আফজল গুরু-র ফাঁসি – একটি আইনি আলোচনা : অতীন্দ্রিয় চক্রবর্তী

[অতীন্দ্রিয় পেশায় আইন- ও কলমজীবি। কলকাতায় বাড়ি ও বর্তমানে কাজের জায়গা। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে পীপলস ইউনিয়ন অফ সিভিল লিবার্টি-র একটি দলের সাথে হাফতাখানেক কাশ্মীর উপত্যকার আজাদি-স্পর্ধিত বিভিন্ন অস্থির অঞ্চলে কাজের সূত্রে গিয়ে, সেখানের নানান বন্ধুবান্ধবদের সাথে থেকে, কথা বলে, জেনে-দেখে-শুনে-বুঝে-চলে-ফিরে অনুপ্রেরণা আহরণ ও সেই থেকে আজাদির আন্দোলনের বিভিন্ন দিক নিয়ে পড়াশুনা করার চেষ্টা করেছেন। সে’সকল উৎস থেকে তিনি আইনি পর্যালোচনা করেছেন আফজল গুরুর ফাঁসির আদেশের। ‘অপরজন’-এর পাতায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সেই আইনি পর্যালোচনা। এই সংখ্যায় প্রথম কিস্তি।]

ভূমিকা/ প্রাককথন

এই লেখার বিষয়বস্তু আফজল গুরুর ফাঁসির আদেশ। দিল্লির সুপ্রীম কোর্ট সেই ২০০৫-সালের ৪-ঠা অগাস্ট এই আদেশ দিয়েছিল। আদেশ বলবৎ হয় ২০১৩ সালের ৯-ই ফেব্রুয়ারি। প্রসঙ্গ – ২০০১ সালের ১৩ই ডিসেম্বরে সংঘটিত পার্লামেন্ট অ্যাটাক। এই ফাঁসির বিষয়ে কিছু চর্চা এর আগে আমি পড়েছি, এবং/ অথবা শুনেছি। তেমন চর্চায় শুনেছি/ পড়েছি যে কোন প্রাইমারি এভিডেন্স ছাড়া-ই, কেবলমাত্র ডকুমেন্টারি এভিডেন্স – তা-ও, ইলেক্ট্রনিক এভিডেন্স-এর ভিত্তিতে আফজল গুরু-কে দোষী সাব্যস্ত করা হয় ও তাঁর ফাঁসির হুকুম জারি করা হয়।

‘সুপ্রীম কোর্ট কেসেস’-এর ১৯৬ পাতা জুড়ে ছড়ানো, ৩৪৯ অনুচ্ছেদে বিভক্ত জাজমেণ্ট, এটা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে ‘ল্য অফ এভিডেন্স’-বিষয়ক আইনের কিছু টেকনিকাল কচকাচানি এসে পড়তে বাধ্য। কিন্তু, এই কচকচানিতে না গিয়ে সরাসরি জাজমেণ্ট-টা নিয়ে আলোচনা করলে গোলযোগ কোথায় ঘটেছে তার অনেকটাই বুঝতে অসুবিধা হবে। অগত্যা,

গৌরচন্দ্রিকা – ইলেক্ট্রনিক রেকর্ড তথা বৈদ্যুতিন তথ্য ও ডক্যুমেণ্টারি এভিডেন্স – ভারতীয় আইনের চোখে

শুরু করা যাক ইণ্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট, ১৮৭২-এর ধারা ৬৫, ৬৫-এ এবং ৬৫-বি দিয়ে। ২০০০ সালের আগে শেষোক্ত ধারা-দুটো ছিলো না – ছিলো কেবল ধারা ৬৫। এই ধারা ৬৫ যেটা করছে সেটা হল – সেকেণ্ডারি তথা ডক্যুমেণ্টারি এভিডেন্স – এই বিষয়টিকে আইনি স্বীকৃতি ও সংজ্ঞান দিচ্ছে; সাথে সাথে, বেঁধে দিচ্ছে ‘ডিউ প্রোসেস অফ ল্য’- অনুসারে এই সেকণ্ডারি তথা ডক্যুমেণ্টারি এভিডেন্স-এর যাত্রাপথ। এই হল ইণ্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্টের ধারা ৬৫-র ভূমিকা।

ধারা ৬৫ জানান দিচ্ছে যে ‘এ’ থেকে ‘জি’ – এই পাঁচ ধরণের পরিস্থিতিতেই কেবলমাত্র সেকেণ্ডারি তথা ডক্যুমেণ্টারি এভিডেন্স আইনে গ্রাহ্য, তথা প্রসিডিওর-এ গ্রহণীয় হবে। সেই পরিস্থিতি-গুলো হল –
‘এ’ – যখন দ্যাখা যায় যে মূলবস্তুটি – তা সে নথি, দস্তাবেজ, উপকরণ, সরঞ্জাম – যাই হোক না ক্যানো, যে বস্তুকে এভিডেন্স হিসেবে আদালতের সমক্ষে আনতে হবে, তা এমন কোনো ব্যক্তির হাতে যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ হিসেবেই সেই বস্তুটি এভিডেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে ইচ্ছুক প্রোসিকিউশান অথবা বিরোধীপক্ষ। অথবা যখন যে ব্যক্তির কাছে সেই বস্তুটি রয়েছে তিনি আদালতের এক্তিয়ার অর্থাৎ জ্যুরিসডিকশানের আওতাবদ্ধ নন, অর্থাৎ আদালতের এই অধিকার নেই যে তেমন ব্যক্তিকে তেমন বস্তুটি কোর্টে জমা করার জন্য তলব করে। অথবা হয়তো সেই ব্যক্তি-র উপরে আদালতে এক্তিয়ারভুক্ত ক্ষমতা ও অধিকার রয়েছে অথচ সেই ব্যক্তি এই এভিডেন্স অ্যাক্ট-এর ধারা ৬৬ অনুসারে আদালতের পাঠানো তলবনামা উপেক্ষা করে মূলবস্তুটি আদালতে প্রত্যক্ষ গোচরে আনতে অস্বীকার করেছেন।

‘বি’ – যে ব্যক্তির অপরাধ অথবা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে সেই বস্তুটি এভিডেন্স হিসেবে আনতে আবেদন করছে প্রোসিকিউশান – সেই ব্যক্তি অথবা তাঁর রেপ্রেজেন্টেটিভ প্লীডার, মোক্তার অথবা আইনি উত্তরসুরি – লিখিত ভাবে কোর্টের সামনে এই মর্মে স্বীকৃতিপত্র পেশ করছেন যে সেই মূল বস্তুটির অস্তিত্ব রয়েছে, অথবা সেই বস্তুটি কোন অবস্থায় রয়েছে, অথবা সেই বস্তুটির কন্টেন্ট-সমূহ সঠিক; – যে পরিস্থিতিতে যা প্রাসঙ্গিক, সেই অনুসারে হবে স্বীকৃতিপত্রের বয়ান।

‘সি’ – যখন মূলবস্তুটি হারিয়ে গ্যাছে, অথবা ধ্বংস অথবা নষ্ট হয়ে গ্যাছে। অথবা, যে ব্যক্তি সেই বস্তুটি এভিডেন্স হিসেবে আদালতের সমক্ষে উপস্থিত করতে চাইছেন তিনি, স্বীয় ত্রুটি অথবা উপেক্ষা-র অন্যথায়; জরা-ব্যধি-মৃত্যু এবং অন্যান্য কোনো সঙ্গত কারণবসতঃ – সেই মূলবস্তুটিকে আদালতের সামনে এভিডেন্স হিসেবে উপস্থাপন করতে অক্ষম হচ্ছে।

‘ডি’ – যখন মূলবস্তুটি-র ধরণ-ধারণ এমন-ই যে তাকে কোনভাবেই কোর্টের সামনে আনে যাবে না। হয়ত সেটি এমন ভারি যে তাকে কোর্টের সামনে আনতে গেলে অপরিসিম অর্থ ও সময় ব্যয় হয়ে যাবে। বা অন্যান্য কোন কারণ যা মহামান্য আদালত ও ধর্মাবতারকে এই মর্মে সন্তুষ্ট করছে – যে, ত্যামোন ক্ষেত্রে, সেই মূলবস্তু কোর্টে না এনে তার বদলে সেকেণ্ডারি তথা ডক্যুমেন্টারি এভিডেন্স-মাধ্যমেই সেটির এভিডেন্স হিসেবে অস্তিত্ব আইনগ্রাহ্য করা যথার্থ।

উপরে বর্ণিত পরিস্থিতি ‘এ’, ‘সি’ এবং ‘ডি’-র ক্ষেত্রে কোন মূল ডক্যুমেণ্ট-এর বিষয়বস্তু-র যথার্থতা প্রমাণ করছে তেমন কোন এভিডেন্স-কে সেকেণ্ডারি এভিডেন্স হিসেবে কোর্ট গ্রহণ করবে, এভিডেন্স অ্যাক্ট-এর এই ধারা ৬৫-র অপারেশনের ফলেই এই গ্রহণ। বলা যেতে পারে, সেই কারণেই তার নাম ডক্যুমেণ্টারি এভিডেন্স – কারণ সেই ধরণের সেকেণ্ডারি এভিডেন্স মূলবস্তু-র অস্তিঃ ও সংজ্ঞান ডক্যুমেণ্ট করছে।
উপরে বর্ণিত এই চারটে পরিস্থিতি ছাড়াও, আর-ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আদালত সেকেণ্ডারি এভিডেন্স গ্রহণ করে। যেমন –
যখন মূলবস্তু এই এভিডেন্স আইন-এর ধারা ৭৪ অনুসারেই, পাব্লিক ডক্যুমেণ্ট হিসেবে স্বীকৃত। অথবা যখন মূলবস্তু-র রকম এমন যে এভিডেন্স অ্যাক্ট বা অন্য কোন বলবৎ আইনের নিরিখে সেই বস্তুর সার্টিফিয়েড কপি অর্থাৎ স্বীকৃত অনুলিপি/ প্রতিলিপি বা নকলনামা গ্রাহ্য এভিডেন্স হিসেবে ধার্য। বিশেষতঃ বিভিন্ন নথি ও লীগাল ইনস্ট্রুমেণ্ট-এর ক্ষেত্রে এই শেষোক্ত পরিস্থিতি বহুক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন যে এই দুই পরিস্থিতিতেই, অর্থাৎ মূল নথি পাব্লিক ডক্যুমেণ্ট হিসেবে স্বীকৃত হলে অথবা মূল ডক্যুমেণ্ট-এর সার্টিফাইড কপি যথাযথ এভিডেন্স হিসেবে স্বীকৃত হলে – মাথায় রাখতে হবে যে – কেবলমাত্র আইন-মাফিক সার্টিফিকেশান – যেমন নোটারি, অ্যাটেস্টেশান – ইত্যাদি উপায়ের মাধ্যমে-ই – স্বীকৃত হলে – তবেই সেই মূল ডক্যুমেণ্ট-এর কপি – সেকেণ্ডারি এভিডেন্স হিসেবে গ্রাহ্য হবে।

এছাড়াও, এভিডেন্স আক্ট, ১৮৭২-এর ধারা ৬৫ অনুসারে আরো একটি পরিস্থিতিতে সেকেণ্ডারি এভিডেন্স গ্রহণ করে কোর্ট – যখন একটা কোন নথি সামগ্রক ভাবে অজস্র অ্যাকাউণ্ট, খরচের হিসেব, ‘বুক’ ইত্যাদি অজস্র অংশ, খণ্ড বা উপনথি-তে বিভক্ত – তখন, যদি সেই বিষয়ে এক্সপার্ট এমন কোন ব্যক্তি সেই সামগ্রিক নথির একীকৃত সারাংশ এমন ভাবে নির্মাণ করে দেন যে সেই সারাংশের মাধ্যমে যে ব্যক্তি সেই নথিটিকে এভিডেন্স হিসেবে উপস্থাপিত করতে ইচ্ছুক হয়ে উঠছেন, – তখন আদালত, আর সব কিছুর মতোই, ‘সাবজেক্ট টু ইটস স্যাটিসফ্যাকশান’, সেই সারাংশ-কে সেকেণ্ডারি তথা ডক্যুমেণ্টারি এভিডেন্স হিসেবে গ্রহণ করছে – যে গ্রহণের ‘ইনহেরেণ্ট পাওয়ার’ আদালতকে দিচ্ছে এই এভিডেন্স আইনের ধারা ৬৫ বর্ণিত পরিস্থিতি – ‘জি’

১২৮ বছর ধরে এরকমই চলছিলো। কিন্তু তত দিনে দেখা গেল যে প্রগত ইতিহাস ও কালের নিয়মে বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক উপকরণ, রেকর্ড, ডেটা, তথ্য ইত্যাদি, বহু ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার ট্রায়াল, মায় আর্বিট্রাল প্রসিডিংস-এ পর্যন্ত, সেই সব মামলায় স্ব-স্ব স্বার্থে কোর্টে এভিডেন্স হিসেবে বাদী-বিবাদী সকল পক্ষেরই প্রোডিউস করা প্রয়োজন হয়ে উঠেছে। সেই সব মামলার যথাযথ রফা-নিষ্পত্তির জন্য সেই ধরণের ইলেক্ট্রনিক এভিডেন্স-এর পর্যালোচনা আদালতের পক্ষেও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছিল ক্রমাগত।

ভারতীয় এভিডেন্স আইন-এ ইলেক্ট্রনিক এভিডেন্স-এর স্বীকৃতিচিহ্নক-স্বরূপ ধারা ৬৫-বি-র আগম

সন ২০০০। বৈদ্যুতিন প্রযুক্তির তখন উদীয়মান – এবং লোকজীবন ও লোকব্যবহারে আজকের মত না হলেও, যথেষ্ট ওতঃপ্রোত। ভারতীয় এভিডেন্স আইন-এ তাই অ্যামেণ্ডমেণ্ট আনা হলো – সংযুক্ত হল ধারা ৬৫-এ ও ৬৫-ব। এর-ই মাধ্যমে ওই সেকেণ্ডারি তথা ডক্যুমেণ্টারি এভিডেন্স-এর হিসেবে-ই আইনের চোখে এক স্বতন্ত্র সংজ্ঞান পেলো – ‘ইলেক্ট্রনিক এভিডেন্স’। ধারা ৬৫-এ-টি খুচরো। সে কেবলমাত্র জানান দিচ্ছে যে ইলেক্ট্রনিক রেকর্ড-এর কণ্টেণ্ট তার পরবর্তী ধারা ৬৫-বি হিসেবে উপস্থাপন ও প্রমাণসাপেক্ষতা প্রাপ্ত হবে। এইটুকু বলেই সে বাকি বন্দুক চাপিয়ে দিচ্ছে ধারা ৬৫-বি-র ঘাড়ে।

এভিডেন্স অ্যাক্ট-এর ধারা ৬৫-বি আবার ‘১’ থেকে ‘৫’ – এই পাঁচটি উপধারায় বিভক্ত। এর মধ্যে আবার শেষ চারটে উপধারার ‘এ’, ‘বি’, ‘সি’, ‘ডি’ প্রভৃতি খণ্ডাংশ-ও রয়েছে। বিস্তীর্ণ এই ধারা ৬৫-বি-র উপধারা নং – ‘১’ আমাদের জানান দিচ্ছে যে – যে কোনো কম্পিউটার সিস্টেমের মাধ্যমে প্রিণ্ট, কপি, স্টোর অথবা রেকর্ড করা ইলেক্ট্রনিক রেকর্ড – তা সে ম্যাগনেটিক মাধ্যমেই চালিত হোক অথবা অপটিকাল মাধ্যমে, সেই রেকর্ড যদি ঐ ধারা ৬৫-বি-র উপধারা নং – ‘২’-এর শর্তগুলির মান্যতা রক্ষা করে, তবে তা ডক্যুমেণ্টারি এভিডেন্স হিসেবে আইনগ্রাহ্য।

উক্ত ধারা ৬৫-বি, উপধারা নং – ‘২’ থেকে আমরা জানছি কোন কোন নির্দিষ্ট শর্তের সাপেক্ষতা মান্য করলে তবে বৈদ্যুতিন রেকর্ড সেকেণ্ডারি এভিডেন্স হিসেবে কোর্ট গ্রহণ করতে সক্ষম হবে। যেমন –
শর্ত ‘ক’ – যে বিশেষ ও প্রাসঙ্গিক তথ্য-সমন্বিত কম্পিউটার রেকর্ড বা আউটপুট সেকেণ্ডারি এভিডেন্স হিসেবে প্রোডিউস বা প্রেসেণ্ট করা হচ্ছে কোর্টের সামনে, সেই আউটপুট সে কম্পিউটার সিস্টেম দ্বারা নির্মিত, সংরক্ষিত ও গৃহীত, তা সেই সিস্টেমের ব্যবহারকারি ব্যক্তি নিয়মিত ভাবে সেই ধরণের তথ্য ও রেকর্ড নির্মাণ-সংরক্ষণাদি কাজে ব্যবহার করেছেন, এবং উক্ত ব্যক্তির আলোচ্য ব্যবহারাদি আইনানুগ।
শর্ত ‘খ’ – সেই নিয়মিত ব্যবহারের সময়ে যে ধরণের ব্যবহার হত সেই কম্পিউটার সিস্টেম-এর, সেই ধরণের ‘অর্ডিনারি কোর্স’-এ ব্যবহার হওয়াকালিন-ই সেই তথ্য বা নথি সংগৃহীত হয়েছে যা ইলেক্ট্রনিক এভিডেন্স হিসেবে কোর্টের সামনে আনয়নে ইচ্ছুক নির্দিষ্ট পক্ষ।

শর্ত ‘গ’ – ব্যবহারের সময়ে, উদ্দিষ্ট তথ্য/ বৈ-নথি/ ই-রেকর্ড সমন্বিত কম্পিউটার সিস্টেমটি সচল ছিলো, অথবা, কোন যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলেও, সেই ত্রুটি এমন নয় যার থেকে প্রাসঙ্গিক ইলেক্ট্রনিক এভিডেন্স-টির উপর এমন কোন প্রভাব পড়েছে বা পড়তে পারে যার থেকে সেই এভিডেন্স বা রেকর্ড বা তথ্যের কোন বিকৃতি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।

শর্ত ‘ঘ’ – ইলেক্ট্রনিক রেকর্ড-এর মাধ্যমে ধরে রাখা সেই যে প্রামাণ্য তথ্য – যা এভিডেন্স, অর্থাৎ তথ্যপ্রমাণ, হিসেবে গ্রহণযোগ্যতার দাবী রাখছে – সেই তথ্য সেই নির্দিষ্ট কম্পিউটার সিস্টেমের স্বাভাবিক ও নিয়মিত ব্যবহারের মাধ্যমেই সৃষ্ট, সংরক্ষিত অথবা পুনর্নির্মিত হয়েছে।

আবার এই এভিডেন্স অ্যাক্ট-এর ধারা ৬৫-বি-র উপধারা নং – ‘৩’ অনুসারে সেই বৈদ্যুতিন তথ্য, যা তথ্যপ্রমাণ-স্বরূপ ব্যবহার্য, এবং যে ব্যবহার আইনস্বীকৃত, তা যদি একাধিক কম্পিউটার সিস্টেম-এর মাধ্যমে নির্মিত তথা নির্ণিত হয়, সে’ক্ষেত্রে সবকটি সিস্টেমকেই ‘ইলেক্ট্রনিক রেকর্ড’ হিসেবে সেকেণ্ডারি এভিডেন্স-এর আইনি মর্যাদা দেওয়া যায় প্রয়োজনে।

উক্ত ভারতীয় এভিডেন্স আক্ট ধারা ৬৫-বি, উপধারা নং ‘৪’ অনুসারে বৈদ্যুতিন রেকর্ডের সার্টিফিকেশন

এছাড়াও রয়েছে সার্টিফিকেশন-এর প্রশ্ন। অর্থাৎ, আলোচ্য ধারা ৬৫-বি-র উপধারা নং – ‘৪’, তিনটি শর্ত নং ‘এ’ থেকে ‘সি’-এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট করছে যে যদি কোন ব্যক্তি তাঁর তরফ থেকে আনা ইলেক্ট্রনিক রেকর্ড-রূপী এভিডেন্স-এর সমর্থনে অ্যাফিডেভিটাদি মাধ্যমে আদালতে লিখিত স্টেটমেণ্ট জ্ঞাপন করতে চান, তাহলে সেই ইলেক্ট্রনিক রেকর্ড-এর সমর্থনে তাঁকে সার্টিফাই করতে হবে – সুনির্দিষ্ট ভাবে চিহ্নিত করতে হবে সেই বৈদ্যুতিন রেকর্ড ও যান্ত্রিক সিস্টেমের রকম, ধরণ – তথ্যের সাথে সেই সিস্টেমের ব্যবহারিক, ফাংশানাল, যোগাযোগ। অর্থাৎ, যে ব্যক্তি সেই বৈদ্যুতিন এভিডেন্স দাখিল করছেন, তাঁর এবং/ অথবা সেই কম্পিউটার সিস্টেমের প্রাসঙ্গিক পরিসরে ব্যবহারকারি ব্যক্তির সাক্ষর প্রয়োজনীয়। এবং এই এই সার্টিফিকেশান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেই ইলেক্ট্রনিক রেকর্ড-কে চিহ্নিত করার এই যে লিখিত দাখিলনামা, তা হতে হবে উক্ত স্বাক্ষরকারি ব্যক্তি-র সাপেক্ষে – ‘টু দ্যা বেস্ট অফ নলেজ অ্যাণ্ড বিলিফ’ – যেমন লেখা আছে ইণ্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট-এর এই ধারা ৬৫-বি-‘৪’-‘সি’-র শেষ লাইনে।

ইলেক্ট্রনিক রেকর্ড-কে তথ্যপ্রমাণ হিসেবে আদালতে গ্রহণীয় করে তোলার আরো কিছু প্রাসঙ্গিক দিক তুলে ধরা হয়েছে এই এভিডেন্স অ্যাক্টের ধারা ৬৫-বি-র উপধারা নং – ‘৫’-এর উপশর্ত নং ‘এ’ থেকে ‘সি’-এর মাধ্যমে। যেমন – ধারা ৬৫-বি-‘৫’ ‘এ’ এবং ‘সি’ অনুযায়ি প্রাসঙ্গিক বৈদ্যুতিন তথ্য কম্পিউটার সিস্টেম-কে সরবরাহ অথবা সিস্টেম থেকে আহরণ করার প্রক্রিয়া, অথবা একাধিক কম্পিউটার সিস্টেমের মধ্যে সেই তথ্য চালনার প্রাসঙ্গিক ব্যবহার রয়েছে – সেখানে এই প্রাসঙ্গিক তথ্যের সরবরাহ, গ্রহণ এবং/ অথবা চালনা মানুষের মাধ্যমে না হয়ে যন্ত্রের মাধ্যমে হলে-ও, ইলেকট্রনিক রেকর্ড-এর তথ্য যদি প্রাসঙ্গিক হয়, তবে সেই ধরণের বৈদ্যুতিন রেকর্ড পর্যন্ত সেকেণ্ডারি তথা ডক্যুমেণ্টারি এভিডেন্স হিসেবে, অর্থাৎ, অপ্রত্যক্ষ তথ্যপ্রমাণ রূপে, আইনগ্রাহ্যতার দাবী রাখে।

একই সাথে, ইণ্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্টের ধারা ৬৫-বি-‘৫’ ‘বি’ – র প্রভাব এক ধরণের প্রায়শঃ-ই ঘটে থাকে এমন এক ধরণের ঘটনার মধ্যে দিয়ে সহজে বোঝা সম্ভব। ধরুণ, আপনি বা আমি, অফিসে নেই, ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছি না, বরং কর্মবিরতি অথবা ছুটির অবসর সময়ে রয়েছি। অথচ কাজের খুব চাপ। তখন, সেই চাপ কমাতে ধরুণ আমরা আমাদের ব্যক্তিগত কম্পিউটারে এমন কোন বৈদ্যুতিন তথ্য, ডক্যুমেণ্ট, প্রোগ্রাম বা সিস্টেম নিয়ে কাজ করলাম যে তথ্য/ ডক্যুমেণ্ট/ প্রোগ্রাম/ সিস্টেম ও তা ব্যবহারের যে প্রয়োগ, নিয়োগ অথঃ কার্য্য, তা আমাদের অফিস-পরিসরে অফিসের কম্পিউটার সিস্টেমে করার কথা, উইদিন স্বীয় ভবদীয় প্রোফেশানাল স্কোপ অফ এমপ্লয়মেণ্ট। ভেবে রাখলাম – ইমেইল, ব্লু টুথ, ইউ-এস-বি বা অন্যান্য কোনো বৈদ্যুতিন প্রযুক্তির মাধ্যমে অফিসের সিস্টেমে কাজটা ট্র্যান্সফার করে নেবো সময়-সুযোগ অনুসারে। সেই ধরণের ক্ষেত্রে, আলোচ্য আইনের আলোচ্য ধারাপধারা-নির্দিষ্ট পথে, সেই বাড়ির সিস্টেমে ব্যবহার করা তথ্য-ও কিন্তু, আপ্নার-আমার অফিশিয়াল কাজের সঙ্গে জড়িত বৈদ্যুতিন প্রমাণ হিসেবে-ই ধরা হবে। সেই ধরণের বৈ-তথ্যকে যদিও আমরা অফিসের কাজে বাড়ির সিস্টেমে ব্যবহার করলাম, তবুও সেই ব্যবহার-কে সাধারণ তথা আইনগ্রাহ্য ব্যবহারিক প্রয়োগ হিসেবেই গণ্য করা হবে আদালত-সমক্ষে। এমনই বলছে ভারতীয় এভিডেন্স অ্যাক্ট, ১৮৭২-এ ২০০০ সালের আইন নং-২১ হিসেবে গৃহীত উক্ত আইনের সেণ্ট্রাল অ্যামেণ্ডমেণ্ট অ্যাক্ট অনুসারে নিবিষ্ট, ধারা ৬৫-বি-‘৫’ ‘বি’।
সামগ্রিক ভাবে এভিডেন্স আইন-এর ধারা ৬৫-বি শেষ হচ্ছে একটা ব্যখ্যা-টীকা তথা ‘এক্সপ্ল্যানেশান’-এর মাধ্যমে। সেখানে ব্যখ্যা করা রয়েছে যে অনেক সময়ে তথ্যপ্রমাণাদিতে প্রয়োজনীয় অনেক ইনফরমেশান অপরাপর কোন ইনফরমেশন থেকে, সেই অপরাপর তথ্যসমূহের কোন এক বা একাধিক ফাংশানের মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়। এককথায়, ‘ইনফরমেশন ডিরাইভড ফ্রম আদার ইনফর্মেশন’ – আর এই ডেরিভেশান – এক বা একাধিক তথ্য বা তথ্যপুঞ্জ থেকে অপরাপর তথ্যমালা গেথে নেওয়ার বৈদ্যুতিন ফাংশান – তার আইনের ভাষার ‘এজুসডেম জেনেরিস’ এক্সপ্রেশান অর্থাৎ, যে প্রকাশের অন্তঃভাগে ‘ইত্যাদি’/ ‘এত সেতেরা’ শব্দরাজি বিদ্যমান – হিসেবে প্রকাশ ঐ ব্যখ্যা-টীকা জানাচ্ছে – গণনা (ক্যালকুলেশন), তুলনা (কম্প্যারিসন) ও যে কোন অন্যান্য প্রক্রিয়া (এনি আদার প্রসেস) – এই সকল ফাংশনের থেকে এমন এক বা একাধিক তথ্য তথা তথ্যসূত্র থেকে অপরাপর এক বা একাধিক তথ্য প্রগত-নির্গত হতেই পারে। এবং তা আইনগ্রাহ্য, ইলেক্ট্রনিক রেকর্ড তথা সেকেণ্ডারি এভিডেন্স এই নির্মাণ-বিনির্মাণ-কে ধরে রাখলো এভিডেন্স আইন-এর ধারা ৬৫-বি-র অন্তস্থঃ ব্যখ্যা-টীকা মারফৎ।

ল্য অফ এভিডেন্স, বিশেষতঃ এভিডেন্স আইন-এর ধারা ৬৫-বি অনুসারে সেকেণ্ডারি তথা ডক্যুমেণ্টারি এভিডেন্স-এর আওতায় এই যে ইলেক্ট্রনিক রেকর্ডস-এর স্বীকৃত গ্রহণযোগ্যতা, তা নিয়ে সর্বপ্রথম সুপ্রীম কোর্ট আলোচনা করে, ২০০০-এ সেই ইলেক্ট্রনিক রেকর্ডস বিষয়ক সংশোধনী আইন নং – ২১ প্রণীত হওয়ার পাঁচ বছর পর – ২০০৫ সালের ৪-ঠা অগাস্ট, স্বীয় ডিভিশান বেঞ্চ প্রণীত জাজমেণ্ট নং – (২০০৫) ১১ সুপ্রীম কোর্ট কেসেস পৃ ৬০০-৭৯৬ মারফৎ। এককথায় সেই জাজমেণ্ট ‘পার্লামেণ্ট হামলা’ জাজমেণ্ট নামে প্রসিদ্ধ। ‘সুপ্রীম কোর্ট কেসেস”-এর যে ১৯৭ পাতা জুড়ে বিধৃত রয়েছে এই জাজমেণ্ট, তার প্রায় প্রথম ৪১ পাতা জুড়ে রয়েছে তার ফুটনোট। সব মিলিয়ে সাইটেড হয়েছে দেশ ও বিদেশের ১১৩-টি বিশিষ্ট জাজমেণ্ট।

[ক্রমশ…]

Facebook Comments

Leave a Reply