সিপিআই, কিংবা ফরোয়ার্ড ব্লক অথবা আরএসপি) একটি সংসদীয় রাজনীতিতে আস্থাশীল, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করা রাজনৈতিক দলমাত্র, যেখানে কিছু বামপন্থী মনোভাবাপন্ন মানুষ একদা একত্রিত হয়েছিলেন সমাজ বদলের স্বপ্নে। বহুবছর ক্ষমতায় থাকার ফলে হয়তো সেই দলের অভ্যন্তরে ঘুন ধরেছিলো, অসংবেদনশীল নেতৃত্ব দূরদর্শিতার এভাবে প্রতিক্রিয়াশীল বিরুদ্ধশক্তিকে, তা সে ফাসিস্ত ই হোক বা জনগণের দুর্দশা বয়ে আনা সম্পূর্ণ দুর্নীতিগ্রস্থ দল, পরাজিত করে বাম ও গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার পথে সফলভাবে এগোতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলস্বরূপ বাংলার সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছেন , নিরাপত্তার অভাব বোধ করেছেন এবং সাময়িকভাবে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন বাম দলগুলির দিক থেকে। এই নির্বাচনে তাই বামদল গুলি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় বামপন্থার মৃত্যু হয়েছে বা প্রকৃত বামমনস্ক মানুষরা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছেন।

দল হিসেবে সিপিআইএম অথবা তার সঙ্গী বামদলগুলি মিলিতভাবে শূন্য আসন পেলেও তাই বামপন্থী আন্দোলন শেষ হয়ে যায় না। আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে অবশ্যই, বাধা বেড়ে যায়, কিন্তু আন্দোলন শেষ হয়ে যায় না। আর কে না জানে বাধার মুখে, শূন্য আসন পেয়েও, টিকে থাকাই প্রকৃত সংগ্রাম। সেই সংগ্রামের মহত্ব জনসমক্ষে হয়তো এইমুহূর্তে প্রজেক্টেড হবে না, কিন্তু এই শূন্য থেকে শুরু করে সংগ্রামের উদ্দীপনা ধরে রাখাই তো আসল বীরত্ব :

..যখন ফুল ঝরে যাওয়ার কথা
তারপরেও সারারাত একটা ফুল
একটা হাল ছেড়ে দেওয়া হতাশ গাছের
সামান্য বোঁটায়
হিমে ভরা বারো ঘন্টা টিকে রইলো।
এই সামান্য ফুলটিকে
বীরচক্র বা পরমবীরচক্র কিছুই দেয়া হয়নি,
হবে না।
কারণ,
একটি হিমেভরা রাত একা একা
হাল ছেড়ে দেওয়া গাছের ডালে
টিকে থাকতে যে সাহস লাগে,
সেই সাহস সকলে বুঝতে পারে না,
সকলের বোধগম্য নয়।..

(সেই সাহস – তারাপদ রায়)

সিপিআইএম বা তার শরিক দলগুলি শেষমেশ এই ফর্মে টিকে থাকবে কিনা, তা ভবিষ্যৎ বলবে। কিন্তু যে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই, তা হলো, বামপন্থার মৃত্যু নেই, তাই বিনাশ নেই বামপন্থীদের ও। বর্তমান বামদলগুলির ভবিষ্যৎ কি তা এই মুহূর্তে পরিষ্কার করে বলতে পারা না গেলেও তাই নির্দ্বিধায় এ কথা বলাই যায় বামপন্থী রাজনৈতিক দল রয়ে যাবে, তা বর্তমান দলগুলির আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে টিকে থেকে পুনরায় শক্তি অর্জনের মাধ্যমেই হোক অথবা নতুন ভাবে উঠে আসা কোনো দলের সাফল্য এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতার মাধ্যমেই হোক। এ প্রসঙ্গে এটাও উল্লেখ করা জরুরি, যে, এখন বিভেদ ভুলে সমস্ত বামদলগুলির একত্রিত হওয়ার প্রয়োজন। বর্তমান বাম এবং অতিবাম রাজনৈতিক দলগুলির অবিলম্বে কাছাকাছি আসার প্রয়োজন একটি কমন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে।

ফাসিস্ত শক্তিকে মোকাবিলা করা কোনো দুর্নীতিগ্রস্থ আঞ্চলিক দলের কাজ না। তৃণমূল কংগ্রেসের কোনো পলিটিক্যাল ম্যান্ডেট নেই – শুধুমাত্র আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করতে কিছু মানুষ তৃণমূল সুপ্রিমোর ছাতার তলায় জড়ো হয়েছেন দল গঠন করতে। এভাবে যে রাজনৈতিক দল গঠিত হয়, তার সদস্য এবং কর্মকর্তাদের বিপথগামী করে দেওয়া খুব সহজ কারণ তাঁরা কোনো কমন আদর্শের জন্য রাজনীতি করেন না। ফলে ফাসিস্ত বিজেপির পক্ষে বিভিন্ন লোভ দেখিয়ে বর্তমান শাসক দলের উচ্চ পদাধিকারীদের নিজের দিকে টেনে নেওয়া শক্ত কাজ কিছু নয়। মুকুল রায় থেকে শুধু করে বর্তমানের শুভেন্দু অধিকারী তার হাতে নাতে প্রমান।

লেসার ইভিলের পক্ষে অতএব, কোনোমতেই সম্ভব না দীর্ঘমেয়াদি স্তরে গ্রেটার ইভিল কে ঠেকিয়ে রাখা, বরং লেসার ইভিল থেকেই ম্যানপাওয়ার সংগ্রহ করে শক্তিশালী হয়েছে এবং হবে গ্রেটার ইভিল। বিখ্যাত রাজনৈতিক পত্রিকা কাউন্টার পাঞ্চ এর ২৬ শে বক্তব্যের (২০২০) সংখ্যায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আমেরিক্যান ট্রেড ইউনিয়ন নেতা এবং এনভায়রনমেন্টাল এক্টিভিস্ট হাওয়ার্ড গ্রীশ্যাম হকিন্স তাঁর Whatever happened to left solidarity? শীর্ষক প্রতিবেদনে লিখছেন :

Reliance on the lesser evil has historically led to greater evils. In the classic case, instead of running their own candidate for German president on 1932, the largest party, the Social Democrats, supported the conservative Paul von Hindenberg as the lesser evil to Hitler. Von Hindenberg won and appointed Hitler to the Chancellorship. The Communists ran their own candidate in the most sectarian way imaginable, saying the Social Democrats were the “social-fascist main enemy” and “after Hitler it’s our turn.” That was a case where left solidarity against the fascist threat instead of relying on conservatives to stop the fascists. Had the socialists and communists formed a left united front, they would have easily outpolled the rightwing parties.

এবং বলছেন :

They have abandoned the idea that the best way for the left to fight the right is to build and fight with its own independent strength, advancing its own program under its own banner against two-capitalist-party system of corporate rule.

ফাসিস্ত বিজেপি কে ঠেকানোর এক এবং একমাত্র রাস্তা সুতরাং বামপন্থী আন্দোলন। বামমনস্ক শক্তিগুলিকে অতএব যে কোনো মূল্যে একত্রিত হতেই হবে দেশ ও সমাজকে বাঁচাতে। বিভিন্ন বামপন্থী ফ্যাকশনের এই যে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষনা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তাত্বিক পার্থক্যের চর্বিতচর্বনের ভিত্তিতে – তা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া প্রয়োজন, এতে চূড়ান্ত ক্ষতি হচ্ছে সার্বিক বামপন্থী আন্দোলনের। `তত্ত্ব নয়, ভাত চাই’ – এটাই হোক আগামীর স্লোগান – এই স্লোগানের মধ্যে দিয়েই সংঘবদ্ধ হোক যাবতীয় বামমনস্ক মানুষ। বীরেনবাবু কি কবেই বলে যাননি :

..হোক পোড়া বাসি ভ্যাজাল মেশানো রুটি
তবু তো জঠরে, বহ্নি নেবানো খাঁটি
এ এক মন্ত্র ! রুটি দাও, রুটি দাও ;
বদলে বন্ধু যা ইচ্ছে নিয়ে যাও :
সমরখণ্ড বা বোখারা তুচ্ছ কথা
হেসে দিতে পারি স্বদেশেরও স্বাধীনতা ।

শুধু দুই বেলা দু’টুকড়ো পোড়া রুটি
পাই যদি তবে সূর্যেরও আগে উঠি,
ঝড়ো সাগরের ঝুটি ধরে দিই নাড়া
উপড়িয়ে আনি কারাকোরামের চূড়া :
হৃদয় বিষাদ চেতনা তুচ্ছ গণি
রুটি পেলে দিই প্রিয়ার চোখের মণি ।

(রুটি দাও – বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)

হে বিদগ্ধ বাম, অতিবাম, প্রোগ্রেসিভ, লিবারেল তাত্ত্বিক ও নেতাগণ, আপনাদের তত্ত্বের ধোঁয়ায় গরম ভাতের গন্ধ আছে?

[লেখক – লেখক ভারত সরকারের পারমাণবিক শক্তি দপ্তরে কর্মরত মহাকাশবিজ্ঞানের অধ্যাপক। বিভিন্ন সামাজিক, আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক বিষয়ে লেখালেখি করে থাকেন। কবিতাও লেখেন, তাপসের একটি প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ আছে।]

Facebook Comments

2 thoughts on “এতো তত্ত্ব কেন? – তাপস কুমার দাস Leave a comment

  1. I largely agree with your analysis and the conclusion you have arrived at. However, the crux of the matter is: Who is to bell the cat? The Left in Bengal today, whether Parliamentary Left or Ultra Left, is pitifully weak in both imagination and action.
    Ramkrishna Bhattacharya.

  2. ধন্যবাদ 🙂 আমি বিস্তারিত উত্তর দিচ্ছি শীঘ্রই

Leave a Reply