বামপন্থার নেতিকরন ও আমাদের ভবিষ্যৎ : সুজন ভট্টাচার্য
পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে বামপন্থীদের আসন শূন্য হয়ে যাওয়ায় অনেকে আহত হয়েছেন, অনেকে হতোদ্যম হয়েছেন। আবার কেউ কেউ প্রবল উল্লসিত তো বটেই। ১৯৪৬ সাল থেকে এই প্রথম বিধানসভায় বামপন্থী প্রতিনিধিত্ব নেই ভেবে অনেকেই খুব মুষড়ে পড়েছেন। পরাজিত বামপন্থী প্রার্থীদের কেউ কেউ প্রকাশ্যেই মুখ খুলেছেন তাদের পার্টি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। বলেছেন, নেতৃত্বের রণকৌশল ও বিশেষ করে আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে জোট গঠনকে মানুষ মেনে নিতে পারেননি। তাই তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তাই এমন বিপর্যয় এক অনিবার্য পরিণতি। সব মিলিয়ে এমন ঘটনায় আলোড়ন পড়েছে। কিন্তু সত্যিই কি বামপন্থার বিপর্যয় ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গের ভোটে? তাহলে একবার বামপন্থা শব্দটার উৎপত্তি আর বিবর্তনের ইতিহাসটা ফিরে দেখা যাক।
বামপন্থা ও থার্ড এস্টেট
অন্য অনেক রাজনৈতিক পরিভাষার মতই বামপন্থী শব্দটারও জন্ম হয়েছিল ফ্রান্সে, মোটামুটি ফরাসী বিপ্লবের হাত ধরে। ১৭৮৯ সালে মে মাসে আহুত হল এস্টেটস জেনারেল। সেখানে তিনটি স্তর। ফার্স্ট এস্টেট হল যাজকদের প্রতিনিধিরা, সংখ্যায় ৩০৩। সেকেন্ড এস্টেট মানে ভূস্বামীদের প্রতিনিধিদের সভা, সদস্য সংখ্যা ২৯১। আর থাকল থার্ড এস্টেট, অবশিষ্ট জনগণের ৬১০ জন প্রতিনিধি। বোঝাই যাচ্ছে, সাধারণ মানুষদের প্রতিনিধিত্ব অভিজাত এবং ধর্মযাজকদের থেকে সামান্য হলেও বেশি। কিন্তু তিনটি কক্ষ আলাদা আলাদা ভাবে আলোচনায় বসত এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত। ফলে থার্ড এস্টেটের কোন সিদ্ধান্তে অন্য দুটি কক্ষের অন্তত একটির সমর্থন না জুটলে সেটি আর কার্যকর হবার উপায় ছিল না। পাশাপাশি ছিল রাজার ভেটো দেবার অধিকার। তিনটি কক্ষ একযোগেও কোন সিদ্ধান্ত নিলে সেটি খারিজ করে দেবার অধিকার ছিল রাজার। প্রথম থেকেই থার্ড এস্টেটের একাংশ সদস্য রাজার ভেটো ক্ষমতার প্রবল বিরোধী ছিলেন। ঘটনাচক্রে এরা বসতেন এস্টেটস জেনারেলের সভাপতিমণ্ডলীর বাঁদিকে। সেই থেকেই লেফটি শব্দের জন্ম। অর্থ যারা রাজার ভেটো ক্ষমতার বিরোধী।
১৭৯২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর এস্টেটস জেনারেলের পরিবর্তে গঠিত হল ন্যাশনাল এসেম্বলি। রাজতন্ত্রের অবসান হয়ে ফ্রান্স ঘোষিত হল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে। কিন্তু রাজতন্ত্র বনাম প্রজাতন্ত্রের সমর্থকদের লড়াই অব্যাহত থাকল। লেফটিরা তখন প্রজাতন্ত্রের উদগ্র সমর্থক। ঘটনাচক্রে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সভাতেও তাদের আসন ছিল স্পিকারের বাঁদিকেই। ফলে রাজার ভেটো ক্ষমতার বিরোধিতা থেকে বামপন্থা শব্দটির নতুন অর্থ হয়ে দাঁড়াল রাজতন্ত্রের বিরোধিতা, গণতন্ত্রের সমর্থন। ফরাসী বিপ্লবকে দমন করার জন্য প্রাশিয়া, অস্ট্রিয়া সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাজারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু ১৮৪৮ সালে ইউরোপের দেশে দেশে বয়ে গেল বিপ্লবের ঢেউ। ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া ভেসে গেল বিপ্লবের জোয়ারে। বেঁচে গেল রাশিয়া। আর ইংল্যান্ড দেখল চার্টিস্ট আন্দোলন যা পরবর্তীকালের গণতান্ত্রিকতা প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ। বামপন্থী শব্দটা আর ফ্রান্সে আটকে রইল না। দেশে দেশে যারাই রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ চাইছেন, তারাই অভিহিত হতে শুরু করলেন বামপন্থী বলে।
ফ্রান্সে বিপ্লব জয়ী হল ঠিকই। কিন্তু পরাজিত হল সর্বত্রই। প্রাশিয়া বা অস্ট্রিয়ায় রাজারাই উদ্যোগ নিলেন জনগণের প্রতিনিধিসভা কিংবা সংবিধান তৈরি করার আন্দোলনকে ঘুলিয়ে দেবার। বৃটেনের চার্টিস্ট আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে এল ১৮৬৭ সালের রিফর্মস অ্যাক্ট। এই প্রথম বৃটেনে ভোটাধিকার পেলেন পুরুষ শ্রমজীবীদের একাংশ। খাজনা বাকি থাক আর নাই থাক, প্রতিটি বাড়ির গৃহকর্তার নাম উঠল ভোটার তালিকায়। স্বভাবতই শ্রমজীবীদের রাজনৈতিক ভূমিকা পালনের আকাঙ্ক্ষা ক্রমাগত বাড়তে শুরু করল। যতই সীমাবদ্ধ চরিত্রেরই হোক না কেন, বিভিন্ন দেশে সংসদের ধাঁচের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল। শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধিরাও স্থান পেয়ে গেলেন। এবং স্বভাবতই তারা রাজতন্ত্র কিংবা ক্ষমতাশালীদের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু অংশ। ফলত স্পিকারের বাঁদিকেই তাদের স্থান নির্ধারিত, বিরোধীপক্ষ হিসাবে। অর্থাৎ বামপন্থী শব্দটার নতুন অর্থ হয়ে দাঁড়াল শাসকবিরোধী গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন গোষ্ঠী।
বামপন্থার শ্রেণী-চরিত্র
ফ্রান্সের বামপন্থীদের মধ্যে প্রথম সংগঠিত শক্তি ছিলেন Jacobin অর্থাৎ জাকব্যাঁ-রা। ১৭৮৯ সালেই এই সংগঠন তৈরি হয়েছিল। জ্যাকবাঁ-দের একাংশ আবার জিঅন্দ্যাঁ (Girondins) নামে সংগঠিত হন যাদের জনপ্রিয় নেতা ছিলেন জাঁ পল মারাত। আবার একইভাবে লা মঁতেন (Montagnards) নামে আরেকটি বামপন্থী গোষ্ঠীরও জন্ম হল প্রায় একই সঙ্গে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছাড়া বামপন্থীদের মধ্যে তখনো অন্য কোনো মতাদর্শগত মিলনের ভিত্তি ছিল না। পারস্পরিক সংঘাত ছিল চরম তীব্র। ১৭৯০ থেকে ১৭৯২ পর্যন্ত জিঅন্দ্যাঁ ও মঁতেনদের ধারাবাহিক সংঘর্ষ সেই কথাই প্রমাণ করে। কিছুদিন পরে যাবতীয় বামপন্থীদের পরিচিতি হয়ে দাঁড়ায় রিপাবলিকান অর্থাৎ প্রজাতন্ত্রী। সমাজতন্ত্র শব্দটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠল আরো পরে। ফ্রান্সের অঁরি দ্য সে-সিমো সমাজকে অলস ও শ্রমজীবী, এই দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত বলে ব্যাখ্যা করেন। সম্ভবত তিনিই প্রথম তাত্ত্বিক যিনি অলস শ্রেণীর উচ্ছেদ করে শ্রমজীবীদের নেতৃত্বে সমাজ গড়ে তোলার আহ্বান রাখেন। এই প্রথম শ্রমজীবীদের আন্দোলনের একটা তাত্ত্বিক দিশা পাওয়া গেল। সে-সিমো অবশ্য সেই তত্ত্বের নাম দিয়েছিলেন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিজম। যাই হোক, পরবর্তীকালে কার্ল মার্কস তাঁকেই ইউটোপিয়ান সমাজতন্ত্রের পুরোধা বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। সিন্ডিক্যালিজম, অ্যানার্কিজম ইত্যাদি নানান মতবাদও তখন বামপন্থী মহলে রাজত্ব করে যাচ্ছিল।
১৮৪৮ সালে কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস প্রকাশ করলেন কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো। শ্রেণী ও শ্রেণী সংগ্রামের ধারণা এই বইটিতে খুব স্পষ্ট হয়ে উঠল। এমন কিন্তু নয় যে মার্কস ও এঙ্গেলসই প্রথম শ্রেণী বা শ্রেণী সংগ্রামের কথা বলেছিলেন। শ্রেণী সংগ্রামের পরিণতিকে তাঁরা শ্রমিকশ্রেণীর শাসন পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। ১৮৫১ সালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট লুই নেপোলিয়ন নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করলেন। এবং তদানীন্তন বামপন্থীদের মধ্যেই প্রচুর সমর্থক জুটে গেল তার। এই বিশ্বাসঘাতকতার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কস এবং এঙ্গেলস প্রজাতন্ত্রবাদ ও ইউটোপিয়ান সমাজতন্ত্রের যাবতীয় ধারণাকে শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের শত্রু হিসাবে ঘোষণা করেন। ১৮৬৪ সালে গঠিত হল আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সংঘ, যা প্রথম আন্তর্জাতিক নামেই পরিচিত। এই সময় থেকেই বামপন্থী বলতে মূলত সমাজতন্ত্রীদেরই বোঝানোর সূত্রপাত হল। ইতিমধ্যে ঘটে গেল প্যারি কমিউন, ১৮৭২ সালে। প্যারি কমিউনের নেতৃত্বের মধ্যে মার্কসপন্থীরা আদপেই ছিলেন না। কিন্তু সেই আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে মার্কস সৃষ্টি করলেন নতুন পরিভাষা ‘সর্বহারার একনায়কত্ব’। মার্কসের সঙ্গে মিখাইল বাকুনিনের অ্যানার্কিস্ট তত্ত্বের সংঘাতে ১৮৭৬ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক ভেঙে গেল। ১৮৮৮ সালে গড়ে উঠল দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক। পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন মার্কস। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কিন্তু শুরু থেকেই মার্কসের মতবাদকে তাদের আদর্শ বলে ঘোষণা করল।
বামপন্থী কারা
তাহলে কি মার্কসবাদীরাই বামপন্থী? বাকিরা অপাংক্তেয়? কিংবা উল্টোটা? এমন স্পষ্ট বিভাজন করা কিন্তু সত্যিই মুশকিল। কারণটা লুকিয়ে আছে শব্দটার উৎপত্তির ভিতরেই। প্রচলিত ব্যবস্থার বিরোধিতা কিংবা ক্ষমতার স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের বিরোধিতাও সেই উৎপত্তিয় অর্থে বামপন্থা। হ্যাঁ, স্পিকারের বাঁদিকের বসার বন্দোবস্তও অবশ্যই আছে। আর আছে, আরো সুনির্দিষ্ট অর্থে শ্রমজীবী মানুষের আশাআকাঙ্খার প্রতিনিধিত্ব করার প্রশ্ন। বিষয়টাকে একটু বাস্তব উদাহরণের সাপেক্ষে বিচার করা যাক। আমরা যারাই স্কুলপাঠ্য ইতিহাস পড়েছি, তারাই জানি কংগ্রেসের মধ্যে সুভাষচন্দ্র, জওহরলাল কিংবা রাম মনোহর লোহিয়াকে বামপন্থী বলেই বিবেচনা করা হত। বিপরীতে বল্লভভাই বা রাজেন্দ্রপ্রসাদ ধরা হত দক্ষিণপন্থী হিসাবেই। কেন? মুখ্যত কারণ এটাই যে সুভাষ-নেহরু-লোহিয়ারা সরাসরি না হলেও সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণার কথা বলতেন, কৃষক-শ্রমিক ও দরিদ্র মানুষদের উত্থানের পথ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতেন।
কিন্তু এখানেও একটা মজার বিষয় আছে। নানান ধাঁচের সমাজতান্ত্রিক ভাবনা মাথায় থাকলেও সুভাষ-নেহরু কিংবা লোহিয়া কিন্তু প্রত্যক্ষত কোনো শ্রমিক বা কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেননি। হ্যাঁ, ১৯২৮ ও ১৯২৯ সালে যথাক্রমে নেহরু ও সুভাষচন্দ্র অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। মাথায় রাখতে হবে, ১৯৪৭ সালের ২ মে পর্যন্ত এটাই ছিল ভারতের একমাত্র ট্রেড ইউনিয়ন। আবার ১৯৩৬ সালে সাড়া ভারত কিষাণ সভা গঠিত হলেও সেখানে কিন্তু কংগ্রেসের নেতৃত্ব সামিল হননি, এমনকি বামপন্থী বলে যারা পরিচিত, তারাও নন। মূলত কমিউনিস্ট ও কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টিরই ভূমিকা ছিল প্রধান। অন্যদিকে দক্ষিণপন্থী বলে পরিচিত বল্লভভাই প্যাটেল ছিলেন কিন্তু বরদৌলি সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রধান সংগঠক। ফলে অঙ্কটা খুব জটিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে তো বটেই। আর দু বছর পরে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের সভাপতি হয়ে স্বাধীন ভারতের যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কাজে হাত দেন সেখানে এক ধরণের সমাজতান্ত্রিক ভাবনার পরিচয় অবশ্যই পাওয়া যায়। তাতে আবার চরম বিরক্ত হন বল্লভভাই। এমনকি গান্ধীর নাম ব্যবহার করে সুভাষের বিরুদ্ধে ঘোঁট পাকাতেও তাঁর আটকাল না।
ব্যঞ্জনার বিবর্তন
পুরনো দিনের কথা আর টেনে লাভ নেই। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লবের পর থেকেই বিশ্বজুড়ে বামপন্থী আন্দোলন মূলত দুটো শিবিরে ভেঙে গেল, কমিউনিস্ট ও অকমিউনিস্ট সমাজতন্ত্রী। পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট ভাবনার মধ্যেও এল নানান ভাঙন। ফলত ব্যানারসূত্রে যারা কমিউনিস্ট, সেই শিবিরও বামপন্থী আর অতিবামপন্থী, দুটো মোটা দাগে চিহ্নিত হয়ে গেল। বামপন্থীরা সংসদীয় ব্যবস্থাকে ব্যবহার করার পক্ষপাতী। আর অতি-বামরা মনে করেন শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির সংগ্রামে সংসদীয় লড়াইয়ের কোনো ভূমিকা নেই। আবার অকমিউনিস্ট সমাজতন্ত্রী শিবিরেও এল নতুন নতুন মাত্রা। কারো পরিচয় উদারপন্থী, কেউ পরিবেশের উপর বাণিজ্যিক আঘাতের বিরোধী, কেউ আবার যুদ্ধ ও সামাজিক ভেদাভেদের বিরোধী। মোদ্দা কথা, সমাজের বুকে ঘটে চলা নানা ধরণের অসাম্য এবং অত্যাচারের যারা বিরোধী, তারাই আজকের অকমিউনিস্ট বামপন্থী। অন্যদিকে কমিউনিস্ট শিবিরের যে বাম ও অতিবাম বিভাজন, সেখানেও চলে এল নতুন মাত্রা, ভাবনার বিবর্তন।
১৯৫৭ সালে কেরালায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নির্বাচনী সাফল্য এক নতুন চিন্তার সূত্রপাত করে দিল। সংসদ ও বিধানসভাকে ব্যবহার করে জনগণের মুক্তির পথসন্ধান সম্ভব কিনা, সেই নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেল। ঘটনাচক্রে ১৯৫৬ সালে রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক নিকিতা ক্রুশ্চেভ শান্তিপূর্ণ উত্তরণের তত্ত্ব হাজির করেন। নতুন তত্ত্বের সমর্থক ও বিরোধীরা বিশ্বজুড়েই আলাদা আলাদা শিবিরে বিভাজিত হয়ে গেলেন। ভারতও তাঁর ব্যতিক্রম ছিল না। কেরালা ভারতে ক্রুশেভের তত্ত্বের সমর্থকদের হাতে বাস্তব উদাহরণ তুলে দিল। মজা হচ্ছে, দুপক্ষের বিতর্কে পার্টি যখন প্রকাশ্যে না হলেও বাস্তবত আড়াআড়িভাবে দু টুকরো, তখন ক্রুশ্চেভের বিরোধীরা পরিচিত হচ্ছেন বামপন্থী সিপিআই বলে, সমর্থকদের পরিচিতি তখন দক্ষিণপন্থী সিপিআই। ভাবুন, কমিউনিস্ট পার্টির একটা অংশ সরাসরি দক্ষিণপন্থী বলে বিবেচিত হচ্ছে। অর্থাৎ সেই মুহূর্তে বামপন্থার অর্থ হয়ে দাঁড়াল নির্বাচনের উপর নির্ভরশীলতার বিরোধিতা।
অতি-বাম যারা তাদের স্থান এই আলোচনায় স্বাভাবিকভাবেই নেই। থাকল পড়ে বামপন্থী কমিউনিস্টরা, অর্থাৎ মূলত সিপিআইএম। সিপিআইএম সরাসরি প্রথম নির্বাচনে লড়ে ১৯৬৭ সালে, খাদ্য আন্দোলনের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে। অবশ্য ‘দক্ষিণপন্থী’ কমিউনিস্টরাও খাদ্য আন্দোলনের শরিক ছিলেন। কিন্তু নির্বাচনী জোট ছিল আলাদা। যদিও নির্বাচনের পরে সিপিআইএম নেতৃত্বাধীন এলডিএফ ও সিপিআই পরিচালিত ইউডিএফ একযোগে যুক্তফ্রন্ট সরকার গড়ল। অঙ্কটা খুব স্পষ্ট। নির্বাচনী জোট না হবার কারণ নিশ্চয়ই মতাদর্শগত বিরোধিতাই ছিল। কিন্তু সরকার গড়ার তাগিদে সেই বিবাদ আর রইল না। বোঝা গেল, সংসদীয় প্রয়োজনে বিবাদবিতর্ক ভুলে থাকা যায়। যুক্তফ্রন্ট সরকারের আয়ু অবশ্য বেশিদিন হল না, মূলত আভ্যন্তরিন ঝামেলার কারণে। ১৯৬৯ সালের দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের ক্ষেত্রেও তাই। আর তারপর ১৯৭৭, নিখাদ বামপন্থীদের একচ্ছত্র ক্ষমতা, প্রথম বামফ্রন্ট সরকার।
প্রথম ও দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের অভিজ্ঞতার শিক্ষায় বামফ্রন্ট সরকার প্রথমেই রাশ টেনে দিলেন গণ আন্দোলন, শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের উপরে। নিপীড়িত মানুষের অভিভাবকত্বের দায় তো তারাই মাথায় নিয়ে রেখেছেন। যে ছক তারা কষে দেবেন, সেটাই মেনে চলতে হবে। সেই ছকের বাইরে গিয়ে কেউ যদি আন্দোলনের চেষ্টা করে, তাকে দাগিয়ে দেওয়া হল বামফ্রন্ট সরকারকে উত্যক্ত করার চক্রান্ত হিসাবে। ৮০ সালের পরে ‘বামফ্রন্ট সরকারকে চোখে মণির মত রক্ষা করা’র শ্লোগান হয়ে উঠল মূল রণধ্বনি। কিন্তু কেন তাকে রক্ষা করতে হবে? কারণ এই সরকার বেকার ভাতা, বিধবা ভাতা, ভূমিহীনদের জমির পাট্টা দেওয়ার মত বেশকিছু কাজ করে যাচ্ছে যা গরিব মানুষকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করছে। সীমাবদ্ধ ক্ষমতার মধ্যে জনগণকে রিলিফ দেবার কর্মসূচিই হয়ে উঠল প্রচারের কেন্দ্রিয় বিষয়। অর্থাৎ বামপন্থার নতুন অর্থ হয়ে দাঁড়াল সরকারি ক্ষমতাকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে কিছু রিলিফ দেবার বন্দোবস্ত করে দেওয়া। আর সেই সূত্রে সরকারিভাবে ভারতে বামপন্থার অর্থ দাঁড়িয়েছে এখন এটাই।
বাম না অবাম
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে আদৌ কোনো বামপন্থী জোট প্রার্থী হিসাবে ছিল কিনা, সেই বিতর্কের পরিসর অন্য। যদি থাকে, তাহলে তাদের বিপর্যয় কেন হয়েছে, সেটা তাদেরই বিবেচ্য। আমরা অন্যভাবে বিষয়টাকে বোঝবার চেষ্টা করি। সবাই জানতেন, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে দুই প্রবল প্রতিপক্ষ ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি। বাকিরা কেউই মূল বৃত্তের ধারেকাছে ছিলেন না। নির্বাচনের ফলাফলে সেটা বোঝাও গেছে। এই আলোচনায় বিজেপিকে নিয়ে ভেবে লাভ নেই। কারণ ভারতের যাবতীয় রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিজেপি যে চরম ফ্যাসিবাদী চরিত্রের প্রতিনিধি, সেই নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। তাহলে থাকল পড়ে তৃণমূল। তৃণমূল যে আসলে মমতা ব্যানার্জী নামক জনপ্রিয় নেত্রীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একটি দল, সেই ব্যাপারে দ্বিধা আছে, সম্ভবত এমন একজনও নেই। এখন প্রশ্ন হল, তৃণমূল দলটির রাজনৈতিক চরিত্র কী? সেকি দক্ষিণপন্থী? নাকি বামপন্থী?
তৃণমূল দলটি কংগ্রেস ভেঙেই বেরিয়ে আসা। ফলে উৎসগত বিচারে তারও পরিচিতি দক্ষিণপন্থী হিসাবেই। কিন্তু দক্ষিণপন্থার যেমন বিবর্তন হতে হতে ভারতে ফ্যাসিবাদী আকার নিয়েছে, বামপন্থারও সংজ্ঞা ও চরিত্রের পরিবর্তন হয়েছে। আমরা আগেই আলোচনা করেছি, ১৯৮০-র পর থেকেই ভারতে বামপন্থা মানে জনগণকে রিলিফ দিয়ে খানিকটা স্বস্তিতে রাখার রাজনৈতিক কার্যক্রম। রিলিফের বহরে তৃণমূল সরকার সাতখানা বামফ্রন্ট সরকারকে ইতিমধ্যেই টেক্কা দিয়েছে। কন্যাশ্রী থেকে শুরু করে দু টাকার চাল হয়ে বিনামূল্যের রেশন, সবুজসাথীর সাইকেল ইত্যাদির কথা সবাই জানেন। আর নির্বাচনের মুখে মুখে এল স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প আর দুয়ারে সরকার। পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বিনা পয়সায় চিকিৎসার সুযোগ পেলেন পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীরা। অনেকটাই হয়তো প্রচার, কিন্তু কেউ কেউ যে সেই সুযোগে খানদানি বেসরকারি হাসপাতালেও চিকিৎসা করাতে পেরেছেন বিনামূল্যে, সেটাও বাস্তব। আর স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে পরিবারের প্রধান হিসাবে মহিলাদের নাম রাখা এক যুগান্তকারী ঘটনা। বাংলার ‘নিজের মেয়ে’কে চিনিয়ে দেবার তাগিদ নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু এর প্রভাব নির্বাচনের ফল দেখলেই বোঝা যাচ্ছে।
মোদ্দা কথা, সাতটি বাম ফ্রন্ট সরকারের জনতোষিণী কার্যক্রমকেই তৃণমূল সরকার নিখুঁতভাবে অনুসরণ করেছে। হ্যাঁ, এক্ষেত্রে কোনো কোনো অংশকে অবহেলা করে সরকার গুরুত্ব দিয়েছে অন্য কোন জায়গায়। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের চাকরির দাবী নিয়ে এই সরকার ছিনিমিনি খেলেছে। যতটুকু নিয়োগ হয়েছে, সিংহভাগই স্কুলে। আর তার সিংহভাগই হয়েছে মোটা টাকার বিনিময়ে। এমনকি পাবলিক সার্ভিস কমিশনকেও এই সরকার ব্যবসায়ী বানিয়ে ছেড়েছে। কিন্তু শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ক্ষোভ নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা নেই। কারণ সরকার অন্য এক বিশাল ক্ষেত্রকে খুঁজে পেয়েছে, যেখানে বিনিয়োগ করলে ফল আসবে হাতে-গরম। রাজ্যের গ্রামীণ আর শহরের দরিদ্র মানুষের সামনে সরকার একটার পর একটা আকর্ষণীয় প্যাকেজ সাজিয়ে দিয়েছে। না, রিলিফ শব্দটা তৃণমূল দল একবারও উচ্চারণ করেনি। কিন্তু আদতে সেই রিলিফের রাজনীতিই চালিয়ে গেছে। তাহলে তৃণমূলের শ্লোগান যাই হোক না কেন, কর্মসূচি কি বামপন্থী নয়? সেই হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে এবারের নির্বাচনে জয়জয়কার তো বামপন্থারই, অবশ্যই চলতি অর্থে।
তাহলে ভবিষ্যৎ
রিলিফ রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বিচার করলে বামপন্থার বর্তমান তো সুস্থিত-ই। কাজেই তার ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু রিলিফের টার্গেট যারা, তাদের ভিড়ে মিশে গেলে কিঞ্চিৎ অস্বস্তির প্রসঙ্গ তো আছেই। কারণ রিলিফ শব্দটা কানে যত মিষ্টিই শোনাক না কেন, আসলে ভিক্ষে। কোনো বিশেষ দুর্বিপাকের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য রিলিফের দরকার চিরকালই থাকবে। কিন্তু সাধারণ পরিস্থিতিতেও মানুষকে যদি নানাবিধ ডোল দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, কিংবা বাঁচিয়ে রাখার অভিনয় করতে হয়, তাতে মনুষ্যত্বেরই অপমান। ভোটের দায় নিঃসন্দেহে মেটে। ঝুলি উপচে পড়ে জনগণেশের আশীর্বাদে। কিন্তু তাতে রিলিফদাতার প্রশাসনিক ক্ষমতার পরিচয় মেলে না। বিপরীতে রিলিফ পাচ্ছেন যারা, তাদেরও সম্মান বাড়ে না। নাগরিক থেকে তারা পরিণত হন ভিক্ষুকে। বামপন্থার পতাকা উড়িয়েও সেই সত্যকে আড়াল করা যায় না।
আজ যাকে আমরা গণতন্ত্র বলি বা সংসদীয় রাজনীতি, তার বিকাশে কিন্তু সংসদের কোনো ভূমিকা ছিল না। যাবতীয় ভূমিকা ছিল রাস্তার লড়াইয়ের। বামপন্থার ক্ষেত্রেও সেই কথাটাই সত্যি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিল এলিটরা। কিন্তু রাস্তায় সেই লড়াইটা লড়েছিলেন সাধারণ মানুষই। আর ক্ষমতাপ্রাপ্তির পরে তারাই হয়েছিলেন বঞ্চিত। বিশ্বজুড়ে তারা আজও বঞ্চিতই রয়ে গেছেন। বিশ্বপুঁজির মুনাফার হার যত পড়ছে, ততই সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার উপর হানাদারি বাড়ছে। সাধারণ মানুষের সামান্য প্রাপ্তির ঘরে থাবা মেরে নিজেদের পকেট ভরানোর জন্য বহুজাতিক পুঁজি আজ হিংস্র হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রতিটি দেশেরই সরকার দায়িত্ব নিয়ে সেই মহান কর্তব্য পালন করে যাচ্ছে। সেই কারণেই বামপন্থার মুল স্পিরিট আজও প্রাসঙ্গিক। হ্যাঁ, ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থা সংক্রান্ত ধারণার যে বিবর্তন হয়েছে, সেটা একটা বিকৃতি, ক্ষমতার সঙ্গে ঘর করার কৌশল। কৌশলী প্রয়াসে কিছু মানুষের হাল ফেরানো যায়। কিন্তু আপামর মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা কৌশলে হয় না, বিশ্বের ইতিহাস তার সাক্ষী।
বামপন্থা আসলে বঞ্চিত সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার মতবাদ, যদিও হাজারটা মুখ আছে তার। একেকটা মুখের মধ্যে দ্বন্দ্বও আছে। কিন্তু মূলগতভাবে বামপন্থা মানেই আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের বিরোধিতা, সাধারণ গণতন্ত্রের ব্যাপ্তির দাবীকে প্রতিষ্ঠা করা। শুধু শ্লোগানে নয়, লড়াইয়ের ময়দানে। বামপন্থার প্রকৃত ভবিষ্যৎ নিহিত আছে সেই প্রয়াসের মধ্যেই। নির্বাচনী জোট নয়, বামপন্থার উদবর্তনের জন্য তাই প্রয়োজন মানুষের সংগ্রামী জোট।
[লেখক – সমাজকর্মী ও লেখক।]
Posted in: ARTICLE, May 2021 - Cover Story