অক্সিজেনের গল্প : রোমেল রহমান
মধ্যরাত্রে কবির বাড়ি ফেরে! তার ডিউটি শেষ হয়ে গিয়েছিল নয়টায়! কিন্তু মধ্য রাত না হলে বস্তির সবাই ঘুমায় না তাই দেরি করে ফেরা আজ! দেরি না করলে ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে যাবে! কবির একটা প্রাইভেট হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়! গেলো কয়দিন ধরে করোনা রোগী বেড়ে যাওয়ায় তার ঘুম হারাম! মৃত্যু দেখে আর টাকাপয়সার খেলা দেখে কিছুটা ঝিম খেয়ে গেছে কবিরের দম! তার উপর আছে দুনিয়ার নানান দেশে অক্সিজেনের অভাবে মরা মানুষের নিয়মিত আপডেট! মাথার মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসা মানুষদের মৃত্যু দেখতে দেখতে কবিরের আউলা ঝাউলা লাগে! তার সঙ্গে যারা কাজ করে তাদের অনেকেই গোপনে টাকা জোগাড় করে রাখছে, সামনে নাকি অক্সিজেনের ব্যবসা আসছে! কথা গুলো শুনে কবিরের গা শিউরে ওঠে! মুমূর্ষু মানুষ নিয়ে ব্যবসা সে ভাবতে পারে না! তবে রোজ তাকে শুনতে হয় তার সহকর্মীদের কথার মধ্য দিয়ে, মড়ক লাগা দেশ গুলোর গোরেস্তান, শ্মশান আর হাসপাতালের নার্স, ওয়ার্ডবয় কিংবা ব্লাক মার্কেটে অক্সিজেন বিক্রেতারা কি পরিমাণ টাকা কামাচ্ছে! কিন্তু শেষমেশ নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি কবির! একটা পাপ করেই ফেলেছে!
কবিরের বউ বিউটি ব্যাপারটা শুনে প্রথমে আঁতকে ওঠে! বিউটি খুবই সাধারণ মেয়ে! সবসময় চুপচাপ টাইপ! বস্তিতে আসার পর প্রথম প্রথম তার খুব সমস্যা হয় বাথরুম ব্যবহার নিয়ে! তবে কবির জানিয়েছে আর বছর পাঁচেক এই শহরে থেকে সে গ্রামে ফিরে যাবে! সেখানে ঘর তুলবে পায়খানা সহ! বিয়ের পর বিউটিকে কোন কাজে যেতে হয় নি! কিন্তু খরচ বেড়ে যাওয়ায় সে একটা কাজের লাইন বের করেছে! তাদের বস্তি থেকে কিলোমিটার খানেক দূরে অফিস পাড়া! সেখানে কয়েকটা অফিসের কর্মকর্তাদের দুপুরের খাবার সে রান্না করে! দুপুর বেলা সেই খাবার একটা ছেলে এসে নিয়ে যায়! বিউটির রান্নার হাত ভালো হওয়ায় খরিদ্দার বাড়ছে দিনে দিনে! এই পেষায় সবচেয়ে সুবিধার দিক হচ্ছে নিজেদের জন্য আলাদা রান্নার চিন্তা থাকে না! ঐ রান্না থেকে হয়ে যায়! কিন্তু দেশে করোনা লাগার পর থেকে কাস্টমার কমে গেছে! প্রথম যেবার সাধারণ ছুটির নামে অফিস অর্ধেক করে দেয়া হল, তখন তার সব কাস্টমার চলে গেলো! কেননা আতঙ্ক সেবার বেশি ছড়িয়ে পড়েছিল ফলে সবাই বাইরের খাবার বাদ দিয়ে ঘর থেকে খাবার এনে খেয়েছে! কিন্তু বিউটিকে গেলো রাতে যখন কবির ব্যাপারটা জানায় তখন বিউটি কয়েক মিনিট থম মেরে থেকে বলে, ‘তুমি যেইটা ভালো মনে করো সেইটাই কইরো! বিপদে তো কেউ পাশে থাকে না! জান বাঁচানো আগে!’ শেষ বাক্যে কবির কিছুটা ভরসা পেয়েছে! ফলে কবির আজ ঝুঁকিটা নিয়েই ফেলেছে! ক্লিনিকের অক্সিজেন মজুদখানা থেকে একটা সিলিন্ডার সে সরিয়ে ফেলেছে!
মাঝরাতে একটা অটোরিকশা ভাড়া করে তাতে করে অক্সিজেন সিলিন্ডারটা বস্তায় মুড়ে যখন ঘরের মধ্যে ঢুকালো তখন রাত তিনটা! সারা গা ঘেমে নেয়ে উঠেছে কবির আতঙ্ক আর অস্থিরতায়! বিউটিকে একটু শক্ত স্বরে বলে ফেলে, ‘দরজা হা কইরা থুইছ ক্যান! বন্ধ করো!’ বিউটি দরজা বন্ধ করতেই কবির বলে, ‘ তোমারে না বলছিলাম, খাটের তলায় এট্টা লম্বা এক হাত গভীর গর্ত কইরা রাখতে?’ বিউটি অপ্রস্তুত স্বরে বলে, ‘আইজকা রান্না বেশি ছিল তারপর ঘুমায় গেছিলাম!’ কবির বিরক্তির চরমে উঠে বলে ফেলে, ‘ আইজ বাদে কাইল যহন দম বন্ধ হইয়া মরবা তহন মনে করবা ক্যান কইছিলাম গর্ত করতে! কাইল যদি লুট হয় এই সিলিন্ডার তহন কেডা আনবো আরেট্টা? টাকার গাছ তো নাই আমার! দুনিয়ার মানুষ মইরা ভ্যাটকায় যাইতেছে আর উনি ঘুমাইতেছে!’ বিউটি এতোগুলো কথা শুনে কেঁদে ফেলে! গেলো কয়েকদিন তার স্বামীকে সে চিনতে পারছে না! কেমন জানি বোবা শক্ত একটা মানুষ হয়ে গেছে! রাতে ঘুমায় না উঠে বসে থাকে! গায়ে হাত দিলে আঁতকে উঠে বলে, ‘এমন কষ্টের মরণ দেহা যায় না বউ!’
ঘরে থাকা একটা ছোট্ট দাউ দিয়ে অনেক কষ্ট করে একটা লম্বা গর্ত খুড়ে গর্তের মধ্যে অক্সিজেন সিলিন্ডারটা মাটি চাপা দিয়ে রাখে কবির! বউকে বলে, ‘এহন থিকা আশপাশের ঘরের লোক কম আনবি ঘরে!’ বিউটি সহজ স্বরে বলে ফেলে, ‘আইসা পড়লে কি করবো? শেফালি তো রোজ একবার আইসা বসে!’ বিরক্ত হয়ে কবির বলে বসে, ‘হাত কামড়ায় ধরবি! তাইলে আর আসবো না কেউ!’ এই কথায় হেসে ফেলে দুইজনে! সেদিন রাত্রে ভাত খেতে বসে কবির ভাত মাখাতে মাখাতে বলে, ‘বউ আমি কী অনেক বড় পাপ করলাম?’ বিউটি কিছু বলে না! কবির বলে, ‘একজন মানুষ আরও কিছু সময় বাঁইচা যাইত এই সিলিন্ডারটা পাইলে!’ বিউটি বলে, ‘আপ্নের বেশি দুঃখ হইলে ফেরত দিয়া দেন!’ কবির বলে, ‘সেইটা দেই কেম্নে! যদি টের পায়া যায় তাইলে চাকরি নট!’ বিউটি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘তাইলে আর কয়ডা দিন থাক!’
পরেরদিন শেফালি আসে গল্প করতে! শেফালি বলে, ‘কাইল রাইতে কিহের শব্দ শুনলাম তোমাগো ঘরে? ধুপধাপ! আমি ভাবলাম কবির ভাই ধরছে তোমারে! পরে মনে হইলো না! অন্য শব্দ!’ বিউটি অপ্রস্তুত স্বরে বলে, ‘নাহ! এম্নে!’ শেফালি বলে, ‘কিছু খুঁচতেছিলা?’ বিউটি বলে, ‘হয়! তোর ভাই গুপ্তধন পাইছে! সেই কলসি পুইতা থুইতে গর্ত করতেছিলাম!’ শেফালি হাসে! বিউটি বলে, ‘তোর ভাই কইলো হাসপাতালে নাকি লোক মরতেছে অনেক!’ শেফালি বলে, ‘গরিবের কিছু হবে না! আমারা তো সাহেব-মেমগোর মতন না! খাইটা খাই! সুবিধা করতে পারবো না!’ বিউটি বলে, ‘পাশের দেশে নাকি লোক মইরা বিছায় যাইতেছে! দম বন্ধ হইয়া মরতেছে! অক্সিজেন নাই!’ শেফালি বলে, ‘আহারে কি কষ্টের!’
সেদিন রাতে বস্তিতে একজন লোক মরে যায়! শেফালি এসে দরজায় ধাক্কাধাক্কি করে খবর জানায়! বিউটি বলে, সে আসছে! কবির বিউটিকে যেতে দেয় না! কবির বলে, ‘কেম্নে মরছে সেইটা না জাইনা যাওয়া যাবে না! করোনায় মরলে তুইও মরবি!’ ফলে বিউটি স্বামীর কথা মেনে নেয় দ্বিধা নিয়ে! পরদিন হাসপাতালে হইচই বেঁধে যায়! অক্সিজেন রিচার্জের জন্য সিলিন্ডার পাঠানোর সময় দেখা যায় একটা সিলিন্ডার কম! স্টোর কিপারকে জানিয়ে দেয়া হয়, সে যদি সিলিন্ডারের হিসাব মিলিয়ে দিতে না পারে তাহলে তার চাকরি যাবে! স্টোর কিপার হাউমাউ স্বরে কাঁদতে থাকে! কবিরের সাথে দেখা হলে সে বলে, ‘এখন কী করি ভাই? এর মধ্যে চাকরি গেলে খাব কী?’ কবির চুপ মেরে থাকে! অন্য একজন কেউ বুদ্ধি দেয় স্যার মার্কেট থিকা একটা সিলিন্ডার কিনা দিয়া দেন! কবিরের অপরাধ অপরাধ লাগে!
বাড়ি ফিরে কবির ভাত খেতে পারে না! বিউটি বলে ফেলে, ‘আপনে না সিলিন্ডারটা ফিরত দিয়া আসেন! ঐটা ঘরে আসার পর থিকাই সব কিছুতে কেমন জানি ঝামেলা লাইগা গেছে!’ কবির বউয়রে মুখের দিকে মরা মাছের মতন তাকায়! বউ অস্বস্তিতে পরে যায়! কবির বলে, ‘বস্তিতে যে মরছে সে কেম্নে মরছে জানো? শ্বাসকষ্ট নিয়া! এহন কও দি কাইল তোমার আমার হইলে বাঁচবা কেম্নে?’ বিউটি চুপ করে থাকে! কবির ভাত থুয়ে উঠে যায়! বিউটিও উঠে যায়! সে রাতে তারা কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলে না একা একা কাঁদে বিউটি আর অন্যদিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে কবির! ভোর হতে না হতে দরজায় ধাক্কা পড়ে! বস্তির একজন কেউ এসে বলে, ‘কবির ভাই একটু আসেন, আব্বা যেন কেমন করতেছে! হাসপাতালে নেয়া লাগবে!’ কবির বলে, ‘ একটা ইজি বাইজ ডাইকা আনো আমি আসতেছি!’ কদিন আগে কিনে রাখা অক্সিমিটারটা কবির বের করে তার ড্রেসিং করার যন্ত্রপাতি রাখার ব্যাগ থেকে! অক্সিমিটার লাগিয়ে দেখে লোকটার অক্সিজেন লেভেল, ৭৭% কবির বলে, ‘জলদি নেও অক্সিজেন দেয়া লাগবে!’ কবিরের একবার মনে পড়ে তার ঘরের সিলিন্ডারের কথা! বিউটি তার চোখের দিকে তাকায় একটু সমর্থনের জন্য! কিন্তু কবির কোন দিকে পাত্তা দেয় না! রোগীটা হাঁসপাতাল নিতে নিতে পথেই মারা যায়! সেদিন কবিরকে বিউটি বলে ফেলে, ‘তুমি চাইলে লোকটা হাসপাতাল পর্যন্ত যাইতে পারত!’ কবির ঘরের বেড়ার দিকে তাকিয়ে থাকে!
হাসপাতালে কবিরের কাজের চাপ বেড়ে গেছে! রোগী আসছে মুহুর্মুহু! তার সহকর্মীরা অক্সিজেনর ব্যবসা করছে ফোনে ফোনে! এরমধ্যে একদিন কবিরের শরীর খারাপ করে! সে স্যাম্পল দেয় করোনা টেস্টের! রিপোর্ট আসে পজেটিভ! কবির তার হাসপাতালকে জানায়! হাসপাতাল তাকে হোম কোয়ারেইন্টাইন করতে বলে! অবস্থা খারাপ হলে হাসপাতালে আসবে! কিন্তু ঘরে ফিরে যখন সে বিউটিকে ব্যাপারটা জানায়, বিউটির মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়! কবির বলে, ‘কত কইরা বললাম, আমি স্যার আপনাগোর স্টাফ আমারে অন্তত এট্টা বেড দেন! দিলো না! কইল অবস্থা খারাপ হইলে হাসপাতালে আসবা! বাড়ি বইসা চিকিৎসা নেও! আরে বাল ঘর তো আমার এট্টা এইখানে কোয়ারেন্টাইন করবো কেম্নে কী?’ বিউটি বলে, ‘সমস্যা নাই! আপনে ঘরে থাকেন আমি শেফালির ঘরে থাকবো!’ কবির বলে, ‘খবরদার সেইটা কখনো না! এরা যদি জানে আমার করোনা হইছে তাইলে পিটায়া আমারে বাইর কইরা দিবে! যাবো কই?’ বিউটি বলে, ‘তাইলে যা থাকে কপালে দুইজনে ঘরেই থাকবো!’ কবির বলে, ‘নাহ! তুই বাপের বাড়ি যাবি!’ বিউটি বলে বসে, ‘না! আমি আপনারে ফেইলা যাবো না!’ কবির ঠাশ করে একটা থাপ্পড় লাগায়! সেদিন রাতে দেখা যায় ঘরের মধ্যে শারি দিয়ে একটা পর্দা তৈরি করে খাটের উপর কবির থাকছে আর নিচে মেঝেতে বিউটি! বস্তিতে কমন বাথরুম হওয়ায় খুব ভোরে উঠে কবির বাথরুমে যায় আর সারাদিন একটা বালতিতে প্রস্রাব করে! কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে ফাঁস হয়ে যায় কবির ঘরের মধ্যে কোয়ারেন্টাইন করছে! বস্তির মালিক এসে বিউটিকে ডেকে বলে, ‘আমার বস্তিটা শেষ না কইরা তোমরা শান্ত হবা না? তোমার হাসপাতালে কাজ করা বরের থিকা ভাইরাস লাইগা দুইজন মরছে! এহন নিজে মরতেছে হ্যাঁয়! এক্ষণ বাইর হবা তোমরা! হাসপাতাল গিয়া উঠো!’ লোকজনের হৈ চৈ এর মুখে তাদের ঘর ছাড়তে হয়ে! বিউটি শেফালির দিকে তাকায় একটু আশ্বাস পাবার আশায় কিন্তু শেফালি সরে যায়! ঘর ওয়ালা বলে, ‘ মালপত্তর থাকুক! ভালো হইয়া ফিরা আইসা ভাড়া মিটায়া যাবা! একটা তালা দিয়া যাও!’
এর আটদিন, নয়দিন বা দশদিন পর বিউটি এক কলেজ পড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে ফেরে! ছেলেটা খুবই চিন্তায় আছে! ছেলেটা এসেছে অক্সিজেনের জন্য, তার মার অবস্থা খারাপ! বিউটি ঘর খুলে, মেঝে খুঁড়তে শুরু করে তারপর টেনে বের করে ভারি সিলিন্ডারটা! অক্সিজেন সিলিন্ডারটা সে ছেলেটার হাতে তুলে দেয়! ছেলেটা কয়েকটা হাজার টাকার নোট বাড়িয়ে দেয় বিউটির দিকে! বিউটি বলে, ‘বাজান টাকা গুলান রাখেন কাজে লাগবে, পারলে আমার স্বামীর জন্য দোয়া দিয়েন! আপনার মায়ের জান বাঁচলে যদি সে বেহেশত পায়!’