বর্ণাশ্রম, অপর, সমাজ এবং দুটি রামায়ণ কেন্দ্রিক সংস্কৃত নাটক : রাম চরিত্রের বিবর্তন তথা রামায়ণের বহুপাঠ – শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ অঙ্ক – ভ্রাতৃগণ, রামের প্রাধান্য, নারীর ভূমিকা ও সম্পদ
এই অঙ্কে ছোট একটি প্রবেশক আছে, যা পূর্ব এবং পরের ঘটনার সংযোজনস্থল। গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল ভরতের রাম সন্দর্শনে আসা। ভরত নিজেকে অপরাধী মনে করছেন কৈকেয়ীর জন্য। ব্রহ্মহত্যার পাপীর মত মনে হচ্ছে তাঁর নিজেকে। রাম-লক্ষণাদির কাছে আত্ম-আগমনের ঘোষণা করছেন নির্দয়, কৃতঘ্ন, নীচ কিন্তু দুঃসাহসী একজন বলে। এই অঙ্কে আমরা জানছি ভরতকে দীর্ঘদিন মাতাদের মতই ভ্রাতারাও দেখেননি। ভরত, সীতাকেও দেখেননি এর আগে বোঝা যাচ্ছে। এই নাটকে যদিও রামবিবাহের সময়কার কথা নেই, তবুও এই না দেখা থেকে বোঝা যাচ্ছে প্রচলিত রামায়ণকে এখানেও অতিক্রম করছেন নাটককার। সেখানে একত্রে চারকুমারের বিবাহ হয়েছিল।
নাটক বলছে কথা ভরতের আকৃতি ও কন্ঠস্বর রামানুরূপ। লক্ষ্মণ-সীতা উভয়েরই ভ্রান্তি হচ্ছে তাতে। প্রচলিত রামায়ণে দশরথের পুত্রদের জন্মের যে ক্রম, সেই ক্রম এখানে নাটককার পরিবর্তন করেছেন। লক্ষ্মণ, ভরতের চাইতে বড় এখানে। কেন করেছেন এ কথা আজ বোঝা প্রায় অসম্ভব। লক্ষ্মণ ভরতের কন্ঠস্বর শুনছেন, দেখেননি তখনো। সেখানে ভরতের প্রশংসা করছেন। করতে গিয়ে বলছেন বিভিন্ন অক্ষরগুলি ঠিক ঠিক উচ্চারণস্থান থেকে স্পষ্টত উদ্ভূত হওয়ায়, কন্ঠস্বরের অধিকারী চতুর্বর্ণের অভয়দানে প্রবৃত্ত বলে মনে হচ্ছে। রামের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার আগেই রামের অনুপস্থিতিতে অযোধ্যায় ভরত যে বর্ণাশ্রমকে রক্ষা করেই চলবেন তার ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে।
নাটককার নাট্যকলা সম্পর্কে অবশ্যই অবহিত বলে বাচিক বিষয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টিধারীও। বাচিকে চরিত্র ভেদে উচ্চারণ গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক উচ্চারণ স্থান ব্যবহার করার অর্থ ভাষায় দক্ষতা, ব্যাকরণে দক্ষতা। এখানে যেহেতু সংস্কৃতই ব্যবহৃত হচ্ছে সুতরাং এই দক্ষতা ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের দক্ষতা। শাসক হতে গেলে অবশ্য অর্জন করার মত দক্ষতা। নাট্যশাস্ত্র, কোন চরিত্র কোন ভাষায় কথা বলবে তা নির্ধারণ করেছে সামাজিক বর্ণ ও জাতিভেদকে মাথায় রেখেই। স্থিতাবস্থাকে বজায় রাখার জন্যই। যে সময়কালে নাটকটি রচিত সে সময়কালেও ব্যাকরণ না জানলে বেদকে বোঝা সম্ভব নয় এই ধারণা প্রবলভাবে প্রচলিত ছিল। সেই বিচারে কোন স্বর উদাত্ত হবে, কোন স্বর অনুদাত্ত তা সম্পর্কেও বিশেষ ধারণা দিত ব্যাকরণ জ্ঞান।
এইখানে বৃত্রের ইন্দ্রের হাতে পরাজয়ের কারণ হিসেবে ব্যাকরণ ও উচ্চারণের কাহিনীটি বলাই চলে। বৃত্র, তাঁর শত্রু ইন্দ্র বধের জন্য অভিচার ক্রিয়ার আয়োজন করেছেন। ‘ইন্দ্রশত্রুর্বধস্ব’ এই কথাটি ঋত্বিক যজ্ঞে উচ্চারণ করতে গিয়ে বিভ্রাট ঘটালেন। এই শব্দটি সমাসনিষ্পন্ন শব্দ। কিন্তু কোন সমাস? বহুব্রীহি সমাস হলে পূর্বপদ বা আদ্যপদ উদাত্ত উচ্চারিত হবে। তৎপুরুষ সমাস হলে অন্ত্যপদ উদাত্ত উচ্চারিত হবে। বৃত্রের অভিচারে ‘ইন্দ্রশত্রুর্বধস্ব’-তে ইন্দ্র শত্রু বধের ইন্দ্র-শাতন বা কাটা, ছেদ করা ইত্যাদি অর্থে ব্যবহার হলে অন্ত্যপদ উদাত্ত স্বরে উচ্চারিত হওয়া উচিত। আদ্যপদ যদি উদাত্ত স্বরে উচ্চারিত হয় তাহলে ইন্দ্র আমন্ত্রিত বোঝায়। ঋত্বিকের অজ্ঞতার জন্য সেই অভিচারে ইন্দ্র আমন্ত্রিত অর্থ হয়েছে উচ্চারণে, ইন্দ্র-শাতন এই অর্থ বোঝায়নি। তারফলে বৃত্রের অভিচার ক্রিয়া (অন্যের অনিষ্ট সাধনের জন্য অথবা নিজের ইষ্ট সাধনের জন্য তন্ত্রোক্ত তুকতাক জাতীয় প্রক্রিয়াদি) বৃত্রেরই মৃত্যুর কারণ হয়। এই গল্পটিকে লক্ষ্য রাখলে লক্ষ্মণ যখন উচ্চারণ থেকেই ধরছেন যে যিনি এসেছেন তিনি বর্ণাশ্রমকে রক্ষা করবেন তখন তা মাথায় রাখার মত বিষয়। শুধু সংস্কৃত ভাষা নয়, তার শুদ্ধ উচ্চারণ বর্ণাশ্রমের ক্ষেত্রে কর্তৃত্বমূলক অংশকে চিহ্নিত করতো। ভাষা-রাজনীতির দিক থেকেও ভরত রামের জায়গায় যোগ্য প্রতিস্থাপন।
এরপরে ভরত রামের থেকে পাদুকা নিয়ে ফিরে যাবেন অযোধ্যায়। তার আগে ভরত জানাচ্ছেন মাতৃদোষ (অর্থাৎ কৈকেয়ীর দোষ) পুরুষের (তথা ভরতের) দোষ নয়। রামায়ণ বা এই নাটকে, নারীর অবস্থান সম্পর্কে কতগুলি পূর্বনির্ধারিত ধারণার সম্মুখীন হই আমরা। সেগুলিকে মেনে নিয়েই আলোচনা চলতে থাকে। তাই কিছু প্রশ্ন যা সংগত তা ওঠে না। কৈকেয়ীর ভূমিকা, এই মহাকাব্যে কলুষিত বলে আমরা জানছি। কিন্তু কলুষ কিসের? দশরথ একজন ক্ষত্রিয় রাজা, যিনি একাধারে তিনটি বিবাহ করতে পারেন, সেখানে প্রতিটি রাণীকে – রাণী এবং নারী হিসেবে তাঁর বশে থাকতেই হবে? যেখানে পুরুষের একাধিক বিবাহ করার অধিকার সেখানে নারীর সে অধিকার নেই কেন এ প্রশ্ন বা পুরুষই কেন, নারী কেন শাসন করতে পারবে না এ প্রশ্ন আমাদের আলোচনাতে আসেও না।
বরং প্রচলিত রামায়ণ পাঠেও দেখি কৈকেয়ী সকলের দ্বারা ভর্ৎসৃত হচ্ছেন। এমন কী দশরথের সারথী সুমন্ত্র, যিনি এ নাটকেরও অন্যতম রাজানুগত রামানুগত চরিত্র ভর্ৎসনা করছেন কৈকেয়ীর লোভকে। শুধু তাই নয়, কৈকেয়ীর মাতাকেও টেনে আনছেন সে আলোচনায়। কৈকেয়ীর পিতা, কোনো এক ঋষির বরে মানুষ ছাড়াও পশু-পক্ষী সকলের ভাষা বুঝতেন। তিনি একদিন একটি সোনার পাখির কূজন শুনে হাসছিলেন। কেকয়রাজের হাসি দেখে কৈকেয়ীর মাতা কারণ জানতে চাইলেন। কেকয়রাজ তাতে বললেন, কারণ যদি তিনি বলেন তাহলে তিনি মারা যাবেন। কৈকেয়ীর মাতা বলেছিলেন কারণ না বললে তিনি আত্মহত্যা করবেন। কেকয়রাজ মরুন বাঁচুন কারণ তাঁকে বলতেই হবে। কেকয়রাজ তখন তাঁকে আশীর্বাদক ঋষির সঙ্গে কথা বলতে গেলেন। তাঁর পরামর্শে রাণীকেই পরিত্যাগ করলেন। সুমন্ত্র এ কথা বলছেন, কৈকেয়ীকে দশরথ পরিত্যাগ করছেন না বলে। বলছেন যখন বুঝিয়ে দিচ্ছেন কৈকেয়ীর মাতা এবং কৈকেয়ী দুই নারীর স্বভাবই এক। প্রবাদ উল্লেখ করে বলছেন পুরুষেরা পিতার এবং কন্যারা মাতার স্বভাবানুযায়ী হয়ে জন্মায়।
অলৌকিক, প্রবাদ ইত্যাদির আশ্রয়ে আসলে একটি কথাই বলা হচ্ছে, কৈকেয়ী বা তাঁর মত উচ্চাকাঙ্খী নারী সংসারের বিষ। কৈকেয়ী শুধু রাজ্য ভরতের জন্য চেয়ে নিয়েছেন এমন না, তিনি রাজ্যের সম্পদও যাতে ভরতের থাকে তার জন্যও লড়েছেন। দশরথ, রামের বনবাসের আদেশ দেবার পরে, সুমন্ত্রের কথাতেও কৈকেয়ীর লজ্জা না হওয়ায় বলছেন, অযোধ্যা বা রাজ্যের সৈন্য থেকে ধান্য সকলই রামকে দেওয়া হোক বনবাসের জন্য। নগরের লোকদেরও যেতে বলছেন। বলছেন তাঁরা অরণ্যে গিয়ে মৃগবধ মধুপান নদনদী দর্শন করে নগরই ভুলে যাবে। তখনও কৈকেয়ী লড়ছেন। বলছেন, তাহলে ভরতের জন্য কী থাকবে!
রাজা, মন্ত্রণাদাতারা সকলেই ব্যর্থ হলে বশিষ্ঠ আসরে অবতীর্ণ হলেন। ততক্ষণে জানকী বনগমনের উপযোগী চীর-বস্ত্র ধারণ নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছেন। তিনি জানেন না কেমন করে সে বস্ত্র পরে। রাম সে সমস্যার সমাধান করছেন তখন। নাটককার, প্রথম অঙ্কে যে সীতার বল্কল ধারণ দৃশ্যে গুরুত্ব দিয়েছেন তা সম্ভবত এই অংশের প্রভাবেই হয়ে থাকবে। যা হোক, বশিষ্ঠ এখানে একটি কৌতুহলজনক কথা বলছেন জানকীকে বনে যাবার উপক্রম করতে দেখে। জানকী বনে যেতে পারেন না। বালিকা, কোমলস্বভাবা তিনি। বশিষ্ঠের সহ্য হচ্ছে না। তিনি বলছেন, গৃহীর অর্ধাঙ্গ হল স্ত্রী। অতএব রাম বনে গেলে সীতা সিংহাসনে বসবেন। রাজ্যপালন করবেন। কিন্তু সে কথাতে না বশিষ্ঠ না অন্য কেউ, খুব একটা জোর দিলেন না। বরং সীতা বনে গেলে সকলেই রাম-সীতা অনুগমন করবেন এমন সব বাক্য উচ্চারিত হল। তাহলে নারীর অধিকার? পুত্রকে সিংহাসনে বসানোর চেষ্টা। অথবা স্ত্রী হয়ে স্বামীর অনুপস্থিতিতে স্বামীর সিংহাসনে বসে রাজ্য চালানো। এর মধ্যেই সীমিত। এবং অবশ্যই তত গুরুতর নয় যে বাকীরা বশিষ্ঠের কথা নিয়ে আলোচনা করবেন। শুধুমাত্র একটি উচ্চারিত বিকল্প হয়েই থেকে গেল এই সম্ভাবনাটি। নারীর সম্পদে অধিকারের ক্ষেত্রে এই মন্তব্য এবং তাকে ঘিরে নৈঃশব্দ অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য।
বনবাসে যাবার আগে কৌশল্যা যে উপদেশ দিচ্ছেন জানকীকে তার সার কথাও হল সীতা যেন রামকে দেবতুল্য বলেই গণ্য করেন। বনবাসে রামের দারিদ্রে যেন অসতী না হয়ে যান। সীতা আশ্বস্তও করছেন তিনি এ সকল ধর্ম জানেন বলে। অর্থাৎ মহাকাব্যই হোক কিম্বা এই নাটক, সর্বত্রই নারীর ভূমিকা ও অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য এমন ভাবে পূর্বনির্ধারিত যে এ প্রসঙ্গে কোনো আলোচনাই এখানে উপস্থিত নেই।
কেন এমন সে সম্পর্কে আরো আলোচনায় যাবার আগে আমরা দেখে নিই বনবাসে গিয়েও রাম কৈকেয়ীর সম্পর্কে কী ভাবছেন! প্রচলিত রামায়ণ অনুযায়ী তিনি ভাবছেন ভরতকে রাজ্য দেবার জন্য কৈকেয়ী দশরথকে বাঁচতে দেবে না। দশরথ কামের অনুবর্তী। তাঁর জীবনে ধর্ম ও অর্থের তুলনায় কামই প্রবল বলে বোধ হচ্ছে রামেরও। মূর্খও এমন ভাবে পুত্রকে বনবাসে দেবে না বলছেন। সঙ্গে এও বলছেন কৌশল্যাকে বিষ প্রয়োগেও হত্যা করতে পারেন কৈকেয়ী। রাম জানাচ্ছেন, অধর্ম ভয়ে এবং পরলোক ভয়েই কেবল তিনি বনবাসে এসেছেন। অর্থাৎ ষড়যন্ত্রের কূট দশা বনবাসেও তাঁকে জীর্ণ করছে। তিনি ততটাও পিতৃঅনুগামী এবং পিতার প্রতি শ্রদ্ধায় নীরব থাকতে পারছেন না। তাহলে পিতৃভক্ত রামের যে চরিত্রে আমরা অভ্যস্ত সে চরিত্র সঠিক না এটি?
শুধু এই নয়, যে শত্রুঘ্নকে মহাকাব্যে প্রায় বাক্যহীন দেখি, এ নাটকে যাঁর তেমন কোনো ভূমিকাই নেই, সেই শত্রুঘ্নও কৈকেয়ীর নিন্দা করছেন। মাতুলালয়ে ছিলেন তাঁরা। দশরথের মৃত্যুতে তাঁদের আনিয়েছেন বশিষ্ঠাদি ঋষিরা। কৈকেয়ীর কাছে সব শুনে ভরত কৈকেয়ীকে যথাসম্ভব নিন্দা করেছেন। তারপরে শত্রুঘ্ন বলছেন, রাম কেন বনে গেলেন! স্ত্রীলোকের কথায় যে রাজা অসৎপথ (অর্থাৎ রামের বনবাসে সম্মত হওয়া) অবলম্বন করে থাকে, তাকে নিগ্রহ করাই উচিত কাজ। সে কাজ কেন লক্ষ্মণ করলেন না? দশরথকে নিগ্রহ করে তাঁর উচিত ছিল রামকে বনবাসে না যেতে দেওয়া। এই সব পিতৃভক্তির নমুনা? না রাজার কামার্ত হওয়ার প্রভাবে পুত্রদের বিদ্রোহের ইচ্ছা? তার অর্থ পিতা বললেই শুনতে হবে এমন আদর্শ পরিবার বা পরিবেশ মোটেও তখনো ছিল না। কখনোই ছিল বলে মনে হয় না। কিন্তু সম্পদের চলন অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে এ সবকে যতটা সম্ভব মাথায় ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টা পরবর্তী সময়ের ধর্মধ্বজীরা করে গিয়েছেন। এই নাটকেও যা প্রকাশিত, তাকে ধামা চাপা দেওয়া গিয়েছে – সম্পদ আর সংসারে পিতৃতান্ত্রিকতার একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে। এমন কী সেখানে দ্রোহকারী হতে চাইলে পুরুষও নিপীড়নের মুখেই পড়বে।
শত্রুঘ্নের সংলাপের আগেই আমরা কৈকেয়ীর দশরথের প্রাণরক্ষার উপহার স্বরূপ দুটি বর দেবার প্রতিশ্রুতির কথা জানি। জানি, দশরথ, শব্দবেধী বাণ ছুঁড়ে বৈশ্য বীর্য ও শূদ্রা গর্ভজাত মুনিবালককে হত্যা করেছিলেন। তাই তিনি অভিশপ্ত। কিন্তু বর বা অভিশাপ কোনো কিছুই কৈকেয়ীর নিন্দা ঘোচাতে পারল না। কেন এমন?
এমন এক সময়ের কথা এই মহাকাব্য ধরে রেখেছে, যখন শিকার, পশুপালনের পাশাপাশিই কৃষি অন্যতম সম্পদের উৎস হিসেবে উঠে আসছে। শিকার এবং পশুপালনের সমাজে যুদ্ধব্যতীত অনেক সম্পদ লাভের রাস্তা কম। ঋগ্বেদের সময় বর্ণাশ্রম যে প্রচলিত ছিল না তার প্রমাণ আছে ঋগ্বেদেই। নবম মণ্ডলের একশো বারোতম সূক্তের তৃতীয় অংশ বলছে সে কথা।
“দেখ, আমি স্তোত্রকার, পুত্র চিকিৎসক ও কন্যা প্রস্তরের উপর যব-ভর্জন-কারিণী। আমরা সকলে ভিন্ন ভিন্ন কৰ্ম্ম করিতেছি। যেরূপ গাভীগণ গোষ্ঠ মধ্যে বিচরণ করে, তদ্রুপ আমরা ধন কামনাতে তোমার পরিচর্যা করিতেছি। অতএব হে সোম! ইন্দ্রের জন্য ক্ষরিত হও।”
তিনজনের তিনটি পৃথক জীবিকা। বর্ণাশ্রম প্রচলিত হবার পরে তা সম্ভব ছিল না। এই সূক্তেই এর আগে ছুতার, বৈদ্য, বাণ প্রস্তুতকারক প্রভৃতিদের উল্লেখ আছে। অর্থাৎ ধীরে ধীরে বৈদিক সমাজে নানা পেশা উদ্ভূত হয়েছে। কিন্তু বর্ণাশ্রম শুরু হয়নি। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের পুরুষ সূক্ত (যাকে বিশেষজ্ঞরা প্রক্ষিপ্ত বলে চিহ্নিত করেন) চতুর্বর্ণের কথা বলছে। তা আবার অথর্ববেদের উনবিংশতি মণ্ডলে আছে। আরো দুটি সূক্ত আছে অথর্বতেই যেখানে বিভাজন হচ্ছে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শূদ্র এবং আর্য। এখানে আর্যকে বৈশ্য বলে না ধরলে আজকের বর্ণাশ্রমের সঙ্গে মেলানো যাচ্ছে না। আরেকটি সূক্তে ব্রাহ্মণ সরাসরি উল্লিখিত নয়, ক্ষত্রিয়ও রাজা বলে চিহ্নিত। বাকী দুই হল শূদ্র এবং আর্য। অর্থাৎ ধীরে ধীরে বর্ণাশ্রম চেহারা নিচ্ছে। মহাকাব্যের এবং এই নাটকের যুগে বর্ণাশ্রম আজকের ভারতের সর্বত্র না হলেও বেশ কিছু অঞ্চলে যথেষ্ট গুরুতর বিষয় বলেই বারংবার তার উল্লেখ আসছে এই সব রচনায়।
নারীর উল্লেখ, বিশেষ করে জায়া বা স্ত্রী অর্থে আমরা পাচ্ছি বৈদিক যুগ থেকেই। নারীর জ্ঞানচর্চা, সম্পত্তির অধিকার এ সব নিয়ে কথা বলার আগে আমরা একটু জেনে নিই স্ত্রী-র ভূমিকা কেমন ভাবে ব্যাখ্যাত হচ্ছে বেদ-পুরাণে। যেমন বৃহদারণ্যক পুরাণ। সেখানে আমরা জানছি সৃষ্টির পূর্বে একমাত্র আত্মাই ছিলেন। তিনি কামনা করলেন, আমার জায়া উৎপন্ন হোক। আত্মবেদমগ্র আসীদেক এব ইত্যাদি শ্লোকে এই বর্ণনা। অর্থাৎ প্রথম পুরুষ, সেই পুরুষ নিজের জায়া কামনা করে সৃষ্টি করছেন। নারী সৃষ্টি থেকেই এখানে পুরুষাধীন। অন্যদিকে আমরা যদি অম্ভৃণ কন্যা বাক-এর রচিত বলে প্রচলিত দেবী সূক্তটি লক্ষ্য করি, তাহলে কিন্তু নারীর থেকেই পুরুষের জন্মের কথা আসছে। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের দশম অনুবাকের একশো পঁচিশতম সূক্ত এটি। দশম মণ্ডলকে অনেকেই প্রক্ষিপ্ত বলে থাকেন। তা ধরে নিলেও আমরা ধারণাটিকে খেয়াল করতেই পারি।
“অহং রুদ্রায় ধনুরাতনোমি ব্রহ্মদ্বিষে শরবে হন্তবা উ।
অহং জনায় সমদং কৃণোম্যহং দ্যাবাপৃথিবী আবিবেশ।”
“আমি সেই পরম তত্ত্বের উপদেশ দিচ্ছি, দেবতা ও মানুষ যাঁর সেবা করেন। আমি স্বয়ং ব্রহ্মা। আমি যাঁকে রক্ষা করি তাঁকে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা বানিয়ে দিই, যাঁকে ইচ্ছা করি তাকে বৃহস্পতির মত মেধাবান বানিয়ে দিই। আমি স্বয়ং ব্রহ্মাভিন্ন আত্মা, যে আমারই স্বরূপ, তার গান করি।”
এই যে বাকের সূক্ত, এতে নারী নিজেকেই ব্রহ্মা বলে ঘোষণা করছেন। তাহলে বৃহদারণ্যকের কথার কি হবে? আমাদের লক্ষ্য করতে হবে নারী-পুরুষের দ্বন্দ্ব অত্যন্ত আদিম দ্বন্দ্বও বটে। সমাজ ও সম্পদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সেও নানা অভিমুখে ও ক্ষেত্রে বেড়েই চলেছে। পুরুষ নারীর অবস্থানকে যেখানে যেভাবে দেখবে তার সঙ্গে নারীর সর্বদা সহমত হবার তাই কারণ নেই। অতএব নানা সৃষ্টিতত্ত্ব আসবেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কেমন ভাবে দেখব বৈদিক নারীর অবস্থানকে? ধরা যাক জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রটিকেই। সেখানে বারংবার গার্গী, মৈত্রেয়ীদের কথা আসেই আমাদের আলোচনায়। কিন্তু জ্ঞানচর্চায় তাঁরা পুরুষের অধীন না পুরুষ তাঁদের অধীন? অথবা উভয়েই স্বতন্ত্র? আমরা যদি গার্গীর সঙ্গে যাজ্ঞ্যবল্কের দ্বন্দ্বের কাহিনীটিকেই দেখি, তাহলে একটি বিষয় চোখে পড়বেই। গার্গীকে অতিপ্রশ্ন করলে মুণ্ড খসে পড়বে বলে হুমকি দিয়েই যাজ্ঞ্যবল্ক থামিয়ে দিচ্ছেন। গার্গীকেও থেমে যেতে হচ্ছে রাজার দরবারে ব্রহ্মজ্ঞানের প্রশ্নে পরাজিত হয়ে। তাহলে একদিকে আমিই ব্রহ্মা ঘোষণা থেকে ব্রহ্মজ্ঞানের প্রশ্নে হেরে যাওয়া নারী আমাদের কি জানাচ্ছে? জানাচ্ছে তাঁদের ক্রমশ পুরুষ অধীন হয়ে ওঠার কথা, জ্ঞানচর্চায়।
কথা হচ্ছে, এমনই ছিল কি শুরু থেকে জ্ঞানচর্চার জায়গা? বৃহদারণ্যকই কিন্তু জানাচ্ছে তা নয়। শিক্ষিত পুত্রের মত শিক্ষিতা কন্যাও কাম্য ছিল।
‘অথ য ইচ্ছেদ্ দুহিতা মে পন্ডিতা জায়েত।
সর্বমায়ুরিয়াদিতি তিলৌদনং পাচয়িত্বা সর্পীষ্পমন্তমশ্লীয়াতাম্।।’ (বৃহদারণ্যক, ৬/৪/১৭)
তবুও পুত্রের আকাঙ্খাই সে সময় বেশী হয়েছে। অথচ বেদপাঠ সে সময় নারীদের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ নয়। এমনকী উপনয়নের ধারণাও ছিল। গোভিল গৃহ্যসূত্রে, বিবাহের জন্য আনীতা পাত্রীর অঙ্গে যজ্ঞোপবীতের উল্লেখ তার সাক্ষ্য। আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রে নারীদের সমাবর্তনোত্তর অনুষ্ঠানের কথা আছে। যে সকল নারীরা বেদপাঠে ইচ্ছুক তাঁদের যজ্ঞোপবীত ধারণ, গায়ত্রী মন্ত্র জপ, অগ্নি আধান করে হোম, অন্যান্য বৈদিক গ্রন্থ পাঠ এ সব করতে হত। অন্তত ষোলো সতেরো বছর অবধি শিক্ষালাভের সুযোগ ছিল। বিবাহের আগে ব্রহ্মচর্যা করার বিষয় ছিল। প্রাক্বিবাহ প্রেম থেকে কুমারীই থেকে যাওয়া সবই বৈদিক সাহিত্য থেকে পাওয়া যাচ্ছে। তাহলে? গার্গীকে কেন হার মানতে হচ্ছে?
ধীরে ধীরে একটি উপজাতীয় সমাজ বদলাচ্ছে। সন্তান ধারণ না করাটা তার বৃদ্ধির জন্য, বিশেষ করে পশুপালন হোক কিম্বা কৃষিক্ষেত্র, নেতিবাচক। সন্তান না থাকাকে তাই দারিদ্র বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। সন্তানহীন বিধবা দেবরের থেকে সন্তান লাভ করতে পারে। অনেকেই অথর্ববেদে বিধবা নারীকে তাঁর স্বামীর চিতাপার্শ্ব থেকে উঠে সংসারে ফিরে আসার নির্দেশ (বা আহ্বান) মূলক একটি সূক্তের উল্লেখ করেন। বিধবা বিবাহের সমর্থন করে এ সূক্ত। কিন্তু সে সমর্থন কি কারণে? শুধুমাত্র নারীর জীবনের সম্মানে? নাকি সন্তান উৎপাদন (বিশেষ করে পুত্র) ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তার জন্য? সম্মানের জন্য হলে পরে সহমরণের প্রশ্নটিই আসতো না। একধরণের উপজাতীয় সংস্কৃতিতে সন্তানের উৎপাদনের মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রয়োজনীয় ছিল। সেখানে নারীর সম্মান নয় প্রয়োজনীয়তা বিবেচিত। তারপরে আস্তে আস্তে বদলে আসছে আরেক ধরণের সমাজ যার বিধবার গর্ভে সন্তান প্রয়োজন নেই। বিধবা থাকার অর্থ সংসারের গ্রাসাচ্ছাদন থেকে ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্যেও তার অবস্থান। তেমন তেমন হলে সে অবৈধ সন্তান জন্ম দিয়েও ফেলবে। তাতে জটিলতা বাড়ে। এই বাংলাতেই যেমন একদা নানা উপন্যাস ও গল্পে বিধবার গর্ভধারণ থেকে গর্ভপাত ও কাশীবাস ইত্যাদি উল্লিখিত হয়েছে। তার চাইতে সহমরণ এ সব সমস্যার সমাধান করে দেয় না কি?
একটি সমাজ বিবর্তিত হতে হতেই আসে। এককালে নারীর যে ভূমিকা, সম্পদের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সে ভূমিকায় তার পক্ষে নারীকে উচ্চ আসন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাকে অধীন থাকতে হবে। কোনো অবস্থাতেই পুরুষের সমালোচনাও তার কাজ হবার কথা নয়। যেমন প্রচলিত রামায়ণে রাম বনে চলে যাবার পরে দশরথ-কৌশল্যার সংলাপ অংশে দশরথের কাছে কৌশল্যা তাঁর সমালোচনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছেন। স্বামীনিন্দা ইত্যাদিতে সাধ্বী নারীর নরকবাসের কথাও আসছে। এভাবেই সম্পূর্ণ অধীনতার প্রকাশেই নারী সংসারে ঠাঁই পেতে পারে, এ নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে। কৈকেয়ীর ক্ষেত্রেও তাই এত তীব্র নিন্দা সকলের।
স্বাভাবিক ভাবে দেখলে যে কারোর সন্তানেরই মাতা-পিতার সমান মনোযোগ থেকে তাদের অর্জিত সম্পদের সমান অধিকারী হওয়াই উচিত। জন্ম যে নিচ্ছে সে নিজে যেচে জন্ম নেয় না। পুনর্জন্মবাদ অবশ্য কর্মফল বলবে জন্মকে। কিন্তু সে বর্ণাশ্রমকে টিকিয়ে রাখার জন্য তৈরী একটি তত্ত্বমাত্র যার বিজ্ঞানগত ভিত্তি নেই। দশরথের পুত্রদের মধ্যে সকলেই তাঁর সম্পত্তির সমান অধিকারী হতেই পারতেন। কিন্তু তা সম্ভব নয় আবার সম্পদের আর্থিক-রাজনৈতিক চেহারায়। কেন সম্ভব নয়? দশরথের বদলে এক কৃষক পিতা-মাতার সন্তানদের কথাই ধরি আপাতত। তাঁদের যা জমি তা তাঁদের চারসন্তানের মধ্যে ভাগ হল। জমির পরিমাণ কমলো। তারপরে চার সন্তানের সন্তানদের মধ্যেও আবার ভাগ হল। আরো কমলো জমি (যদি মধ্যে সন্তানেরা তা ক্রয় করে বাড়াতে সক্ষম না হয়ে থাকে)। এভাবে একটা সময় আসবে (যেমন একদার বহু তথাকথিত বনেদীবাড়িতে এখন শরিকের সংখ্যা যা তাতে ভাগাভাগি করলে একেকজন একটি দরজাও সম্ভবত গোটা পাবেন না) যখন ভাগাভাগিই অসম্ভব। তাহলে কৃষি, তার থেকে সম্পদ দিয়ে জীবনধারণও অসম্ভব হবে। সেক্ষেত্রে কি হবে?
এ সমস্যার সমাধানের জন্য ‘মিতাক্ষরা’ পূর্বজদের সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ এবং স্বীয় সম্পদের একটি ভাগাভাগি তৈরী করেছিল। তার আগে লিখে নেওয়া ভাল ১৯৫৬-র হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের আগে এই উপমহাদেশের নানা জায়গায় নানা হিন্দু বলে কথিত শাস্ত্রের নিয়ম চলতো। ব্রিটিশরা তাদের ১৮৫৭-এর অভিজ্ঞতার পর থেকে এ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ সচরাচর করত না। বাংলা এবং পূর্ব ভারতের সংলগ্ন অঞ্চলে চলতো ‘দায়ভাগ’। পশ্চিমে মুম্বই, কোঙ্কণ, গুজরাট ইত্যাদিতে চলতো নীলকন্ঠের ব্যবহার ময়ুখ। দক্ষিণে, বিশেষ করে বর্তমান কেরালা অঞ্চলে চলতো মারুমাক্কাথ্যায়াম, যার অর্থ সম্পদে ভগ্নীর সন্তানদের অধিকার (নাম্বুদ্রিরা এই ধারাতেই)। অবশিষ্ট ভারতে মোটামুটি মিতাক্ষরা-র নানা এদিক ওদিক করা শাস্ত্রই চলতো।
মিতাক্ষরার সম্পদ বন্টনের একটি পদ্ধতি নিয়ে আমরা সামান্য আলোচনা করি। তিনটি প্রজন্মের সকল পুরুষের পূর্বজদের সম্পত্তিতে অধিকার বর্তায়। অর্থাৎ পিতামহের থেকে পিতা সম্পত্তি পেলে, পিতার পুত্র এবং প্রপৌত্ররাও সে সম্পদের সাধারণ অংশীদার হয়। এখানে দেখার বিষয় নারীর অধিকার স্বীকৃত নয়। যা জীমূতবাহনের দায়ভাগ (যা বাংলায় এবং পূর্বাঞ্চলে প্রচলিত ছিল) মানে না। তিনটি প্রজন্মের মধ্যে কেউ যদি মারা যেত, তাহলে বাকীদের সাধারণ সম্পদের পরিমাণ বাড়তো। জন্মালে কমতো। এবারে এই সাধারণ অংশীদারদের মধ্যে যে কেউ সম্পদের বিভাজন দাবী করতে পারতো। বিভাজিত হলে আবার বিভাজনকারী সহ তার পরের দুই প্রজন্মের সাধারণ অধিকার বর্তাতো। সোজা কথায়, নতুনদের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে পুরোনোদের খানিক করে সাধারণ সম্পদের অধিকার কমে যেত। মিতাক্ষরা অবশ্য পিতার বা অধিকারীর স্বীয় উপার্জনকে এই সাধারণ সম্পদের অংশ বলে ধরেনি। দায়ভাগে কিন্তু এমন না। দায়ভাগের ক্ষেত্রে পিতা যতদিন জীবিত সমগ্র সম্পত্তিতে তাঁরই অধিকার। সন্তানেরা চাইলেও সে সম্পদ পিতার জীবৎকালে পিতার অসম্মতিতে ভাগাভাগি করতে পারত না।
দায়ভাগ, মিতাক্ষরা ইত্যাদি যতরকমের স্মৃতিশাস্ত্র অনুবর্তী সম্পদ বন্টন পদ্ধতি আছে সবেরই কিছু না কিছু পার্থক্য আছে। কথা হচ্ছে, মহাকাব্যের কালে বা এই নাটকের কালেও সম্পদ বন্টনের পদ্ধতি নিশ্চয়ই ছিল। এবং সম্পদ না বন্টন করে সম্পদের জোর বজায় রাখার পদ্ধতিও নিশ্চয়ই ছিল। দশরথের রাজ্য যদি চারভাগ হয়ে যায়, তাহলে সে রাজ্য বংশের শাসনের দিক থেকে দুর্বল হয়ে যায়। এক জায়গায় সম্পদ এবং সামরিক শক্তি জোটবদ্ধ না থাকার ফলে, আভ্যন্তরীণ এবং বহিঃশত্রুর থেকে তা বিপন্ন হবার সম্ভাবনা বাড়ে। সুতরাং, দশরথ তার ভাগ করবেন না। দশরথের পরে রাজ্যভার যাবে জ্যেষ্ঠ পুত্রের কাছে। অথবা সর্বাধিক গুণী পুত্রের কাছে। এখানে জ্যেষ্ঠও রাম, আবার বেদ-ব্রাহ্মণ রক্ষাকারী দশরথের রাজত্বের বিত্ত্বশালী অংশের পছন্দও রাম। সুতরাং রামের কাছেই যাবে সম্পদ। বাকীদের যা কিছু পাওনা, তা রাম দিলে তবেই।
এই নাটককার জ্যেষ্ঠ যে পিতার পরেই সর্বশ্রেষ্ঠ সে মত অন্যান্য নাটকেও প্রতিষ্ঠা করেছেন। সুতরাং এখানেও করবেন বলাই বাহুল্য। কৈকেয়ী সম্পদের এই ধারাচলটিকেই দ্বন্দ্বে আহ্বান করেছেন। সে জন্যই তাঁর অপরাধ আরো অক্ষমণীয় হয়ে উঠেছে। যেমন মহাভারতে দুর্যোধনের অপরাধ। নাটককারকে আদর্শ পরিবার স্থাপন করতে হবে। সে পরিবারের নারী পুরুষের অনুগত নয় এমন হতেই পারে না। আবার সম্পদের দিকে তার নজর থাকতেও পারে না। সুতরাং নাটককারকে নিতে হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন রাস্তা। সে রাস্তার সন্ধানে আমরা যাব।
আদর্শ পরিবার সৃষ্টি করতেই এখানে প্রচলিত রামায়ণে ভরতের রাম সন্দর্শনের পাঠ থেকে দূরে সরেছেন নাটককার। সেখানে চিত্রকূটে ভরত রামের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন। বিরাট বাহিনী নিয়ে চলেছেন। রাম-লক্ষ্মণ বা সীতা কেউ জানেন না দশরথ মৃত। লক্ষ্মণ ভয়ঙ্কর আক্রোশে ভরত আক্রমণ করতে আসছে তাঁদের এই ধরে নিয়েই ভরতকে এবং কৈকেয়ী-মন্থরাকে বধ করবেন বলছেন। রাম কিন্তু পিতৃসত্যে অটল। তারই সঙ্গে তাঁর ভ্রাতৃপ্রেম অটল। তিনি রাজ্যের লোভে ভ্রাতা কেমন করে ভ্রাতাকে বা পিতাকে পুত্র হত্যা করে ভাবতেই পারছেন না। রাজ্য তাঁর চাই না। লক্ষ্মণের প্রয়োজন হলে ভরতকে বলবেন তাঁকেই দিতে তাও বলছেন। বলছেন ভরত কখনো লক্ষ্মণের প্রতি ভয়ঙ্কর বাক্য প্রয়োগ করেনি, তাহলে লক্ষ্মণের সন্দেহ কেন ইত্যাদি!
এতে একদিকে আদর্শ পরিবারের জ্যেষ্ঠ হিসেবে রামের ভূমিকা উজ্জ্বল হচ্ছে, অন্যদিকে কিন্তু প্রশ্ন থেকেও যাচ্ছে। ভরতকে নিয়ে এই বনবাসের অংশে যা বলছেন তা কিন্তু প্রচলিত পাঠেই আগের কথার বিরোধী। সীতাকে নিজেই প্রচলিত পাঠে যা বলেছিলেন সে সব কথার সঙ্গে মেলালে অসঙ্গতি ধরা পড়ে। তার থেকেও বড়, প্রচলিত পাঠে, কৈকেয়ীর ষড়যন্ত্র, কৌশল্যাকে হত্যার সম্ভাবনা, পিতাকে মৃত্যুমুখে প্রেরণ করার সম্ভাবনা রাম নিজেই বলেছেন। আবার এখানে যা বলছেন সে সব কোনোটাই রামের আগে বলা কথাগুলির সঙ্গে মিলছে না। এমন হতে পারে, নানা কবির হস্তাবলেপনে পাঠ কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু তা বলে সমগ্র পাঠ জুড়েই কৈকেয়ীর ষড়যন্ত্রের সুর বাড়া, ভরতের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ, কৌশল্যারও ভরতের উপস্থিতিতে দাসীদের ব্যবহার নিয়ে বলা কথা এ সব নানা বিরোধ হতে পারে না। এ সব কারণেই কি নাটককার এ সব প্রসঙ্গ কোনোভাবেই আনেননি? ভরতকে প্রতিমাগৃহ থেকে সরাসরি রাম সন্দর্শনে পাঠিয়ে দিয়েছেন?
আজ তার উত্তর লাভ সমস্যার। কিন্তু প্রচলিত পাঠেও আমরা ভরতকে দেখি রামের প্রতি অনন্যমন। তিনি কৈকেয়ীর অপরাধের দায়ে জীর্ণ। হ্যাঁ, তিনিও সম্পদের জন্য কৈকেয়ীর যুদ্ধকে অপরাধই মনে করছেন। পরম্পরাগত যে সম্পদ বন্টনের পদ্ধতি তা কৈকেয়ীর জন্য বিনষ্ট হয়েছে। ষড়যন্ত্রের জন্য কৈকেয়ী আর মন্থরা দায়ী। মন্থরাকে তিনি স্বহস্তে শাস্তিও দিয়েছেন। অর্থাৎ নারী বলে তাঁকে ছেড়ে দেননি। রাম সন্দর্শনে এসে ভরতকে প্রচলিত পাঠে প্রথমে রামের কাছে রাজ্যশাসন সংক্রান্ত উপদেশ শুনতে হয়। নাটককার সে সবের মধ্যে গিয়ে পাঠকে বা নাট্যকে গুরুভার করেননি বোঝাই যায়। ভরত, প্রচলিত পাঠেও কিন্তু কৈকেয়ীকে নরকগামিনী বলে উল্লেখ করছেন। তারপরে জানাচ্ছেন দশরথের মৃত্যু সংবাদ। কিন্তু সে সংবাদ দেবার পরে আমরা যে সম্পদ বন্টনের পরম্পরার আলোচনা করছিলাম তার সঙ্গে সঙ্গত আলোচনা করছেন। তিনিও দশরথের নিন্দা করবেন না বলেও তাঁকে কামপরবশ বলে উল্লেখ করছেন। নারীর অধীন রাজা বলে তাঁকে বিপরীতবুদ্ধি বলেও চিহ্নিত করছেন। অর্থাৎ ভরতের জন্য কৈকেয়ী রাজ্য নিলেও, সেই ভরত ইক্ষ্বাকু পরম্পরা এবং পুরুষতন্ত্রের চিহ্নিত রাস্তা ত্যাগ করতে পারছেন না।
এখানে আমরা স্মরণ করতে পারি আরেকটি কারণের কথাও। দশরথ, ভরতকে মাতুলালয়ে পাঠানোর পরে সভা ডেকেছিলেন। সে সভায় তাঁর অধীনস্থ রাজা এবং নানা নগর ও গ্রাম প্রধানরাও রামের পক্ষেই নিজেদের সমর্থন জ্ঞাপন করেছিলেন। বশিষ্ঠাদি ঋষিরা তো করেইছেন সে কাজ। অতএব ভরত যদিও বা চাইতেন, অযোধ্যা কি নিষ্কন্টক হত তাঁর কাছে? প্রজা এবং ক্ষমতার নানা কেন্দ্র তাঁর বিপক্ষেও কি কাজ করত না? কিন্তু এঁরা সকলে রামানুগত কেন? এ প্রশ্নের উত্তরও আমাদের অতিপ্রয়োজনীয়।
ভরত বলছেন ইক্ষ্বাকু বংশে রাজ্য জ্যেষ্ঠানুগত। কিন্তু রাম বলছেন পিতাই সর্বাধিকারী। এবং মাতাও। তাঁরা মিলে যখন তাঁকে বনে দিয়েছেন, ভরতকে রাজ্য, তখন তার অন্যথা উচিত কাজ নয়। এ সব কথার মধ্যেই এখানে দশরথের মৃত্যুর পরে রামের তর্পণের ভাবনাটি আসে। ভরতের উপস্থিতিতেই সে কার্য সম্পন্ন হয়। সে কথার আলোচনা আমরা পরের অঙ্কে করব। কিন্তু অন্য একটি কথার আলোচনা আমাদের করতেই হবে। তা হল রাম-জাবালি সংবাদ। ভরতের অনুরোধ যখন কাজ করছে না তখন আসরে এলেন জাবালি।
ইনিই কি সেই সত্যকাম জাবাল? প্রচলিত পাঠ থেকে সে সম্পর্কে নিঃসংশয় হওয়া সমস্যার। যাই হোক, জাবালি এবং রামের সংবাদটি আমাদের অত্যন্ত আগ্রহের বিষয়। এই আলোচনা থেকে আমরা বাকীদের এই রামভক্তির কয়েকটি কারণ অবশ্যই অনুধাবন করতে পারব। জাবালি রামকে জীবনধর্ম বোঝাচ্ছেন। তাঁর দার্শনিক প্রস্থানভূমিটিকে আমরা পরে বুঝবো। আগে শুনে নিই তাঁর কথা। তিনি বলছেন পিতা-মাতা ইত্যাদি সম্পর্কের প্রতি যার স্নেহাসক্তি, সে উন্মত্ত। কেন? কারণ জীব একাকী আসে, একাকী যায়! যেমন প্রবাসে যাবার সময় কেউ গ্রামের বাইরে অবস্থান করে, আবার পরদিন সেই স্থান ত্যাগ করে, এই সব সম্পর্কও তেমনই। এখানে আমাদের শঙ্করাচার্য রচিত বলে কথিত ‘মোহমুদ্গর’ মনে পড়াই স্বাভাবিক।
“কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ সংসারোহয়মতীববিচিত্রঃ।
কস্য ত্বং বা কুতঃ আয়াতঃ তত্ত্বং চিন্তয় তদিদং ভাতঃ।।”
“কে তোমার স্ত্রী? কেই বা তোমার সন্তান? এই সংসার হল অতীব বিচিত্র। তুমি কার? তুমি কোথা থেকে এসেছ? তত্ত্ব সহকারে এই বিষয়ে চিন্তা করে দেখ।”
আশ্চর্যজনক হল এইখান থেকে জাবালির প্রস্থানগতি। জাবালি, সম্পর্ক এমনই অনর্থক বলে রামকে বলছেন দশরথের কথায় গুরুত্ব না দিতে। অযোধ্যায় ফিরে শাসন করতে। শুধু তাই নয়, পুরুষতন্ত্রের যে মূল, সেই পিতার প্রাধান্যকেই জাবালি পাল্টে দিচ্ছেন। বলছেন, লোকে বলে পিতা জন্মে নিমিত্তমাত্র। মাতা বরং ঋতুকালে গর্ভে যে শূক্রশোণিত ধারণ করেন তাই জীবোৎপত্তির উপাদান। অতএব পিতা নয়, মাতাই প্রধান। এই অংশটি থেকে এই জাবালিকে সত্যকাম জাবালি বলেই সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক। এমন স্পষ্টবাক্যে মাতৃপ্রাধান্য ঘোষণা মহাকাব্যে খুব একটা শোনাই যায় না। তাছাড়া এ তো একেবারেই পুরুষপ্রাধান্যকে দ্বন্দ্বে আহ্বান করছে। সে কাজ করেই জাবালি থামছেন না। বলছেন যারা প্রত্যক্ষসিদ্ধ পুরুষার্থ ত্যাগ করে ধর্ম নিয়ে থাকে তাদের নিয়ে তিনি চিন্তিত। ইহলোকে বিবিধ যন্ত্রণা লাভ করে অন্তে মহাবিনাশ প্রাপ্ত হয় তারা। তীব্র ব্যঙ্গ করছেন পিতৃদেবতার উদ্দেশ্যে করা শ্রাদ্ধকে। অষ্টকা শ্রাদ্ধ করে কি সিদ্ধি? ধরা যাক কেউ প্রবাসে গেছে। তাঁকে স্মরণ করে যদি এক ব্যক্তিকে আহার করানো হয় তাহলে কি প্রবাসীর ক্ষুধানিবৃত্তি ঘটে? তাহলে শ্রাদ্ধে অন্ন নষ্ট ছাড়া আর কী হয়? দেবপূজা, যজ্ঞ, দান ও তপস্যা ইত্যাদির বিধান যে সমস্ত শাস্ত্রে আছে, লোককে বশীভূত করার জন্য ধীমান মানুষেরা সে সব রচনা করেছে। অতএব পরলোকধর্ম বলে কোনো ধর্মই নেই। সুতরাং, রাম যেন প্রত্যক্ষের অনুষ্ঠান করেন, পরোক্ষের অননুসন্ধান করেন। সবার কথামতো অযোধ্যার রাজ্যভার গ্রহণ করেন।
জাবালির এই কেউ কারো নয় থেকে পরলোক, শাস্ত্র, আচার সবকে উড়িয়ে দেওয়া এক অতি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক প্রতর্ক। একাধারে তিনি মায়াবাদীদের রাস্তাকে ব্যবহার করছেন। আবার প্রত্যক্ষ প্রমাণকে অবলম্বনও করছেন প্রবাসীর খাদ্যের কথায়। বলেই দিচ্ছেন শাস্ত্র কিছু মানুষের তৈরী করা বিষয়, অন্যদের বশীভূত করার জন্য। মায়াবাদীর থেকে চার্বাক জাতীয় দর্শনের একত্রে দেখা মিলছে। এবং একটি সন্দেহও জন্মাচ্ছে, নিতান্তই বস্তুগত ভাবে এ তো সত্যই জীবের জন্ম তার দ্বারা নির্ধারিত হয় না। মৃত্যু বরং নির্ধারিত হতে পারে আত্মহত্যা ইত্যাদির দ্বারা। তাহলে প্রাচীন লৌকিক দার্শনিকেরা নিশ্চয়ই এইটি লক্ষ্য করেছিলেন। সংসার ইত্যাদি সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার প্রয়োগও নিশ্চিত করেছেন। তার থেকেই কি পরবর্তীতে মায়াবাদে গিয়েছে এই ভাবনা? আবার জাবালির বক্তব্যে দেখার বিষয় শরীরবিজ্ঞানের ধারণাও। স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তখনই মানব প্রজননের পদ্ধতি। তাকেও দার্শনিক-রাজনৈতিক অভিপ্রায়ে ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। মহাকাব্যের মূলগত দর্শনের সঙ্গে এর যে বিবাদ আছেই তা বলাই বাহুল্য।
সেই বিবাদই ফুটে ওঠে রামের কথায়। রাম উত্তরের প্রথম অংশে দীর্ঘ বাক্যে একে খণ্ডণ করছেন যুক্তিগুলির একটিকেও সরাসরি খণ্ডণ না করে। একটি কথাই তিনি বলছেন যা অসম্ভব গুরুত্বের। বলছেন রাজা যেমন হবে প্রকৃতি (বা প্রজাপুঞ্জ) তেমনই আচরণ করবে। রাম যদি এভাবে সমাজ-সংসারকে দেখেন প্রজারাও তাই দেখবে। পরের অংশ শুরু করছেন রাজত্বের কথা দিয়েই। তাঁর কথায় অনাদি শাস্ত্রসিদ্ধ দয়াপ্রধান রাজত্ব স্বয়ংসত্য। এ জন্য লোকে রাজাকে সত্যস্বরূপ বলে চিহ্নিত করে থাকে। এরপরে দীর্ঘ বাক্যে রাম আবার সত্য (যা এই রাজা, বেদ এ সব অবলম্বন করে থাকে) তার গুণাখ্যান জানাচ্ছেন। সেই আধ্যাত্মিক সত্যপালনই সর্বশ্রেষ্ঠ জানাচ্ছেন। তারপরে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পথগুলিকে মহিমান্বিত পথ বলে জানাচ্ছেন। সঙ্গে জাবালিকে জানাচ্ছেন বৌদ্ধ যেমন তস্করের ন্যায় দণ্ডনীয়, নাস্তিকেরও তেমন দণ্ড হওয়া উচিত। দশরথ যে জাবালিকে যাজকত্বে নিয়োগ করেছেন তার কঠোর নিন্দা করেন রাম। এবং জাবালির উত্তরটিও কৌতুহলজনক। তিনি বলছেন সময় বিশেষে তিনি আস্তিক, সময় বিশেষে নাস্তিকের ন্যায় আচরণ করেন। রামকে ফেরাতে নাস্তিকের আচরণ করছিলেন, রাম অসন্তুষ্ট বলে সে আচরণ ফিরিয়ে নিয়ে তিনি আস্তিক হলেন।
দেখার বিষয় এই যে, রাম জাবালির একটি তর্ককেও, হেতুবাদ বলে রাম যাকে চিহ্নিত করছেন, আসলে খণ্ডণ করেননি। বরং বেদাদি শাস্ত্র এবং দেবতার থেকে রাজা রাজত্ব প্রাপ্ত হয় বলে তা সত্য – এই দর্শনে চলে গিয়েছেন। এই দর্শনকে সামান্য বাড়ালেই রাজা ঈশ্বরের সন্তান হয়ে ওঠে। নিজেই বলছেন রাজাকে প্রজা সত্যস্বরূপ বলে চিহ্নিত করে থাকে। রাজা যদি এভাবে সত্যস্বরূপ বলে মেনেই নেওয়া হয় তাহলে অত্যাচারী রাজার অত্যাচারও সত্য বলে মেনে নিতে হবে। রামের আদত সমস্যা হচ্ছে, যদি জাবালির পরামর্শে তিনি অযোধ্যায় ফেরেন, তাহলে প্রজারাও তো শাস্ত্র-আধ্যাত্ম এ সব মানবে না। সেক্ষেত্রে অনাদি শাস্ত্র থেকে প্রাপ্ত রাজত্বকেই বা সত্য বলে মানবে কেন? রাজাকে তাদের মাথা বা ঈশ্বরপ্রতিম বলেই বা মানবে কেন?
রাজা যতটা পেশীর জোরে (সৈন্যাদি) শাসন করেন, তার চেয়েও বেশী শাসন করেন শাস্ত্র ও শাস্ত্রপরিচালক যাজকদের দ্বারা। ইহলোকে পাপের (রাজদ্রোহও পাপ) শাস্তি রাজা না দিতে পারলেও পরলোকে শাস্তি হবে। তার সঙ্গে পুনর্জন্মেও শাস্তি হবে। শাস্তির এই দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং ভয়কে প্রজার মগজে ঠেসে দিতে না পারলে রাজ্য পেশীশক্তিতেই শুধু চালাতে হয়, যা অসম্ভব কঠিন কাজ। সুতরাং রাজা হতে গেলেও রামকে ব্যবস্থাটি বজায় রেখেই রাজা হতে হবে। জাবালির পন্থায় রাজা হলে সর্বনাশের রাস্তাও খোলা হয়ে যাবে।
তাছাড়া প্রচলিত পাঠে যে নানা হস্তক্ষেপ হয়েছে তার মধ্যে বৌদ্ধঘৃণার নমুনাও এখানে আমরা পাচ্ছি। সঙ্গে পাচ্ছি নাস্তিকদের প্রতি (যারা বেদ মানেন না এই অর্থে নাস্তিক, আজকের নিরীশ্বর অর্থে নয়) ঘৃণাও। বর্ণাশ্রম, ব্রাহ্মণ্যবাদ, স্বর্গ-নরক-পরজন্ম ইত্যাদি এ সব কিছুই এরা মানে না। অতএব এই ধরণের রাজত্বে এঁরা অন্যতম শত্রু তখনই।
এই বিতর্কে বশিষ্ঠ অংশ নেবেন এরপরে। বিতর্ককে ধামা চাপা দিয়ে তিনি সোজা ইক্ষ্বাকু বংশের রাজত্বের অধিকার যে একেবারে ব্রহ্মা ও মনুর সূত্রে পাওয়া সে তত্ত্বকে খোলসা করে বলবেন। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য ধর্মের যা আদর্শ আচরণ তার জন্যই রামের চরিত্রটিকে নির্মাণ করা হয়েছে। জাবালির দার্শনিক তর্ক আসলে রামের আরেক পরীক্ষা ব্রাহ্মণ্য ধর্মে ও সংস্কারে নিষ্ঠার প্রতি। সুতরাং নানা স্তরের শাসকেরা এবং রামের ইক্ষ্বাকু গোষ্ঠী (যাঁদের এই ব্রাহ্মণ্য ধর্মমত), নানা মুনিরা রামভক্ত হবেন তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। ফলে ভরত রাজ্য সরাসরি চাইলে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়তেন যা অতিক্রম করা অসম্ভবই ছিল প্রায়।
স্বাভাবিক ভাবেই নাটককার, প্রচলিত রামায়ণের এই সব অংশকে তাঁর রচনার অন্তর্ভূক্ত করেননি। এই অংশের দৈর্ঘ্য নাটককে বিঘ্নিত করত। এ ছাড়াও এতে তাঁর যে মূল পরিকল্পনা তা ক্ষতিগ্রস্ত তো হতই, সঙ্গে অন্য দার্শনিক ধারণার সঙ্গে দর্শকের পরিচয় ঘটতেও পারতো, যা ব্রাহ্মণ্য পরিসরের জন্য ক্ষতিকর হত সম্ভবত। অতএব ভরত সোজা রাম সন্নিধানে চলে আসছেন এবং পাদুকা নিয়ে ভ্রাতৃকর্তব্য ব্রাহ্মণ্য মতানুসারে ও আদর্শ সম্পদ বন্টনের মতানুসারে করে চলে যাচ্ছেন। ভরতের সাক্ষাতে তর্পণ, পিণ্ডদান এ সব ঘটছে না। ঘটছে তাঁর অনুপস্থিতিতে নাটকের পঞ্চম অঙ্কে। কেন জানব অবশ্যই। তার সঙ্গে পুরুষের দর্প এবং সংস্কারের সম্পর্ককেও আমরা কিছুটা দেখে নেব পরবর্তী অঙ্কে।
[ক্রমশঃ]
Posted in: ARTICLE, May 2021 - Serial