পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন ২০২১ – আদিবাসী, দলিত রাজনীতি বিষয়ে দু-একটি কথা : প্রবুদ্ধ ঘোষ

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী, বিজেপি প্রধান বিরোধী দল হয়ে উঠেছে। আপাততঃ ৭৭টা আসন ও প্রায় আড়াই কোটি (৩৮%) ভোট তাদের দখলে। বামফ্রন্ট সম্মিলিতভাবে প্রায় ৩৩ লাখ ভোট (৫.৫%) পেলেও, আসনসংখ্যা শূন্য। কংগ্রেসেরও আসনসংখ্যা শূন্য এবং মোট প্রাপ্ত ভোট ১৭ লাখ ৫৭ হাজার (২.৯৩%)। তৃণমূল কংগ্রেস একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে (২১৩টি আসন ও ৪৭% ভোট) নিয়ে তৃতীয়বারের জন্যে ক্ষমতায় আসীন। এই নির্বাচনে মূল বাইনারি ছিল বিজেপি বনাম অ-বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী ইতিহাসে এই ঘটনা অভূতপূর্ব, যেখানে বিরোধী দলকে ক্ষমতা পাওয়া থেকে আটকাতে তাদের ভোট না-দেওয়ার আহ্বান মুখ্য হয়ে উঠেছে। এমনকি দিল্লি থেকে কৃষক আন্দোলনের নেতারা এসে বিজেপিকে ভোট না-দিতে অনুরোধ করেছেন বিভিন্ন সভায়। বামফ্রন্ট (মূলতঃ সিপিআইএম) তৃণমূল আর বিজেপির সাথে অভিন্ন ভেবে কাল্পনিক বিজেমূল তত্ত্ব বানিয়ে ফেলেছিল, শাসকশ্রেণির মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে চিহ্নিত করতে পারেনি। অন্যান্য কিছু সংসদীয় বামদল বিজেপিকে ভোট না-দেওয়ার কথা বলেছিল, কিন্তু কাকে ভোট দেওয়া উচিত সেই দিশা নির্দিষ্ট করতে পারেনি। কারণ, সংসদীয় নির্বাচনী ব্যবস্থা মানে, ভোট দিয়ে শাসক পছন্দ করার পদ্ধতি। কোনও নির্বাচনী কেন্দ্রে বিজেপির বিরুদ্ধে শক্তিশালীতম যে দল, তাকে ভোট দেওয়ার আহ্বান প্রকারান্তরে তৃণমূলের পক্ষে যায়। আর, ‘নো ভোট টু বিজেপি’ আশু নির্বাচনভিত্তিক স্লোগান হতেই পারে, কিন্তু যে ফ্যাসিবাদ গোটা আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে গ্রাস ক’রে নিচ্ছে, তার বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী কোনও অভিমুখ রাখতে পারে না। কারণ, ‘নো ভোট টু বিজেপি’র শ্রেণিঅবস্থান ও বর্ণ-রাজনৈতিক অবস্থান নেই। আইএসএফের উত্থান এই নির্বাচনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, নিঃসন্দেহে। পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু রাজনীতিতে আব্বাস সিদ্দিকী বিতর্কিত নেতা। তার পুরুষতান্ত্রিক বাচন ও ধর্মগুরুসুলভ আদেশ নিন্দার্হ, কিন্তু সরকারের প্রতি তার সমালোচনা অকাট্য। সংযুক্ত মোর্চার তরফে আইএসএফ যে ৩০টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল, তার ১টিতে জয়ী হয়েছে; বাকি ২৯টি আসনের ২৬টিতে তৃণমূল ও ৩টিতে বিজেপি জয়ী। শেষপর্যন্ত নির্বাচনের ফলাফলে বাংলার রায় তৃণমূলকে যতটা না চেয়েছে, বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান করেছে তারও বেশি। বিজেপির ক্ষমতালাভের আশঙ্কাকে সত্যি না-হতে দেওয়ার জন্যেই আপাততঃ ভরসা রাখতে বাধ্য হয়েছে স্বৈরতান্ত্রিক তৃণমূলে (অন্য সংসদীয় দলগুলির সেই বিশ্বাসযোগ্যতাটুকুও আর নেই)। কিন্তু, নির্বাচনের ফলাফলে ও বিগত দু’টি নির্বাচনের ফলাফলে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে পশ্চিমবঙ্গের তফসিলি জাতি, তফসিলি জনজাতি ও মূলবাসী মানুষের পছন্দ-অপছন্দ। বিষয়টি আলোচনা করা যাক-

এই নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন আদিবাসী ও দলিত নির্বাচকরা এবং মহিলা নির্বাচকরা। পশ্চিমবঙ্গের মোট ২৯৪টি আসনের মধ্যে ৬৮টি আসন শিডিউল্ড কাস্ট (তফসিলি জাতি) ও ১৬টি আসন শিডিউল্ড ট্রাইবদের (তফসিলি জনজাতি) জন্যে সংরক্ষিত। এই ৮৪টি আসনের মধ্যে ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল ও বিজেপি যথাক্রমে ৪৫টি ও ৩৯টি আসনে জয়লাভ করেছে। অসংরক্ষিত সাধারণ আসন তথা ‘উচ্চবর্গ’-র আসনে তৃণমূল ও বিজেপি যথাক্রমে ১৬৯টি ও ৩৮টি আসন পেয়েছে। অর্থাৎ, তুল্যমূল্য বিচারে, বিজেপির প্রাপ্ত আসনের অর্ধেক এসেছে সংরক্ষিত আসন থেকে আর তাদের নির্বাচনী সাফল্যের হারও ওই আসনগুলিতে বেশি। তফসিলি জাতির জন্যে সংরক্ষিত সব আসনের মধ্যে ৩১টি ও তফসিলি জনজাতির জন্যে সংরক্ষিত আসনের মধ্যে ৮টি বিজেপি জিতেছে। ভোটের হিসেবে তফসিলী জাতির জন্যে সংরক্ষিত আসন থেকে তৃণমূল পেয়েছে ৪৬.২% ভোট এবং বিজেপি পেয়েছে ৪২.৮%। আর, তফসিলি জনজাতির মোট ভোটের ৪৫.২% পেয়েছে তৃণমূল ও ৪৪% পেয়েছে বিজেপি। অর্থাৎ, তফসিলি জাতির ১১% নির্বাচক ও তফসিলি জনজাতির ১০.৮% নির্বাচক অ-তৃণমূল অ-বিজেপি সংসদীয় দলকে ভোট দিয়েছেন (এই ১১%-র সিংহভাগ পেয়েছে সংযুক্ত মোর্চা)। একটা জিনিস অন্ততঃ পরিষ্কার যে, দক্ষিণপন্থী বাইনারিতেই ভাগ হয়ে গেছে তফসিলি ভোট। তফসিলি জনজাতির ভোট দক্ষিণপন্থামুখী হওয়া কোনও অত্যাশ্চর্য ঘটনা নয়। বাংলার রাজনীতির দীর্ঘদিনের ভদ্রলোকায়নের বিপরীতে নিম্নবর্গের সঙ্ঘবদ্ধতার এক প্রবণতা উঠে আসে এবং সেই প্রবণতা একরৈখিক নয়। প্রথমতঃ, একুশ শতকের শুরুর দশক থেকেই মতুয়া মহাসঙ্ঘ রাজনীতিতে নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর ছিল। মহাসঙ্ঘ শুধুমাত্র নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে সচেতন হল না, বরং ভদ্রলোক-রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান ক’রে বিধানসভায় ঠাকুর-পরিবার থেকে প্রার্থীপদ দাবি করল। তৃণমূলের টিকিটে ২০১৪ সালে জিতলেন কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর। পরিচিতি-রাজনীতির (Identity Politics) এই নতুন অধ্যায়ে আরএসসের হিন্দুত্ববাদ কি চুপ থাকতে পারে? ২০১৪ সালেই তারা মতুয়া রাজনীতির অন্যতম প্রচারক কেডি বিশ্বাসকে প্রার্থীপদ দিল এবং ২০১৫ থেকে মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর মিজেই বিজেপিতে যোগ দিলেন। পরিচিতি-রাজনীতির প্রয়োজন ছিল দীর্ঘদিনের ভদ্রলোক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে ও দলিতদের নিজস্ব শ্রেণি-বর্ণ অবস্থানের সোচ্চার ঘোষণায়। কিন্তু, একইসঙ্গে তৃণমূল ও সংসদীয় বামেদের সচেতনতারও প্রয়োজন ছিল। বিজেপি-আরএসএস হিন্দুরাষ্ট্রের মতাদর্শকে অনুশীলনে প্রয়োগ ক’রে নাগরিকত্বের রাজনীতি নিয়ে এসেছে। [১] বিজেপি ক্ষমতায় এলে শরণার্থী দলিতদের নাগরিকত্ব দেবে- এমত প্রচারকে বিজেপি প্রাধান্য দিয়েছিল, তার সঙ্গে ছিল বহুল পরিমাণ অর্থ ও মিডিয়ার ফাঁপানো প্রচারকৌশল। বিজেপি সুকৌশলে এড়িয়ে গেছিল অসমে এমনই নাগরিকত্ব দেওয়ার নাম ক’রে ১৯ লক্ষ মানুষকে (যার মধ্যে ১৩ লক্ষ হিন্দু শরণার্থী) ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানোর বাস্তব। পরিচিতি-রাজনীতিকে হিন্দুত্বের মোড়কে মুড়ে ফেলার রাজনীতি দিয়ে বিজেপি ২০২১ সালে ক্ষমতা দখল করতে পারেনি, কিন্তু তাদের এই ‘ভ্রান্ত সচেতনতা’ তৈরির চেষ্টা ভবিষ্যতেও জারি থাকবে। দ্বিতীয়তঃ, দলীয়-পতাকার তলায় স্থানীয় ও আঞ্চলিক সম্প্রদায়গত আকাঙ্খাকে অভিমুখ দেওয়ার পদ্ধতিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে দলিত ও আদিবাসী অস্তিত্বের রাজনীতি নিজস্ব অভিমুখ খুঁজে পেতে চাইছে। “Party Banners are no longer the only identity of candidates in the fray. For instance, Manohar Tirkey of RSP, Dasarath Tirkey of TMC and BJP’s Birendra Bera are known by their Oraon origin. Joseph Munda of Congress has a protestant Christian lineage. In other words, the party identity of a candidate is no longer the only strong marker of her or his political credibility, rather the identity of the candidate as a ‘minority’ has become crucial in support of the candidature” [২] শুধুমাত্র উন্নয়নের মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং সেই প্রতিশ্রুতির ‘কৃতজ্ঞতা’ ভোটে বদলে দিয়ে কিংবা শুধুমাত্র শ্রেণিপরিচিতি (গরিব বড়লোকের সরলীকরণ) দিয়ে আর এঁদের সামাজিক-রাজনৈতিক আকাঙ্খাকে এঁটে ফেলা যাবে না। এঁরা শ্রেণিসংগ্রামে বিমুখ নন, এঁরা হিন্দুত্ববাদে বিমোহিত হয়ে ধর্মকে সর্বাগ্রে রাখেন এমনটা নয়, এঁরা নিজেদের পরিচিতির স্বীকৃতি চান, এঁরা শ্রমের মর্যাদার পাশাপাশি এতদিনের সমস্ত সামাজিক-সাংস্কৃতিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে সম্মানজনক অংশগ্রহণ চান। রণবীর সমাদ্দার তাঁর প্রবন্ধে বাউড়ি ও বাগদি সম্প্রদায়ের আর্থিক-সামাজিক অবস্থান ও আকাঙ্খার উল্লেখ করেছেন। বীরভূম ও বাঁকুড়ায় কৃষিজমির আন্দোলনে তাঁরা সামনের সারিতে ছিলেন কিন্তু এখনও পর্যন্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি, পুনর্বাসনসহ মৌলিক দাবিগুলিকে কোনও সরকারই আমল দেয়নি। [৩] না, বিজেপি কিংবা আরএসএসও তাঁদের আকাঙ্খার মর্যাদা দেবে না। আরএসএসের ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শ তাঁদের দিয়ে হিন্দুরাষ্ট্রের ‘ফৌজ’ বানাতে পারে কিন্তু তাঁদের স্বাধিকারের প্রশ্নকে দমিয়েই দেবে। তবু, বর্তমান ও পূর্বতন শাসকের উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে বিজেপি এঁদের আশু স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যবহার ক’রে নেবে। ঠিক যের’ম ভদ্রলোক-মধ্যবিত্তকে চাকরিতে দুর্নীতি, সিন্ডিকেটের দুর্নীতির বিজ্ঞাপন দিয়ে ব্যবহার ক’রে নিতে চেয়েছে, সের’মই এঁদের আর্থ-রাজনৈতিক বঞ্চনার ইতিহাস বিজ্ঞাপিত ক’রে ব্যবহার ক’রে নিতে পারে।
বিজেপি যে’কটি সংরক্ষিত আসনে জিতেছে, তার অধিকাংশ মতুয়া অধ্যুষিত অঞ্চল এবং উত্তরবঙ্গের রাজবংশী অধ্যুষিত অঞ্চল। আর, জঙ্গলমহলে ১২টি সংরক্ষিত আসনের ৩টিতে বিজয়ী তারা। আরও কিছু পরিসংখ্যান দেখা যাক- ২০১৯ সালে ওই ৮৪টি আসনের মধ্যে ৪৬টিতে বিজেপি জিতেছিল আর ৩৮টা আসনে তৃণমূল। ২০১৯ লোকসভা ভোট বাংলার সংসদীয় রাজনীতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট। কারণ, এই নির্বাচনের ফলাফল (তৃণমূল ২২,[৪] বিজেপি ১৮ ও কংগ্রেস ২) বাংলায় বিজেপি-আতঙ্কের আবহ তৈরি ক’রে দেয়। বামফ্রন্টের আসন শূন্যতে ও ভোট ২৩% কমে গিয়ে ৬.৩৪%-তে নেমে আসে। বিজেপির ভোট বেড়েছিল ২২.৭৬%; যদিও, তৃণমূলের ভোট বেড়েছিল ৩.৪৮%। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল ও বিজেপির আসনসংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩৪ ও ২। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল পেয়েছিল ২১১টি আসন, বামফ্রন্ট ৩২টি, কংগ্রেস ৪৪টি ও বিজেপি ৩টি। আগের নির্বাচনের থেকে বামফ্রন্টের ভোট ১৩.৫% কমলেও, বিজেপি ও তৃণমূলের ভোট বেড়েছিল যথাক্রমে ৫.৫৬% ও ৫.৯৮%। মাদারিহাট, বৈষ্ণবনগর ও খড়গপুর সদরে জিতেছিল বিজেপি। আর, সেই নির্বাচনেই প্রায় সকল নির্বাচনবোদ্ধার অগোচরে ভবিষ্যতের প্রস্তুতি সেরে ফেলছিল বিজেপি-আরএসএস। ভারতে তফসিলি জাতির দ্বিতীয় সর্বাধিক জনসংখ্যা বাংলায়, ২৩.৫১% এবং তফসিলি জনজাতি আরও ৫.৮%। সংরক্ষিত আসনগুলির মধ্যে যেক’টি আসনে মুসলিম অধিবাসী বেশি, সেগুলি তৃণমূলের দখলে গেছিল, কিন্তু বাকিগুলিতে বিজেপির আধিপত্য। ২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির প্রধান পদে বসে দিলীপ ঘোষ (পিছড়েবর্গ)। আর, ২০১৬ সালে বহু অসংরক্ষিত আসনেও তফসিলি জাতি ও জনজাতির প্রার্থী দেয় বিজেপি। আদিবাসী অঞ্চলে ও উত্তরবঙ্গের মূলবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে (ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি)-তে সরস্বতী স্কুল, বিবেকানন্দ বিদ্যাবিকাশ পরিষদ, অখিল ভারতীয় শিক্ষা সংস্থান ইত্যাদি নামের অধীনে সরকারের অনুমতি ছাড়াই বহু ইস্কুল খুল ফেলে আরএসএস। তাদের বহু শাখাসংগঠন রাতারাতি গজিয়ে ওঠে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে। মতুয়া অধ্যুষিত অঞ্চলে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি থেকে বিজেপি ‘নাগরিকত্ব প্রদান’-র কুমীরছানা দেখিয়ে ভোট বাগাতে শুরু করে, কিন্তু তার প্রায় দেড়-দু’বছর আগে থেকেই পাখির চোখ ক’রে নেয় দলিত অধ্যুষিত উদ্বাস্তু কলোনিগুলিকে। আরএসএস-নিয়ন্ত্রিত ইস্কুল, শাখা ও উদ্বাস্তু কলোনির মধ্যে হিন্দুত্ববাদী প্রচারের দু’টি সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে- মুসলিমবিদ্বেষ ও সনাতনবাদ।

কিন্তু, প্রস্তুতি সত্ত্বেও, ২০১৯ লোকসভা ভোটের আগে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির এত বড় সাফল্য আগে আসেনি। তফসিলি জাতি ও জনজাতির ভোটের বড় অংশ বিজেপির ঝুলিতে গেছিল। আর, ২০১৯-র মে থেকে ২০২১-র মে অবধি দু’বছর বিজেপি-আতঙ্ক তাড়া ক’রে বেড়িয়েছে বাংলার মানুষকে। বাংলায় বিজেপির এই প্রভাববৃদ্ধির পেছনে বেশ কিছু প্রকট কারণ রয়েছে। যেমন- (১) তৃণমূলস্তরে তৃণমূলের মাত্রাছাড়া দুর্নীতি। সিন্ডিকেট। কাটমানি। আবাসপ্রকল্প থেকে বিধবাভাতা থেকে ‘শ্রী’ প্রকল্পগুলি থেকে Mgnrega প্রকল্পে কাজ- তৃণমূলের নেতানেত্রীরা অসৎতর হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। (২) ২০১৮ পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের সন্ত্রাস বহু মানুষকে বীতশ্রদ্ধ ক’রে তুলেছিল, বহু বুথে কার্যত পুলিশ-প্রশাসনের সহায়তায় প্রকাশ্যে রিগিং করার সাহস পেয়েছিল স্থানীয় নেতারা। ২০১১ সালের পর থেকে সংসদীয় কমিউনিস্ট পার্টির ভোট-মেশিনারি ও রেজিমেন্টেশন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে (মতাদর্শের সঙ্গে সঙ্গতি না থাকার ফলাফল) এবং তৃণমূল কংগ্রেস বেপরোয়াভাবে তার দখল নেয়। ২০১৬ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিচুতলার বামফ্রন্ট কর্মীদের নৈতিক-মানসিক দৃঢ়তায় আরও ফাটল ধরায়। (৩) পাড়ায়-গ্রামে-ব্লকে অ-তৃণমূল মানুষদের মারধর ক’রে বিরোধীশূন্য করার চেষ্টা করেছিল তৃনমূল। আর, বিজেপি ও আরএসএসের নেতারা বিভিন্ন কৌশলে তৃণমূলকে প্রতিরোধ করতে পেরেছিল, সংসদীয় কমিউনিস্ট পার্টিগুলি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। ফলে, বহু নিপীড়িত মানুষ আশু সুরাহার জন্যে বিজেপির ছাতার তলায় আসতে বাধ্য হন। এবং (৪) আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী প্রচারকৌশল- কেন্দ্রের সহায়তা ও মুৎসুদ্দি বেনিয়াদের অর্থানুকূল্যে হিন্দুত্ববাদের পক্ষে প্রচার চালানো, মন্দির তৈরি, হনুমান জয়ন্তী পালন ও মুসলিমবিদ্বেষ ছড়াতে ঘৃণ্য পদক্ষেপ নেওয়া- আরএসএস বাকি রাখেনি কিছুই। তৃণমূলের আপাত ‘সেক্যুলারিজম’ দলিত ও আদিবাসী মানুষদের সুরাহা দিতে পারবে না, বিজেপি-আরএসএসের সনাতনবাদ পারবে, এমত বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা দেওয়া গেছিল। আর, এর সঙ্গে আইটি-সেলের প্রচার, ভুয়ো ছবি ভিডিও, ক্ষমতাবানেদের ট্যুইট-ফেসবুক এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের উস্কানিমূলক ভাষণ তো ছিলই। মূলবাসী মানুষের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে আরএসএস জঙ্গলমহলের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রভাব বাড়াতে সক্ষম হয়। বিগত কোনও সরকারই মূলবাসী জনজাতির সমস্যার গভীরে পৌঁছায়নি। ন্যূনতম মূল্যে চাল দেওয়া বা রেশন দেওয়া ভাল প্রকল্প- কিন্তু, খেয়াল রাখা দরকার যে, এটা সরকারের মহানুভবতা নয় বরং দায়বদ্ধতা। মূলবাসী কিছু যুবককে হোমগার্ডের অস্থায়ী চাকরিতে নিয়োগ করা ভাল সিদ্ধান্ত, কিন্তু স্থায়ী সমাধান নয়। মূলবাসী মানুষদের ক্ষমতায়ন ছাড়া তাঁদের দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তাঁরা যখনই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন, রাষ্ট্রীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন, তখনই রাষ্ট্র বাহিনীসমেত ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাঁদের ওপরে। আর, মূলবাসী মানুষের জমি-জঙ্গলের অধিকার কেড়ে নিয়ে সেজ্‌ বানানো বা কর্পোরেটের মুনাফায় তুলে দেওয়া সারা ভারতবর্ষ জুড়েই চলে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার এই ব্যবস্থাকেই পুষ্ট করার সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে। বিজেপির নীতি কি কিছু আলাদা? আদিবাসীসমাজের ক্ষমতায়নের পক্ষে? না। মধ্যভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিজেপির সন্ত্রাস, আরএসএসের আর্যসংস্কৃতির খুনে মানসিকতা সবটাই আদিবাসী জনজাতির বিরুদ্ধে। আধাসেনা ও সেনা নামিয়ে আদিবাসী জনজাতির প্রতিরোধ স্তব্ধ ক’রে দিতে ‘অপারেশন সমাধান’ এনেছে তারা। হিন্দুত্ববাদের অন্তর্ভুক্ত ব্রাহ্মণ্যবাদ ও আর্যায়ন দলিতদের অবমানবিত করে। দলিতদের পিটিয়ে হত্যা করা থেকে সংরক্ষণ-বিরোধী মিছিল করা- আরএসএস ও বিজেপির নীতির মধ্যেই পড়ে। উচ্চবর্ণের মন্দিরে প্রবেশ করার ‘অপরাধে’ দলিতকে পেটানো, নিম্নবর্ণের কিশোরীকে ধর্ষণ ক’রে উচ্চবর্ণের গর্বে বুক ফোলানো কিংবা দলিত বর্গাদারের জমি কেড়ে নিতে উচ্চবর্গের ঠাকুর-ভূমিহারের প্রাইভেট আর্মি পোষা- বিজেপি (অনেকক্ষেত্রে কংগ্রেসও) এই পদ্ধতি অনুশীলন করে। তারপরও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির এত আদিবাসীদরদ কেন? দলিতপ্রেমে উতলা হয়ে জেপি নাড্ডা, অমিত শাহ্‌রা দলিতপরিবারে বসে খাবার খাচ্ছেন ও ফলাও ক’রে প্রচার করছেন। কেন? মতুয়া অধ্যুষিত অঞ্চলে সভার পর সভা ক’রে তাদের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠার মরিয়া চেষ্টা কেন? কারণ, এই সব চেষ্টার মধ্যে দু’টি উদ্দেশ্য লুকিয়ে- প্রথমতঃ সনাতন ধর্মের অধীনে এঁদের সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করানো এবং দ্বিতীয়তঃ হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের আশু প্রয়োজনে দলিত ও আদিবাসী (যাঁরা মূলতঃ অ-হিন্দু) মানুষদের ব্যবহার ক’রে নেওয়া।
বিজেপি উদ্দশ্যপ্রণোদিত ভাবে ‘নিম্নবর্গ’বন্ধু সাজতে শুরু করে। গ্রামীণ এলাকায় যেখানে তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রয়োজন, সেখানে বিজেপির এই ভূমিকা আরও বেশি। আরএসএস-র হিন্দুত্ববাদী সংহতি ও বিজেপির এই ‘ত্রাতা’ হয়ে ওঠা গ্রামাঞ্চলে ভাল রাজনৈতিক প্রভাববিস্তার করেছিল। বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বহুবার ভাষণে বলেছেন যে, “আমি ভদ্রলোক নই” বা “আমি ভদ্রলোকের মতো ন্যাকা রাজনীতি করি না”- স্পষ্টতঃই দিলীপ ঘোষের টার্গেট অডিয়েন্স কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীমহল নয় কিংবা উচ্চশিক্ষিত-ভদ্রলোক সম্প্রদায় নয়। দিলীপ ঘোষের উদ্দিষ্ট-শ্রোতা নিম্নবর্গের মানুষ, যাঁদের সঙ্গে উচ্চবর্গের ও ভদ্রলোক শ্রেণির প্রায়-অনপনেয় দূরত্ব নির্মিত হয়েছে বিগত কয়েক দশকে। ক্ষমতা হস্তান্তরের পরে কংগ্রেসের শাসনকালে এই দূরত্ব বাড়ার কারণ ছিল কংগ্রেসীয় মতাদর্শের ভদ্রলোক-এলিট অবস্থান। জোতদার, বৃহৎ জমি মালিক ও উচ্চবর্গের পুঁজিপতিদের সহায়তায় চলা একটা দক্ষিণপন্থী দল যে দলিত ও আদিবাসীদের ক্ষমতায়নের বিরোধিতা করবে তা বলাই বাহুল্য। ‘প্রগতিশীল’ বামফ্রন্ট সরকারের সময় আশা করা গেছিল যে, ওই দূরত্ব মিটবে, কিন্তু তা আরও বেড়েছে। মরিচঝাঁপিতে নমঃশূদ্র উদ্বাস্তুদের ওপরে বামফ্রন্টের দমন ও গণহত্যা, চুনী কোটালের ঘটনা এবং ভূমি সংস্কারের ঢক্কানিনাদের পরেও উচ্চবর্ণ উচ্চবর্গের হাতে নামে-বেনামে জমির মালিকানা থেকে যাওয়ার উদাহরণগুলি তা প্রমাণ করে। মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়িত করার প্রসঙ্গে জ্যোতি বসুর বক্তব্য ছিল, “বাংলায় দু’টোই কাস্ট- বড়লোক আর গরিব”[৫] অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গে দলিতদের অস্তিত্ব এবং বর্ণরাজনীতি দীর্ঘদিন ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে পরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছুটে গেছিলেন মতুয়াপ্রধান ‘বড়মা’র কাছে। মতুয়াগুরুর পরিবার থেকে সাংসদ, বিধায়ক হয়েছে। ২০১২ সালে উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সম্প্রদায়ের মহান নেতা পঞ্চানন বর্মার নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। রাজবংশীদের প্রতি দীর্ঘদিনের বঞ্চনার সামান্য ‘ক্ষতিপূরণ’ বলা যায় একে। জঙ্গলমহলে মাওবাদীরা যে ন্যায্য দাবিতে রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলন ও গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, মমতা ক্ষমতায় এসেই সেই আন্দোলনকে সেনাবাহিনী দিয়ে দমন করেন এবং বিক্ষুব্ধ মূলবাসী যুবকদের কয়েকজনকে হোমগার্ডের অস্থায়ী চাকরিতে নিয়োগ করেন। আর, শহরের হোর্ডিংয়ে বিজ্ঞাপিত হয়, ‘জঙ্গলমহল হাসছে’; আদৌ হাসে কি? দুর্নীতির বহু স্তর পেরিয়ে প্রতিশ্রুত অর্থ তাঁদের হাতে পৌঁছায় না, জঙ্গলমহলের কৃষিকাজে দীর্ঘদিনের জলসমস্যার সমাধান হয় না। ২০১৯-এ জঙ্গলমহলের একাধিক আসনে জেতার পরে ভোটভিত্তি ধরে রাখতে বিজেপি প্রচুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল- আরএসএস মডেলের ইস্কুল খোলা আর আর্থিক সমস্যা মেটাতে হাতে হাতে কাঁচা টাকা দেওয়ার কাজও করেছে তারা। কিন্তু, তাতে দীর্ঘ সময়ের বঞ্চনা ও সমস্যার মূল সমাধান তথা ক্ষমতায়নের প্রশ্ন নেই, রয়েছে ওপর ওপর কিছু অর্থ আর প্রতিশ্রুতি দিয়ে হিন্দুত্ববাদের পক্ষে ভোট আদায় ক’রে নেওয়ার নীতি। আর, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক অধিকারের বিষয়গুলি নির্বাচনী ইস্তেহারের পাতায় একই বয়ানে লেখা থাকে। কিন্তু দলিত বা আদিবাসীদের মূলগত উন্নতি হয় কি? প্রতিটি সংসদীয় দলই এঁদের ‘ভোটবাক্স’ ছাড়া কিছু ভাবেন না। তাই, সেই ভোটবাক্সের তাগিদেই তৃণমূলকে ফেব্রুয়ারির শুরুতে একগুচ্ছ অনুদান ঘোষণা করতে হয় রাজ্য বাজেটে- পিছড়েবর্গের শিক্ষাহেতু ১০০টি নতুন ইংরেজি মাধ্যম ইস্কুলের জন্যে ৫০ কোটি টাকা ও অলচিকি ভাষার ৫০০টি নতুন ইস্কুলের জন্যে আরও ৫০ কোটি টাকা। আইপ্যাক-টিম তথা প্রশান্ত কিশোর নিশ্চিতভাবেই সেফ্‌টি ভালভের দায়িত্ব পালন করেছেন। মূলবাসী মানুষের ক্ষোভের কারণগুলি সম্পর্কে তথ্যভিত্তিক গবেষণা ক’রে নতুন নতুন প্রকল্পায়নে রাজি করিয়েছেন রাজ্য সরকারকে। নির্বাচনের বেশ কয়েক মাস আগে ছত্রধর মাহাতো ও সুশান্ত ঘোষের মতো দু’ই ‘বামপন্থী’ মুখকে জঙ্গলমহল এলাকায় রাজনীতি করতে ‘অনুমতি’ দেওয়া বিজেপির ক্রমবর্ধমান প্রভাব আটকানোর জন্যে তৃণমূলের সময়োপযোগী কৌশল। আর, বিজেপি-আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী উদ্দেশ্য নিয়ে জঙ্গলমহলের মূলবাসী মানুষ তথা সাঁওতাল, ওঁরাও, কুর্মি, মুণ্ডা, শবর এঁরা সন্দিহান ছিলেনই। বিজেপি কিছু ক্ষেত্রে তাঁদের সংকটের আশু সমাধান হিসেবে বিজেপিকে ভোট দেওয়ানোর পক্ষে রাজি করাতে পেরেছিল তৃণমূলের মাত্রাছাড়া দুর্নীতিকে সামনে রেখে। কিন্তু, আরএসএসের সবথেকে বড় ‘ভুল’ আর্যায়ন বা ‘ঘর ওয়াপসি’-র নীতিকে প্রয়োগ করতে যাওয়া। বিগত কয়েক বছরে ঝাড়খণ্ডে, ওড়িশায় এই কাজটাই তারা করতে চেয়েছে- আদিবাসীদের হিন্দুধর্মের অন্তর্ভুক্ত করিয়ে নেওয়া। কিন্তু, সারি ধরম ছেড়ে, নিজেদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ছেড়ে কেনই বা তাঁরা হিন্দুত্বের আশ্রয় নেবেন? শেষোক্ত এই দু’টি কারণের জন্যে (তৃণমূলের হঠাৎ উন্নয়নমুখী হওয়া ও আরএসএসের হিন্দুত্ববাদ) মূলবাসী মানুষদের ভোট কিছুটা হলেও বিজেপির বিপক্ষে গেছে। কিন্তু, এতে দুশ্চিন্তা শেষ হয়না, ফ্যাসিস্ত আরএসএসের আগ্রাসী প্রভাব ফুরিয়ে যায় না এবং মূলবাসী মানুষের ক্ষমতায়নের প্রশ্নের সমাধান হয় না।

আরএসএস সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনসংখ্যার সুযোগ নিয়ে হিন্দুত্ববাদী নীতি যেভাবে প্রয়োগ করেছে, অন্যান্য সংসদীয় দলগুলির পক্ষে তা সম্ভব নয়। তৃণমূল কংগ্রেস স্বৈরতান্ত্রিক, দক্ষিণপন্থী কিন্তু ফ্যাসিস্ত গুণাবলী অর্জন করেনি। কংগ্রেস উদারনৈতিক, কেন্দ্রবাদী ও নরম-হিন্দুত্ববাদী। আর, সিপিআইএম উদারনীতিতে বিশ্বাসী, বাজার-সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী সমাজ-গণতন্ত্রী দল। এই তিনটি দলকেই প্রকাশ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা অনুশীলন করতে হয় নিজ নিজ দলীয় নীতি অনুযায়ী। আরএসএস-বিজেপি জুটির থেকে অর্থে-ক্ষমতায় এরা কমবেশি অনেকটাই পিছিয়ে। সর্বোপরি, এদের প্রত্যেকেরই রাজনৈতিক হত্যার ইতিহাস এবং বিরোধীমত দমনের জন্যে প্রশাসনিক+দলীয় যোগসাজশে হত্যার ইতিহাস আছে; কিন্তু, ধর্মীয় সন্ত্রসবাদী বিজেপি-আরএসএসের রয়েছে একাধিক সংগঠিত গণহত্যার ইতিহাস এবং সংগঠিতভাবে দলিত ও অ-হিন্দু জাতির মানুষকে গণহত্যার ইতিহাস। বিজেপি এই কাজ প্রকাশ্যেই করে। হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসের পক্ষে সায় দিতে এবং হিন্দুত্ববাদী নীতিকৌশল প্রচার করতে কোনও রাখঢাক রাখে না তারা। ২০১৯ থেকে উপরোক্ত তিনটি দলের বেশ কিছু নেতানেত্রী ‘বিজেপি ২০২১-এ ক্ষমতায় আসছে’ হাওয়ায় ভেসে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিল বটে, কিন্তু উপরোক্ত দলগুলির সঙ্গে মৌলিক কিছু পার্থক্য বিজেপি-আরএসএসের রয়েছে। কিন্তু, এই তিনটি দলই বিভিন্ন সময়ে বিজেপির সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী অনুশীলনের প্রতিযোগিতা করেছে। লক্ষ্য অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু নির্বাচকদের ভোট। বিশেষতঃ শাসকদল তৃণমূল বিজেপির সঙ্গে এই প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে তুলেছিল আরও, মন্ত্রী-সাংসদ-নেতা সকলেই বিজেপিকে খাটো করার উদ্দেশে ‘সহি হিন্দুত্ব’ অনুশীলন করতে নেমেছিল। আরএসএস-বিজেপিকে প্রতিহত করার পদ্ধতি যেখানে হতে পারত উন্নয়নের প্রকৃত মডেল এবং ফ্যাসিস্তবিরোধী জনমুখী রাজনীতি, সেখানে পদ্ধতি নেওয়া হল হিন্দুত্বের আচার-অনুষ্ঠান। পাড়ার মোড়ে মোড়ে হনুমান মন্দির আর ভারতমাতার পুজোস্থল গজিয়ে উঠল। নবাগত রামনবমীর ‘শান্তিপূর্ণ’ মিছিল বনাম ‘উগ্র’ মিছিলের ঝামেলা পেকে উঠল। নেতা-মন্ত্রীরা প্রকাশ্যমঞ্চে বা ফেসবুক-লাইভে স্তোত্রপাঠ আর পুজো করতে শুরু করল। কিন্তু, প্রশ্ন ওঠা দরকার ছিল যে, নির্বাচনের জন্যে ধর্মের ন্যূনতম ব্যবহারই বা কেন হবে? হিন্দুত্ববাদের বাড়বাড়ন্তের যুগে উক্ত পদ্ধতিগুলি কি হিন্দুত্ববাদকেই তোল্লাই দেয় না? অ-হিন্দু নির্বাচকদের ত্রস্ত করে না? আরএসএস ঠিক এই বয়ানটাই প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছিল। শুধুমাত্র শিক্ষিত নিম্ন বা উচ্চ মধ্যবিত্ত মননে[৬] নয়, বরং নিম্নবর্গের মননে বিজেপির নীতিকে প্রতিষ্ঠা দিতে তাদের হাতিয়ার ছিল ওই হিন্দুত্ববাদ। ‘জয় শ্রী রাম’ ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের স্লোগান থেকে রাজনৈতিক স্লোগান হয়ে উঠেছে এই কয়েক বছরে; এই স্লোগান দিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে খানিক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া গেছে এবং হিন্দু-অস্তিত্বের পরিচয়ও জোরদার করা গেছে। বীরভূমের শ্রীচন্দ্রপুর গ্রামের রাজনৈতিক অবস্থান বিশ্লেষণে সাংবাদিক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য আরএসএসের রাজনৈতিক উত্থান ও তৃণমূলের রাজনৈতিক অবক্ষয়ের বেশ কিছু উদাহরণ তুলে ধরেছেন, “According to the villagers, Hindutva started gaining influence among them after the panchayat election, when local organisers of the BJP and the RSS started building public opinion against the selling of cows to traders operating in the weekly cow market at Illambazar, and against Mamata Banerjee’s policy of “Muslim appeasement”, chiefly monthly stipends for imams and muezzins. Most of the young men and women at Shrichandrapur could not recall the name of either the BJP or the TMC candidate, but they all knew what “love jihad” was.”[৭] যদিও, স্নিগ্ধেন্দু শেষপর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, ধর্মান্ধতা নয় বরং তৃণমূলের আর্থ-রাজনৈতিক দুর্নীতি ও সরকারি নীতিপ্রয়োগের ব্যর্থতাই বহু আদিবাসী ও তফসিলি জনজাতির মানুষকে বিজেপিমুখী করেছে। কিন্তু, তা সত্ত্বেও হিন্দুত্ববাদী বয়ানের বাড়বাড়ন্তকে গুরুত্ব সহকারে বিচার করতেই হয়।
বর্ণগত পরিচিতির চ্যালেঞ্জের থেকে, শ্রেণিগত অবস্থানের সচেতনতা থেকে ধর্মীয় বয়ান যখন বড় হয়ে ওঠে, তখন তা চিন্তার বিষয় হয়, বিশেষতঃ উপমহাদেশের রাজনীতিতে। আর, হিন্দুত্ববাদী বয়ান শহুরে কীভাবে ভদ্রলোকেদের মগজে গেঁড়ে বসে আছে, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে আব্বাস সিদ্দিকি ও সেক্যুলার মজলিশ পার্টির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিকে কেন্দ্র ক’রে। ভদ্রলোক রাজনীতির এও এক নমুনা। ২০২০ বিহার বিধানসভা নির্বাচনে অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমীন তথা এআইমিম মহাগাঁটবন্ধনের বাইরে প্রার্থী দিয়েছিল বলে বাংলার সংসদীয় বামপন্থীর, প্রগতিশীল, বুদ্ধিজীবী, মুক্তমনা দক্ষিণপন্থী ও উদারনৈতিক স্বাধীনরা তেড়ে গাল পেড়েছিল। তাদের বক্তব্য ছিল যে, এআইমিম নাকি আসলে বিজেপি-র ‘বি-টিম’ এবং মহাগাঁটবন্ধনের মুসলিম ভোট কেটে বিজেপিকে সুবিধা ক’রে দিতেই তারা স্বাতন্ত্র্যের রাজনীতি করছে! আব্বাস সিদ্দিকি জানুয়ারি মাসের শেষে যখন ভোটে প্রার্থী দেওয়ার কথা বলে এবং সংযুক্ত মোর্চার সঙ্গে জোট করার কথা বলে, তখন এক আশ্চর্য বিভাজন হয়- সংসদীয় বামপন্থীরা যারা এআইমিমের পরিচিতি-রাজনীতিকে গাল পেড়েছিল, তারা হঠাৎ আব্বাসকে নিয়ে গদগদ হয়ে পড়ে এবং মুক্তমনা দক্ষিণপন্থী ও উদারনৈতিক স্বাধীনরা আব্বাসকে গাল পাড়তে থাকে সে অ-বিজেপি মুসলিম ভোট কেটে নেবে আশঙ্কা ক’রে। আব্বাসের দল ক’টা আসন পেল বা কত শতাংশ ভোট পেল, তার থেকেও বেশি বিবেচ্য হচ্ছে, বাংলায় সংখ্যালঘুর রাজনীতি ও পরিচিতির রাজনীতিকে কীভাবে দেখা হয়। প্রথমতঃ, মুসলমান অর্থেই সংসদীয় দলগুলির কাছে (বামপন্থী, ডানপন্থী বা ফ্যাসিপন্থী) ভোট দেওয়ার মেশিন অথবা ভোট কাটার মেশিন। মূলধারার বাম বা ডাম দলগুলির স্বার্থে তাদের ভোট দিয়ে যেতে হবে। দ্বিতীয়তঃ, মুসলমান পরিচিতি নিয়ে কেউ রাজনৈতিক দল তৈরি করছে মানেই সে ‘জেহাদি’ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী! আব্বাসকে বা ওয়াইসিকে সমালোচনা করা যায় তাঁদের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব ও রক্ষণশীলতা নিয়ে, কিন্তু তার বদলে তাঁদের ধর্মীয় পরিচিতিকে সমালোচনা করতেই ব্যস্ত হয় পড়ল উচ্চবর্গ শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। আর, এই সমালোচনাগুলির অধিকাংশের নির্যাস আরএসএসের হিন্দুত্ববাদের থেকে কম কিছু নয়। শিক্ষিত-হিন্দু ভদ্রলোক বাঙালি মুসলমানকে আজও সেই ‘সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ (১৯৩৫)’-র সময়কার দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখতে অভ্যস্ত বোধহয়। আর, বাঙালি দলিতদের ক্ষেত্রে এবং আদিবাসী জনজাতির ক্ষেত্রেও তাদের এই অসহিষ্ণু একবগ্‌গা শ্রেণিসঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রবলভাবে এসে পড়ে। আরএসএস এই দৃষ্টিভঙ্গিরই ফায়দা তুলতে চেয়েছিল। একদিকে বিভিন্ন কৌশলে মুসলমান-বিদ্বেষ বাড়িয়ে দিয়ে, অন্যদিকে অ-ভদ্রলোক নিম্নবর্গের পরিচিতিকে সনাতনবাদের ফাঁদে আটকে ফেলতে চেয়ে। কারণ, ফ্যাসিস্তরা ক্ষমতার আশে কোনও সম্ভাবনাকেই ছেড়ে রাখে না। এই নির্বাচনে অন্ততঃ বিজেপি-আরএসএসের সেই নীতি ব্যর্থ হল। কিন্তু, আমাদের অপ্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গি, ভদ্রলোকীয় রাজনীতির অহং আর শ্রেণি-অসচেতনতা রইল। আর, ফ্যাসিস্ত আরএসএসের সর্বগ্রাসী রাজনীতির ভ্রান্ত মোহের জাল বিস্তারের সম্ভাবনাগুলিও রইল। বিধানসভায় প্রধান ও একমাত্র বিরোধী দল হিসেবে বিজেপি রইল। দক্ষিণপন্থী বনাম উগ্র-দক্ষিণপন্থী দুই শাসকের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-আপস রইল। আর, রইল দলিত, পিছড়েবর্গ, আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের আত্মমর্যাদা ও ক্ষমতায়নের প্রশ্নগুলি। সংসদীয় বামপন্থীদের ফের পুরনো দলিল আর গণপ্রতিরোধের অকৃত্রিম নীতি খুঁজে দেখার সম্ভাবনাগুলিও রইল। সমস্ত সংসদীয় আপসের নীতি-কৌশল ঝেড়ে ফেলে সমাজব্যবস্থা বদলের সদিচ্ছা তারা দেখাতে চায় কিনা, সেই প্রশ্নও তীব্রতর হল। আর, রইল সময় ও আগামীর পথ। দেখা যাক কোন উত্তর, কোন পথ খুঁজে পাওয়া যায়!

[লেখক – গবেষক, তুলনামূলক সাহিত্য, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়]

___________________________________________________________________________________________

তথ্যসূত্র:

[১] এই রাজনীতি নতুন কিছু নয়। নাগরিকত্ব বিল নিয়ে রাষ্ট্র দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছে; কংগ্রেস বা বিজেপি, ক্ষমতায় যে দলই এসেছে, তারাই এই রাজনীতি করেছে। ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব আইন ২০১৯-র আইনের সঙ্গে সম্পর্কিত। আর, ২০১৯ সালে পাশ হওয়া বিল দেশব্যাপী অনেক বেশি আলোড়ন তৈরি করেছে।

[২] Praskanva Sinharoy, West Bengal’s Election Story: The Caste Question, 26th April, 2014

[৩] Ranabir Samaddar, Whatever Has Happened to Caste in West Bengal?, 7th September, 2013

[৪] যদিও বর্তমানে তৃণমূলের সাংসদ সংখ্যা ২০, কারণ শিশির অধিকারী ও সুনীল কুমার মন্ডলের বিজেপিতে যোগদান। যদিও লোকসভার অধ্যক্ষ এখনও তাদের সদস্যপদ খারিজ করেন নি।

[৫] Himadri Ghosh, West Bengal’s Landscape Is Shifting from ‘Party Society’ to ‘Caste Politics’, 12th February, 2021

[৬] বিজেপি-র ‘আর নয় অন্যায়’ স্লোগানের উদ্দিষ্ট ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি। সিন্ডিকেট, চাকরিতে দুর্নীতি, ত্রাণ ও শিক্ষায় বেনিয়ম ইত্যাদি ইস্যুগুলিকে এই স্লোগানের বিজ্ঞাপনী প্রচারে প্রাধান্য দিয়েছিল তারা।

[৭] Snighdendu Bhattacharya, How the BJP won over Bengal’s Scheduled Castes, 3rd April, 2021.

Facebook Comments

Leave a Reply