জনৈক বাবা : অত্রি ভট্টাচার্য্য
২০২১-এর অস্কার পিছিয়ে গিয়েছে প্রায় দু’মাস, প্রধানতঃ করোনা পরিস্থিতির কারণে। সারা পৃথিবী মৃত্যুযন্ত্রনায় ছটফট করছে, তার ছায়া যে স্বভাবতঃই হলিউডে পড়ত – একথা মনে রেখেও বলা যায়, জৌলুস ও খরচাপাতির বিষয়ে এবারের অস্কার অনেকাংশে সংযত। কিন্তু সেরা অভিনেতা হিসেবে সদ্যপ্রয়াত চ্যাডউইক বোসম্যানকে টপকে অশীতিপর অ্যান্থনি হপকিনসের পুরষ্কারপ্রাপ্তি অনেক ভ্রুকুঞ্চণকে উপেক্ষা করেই আকাদেমী কর্তৃপক্ষের অন্যতম সিদ্ধান্ত হিসেবে ফিল্মের ইতিহাসে লেখা থাকবে আশা করা যায়। এবং সেরা চিত্রনাট্যকার হিসেবে ফ্লোরিয়ান জেলার-সহ যে দু’টি অস্কার পকেটে পুরল The Father (২০২০), তাকে শুধু ফিল্মের নয়, একার্থে একটি নিখাদ নাটকেরও সর্বজনস্বীকৃতি বলে অভিহিত করা সম্ভব।
“লা পেরে” (La Père, ২০১২), ফ্লোরিয়ান জেলার রচিত এই নাটক প্রথমবার ফিল্মে অনুদিত হচ্ছে না। ইতিপূর্বে ২০১৫ সালে খোদ ফরাসী ভাষাতেই এর সফল চিত্রায়ন ঘটেছে এবং স্বকীয়তার স্বাক্ষর রেখেছে। যদিও বার্ধক্যজনিত ডিমেনশিয়া, তথা এক বৃদ্ধকে কেন্দ্রে রেখে জাল বুনতে থাকাই উপাদান হিসেবে এই ফিল্মের একমাত্র রেকগনিশন হত, তবে একে নেহাৎ চ্যারিটি ছাড়া কিছু ভাবা যেত না। তবে জেলার স্বয়ং, তার মতে, এ নাটকের চলচ্চিত্রে রূপদান করেছেন মূলতঃ এক অন্য, অসুস্থ ও অন্তর্হিত পৃথিবীকে খুঁজে বার করতে। পরিচালক তথা লেখকের কথাতেই, এ ছবি দর্শকের অভিজ্ঞতায় যে সেতু নির্মাণ করে তা রোগীর সঙ্গে, এবং অনেকাংশে রোগের সঙ্গে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া সংজ্ঞানুযায়ী ডিমেনশিয়ার মূল উপসর্গগুলির যে তিনটি স্তর, তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে স্মৃতিলোপ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগী অ্যালঝাইমার্স-আক্রান্ত হয় এবং ক্রমশঃ বিস্মৃতির শেষ পর্যায়ে যেতে থাকে। যদিও এ ছবি কোন ডকুমেন্টারি নয়, তাই সংযোগ করতে হলে চিকিৎসার পরিবর্তে রোগেরই বিভিন্ন ঘরদুয়ারে ঠাঁই খুঁজতে হবে দর্শককে।
মূল নাটকের পরিসরের সঙ্গেও ছবির সাযুজ্য খুঁজতে যাওয়া, এক শিথিল সরলরেখা ব্যাতিত, বৃথা। যেমন ক্ষুদে দ্বিরালাপটি নাটকের একমাত্রিক স্রোতধারা, ছবি শুরু হয় তার কয়েক মিনিট পূর্বে এবং আগাগোড়া এই ডায়লগের উপর এক খোড়ো আঁতুর নির্মিত যা, অ্যান্থনি হপকিনসের একক অভিনয়ের জোরেই হয়তো, সাবেকি ব্রিটিশ পরিবারতন্ত্রের বাইরে এক প্রাচ্যের ছায়া সম্বলিত তৃতীয় ভুবনের সন্ধান দিয়ে গিয়েছে পদে পদে। আর চোখের সামনে পৃথিবী যে ভঙ্গীতে পাশ ফিরে শোয় তা আগাগোড়াই তার অচেনা লেগেছে। এ বিস্মৃতি বাহ্যতঃ সুপ্ত ছিল তার অতৃপ্তে তার উইঢিবির বসতে। অ্যান্থনির স্মৃতির যে ক’টি ফোকাল পয়েন্ট, বহতা স্রোতের মধ্যে কম্পমান শাখা তারা মূলতঃ মেয়েদের ঘিরে। তাই এই দীর্ঘ নাকি ক্ষুদ্র প্রবাসে একবারও ভেসে ওঠে না তার স্ত্রী-র কথা। তিনি মৃতা, অথবা বিচ্ছিন্না; অ্যান্থনির জীবনে নারীর অভাব পূর্ণ করে রাখে তার বড় মেয়ে অ্যান, আর স্মৃতির ফোকরগুলি – ছোটকন্যা, লুসি। অ্যান্থনি লুসির মৃত্যুসংবাদ পেরিয়ে এসেছে, অথবা মনে রাখতে চায়নি। ফ্লোরিয়ান জেলার-এর অসাধারণ ট্রিটমেন্ট একসময় দর্শককে ভাবাতে শুরু করে অ্যান্থনির স্মৃতির ভালমন্দ, ইচ্ছে-অনিচ্ছে। মনে রাখা, রাখতে পারা আর ভুলতে চাওয়ার দ্বন্দ্ব সজীব করে স্মৃতি নিজেই এখানে সবচেয়ে বড় প্রোটাগনিস্ট, এবং অবিশ্যি, রহস্যময়।
বলাবাহুল্য, অ্যান্থনির স্মৃতিতে ওভারল্যাপিং এক বড় ভূমিকায়, এবং তার একাধিক রূপ একই সঙ্গে, প্যারালালি দৃশ্যমান যার কুশীলব হিসেবে এক-দেড়টি মুখ বাদেও এসে গিয়েছে রাস্তা, জানলা, মেয়ের আঁকা ছবি এবং এমনকি তার ফ্ল্যাটের মালিকানা। নিজের ফ্ল্যাটেই তিনি ছেড়ে আসেন তার আরোগ্যের যাবতীয় সম্ভাবনা, এবং এখানেই একটি কবিতা রূপকের স্থির জলতলকে প্রচন্ড আলোড়িত করে, আধুনিকতাকে দৃশ্যে নয় শুধু, দর্শনের আঙিনাতেও প্রাণিত করে তোলে। এককথায়, এ ছবি ঐহিকে যতটুকু এক বৃদ্ধ মনোরোগীর রোগযাপনের যাত্রাপথ, দর্শক তথা অ্যান্থনির নিজের মস্তিষ্কে ক্রমশঃ পথ হারিয়ে ফেলার রোজনামচা, এমন এক ডায়রি যার পাতারা এক এক করে ছিঁড়ে উড়ে যাচ্ছেঃ অ্যান্থনি তার উপলব্ধি সক্রন্দন ব্যাক্ত করছেন ছবির অপরাহ্নে, “I am feeling as if I’m losing all my leaves.” তিনি মা, জীবজগতের প্রাচীনতমা দেবী-কে স্মরণ করছেন, যে লাটাই থেকে যে কোন স্মৃতির সুতো খুলতে থাকে।
এ ছাড়াও জেলার যে ক্যাজুয়াল ভঙ্গীতে স্বপ্ন ও বাস্তবের সীমানা ভেঙেচূড়ে মিলিয়ে দিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে শিল্পের ভুবনে এক স্পষ্ট জঙ্গমতায় আকীর্ণ। ব্রেতোঁ, ম্যানিফেস্টো অফ সুররিয়ালিজম-এ (১৯২৪) লিখছেন, “I am growing old and, more than that the reality to which I believe I subject myself, it is perhaps the dream, the difference with which I treat the dream, which makes me grow old.” তখন ব্রেতোঁ সবেমাত্র আঠাশ, এবং এ বক্তব্য সরাসরি মনোরোগীদের নির্দেশ না করলেও, আলোচ্য ছবির নিরিখে এর প্রাসঙ্গিকতা স্পষ্টতঃ ফুটে ওঠে।
স্বপ্ন ক্রমাগতঃ বাস্তবের সঙ্গে তুলনায় আসতে আসতে ক্ষয় হয়, অথবা উল্টোটা; বয়স বাড়ার সঙ্গে, ডিমেনশিয়া ইতরবিশেষ অধিকার করবার ফলে স্বপ্ন ক্রমশঃ মনকে অধিকার করে, তার স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যৎসহ যাবতীয় প্রাসঙ্গিকতা কাজে লাগিয়ে। সুস্থ এবং ইভেঞ্চুয়ালি মনোরোগীর মধ্যে পার্থক্য অনেকাংশে একটিই, যেমন ব্রেতোঁ বলেন, “জেগে ওঠাকে আমি নেহাৎ বাধাপ্রাপ্তি (Interference) ব্যাতিত কিছু ভাবতে পারিনা।” এক্ষেত্রে, ফিজিক্সের ভাষায় উক্ত শব্দটির অর্থ দু’টি পৃথক তরঙ্গের মিলনে একটি তৃতীয় তরঙ্গের উৎপত্তি। স্বপ্ন এবং বাস্তবকে যদি পৃথক তরঙ্গ হিসেবে ধরে নেওয়া যায়, ( Dream-এর সমান্তরাল হিসেবে wakefulness নাকি reality, কোনটি ধরে নেব তা যদিও অস্পষ্ট! ) তবে অ্যান্থনির ঘন ঘন একই দরজার পিছনে আলাদা আলাদা গন্তব্য খুঁজে পাওয়া বা একই ঘটনা চোখের সামনে বারবার পুনরাভিনীত হতে দেখাও এই মিলিতেরই অমোঘ আহ্বান, ফ্রয়েডের দিকে সামান্য তাকিয়ে।
অ্যান্থনির ডিমেনশিয়াক্রান্ত স্মরণশক্তির নিম্নগামী গ্রাফ তার জগৎময় অজস্র মুখকে স্বল্পসংখ্যকের বন্ধনীতে ন্যারো করেছে। নাম মিশে গিয়েছে মুখে, মুখ ঘটনায়, ঘটনা অনুদিত হয়েছে আবেগের বেনিআসহকলা দ্বারা সিদ্ধ হতে হতে। এবং যথারীতি, এ স্মৃতির যেহেতু কোনও টাইমলাইন নেই, সবই এক কুয়াশাচ্ছন্ন মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যান্থনির (পড়ুন দর্শকের) ক্রমঃরহিত দৃষ্টিশক্তি এবং যুক্তিবোধের সারভাইভাল, এর মধ্যে কার্য্যকারণ সম্পর্ক খুঁজতে হবে অবশ্যই একটি শিশুর মানসিকতায়। শিশুটি ঘড়ি হারায় ঘন ঘন, গোপন কাবার্ডে লুকিয়ে রাখে সবেধন নীলমণি একটি চামচ, জলের বদলে চায়ের সাথে ওষুধ খেয়ে তাক লাগিয়ে দেয় তার আয়াকে। সে শিশু মাতৃক্রোড়েই ফেরে আবার, যা আগেই ব্যাক্ত হয়েছে।
চরিত্রের তালিকা এই ফিল্মের ক্ষেত্রে যত না কঠিন তার থেকে বেশি অসার। কারণ এক ঋজু নোঙরের মত বড় মেয়ে অ্যান যেমন থেকে যায় বাবার মস্তিষ্কে, বাকিরা স্রোতের প্রায়, একে অন্যের থেকে পৃথক হতে পারে না পরিস্থিতিবিশেষে। সময় অ্যান্থনিকে খায় বাঘের মত ঘাড় মটকে না, সাপের মত আস্তে আস্তে; ক্রমশঃ নিকট দূরের জন অস্পষ্ট হয়ে গিয়ে সাপের রাক্ষুসে দাঁত ও চোয়াল তার পৃথিবীকে অধিকার করে। ছোট মেয়ে লুসি ফুটে উঠে সদ্য বহাল হওয়া আয়াটির মুখে, সেই মেয়েটির নাম হারিয়ে যায় তার চিকিৎসাকেন্দ্রের সেবিকার কাছে, এমনকি সেই সেবিকাও তার বড় মেয়ের চরিত্রে প্রবেশ করে ফ্যালে হঠাৎ, আবার দেখা দেয় অ্যান্থনির পরম আশ্রয় হয়ে, যখন তার দুর্বল মস্তিষ্ক বুঝে ফেলেছে তার পালাবার জন্য নিজস্ব প্রতিবেশটিও চিরতরে উধাও ! আবার অ্যান্থনির জীবনে পুরুষ চরিত্রগুলিও ঘন ঘন মুখ বদল করে; তাদের সঙ্গে প্রধানতঃ যুঝতে হয় মালিকানা নিয়ে। ফ্ল্যাটের, ঘড়ির, অস্তিত্বের, গলগ্রহ হয়ে থাকার যাবতীয় দাম চুকিয়ে নিতে বার বার ফিরে আসে একটি মুখ, একাধিক নাম। আমরা, বাইনারি সিস্টেমে ঘর করা রোবটেরা কনফিউজড হতে শুরু করি কে ভাল কে খারাপ, কে ঠিক কে ভুল, কে মিথ্যে কে সত্য – তা নিয়ে। আমাদের ফর্মূলায় ফেলা অভিজ্ঞতা ধাক্কা খেয়ে যায় অ্যান্থনির এলোমেলো হওয়া কালতন্ত্রের ঘূর্ণিতে পড়ে। আমরা রক্ত দিয়ে বুঝতে পারি কী অসহায় অবস্থায় এক মানসিকভাবে মুমূর্ষু বৃদ্ধ দিনযাপন করে চলেন প্রিয়জনপরিত্যক্ত হয়ে, এ কাঙ্খিত নরকে।
অতিদীর্ঘ কোনও আলোচনা এ ছবির ফ্যাকাশে শাখাপ্রশাখাগুলিতে রসসঞ্চার করতে পারে বলে বোধ হয় না যেহেতু ঘটনাতন্ত্রটি প্রতিক্রিয়ার নয়, ক্রিয়া ও বিচ্ছিন্নতার, ক্রমশঃ শুকিয়ে আসার। মনোরোগী হিসেবে যে জাল অ্যান্থনি ফেলতে থাকে তার পারিপার্শ্বিকে রোজ সকালে, প্রতি ঘন্টায়, তা নেহাৎ নিজেকে ধরার জন্যেই নয় – এ ধারণা ক্রমশঃ স্পষ্ট হতে থাকবে। বিভিন্ন সংলাপে, স্বগতোক্তিতে, একাকী ছুঁড়ে দেওয়া জেশ্চারে সে তার অতৃপ্তের দিকেও আঙুল তুলেছে একাধিকবার, এবং শেষপর্যন্ত করায়ত্ত হয়নি। আজীবনের ইঞ্জনিয়ার সে, নিজেকে ট্যাপ ড্যান্সার হিসেবে কেন পরিচয় দেয়? কেন সূঁক্ষ্ম বাসনা লেগে থাকে তার চোখেমুখে, যখন নতুন আয়াটির মুখের হাসি উচ্ছ্বাস থেকে ক্রমশঃ পেশাগত উচ্চাঙ্গের দিকে যাচ্ছে? এক ডিমেনশিয়াপীড়িতের তথাকথিত দুর্ব্যবহার কি সত্যিই রোগের অংশ, নাকি চরিত্রের অনাবিষ্কৃত দিক, যা খুঁড়লে আরোপিত সত্যিগুলি ফূঁড়ে রূপোলি ফসল বেরিয়ে আসত?
ফ্লোরিয়ান জেলার উত্তর খোঁজেননি কারণ তিনি ডাক্তার নন, সমস্যার গোড়া খোঁজেননি কারণ কাউন্সিলার-ও নন তিনি। খুঁজেছেন স্রেফ এক ঢেউয়ে মুছে আসা কবিতার মৃত্যুপথযাত্রী পংক্তিগুলি। ২০০৫-এ মুক্তিপ্রাপ্ত, অমিতাভ বচ্চন-রাণী মুখার্জি অভিনিত ব্ল্যাক ছবির মূল প্রোটাগনিস্ট-ও ছিলেন অ্যালঝাইমার্স-আক্রান্ত। বিশেষতঃ নিয়মিত বিস্মৃতির মূহুর্তগুলিতে অ্যান্থনি হয়তো স্মরণ করিয়ে দেবেন অমিতাভ বচ্চনের ধাক্কা খাওয়া মুখচোখ, প্রাণপণে উত্তর খোঁজার অভিনয়কে। তবে চিত্রনাট্য ও অভিনয়ের জেরেই এ ছবি অবশ্যদর্শনীয় – এ কথা হলফ করে বলা যায়।
ছবি: The Father
পরিচালনা: Florian Zeller
চিত্রনাট্য: Florian Zeller, Christopher Hampton
অভিনয়: Anthony Hopkins, Olivia Coleman, Rufus Sewel
মুক্তি: ২৭শে জানুয়ারি ২০২০
Posted in: FILM-REVIEW, May 2021