ভাগ্যহারা জমিদারের ভূমিকা ছেড়ে বামপন্থীরা ‘বিরোধী’ হয়ে উঠুন, প্লিজ! : অর্ক ভাদুড়ি

পশ্চিমবঙ্গের সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনে বামপন্থীরা পরাজিত হয়েছেন। কেবলমাত্র পরাজিত বললে ভুল বলা হবে, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচকমণ্ডলী তাঁদের সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করেছেন। যে বিপুল গণভিত্তি দশকের পর দশক এই রাজ্যের বামপন্থী দলগুলির সঙ্গে ছিল, তা কার্যত চুরমার হয়ে গিয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার মাত্র ১০ বছরের মধ্যে এমন বিপর্যয় নিশ্চিতভাবেই বলে দেয়, গলদ এক্কেবারে গোড়ায়। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ডি রাজা যেমন বলেছেন, তাঁরা রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ভাবে পরাজিত হয়েছেন। এটা সরাসরি মেনে নেওয়া ভাল যে, বামপন্থীদের পরাজয়ের কারণটা কেবল সাংগঠনিক ব্যর্থতা নয়। সাংগঠনিক দুর্বলতা তো আছেই। কিন্তু একই সঙ্গে এটা একটা রাজনৈতিক বিপর্যয়। গত ১০ বছর বামপন্থীরা বাংলায় যে রাজনৈতিক অনুশীলন করেছেন, তা মানুষের আকৃষ্ট করতে পারেনি। বরং বিরাট সংখ্যক মানুষকে তাঁদের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু কেন এমন হল?

স্বাধীনতার পর এই প্রথম বিধানসভার অভ্যন্তরে একজনও কমিউনিস্ট থাকবেন না৷ এই সত্য একদিকে যেমন মর্মান্তিক, অন্যদিকে তেমনই নিবিড় আত্মসমালোচনা ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ১৯৪৭-৬৭ সাল পর্যন্ত বাংলার শাসনক্ষমতায় বামপন্থীরা ছিলেন না। কিন্তু কংগ্রেসের একের পর এক নির্বাচনী সাফল্য এবং নিজেদের পরাজয় সত্ত্বেও সামাজিক ভাবে বামপন্থীদের উপস্থিতি ছিল উজ্জ্বল। বিধানসভায় অন্দরে এবং রাজপথে তাঁরা প্রবল ভাবেই ছিলেন। খাদ্য আন্দোলন, ভাড়া বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলন, শিক্ষক আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলা, বিহার সংযুক্তি বিরোধী আন্দোলন বা উদ্বাস্তু আন্দোলন – একের পর এক গণসংগ্রামে বামপন্থীরা সেই সময় নিজেদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। কংগ্রেসের বিকল্প হিসাবে তাই তাঁরাই ছিলেন স্বাভাবিক বিকল্প। জনসংঘ বা পরবর্তীকালের জনতা পার্টি নয়। তাই ১৯৬৭ এবং ১৯৬৯ সালের যুক্তফ্রন্ট বেশিদিন না টিকলেও বামেরা হারিয়ে যাননি। বাহাত্তরের কারচুপির নির্বাচন, পঁচাত্তরের জরুরি অবস্থা পেরিয়ে এলো সাতাত্তরের লোকসভা। কেন্দ্রে মোরারজির সরকারের আলোয় আলোকিত বঙ্গীয় জনতা নেতৃত্ব এই রাজ্যের সাধারণ মানুষের মনের গভীর লাল পতাকার শক্ত অবস্থান বুঝতে পারেননি। তাঁরা জ্যোতি বসুদের নামমাত্র আসন দিতে চাইলেন। জোট হল না। আলাদা ভাবে লড়ল বামফ্রন্ট। বাকিটা ইতিহাস।

এই ইতিহাস তৈরি হয়েছিল, কারণ তার আগের তিনটে দশক বামপন্থীরা সঠিকভাবে বিরোধী রাজনীতিটা করতে পেরেছিলেন। একই কথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্কেও বলা যায়। যুব কংগ্রেসের দিনগুলি থেকে তিনি সফলভাবে একটানা বিরোধী রাজনীতি করে গিয়েছেন। রাস্তায় থেকেছেন। তাই বিধান ভবনের কংগ্রেসিদের কার্যত নক আউট করে দিয়ে তিনিই হয়ে উঠতে পেরেছেন সিপিএমের বিকল্প। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম নিঃসন্দেহে অনুঘটকের কাজ করেছে, নিঃসন্দেহে লালগড় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে, কিন্তু সিপিএম বিরোধী জনতাকে নিজের পক্ষে আনতে পারা মমতার কৃতিত্ব। তিনি পেরেছেন, কারণ একটানা কয়েক দশক তিনি ক্লান্তিহীন ভাবে বিরোধী রাজনীতিটা করেছেন। তার সুর হয়তো চড়া, অধিকাংশ সময়ে সমর্থনযোগ্যও নয়, কিন্তু বিরোধিতায় নিখাদ।

২০১১ সালে পালাবদলের পর এক দশক পেরিয়ে গিয়েছে। এই কালপর্বে বামপন্থীরা বিরোধী দল হিসাবে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছেন। বস্তুত তাঁরা গত ১০ বছর ‘সাবেক শাসক’ হিসাবেই রয়ে গিয়েছেন। এক ভাগ্যবিড়ম্বিত জমিদারের মতো তাঁরা নিজেদের পুরনো আমলের সমৃদ্ধির কথা বলে গিয়েছেন যেন। যে ‘শিল্পায়নের’ প্রচারকে বাংলার মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছেন, বার বার তাকেই সামনে আনার চেষ্টা করে গিয়েছেন। নিজেদের যে বড়সড় গলদগুলির জন্য তাঁদের সরকারটা আর নেই, সেগুলি নিয়ে প্রকাশ্য আত্মসমালোচনা করতে পারেননি তাঁরা। এত দশক যে মানুষরা তাঁদের ভোট দিয়েছেন, তাঁরা কেন মুখ ফিরিয়ে নিলেন, সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাননি। খুঁজতে চেষ্টা করেছিলেন কি?

তৃণমূল সরকার ক্ষমতার পর থেকে একের পর এক ইস্যু তৈরি হয়েছে। বিষ মদ কাণ্ড, পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ, আমরিতে আগুন, সারদা কেলেঙ্কারি, নোনাডাঙা, সুদীপ্ত গুপ্ত খুন সহ আরও অনেক কিছু্। তখনও বামেদের বিপুল জনভিত্তি ছিল। তাঁরা গোটা রাজ্য অবরুদ্ধ করতে পারতেন। কিন্তু করেননি। তাঁরা পারতেন আন্দোলনের ঢেউ বইয়ে দিতে। স্বৈরাচারী, দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূলের কলার ধরে ঝাঁকানোর ক্ষমতা তাঁদের ছিল। কিন্তু সাড়ে তিন দশকের ক্ষমতার চিটেগুড় আটকে দিয়েছিল পা। সেই বাঁধন ছিঁড়ে বেরতে পারেননি তাঁরা। এই ১০ বছরে হাজার হাজার বামকর্মী ঘরছাড়া হয়েছেন, খুন হয়েছেন অনেকে, ধর্ষিতা হয়েছেন। কিন্তু ক’জন বাম নেতা, সম্পাদকমণ্ডলী বা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন? জনভিত্তি থাকা সত্ত্বেও ক’জায়গায় পাল্টা আঘাত ফিরিয়ে দিতে উদ্যোগী হয়েছেন নেতারা? এগুলো হয়নি, কারণ বামেরা নিজেদের বিরোধী দল হিসেবে মেনে নিতে পারেননি৷ তাঁরা রয়ে গিয়েছেন সেই পুরনো শাসকের মানসিকতায়। আর পার্টি কংগ্রেসের সিদ্ধান্তকে বাতিল কাগজের ঝুড়িতে ফেলে জাতীয় কংগ্রেসের মতো দলের সঙ্গে জোট করেছেন। যা কেবলমাত্র রাজনৈতিক বা নৈতিকই নয়, স্ট্র্যাটেজির দিক থেকেও সম্পূর্ণ ভুল।

২০১১-২০১৮ অবধি একটানা সন্ত্রাস চালিয়েছে তৃণমূল। প্রতিরোধহীন সন্ত্রাস। ফলে ক্রমশ পাতলা হয়ে এসেছে বামেদের জনভিত্তি। স্বাভাবিক, কারণ মানুষের প্রয়োজন নিরাপত্তা। বামেদের সঙ্গে থাকা মানুষ দেখেছেন নেতৃত্ব প্রতিরোধ নয়, বিবৃতিতে বিশ্বাস করেন। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে এই সন্ত্রাস চরমে পৌঁছল।।বাম ও কংগ্রেসের সংগঠন চুরমার হয়ে গেল। সেই শূন্যস্থান ভরাট করল বিজেপি। যার পরিণতি ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফল। এরপর আর রামে চলে যাওয়া বাম জনভিত্তি বামে ফেরানো সম্ভব ছিল না৷ কেবল রাম নয়, বসিরহাট সহ কিছু পকেটে বাম ভোট তৃণমূলেও গিয়েছিল। ২০২১ সালে সেই ভোট ফিরে আসার কোনও সম্ভাবনা ছিল না, আসেওনি। আব্বাস সিদ্দিকি লড়েছেন। আইএসএফ নিজেদের লড়া আসনগুলিতে ১৩ শতাংশ ভোট পেয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাহীন, সংগঠনহীন এই দলের পক্ষে ঘাড়ভাঙা সংযুক্ত মোর্চাকে বাঁচানো সম্ভব ছিল না। বাম ভোট এবার প্রায় সমান ভাবে গিয়েছে ছোট ফুল আর বড় ফুলে। বিজেপিকে আটকানোর তাগিদ অনেক বাম সমর্থককে বাধ্য করেছে চাঁদ সওদাগরের মনসা পুজোর মতো করে তৃণমূলকে ভোট দিতে৷ সেই সঙ্গে শেষ কয়েক দশকে সরকারি দলে পরিণত হওয়া, রাজনৈতিক চর্চার অভাব, জনভিত্তি তো বটেই এমনকি কর্মীবাহিনীর মধ্যেও আদর্শগত প্রচার না করার দরুন বড় অংশের হিন্দু বামপন্থীর ভোট আবারও বিজেপি পেয়েছে। আগামীতেও পাবে।

স্পষ্ট কথা স্পষ্ট ভাবেই বলা ভাল। বামেদের রাজনৈতিক লড়াই লড়তে হবে৷ সাবেক শাসকের মনোভাবকে লাথি মেরে বিরোধী দল হয়ে উঠতে হবে। রেড ভলান্টিয়ারদের কাজকর্ম শ্রদ্ধার, শ্রমজীবী ক্যান্টিনগুলিও জরুরি আন্দোলন। কিন্তু এগুলো নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে বামপন্থীদের রাজনৈতিক বিকল্প হিসাবে তুলে ধরবে বলে মনে হয় না। বামেরা যদি যথার্থ বিরোধী দল হিসাবে নিজেদের মনে করতে পারেন, বিরোধী রাজনীতিটা বিরোধী রাজনীতির মতো করেই করতে পারেন, তাহলেই হয়তো চাকা ঘুরলেও ঘুরতে পারে৷ নাহলে, সাম্প্রদায়িকতা আর স্বৈরাচারের বাইনারি থেকে বাংলার মুক্তি নেই।

[লেখক – সাংবাদিক, গবেষক। বামপন্থী রাজনীতির ছাত্র।]

Facebook Comments

Leave a Reply