অন্ধকারের উৎস হতে….. : আবীর মজুমদার

প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় আজি অদ্য
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা
চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য
কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া
সুভাষ মুখোপাধ্যায়।

এই প্রবন্ধ যখন লেখা হচ্ছে তখন ভারতবর্ষের রাজনীতি এক ভয়ঙ্কর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। আর.এস.এস-এর অভিভাবকত্বে ভারতীয় জনতা পার্টি বলা ভাল মোদী-শাহ জুটি দেশকে বিক্রি করে দিচ্ছে কর্পোরেট পুঁজির হাতে, আর বিজেপির ছদ্ম বিরোধিতা করা মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা প্রথমবারের জন্য বাম শূন্য হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে বামপন্থার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে। আমি রাজনীতিজ্ঞ নই। কাজেই এই বিষয়ে জ্ঞান দেওয়ার ধৃষ্টতা আমার মানায় না। কিন্তু একজন বামমনষ্ক সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে কিছু বলার দায় থেকেই যায়।
পৃথিবীর ইতিহাসে শিল্প নিয়ে বহু আলোচিত বিষয়ের একটি হল Art for Art sake নাকি Art for Art people? ‘শিল্পের জন্য শিল্প’-এর প্রবক্তারা আসলে বুর্জোয়া ব্যবস্থাটাকে টিকিয়ে রাখার জন্যই নিজেদের প্রয়োগ করেন। অন্যদিকে শিল্প যদি সমাজ সচেতন, শ্ৰেণী সচেতন হয়ে ওঠে, তখন Art for Art sake-এর প্রবক্তারা শঙ্কিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু শিল্পীর অস্থিতে যদি ইতিহাস চেতনা এবং মরমে বিষয়-বস্তুর সমান প্রাধান্য থাকে তা হলে তা হয়ে ওঠে কালোত্তীর্ণ শিল্প। এই দুই চেতনার সুস্থ সমন্বয়েই জন্ম হয় গোর্কি, লু-সুন, অস্ত্রোভোস্কি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
কিন্তু সমস্যা হল এই ইতিহাস চেতনা ও শ্রেণী চেতনাকে গুলিয়ে দিতে চায় বুর্জোয়াদের মদতপুষ্ট শিল্পী, সাহিত্যিকরা। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। আগে আমরা দেখেছি কোন জনপ্রিয় নরম পানীয়ের বিজ্ঞাপনে চলচ্চিত্র জগত বা ক্রীড়া জগতের কোন আইকনকে ব্যবহার করা হতো প্রোডাক্টের জনপ্রিয়তা সাধারণ মানুষদের মধ্যে বৃদ্ধি করতে। গত দু’এক বছরে চিত্রটা একটু বদলেছে। একটি বিজ্ঞাপনের কথা বলি— একটি কারখানা গেটে শ্রমিকরা অনশন করছেন। তাদের মুখে স্লোগান “যব হামারি মাঙ্গে পুরি নেহি হোতি, হাম পানিকে এক বুঁন্দভি নেহি পিয়েঙ্গে।” সাংবাদিক ক্যামেরা ঘুরিয়ে দেখান। একজন শ্রমিক সব আন্দোলন ভুলে ১০ টাকার পেপসি খাচ্ছে। অর্থাৎ তাদের আন্দোলন, জীবনের দাবির থেকেও এক বোতল নরম পানীয় অনেক বেশী মূল্যবান।
আরেকটা বিজ্ঞাপনের কথা বলি— গ্রামের কৃষকরা তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে মিটিং করছেন, হঠাৎ করে বেজে ওঠে আই.পি.এল ক্রিকেটের সিগনেচার টিউন। কৃষক নেতা বলে ওঠেন ‘আন্দোলন কাল হোঙ্গে, আজ আই.পি.এল দেখ লেতে হ্যায়।’ যে বুর্জোয়া পুঁজি মানুষকে মোহিত করতে মনোরঞ্জনকারী মডেলদের ব্যবহার করে, আজ তারাই হানা দিয়েছে শোষিত মানুষের শ্রেণী চেতনায়। আর এই কাজে তারা ব্যবহার করছে বিজ্ঞাপন, নাটক, গান, চলচ্চিত্র। একথায় সমস্ত শিল্পকে। ৫০ এর দশকে বিষ্ণু দে লিখেছিলেন, “আমাদের আশা নেই, আমাদের ভাষা নেই, আমাদের চৈতন্যে মড়ক।”
চৈতন্যে এই মড়ক দেখা দিয়েছে বলেই জনজীবনে সাম্প্রদায়িকতা, ডোল পলিটিক্স, মিথ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদ ক্রমাগত তাদের পথ প্রশস্ত করছে। সমস্যাটা এই জায়গায়। যে বামপন্থী দলগুলি তাদের সমান্তরাল রাজনৈতিক বোধ, সংস্কৃতির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে ব্যর্থ। যান্ত্রিক সংগঠনের নেশায় এই প্রজন্মের মানসিক গঠন নির্মাণের কাজটিই বহুক্ষেত্রেই অবহেলিত হচ্ছে, এবং হয়েছে। ৪০-এর দশকে বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, মহামারীকালের সেই দমবন্ধ করা পরিস্থিতির মধ্যেও সময়ের দাবী মেনে শিল্প খুঁজে নিয়েছিল তার নিজস্ব অবয়ব। গল্প, নাটক, কবিতা, গানে, উপন্যাসে ছিল মানুষের হাহাকার, তেমনই প্রতিভাত হয়েছিল বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম।
নবান্ন, জ্বালা, সাঁকো এই নাটকগুলি সেদিন ঘোষণা করেছিল কবোন্ধ সময়ের মধ্যেও শুরু হয়ে গিয়েছে মনোজগতের তুমুল শ্রাবণের চাষবাস। একদিকে গোগোল, চেখভ, গোর্কির অনুবাদ, অন্যদিকে সোভিয়েত চলচ্চিত্রের দিকপাল আইজেনস্টাইন, পুদভকিন, দভচোঙ্কোর ছবি আমাদের ভাবনার অভিমুখ ঠিক করে দিচ্ছিল এক প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। ভাবলে অবাক লাগে আজ থেকে ১০০ বছর আগে সোভিয়েত বিপ্লবের পরেই লেনিন বলেছিলেন, Among all art, cinema is most powerful. সোভিয়েত চলচ্চিত্রকে জাতীয়করণ করে, নিজের স্ত্রী ক্রুপস্কায়াকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন জনশিক্ষা প্রচারে যেন সিনেমাকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়। কারণ সেই সময়কার রাশিয়ায় বেশীর ভাগ নিরক্ষর মানুষ ছবি দেখে বুঝতে শিখবে বিপ্লবের সাফল্য। মহামতি লেনিনের নির্দেশে বিখ্যাত চলচ্চিত্র সম্পাদক এডওয়ার্টটিশে গোটা দেশ ঘুরে ছবি দেখাতেন। সেই আন্দোলনের নাম ছিল আজিতাঁতসিয়া প্রোপাগান্ডা (Agit prop movement)।
বিল্পবের পর লেনিন ছাড়া একমাত্র মেয়ার হোল্ড বুঝেছিলেন বিপ্লবের বাণীকে দেশের কোনে কোনে পৌঁছে দেবার জন্য সবচেয়ে বড় মাধ্যম হচ্ছে সিনেমা। তার শিষ্যদের তিনি চলচ্চিত্রে বৈপ্লবিক উপকরণের নানান শিক্ষা দিতে থাকলেন। ১৯১৭ সালে রুশ দেশে চলচ্চিত্রের যে স্ফুলিঙ্গ দাবানলে পরিণত হয়েছিল তাকেই কিউবায় এগিয়ে নিয়ে গেলেন ফিদেল কাস্ত্রো। ১লা জানুয়ারি ১৯৫৯ সালে বাতিস্তা সরকারে উচ্ছেদের পর বিপ্লবী সরকার তিন মাসের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করল কিউবান ইনস্টিটিউট অব সিনেমাটোম্যাটোগ্রাফিক আর্ট অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ICAIC)। ভ্রাম্যমান প্রজেক্টরে গ্রামে গ্রামে দেখানো হত সিনেমা। জনচেতনা জাগ্রত করার দায়িত্ব নিয়েছিল চলচ্চিত্র। ৩০-৪০ দশকে প্রগতিশীল সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, ভারতীয় গণনাট্য সংঘের শিল্পীরা চেষ্টা করছিলেন জনগণের মানসিক গঠন নির্মাণের, আর শিল্পই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।
চীনে মাও সে তুং, ‘লিয়াং সান পাহাড়ের বিদ্রোহে যোগদানের প্রেরণা’ নাটকটি দেখার পর পিকিং অপেরা থিয়েটারকে অভিনন্দন জানিয়ে ছিলেন। সুই লুচুয়ান’ (জলাভূমির নায়কেরা) উপন্যাসের উপর নির্মিত এই নাটকটিতে দেখানো হয় লিন-চুং প্রক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে জনগণের বিদ্রোহে যোগদান করেছে। ১৯১৯-২১ চীনের কমিউনিস্ট পার্টি সাম্রাজ্যবাদী, সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অন্য ধারায় সাহসী আক্রমণ শুরু করল। সিনেমা, নাটক, সঙ্গীত সবক্ষেত্রেই দেখা গেল এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। লু-সুন হয়ে উঠলেন সেই সময়কার সবচেয়ে বৈপ্লবিক নাট্যকার ও চিন্তাবিদ। এক কথায় নয়া গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে পরিচালিত ব্যাপক জনগণের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ও সামন্ততান্ত্রিক বিরোধী সংস্কৃতি।
ফ্যাসিবাদও তাদের নিজেদের স্বার্থে নিজেদের তৈরি সংস্কৃতির কাঁধে ভর দিয়েই পথ চলা শুরু করেছিল। ‘ফিউচারিস্ট’ মুভমেন্টের ইস্তেহারের লেখক মারিনেত্তি তার ‘ফিউচারিসম ও ফ্যাসিজিম’ বইটিতে ফ্যাসিজিমের সাথে ফিউচারিসমের অনেক যোগসূত্র দেখিয়েছেন। ১৯০৯ ফিউচারিস্ট ম্যানিফেস্টোতে লেখা হয় ‘আমরা যুদ্ধের স্তব করতে চাই।’ মারিনেত্তি ছিলেন মুসোলিনির অন্তরঙ্গ বন্ধু। ১৯১১ সালে ইটালি যখন ত্রিপোলি আক্রমণ করে দখল করে, তখন মারিনেত্তি তার ইস্তেহারে লিখেছিলেন ‘সমস্ত দেশ যুদ্ধের অভিলাসে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে যে আমাদের ছোঁয়ায় সেটা জেনে আমরা গর্বিত।’ ফিউচারিস্টরাও জানিয়ে দেয় যে তারা ইটালির সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণকে সমর্থন করে এবং সোস্যালিজমকে ঘৃণা করে। নাৎসীরা প্রসিদ্ধ সমস্ত লেখকদের বই পুড়িয়ে, চিত্রকরদের ছবি নষ্ট করে Cultural reaction-এর জন্ম দিয়েছিল। ফ্যাসিস্ট গভর্নমেন্ট প্রেসের স্বাধীনতা ও বাক্যের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করেছিল। ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষমতাকে খর্ব করেছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল পুঁজিপতিও ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে মুনাফার হার বাড়ানোর এবং বেতন হ্রাস করা। ১৯২৭-৩১ সালের মধ্যে ইটালি শ্রমিকদের বেতন ৩০-৫০ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। খেতমজুরদের মাইনেও কমেছিল প্রায় ৫০ শতাংশ। আজও ভারতবর্যের কেন্দ্র সরকার এইভাবেই কৃষি আইন, শ্রম আইন, পাস করে জনগণের উপর নামিয়ে আনছে এক ভয়ঙ্কর আক্রমণ। আর সেই অনাচারকে তারা জাস্টিফাই করছে তাদের আই.টি সেলের বিকৃত প্রচারের মাধ্যমে।
আজ এই দেশে সামান্য প্রতিবাদ দেখালেই জুটছে রাষ্ট্রদ্রোহীর তকমা; ঠিক যেমন হিটলার, মুসলিনির সময় হতো। ইতিহাস সময়ের পথ ধরে অনেকটা এগিয়ে গেছে, কিন্তু ফ্যাসিবাদের স্বৈরাচারী চরিত্র বিশেষ বদলায়নি। তাই যুক্তিবাদী আন্দোলন করার জন্য খুন হতে হয় কালবুর্গি, পানসারে, গৌরি লঙ্কেশকে। চারণ কবি ভারভারা রাও, সাঁইবাবা, সোমা সেন-দের জীবন কাটে অন্ধকার কারাগারে। এ যেন হীরক রাজার সেই দেশ, যেখানে হয় মগজ ধোলাই, নয় মৃত্যু। কিন্তু কবি তার লেখা দিয়েই ‘শ্বাস নেবেন জনতার মাঝে, তাকে আটকে রাখবে কোন কারাগার?’।

যাদের কণ্ঠস্বরের স্বচ্ছশক্তি নৈঃশব্দ্য পার হয়ে অন্ধকারে অঙ্কুরিত হল

সমাজে শিল্পীর ভূমিকা কি হবে এই নিয়ে বিতর্ক সুদীর্ঘকাল। কোন কোন শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, চেয়েছিলেন শিল্পের বিশুদ্ধ মন্দিরের পূজারী হতে। আরেক দল শিল্পের আকাশ থেকে নেমে এসেছিলেন জীবনের রুক্ষমাটিতে। যেখানে শিল্প তাদের সমাজ বদলের হাতিয়ার। ইতিহাস সাক্ষী আছে শিল্প যখন রাষ্ট্রের সমালোচকের ভূমিকা নেয়, তখনই শুরু হয় রাষ্ট্রের চোখ রাঙানি। কারণ সাহিত্য, নাটক, সিনেমা, কবিতা, গানের জনজাগরণী শক্তি রাষ্ট্র নেতাদের অজানা নয়। তাই কখনো কখনো বেয়ারা বিদুষকদের নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে রাষ্ট্র। কখনো সফল হয়, কখনো বা রাষ্ট্র প্রত্যাখ্যাত হয় ঋজু মেরুদণ্ডের শিল্পীর ব্যক্তিত্ব ও চেতনার কাছে। দু-রকম উদাহরণই মজুত রয়েছে ইতিহাসের ভাণ্ডারে।
চ্যাপলিনও বাদ গেলেন না রাষ্ট্রের রোষদৃষ্টি থেকে। ‘মর্ডান টাইমস’ যখন শুধুই আর হাসালো না, প্রশ্ন করল রাষ্ট্রকে, পুঁজিবাদকে, যন্ত্র সভ্যতার অন্তঃসারশূন্যতাকে, তখনই তিনি রাষ্ট্রনেতাদের বিরাগভাজন হলেন। তার গায়েও কমিউনিস্ট স্ট্যাম্প মেরে দেওয়া হল। ফাঁসানো হল নানা মামলায়। আর চ্যাপলিন বলেন–‘I am not a Communist, I am human being. I am an artist. I am interested in life. Bolshevism is a new phase of life. I must be interested in it.’
অবশেষে চ্যাপলিনকেও একদিন নিজ দেশ ত্যাগ করে চলে যেতে হল। ফ্যাসিবাদ যখন চরমে উঠল তখন সত্যিকারের বুদ্ধিজীবীরা নন্দনতত্ত্বে বিভোর হয়ে থাকতে পারলেন না। ১৯২৭ সালে রম্যা রোলাঁ, বারবুসের নেতৃত্বে প্রথম ফ্যাসিবিরোধী সম্মেলন ডাকা হয় প্যারীতে। সেই সম্মেলনে লিখিত বাণী পাঠালেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। একদিকে রোলাঁ, বারবুস, চ্যাপলিন, রাসেল, রবীন্দ্রনাথ, আইনস্টাইন গর্জে উঠছে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, স্প্যানিশ সিভিল ওয়ার দেখে চরম বিষাদে পিকাসো আঁকছেন গুয়েরনিকা, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠছে ফ্যাসিবিরোধী সংঘ; আর অন্যদিকে মার্কিন হাউডগার, স্পেন্সলার, জাপানি কবি নোগুচি হিটলারের গুণগান গাইছে। ফ্যাসিবাদের গুণগান করে সেদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল ‘শক্তিমান, বীর, নূতন পতাকা হস্তে স্বদেশ প্রেমিক হিটলার।” আর অমৃতবাজারে লেখা হয়েছিল- “মুসোলিনি দেশপ্রাণতার অবতার।”
সেদিন ঐ সমস্ত কাগজগুলোর হেডলাইন প্রমাণ করে দেয় আজও তারা কোন শ্রেণীর হয়ে ক্রমাগত প্রচার করে যাচ্ছে। ১৯২৭ সালের ১৬ই জুন গণবাণী পত্রিকায় মুজফফর আহমেদ লিখেছিলেন- “আজকের জগতের মধ্যে মুসোলিনি সবচেয়ে ঘৃণ্য জীব”।
চ্যাপলিন বিশুদ্ধ আর্টের মন্দির থেকে নেমে এলেন মাটিতে, যে মাটির সঙ্গে আকাশের কোন বিরোধ নেই। হিটলার, মুসোলিনির ফ্যাসিজিমকে বিদ্রূপ করে সৃষ্টি করলেন ‘The Great Dictator’। নতুন শিল্পের আঙ্গিকে তীব্রভাবে আঘাত করলেন ফ্যাসিবাদকে। তার ফলে চ্যাপলিনের সাময়িক লোকসান হলেও সুদীর্ঘ ভাবীকালে তা পূর্ণ হয়ে উদ্বৃত্ত থাকল। দীর্ঘদিন নির্বাক থাকার পর কথা বললেন চ্যাপলিন। আইজেনস্টাইনের ভাষায় বড় হয়ে গেলেন চ্যাপলিন – grown up Chaplin.
এবার চ্যাপলিনের যুদ্ধ ভিন্ন রণাঙ্গনে। তাই ভবঘুরের পোশাক খুলে পরে নিলেন যুদ্ধের পোশাক। তার মুখে আপাত সারল্য তখন অপসৃত। চলচ্চিত্রের বিবর্তনের প্রেক্ষিতে The Great Dictator-এ বিস্ময়কর শৈলীর আধুনিকতা ও ব্যঞ্জনাময় ভাবনার তীব্র বিদ্রূপ এক চরম উৎকর্ষতায় পৌঁছে গেল। নাপালি (মুসোলিনি) ও হিংকেল (হিটলার) চরিত্র সৃষ্টির মাধ্যমে চ্যাপলিন চূড়ান্ত বিদ্রূপাত্মক আঘাত করলেন ফ্যাসিবাদকে। নাপালনি ও হিংকেল পরস্পরের মুখোমুখি দুটো চেয়ারে বসে আছে। আর দুজনেই নিজেকে অন্যের চেয়ে উঁচুতে দেখার জন্য চেয়ারের স্প্রিং ঘুরিয়ে চেয়ারটাকে উঁচু করে নিচ্ছে; যেমন করে ফ্যাসিস্টরা ক্ষমতার চূড়ান্ত উচ্চতায় পৌঁছানোর জন্য প্রতিযোগিতা করে। হিংকেলের সহকারী গারবিল (গোয়েরিং) তখন তাকে বোঝাচ্ছেন যে যতক্ষণ না ইহুদীরা ধ্বংস হচ্ছে, যতক্ষণ না আর্য জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার পাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত পৃথিবীতে শান্তি আসবে না। “We will never have peace untill there is a pure blue eyed, blond race with you as dictator of the world.” গারবিল হিংকেলকে বলছেন, ‘একদিন সবাই আপনাকে ঈশ্বরের মতো পূজা করবে।’ আনন্দে উত্তেজনায় হিংকেল একা ঘরে একটা রাবারের গ্লোব (পৃথিবী) নিয়ে লোফালুফি খেলছে। অনুভূতিতে তখন গোটা পৃথিবী তার অনুগত ক্রীতদাস। পৃথিবীর অধীশ্বর তিনি। ইচ্ছে মতো যা খুশি করা যায় এই পৃথিবীকে নিয়ে। তেমন করেই হিটলার পৃথিবীর উপর প্রভুত্ব কায়েম করতে চেয়েছিলেন।
হঠাৎ করে রাবারের বেলুনটা ফেটে যায়। কান্নায় ভেঙে পড়ে হিংকেল। এমনি করেই শুভ বুদ্ধির উত্থান আর স্ট্যালিনের লাল ফৌজের পৌরুষের কাছে পরাভূত হয় ফ্যাসিবাদের ঔদ্ধত্য। এই দৃশ্যটি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে চিরস্থায়ী সম্পদ হয়ে রইল। এই ছবিতে চার্লি পেশায় নাপিত। জাতে ইহুদী। দেশের প্রয়োজনে সে যুদ্ধে যায়। যুদ্ধে চার্লির স্মৃতি লোপ পায়। সে ফিরে আসে তার ইহুদী পাড়ায়। ইতিমধ্যে হিংকেল বাহিনীর ইহুদীদের প্রতি অত্যাচারের কথা তার অজানা। ছবিতে বারবার দ্বন্দ্ব হিসেবে উপস্থিত হয়েছে একাধারে ইহুদী পাড়া অন্যদিকে হিংকেলের প্রসাদ। ইহুদী নাপিতকে গ্রেপ্তার করে হিংকেল বাহিনী। নাপিত জেল থেকে পালায় মিলিটারি পোশাক পরে। নৌকা করে নাপিত হাঁস শিকার করতে বের হয়। নৌকা উল্টে যায়। হিংকেল বাহিনী নাপিতকেই হিংকেল ভেবে মঞ্চে নিয়ে যায়। মঞ্চে দাঁড়িয়ে হিংকেল বেশে ইহুদী। নাপিত যে বক্তৃতা দেয় তা ইতিহাসের সম্পদ:
“আমি দুঃখিত আমি সম্রাট হতে চাই না। কাউকে শাসন করতে চাই না। মেশিন প্রচুর উৎপাদন করলেও আমাদের অভাব বেড়ে চলেছে। … আমাদের প্রয়োজন যন্ত্রের চেয়েও বেশী মানবতার। … আমাদের লোভের পরিণতিই দুঃখ দুর্দশার কারণ … কিন্তু মানুষের ঘৃণা একদিন দূর হবে … ডিক্টেটর একদিন মরবে মানুষের কাছে … মানুষের হাতে আবার ক্ষমতা ফিরে আসবে। … এসো আমরা মুক্ত পৃথিবীর জন্য লড়াই করি। … এসো গণতন্ত্রের জন্য আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হই।”
এই তো মানবতার সেই অমর বাণী যা চিরকাল আমাদের শোনাতে চেয়েছেন চ্যাপলিন। ছবির শেষে দীর্ঘ ৬ মিনিটের বক্তৃতার আঙ্গিক নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এই বক্তৃতা মানব সভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্য। বক্তৃতায় শেষে দেখা যায় হানা (একটি ইহুদী মেয়ে) আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, মেঘ সরে যাচ্ছে, সূর্য উঠছে। এক নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হচ্ছে পৃথিবী যে আলোর নাম মানবতা। মানুষের অন্তরাত্মা রামধনু রঙ মেখে ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে নতুন আলোকময় পৃথিবীর দিকে।

আজকের ভারতবর্ষ ও ফ্যাসিবাদ

আজ ফ্যাসিস্ট বিজেপি সরকার ভয়ানক করোনা কালে লকডাউনে কাজ হারানো শ্রমিকদের কথা না ভেবে ২৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন নির্মাণ করছে। সাত হাজার কোটি টাকা দিয়ে মোদী সাহেবের চাটার্ড বিমান কিনছেন, ৩ হাজার কোটি টাকা দিয়ে মুৰ্ত্তি বানানো হচ্ছে, এন.আর.সি চালু হচ্ছে, আর এই সমস্ত অপকর্মকে আড়াল করার জন্য তাদের আইটি সেল ক্রমাগত মিথ্যাচার করে মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছে। আমার প্রশ্ন হল যে এই প্রজন্মের বেশীরভাগ তরুণ, তরুণী তাতে প্রভাবিত হচ্ছে তার কারণ আমরা আমাদের বিকল্প সংস্কৃতি তাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারছি না। বিজেপি যখন তাদের প্রচারে ‘বেলাচাও’ গানের প্যারোডি করছে তখন আমরা টুম্পা সোনার পেছনে ধাবিত হচ্ছি।
আচমকা একদিন বামপন্থীরা যদি মনে করে লুঙ্গি ডান্স, উরি বাবা দিয়ে প্রতিক্রীয়াশীল শক্তির সঙ্গে তরল সাংস্কৃতিক (কেউ বলছেন সাব-অল্টার্ন) প্রতিযোগিতায় জয়ী হবেন তাহলে শুধু তারা ভুলই করছে না, এক ভয়ঙ্কর অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সারল্য আর তারল্য এক জিনিস নয়। পার্টি কনফারেন্সে নিজের গোষ্ঠীর সংখ্যার আধিক্য রাখতে গিয়ে হয়ত একদল প্রশ্নহীন আনুগত্য প্রদর্শনকারী দলদাস তৈরির করা যায়, কিন্তু তাতে বামপন্থার ভবিষ্যতই দুর্বল হয়ে পড়ে। কিছু পছন্দের লোক জনকে দিয়ে বড় মিটিং-এর আগে গান গাওয়ানো বা আবৃত্তি করানো কোন প্রগতিশীল সংস্কৃতির ভিত্তিভূমি রচনা করে না। আসল কাজটা অনেক কঠিন এবং ধারাবাহিকতা প্রত্যাশা করে।
১৮৯০ সালে রাশিয়ার বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে অন্যতম হাতিয়ার ছিল বিপ্লবী গণসঙ্গীত। পোলিশ সোশ্যালিস্টদের বিপ্লবী গান ভার্সাভিয়াঙ্কা’ (১৮৭৯ সালে রচিত) রুশ বিপ্লবের পর অন্যতম গান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
‘যত সাম্রাজ্যের শিরের মুকুট
ধূলি তলে হবে আজ অবনত
বিশ্বের অধিকারী শ্রমজীবী সন্তান
মানুষের মুক্তির দিন আগত
(অনুবাদ, হেমাঙ্গ বিশ্বাস)
কাজেই সত্যিকারের বাম রাজনৈতিক চর্চা, সাংস্কৃতিক চর্চাকে বাদ দিয়ে হতে পারে না। আমাদের দেশে এই চর্চায় ভিত্তিভূমি নির্মাণ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীরা। তাদের শ্রেণী অবস্থান মাঝেমাঝেই বদল হয়। নিজেদের রাজ্যেই আমরা দেখলাম যাদের গান শুনে, কবিতা পড়ে যৌবনকালের ভোর বেলায় শিহরিত হয়েছি তারাই আজ যত্রতত্র মলমূত্রের মতো ছড়িয়ে থাকা অনুপ্রেরণার ভারে ন্যুব্জ হয়ে গেলেন। বন্ধক রাখলেন তাদের কলম, মেধা, চেতনা, শাসকের কাছে। সাংস্কৃতিক আন্দোলনে আমাদের সত্যিকারের বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের সামনে নিয়ে আসতে হবে।
১৯৪২ সালে মাও সে তুং ইয়েনানে তার প্রদত্ত ভাষণে বলেছিলেন, “সামরিক ফ্রন্ট ও সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট যৌথভাবে শত্রুর সঙ্গে লড়াই চালাবে। বিপ্লবী শিল্পী, সাহিত্যিকদের কর্তব্য অত্যাচারী শাসকের নির্দয়, নিষ্ঠুরতাকে জনতার সামনে উন্মোচন করা, জনগণকে উৎসাহ দেওয়া। জনগণের শিল্প সাহিত্য করতে গেলে জনগণের ভাষা বুঝতে হবে। নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাবের পরিবর্তন করেনি এমন বুদ্ধিজীবীরা, শ্রমিক-কৃষকদের চেয়ে মোটেই পরিচ্ছন্ন নয়। আরও অনুভব করলাম শ্রমিক, কৃষকদের হাত যদিও মাটি মাখা এবং তাদের পা যদিও গোবর মাখা, তবুও চূড়ান্ত বিশ্লেষণে তারাই সবচাইতে পরিচ্ছন্ন মানুষ। তারা সত্য সত্যই বুর্জোয়া, পাতি-বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের চেয়ে বেশী পরিচ্ছন্ন। অনুভূতির পরিবর্তন বলতে বোঝায় এক শ্রেণী থেকে অন্য শ্রেণীর পরিবর্তন। আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিকরা যারা বুদ্ধিজীবীদের মধ্য থেকে এসেছেন, তাদের শিল্প-সাহিত্যকে যদি সত্যিকারের জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে হয়, তবে তাদের চিন্তাধারায় অনুভূতির পরিবর্তন ঘটাতে হবে।”
ইয়েনানে মাওয়ের এই ভাষণের গুরুত্ব ইতিহাসে অপরিসীম। আমাদের খুঁজতে হবে সেই শিল্প, সাহিত্য যারা শেষ বিচারে মেহনতি জনগণের আন্দোলনের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাংস্কৃতিক ও সামরিক ফ্রন্ট হিসেবে কাজ করবে। আর এর ভিত্তিতেই নির্মিত হবে আন্দোলনের নতুন রূপরেখা।
আজ পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের ফলে বাম শূন্য হওয়ায় একদল বলছেন, জনতা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে তাই তাদের নিয়ে ভাবার দায়িত্ব আমাদের নয়। আরেক দল বামপন্থাকে সমাজসেবী সংগঠন বানিয়ে খানিকটা পাপস্খলন করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ধারণা এই শূন্যতা প্রকৃত বামপন্থীদের দায়িত্ব আরও বাড়িয়ে দেয়। কেন জনতার স্লোগান জনতার দরবারেই প্রত্যাখ্যাত হলো তার কারণ বিশ্লেষণ করেই শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। কাজটা রাতারাতি হবে না। ধৈর্য ধরে মানুষের কাছে পৌছাতে হবে। আর এই পৌঁছানোর কাজে গণসাংস্কৃতিক আন্দোলনের কোন বিকল্প আছে কি?
মিডিয়া বামপন্থীদের হয়ে কথা বলবে না। কর্পোরেট পুঁজি বামপন্থার বিলোপ চাইবে। এই সব তো জানা কথা। এই অজুহাত দিয়ে দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। গোটা দেশ বিক্রি করে দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী আর সেই দেশের ৯০ কোটি গরিব মানুষ সেটা মেনে নেবেন, তা হতে পারে না। তাই তাদের মূল দাবি দাওয়াকে হাতিয়ার করেই এগিয়ে চলার প্রত্যয় নিতে হবে।
এক ভয়ঙ্কর অন্ধকার সময়ের সাক্ষী হলাম আমরা। মারামারি কেড়ে নিলো অসংখ্য প্রাণ। লকডাউনে কাজ-হারা শ্রমিক উদ্বাস্তু হয়ে রেললাইনে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল চিরনিদ্রায়। বলা ভালো রাষ্ট্রের হাতে খুন হতে হলো তাদের। তবুও রাত জেগে কৃষকরা ঝড়-বৃষ্টি, গরম, মহামারিকে উপেক্ষা করে লড়াই জারি রেখেছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। কাজ হারানো শ্রমিকদের মুষ্টিবদ্ধ হাতগুলো ক্রমাগত এক জায়গায় হচ্ছে। এক ভয়ঙ্কর বিদ্রোহের অশনি-সংকেত টের পাচ্ছে রাষ্ট্রও।
অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলোকে খুঁজে নেওয়ার দায়িত্ব তাই বামপন্থীদেরই নিতে হবে। আর সংস্কৃতি হবে সেই অন্বেষণের বিশ্বাসযোগ্য হাতিয়ার। একটি নির্বাচনে একটি পার্টির পরাজয়, একটি রাজনৈতিক মতাদর্শের পরাজয় হতে পারে না। তাই ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারীরা নয়, নব্য ইতিহাস নির্মাণের কারিগর হবে শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি জনগণ। শাণিত বামপন্থী সংস্কৃতির দায়িত্ব হবে সেই নির্মাণ কাজকে তরান্বিত করা।
‘যদি তাই হয়, তবে
দেশের লক্ষ কোটি মানুষের জন্য এসো,
এসো আমরা দেশদ্রোহী হই।
“দ্য আদার ডে’ ভাষান্তর, অশোক চট্টোপাধ্যায়।

[লেখক – কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর। বর্তমানে রাজ্য সরকারের টাউন প্রজেক্ট অফিসার পদে কর্মরত। কবিতা, ছবি আঁকা, চলচ্চিত্র এবং পর্বতারোহন তাঁর প্যাশন।]

Facebook Comments

Leave a Reply