বাম ও জাতীয় কংগ্রেস শূন্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভা : মনোজ চট্টোপাধ্যায়

২৯৪টি আসনবিশিষ্ট রাজ্য বিধানসভায় সাম্প্রতিককালে নির্বাচন সম্পন্ন এবং/অথবা ফলাফল ঘোষিত হয়েছে ২৯০টি আসনে। ২১৩টি আসনে জয়লাভ করে, দুই তৃতীয়াংশের বেশী আসন দখল করে, জয়ের হ্যাট্রিক করে, তৃতীয়বারের জন্য রাজ্য শাসনের সাংবিধানিক অধিকার পেয়েছে মমতা ব্যাবনার্জীর নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস। পক্ষান্তরে আর এস এস এর রাজনৈতিক শাখা সংগঠন, বি জে পি, ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে পর্যুদস্ত হলেও বাম-কংগ্রেস শূন্য বিধানসভায় ৭৭টি আসন পেয়ে শুধুমাত্র প্রধান বিরোধী দল নয়, একমাত্র বিরোধীদলের বা অপেক্ষমাণ সরকারের মর্যাদা লাভ করেছে।
জয় হল কার?

প্রশ্ন হল, জয় হল কার?

বেশীরভাগ মানুষই বলবেন, কেন, জয় হল তো তৃণমূলেরই; পাঁচ বছরের জন্য রাজ্য শাসনের ক্ষমতা পেল হাতে।
আবার কেউ হয়তো বলবেন, জয় হল বামপন্থীদেরই; তাঁদেরই বিশেষ একটি অংশের, যারা “নো ভোট টু বিজেপি” বলে প্রচারাভিযান সংগঠিত করেছিলেন, ধারাবাহিকভাবে, এবং যাঁদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাজ্যের বামপন্থীদের একটা বড় অংশ বিজেপি-কে ক্ষমতা কেন্দ্র থেকে দূরে রাখতে গিয়ে সচেতনভাবেই শাসক দল তৃণমূলের অনুকূলেই ভোট দিয়েছেন বলেই না তৃণমূলের ভোট শতাংশ এবং আসনসংখ্যা বেড়ে গেল এতখানি।
মনে রাখা দরকার, এরাজ্যেন বর্তমানে বাম মানেই বামফ্রন্ট নয় এবং বামফ্রন্ট মানেই সিপিএম নয়।
একদল আছেন, যারা বলবেন, জয় হয়েছে বিজেপি’র-ই, কেন না, তাঁদের আসনসংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩ থেকে ৭৭, ভোট শতাংশও বেড়েছে, এবং বামপন্থীদের কাছ থেকে বিরোধী দলের মর্যাদাটাও তারা নিয়েছে কেড়ে।

সমদূরত্বের নীতি এবং কৌশলটা কি ঠিক ছিল?

বিজেপি এবং তৃণমূলের থেকে সমদূরত্বের নীতিতে আস্থাশীল ছিলেন না অনেকেই। অথচ বামপন্থীরা বিজেপি-কে ‘ফ্যা সিস্ট’ এবং তৃণমূলকে ‘স্বৈরাচারী’ হিসাবে চিহ্নিত করে এই দুই শক্তিকেই কার্যত সমপর্যায়ভুক্ত বলে দাবী করে উভয়ের বিরুদ্ধেই যুগপৎ যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। এই কৌশলটা ঠিক ছিল না বলে মনে করছেন অনেকেই।
কেউ কেউ বলছেন, বামপন্থীদের তথাকথিত বিজেমূলের বিরুদ্ধে লড়াইটা ছিল কিছুটা কাল্পনিক, এবং বেশ কিছুটা আত্মঘাতী।

কংগ্রেস আর বি জে পি কে কি একাসনে বসানো যায়?

কংগ্রেসকে তো, আর যাই হোক, বি জে পির সঙ্গে এক পাল্লায় ফেলা যায় না। বিজেপির ফ্যা সিস্ট অভ্যুত্থানের চক্রান্তের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের প্রতিরোধ সংগ্রামে কংগ্রেস নিশ্চয়ই একটি সহায়ক শক্তি এই মুহূর্তে, যদিও তাদের একটি দীর্ঘদিনের অগণতান্ত্রিকতার ইতিহাস আছে, এবং তারা কোনোমতেই বামপন্থীদের একটা দীর্ঘকালীন স্বাভাবিক মিত্রশক্তি হতে পারে না।

আইএসএফ-এর কি কোনো নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক ইতিহাস আছে?

আইএসএফ-এর কোনো বিশ্বাসযোগ্য রাজনৈতিক ইতিহাস বা ঐতিহ্য নেই। তারা বিজেপি-র মতই একটি নারীবিদ্বেষী এবং ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি কিনা সেটা ভাল করে যাচাই না করে তাদের সঙ্গে নির্বাচনী বোঝাপড়ায় যাওয়াটা বামপন্থীদের পক্ষে উচিৎ কাজ হল কিনা সেটাও বিচারসাপেক্ষ।
কেউ বলবেন, এটি মৌলবাদী মুসলমান সম্প্রদায়ের হঠাৎ গজিয়ে ওঠা একটা নিজস্ব রাজনৈতিক দল। আবার কেউ বলবেন, এটা ছিল এ রাজ্যের দীর্ঘদিনের অবহেলিত, বঞ্চিত এবং পিছিয়ে পড়া হিন্দু এবং মুসলমান সম্প্রদায়গুলির একটি রাজনৈতিক মঞ্চ, যারা জাতীয় দল কংগ্রেস এবং আঞ্চলিকভাবে শক্তিশালী সিপিএম-এর সঙ্গে নির্বাচনী বোঝাপড়া করে শাসনক্ষমতায় অংশীদারি কায়েম করতে চেয়েছিলেন। এইসব পশ্চাৎপদ হিন্দু জনজাতিগুলি মুসলমান সম্প্রদায়ের মতই বঞ্চিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়েরই অংশ এবং এদের জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার লড়াইকে অস্বীকার করে শুধুমাত্র শ্রেণিসংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা তো সফল হয় নি এতদিন। তাই এই পরীক্ষা-নিরীক্ষাটা ভুল ছিল না মোটেই। সাফল্যের মাপকাঠিতে পরীক্ষাটা উতরোল না ঠিকই, কিন্তু দীর্ঘকালীন বিচারে সম্ভবত এই নিরীক্ষাটির প্রয়োজন ছিল।

বাম-কংগ্রেস বিরোধী বিধানসভা ও আগামী দিন

এক অর্থে ভালোই হয়েছে নির্বাচনী ফলাফল। এখন এই সংযুক্ত মোর্চা নামক তৃতীয় শক্তি হাতে একটা লম্বা সময় পাবে, মাঠে ময়দানে ধারাবাহিকভাবে জনস্বার্থে লড়াই আন্দোলন সংগঠিত করে, তারাই যে প্রকৃত জন দরদী বন্ধু এ রাজ্যের আপামর জনসাধারণের, সেটা বিশ্বাসযোগ্যরভাবে মানুষের কাছে তুলে ধরার। তবে তার আগে পারষ্পরিক আলোচনার মধ্যে দিয়ে স্থির করতে হবে লড়াই আন্দোলনের ইস্যুগুলি, যথোচিত গুরুত্ব সহকারে, পারষ্পরিক শ্রদ্ধা ও সহযোগিতার আবহে।
বিজেপি বিরোধী যে কোনো সরকারি পদক্ষেপকে নিঃশর্ত সমর্থন দানের মধ্য দিয়ে গড়ে তুলতে হবে বি জে পি বিরোধিতায় এক সর্বজন গ্রাহ্য বিশ্বাসযোগ্যতা।
একসঙ্গে তৃণমূল এবং বিজেপি’র বিরুদ্ধে লড়াই চালাবার ক্ষমতা যে মিলিতভাবেও বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ-এর নেই, অন্তত এই মুহূর্তে, সেটা স্বীকার করে নিয়ে আপাতত বি জে পি বিরোধী লড়াইটাতেই মনোনিবেশ করতে হবে, বিশেষত ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের কথাটা মাথায় রেখে।
নির্বাচনী সমঝোতাটা যে একটা আপৎকালীন সুবিধাবাদী ব্যবস্থা ছিল না, এটাই যে আগামী দিনের চলার পথ, সেটা নির্ভুলভাবে মানুষের কাছে প্রতীয়মান করতে হবে, কর্পোরেশন মিউনিসিপালিটি পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে লোকসভা পর্যন্ত সর্বস্তরে এই বোঝাপড়ার ভিত্তিতে লড়াই করে।

তার আগে কিছু অবশ্যপালনীয় কর্তব্য

অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে কংগ্রেস এ রাজ্যে ক্ষমতায় নেই। তাই কংগ্রেস বিরোধী মনোভাব রাজ্যববাসীর মনে অতটা তীব্র নয়, যতটা তীব্র বাম বিরোধ মনোভাব, কারণ, বামেদের সম্পর্কে খারাপ কিছু স্মৃতি তুলনায় সাম্প্রতিক, এক থেকে দেড় দশক আগের।
তাই বামেদের তরফে আসা দরকার কিছু সরল লিখিত স্বীকারোক্তি এবং প্রতিশ্রুতি।
একটানা ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকাকালীন শেষ পাঁচ-দশ বছরে বামেদের কিছু কাজকে মানুষ অনুমোদন দেন নি, সেগুলো যে বামেদের ভুল হয়েছিল, সেটা স্বীকার করে নিতে হবে অকুণ্ঠচিত্তে, নির্দ্বিধায়। “মানুষ আমাদের বুঝতে ভুল করেছেন” জাতীয় কথাবার্তায় চিঁড়ে ভিজবে না।
“স্বীকারোক্তি ও প্রতিশ্রুতি” শিরোনামে সব কটি শরিক দলের স্বাক্ষরযুক্ত একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হওয়াটা প্রয়োজন, যে বিবৃতিতে স্পষ্টাস্পষ্টি এক দুই করে উল্লেখ করা হবে, বামফ্রন্ট কি কি ভুল করেছিল। সঙ্গে থাকবে নিঃশর্ত প্রতিশ্রুতি যে আবার একবার যদি মানুষ তাঁদের সেবা করার সুযোগ দেন, তাহলে তাঁরা সজাগ ও সচেতন থাকবেন, এই ভুলগুলির পুনরাবৃত্তি যেন না হয়।

[লেখক – কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজের প্রাক্তন অর্থনীতির অধ্যাপক, ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার অর্থনৈতিক গবেষণা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রবন্ধক। রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ে লেখালেখি করেন।]

Facebook Comments

Leave a Reply