অর্ধেকের খোঁজে: নিজস্ব বুননে ভারতীয় নারীদের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ – অমৃতা সরকার

ত্রয়োদশ কিস্তি

একাকী যাত্রা: মেরি জন থোট্টাম

১৯২৮ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত মেরি জন থোট্টামের আত্মজীবনীমূলক কবিতা ‘লোকামে যাত্রা’ (‘বিদায় পৃথিবী’) মালায়ালি নারী জীবনে একটি অতীব গুরুত্ববহ বই। কেরালার যে নারীরা কবিতার পাঠক নন, সাহিত্য অনুরাগীও নন তারাও এই কবিতাটি তাদের জীবনের একটি গুরুত্ববহ অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। এই কবিতাটি বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাই ‘সাহিত্যগুণে’র চেয়ে ‘সামাজিক প্রভাব’ অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।
১৯২০ এর দশকে সিরিয়ান খৃষ্টান পরিবারের একটি মেয়ের নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থেকে সন্ন্যাসিনীর জীবন বেছে নেওয়া খুব সাধারণ ঘটনা ছিল না। ১৯২৮ সালে মেরি সংসার ছাড়েন, বেছে নেন সন্ন্যাসিনীর জীবন। এতদিনের চেনা জীবন ও পৃথিবীকে বিদায় জানাতেই লেখেন ‘লোকামে যাত্রা’। বইটির প্রতিটি কবিতায় যেমন ধরা আছে পরিবার, বন্ধু, চারপাশকে ছেড়ে যাওয়ার ব্যক্তিগত দুঃখ অপর দিকে মেরি সুস্পষ্ট আত্মপ্রত্যয়ে উচ্চারণ করেছেন যে তাকে হারিয়ে পৃথিবীরও ক্ষতি কিছু কম নয়। মেরির নারীবাদী সত্তার ঋজুতা চোখে পড়ে, যখন তিনি সন্ন্যসিনী জীবনে পা দেওয়ার সময় সমস্ত কিছু ছেড়ে এলেও নিজের কলমটিকে ছাড়েন না।
মেরির কবিতা মূলত রোমান্টিক ধাঁচার, যেখানে প্রকৃতি মানুষের মতই রক্ত মাংসে গড়া। কবিতায় রয়েছে এক যাত্রার কথা-ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পৃথিবীর পথ থেকে অতীন্দ্রিয় আনন্দ ও জ্ঞানের আলোর দিকে আত্মার চিরন্তন যাত্রা। কেরালায় খুব প্রচলিত একটি ধারণা সিরিয়ান খৃষ্টানদের এই যে এরা ধর্মান্তরিত হওয়ার আগে ব্রাহ্মণ ছিল। সিরিয়ান খৃষ্টান হওয়ার কারণেই হয়তো মেরির লেখায় বেদান্তিক হিন্দুত্বের অজস্র ইমেজারি এবং দর্শন সঙ্গে মিশে গেছে খৃষ্টের প্রতি তার আনুগত্য ও প্রেম। ‘সন্ন্যাসিনী’ জীবনের নিয়মনিষ্ঠ শুষ্কতা মেরিকে গ্রাস করতে পারেনি।রক্ত মাংসের পৃথিবীতে সম্পৃক্ত চেতনাই তার ভাবনাচিন্তাকে সীমাবদ্ধ, একমুখী করে তোলে নি। আবেগের প্রকাশ ও আবেগ নিয়ন্ত্রন দুই-ই সমানভাবে দেখা যায় তার কবিতায়।মেরি জন থোট্টামের নারীবাদী স্বর পাঠকের সামনে আসে তার ক্যালাইডোস্কোপিক বৈচিত্রে- নিজস্ব চয়েস ও তার উদযাপনে। দৃঢ়তায় ও দৃপ্ততায় একলা সন্ন্যাসিনী একাকী সন্ধ্যায় বেরিয়ে পড়েন নিজস্ব খোঁজে , পিছনে পড়ে থাকে পৃথিবীর ঐশ্বর্য্য, কলমে উঠে আসে ‘সায়ান্থিলে একান্ত যাত্রা’ (সন্ধ্যায় একাকী যাত্রা)।
এই অনুবাদের সোর্স ভাষা ইংরেজি। অনুবাদের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে পি.টি. জর্জের মালায়ালাম থেকে করা ইংরেজি অনুবাদটি।

মেরি জন থোট্টাম

পৃথিবীকে বিদায়

লালন করেছ মমতায় জন্মের দিনটি থেকে,
পুরেছ সব প্রয়োজন ; ও পৃথিবী,
জানবো আগামীকে বিদায়
শনির দৃষ্টি পড়ে না যেথায়।

কেন বিহ্বল মুখ ?
বন্ধু, কোনও ক্ষোভ তো রাখিনি আমরা;
একসাথে কেটেছে যে দিন ,যেন কখনো হব না আলাদা,
ভুলিনি আমি।

তুমি এখনও বন্ধু ,কিন্তু বুঝেছি,
তোমার নেই কোনও চিরন্তন মূল্যবোধ-
এ কারণে পা বাড়িয়েছি
তোমায় ছেড়ে যেতে

হেসো না, ও পৃথিবী, বোকা ভেবে তামাশা কোরো না-
বুঝছো না হয়তো এখনও ;
একদিন, নিশ্চিত, আমার সত্য
তোমার মুখে চাইবে এক দৃষ্টে- বিশ্বাস করবে আমায় তখন!

অতীতে খ্যাত ছিল বুদ্ধিতে
তাদের পরিণতি কী জানো না ?
বিদ্যা আসেনি উপকারে, নিসঙ্গ আত্মা,
পচা শরীর মিশে গেছে ধুলায়।

চলেছি সত্য সন্ধানে
অনিঃশেষ জীবন করবে সহনীয় , মুক্ত করবে শোক;
উজ্জ্বল চ্ছটার মেকি যা লোভনীয়
আমার নয়; খুঁজবো না তাকে ।

সকল ছেড়ে, নেবো নিডরের পথ
বাসনা পেরিয়ে ,যে পেয়েছে শান্তি।
হঠকারিতা ক্ষমা করুক পৃথিবী
খুঁজে যেন পাই জীবন মহোত্তর।

সহজ নয় প্রিয়জনকে ছেড়ে যাওয়া
সরল ও গভীর ভালোবাসায় জড়িয়েছে যেজন
শক্তি মোর নেই কোনো মানুষের অধিক
কিন্তু স্থির করেছি এবা্রে পথ।

অপরিণত মন, কী বা আশা
ওপড়াবে বাসনার মূল, কাটবে এ পৃথিবীর মায়ার বুনন?
কঠোর তাপসেরও ছেড়ে যাওয়া কঠিন অনেক;
মন শুধু পোড়েনি , জ্বলছে এখনও।

১০

শোনো, বন্ধু আমার , চলে যাচ্ছি,
বিদায়; কিছু দিন থাকি বিচ্ছিন্ন;
তারপর, দেখা হবে আবার,
কথা রইলো একাকার হওয়ার ।

১১

আমার শিক্ষকেরা, মাথা নোয়াই পূত পায়ে
চেয়েছেন তারা, লড়েছেন সমৃদ্ধ করতে আমায়,
প্রথম দিন থেকে ধরে আছেন আঙুল
শিখিয়েছেন লিখতে অক্ষর

১২

এইখানে, ভাঙাবুকে, নেভানো শরীরে
মাটিতে শুয়ে কাঁদে, জন্ম দিয়েছে যে মা;
ভাইয়ের চোখের জল ভেজায় মাটি, ভালোমানুষ বাবা
চেয়ে থাকেন, বুকের কাছে হাত করে জরো।

১৩

বুঝি না, কী বলি,
কীই বা করি-সত্য দিয়েছে ক্ষত।
চলে যাব সোজাসুজি? বুদ্ধি মানে না তা; সান্ত্বনার কথা দুটি
বলে যাব শ্রদ্ধায় ।

১৪

সাহস কর বাবা মা, প্রার্থনা করি
রহস্যময় অন্ধকারে মহাজাগতিক প্রবাহের নিচে
বয়ে যাব-
মন ভরবে না তোমাদের ?

১৫

ছোট ছোট ভাই বোনেরা দাঁড়িয়ে আছিস
চুপটি, সাদা সরল মনের কথা
লেখা তোদের মুখে, আলো জ্বাল মনে
সহজে বিদায় দে আমায়

১৬

ছোট্ট ভাইটি আমার,লতার মত হাতের বেড়ে
আমার কোমর জড়িয়ে কাঁদছিস,
আমার যাওয়ার সময় যে হয়ে গেছে; এখন
তোর কপালে একটা চুমু এঁকে দি
যেতে দে, সোনা, যেতে দে আমায়

১৭

আমার বাড়ি, তোমার মেঝেতে জন্মেছি আমি
বাতাসে নিয়েছি শ্বাস, ঘুমিয়েছি তোমার ছাদের তলায়,
অবাঁধ আনন্দে বেঁচেছি আজকের দিন অব্ধি,
চলে যাচ্ছি, চিরদিনের জন্য তোমায় ছেড়ে যাচ্ছি আমি।

১৮

আজকের পর আমার জন্য খুলবে না এই দরজা,
এই ঘরে আমার জন্য কোনও বাতি জ্বলবে না,
বিছানা পাতা হবে না , প্রিয়জনদের সঙ্গে
বসে খাওয়া হবে না এ বাড়িতে আর।

১৯

আমার কলম, আমার সব সময়ের সঙ্গী, ঘুরে দাঁড়ালে;
কেন আসতে চাও আমার সাথে এই পথে এখন?
সঙ্গ-লিপ্সা ফুরোয়নি এখনও – শান্ত সন্ন্যাস কি
তোমায় বিশ্রাম দেবে? আশ্রয় দেবে ?

২০

যদি আসতেই চাও, তাহলে এসো ,বন্ধু,
তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার নিষ্ঠুরতা করতে চাই না।
শুধু আমাকে অপরাধী কোরো না,
ভয় নেই আর কিছুতে।

২১

ও বিশাল পৃথিবী, এখন, চললাম আমি
পেরিয়ে যাচ্ছি আমার প্রিয় শহর, প্রিয় মানুষ;
পারব না ফিরতে, ডেকো না আমায়, এই মিনতি।
তোমাকে প্রণাম, আশিষ দিও বিদায়ের কালে

২২

পিছনে ফেলে সকল কিছু, আমার তরি চলেছে সুমুখে,
উঁচু উঁচু ঘুর্নি স্রোতেও আমি এগিয়ে যাব অটল হৃদয়;
দিগন্তে হবে ব্যাপ্তি; হাত ছুঁয়ে যাবে সোনালি সূর্য, আনন্দ স্বরূপ!

Facebook Comments

Leave a Reply