অর্থনীতির মৃত্যুফিকির : প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়

শ্রাদ্ধবাড়িতে মাছ-মাংস পরিবেশিত হয় না । আমিষান্ন উৎসবের দ্যোতক। এম্‌মা! ভূমিকাপর্বেই আমি যে ‘ম্যরাল’ টেনে দিলাম। কিন্তু কেন হয়না: এই নিয়েও কি কখনো ভাববো না? বলা হয়, যুগ-যুগান্ত ধরে চলে আসা প্রথা, লোকাচার বলেই এমনটি হয়ে থাকে। উদ্দেশ্য “শোক”-এর আবহটি বজায় রাখা । বেশ তা নাহয় হল। কিন্তু নিজস্ব তৃতীয় নয়নে পাওয়া তথ্যসূত্রের দৌলতে দেশীয় রাজনীতির একটা অটোপ্‌সি রিপোর্টের ধূপধুনো-রজনীগন্ধার শ্রদ্ধার্ঘ্য তো অর্পণ করিতেই পারি। মোচ্ছবের দিনক্ষণ তো ভিন্ন।সবার মুখ থেকে মুখে সেই সুখ ঝরে পড়ে। তখন উৎসব। শাস্ত্র বলছে সকালবেলার রাগ-‘যোগিয়া-ভৈরবী’। এমনটাই ভারতীয় রীতিনীতি। কিন্তু, এখন দিনকাল আলাদা। আজ আর কেউ ‘৭০-এর ডায়ালগ আওড়ায় না যে ধনবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিক শোষিত হচ্ছে । শ্রোতা-জনতার অনুরোধে ভরদুপুরে মালকোষ, রাতগহীনে ভৈরবী অনায়াসে পরিবেশিত হয়। পঠন-পাঠন, নিয়মনিষ্ট-সুনিয়ন্ত্রিত অর্থময় জীবনযাপনের কী দরকার? দাড়ি রাখলেই এখন ‘গুরুদেব’ সাজা যায় ! প্রচার ঠিকঠাক হলে, মিডিয়া সাথ দিলে গোরু নিশ্চিতই গাছে উঠবে। ক্যামেরা-সাংবাদিক-চিত্রগ্রাহক-টিভিকর্মী মজুত প্রতিটি বুথে। শীতল(?) ছবিগুলো তবু কুচি-কুচি হবে, ১৯৭০-এর ইস্টাইলে, প্রথমে যাবে ডার্করুমে। ল্যাবচর্চিত নেগেটিভ হয়ে ঘুরবে তারপরে চোখে-চোখে। ইয়ে পাব্লিক হ্যায় ভাই; সব জান্‌তা/জান্‌তি হ্যায়। যা বোঝার তারাই বুঝে নেবে। কোন এক ফাঁকে মিডিয়া জানিয়ে দেয় যে দেশজুড়ে নাকি টিকা-উৎসব হবে। আমরা বিশ্বাস করি। দুর্জনে বলে—আরে, টিকা তো অসুখে দেওয়া হয়! এসময়ে কি (অ)-সুখও উৎসব? দিনকাল কত্তো বদলেছে। এই প্রথম, কং-সিপিএম ভোটে শূন্য পেয়েছে। মজার কথাটি কী জানো—সেই মিডিয়াই পরের দিন (টেলিগ্রাফ, ১৮/৫/২১) ‘পেজ থ্রি’-তে ছেপে দেয় ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা:—‘গাছ আর / গাছের ছায়ার নীচে দড়ির খাটিয়া / আমাদের তৃতীয় পৃথিবী।’ (স্থিরচিত্র)।

কমল চক্কোত্তির ‘বৃক্ষনাথ’-এর দয়াপ্রার্থী হয়ে হাট্টাগোট্টা এক মাঝবয়সী মুমূর্ষু এক বৃদ্ধের পাশে মাস্ক পরে গাছের ছায়ায় খাটিয়ায় শুয়ে আছে । ওই ছবিটারই এককোণে নীল রঙের একটা মোটরগাড়ি আর শিয়রের কাছে কেঁদো মোটা একটি কেলেকুলো গাই (গোষু কৃষ্ণা বহুক্ষীরা!)। আর তারই সহাবস্থানে (ফ্রন্ট পেজ-এ )গাছে টাঙ্গানো স্যালাইন-এর বোতল । ভূচাল এলো বুকে। উফ্‌! গাছটা কি সহি-সলামত টিকে আছে ? অক্সিজেনের ভারী অভাব দেশজুড়ে। চিত্র-কবিতা থেকে আমি পা রাখি ভিনদেশির শব্দ-চিত্রে।
অ্যান্টি–ক্লকওয়াইজ’ হেঁটে—সোমবারের ভোর ফেরত যাচ্ছে রোব্বারের দুপুরে—অ্যাংরি সত্তর-হাংরি ষাট; দম মারো দম্‌—বেলবটম আর ড্রেনপাইপ-চোঙপ্যান্ট, হাতে হাতে—‘চুল্লির প্রহর”…আরে,আরে! পিছিয়ে চলেছি যে। আঃ, তিষ্ট ক্ষণকাল; ‘এই তো পৌঁছে গেছি ১৮২৪-য়ে! এইমাত্র তিনি সিটি অব প্যালেস নাম দিয়ে (সুকৌশলে) লণ্ডনের সঙ্গে সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় নগরীর তুলনা টেনে কবিতা–প্রশস্তিটি শেষ করিলেন বটে; তবে একটি গ্লানিময় হকিকৎ-ও যে ঠুসে দিলেন তাঁর কাব্যশব্দচিত্রে ।
‘… পুরোদস্তুর দিনমানে / লক্ষ করেছি ভাঁটি-জলে / ভেসে যাচ্ছে মৃতশরীর ,নগ্ন /
স্মৃতিচিহ্ন—ভয়ঙ্কর দুর্নীতির / চোখ সরিয়ে নিলাম—উপসাগরের দিকে
গড়িয়ে চলেছে দুর্গন্ধময়,দ্রুত পচনশীল ওই শকুনের শিকার—’

কাগুজে বিবরণে পাচ্ছি অগুনতি মড়া ভেসে আসছে গঙ্গা বেয়ে…। হে একুশের নবকুমার, তুমি নিশ্চয়ই পথ হারাওনি এখনো! মৃত্যুকলরব তোমার চারপাশে, পরিশ্রান্ত মেডিকস্‌, ভিড়ে ভিড়াক্কার হাসপাতাল, শবের ওপরে শব—পিছমোড়া করে বাঁধা, কবরে-শ্মশানঘাটে, কতো ধর্মের, কতো বর্ণের, কতো গোত্রের, নিম্ন-মধ্য-উচ্চবিত্ত, কতো মৃতমানুষের ভিড়–-কে রাখে হিসাব তার? ড্যান প্যাট্রিক, টেক্সাসের গভর্ণর, ফক্স নিউজকে বলেছেন অকপটে—ষাট পার করা বয়োবৃদ্ধের বেঁচে থাকার অধিকার নেই আর! সাক্ষাৎকারী টিম কার্লসন হতবাক! তবু প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন—‘ব্যর্থ অর্থনীতি কি মানুষের মৃত্যু-টিত্যুর থেকেও ভয়ঙ্কর‘? উত্তর আসে—‘হ্যাঁ’। মাসখানেক পরে ট্রাম্প সরকারের ওই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি ফক্স নিউজে আবার বলেন “there are more important things than living” (Brown 2020). আমিও জল হইতে দুধটুকে বেছে নিতে ব্রতী হলাম= ভূমিকায় দাঁড়ি টানলাম ।

নেক্রোপলিটিক্সের কথা পেড়েছেন (কলম্বিয়া / পেনসিলভ্যানিয়া / ডিউক / বার্কলে / ইয়েল য়ুনিভার্সিটির প্রাক্তন অধ্যাপক) যোসেফ এম্বেবে। নেক্রোপলিটিক্স = commodification of death বা মৃত্যুর পণ্যায়ন, যে অবস্থায় ‘people are more valued dead than alive)। অর্থাৎ জীবিতদের থেকে মৃতমানুষেরা বেশী মূল্যবান। কিংবা লোপেজ-গিলেস্পি যেভাবে বলেছেন ধনবাদী ব্যবস্থায় ‘a differential hierarchy operates in which some bodies and lives must die so that others may live and flourish’. প্রায় সমর্থনের সুরে Gržinić, Marina ও Šefik Tatlić লিখেছেন—‘নেক্রোপাওয়ার হল সেই ধরণের শক্তি এককথায় যার অর্থ হয় “to make live and let die,” (সূত্র:- ‘Necropolitics, Racialization, and Global Capitalism’)। এই সন্দর্ভে লোপেজ-গিলেস্পির আরো একটি মন্তব্যের উদ্ধৃতি দিতে চাই যেখানে বলা হয়েছে যে ইদানীং ধনবাদী সমাজের এক বিশেষ লক্ষণ হয়ে উঠেছে “hierarchy of killability” বা ‘নিধনযজ্ঞের শ্রেণিবিন্যাস’।‘… all of us, individually and collectively, are implicated in the practices of capitalism that dehumanize some people and then allow them to die for the benefit of certain others. As they state, “it is not the impact that the deaths of Others will have on our own liveliness that is our concern, so much as the absolute disinterest in the liveliness of Others—human, non-human animals, and environment” (Lopez and Gillespie 2015: 182) এরই পাশাপাশি নেক্রো-ইকনমির কথা বলেছেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল ও ইন্ট্যারন্যাশানাল স্টাডিজ শাখার অধ্যাপিকা ইভ দারিয়ান স্মিথ । তাঁর ভাষায় সংক্ষেপে—নেক্রোইকনমি = শবকেন্দ্রিক অর্থনীতি । দারিয়ান স্মিথ লিখেছেন যে ‘অধিকাংশ মানুষের কাছে খানিক অদ্ভুত শোনালেও বাস্তবিক পরিস্থিতির স্বার্থে আমি সওয়াল করতে চাই যে কর্পোরেট সেক্টর ও ব্যবসায়ীদের মন জুগিয়ে চলা রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই মনে করেন যে প্রাণবন্ত একটি অর্থনীতির জন্য কিছু মানুষের প্রাণোৎসর্গকেও মেনে নেওয়া যেতে পারে।’ ধনবাদের সঙ্গে মৃত্যুবিভীষিকা আদতে এইভাবেই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এবং এইসব নিধনযজ্ঞের মধ্যে কয়েকটি অন্তত ধনবাদেরই গভীরে নিহিত ‘pre-calculated collateral loss of life’ বা পূর্বনির্ধারিত সমান্তরাল / সমপার্শ্বিক জীবনহানি।’সত্যাসত্য জানিনা, আজই ফেবুতে একটা পোস্ট দেখলাম যে ICMR নাকি বলেছে যে শ্রমিকদের যাতায়াত ও ধর্মীয় জমায়েতের ফলে এদেশে নানারূপে করোনা ছড়িয়েছে। এক্ষণে, এই দুই তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষের COVID-19 হাল-হালাত-হকিকতের ভিসেরা রিপোর্ট বানানোর প্রয়াস করব ।
এম্বেবে বলছেন যে ফুকোর ‘বায়োপাওয়ার’ তত্ত্ব আর তদনুসারী ‘বায়োপলিটিক্স’-এর পদ্ধতিতে শৃংখলাবদ্ধ রাষ্ট্রিক শক্তির সমাবেশটিকে এসময়ের আঙ্গিকে ব্যাখ্যার জন্য যথেষ্ট নয়। ফুকোর ব্যাখ্যায় ‘বায়ো-পাওয়ার’-এর অর্থ হল ছলে –বলে-কৌশলে, ভিন্ন-বিভিন্ন উপায়ে নাগরিকের শরীরের ওপর কর্তৃত্ব হাসিল করা এবং সেইসূত্রে জনগণেশের ‘নিয়ন্ত্রণ’। অর্থাৎ, বায়োপাওয়ার হল গোষ্ঠীভুক্ত বিশাল জনসমাজকে বশংবদ রাখার একটি পন্থা। এই ধরনের রাজনৈতিক কৌশলের বিশেষত্ব হল সমগ্র জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণ। ফুকোর ভাষায়—”diverse techniques for achieving the subjugation of bodies and the control of populations”.(সূত্র উইকিপিডিয়া)। এই সূত্রেই আধুনিক জাতিরাষ্ট্রগুলো বা ধনবাদের বিকাশ সম্ভবপর হয়েছে। এককথায়, বায়োপাওয়ারের অর্থ হল নাগরিকের শরীর ও স্বাস্থ্যের ওপর রাষ্ট্রিক নিয়ন্ত্রণ। এম্বেবে এর সঙ্গে নেক্রোপলিটিক্স বা শব রাজনীতির প্রসঙ্গটি জুড়ে দিয়েছেন। প্যালেস্তাইন, আফ্রিকা, কসোভোয় জারি থাকা গণনিধনকে উদাহরণ হিসাবে হাজির করে এম্বেবে বলেছেন যে দেহগুলোকে শাসনতান্ত্রিক শৃংখলার দায়রায় ঢুকিয়ে ফেলাই নয় কেবল সার্বভৌম শক্তিগুলো এখন (death –zones=) মৃত্যুঠিকানাও গেঁথে ফেলছে যেখানে মৃত্যুই হচ্ছে আধিপত্যবাদের চূড়ান্ত মহড়া আর প্রতিরোধের প্রথমতম পাদানি। একটুকরো এম্বেবে গেঁথে রাখি আমি:-
‘the ultimate expression of sovereignty resides, to a large degree, in the power and the capacity to
dictate who may live and who must die. Hence, to kill or to allow to live constitute the limits of
sovereignty, its fundamental attributes. To exercise sovereignty is to exercise control over
mortality and to define life as the deployment and manifestation of power। ‘

ইভ দারিয়ান স্মিথ এর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন:- Death, in short, has become a commodity around which monetary value and late capitalist activities flourish । প্যারাটির বঙ্গানুবাদ করেছি এরকম— ‘আজ আমরা এ্মন এক অর্থনৈতিক যুক্তি-তক্কোর সম্মুখীন,যা কোনো এক বিশেষ শ্রেণিভুক্ত মানুষদের শোষণযোগ্য এবং বর্জ্য হিসাবে গণ্য করছে—(যেমন,পরিযায়ী শ্রমিক,যুবতি,কালোচামড়ার যুবক বা আদিবাসী)। এই বিষয়ে আমার,এবং অন্য অনেকেরও, বক্তব্য হচ্ছে যে সাম্প্রতিক কালে ধনবাদের যুক্তিই হয়ে দাঁড়িয়েছে যে বিশেষ বিশেষ শ্রেণি-গোত্র-গোষ্ঠীর মানুষকে কেবলমাত্র বর্জ্যনীয় ভেবে নেওয়া হচ্ছে,কিন্তু সেই একই মানুষকে ফের মুল্যবান মনে করা হচ্ছে যখন তারা মৃত ।মৃত্যু এখন,সংক্ষেপে,একটি পণ্যবিশেষ,যার মাধ্যমে পণ্যের অর্থমূল্য এবং ধনবাদের অত্যাধুনিক ক্রিয়াকলাপ জারি থাকছে।’ অতএব, স্মিথ-এর মন্তব্যের অর্থ হয় = ধনবাদে মৃত্যুই মূল্যমাণ! ‘today we are facing a new form of economic logic that goes beyond considering certain populations (i.e. migrant labourers, young women, black youth, Indigenous tribes) as particularly exploitable and disposable. I argue—as have others—that the logics of capitalism have shifted in recent years to view certain populations not only as disposable, but in fact only valuable when dead. ( সূত্রঃ-ইভ দারিয়ান স্মিথঃ ‘ডায়িং ফর দি ইকনমি’)।

অর্থনীতি অবশ্যই একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। প্রমাণ? ডিমনিটাইজেশন= বলা হচ্ছে যে নভেম্বর, ২০১৬-র এই হঠকারী পদক্ষেপ ভারতীয় অর্থনীতি থেকে ৮৬% টাকা শুষে নিয়েছিল। অর্থ হয়, প্যান্ডেমিকের বহু আগেই ভারতীয় অর্থনীতি ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট কমেছে। ইকনমিক টাইমস্‌ জানাচ্ছে (১৯/২/২০২০-সূত্র,গুগল) সেভিংস রেট (সঞ্চয় প্রবৃত্তি) গত পনেরো বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। পাশাপাশি, ইনভেস্টমেন্ট রেট ২০০৮-এর (৪০%) থেকে ২০১২-১৩ পর্যন্ত (৩৫+)-এর আশেপাশে থাকলেও ২০১৬-১৭-য় অধোমুখী হয়ে পড়ে। ঠিক তেমনই রপ্তানিবাণিজ্যে ভারতীয় পণ্য ২০০৩-এর শতকরা ১০ থেকে ২০১২-১৩য় ১৬%-এর চড়াই পার করে এখন নিম্নমুখী ফের।কাজের সন্ধানে অজস্র বাঙালি গত দুতিন দশক ধরে কাজের বাজার না থাকায় প্রবাসজীবন বরণ করে নিতে বাধ্য হয়েছিল। করোনাধাক্কায় সে গুড়েও বালি পড়ল। কাজকর্ম ছেড়ে সবাই ঘরমুখো হলেন। আনএমপ্লেয়বল তকমাটি হাওয়ায় ভেসে উঠল। করোনার মতোনই এটিও একটি মারণ-ভাইরাস। একটি বস্তির ছেলে কি ‘কমপ্ল্যান বয়’ হতে পারে? একজন জ্যাভেরিয়ান আর একজন চিত্তরঞ্জনিয়ান কী একই স্তরের মেরিটধারী হতে পারে ? ‘to make live’ আর ‘to let live’ সম্বন্ধে গ্রাচিনি আর তাতলিক মন্তব্য করেছেন যে ‘to make live’-এর অর্থ হল বাঁচার পরিমণ্ডলকে উন্নত করে তোলা আর ‘to let live’-এর অর্থ হল কোনো সাধন/ উপকরণ ছাড়াই কেবল বেঁচে থাকতে দেওয়া; আদতে যা “to let die’-এর নামান্তর। এই ব্যাপারটি দু-ধরণের ‘বায়োপ্লিটিক্স’-এর আধার। শেষেরটি অর্থাৎ ‘to let live’ হচ্ছে নিখাদ ‘নেক্রোপলিটিক্স’ বা শবকেন্দ্রিক রাজনৈতিকতা।নেক্রোপলিটিক্স-এর মধ্য দিয়ে, তারা মনে করেন বায়োপলিটিক্সের তীব্রতর রূপের সন্ধান পেয়েছেন আর একইসঙ্গে বিশ্বব্যাপী নব্য-উদারবাদী ধনবাদের মাধ্যমে বায়োপলিটিক্সের ঐতিহাসিকতা, ইতিহাসলগ্নতার ক্ষেত্রটিও প্রস্তুত করে তুলি। ’অর্থ হয়, যারা ঘরে ফিরে এসেছে তারা নামগোত্রহীন কাগাবগা। আনএমপ্লয়েবল। উদ্বৃত্ত। মরণাপন্ন। পরিত্যাজ্য।

সবিশেষ লক্ষণীয় যে একটি স্বাস্থ্যসমস্যা কীভাবে সারাবিশ্বের অর্থনীতিকে তছনছ করে দিয়েছে। বিশেষত, ভারতীয় অর্থনীতির সমস্ত সেক্টরগুলোরই সামূহিক ক্ষতি করেছে। বিশ্ববাজার এবং দেশীয় বাজারগুলো বন্ধ থাকায় অন্তর্বাণিজ্যের পাশাপাশি বহির্বাণিজ্যও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমস্ত ফ্যাক্টরি আর অফিসগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে পণ্য পরিষেবা ও উৎপাদন-ব্যবস্থা প্রায় ধ্বস্ত হয়ে পড়ে। কৃষিপণ্যের সরবরাহ-ক্রম বা শৃংখল ভেঙ্গে পড়ার কৃষিক্ষেত্রের উৎপাদন–ব্যবস্থায় উপর সরাসরি প্রভাব পড়ে। মণ্ডিগুলো ধুঁকতে শুরু করে। সরবরাহ-ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার পাশাপাশি নতুন চাহিদা তৈরি হওয়াও স্তব্ধ হয়ে যায়। আর চাহিদা কমে যাওয়ার প্রত্যক্ষ ফল হিসাবে প্রায় ১৫ মিলিয়ন মানুষ রুজিরোজগার হারিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়ে। বাজারে চাহিদা সৃষ্টি না হওয়ার কারণে রাজস্ব ঘাটতি হওয়ার ভয়ে সরকার বাজেট বরাদ্দ কমিয়ে তো দেয়ই; উপরন্তু, গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো সরকার, এই করোনাকালেই, কৃষিকর্মীদের এক মরণপণ আন্দোলনের মুখে ঠেলে দেয়। বৃহৎপুঁজির স্বার্থ রক্ষার্থে সরকার পার্লামেন্টে তিনটি আইন পাশ করায়। কৃষিকর্মিরা আইনগুলোর তীব্র বিরোধিতা করে মরণপণ আন্দোলনে নামেন; যেহেতু তাঁরা মনে করতেন যে আইনগুলো তাঁদের অস্তিত্বের শিকড়সুদ্ধু উপড়ে ফেলে দেবে । মণ্ডিব্যবস্থা ধীরে ধীরে লোপ পাবে এবং আইনের প্রয়োগ ঘটিয়ে কৃষকদের অতি স্বল্পমূল্যে কর্পোরেট সংস্থার কাছে পণ্য বেচতে বাধ্য হবেন। তাঁরা আইনি প্রতিকার পাবেন না। সেইজন্যে মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস বা ন্যূনতম সহায়তা মূল্যের দাবিতে অনড় হতে বাধ্য হন । আন্দোলন একশো দিন পার করে। সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে যে ২৬/১১/২০২০-তে কৃষিশ্রমিকের আন্দোলনের সমর্থনে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন মানুষ শামিল হন। ২৬শে জানুয়ারী ২০২১-এ লাখো কৃষকের জমায়েত প্রত্যক্ষ করে রাজধানী দিল্লি। ১৯৯৫ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত কুড়ি বছরে দেশের ২,৯৬,৪৩৮ জন কৃষক আত্মহত্যা করেন। তার মধ্যে, ২০১৯-এই কেবল ১০,২৮১ জন আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের তড়িঘড়ি লকডাউন তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বিশেষজ্ঞজন, বিশেষত ইভ স্মিথ দারিয়ান, এই বিশেষ জনবিরোধী প্রবণতাটিকে ‘necroeconomy’ আখ্যা দিয়েছেন। কেননা, তিনি মনে করেন যে এই ধরণের হঠকারী ও অমানবিক অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়ার পিছনে যেন কিছু মানুষের বাঁচার অধিকারকে হেয় করা হয়েছে; অর্থনীতিকে সুদক্ষ, সমৃদ্ধ এবং চাংগা করে তোলার প্রয়োজনে কিছু মানুষকে ‘কিলেবল’=’বধ’যোগ্য ঠাওর করা হয়েছে।
টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী,অস্ত্র আমদানির বিষয়ে—সারা বিশ্বের মধ্যে—ভারত হল দ্বিতীয় স্থানাধিকারী। প্রথম দেশটি হল সৌদি আরব। ২০১৬-২০২০ অর্থবর্ষে সারা বিশ্বে যতো অস্ত্র কেনাবেচা হয়েছে,তার শতকরা ৯.৫% কিনেছে ভারত। সৌদি-১১% । যুদ্ধাস্ত্র রপ্তানিকারক প্রথম পাঁচটি দেশ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (৩৭%), রাশিয়া (২০%), ফ্রান্স (৮.২%), জার্মানি (৫.৫%) এবং চীন (৫.২%)। এই পাঁচটি দেশ মোট অস্ত্রের ৭৬% শতাংশ সরবরাহ করেছে (সূত্র—গুগল)। প্রশ্ন করব না যে (তৃতীয়বিশ্বে) অস্ত্র বিক্রির এমন হুড়হুজ্জত কি নিও-কলোনিয়ালিজম নয়? আকুলা-রাফায়েল-এস ৪০০ কেনা আর সেন্ট্রালভিস্তা সৌধ নির্মাণের টাকায় কি করোনারোধের টিকাকরণ জাতীয় ব্যাপারে বা চাকরি খোয়ানো যুবকবৃন্দের রুজিরোজগারের ব্যবস্থা করা যেত না? প্রাপ্ত তথ্যসূত্রে জানা যাচ্ছে যে একশো দিনের কাজের বরাত আর তেমন নেই। কিংবা থাকলেও পয়সার তেমন যোগান নেই। এশিয়ার আকাশে ফের শকুনেরা কেন হাজির? সে কথা জানা যাবে আরো পরে, হেসে হেসে জানালো রেফারি— ওর্ফে বাঁশি হাতে প্রেমিক কেষ্টা: এখন হাফটাইম, খতিয়ানে বলে শুধু নীল শকুনই ছড়িয়ে পড়েছে এশিয়ার মাঠঘাটে। ব্যথিত হই, শিল্প-সাহিত্য-দর্শন-সংস্কৃতির পীঠস্থান ফ্রান্স ও জার্মানিকে ‘অস্ত্রব্যাপারি’-র দলভুক্ত হতে দেখে! বিশেষত, এই দুটো দেশই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সবচাইতে বেশি ধ্বস্ত-বিধ্বস্ত-ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আর তাঁরাই ফের, অমেয় জ্ঞানভাণ্ডারের পুঁজি নিয়ে, অস্ত্র বানায় আর মানবকল্যাণসূচকে একদম নীচের পাদানিতে, ১৩১ নম্বরে থাকা দেশ—ভারতকে বিক্রি করে! ৭০-৮০’র দশকে ডিস-আর্মামেন্ট নিয়ে জবরদস্ত চর্চা হত। দিনকাল বদলেছে বিস্তর । নেক্রোপলিটিক্স-নেক্রোইকনমির এর চাইতে বড়ো উদাহরণ কি হতে পারে? আমরা বাম-কং-তৃণ-হিন্দুত্ব নিয়ে মেতে আছি। ওদিকে সারা এশিয়া জুড়ে ভাগাড় গজিয়ে উঠছে। চীন-ও সেই দলে নাম লিখিয়েছে। আমাদের নিস্তার নেই। ধম্ম-আফিমে আমরা আকন্ঠ ডুবে আছি। ভাস্কর তো কবেই লিখে গেছেন—
‘সোনালি হাজার শুভেচ্ছা এছাড়া আমি কী আর লিখে জানাতে পারি তোমাকে
এই তো এখন দেখছি পেট ফুলে উঠছে ইতিহাসের
আর আমি নিজেকেই ডেকে বলছি: বেওকুফ,তোমার ভড়ংগুলো এবার ছাড়ো
দেখতে থাকো ওইসব মুখ মুখগুলো পৃথিবীটাকে।’ ( মুখস্নান / স্বপ্ন দেখার মহড়া)…

২৫০/৫০০ কি.মি পথ হেঁটে যে ঘরে ফিরছে তাকে পথচারীর পায়চারি বলব কি করে? কিংবা দিনপ্রতি ১০০ কি.মি সাইকেল চালিয়ে মানুষ যখন নিজের দৈনন্দিনতা / অন্নসংস্থান / রুজিরোজগার বজায় রাখে—সেই আকালের অর্থনীতির প্রশংশায় গদগদ হয়ে ভাবের ঘরে চুরি করব আর আনন্দিত হব এই ভেবে যে কুড়ি হাজার কোটি খরচ করে গণতান্ত্রিকতার নব্য তাজমহল গড়ে উঠছে দিল্লিতে? সারা দেশজুড়ে শ্রমিক মানুষ যখন দি গ্রেট এক্সোডাসে বেরিয়ে পড়ছিল, তখন তাঁদের কুড়ি লক্ষ হাজার কোটির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। শূন্যগুলোই তো নিরেট শূন্যতা—কুড়িলক্ষহাজার কোটির অনাবিলতা। করাপশন বনাম নির্ভরতা, আভিজাত্য বনাম নব্য-সাংস্কৃতিকতা, অনশন বনাম হোর্ডিং, কৃষ্টি বনাম অনাসৃষ্টি, মন (অবলম্বন) বনাম নিয়ন্ত্রণ (কৌশল), সমাজবাদ বনাম ধনবাদ, সরকারি বনাম বেসরকারি, কালাধন বনাম ডিমানিটাইজেশন, রাষ্ট্রীয়তা বনাম আঞ্চলিকতা, মূল্যমান ভার্সেস ইনফ্লেশন এইসব গতানুগতিক পোস্টমডার্ণ টাগ অব ওয়্যার, ব্লাড-ট্রান্সফিউশনের মতো কেউ যেন মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছিল যে জীবন = নেগেটিভ-পজিটিভের সমাসক্তি । গর্ভাবস্থাতেই, ফর্সেপ দিয়ে তুলে নেওয়া হোক তবে এযাবৎ লালিত মানবকল্যাণ। এসো, এসো—শনাক্ত করো আনন্দের ছায়ায় দগ্ধ সহস্র শব। লক্ষ করো, প্রাদেশিকতার ন্যাড়া ছাদে অক্ষম কোকিলতান জুড়েছে কিছু উল্লসিত কাক। শোনপুর মেলার নবতম প্রতিরূপ হয়ে উঠেছে যখন শুয়োরের খোঁয়াড়—তখন আজ—দিনের এই রুগ্ন আলোতেই হবে, সর্বসমক্ষে, ষড়যন্ত্রের শব-ব্যবচ্ছেদের কাজ। গর্ভপাত ইস্যু নয়, খুন হয়েছে আদতে উন্নয়নের ভ্রূণ—ভিসেরা রিপোর্ট লেখা হয় দায়—স্থৈর্য আমাদের, নীরবতা, মুর্খ সহিষ্ণুতা, মূঢ়তা, ঘৃণা, দ্বেষ!!! রজস্বলা আশা থেকে তবু ঢেরগুচ্ছের স্বপ্ন ছলকায়। যে আগুন পোড়াবে বলে শতকরা ৬৩ ভাগ প্রস্তুত হয়েছিল (মনে মনে)—তাকে বলেছি গোপনে—বন্ধু, তোমাকে পোড়াতে হবে রাখ্‌ অর্থাৎ পুরোমাত্রায় ছাই—সরীসৃপসুলভ দৃষ্টিশীতলতায়,গতিহীন স্তব্ধ-স্থিরতায়—পূর্ণত ক্ষয়প্রাপ্ত ২০৬-টি ফসিলাইজড্‌ হাড়গোড়…শালপ্রাংশু আর বুনোলতার আত্মীয়তা নিয়ে মাথা ঘামাবার এই তো প্রকৃষ্ট সময়।

সরল কথাটি তো (৮-১০%) বৃদ্ধির হার বজায় রাখতে গেলে চাহিদা মাফিক কর্মক্ষম দুটি হাতই প্রয়োজন। হ্যাঁ, এই মিল মেশিনের যুগেও । শ্রমের দাম বেশি হয়ে যাচ্ছে, ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী যে। তাই কি ইওরোপ আমেরিকা ফের এশিয়ার দুয়োরে হত্যে দিতে শুরু করেছে? তাই চীনে-বাংলাদেশে এতো কারখানা খুলছে ফের? হে নবকুমার, ওই সস্তা শ্রমের ক্রিমটুকু লোপাট হলে ইকনমি তো বদ্ধজলা। দুহাজার কুড়ি’র জিডিপি’র হার মাইনাস তেইশ (-২৩)। এ বছরেও তেমনই কিছু হতে চলেছে। ইনভেস্টর কনফিডেন্স বজায় থাকবে কি? ভাবো ভাবো হে থিঙ্কট্যাঙ্ক!! করোনা-উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এতদিনের গচ্ছিত ধনে টান পড়েছে। ডিসইনভেস্টমেন্ট আর প্রাইভেটাইজেশন। যা কিছু নিজস্ব ছিল বেচেবুচে পয়লাট। হাত পড়েছে এখন বিদুরের খুঁদকুড়োয়। আমি বুঝেছি সেইসব যা বোঝেনি কেউ। আমি ছিঁড়েছি ফুল—ফুলকে ভালোবেসে। আমি ফোলানো বুকে হাস্যমুখে হেঁটেছি দিবালোকে আর মুখ ঢেকেছি মুখোশে রাতের অন্ধকারে। ইফতারে গেছি, প্রসাদী নিয়েছি সাপারের শেষ ভোজে। আমি পাগল নিরো বেহালা বাজাই তানসেনী দীপকে। আমি জ্বেলেছি আগুন হৃদয়ে হৃদয়ে—মরে যদি,মরুক পুড়ে লোকে। রাজতন্ত্রের একা থেকে গণতন্ত্রের পাঁচসালা ভিড়ে বদলায় সময় শুধু; দুঃখেরা দুঃখই থাকে দুর্লভ একলব্য অনুভবে।

ফিকি-র দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায় যে প্রায় ৫৩% ব্যবসায়িক সংগঠনগুলো অতিমারীর ‘ব্যাপক’ প্রভাবের কথা বলেছে ,৭৩% বলেছে অর্ডার কমে যাওয়ার কথা আর ৮১% ফার্ম নগদ আয় হ্রাস পাওয়ার ঘোষণা রেখেছে। ৬০ মিলিয়ন MSME সংগঠনে ১১০ মিলিয়ন লোক কাজ করে । এই MSME সেক্টরেই (২০২০-র) লকডাউন –এর সবচেয়ে বড়ো প্রভাব পড়েছিল। এইসমস্ত ফার্মগুলোর আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ US$ 10687 মিলিয়ন থেকে US$ ১৬০০০-মিলিয়নে পৌছেছিল । অল ইন্ডিয়া ম্যানুফাকচারাস সংগঠনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৩৫% MSME সংগঠনে ‘পুনরুদ্ধারযোগ্য’ নয় বলে চিহ্নিত হয়।৫৭ শতানগশ জানায় যে তাদের কোনো ক্যাশ রিজার্ভ নেই । কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যক্তিগত সঞ্চয় ভাঙ্গাতে হয় । এইসবকিছুর প্রভাব রপ্তানিবাণিজ্যের ওপর পড়ে । মোট রপ্তানির প্রায় US$ ৪৫,১৯১ মিলিয়ন কমে যায়।(সূত্রঃ রামকুমার: ইম্প্যাক্ট অব কোভিড-১৯)। তবে,অতিমারীর সবচেয়ে বড়ো প্রভাব পড়েছিল বেকারত্বের ওপর। টেলিগ্রাফ কাগজের (12/05/21)প্রতিবেদন অনুযায়ী করোনাকালেই মধ্যবিত্তের সংখ্যা প্রায় ৩২ মিলিয়ন কমে গিয়ে নিম্নবিত্তের পর্যায়ভুক্ত হয়েছে আর প্রায় ৩৪ লক্ষ চাকুরিজীবী শুধু এপ্রিল’২১-য়েই চাকুরি হারিয়েছেন। CMIE ডেটা অনুযায়ী মার্চ-মে ২০২১-এ জাতীয় বেকারত্বের তুলনাত্মক হার ছিল এইরকম

গ্রামীণ    শহরাঞ্চল জাতীয় %
6.17       7.63        6.63   (14/ 3 /2021)
14.34     14.71      14.45  (16/ 5/ 2021)

অর্থ হয়, গ্রামীণ ক্ষেত্রে বেকারত্বের হার উদ্বেগ জনক হারে বেড়েছে । জাতীয় স্তরেও মাত্র দুমাসে বেকারতের পরিস্তিতি খুবই চিন্তাজনক।বেকারত্বের বোঝা সবচেয়ে বেশি পড়েছে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির অপরে.২০১৯-২০তে চাকুরিজীবী মানুষের সংখ্যা ছিল ৮৬.১ মিলিয়ন। এপ্রিল ২০২০তেই সেই সংখ্যা ৬৮.৪ মিলিয়নে নেমে আসে। ২০ থেকে ২৪ বছরের যুবকেরা চাকুরিজীবিদের মধ্যে মাত্র ৯% কিন্তু এদেরই ৩৫% চাকুরি হারায় এই করোনাকালে।
ওঁরা কাজ করতেন শহরে-নগরে, শিল্প-তালুকে, খাঁড়িতে-বন্দরে, স্টোন-কোয়ারিতে, মাছের আড়তে, নুনের ভাটিতে, কিংবা কুলি বা কামার-পরিচারিকা-হোটেল বয়-বাস কন্ডাক্টর,রিকশাচালক, হকার-ব্যাপারি-ঠেলাচালক বা নির্মাণশিল্পে। ঠিক যেমন কলকাতাকে সচল রেখেছিল একদিন “ডি-ইন্ড্রাস্ট্রিয়ালাইজড’ অজস্র মানুষের ভিড়, কতো ভিন্ন-বিভিন্ন পেশার মানুষ। মাইল-মাইল লম্বা সে লিস্টি, কয়েক ছত্রেও ফুরোবে না। ব্রিটিশ অবশিল্পায়নের বদান্যতায় তাঁদেরও এমন হাল হয়েছিল। জমিজমা, চাষ-তাঁত খুইয়ে পথে বসেছিল। ক্রমে বিদেশি শাসকের ঘর-গেরস্থালির নিত্যসঙ্গী হয়ে কেউ খা্নসামা, কেউ হুঁকোবরদার, কেউ পাইক, কেউ বরকন্দাজ। ফলানা-ফলানা। আত্মনির্ভরতা ভালো, আত্মবিস্মৃতি নয়। ওদের ফিরে আসতেই হবে, নইলে সভ্যতার আয়েষী রথের চাকা রুদ্ধ হবে যে। জানিনা এমন বিপ্লব হবে কি কোনোদিনও যে সন্ধ্যে নামার সাথে সাথে সুপারসনিক জেট-এ চেপে বার্লিনের কর্মরত শ্রমিক এসে ঘুমোবে পিকিং-য়ের কোজি নুক-য়ে? দুনিয়াদারির আ-বিশ্ব খোলাবাজারে হঠাৎই অনভিপ্রেত হয়ে উঠছে ’বর্ডারলেস বিশ্ব’ধারণা । চতুর্দিকে “অ-বিশ্বায়নী’ রমরমা। এবং ব্রেক্সিট। আস্তাকুঁড়ে স্থান পেতে চলেছে সীমান্তবিহীন মুক্তাঞ্চল। সর্বত্র হাজির হচ্ছে ফের জাতীয়তাবাদী আপনাপন। সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি, কবচকুণ্ডলের সন্ধান করি। দারিদ্র্য একটি অতিমারী। ক্ষুদ্রঋণ তার টীকা। নিছক পাইয়ে দেওয়া নয়; কোলাটেরাল, থুড়ি, স্থাবর-অস্থাবর নয় ; চাই উৎপাদনমুখী বাস্তবিকতা। দারিদ্র মূলধন ছিল না কখনো। আর হতেও পারে না। ইকনমি তো একটা মিলনস্থল—অর্থ ও শ্রমের। মুখরার মতন কিছু প্রশ্ন এগিয়ে আসে:—

  • সাবপ্রাইমের(২০০৮) মতো দুনিয়াজোড়া ব্যাপক আর্থিক সমস্যা কোনো ছাপ ফেলতে পারেনি। অথচ, করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা সামলে উঠতে অসফল হল ভারতীয় অর্থব্যবস্থা? তবে কি অর্থব্যবস্থায় ঘুণ ধরে গেছে?
  • ইনভেস্টমেন্ট রেট, সেভিংস রেট কি বাড়বে ২০২২-য়ে?
  • মাসে ২ ডলার আয়বিশিষ্ট লোকের সংখ্যা বেড়েছে ৭৫ মিলিয়ন। তারা কীভাবে এই দ্বিতীয় বা সম্ভাব্য তৃতীয় ঢেউ বা আর্থিক টানাপোড়েনের ‘ইনইক্যুয়ালিটি ভাইরাস’-এর মোকাবিলা করবে? মার্চ ২০২০-র তিনমাসের মধ্যেই চাকুরিপ্রার্থীর সংখ্যা ৩৪.২ থেকে ৮৬.৮-এ পৌঁছেছে। কিন্তু বিহারে বা পশ্চিমবঙ্গে এইসব তথ্য কি ভোটবাজারে কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে পেরেছে? উত্তর –এ বিগ নো!।রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতির কোনো সম্পর্ক নেই ২০২০-২১য়ে ।
  • সরকার কি চাহিদা বাড়ানোর লক্ষ্যে,বাজারের গতিশীলতা আনতে—আরো বেশি বাজেট–বরাদ্দ বাড়াবেন? GST
    সূত্রে আয় ১ লাখ কোটির নীচে নেমেছে।
  • ৩২ মিলিয়ন সদ্য নিম্নবিত্তরা কি অবসাদে নুয়ে পড়বেন? কাজের বাজার সৃষ্টি হবে কি আগামী অর্থবর্ষে? ধন্দ হয় , যেহেতু করোনার তৃতীয় ওয়েভ নাকি এখনই ডানা মেলেছে। স্বভাবতই, প্রশ্ন জাগে যে পরপর দু বছরের নেগেটিভ গ্রোথ সামলে পোস্ট-করোনা দিনগুলোয় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কি বাড়বে?
  • যথেষ্ট পরিমাণ টিকা কি বিনামূল্যে, পাওয়া যাবে? অর্থনীতিবিদ প্রভাত পট্টনায়েক করোনার বর্তমান টিকাকরণ নিয়ে অনৈতিক ব্যবসাপ্রবণতা, মুনাফাখোরীর অভিযোগ এনেছেন।

নজর কেড়ে নেয় ফ্রিডম্যানের মন্তব্য যে “এর থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে অতিমারীর মোকাবিলায় জাতীয়তাবাদী ডানপন্থীদের ব্যর্থতা ভয়ঙ্কর…ডানপন্থীরা যে মানুষের বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করেন, সেই মিথ আদতে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল (সূত্র-কনভারসেশন, এপ্রিল ২০২০)

এমতাবস্থায়, বিচার্য বিষয় হল:— ১)করোনার প্রথম ওয়েভ আসার ঢের ঢের আগে ‘ডিমনিটাইজেশন’ নামক এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিয়ে এবং মাত্র চার ঘন্টার নোটিশে রাষ্ট্রব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করে লাখোলাখো পরিযায়ী শ্রমিকের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে তাদের অনাহারে-অর্ধাহারে মৃত্যুর মুখের ঠেলে দেওয়ার সূত্রে সরকার কি ভারতরাষ্ট্রে নেক্রো-ইকনমি জাতীয় পদক্ষেপ নিয়েছিলেন? একইভাবে, বৃহৎপুঁজির স্বার্থরক্ষার্থে ভারতের অন্নদাতা কৃষকদের বিরুদ্ধে কঠোর ও অনমনীয় মনোভাব নিয়ে তাঁদের জীবন ও জীবিকাকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেওয়া তো নেক্রোইকনমিরই পরিচায়ক নয় কি?

এবং ২)করোনার ‘দ্বিতীয় ওয়েভের ক্ষেত্রে ‘লকডাউন’ ঘোষণার বিষয়ে যথেষ্ট গড়িমসি করে এবং দেশীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে অতিমারী মোকাবিলার উপযুক্ত পন্থা অবলম্বন না করায় আমাদের দেশীয় শাসকবৃন্দ কি নেক্রোপলিটিক্সের অনুগামী হলেন না? সংবাদপত্র ও টেলিমিডিয়ার রিপোর্ট সূত্রে অনুমান করা যেতেই পারে যে, যথাযথ প্রস্তুতির অভাবে, কোভিডের দ্বিতীয় ধাক্কাটি সামলাতে ভারতবর্ষ বস্তুত একদমই ব্যর্থ হয়েছে।

ট্রাম্পসাহেব আদতে জীবনহানির বিনিময়ে কাজে ফিরে যাওয়া এবং অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের বিষয়টির মধ্যে ফারাক-পার্থক্যের মাপজোক করতে চেয়েছিলেন । কিন্তু ট্রাম্পকে কয়েকধাপ ছাপিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন প্রাথমিক পর্যায়ে ‘“herd immunity” বা আক্রান্তের প্রতিরোধ শক্তিকে পশুর প্রতিরোধ শক্তির সঙ্গে তুলনা করে কোভিদ-১৯ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার ব্যবস্থা করেননি, যদিও অসংখ্য জীবনহানির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। দারিয়ান স্মিথ লিখেছেন যে ট্রাম্প ভাইরাসটিকে একটি চূড়ান্ত ধাপ্পাবাজি বলে অভিহিত করে কার্যত অবহেলা করেছিলেন। কেবল তাই নয়, ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে মার্কিনী সমর্থন তুলে নেন এবং সবরকমের সহযোগিতা প্রত্যাহারের কথাও ঘোষণা করার পাশাপাশি চটজলদি মার্কিনী অর্থনীতির হাল ফেরানোর লক্ষ্যে মেডিক্যাল বিশেষজ্ঞদের অভিমত অগ্রাহ্য করে অপরীক্ষিত ওষুধ ব্যবহারের ঢালাও অনুমতি দিয়েছিলেন। মার্কিনী জনগণ স্বভাবতই বিস্ময়ে শিউরে ওঠেন। লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণনাশ ঘটে। দারিয়ান স্মিথ লিখেছেন যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এমন মনোভঙ্গির প্রভাব পড়ে বাকি বিশ্ব নেতাদের মধ্যে,যাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন রাশিয়ার পুটিন, ভারতের নরেন্দ্র মোদি, ব্রাজিলের বোলসোনারো আর ব্রিটেনের বরিস জনসন (সূত্রঃ-ইভ দারিয়ান স্মিথ ,’ডায়িং ফর দি ইকনমি’)।

বাঁচার অধিকার বনাম খতম-অভিযানের লড়াইতে দেরিতে শুরু করেও ব্রিটেনের বরিস জনসন বরং নিশ্চিতই যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেছেন । বলা হল, মানুষ ফের মানুষের সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ হতে পারেন। (10/5/21) তারিখে বরিস জনসন পাবে বসে এক–দু পাঁইট পান করারও মঞ্জুরি দেন ইংলণ্ডবাসীদের। যদিও, সামাজিক মেলামেশার ব্যাপারটা জনসন জনগণের ইচ্ছার ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কাজের জায়গায়, পথিমধ্যে আর দোকানপত্রে আগের মতোই কড়াকড়ি বলবৎ থাকবে। ৮ইমে থেকে লণ্ডনের খেলার মাঠগুলোয় দর্শক ফের মাঠে ভিড় করার অনুমতি পেল। লক্ষণীয় যে ঠিক ওইদিনই, সাবেক সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় নগরীতে লকডাউন জারি করা হল। তৃতীয় পর্যায়ে, ১৭ইমে থেকে, পাব-কাফে-রেঁস্তোরাগুলো খুলে দেওয়া হলে সামাজিক বিধিনিষেধের ব্যাপারে ব্যাপক শিথিলতা আনা হবে বলে জানানো হয়েছে। বলা হচ্ছে ব্রিটেনে মৃতের সংখ্যা মোট ১.২৭,‌৬২৯। পনেরোই মে’২১ ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে বহু মানুষের কলরোল শোনা ও দেখা গ্যাছে। শুধু লণ্ডনই বা কেন, উয়েফা কাপ ফাইনাল অনুষ্ঠিত হতে চলেছে পর্তুগালে। টিকিট বিক্রি শুরু হয়ে গ্যাছে। একই কথা প্যারিসের সম্পর্কে বলা চলে। সেখানে এ মাসের শেষাশেষি ফরাসি টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। পর্তুগালে করোনাআক্রান্তের সংখ্যা ৮.৪৩.৭২৯। মৃত্যু =১৭০১৪ বা ২%।নিউজিল্যাণ্ড নিতান্তই বিস্ময়কর। আক্রান্ত ২৬৬২। মৃত (০.০৯৮% )। এমনকি, মেক্সিকোয় আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ২৩ লক্ষ। কিন্তু আমেরিকায় সেই সংখ্যা ৩ কোটি ৩৮ লক্ষ। আর ভারত, (আজ – ২১/০৫ – এ )=২ কোটি ষাট লক্ষ। অস্ত্র কেনাবেচায় আমরা দ্বিতীয়। করোনাবিমারীতেও রয়েছি দ্বিতীয় স্থানে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেভাবে আগাম সতর্কবার্তা সত্ত্বেও কোভিদ মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে লাখ লাখ মার্কিনী জনতাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনই, যথেষ্ট সময় পাওয়া সত্ত্বেও, শাসনতান্ত্রিক অকর্মণ্যতার জন্যই ভারতবর্ষের অগুণতি মানুষ কোভিদ অতিমারীর শিকার হয়েছেন। এ বিপর্যয় অবশ্যই এড়ানো যেত।

পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের ‘ইবলিশের আত্মদর্শন’-য়ে একটি পংক্তি এরকম ছিল—“একটি জীবাণু পারে অন্ধকারে ঢেকে দিতে সূর্যের শরীর’। কতকিছুই তো বদলে দিল এই ছোট্ট ভাইরাস—বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি-সমাজনীতি-রাজনীতি-বিদেশনীতি। তবু আশা রাখি বিজয়ীর হাসিতে উজ্জ্বল হবে মানুষী সভ্যতা। আশা রাখি, করোনা ভাইরাস হয়তো অসুখের বুক থেকে ‘অ’ অক্ষরটি মুছে দেবে। অসুরক্ষার কব্জা থেকে সুরক্ষার বন্দিত্ব ঘোচাবে, অ-সোয়াস্তি ফের স্বস্তি-দীপ্র হবে। শবকেন্দ্রিক আর্থ-রাজনীতির স্বার্থপরতা, যুদ্ধপরায়ণতা আর ‘কিলেবিলিটির হায়ারার্কি’র অ-কল্যাণ থেকে কল্যাণকামী রাষ্ট্রটি ফিরে পাবে আ-বিশ্ব সমাজ।ফিরে আসবে আমাদের প্রত্ন সুরক্ষা-কেন্দ্রি্কতা। পৃথিবীও—মুনাফা ও মৃত্যুর মধ্যে জীবন বেছে নেবে।

[লেখক – জন্ম ১৯৫০। অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক আধিকারিক। ইতিহাসে স্নাতকোত্তর, ব্যাঙ্কিং  ডিগ্রি প্রাপ্ত  আইন গ্র্যাজুয়েট। কবিতা  দিয়ে  সাহিত্যকৃতির  শুরু। কবিতার বই আটটি।  মূলত  প্রাবন্ধিক। তিনটি বই প্রকাশিত :১] বিনির্মিত কলকাতা (সোপান), ২]দেশভাগের  দায়ভাগ (সোপান), উচ্ছেদ -উদ্বাসন (গাংচিল)। প্রথমোক্ত  বইয়ের  জন্য  বাংলাদেশে পুরস্কৃত। অনুবাদ করেছেন অ্যালিস মুনরো (কারিগর)।]

Facebook Comments

Leave a Reply