মূলধারার সামাজিক আন্দোলন এবং বিকল্প সোশ্যাল মিডিয়া ভিত্তিক আন্দোলন ― একে অপরের পরিপূরক না অভাবপূরক? : পাঞ্চালী কর
যখনই মানুষের ওপর, তার অধিকারের ওপর অন্যায় অপশাসন, বঞ্চনার ছায়া নেমে এসেছে, তা রুখে দাঁড়াতে মানুষই একজোট হয়েছে। ভিন্ন আর্থসামাজিক পরিস্থিতি থেকে, কখনও রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতা নিয়ে মানুষ জোট বেঁধেছে প্রতিবাদ করতে, অধিকারের দাবি জানাতে। নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে কৃষক-শ্রমিকের অধিকার, রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের বিরোধিতা থেকে, জল-জঙ্গল বাঁচানোর দাবি, নারী সুরক্ষা থেকে লৈঙ্গিক সমানাধিকার, সমস্ত ক্ষেত্রে মানুষ বিভিন্ন সময় নেমেছে রাস্তায়, তুলেছে আওয়াজ, বা ভরিয়ে তুলেছে সোশ্যাল মিডিয়া।
সামাজিক আন্দোলনের পরিসর সম্পর্কে বুঝতে গেলে প্রথমে দৃষ্টি আকর্ষণ করা প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলনের ধরণের ওপর। ডেভিড এফ. আ্যবার্লে’র গবেষণার ভিত্তিতে সামাজিক আন্দোলনের গতিবিধি দুটো প্রশ্নের ভিত্তিতে বোঝা যায় ― ১. আন্দোলনটি কি বা কাকে বদলাতে চাইছে? ২. কতখানি বদলাতে চাইছে? এই দুটি প্রশ্নের ওপর ভিত্তি করে এবার্লে চার ধরণের সামাজিক আন্দোলনের কথা বলেছেন ― বিকল্পবাদী, সংশোধনবাদী, পুনরুদ্ধারবাদী, এবং বৈপ্লবিক। এ ছাড়াও আন্দোলনের মূল লক্ষ্য, টার্গেট গ্রুপ, পদ্ধতি, ব্যাপ্তি ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে সামাজিক আন্দোলনের গতি প্রকৃতি এবং পরিসর।
সোশ্যাল মিডিয়ায় উত্থানের সাথে সাথে খবর আদান প্রদানের বা যোগাযোগ গঠনের একটা বিকল্প মাধ্যম তৈরি হয়েছে। এর ফলে অল্প সময়ে ইনফরমেশন অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছে যায় বটেই। কিন্তু একই সাথে আমরা বৈদ্যুতিন মাধ্যমের ওপর বেশি নির্ভরশীল হওয়ার দরুন অনেকেই মনে করছে যে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলনে ফিজিক্যাল পার্টিসিপেশন থেকে বিচ্যুতি ঘটছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সলিডারিটি জানিয়ে তারা নিজেদের কর্তব্য সেরে নিচ্ছেন। আবার অনেকে মনে করেন যে সোশ্যাল মিডিয়ার ফলেই এমন অনেক সাধারণ মানুষ, অল্পবয়সী ছেলে-মেয়ে বুঝতে পারছে যে নিজেদের অধিকারের রক্ষার জন্য নিজেদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে, মিছিলে পা মেলাচ্ছে। তাই সোজাসাপ্টা বলে দেওয়া মুশকিল যে সামাজিক আন্দোলনের পরিসর বদলে যাচ্ছে, বরং সামাজিক আন্দোলনে বিকল্প স্পেস তৈরি হচ্ছে, যা মূলধারার আন্দোলনকে বিভিন্ন ভাবে প্রভাবিত করছে ― কখনো সম্পৃক্তও করছে। এবং এই দুটিই খুব জরুরি, কারণ একদিকে ফেসবুক না থাকলে নিয়মগিরি নামটাই অনেকের কাছে পৌঁছাত না, একই সাথে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার হ্যাশট্যাগ শুধু মুঠোফোনে সীমাবদ্ধ থাকলে তা নির্যাতিত মানুষের জীবনে কোন রকম আশার আলো নিয়ে আসবে না, কারণ কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের নির্যাতনের মুখে পড়তে হয় সর্বত্র ― রাস্তাঘাটে, কাজের জায়গায়, এমন কী প্রশাসনের নির্লজ্জ পক্ষপাতের কারণে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি মূলধারার আন্দোলন আর সোশ্যাল মিডিয়ার চলছে একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। সিএএ, এনআরসি বিরোধী আন্দোলন থেকে, হোক কলরব; যত দূর পর্যন্ত হেঁটেছে মিছিল, যত উচ্চ কণ্ঠে উঠেছে স্লোগান, ততই ছড়িয়ে পড়েছে হ্যাশট্যাগ, দেশে বিদেশে।
মূলধারার সংবাদ মাধ্যম যখন রাষ্ট্রের দালালি করতে বদ্ধপরিকর। সাংবাদিকদের একাংশ যখন নিজেদের পেশাগত সততা ভুলে রাষ্ট্রের সুবিধা মাফিক খবর “তৈরি” করতে ব্যস্ত। বিকল্প বৈদ্যুতিন মাধ্যম আমাদের কাছে খবর “পৌঁছে” দিয়েছে। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামে ছড়িয়ে গিয়েছে পাঞ্জাবের কৃষক আন্দোলন থেকে মহারাষ্ট্রের লং মার্চের খবর, দিল্লির গণহত্যা থেকে জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয় হামলার লাইভ ফুটেজ। মানুষ প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং ফিজিক্যাল আন্দোলনে। এই নিমেষের মধ্যে খবর ছড়ানোর খারাপ দিকও আছে বৈকি। সঠিক খবরের সাথে সাথে অনেক ভুয়ো খবরও ছড়িয়ে পড়ে নিমেষের মধ্যে। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশ যে সাম্প্রদায়িক শক্তির কবলে, তারা ধর্মীয় ভাবাবেগ এবং অসহিষ্ণুতাকে কাজে লাগিয়ে মানুষে-মানুষে দাঙ্গা লাগাবার চেষ্টা করে থাকে। এরকম ঘটনা আমরা বহুবার দেখেছি, বিশেষ করে সাম্প্রতিক কালে ভোট পরবর্তী বাংলায় এই ইন্ধন দেয়ার লক্ষণ বার বার দেখা গিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার এই নিমেষে ছড়িয়ে পড়ার চরিত্রকে হাতিয়ার বানিয়ে বিজেপি, আরএসএস ঘৃণা এবং বিদ্বেষের বীজ রোপণ করছে মানুষের মধ্যে, যার মাশুল দিতে হচ্ছে গরিব, খেটে খাওয়া, সংখ্যালঘু মানুষকে, মুসলমান মানুষকে। একই সাথে সোশ্যাল মিডিয়া ছিল বলেই পৃথিবী জুড়ে #মিট্যু আন্দোলন ভিক্টিম-এবিউজার সমীকরণে আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। #মিট্যু আন্দোলন কোন নিৰ্ভুল সোজাসাপ্টা সমাধান দেয়নি, কিন্তু দিশা দিয়েছে যৌন হেনস্তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য, ভয়ে সিটিয়ে থাকা মানুষকে নিজের কথা বলার পরিসর দিয়েছে।
লকডাউনে জমায়েত করা যখন অসম্ভব, তখন নিজেদের রাগ, ক্ষোভ, দাবি মানুষ উগরে দিচ্ছে ফেসবুক, টুইটারে। জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে অতিমারী মাঝে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে অহরহ, এবং তাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্যাটালিস্টের ভূমিকা পালন করছে সোশ্যাল মিডিয়া। দূর দুরন্ত থেকে রোগীর খাবার, অক্সিজেন, হাসপাতালের বেড, এম্বুলেন্স ইত্যাদির জোগাড় করছে ঝাঁকে ঝাঁকে অপরিচিত মানুষ। এই যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। সোনারপুরে বসে একজন মানুষ তারকেশ্বরে একজন পেশেন্টের ওষুধের ব্যবস্থা করে দিতে পারছে। যারা বিভিন্ন এলাকায় রাস্তায় নেমে কাজ করছে তাদের প্রয়োজনীয় তথ্যের জন্য বৈদ্যুতিন মাধ্যমে ডেটাবেস তৈরি এবং নিয়মিত আপডেট করছে দলে দলে মানুষ। এ ছাড়া মানুষের দুরবস্থায় অর্থ সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে হাজারো মানুষ। তা সম্ভব হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগাযোগ স্থাপনের ফলে। অপদার্থ সরকার যখন নিজের অপদার্থতা ঢাকতে মানুষে-মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করতে বদ্ধপরিকর, সেই সময় জাত, ধর্ম, লিঙ্গ, শ্রেণী ভুলে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ছে একে অপরকে বাঁচাবার জন্য; এই ধসে যাওয়া সিস্টেমের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে ― সেটা যদি আন্দোলন না হয়, তবে আন্দোলন কি?
[লেখক – জেন্ডার রাইটিস্ট এক্টিভিস্ট, থিয়েটার কর্মী, এবং লেখক। অল ইন্ডিয়া কুইয়ার এসোসিয়েশনের রাজ্য সহ: সভাপতি। লৈঙ্গিক অধিকার, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন, যৌন হিংসা বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় কর্মী।]