বাংলা বিধানসভা সিপিএমশূন্য হয়েছে, কিন্তু বামপন্থী চিন্তাভাবনার পরাজয় হয়েছে কি? – দীপাঞ্জন ভট্টাচার্য

২০২১ সালের ভোট হয়ে গেল, বাংলাতে তৃনমূল রেকর্ড আসনে জিতে বাংলাতে ক্ষমতাতে এলো। বিজেপির সাম্প্রদায়িকতা, কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতার অপব্যাবহার, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ক্ষমতাশালী নেতাদের দ্বারা শক্তিশালী প্রচার, সিবিআই-ইডি থেকে ইলেকশান কমিশানের মতো আপাত নিরপেক্ষ সরকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষপাতমূলক আচরণকে দূরে ঠেলেই তৃনমূল কংগ্রেস এবারের বিধানসভা ভোটে জিতে বাংলার ক্ষমতা দখল করলো। বাংলার সিংহাসন দখল করা থেকে বিজেপিকে প্রতিহত করার সাথে সাথে আরও একটি বড় ঘটনা এবারের ভোটে ঘটে গেল। স্বাধীনতার পর (১৯৪৭ সাল) থেকে ১৯৬৭ সাল এবং ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত- মোট প্রায়২৫ বছর বাংলাতে রাজত্ব করা জাতীয় কংগ্রেস এবং ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত -টানা ৩৪ বছর রাজত্ব করা সিপিএম এর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের আজকে বাংলার বিধানসভাতে অস্তিত্ব নেই। পাশাপাশি ২০২১সালের ভোটে বিজেপিকে বাংলা দখল থেকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হলেও বিজেপিকে বাংলা থেকে ছুঁড়ে ফেলা সম্ভব হল না। বাংলার প্রধান বিরোধী হিসেবে উঠে এলো বিজেপির মতো একটি দক্ষিণপন্থী দল।
২০২১ সালে দাঁড়িয়ে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিজেপির নাম করলেওসেটা সম্পূর্ণ ভাবে বলাহল না। এই বিজেপি দল নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, আদিত্য নাথের সর্ব্বভারতীয় নেতৃত্বে এবং বাংলাতে দিলিপ ঘোষের নেতৃত্বাধীন চলা বিজেপি। আমি ব্যক্তিগত ভাবে কোন রাজনৈতিক দলের ৫০-১০০ বছরের ইতিহাসকে একটি নির্দিষ্ট দাগে দেগে দেওয়ার পক্ষে নই। যেমন, জাতীয় কংগ্রেসের এক পরিবারের নেতৃত্বাধীন হলেও নেহেরুর কংগ্রেস, ইন্দিরার কংগ্রেস এবং সোনিয়া-রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস এক নয়। তেমন ভাবেযদিও বলা যেতেই পারে যে বাজপেয়ীর আমলে সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপির বৃদ্ধির মধ্যেই আজকের নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপির বীজ লুকিয়ে ছিল কিন্তু পাশাপাশি নির্দ্বিধায় এটাও বলা যায় যে বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন বিজেপির থেকে মোদী-শাহের বিজেপি অনেকগুণ বেশী ভয়ানক, অনেক বেশি রকমের ভারতের সংবিধান এবং সংস্কৃতি বিরোধী। যেহেতু বিজেপি দলের মধ্যে সময়ের সাথে এই বিবর্তন বর্তমান আলোচনার বিষয় নয়, তাই সেই আলোচনার মধ্যে না ঢুকেও একটা কথা বলে দেওয়া যায় যেমোদী- শাহের নেতৃত্বাধীন বিজেপিকে বাংলার জনতার রুখে দেওয়ায় জন্যে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচন বাংলার রাজনীতিতে একটি বড় মাইলস্টোন হয়ে রইল। তেমনি পাশাপাশি এটাও সত্যি যে এই দল যদি বাংলার বিধানসভার প্রধান এবং একমাত্র বিরোধী দল হিসেবে থাকে (আইএসএফের একটি আসন বাদ দিয়ে) তাহলে বাংলার ভবিষ্যৎ রাজনীতি কোন দিকে যাবে সেটা নিয়ে একটা প্রচণ্ড ভয়ের জায়গা রয়েই গেল। একদিকে যেমন কেন্দ্রের ক্ষমতা ব্যবহার করে, যে কোন অজুহাতে এরা বাংলাতে রাষ্ট্রপতি শাসন জারী করে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করবে, তেমনি এটাও ধরেই নেওয়া যায় আরএসএস-এর সাহায্যে রাজ্যের মধ্যে নিজেদের ভিত শক্তিশালী করে, ৫ বছর বাদে বাংলার ক্ষমতা দখলের আরেক আপ্রাণ চেষ্টা বিজেপি করবে। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলার রাজনীতিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রতিহিংসা, রক্তক্ষয়ী মারামারির উদাহরণ অনেক থাকলেও সে ভাবে কোন মারামারিরই সাম্প্রদায়িক রূপ ছিল না।বিজেপি শক্তিশালী হওয়ার পর থেকেই বিচ্ছিন্ন ভাবে বিগত ৬-৭ বছরেবাংলাতে সাম্প্রদায়িক মারামারির উদাহরণ উঠে এলেও বিগত ৫০ বছরের সব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা মিলিয়েও বাংলাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাতে মৃত্যুর সংখ্যা ১০-ও পার করবে না। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রের তুলনাতে সেটা নগণ্য। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিজেপি উঠে আসায় সেই জায়গাতে একটা ভয়ের বাতাবরণ তৈরি হয়ে রইল। আগামী ৫ বছরে রাজ্যের মধ্যে যে কোন রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক মারামারি-খুনখুনিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রূপ দিয়ে রাজ্যের মধ্যে ঘৃণার বাতাবরণ তৈরি করে দেওয়ার এক আপ্রাণ চেষ্টা বিজেপি করবে, আর সেখানেই বাংলার বামমনস্ক এবং সুস্থ চিন্তাভাবনার অধিকারী লোকেদের খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়ার প্রত্যাশা থেকে যাচ্ছে। আমার মনে হয়, ২০২১ সালের ভোটে বিজেপিকে আটকানো যদি এই লড়াই-এর প্রাথমিক সাফল্য হয় তাহলে বিজেপির সাম্প্রদায়িকতার বিস্তারকে আটকানো আগামী ৫ বছরের জন্যে বাংলার সব লোকের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হয়ে রইল।
একটি কথা আজকাল প্রায়শই বলা হচ্ছে এক কালের বামদূর্গ বাংলাতে ২০২১ সালের ভোটের পরে বামশূন্য হয়ে গেল। যদি সত্যিই তা হত, যদি বাংলার সাধারন মানুষ বামপন্থী চিন্তাভাবনা থেকে, বামপন্থী প্রকল্প থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিত, তাহলে তারা প্রভূত ক্ষমতাশালী দক্ষিণপন্থী বিজেপির দিকেই ঢলে যেত। ফ্যাসিজমের উত্থানের তাত্ত্বিক কারণগুলো যদি দেখা যায় তাহলে দেখা যাবে লাইন ধরে বিজেপির বিগত ৭ বছরের উত্থানকেই যেন বলা হয়েছে। অথচ এত ক্ষমতা, প্রতিপত্তি নিয়েও এরা বাংলা দখল করতে পারলো না, তার প্রধান কারণ হল, এখনো বাংলার জনগণের কাছে বামপন্থী চিন্তাভাবনার প্রভাব তীব্র ডানপন্থী চিন্তাভাবনার প্রভাবের থেকে অনেক বেশি। আর হয়ত সেটাই সবচেয়ে বড় স্বস্তির জায়গা।
এই ব্যাপারে আলোকপাত করতে হলে আমাদের প্রথমেই বুঝতে হবে, যে বামপন্থী-ডানপন্থী ইত্যাদি এক-একটি চিন্তাভাবনা, অন্যদিকে বিজেপি-তৃনমূল-সিপিএম-কংগ্রেস ইত্যাদি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এদের মধ্যে কাগজে কলমে সিপিএম বামপন্থী, কংগ্রেস-তৃনমূল মধ্যপন্থী এবং বিজেপি ডানপন্থী রাজনৈতিক দল। কিন্তু আদপে প্রতিটি দলের বিগত ৫০ বছরের রাজনৈতিক কাজ যদি দেখা হয় তাহলে পরিস্কার ভাবেই দেখা যাবে রাজনৈতিক বাধ্য-বাধ্যকতাতে, বা রাজনৈতিক সুবিধে লাভের আশায় অনেক ক্ষেত্রেই সিপিএম যেমন ডানপন্থী দলের মত কাজ করেছে, তেমনি মধ্যপন্থী দল তৃনমূল বা কংগ্রেস বামপন্থী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিগত ৫-১০ বছরে বাংলাতে বারংবার সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।
২০২১ সালের ভোটে বাংলার বামপন্থা সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে আগে ফিরে যেতে হবে, তৃনমূল যেভাবে বাংলার ক্ষমতা দখল করলো সেই প্রসঙ্গে। এত শক্তিশালী সংগঠন নিয়েও সিপিএমের মত একটি রাজনৈতিক দলের পতন হয়েছে কৃষক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। এর পিছনে তৃনমূলের কূটনীতি বা ষড়যন্ত্র , কৃষি বনাম শিল্প আলোচনা ইত্যাদি বাইরে রেখেও যা সোজাসুজি বলা যায় যে, এটা সম্ভব হয়েছে তার কারণ সিপিএম অনেক ক্ষেত্রেই কার্যক্ষেত্রে বামপন্থী চিন্তাভাবনা থেকে সরে যাচ্ছিল। আর নিজেদের উপরে প্রচণ্ড আত্মদম্ভ এবং মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস তৈরি না হলে এই ভুল একটি বামপন্থী দলের থেকে আশা করা যায় না। যেখানে এত বড় জমি অধিগ্রহণ হতে চলেছে, সেখানে আগে থেকেই স্থানীয় কৃষক সভার সম্মতি আদায় না করে উপর থেকে নেওয়া সিদ্ধান্ত স্থানীয় স্তরে চাপিয়ে দিতে চাওয়া রাজনৈতিক ভুল। হয়তো ভূমি-সংস্কার এবং শক্তিশালী পঞ্চায়েত ব্যবস্থা স্থাপন করার আগে হলে এই রকমের জমি অধিগ্রহণের ব্যাপারে তেমন সমস্যা হত না। একটি কারখানার জমি অধিগ্রহণ করার জন্যে এতজন ক্ষুদ্র-চাষিকে জনে-জনে রাজি করানোর দরকারও হত না। কিন্তু এক সময়ে সিপিএমের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট তো এই রাজ্যেই বাম আদর্শ মেনে এই জনমুখী কাজ করেছিল এবং রাজ্যের জনগণের মধ্যে বামপন্থী চিন্তাভাবনার প্রকাশ হয়েছিল। তাই স্থানীয় পঞ্চায়েত এবং কৃষক সভাকে গুরুত্ব না দিয়ে উপর থেকে জমি অধিগ্রহণ চাপিয়ে দিতে গিয়ে সিপিএম নিজেদেরকেই কৃষক স্বার্থ বিরোধী বলে দাগ মেরে দেওয়ার সুযোগ করে দেয়। তখন একদিকে বাম্ফ্রন্টের বাইরে থাকা প্রায় সব বামপন্থী সংগঠনের সমর্থক, বামপন্থী চিন্তাধারা নিয়ে চলা একাধিক বিশিষ্ট বাঙালি এবং বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী সংগঠনের সমর্থনে তৃনমূল নিজেদের কৃষক সমাজের এবং রাজ্যের গরীবের মুখপাত্র হিসেবে তুলে ধরে। ২০০৬-২০১১ সালের মধ্যে মমতার সব কটি আন্দোলন শুধুমাত্র বামপন্থী চরিত্রেরই ছিল না, মমতাকে রাজ্যের একদম পিছিয়ে পড়া জনগণের কাছে বিকল্প বাম-রাজনীতির মুখ করে তুলেছিল। ২০১১ সালে তৃনমূল শুধুমাত্র প্রথম বারের মতো বাংলার ক্ষমতা দখলই করলো না, এরা দীর্ঘদিন ধরে বামপন্থী চিন্তা ভাবনাতে পালিত হওয়া বাঙালি ভোট ব্যাঙ্কের একটা বড় অংশকেও নিজের দিকে দীর্ঘ দিনের জন্যে নিয়ে যেতে পেরেছিল। ক্ষমতা দখলের পরের ১০ বছরে তৃনমূল যেমন একদিকে ছলে-বলে-কৌশলে বিরোধী দলগুলোর সংগঠন ভেঙ্গে দেওয়াতে মগ্ন ছিল, তেমনি নিজেদের বামেদের থেকেও বেশি বাম প্রমাণ করে বামপন্থী দল হিসেবে সিপিএমকে গুরুত্বহীন করে তোলে। সিপিএমও নিজেদের ভুল সংশোধনের দিকে না গিয়ে কিছু পুরনো গতানুগতিক পথে চলে, ভুল পথে তৃনমূলের বিরোধিতা করে মমতার রাজনীতির আরও সুবিধে করে দেয়। ঠিক যে ভুলগুলো করে সিপিএম নিজের ক্ষতি করেছে আর মমতাকে বামপন্থী ভোট কব্জা করতে সুবিধে করে দিয়েছে সেগুলো ব্যাখ্যা করছি-

১। মহিলা ভোট-

বামপন্থী রাজনীতির একটি বড় দিক হল সমাজে মহিলা-পুরুষের ইকুয়ালিটি। বিশেষত বাংলার মতো রাজ্যে, যেখানে সমাজে মহিলারা দীর্ঘকালীন ভাবেই ভারতের অন্যান্য রাজ্যের থেকে অনেক প্রগতিশীল সেখানে রাজ্যস্তরে এবং সর্ব্বভারতীয় স্তরে মহিলা নেতৃত্বকে পিছনে রেখে দেওয়া সিপিএমের সবচেয়ে বড় ভুল গুলোর একটি। রাজ্যে যেখানে প্রায় ৫০% ভোটই মহিলা ভোট এবং প্রধান প্রতিপক্ষ মমতার মতো একজন শক্তিশালী জননেত্রী সেখানে বিগত ৫০ বছরে বাংলার রাজনীতিতে একজনও প্রথম সারির নেত্রী তুলে আনতে না পারা সিপিএমের বড় ব্যার্থতা গুলোর কটি। ২০১৯ সালের ভোটের আগে বিজেপির লকেট বা রূপা গাঙ্গুলির মতো উঠতি নেতারাও যেভাবে রাজ্যের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে বেড়িয়েছে সংগঠন তৈরির চেষ্টা করেছে, ক্ষমতা হারানোর ১০ বছর পরেও সিপিএম এমন কিছু মহিলা নেত্রীও রাজ্যস্তরে তুলে আনতে পারেনি। দেবলীনা হেম্ব্রেমের মতো আদিবাসি মহিলা নেত্রী যে কাজের প্রধান এবং শক্তিশালী মুখ হতে পারতেন। অথচ, তাকেও ২ বছর অন্তর ব্রিগেডে একটি করে বক্তৃতা দেওয়াতেই সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ২০১৯ সালে ব্রিগেডের পর থেকেই উনাকে সিপিএমের মুখ করে প্রজেক্ট করে ২০২১ সালের ভোটের প্রস্তুতি নিলে একসাথেই মহিলা, আদিবাসি এবং রাজ্যের সাধারণ দরিদ্র জনগণের কাছে পৌছনোর রাস্তা তৈরি করা সম্ভব হত। উল্টোদিকে মমতা ক্ষমতায় এসে পরের পর কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, সবুজ সাথী, স্বাস্থ্যসাথী ইত্যাদি প্রকল্প করে এবং সমাজে মহিলাদের অবস্থানের গুরুত্ব দিয়ে বাংলার মহিলা ভোট ব্যাঙ্ককে আরও শক্তিশালী করে ফেলেন। ২০২১ সালের ভোটে তৃনমূলের ভোট বৈতরণী পার করার প্রধান কারণ কিন্তু রাজ্যের মহিলা ভোট ব্যাঙ্ক। একদিকে বিজেপির ক্রমাগত মহিলাদের সম্পর্কে কুরুচিকর মন্তব্য, বিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে মহিলাদের সামাজিক পরিস্থিতি, এর পাশাপাশি বিজেপি এবং রামসেনা-বজরং দলের মতো বিজেপির সহযোগী রাজনৈতিক/সামাজিক দলগুলোর লাভ-জিহাদ, ঘর বাপাসি, অ্যান্টিরোমিও স্কোয়ার্ড বাংলার লোকেদের, বিশেষত বাংলার মহিলাদের বিজেপির দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিরুদ্ধে আরো সঙ্গবদ্ধ করেছে। আর রাজ্যের জনগণ মমতা ব্যানার্জীকে সামনে রেখে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে তৃনমূলকেই দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রধান মুখ হিসেবে দেখেছে। অথচ বামপন্থী দল হিসেবে এই ভোটের বড় অংশই সিপিএমের দিকে আসার কথা ছিল।

২। বামপন্থী প্রকল্প –

একদিকে যেমন মমতার অধিকাংশ প্রকল্পতেই দূরদৃষ্টির অভাব রয়েছে, তেমনি একাধিক জনমুখী প্রকল্প করে রাজ্যের একদম পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। যা ভোট ব্যাঙ্ক পলিটিক্সে প্রচণ্ড কার্যকর। একদিকে যেমন স্কুল সার্ভিস কমিশান না করা, বড় কলকারখানা স্থাপন না করতে পারা তৃনমূলের বড় ব্যার্থতা, তেমনি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিগত ৫ বছরে বাংলা ভারতের মধ্যে একদম প্রথম দিকেই রয়েছে। পুঁথিগত ভাবে বাম আদর্শের দিক থেকে দেখতে গেলে ক্ষুদ্র আর মাঝারি শিল্পেই বেশি জোর দেওয়ার কথা। বিগত ৩ বছর ১০০ দিনের কাজ আর নারেগা প্রকল্পে সারা ভারতের মধ্যে বাংলার প্রথম হওয়ায় রাজ্যের গরীব জনগণের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়েছে এবং ভোটবাক্সেও এর প্রভাব পড়েছে। এর সাথে মনে রাখতে হবে চার ঘন্টার নোটিশে ডাকা লকডাউন ঘোষণা হলে, এবং আম্ফানের প্রভূত ক্ষতির মধ্যে রেশন ব্যাবস্থার মাধ্যমে মাথা পিছু পাঁচ কেজি চাল সহ অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী প্রদান করা দেশের গরীবের কাছে জীবনদায়ী হিসেবে পৌঁছেছে। এই করোনা পরিস্থিতিতেও বিদ্যালয়ের মাধ্যমে মিড্-ডে মিলের সাহায্যে অগণিত দরিদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারকে বাঁচার ন্যূনতম রসদ জুগিয়েছে। করোনার লকডাউনের সময়ে সিপিএমের যুবছাত্ররাও বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে একটি বামপন্থী কাজ করে খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। সেটা হল রাজ্যের গরীব দুঃস্থদের জন্যে সস্তাতে খাবার জোগান দিয়ে ক্যান্টিন চালানো। কাজটি এমনই জনপ্রিয় হয় যে তৃনমূল সরকারও ‘মা-কিচেন’ এর নামে ৫ টাকাতে ডিম-ভাত খাওয়ার জোগান দেওয়ার ব্যবস্থা করে। ২০২০ সালে করোনা এবং আম্ফানের সময়েও রাজ্যের বিভিন্ন তরুণ-তরুণী যেভাবে ক্ষতিগ্রস্থ লোকেদের সাহায্য করার জন্যে ঝাঁপিয়ে পরে তাতেও রাজ্যের তরুণ প্রজন্মের বামপন্থী মানসিকতারই প্রকাশ পায়। একদিকে যেমন অস্বীকার করা যায় না যে বিভিন্ন তৃনমূলের নেতাদের বিরুদ্ধে এই ত্রাণ সরাবরাহ নিয়ে প্রভূত দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে, কিন্তু দিনের শেষে এই জনমুখী বামপন্থী চিন্তাধারার এই প্রকল্প গুলোতে অনেক সাধারণ জনগণ উপকৃত হয়েছে। এছাড়াও বার্ধক্য ভাতা, এবং দলিত আদিবাসি এলাকার জন্যে বিভিন্ন জনপ্রিয় প্রকল্পের নাম উল্লেখ করা উচিত। আখেরে দেখা গেছে, রাজ্যের গরীব জনগণের কাছে বামপন্থী প্রকল্পগুলোই জনপ্রিয় হয়েছে, কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের হাত ধরে উঠে আসা কোন বিশেষ ডানপন্থী প্রকল্প যার বিকল্প হিসেবে উঠে আসতে পারেনি।

৩। পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়

সমাজের সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশ-রাজ্যের মহিলা, গরীব, আদিবাসি, দলিত, অথবা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেদের কাছে একটি আদর্শ বামপন্থী দলই সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় হওয়া উচিৎ। ১৯৭৭ সালে বাংলাতে যখন সিপিএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার গঠন করে, তখনও এই সম্প্রদায়ের লোকেরাই সিপিএমের সবচেয়ে বড় ভোট ব্যাঙ্ক ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে এই সম্প্রদায় ক্রমশ সিপিএমের থেকে দূরে সরে গেছে। সম্প্রতি আব্বাস সিদ্দিকির মতো একজন গোঁড়া ধর্মীয় নেতাকে ধরে এনে জোট করে তাকেই রাজ্যের দলিত-আদিবাসি-এবং সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা আখেরে নিজেদের দৈন্যতাই আরো প্রকাশ করে দেয়। আব্বাস সিদ্দিকির দল যদি এই পিছিয়ে পড়া দলের প্রতিনিধি হয় তাহলে নিজেরা কি? সিপিএমকেই তো এই সব পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায়ের মুখ হিসেবে দেখতে পাওয়ার কথা। সম্প্রতি কাঞ্চা ইলাইয়া বলেছেন, “পশ্চিমবঙ্গে, প্রথম থেকেই কম্যুনিস্ট দলটি ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্য নামে তিনটি বর্ণ নিয়ে গঠিত ভদ্রলোক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। বাকী শূদ্র ও নামশূদ্র (দলিত) বর্ণকে ভদ্রলোক বুদ্ধিজীবীরা ছোটোলোক (নীচ ও নিম্ন বর্ণের লোক) হিসাবে মনোনীত করেছিলেন। তাদের কখনই দলীয় পদে নেতা হিসাবে উঠতে দেওয়া হয়নি।” তাই নিজেদের বামপন্থী চিন্তাভাবনার লোকেদের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরতে গেলে এই ভোট ব্যাঙ্ককে ফিরে পাওয়া সিপিএমের প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য।

৪। সিপিএমের আত্মদম্ভ বামপন্থার বিরোধী

বিগত ১০ বছরে সিপিএম একদিকে যেমন রাজ্যের সাধারণ গরীব মানুষের থেকে নিজেদের দূরে করে নিয়েছে, তেমনি পাশাপাশি নিজেরাই রাজ্যের একমাত্র শিক্ষিত-বিচক্ষণ ব্যক্তি ভেবে নিজেদের এলিট সম্প্রদায় বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে গেছে। মমতাকে ভুল ইংরাজি বা হিন্দির জন্যে মস্করা করার সময়ে বোঝা উচিৎ রাজ্যের ৯০% লোকেই সুদ্ধ ইংরাজি বা হিন্দি বলতে পাড়ে না। তারা এই সমালোচনার ফলে মমতার থেকে দূরে যাওয়া দূরের কথা, মমতাকে নিজেদের মতো সাধারণ লোক বলে ভাবতে শুরু করেছে। ৫ টাকায় চাল দেওয়ার জন্যে মমতার জনপ্রিয়তাকে নিয়ে মস্করা করেছে, গরীব লোকেদের ভিখারি হিসেবে দেখাতে চেয়েছে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যে লোকেরা মমতার মিটিং শুনতে ব্রিগেডে এসে মিটিং এর পরে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সামান্য ডিম-ভাত খাওয়ার ছবি নিয়েও মস্করা করেছে। একটি বাম দলের কাছ থেকে কি সত্যিই এগুলো আশা করা যায়? এতে নিজেদের এলিট প্রমাণ হয়ত করা যায়, কিন্তু গ্রামের গরীব লোকেরা কলকাতাতে এলে কি সত্যিই এদের বড় রেস্তোরাতে খাবার পয়সা থাকা সম্ভব? এই সব অকারণ বিদ্রূপ শুধুমাত্র ভোট বাক্সেই বিরূপ প্রভাব ফেলেনি, একটি বামপন্থী দল হিসেবেও নিজেদের অবস্থান দূর্বল করেছে।বিগত ১০ বছরে সিপিএম সমর্থক আর কর্মীরা দলের মধ্যের এবং দলের বাইরের যে কোন রকমের রাজনৈতিক সমালোচনাকে ভালো ভাবে গ্রহণ না করে, উল্টেসমালোচকদের অনর্থক অপমান করে গেছে। অন্য বামপন্থীদেরকেই দূরে ঠেলে দিয়েছে, মিত্রকে শত্রু বানানোর কাজ করে গেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের দলের উপরের মহলের একাধিক হঠকারী সিদ্ধান্তকে অন্ধ ভাবে সমর্থন করে গেছে। আখেরে, রাজ্যের সাধারণ লোক, এবং রাজ্যের বামমনস্ক লোকেদের দূরে ঠেলে দিয়েছে।হামেশাই সিপিএমের অনেক নেতার মুখেই শোনা যায় যে তারাই রাজ্যের একমাত্র বামপন্থী দল। এখানে বুঝতে হবে, কোন দলের কাছেই বামপন্থার পেটেন্ট নেই। যে দলের কাজ গরীব লোকেদের সুবিধে করবে, দৈনন্দিন সমস্যার সুরাহা করবে, তারা তাদেরই ভোট দেবে এবং এতে কোন অন্যায় নেই। রাজ্যের জনগণ এখনো বামপন্থাতেই বিশ্বাস করে, তাই তারা এত প্রলোভন সত্ত্বেও ডানপন্থাকে বর্জন করেছে।
দিনের শেষে এটা বলাই যায় যে বাংলার লোক এখনো তাদের বামপন্থী মানসিকতাই ধরে রেখেছে। তাই সাম্প্রদায়িক, দক্ষিণপন্থী দল বিজেপি বাংলাতে ঢুকতে পারেনি। বাংলার উচ্চবিত্ত সমাজের লোকেও নিজেদের পরিবারের ক্ষুদ্র সুবিধের থেকেও রাজ্যের সব লোকের খেতে পাওয়াকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। বাংলার সব সম্প্রদায়ের, সব জীবিকার লোকেই এই ভোটে মোদী সরকারের কৃষি বিলের বিরোধিতা করেছে। বাংলার লোকে ১০০ দিনের কাজের ভাল প্রয়োগ, গ্রামীণ সমবায়ের উন্নতি, ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পে উন্নতি এগুলোকে বড় শিল্পে উন্নতির থেকেও বেশি প্রাধাণ্য দিয়েছে। যা বাংলার লোকের বামপন্থী মানসিকতারই প্রকাশ। এই ভোটের ফল, প্রমাণ করেছে যে বাংলার হিন্দুপ্রধান অঞ্চলের লোকেরাও মুসলিমদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে দেওয়ার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। পাশাপাশি অধিকাংশ মুসলিম প্রধাণ অঞ্চলের লোকেরাও শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে আব্বাসের দলে ঢেলে ভোট দেয়নি। ফলে বাংলার লোকে বামপন্থাকেই উগ্র-ডানপন্থার বদলে বেছে নিয়েছে। ২০২১ সালের ভোটে বাংলা সিপিএম শূন্য হয়েছে, বাম শূন্য হয়নি। বাংলার লোকের বাম মানসিকতা থেকে সরে গেলে সেটা বরং সিপিএমের কাছেও অনেক বেশি ভয়ের কারণ হত। কারণ তাহলে বামপন্থী দল হিসেবে বাংলার রাজনীতিতে সিপিএমের পুনরায় প্রাসঙ্গিক হওয়ার পথ আর দূর্গম হত।

[লেখক – ইটালির মিলান নিবাসী প্রবাসী বাঙালী বিজ্ঞানী। Istituto FIRC Oncologia Molecolare-তে কর্মরত।]

Facebook Comments

Leave a Reply