কাশবনের ভাষ্কর্য : শুভংকর গুহ

[“নিজের কিছু কথা ভোরের পাখির মতো সত্য হয়, এই পড়ে পাওয়া জীবনে অস্বীকার করি কি করে? নিজের স্মৃতিকথার সাথে এক ঝাঁক ছাতারে উড়ে আসার দৃশ্যকে মেলাতে গিয়ে দেখি, সবটাই বাতাসে উড়ে যাওয়া খইয়ের মতো লুটোচ্ছে বসতখানার উঠোন জুড়ে। কিছু কথা তুলে নিলে অনেক কথাই আবার যেন থেকে যায়, বাকি শুধু কল্পনা কৃষিজমি কর্ষণের মতো এক অভ্যাস, আত্মকথাকে ক্রমশ উর্বর করে তোলে।”- কথাসাহিত্যিক শুভংকর গুহের আত্মকথা ‘কাশবনের ভাষ্কর্য’। বাবার কর্মসূত্রে পানাগড়, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, মথুরা, কানপুর, এলাহাবাদ সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে বসবাস করেছেন লেখক। সেই যাপনের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি এক সময়ের দলিল নিঃসন্দেহে।]

১০

মথুরা শহরে মাথায় ঝুড়ি চাপিয়ে মাটির কারিগর পুতুল বিক্রি করত। আমদের পরিবারে মাটির পুতুলের প্রতি এক প্রকার আকর্ষণ ছিল। যখন আমরা কলকাতা মানে জলতরঙ্গের শব্দের মতো নিঝুম শহরতলী অঞ্চল থেকে এসে এইখানে, সেখানে আষাঢ় শ্রাবণ মাসে ঝুলন পূর্ণিমার আগের দিনগুলিতে কুমোর বাড়িতে গিয়ে দেখতাম, কতরকমের পুতুল। মাটির পুতুলের বালক ছোটো একটি লাঠির সাহায্যে সাইকেলের টায়ারের ব্যালান্স নিয়ে ছুটে যাচ্ছে। আইসক্রিমওয়ালা ও তার গাড়ি। সার্কাসের জোকার। ফেরিওয়ালা। ফুটবল খেলছে বালক। মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে বসে আছে ময়রা। এই সব পুতুলই ছিল শৈশবের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক একটি ক্লাস রুমের অধ্যায়। বাঙলার মাটির পুতুলের তুলনায় মথুরা শহরের মাটির পুতুলের মধ্যে মাটির মণ্ড, গঠনে আকারে রঙে ও বেশ পার্থক্য ছিল। বাঙলার মাটির পুতুল যেমন শুধুই মাটির, মথুরার মাটির মণ্ডতে একপ্রকার কাগজ ও পিসবোর্ডের কুঁচি মেশানো হত। এর ফলে হাত থেকে পড়ে গেলে, সহজেই ভেঙ্গে যেত না। উত্তরপ্রদেশে মথুরার মাটির পুতুলের বেশ সুখ্যাতি। বিশ্রামঘাটের পূর্বদিকে মাটির পুতুলের কারিগরদের জনপদ। ওখানকার আঞ্চলিক ভাষায় ওদের কুম্ভার বলে। সেখান থেকেই আসত, হরিপ্রসাদ গোয়ালা। সে চমৎকার মাটির পুতুল বানাত। মাসে একবার সে আসত আমাদের কোয়ার্টারে। মাথায় ঝুড়িতে চাপিয়ে, পুতুল নিয়ে আসত। অধিকাংশই গোবিন্দ গোপাল, কালীয়দমন, গাছের ডালে বসে পোংটা কৃষ্ণ, সখীদের বস্ত্র হাতে দিব্য পা ঝুলিয়ে। আবার বালক কৃষ্ণ কংশ বধ করছে। মজা হচ্ছে, মথুরার অধিকাংশ পুতুলই কোনো লীলা বা কাহিনি বহন করে। বাঙলার পুতুলের মতো শুধু মূর্তি নয়।

পরে জেনেছিলাম, মথুরা হল টেল ফেবলের নগর। শহরের মাহাত্ম জানতে হলে, কৃষ্ণ নির্ভর কাহিনির ছোঁয়া থাকবেই। ছোঁয়া থাকবে সুদর্শন চক্রের মতো ধারালো ভক্তি ও বিশ্বাসের। হরিপ্রসাদ গোয়ালার কাছ থেকে মা আমাকে একটি পুতুল কিনে দিলেন। সাদা রঙয়ের বলদের গায়ে বালক কৃষ্ণ বাঁশি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমার বিস্তর কান্নাকাটির কারণে, মায়ের কাছ থেকে পাওয়া উপহারটি নিয়ে আহ্লাদে তছনছ হয়ে গেলাম। মা বকুনি দিয়ে বলতেন,- তুমি পুতুলের অত গন্ধ শোঁক কেন? জুতো, পুতুল, বই সমস্ত কিছুর গন্ধ থেকে এত কি পাও তুমি? মায়ের এই কথার উত্তর আমার জানা ছিল না। মাটির পুতুল থেকে রঙ মাটি ও কাগজের মণ্ডের একপ্রকার চমৎকার গন্ধ আমার বালক জীবনকে মোহিত করে দিল।

গাঙ্গুলি বাড়ি মথুরার বিখ্যাত বাড়ি। গোটা শহরে গাঙ্গুলি বাড়িকে সবাই চিনত। আমাদের পাশেই গাঙ্গুলিদের আসল মহলের মতো বাড়ি। একদিন দেখলাম, সেই বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন, একজন বৃদ্ধা। তিনিই এই গাঙ্গুলি এলাকার মালকিন। তাঁকে আমরা জেঠিমা বলে ডাকতাম। তার পুত্র ছিলেন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী। তিনি কোথাও এক জায়গায় স্থির থাকতেন না। জাতীয়তাবাদী নামী কংগ্রেস কর্মী। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাঁর মহলে অনেকেই আসতেন। মহলের পিছন দিকে ঘোড়াশাল ছিল। আর মহল জুড়ে, বিভিন্ন পাথরের মূর্তির সংগ্রহ। অনেক বিদেশি সাহেবকে দেখতাম তাঁর বাড়িতে এসে পাথরের মূর্তির ছবি তুলতেন। আর ঘোড়াশালের ছবি তুলতেন। সে এক রহস্যময় মহল। বৃদ্ধা জেঠিমা একা একা তাঁর মহলের ক্ষেত্রে পায়চারি করতেন। বহুদূর থেকে তাঁকে দেখতাম। সেই প্রথম জেনেছিলাম প্রতিষ্ঠা খ্যাতি ধনী মানুষও একা একা বাঁচতে জানেন। যখন হাঁটতেন, দেখে মনে হত নিকটের জঙ্গল থেকে তিনি হরিণকে আহ্বান করছেন নিজের দরবারে, আর ময়ূর তাঁর মহল ঘিরে পায়চারি করে বেড়াত। একদিন জেঠিমা আমাদের দুই ভাইকে কাছে ডাকলেন, আর দেখালেন গাছের উঁচু ডালে একটি ময়ূর সাপকে ঠোঁটে ধরে কি ভাবে সংঘর্ষ করছে। ময়ূর সাপ খায় কি না জানার প্রয়োজন না থাকলেও ময়ূর সাপের সংঘর্ষ হল পাখি বনাম সরীসৃপের, যা কি না নানাভাবে প্রতীকী।

শীতকাল এসে গেল। মা বড় বড় কাঁচের বয়ামে, সর্ষের তেলের মধ্যে, কত কিছু দিয়ে রোদে রেখে দিলেন। আর থান কাপড়ের ওপরে চাল সাবু গুঁড়ো করে সেদ্ধ তরল ঘন পানি করে ডাবু হাতা দিয়ে ছড়িয়ে দিতেন। পাঁপড়। আচার। আমি কাঁচের বয়ামের ঘন সর্ষের তেলের মধ্যে খুঁজে বেড়াতাম রোমান সাম্রাজ্যের পাথরের বড় বড় খিলান। তখন মনে হত কাঁচের বয়ামের তেলের মধ্যে যাই কিছুই দেওয়া হোক না কেন, সব কিছুই যেন ভেঙ্গে যাওয়া প্রস্তরের ছবি হয়ে উঠত। এই তো কিছুদিন আগেই পড়লাম একজন শিল্পীর জীবনী যিনি, একটি কাঠের পুল থেকে নিজের প্রেমিকাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে, শান্ত পায়ে ও মাথায় বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন। আমার হাত থেকেও একদিন একটি কাঁচের বয়াম পড়ে গেল। ভীষণ ভীষণ ঘোরতর অপরাধটিকে নিজেই সহজ করে নিয়ে মাকে বলেছিলাম, ছবি দেখছিলাম, তাই হাত থেকে পড়ে গেল। মা আমার কথা শুনে খুব অবাক হয়ে গেলেন। বললেন,- আগুনে রান্না করতে ধৈর্য লাগে না, কিন্তু রোদের মধ্যে আচার তৈরি করতে অনেক অনেক ধৈর্য লাগে। রোদ আগুন নয়। রোদ হচ্ছে, আমাদের সংসারে ধৈর্যের আলো। আচার শুধু আচার নয়, আমাদের সাংসারিক জীবনের “আচার”। উত্তর প্রদেশের শীতকাল মোটেই শ্রদ্ধেয় কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর সুপর্ণা নয়। প্রবীণ বয়স্ক মানুষদের দেখেছি মখমলের লেপ শরীরের ওপরে চাপিয়ে হাঁটা চলা করতে। সে বড় অদ্ভুত। শীতকালে উত্তর প্রদেশের মানুষ যেন তুলোর পোকা হয়ে যায়। সারাদিন এত কুয়াসার পতন, মনে হত দুনিয়া জুড়ে হিম যুগ নেমে এসেছে। বাবা ডিউটিতে যেতেন আর্মির মোটা সোয়েটার চাপিয়ে। আর আমরা এমন কম্বল চাপিয়ে বিছানায় পড়ে থাকতাম, মাথা ঢেকে, যেখান থেকে দিল্লির কুতুব মিনারের কুয়াসায় ঢাকা মাথা দেখতে পেতাম। এত কঠিন ও শরীরে বিঁধে যাওয়া ঠাণ্ডার প্রবাহ শরীরের অভ্যন্তরের রক্ত সঞ্চালনকে স্তব্ধ করে দিত।

উত্তর প্রদেশের শীতকাল যেমন কষ্টের তেমনি গ্রীষ্মকালে গরম হাওয়ার দাপট। শীতকাল ফুরিয়ে এলে রোদের তেজ, আগুনের মতো। বসন্তকালে বিকেলের দিকে মাঝে মধ্যেই আঁধি ধেয়ে আসত। ধুলো বর্বর ও অন্ধকার চারদিক ঢেকে দিত। মোটেই পশ্চিমবঙ্গের কালবৈশাখীর মতো নয়। তার থেকে অনেক অনেক ভয়ংকর। ধুলো ঢাকা অন্ধকার দীর্ঘস্থায়ী। কোনোরকমে শীতকাল পার করে, যখন মা আমাদের গরম পোশাক ও সোয়েটার রোদে ফেলে উষ্ণ মুচমুচে করে তুলছেন, সেই সময়ের বিকেলগুলি অনেকটা সন্ধ্যামালতীর মতো স্নিগ্ধ।

একজন, বিকেলের দিকে উত্তর প্রদেশের ব্রাহ্মণ এলেন কয়েকটি পুস্তিকা নিয়ে। নাম মনে নেই, তবে দীক্ষিত পণ্ডিত বলেই তাঁকে জানতাম। বাবা তাকে গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করতে চাইলেন। একটি সাইকেলে চেপে মথুরা ক্যান্টনমেন্ট এরিয়াতে ফৌজি পরিবারের সন্তানদের শিক্ষা দিতেন। মনে আছে, তিনিই বলেছিলেন, ভারতবর্ষের সবথেকে গভীর বনাঞ্চল অতিক্রম করে, একমাত্র নদী প্রবাহিত যার নাম যমুনা। যমুনা নদীর সহচর কচ্ছপ। সেই তিনিই আমাকে প্রথম কবিতা পড়তে দিয়েছিলেন। সুমিত্রানন্দন পন্থ ও মৈথিলী শরণ গুপ্তা ও বেশ কয়েকজনের কবিতা। ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় কবিদের মধ্যে অন্যতম সুমিত্রানন্দন পন্থ জ্ঞানপীঠ পুরস্কারে সম্মানিত। হিন্দি সাহিত্যে রামচন্দ্র শুক্লা যিনি আচার্য শুক্লা নামে খ্যাত, তাঁর রচনাও ছাত্র ছাত্রীদের পাঠ্য ছিল। সুমিত্রানন্দন পন্থের একটি কবিতা এই অন্ধকার সময়ে খুবই প্রাসঙ্গিক,- কালে বাদল জাতি দ্বেষ কে, কালে বাদল বিশ্ব ক্লেশ কে, কালে বাদল উঠতে পথ পর, নব স্বতন্ত্রতা কে প্রবেশ কে ! শুনতা আয়া হুঁ, হ্যাঁয় দেখা, কালে বাদল মেঁ হঁসতি চাঁদি কি রেখা… উত্তর প্রদেশে অনেক বছর থাকার কারণে হিন্দি সাহিত্যের প্রতি আমার আকর্ষণ গভীর ছিল। তবে মুন্সি প্রেমচন্দের মতো একজন কথাকারকে একটি রাষ্ট্র খুবই ভাগ্য করে অর্জন করে। মুন্সি প্রেমচন্দ শুধু ভারতবর্ষের নয় একটি মহাদেশের লেখক যার নাম এশিয়া। গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে ধর্মের নামে ও উন্নয়নের ধোঁকাবাজির নামে যে স্বৈরশাসন চলছে, সেই প্রসঙ্গে মুন্সি প্রেমচন্দের “দুই বলদের কাহিনি” খুব খুব প্রাসঙ্গিক। লেখক যুগ যুগ ধরে কাজ করে যান, সময়ের স্রোতে চিরন্তন হয়ে থেকে যান।

শীতকালের পরে খুব দ্রুত জানালা অতিক্রম করে, প্রবেশ করল বসন্তকাল। আমাদের বাড়ির নানা ঘুপচি গলিতে ও ঘরগুলিতে, আলো বাতাসের আবহ সঙ্গীতে ভরে উঠল। কান পাতলে যমুনা নদীর জলের খল খল শব্দ শুনতে পেতাম। মথুরার মন্দিরগুলি থেকে ঘণ্টার ও জয়ঢাকের ধ্বনি, ভেসে আসত। প্রশস্ত লাল পাথেরের বারান্দার মধ্যে ময়ূর এসে ঘরের চৌকাঠে উঁকি দিত। যখন আসত একসাথে জোড়া, আমরা গম চাল ঘরে মজুত করা সামান্য ফলাদি দিয়ে অভ্যর্থনা করতাম। আমাদের অভ্যর্থনা গ্রহণ করার পরে, ময়ূর তার সৌন্দর্যের সৌজন্য পাথরের ওপরে রেখে দিয়ে সামনেই একটি প্রাচীন নিমগাছের ডালে উড়ে গিয়ে বসত। তারপরে সেই কি বিষণ্ণ কোউউউ কোউউউ…আশেপাশের দূরে অন্য কোথা থেকে উত্তর আসত কোউউউ কোউউউ…..ময়ূরের ডাক বা আহ্বানের মধ্যে অনেকেই কুৎসিত শব্দের বিন্যাস খুঁজে পেলেও আমি কিন্তু খুঁজে পেতাম বহুদূরে কুয়াসা ঘেরা রেল স্টেশনের হুইসেলের শব্দের বিষণ্ণতা। পাখির ডাক জীবনের অনেক কল্পনা বা সত্যকে মিলিয়ে দেয়।

সকালের দিকে ধুলো বিনাশের জন্য কয়েক পশলা হয়ে গেল যেন। সাইকেলে চেপে কাঠের বাক্সে মাছ নিয়ে এলো মেছুয়া। মুখে দোক্তা পাতার সঙ্গে পান। মা বেরিয়ে এসে বললেন,- কালিবাউস আছে? মেছুয়া বলল, আড় আছে। যমুনার আড় খুব সুস্বাদু হয়। আপনার জন্য এনেছি। মা মাছের বাক্সে উঁকি দিয়ে বললেন, কই দেখি?
মা মাছ দেখার পরে, বললেন, মাছের পাশে কীসের মাংস?

মেছুয়া যতটা সম্ভব ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,- হরিণের মাংস। আপনাদের জন্যই লুকিয়ে এনেছি।

মা মেছুয়াকে সাবধান করে দিয়ে বললেন,- কোয়ার্টারের ভিতরে হরিণ এবং কচ্ছপের মাংস খাওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ আছে। পরিবার নিয়ে থাকি, কেউ জানতে পারলে বিপদ হয়ে যাবে। তোমার বাবুজি আমাকে সাবধান করে দিয়েছে, হরিণ এবং কচ্ছপের মাংস এখানে খাওয়া চলবে না। তুমি তাড়াতাড়ি চলে যাও। আড় মাছ আমি নেব, সেটাই দাও।

আমার খুব ইচ্ছে হয়েছিল, হরিণের মাংস কোনোদিন খাইনি। একবার যদি জিভে স্বাদ পেতাম। আমার এই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়েছিল অনেক বছর পরে।

জীবনের অনেক সত্যকে স্বীকার করতেই হয়। আত্মকথায় কনফেসের একটি বড় ভূমিকাকে আড়াল করলে, নিজের অনুশোচনা মোচন হয়না। হরিণের ও কচ্ছপের মাংস ভক্ষণের অনেক বছর পরে, ভারতীয় আইনসভায় সম্ভবত ১৯৮০ সালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন পাস হয়ে গেল।

দুপুর গড়িয়ে যেতেই মাকে দেখলাম আমাদের বাইরে বেরুনোর পোশাকগুলিকে তোরঙ্গ থেকে বার করে নিজের বিছানার এক পাশে রাখছেন।

আমি অবাক হয়ে বললাম,- আমরা কি কোথায় যাব?

মা বললেন,- হ্যাঁ, বিকেলের দিকে এই সময়ে, বিশ্রামঘাটের চারদিকে বেশ লাগে।

সত্যিই সুন্দর। লাল পাথরের সিঁড়িতে, যমুনা নদীর জল, ঘাই মারছে। বাগবাজারের ঘাটে বিকেলের দিকে যেমন জোয়ার দেখেছি, যমুনা নদীর জোয়ারের মধ্যে অদ্ভুত এক, গভীর কালো জলের গভীরে বেদনা আছে। বিকেল গড়িয়ে আসার বেশ কিছু আগে আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে, কংসের কারাগার অতিক্রম করে গেলাম। কংস রাজের কারাগার মথুরায় এসে অনেকবার দেখেছি। চারদিকে লোহার খাঁচার মতো, আর অন্ধকারাচ্ছন্ন। মায়াময় ভক্তির অপূর্ব বিন্যাস।

কারাগারের ভিতরের দিকে, সামনাসামনি বালক কৃষ্ণের মূর্তি। আমরা হেঁটে যাচ্ছিলাম, বিশ্রাম ঘাটের দিকে। সারি সারি দোকান। দোকানের ক্ষীরের প্যারা রাখা। থরে থরে লাড্ডু। ফুল, টোকরি, গোবিন্দ গোপালের বস্ত্র সাজানো। কত ছবি ও মূর্তি। মথুরার পাথরের মূর্তির কদর আছে। মাটির মূর্তিও আছে। মাটির মূর্তিগুলির মধ্যে, সাদা রঙয়ের ভীষণ প্রাধান্য। মাটির মূর্তিগুলি পালিশ করা চকচকে। কলকাতার মাটির মূর্তির মতো নিখুঁত না হলেও, অদ্ভুত চমৎকার আবেদন আছে।

প্রশস্ত বিশ্রামঘাট। পিতলের ঘণ্টার টুংটাং শব্দ। আর ঘাট জুড়ে, বেলফুলের মালার মন ভরানো গন্ধ। পশ্চিমদিকে যমুনা নদীর জলের ওপরে টকটকে লাল সূর্য, বিশ্রামঘাটের পাথরের ওপরে দিনের শেষের রোদ নয় আলো। সেই আলো ফুলের পাপড়ির মতো নরম। আমরা তিনজন ছিলাম, মা এবং দুই ভাই। আমার ভাই আঙ্গুল তুলে মাকে কি যেন দেখালো। মা মনোযোগ দিয়ে দোকানের পসরার দিকে মুগ্ধ হয়ে দেখছিলেন। আর ভাবছিলেন, বিশ্রামঘাটের এক কোণে পাথরের ওপরে বসে, যমুনা নদীর সূর্যাস্ত দেখবেন। কিন্তু আমাদের সবার সেই দিকে দৃষ্টি চলে যেতেই অবাক হয়ে গেলাম। এগিয়ে গেলাম পায়ে পায়ে।

আমাদেরই মতো অনেকেই সাধুর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিল। কয়েকজন যারা, পাণ্ডা গোছের, সাধুর চারপাশে পড়ে থাকা ফল ফুল বস্ত্র ঘিয়ের শিশি টাকা পয়সা সেইগুলি গুছিয়ে রাখছে। গামছা, সাদা কাপড় আতরের শিশি কিছুই বাদ নেই যেন। সাধু চোখ বুজে ধ্যানস্থ। কোনোদিকেই তার ভ্রূক্ষেপ নেই। আমরাও গুঁটি গুঁটি পায়ে তার কাছে এগিয়ে গেলাম। দীর্ঘদেহী, ধ্যানস্থ হয়ে বসে থেকেও তার উচ্চতা, একজন দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের মতো। সন্ন্যাসী যখন দাঁড়িয়ে পড়েন, তাহলে তার উচ্চতা নিশ্চয়ই এক পাহাড় বরাবর। চওড়া কপাল, জটা এলিয়ে গেছে পিঠ জুড়ে। কোমরের নিচে দাগের মতো শুধু কৌপীন। কপাল জুড়ে মাটির দাগ। ঠোঁট দুইটি পাথরের মতো, যেন ছেনি হাতুড়ির টোকায় শিল্পীর অবাক বিন্যাস। বসে থাকা সন্ন্যাসী অপূর্ব রক্ত মাংসের ভাস্কর্য।

দর্শনার্থী সবাই চুপ করে কেউ বসে কেউ ঠায় দাঁড়িয়ে। আমি মায়ের খুব কাছেই দাঁড়িয়ে। সাধু হোক বা অসামান্য সাধক, মহিলাদের চোখে ভক্তির ও আত্মসমর্পণের এক ভাব। সূর্যের ফুলের পাপড়ির মতো আলোতে, তার দেহের অলৌকিক বিচ্ছুরণ ভারতবর্ষের ধুলোমাটির ভক্তির চিরায়ত অন্বেষণ। মানুষের জমায়েত ক্রমশ বড় হচ্ছিল। সেই সঙ্গে নানান কিছুর পাহাড় জমে উঠছিল। মা কি করে জানবেন, এই সন্ন্যাসীর মাহাত্ম। তবুও কখন যে তিনি একটি বেলফুলের মালা এনে নিবেদন করলেন, জানতেও পারিনি।

আমি মেলাতে চেষ্টা করছিলাম, মা যিনি ব্রজেন মিশ্রাজির এ্যাকোরডিয়ানের শব্দ শুনে মুগ্ধ হয়ে যেতেন, সেই তিনিই এই সন্ন্যাসীর শেষ বিকেলের আলোর বিচ্ছুরণ দেখে অন্য এক অচেনা মা। এক জীবনে খুব কমই মহিলা আছেন, যিনি বিস্মিত হওয়ার মতো পুরুষমানুষের খুবই কম সাক্ষাৎ পান। হোক না সে সন্ন্যাসী বা এ্যাকোরডিয়ান বাদক ব্রজেন মিশ্রা। মাঝে মাঝে আমি অবাক হয়ে দেখতাম মাকে, যিনি মায়ের সমস্ত সংজ্ঞা অতিক্রম করে এক বিস্ময়কর নারী হয়ে ওঠেন।

বিকেল প্রায় পড়ে এলো। ফুল ফল ও মিষ্টি মনিহারি দোকানগুলিতে আলো জ্বলে উঠল। দীর্ঘাকৃতি সন্ন্যাসী আকাশভেদী শ্রীকৃষ্ণের নাম নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। অস্তগামী সূর্যের দিকে প্রণাম করে, পা বাড়ালেন। তাকে নিবেদন করা সামগ্রীর স্তূপ, একটিবারও সেই দিকে তাকালেন না। কোনো কিছুই স্পর্শ করলেন না। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে কংসের কারাগারের ওইখানে মাথা ঝুঁকিয়ে চলে গেলেন সোজা রাস্তা ধরে যমুনা নদী বরাবর।

উপস্থিত অনেকের সঙ্গে মা কথা বলে জানতে পারলেন, লোকালয় ছেড়ে এবার তিনি ছায়ার সমান গতিময়। যাত্রা তার গভীর উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশে হয় তো। ফিরে আসার সময় জানতে পারলাম, প্রতিবছর ঠিক আজকের দিনেই সন্ন্যাসী ধ্যানস্থ হয়ে বিকেলের কৌলীন্য অবগাহন করে ফিরে যান। কোথায় কোন ঠিকানায় ফিরে যান তা কেউ জানেনা। হ্যাঁ, প্রতিবছর আজকের দিনেই তিনি আসেন, ঠিক আজকের দিনেই না কি বালক কৃষ্ণ কংসরাজকে বধ করেছিলেন।

ফেরার পথে মা একটি পুতুলের দোকান থেকে রাধাকৃষ্ণের শ্বেত পাথরের মূর্তি কিনলেন। মা যখন দোকানে নানা রকমের মূর্তি দেখছিলেন, আমি বলেছিলাম বাঁশি হাতে দাঁড়িয়ে শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি কি সুন্দর !!!

কোন মূর্তির কথা বলছ?

ওই যে কাগজের ফুলের পাশে শ্রীকৃষ্ণ একা।

রাধা ছাড়া শ্রীকৃষ্ণ… কিনলে এই লীলা ক্ষেত্রের স্মৃতি গভীর বেদনা পাবে।

Facebook Comments

1 thought on “কাশবনের ভাষ্কর্য : শুভংকর গুহ Leave a comment

  1. শুভঙ্কর গুহর লেখাটি পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল যেন রূপকথার কোন অরণ্যে অন্য সব ছায়ামানুষ মিথসকলের মধ্যে দিয়ে লেখকের পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি । কবিতার এত সূক্ষ্ম ডিটেইলিং, অনবদ্য !

Leave a Reply