সম্পাদকীয়
“নৌকা গণ। কয়খান নৌকা যাইতেছে বল দেখি? ষোলখানা। বাজি রাখ, আঠারখানা। শৈবলিনী গণিতে জানিত না, একবার গণিয়া নয়খানা হইল, আর একবার গণিয়া একুশখানা হইল। তারপর গণনা ছাড়িয়া, উভয়ে একাগ্রচিত্তে একখানি নৌকার প্রতি দৃষ্টি স্থির করিয়া রাখিল। নৌকায় কে আছে — কোথা যাইবে — কোথা হইতে আসিল?”
সদ্য নির্বাচন হল। ফলপ্রকাশ হল। ‘অপরজন’ তার বর্তমান সংখ্যাটির প্রচ্ছদকাহিনি ‘ভোটে যখন আসন শূন্য’ সাব্যস্ত করল। প্রচ্ছদকাহিনির মধ্যে সত্যতা, বাস্তবতা আছে, অস্বীকার করব না কিছুটা ঠেস, বক্রতা ও শ্লেষ আছে। কোথাও না কোথাও বিঁধবার কথা। বিঁধবে কিনা বলা শক্ত। না বিঁধবার সম্ভাবনা বেশি। ডুবে যাওয়ার সংলাপ সূত্রেই বঙ্কিমের ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসের কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল প্রতাপ শৈবলিনীর সংলাপ ‘আইস তবে দুই জনে ডুবি’। প্রতাপ ও শৈবলিনী, দুই নারী পুরুষের বাল্যাবধি প্রেমের কাহিনি, সেকালের প্রেমের রীতিনীতি মেনেই অগ্রসর হয়েছে। দীর্ঘকাল বাদে, একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের উপান্তে বাস্তবে দুই বিপরীত রাজনীতি ও তাহার পরিণতির এমন হুবহু মিল ঘটবে এরূপ আশাতীত ছিল। দুয়ের মধ্যে কে প্রতাপ কে শৈবলিনী সেই বিচার অনাবশ্যক, কে কাহাকে ডুবতে আহ্বান জানাল তেমনতরো প্রশ্ন অহেতুক। মোদ্দা কথা হল কেউ জোর খাটায় নি, স্বেচ্ছায় বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থীরা জড়াজড়ি করে ‘ডুবিয়াছে’, বিধানসভায় শূন্য হইয়াছে।
‘অপরজন’ পত্রিকার একটা রাজনৈতিক বিশ্বাস আছে। তবে দল নেই। সেই সুবাদে উপদল নেই। নির্বাচন নেই। মত আছে। প্রশ্ন আছে, আপন স্বর আছে, বিচার আছে, কোনটি ঠিক কোনটি ভুল বলিবার হিম্মত আছে, আপন ভুল স্বীকার করার সাহস আছে, যত ক্ষুদ্রই হোক দায় পালনের অঙ্গীকার আছে, ‘অপর’ বলিয়া কথিতদের প্রতি দায় আছে, সত্য ছাড়া কারো প্রতি দায়বদ্ধতা নেই।
বিগত বিধানসভা নির্বাচনে সংযুক্ত মোর্চা সংখ্যায় হেরেছে কেবল নয়, আসন কেবল শূন্য হয়েছে তাও নয় – মূল্যবোধ হারিয়েছে, কোন রাজনীতি ছিল না বলে রাজনীতি হারে নি। থাকলে ইজ্জৎটা বাঁচত, তাও খোয়া গিয়েছে। যারা দীর্ঘকাল লুটে কেড়ে খেয়েছে, আজও যারা খাচ্ছে তারা ‘অপর’জনের মিত্র নয়, শত্রু। তাদের সাথে কোন কারণে জোট নয়, এমন জোট সব কিছুর মধ্যে ‘কৌশল’ নামক বেলপাতা সহযোগে জট পাকিয়ে দেয় – এই কথাটি স্পষ্ট করে বোঝার ও বলার শিরদাঁড়া কম পড়িয়াছে। কম পড়লেও তা নিঃশেষিত হয় নি, তারা আছে এবং থাকবে।
যারা জিতেছে বলে দাবি করছে কেন্দ্র রাজ্য উল্লেখে তাদের আলাদা করে দেখবার কোন হেতু নেই। এরা পরস্পরে ঠোকাঠুকি করবে, এ ছাড়া গতি নেই, এরা দক্ষ বাজীকরের নির্দেশে চলবে, কেউ দুয়ারে থেকে কেউ বা শ্মশানে থেকে, নদীতে লাশ ভাসিয়ে ‘অপর’কে লুটে বন্ধু বানাবার ছল ও কপটের আশ্রয় নেবে – এ ছাড়া যেন এদের গতি নেই। আবার এরা পরস্পরে জড়াজড়ি করে আজ না হোক কাল ডুবে মরবে এতেও কোন সন্দেহ নেই। নির্বাচনে শূন্যর জোরটা এখানেই।
মে, ২০২১