ব্যক্তিগত সিনেমাটিক : সেঁজুতি দত্ত

[ব্যক্তিগত সিনেমাটিক – সিনেমা সংক্রান্ত নিজের ভাবনাগুলি অথবা প্রতিনিয়ত যা কিছু নিজেকে ভাবাচ্ছে সেগুলিকে সিনেমার রেফারেন্সে ভাবার একটা প্রয়াসে এই কলাম। তাই এই কলামটি যেমন ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক আবার তেমনই ব্যক্তিগত এবং সিনেমাটিকও বটে। সিনেমায় পাওয়া বিশেষ কিছু মুখ নিয়ে লেখা এই কলাম এবং সেই প্রতিকৃতির বাছাই প্রক্রিয়া অবশ্যই ব্যক্তিগত। সেই মুখ সিনেমার, সেই মুখ ব্যক্তিগত এবং সেই মুখ রাজনৈতিক।]

আজকের মুখ – যারা শিরিনকে দেখে

মুখ নিয়ে আলোচনায় আজকের ছবি আব্বাস কিয়ারোস্তামির শিরিন (২০০৮)। এটি এমন একটি ছবি যার প্রায় পুরোটা জুড়ে আছে সিনেমা হলে বসে থাকা মহিলাদের মুখের ক্লোজআপ, মিডশট অথবা টু-শট। সারাটা ছবি জুড়ে এই মুখগুলো খুসরো এবং শিরিনের প্রেমের কাহিনী দেখছে এবং আমরা দেখছি তাদের মুখের ওপর ছাপ ফেলে যাওয়া সেই প্রেমের কাহিনীর প্রভাব, এবং শুনছি ব্যাকগ্রাউন্ডে চলতে থাকা এক মেলোড্রামাটিক উপাখ্যান। ইরানী চলচ্চিত্রের বিভিন্ন অভিনেত্রীদের এবং ফরাসী অভিনেত্রী জুলিয়েট বিনোশের মুখ আমরা দেখতে পাই এই ছবিতে। এই সবকটা মুখ শিরিনের গল্পের ছোঁয়ায় এক আবেগঘন রুপোলী পর্দার প্রতীক হয়ে ওঠে। ‘নারী’ শব্দের উচ্চারণটি যদি অনিশ্চয়তা উদ্রেক করে তাহলে এই ছবি বিশ্বজনীন অনিশ্চয়তার রূপক।

গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের মুখ করে তোলা হয়েছে। সেইদিক থেকে দেখতে গেলে ইরানের অবস্থান প্রান্তিকতারও প্রান্তে কারণ এটি একটি সিয়া শাসিত দেশ। একইসাথে মুসলমান সম্প্রদায়ের ভেতর থেকে সিয়া বিরোধী ক্ষিপ্রতা, এবং একটি ইসলামিক রাষ্ট্র হবার দরুন পৃথিবীর কাছে ভীতির কারণ হয়ে ওঠা, এই দুই প্রান্তিকতার মধ্যেই ইরানের অবস্থান। কিন্তু আমাদের মাথায় রাখতে হয় যেকোন সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যেও প্রান্তিককরণের রাজনীতি চলতে থাকে নিজের মতো করে। ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের স্বৈরাচারী ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা থেকে সরে এসে ইরানের যে ধর্মীয়করণ শুরু হয় তার পুরো আঘাতটা এসে পড়ে দেশের নারীদের ওপরে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে মারজান সাত্রাপি-র লেখা আত্মজীবনমূলক গ্রাফিক নভেল পারসেপলিস-এর (২০০৭) কথা যেখানে একটি ছোট মেয়ের চোখ দিয়ে সেই সময়ের অভিজ্ঞতাকে তুলে আনেন লেখিকা।
শিরিন ছবিটিও সেরকমই কিছু করার চেষ্টা করছে হয়ত কিন্তু সেটা পুরুষ পরিচালকের আত্মজীবনমূলক সন্দর্ভের জায়গা থেকে নয় বরং পারফর্মারের অনুভবক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। ছবিটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ‘সব বুঝে ফেলা’ অথবা ‘বুঝতে না পারার’ কষ্ট ইত্যাদির কারণে পুরুষ পরিচালকের অস্তিত্ব-সম্বন্ধীয় সঙ্কটের নথি হয়ে ওঠে না এই ছবি। একমাত্র সিনেমাটিক ফর্মের নির্লিপ্তির বাইরে আব্বাসের উপস্থিতি প্রায় নগণ্য এই ছবিতে। কিন্তু ফর্ম আর কন্টেন্টের যে চিরকালীন দন্দ্ব সেখান থেকে দেখলে কী ছবিটি পুরুষের নির্মাণ বনাম গল্পে নারীর উপস্থিতি এই মর্মে পাঠ করতে হবে? একদমই তা নয়। শিরিন-এ উপস্থিত প্রত্যেকটা মুখ তার নিজের নিজের গল্প নিয়ে আছে। স্থায়ী কোন একটি গল্প দিয়ে এই মুখগুলি পাঠ করা সম্ভব না। অপর দিকে, পরিচালকের দক্ষতাই শুধুমাত্র এই ছবির ফর্মের একমাত্র উপাদান নয়। মিজঁসেন, এডিটিং, ক্যামেরা ইত্যাদির ওপর যেমন দাঁড়িয়ে আছে একটি ছবির ফর্মাল উপস্থাপনা তেমনই এই প্রত্যেকটি উপাদান যদি কন্টেন্ট-এর জন্য অভিপ্রেত অভিঘাতের থেকে বিন্দুমাত্রও স্থানচ্যুত হয় তাহলে বুঝতে হবে যে ফর্ম এবং কন্টেন্ট এই দুইকে লড়িয়ে দেবার মতো বোকামো হয়ত আর হয় না। এবং এখান থেকেই শিরিন-কে বোঝা একটু সহজ হয় হয়ত। এই ছবির মিজঁসেন নারী মুখের অভিব্যক্তি, এই ছবির এডিটের ছন্দ নির্ধারিত হচ্ছে সেই শিল্পীদের মুখগুলির ইম্প্রোভাইজেশন অথবা আবেগের ওপর ভিত্তি করে এবং এই মুখগুলি ফ্রেমের (হয়ত) আকাঙ্ক্ষিত সীমারেখা ছাপিয়ে বেরিয়ে যায়। কিন্তু তাই বলে কী পরিচালকের উপস্থিতি অস্বীকার করতে চাইছি? না। বরং আব্বাস যেভাবে নারীর অদৃশ্যতার সঙ্গে তাল রেখে তার পরিচালক সত্তাকে প্রায় অদৃশ্য করে ফেলতে পারছেন সেটা উল্লেখ করতে চাইছি। যদিও এখানে প্রশ্ন থেকেই যাবে যে এই অদৃশ্যতার রাজনীতি অভিপ্রেত ছিল নাকি এত এত নারী-মুখ বাধ্য করল সেটা? আর এও প্রশ্ন থাকে যে, মুখকে ফ্রেমে আবদ্ধ রাখতে যে ক্লোজ-আপ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত সেটাও বা কতটা নির্মাতার নিজের আয়ত্তে থাকে? ক্লোজ-আপ কি শুধুই একটা শটের মাপ এক্ষেত্রে?
শিরিন-এর সেই মুখগুলো ধর্মীয় রাষ্ট্রের অপর। এই মুখেরা সীমাবদ্ধ, বাহিরজগতে তারা নিয়ন্ত্রিত এবং জনপরিসরে আবৃত থেকে যাওয়ার মধ্যেই তাদের স্বীকৃতি মেলে শুধু। এই ছবির প্রতিটি মুখ অনিশ্চয়তার প্রতীক। এই অনিশ্চয়তা থেকে উঠে আসে রাষ্ট্রহীনতার সঙ্কট এবং যেন সেটারই প্রতিনিধি হিসেবে উঠে আসে শিরিন খুসরোর আখ্যান। রাষ্ট্রের চোখে অদৃশ্য মুখেরা সাক্ষী হয় সেই আখ্যানের। অন্ধকার সিনেমা হল অন্দরের প্রতীকী সংযোজন হয়ে ওঠে আর সেখানে এই অনাবৃত মুখেরা রুপোলী পর্দায় শিরিন খুসরোর গল্প থেকে উদ্ভূত আবেগের সাক্ষ্য হয়।

এখানে মনে পড়ে ভার্জিনিয়া উলফ-এর সেই বিখ্যাত উক্তি; “in fact, as a woman, I have no country. As a woman I want no country. As a woman my country is the whole world.”। তার কথার সূত্র ধরেই ভাবা যায় যে রাষ্ট্রহীন নারী, গৃহহীন মানুষ, এবং অদৃশ্য মুখেরা একে অপরের সঙ্গে আন্তর্জাতিক এবং আধ্যাত্মিক যোগসূত্র স্থাপন করে। শিরিন-এর প্রত্যেকটি মুখ পৃথিবীর সমস্ত ধর্মীয় রাষ্ট্রে বসবাসরত নারীদের মুখের সাথে একাত্ম হয়ে যায়। লিঙ্গ পরিচিতির প্রান্তে থাকা মানুষেরা এই যোগসূত্রে একে অপরের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। তাই আব্বাস কিয়ারোস্তামির শিরিন পরিচালকের হাত থেকে বেরিয়ে গিয়ে হয়ে ওঠে সেই সব নারী মুখেদের ছবি, সেই সব অভিনেত্রীদের আবেগের উপাখ্যান।

দর্শকের মধ্যেও অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি করে এই ছবি। একদিকে বিষাদঘন আবেগ আর অন্যদিকে বহুত্বের সম্ভাবনার সীমাবদ্ধতা, এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। আমরা জানতে চাই প্রতিটি মুখ কী ভাবছে। এক অভিশপ্ত প্রেমের গল্প এক একজনের নারীর মনে কী আবেগের সৃষ্টি করছে? আবার এই নারীদের সামাজিক অবস্থানের নিরিখে এক এক জনের ভেতরে তৈরি হতে থাকা ভিন্ন ভিন্ন আবেগকে বুঝতে পারা বা ছুঁতে পারার যে ব্যর্থ প্রয়াস সেই ব্যাপারেও দর্শক অবগত। দর্শক (হয়ত) বোঝে যে অদৃশ্যতা যখন সমষ্টির তখন শুধু ব্যক্তিগততে আটকে থাকলে চলে না। আবার সমষ্টির প্রভাবে ব্যক্তিমানুষের বিভিন্নতা অস্বীকার করা যায় না। এই অবস্থান থেকে দেখলে বোঝা যায় যে এই ছবি কোন নির্দিষ্টতার ঘেরাটোপে আটকে থাকে না বরং হয়ে ওঠে বিমূর্ত।
বিভিন্ন মাত্রার শটের মধ্যে ক্লোজ-আপ ছবির বিভিন্ন উপাদানকে কাছে নিয়ে আসে, কখনও তুলে ধরে না দেখতে পাওয়া কিছু ডিটেল অথবা অভিব্যক্তি। এভাবে ভাবলে ক্লোজ-আপ শুধুই একটা শটের মাপ যা চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে কিছু বেসিক উদ্দেশ্য পরিবেশন করে। এই কলামে আমি চেষ্টা করছি সেই ভাবনা থেকে সরে এসে ক্লোজ-আপ কে একটা ডিভাইস হিসেবে ভাবতে, যেখান থেকে এটির একটি দার্শনিক সম্ভাবনাও বের করে আনা সম্ভব হবে। এক বা একের অধিক মুখের ক্লোজ-আপে শিরিন সেইসব পাঠের সম্ভাবনা খুলে দেয় কারণ এই ছবির ক্লোজ-আপগুলো মিডিয়ামের ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত হয়ে দার্শনিক হয়ে ওঠার চেষ্টা করে।

[লেখক – সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের চলচ্চিত্রবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।]

Facebook Comments

Leave a Reply